উপন্যাস
গল্প

স্পেসশিপ, মিনিবাস ও ঝন্টুমামা

স্পেসশিপ, মিনিবাস ও ঝন্টুমামা

রবিবারের সকালগুলোয় পার্ক স্ট্রিট অঞ্চলের একটা বাড়তি আকর্ষণ থাকে। দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন ও অদ্ভুত সব জিনিসপত্রের তল্লাশে অনেকেই এ সময়টায় বিভিন্ন নিলামঘরে হানা দেয়। এটা একটা নেশার মতো। পকেটে টাকা না থাকলেও ক্ষতি নেই। নিছক দর্শক হিসেবে নিলয়ও এসেছিল। প্রায়ই আসে। সেরকম কিছু চোখে পড়লে ফিরে গিয়ে ঝন্টুমামাকে খবর দেয়।

তা বলে রাসেল এক্সচেঞ্জে ভূত দেখবে–এটা নিশ্চয় সে কল্পনা করতে পারেনি। আক্ষরিক অর্থেই ভূত। পৃথিবীর যাবতীয় প্রথম সারির সংবাদপত্রে যার মৃত্যুসংবাদ মোটা মোটা হরফে ছাপা হয়েছে, সেই জেনারেল তরফদারকে স্বচক্ষে দেখল নিলয়। জেনারেল তাঁর বিখ্যাত গোঁফ-দাড়ি কমিয়ে ফেলেছেন, চুল ব্লিচ করেছেন, কিন্তু নিলয়কে ফাঁকি দিতে পারেননি। ডান হাতের অনামিকা তাঁকে ধরিয়ে দিয়েছে। সৈনিক জীবনের প্রথম অধ্যায়েই এই আঙুলের দুটি পর্ব খুইয়েছিলেন তিনি।

নিলয় ভূত দেখে অবাক হয়েছিল আর নিলয়ের চোখে চোখ পড়ার পর ভূত আতঙ্কিত। নিলয়কে কাছে ঘেঁষার সুযোগ দেয়নি তরফদার। কোনও এক প্রাইভেট দরজা ব্যবহার করে উধাও হয়ে গেছেন।

ঝন্টুমামার বাড়ি। নিলয় যত উত্তেজিত হয়ে উঠেছে, তার সঙ্গে সংগতি বজায় রাখতে ব্যস্ত অনুপাতে নিরাসক্ত হয়ে পড়ছে ঝন্টুমামা।

প্লিজ ঝন্টুমামা, তুমি বইটা একটু নামাও মুখের সামনে থেকে। তুমি কি এখনও কিছু বুঝতে পারছ না! স্পেসশিপ ম্যাগেলান-এর পরিচালনার ভার জেনারেল তরফদারের ওপর দেওয়া হয়নি। তরফদারের নামটাই শুধু ব্যবহার করা হয়েছিল। আর তাই ম্যাগেলান ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পরে তরফদারকে এখন ভূত হয়ে গা-ঢাকা দিতে হয়েছে।

ঝন্টুমামা বইটা বন্ধ করে, হাফ-চশমার ওপর দিয়ে তাকাল, সরকারি অফিসে চাকরি করার এই একটা সুবিধে। তাই না?

আবার হেঁয়ালি!

মোটেই না। তুইই তো বলেছিলি যে, কে যেন সরকারি পয়সায় ছুটির দিনে বেড়াতে যাওয়ার নাম করে ভাঁওতা দিয়েছিল। ফল্স সার্টিফিকেট দাখিল করেছিল। তারপরে বাসটা যখন খাদে পড়ে গেল, জলজ্যান্ত মানুষটা দেখল, তার নাম উঠে গেছে ডেথ লিস্টে। বলিসনি?

হ্যাঁ, হয়েছিল তো। ডক্টর ব্যানার্জি। কিন্তু তার সঙ্গে…।

গভীর সম্পর্ক। তরফদার সম্বন্ধে তোর অসাধারণ হাইপথেসিসটার আইডিয়া তুই সরাসরি ওই…।

দ্যাখো ঝন্টুমামা, এ সমস্ত উলটোপালটা যুক্তিতর্ক শুনতে চাই না। এই ঘরে বসেই তুমি একদিন জেনারেল তরফদারের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলে।

নির্ঘাত।

আমার একটাই প্রশ্ন, তুমি কি জানতে যে, তরফদার বেঁচে আছে? ম্যাগেলান-এর ওই অভিশপ্ত সফরের সময়ে সে রকেটের কমান্ডারের পদে নিযুক্ত ছিল না?

তুই দুটো প্রশ্ন করেছিস। যা-ই হোক, তোর কাছে যেটা বিশেষ জরুরি, সেটাই বলি। না, তরফদার বেঁচে আছে–এটা আমি জানতুম না। সত্যি বলতে, এমন কোনও চিন্তা আমার মাথাতেও আসেনি একবারের জন্যেও।

নিলয় আরও উত্তেজিত হয়ে ওঠে, কিন্তু মাথাতে আসার পরেও–ঢুকিয়ে দেওয়ার পরেও তো কোনও লাভ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। তোমার মধ্যে যদি এতটুকু মনুষ্যত্ব থাকত তাহলে এরকম নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে থাকতে পারতে না। দু-শো পঁচাত্তরটা মানুষ প্রাণ হারিয়েছে মহাশূন্যে। ম্যাগেলান চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে গেছে মঙ্গল গ্রহের দিকে যাত্রা শুরু করার দু-দিনের মধ্যে। তরফদারের নাম ভাঙিয়ে কার হাতে ওই রকেট পরিচালনার ভার তুলে দেওয়া হয়েছিল? সে কি তার উপযুক্ত? তারই ত্রুটি ওই দুর্ঘটনার কারণ কি না, কে বলবে? সবচেয়ে বড় কথা, ম্যাগেলান রকেট সার্ভিস সংস্থা ও তরফদার–এদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ তো আনা যাবেই।

নিশ্চয়। একশোবার। এবং এই মুহূর্তে আমরা স্পেস ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির হাতে তোর এই থিয়োরি তুলে দিই, বাকি জীবনটা ঠ্যাঙের পরে ঠ্যাং চড়িয়ে চৰ্য্যচোষ্য খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিতে পারব। ওই দু-শো পঁচাত্তরজন মানুষের জীবনবিমা দিতে গিয়ে কোম্পানির নাভিশ্বাস উঠে গেছে।

আবার তুমি মূল জায়গাটা থেকে সরে যাচ্ছ।

কীরকম?

তোমার কি এখনই ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের সাহায্য নেওয়া উচিত নয়? যাতে তরফদার পালাতে না পারে। ওই দলের অনেকেই তো তোমাকে খুব খাতির করে।

অসম্ভব। তার অনুমান যদি ঠিক হয়, তাহলে এটা একটা ব্লান্ডার হবে। তরফদার বেঁচে আছে, জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফল কি তুই জানিস? তরফদার ধরা পড়বে না, তার আগেই খুন হয়ে যাবে। ওই ম্যাগেলান কোম্পানির ভাড়াটে মাফিয়ারাই ওকে লোপাট করে দেবে।

তাহলে কি তুমি হাত গুটিয়েই বসে থাকবে এখন?

অন্তত আজকের দিনটা তো বটেই।

কেন?

আজ ন্যাশনাল লাইব্রেরির সংবাদপত্র বিভাগ কার্যত অচল।

 মাগেলান-এর বিষয়ে খবরগুলো দেখতে চাও, এই তো? তার জন্যে ন্যাশনাল লাইব্রেরির দরকার নেই। সুজয়ের বাড়ি গেলেই হবে। মহাকাশ অভিযান নামে ওর বইটা বেস্টসেলার লিস্টে ওঠার পর থেকে ও কিছু মিস করে না। খবরের কাগজের কাটিং-এর ফাইল দিন দিন ফুলে উঠেছে। পরিমার্জিত ও পরিবর্ধিত সংস্করণের জন্য তথ্য সংগ্রহ করে যাচ্ছে।

ঘড়ির দিকে তাকাল ঝন্টুমামা। তারপরেই এই প্রথম তাকে উত্তেজিত হতে দেখা গেল, শিগগির চল!

ট্যাক্সি! ঝন্টুমামার ডাক শুনে ঘাবড়ে গেল নিলয়। নিজের পয়সায় ট্যাক্সি চড়বে ঝন্টুমামা?

সুজয়ের মা দরজা খুলে দিলেন।

একটু অসময়ে এসেছি মাসিমা। ঝন্টুমামা কবুল করলেন।

 অসময় কী বাবা, ঠিক সময়েই এসেছ। রবিবার আমরা একটু দেরিতেই খেতে বসি। এসো এসো, আজ অনেকদিন বাদে সরষেবাটা দিয়ে ইলিশ করেছি। না বললে শুনব না।

ট্যাক্সি ধরার রহস্যটা পরিষ্কার হয়ে গেল। খাওয়ার পরে খুব বেশি হলে মিনিট পনেরো সুজয়ের কাটিং ফাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করেছে ঝন্টুমামা। ওই পরিমাণে ক্যালোরি আত্মস্থ করার পর প্রাকৃতিক নিয়মেই ঝিম ধরেছে। হাত থেকে ফাইলটা বেশ কয়েকবার খসে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

সুজয় চোখ টিপে থামিয়ে না দিলে হয়তো মুখ ফসকে কিছু বলেই ফেলত নিলয়। অবশ্য ঝন্টুমামার চেষ্টার কসুর নেই। ঘুমে শরীর অবশ হয়ে এলেই নড়েচড়ে উঠে বসছে, আর শিশুর মতো এক একটা প্রশ্ন করছে, হ্যাঁ রে, ম্যাগেলান বিশাল একটা রকেট, তা-ই না?

সুজয়ের অসীম ধৈর্য। কোনও বিরক্তি নেই। হ্যাঁ, ঝন্টুমামা। ম্যাগেলান ওয়ান, টু, থ্রি তিনটেই সাতশো করে যাত্রী বহন করতে পারে। বৃহত্তম মহাকাশযান।

ওয়ান, টু, থ্রি–সব ক-টাই কি দেখতে একরকম নাকি?

একই মডেলের রকেট!

এর মধ্যে কোনটা ধ্বংস হয়েছিল রে?

 ম্যাগেলান থ্রি।

 হঠাৎ উঠে বসল ঝন্টুমামা, চল নিলয়, বাড়ি যাই। সুজয় তোর এই একটা কাগজ শুধু ধার নিচ্ছি। অভিশপ্ত ম্যাগেলান-এর যাত্রীতালিকা।

বাড়ি ফেরার পথে ঝন্টুমামা যে ট্যাক্সি নেবে না, জানাই ছিল। মিনিবাসে আসন গ্রহণ করেই চোখ বুজেছে। পাঁচ মিনিটের পথ পেরোতে কুড়ি মিনিট লেগে গেল। একটু জোরে জোরেই স্বগতোক্তি করেছিল নিলয়, এই এক যন্ত্রণা। ছুটির দিন যেই বাস ফাঁকা হল, অমনি সে আর নড়তে চাইবে না।

কী বললি? ঝন্টুমামা যেন দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে উঠে বসল।

 বললাম, ফাঁকা বাসে চড়ার আনন্দ পুষিয়ে দিতে হচ্ছে। বাস ভরতি না হলে তার চাকা গড়ায় না।

নিলয়ের পিঠের ওপর একটা অভিনন্দনমূলক থাপ্পড় কষিয়ে ঝন্টুমামা বলল, তুই একেবারে সমস্যার শিকড়ে পৌঁছে গেছিস।

বলেই নিলয়কে এক ঠেলা, শিগগির নেমে পড় এখানে। সুজয়ের বাড়ি থেকে আর একটা তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। এক্ষুনি।

মানিব্যাগ খুলে একশো টাকার একটা নোট বাড়িয়ে দিয়ে ঝন্টুমামা বলল, এক মিনিটও দেরি নয়। ট্যাক্সি নিবি, যাবি আর আসবি। ওঠ, ওঠ–

কী বিপদ! কাজটা কী, সেটাই তো এখনও বলোনি।

ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ঠিকানা। যে কোম্পানির কাছে মাগেলান-এর যাত্রীরা মহাকাশ সফরের আগে জীবনবিমা করিয়েছিল। একটাই কোম্পানি।

মিনিট চল্লিশের মধ্যে ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির নামধাম সংগ্রহ করে ফিরে এল নিলয়। ঝন্টুমামা কাগজের টুকরোটা, বলতে গেলে, ছিনিয়ে নিয়েছে তার হাত থেকে। এ কী! ফোন নাম্বার নেই?

সেটা তো ডাইরেক্টরি থেকেও বার করা যাবে। কিন্তু আজ তো রবিবার। সেটা কি খেয়াল আছে!

এই প্রথম ঝন্টুমামাকে হার স্বীকার করতে দেখল নিলয়। চোখে-মুখে গম্ভীর হতাশা।

নিলয় সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করে, আর তো কয়েক ঘণ্টা, কাল সকালে দশটা বাজলেই ফোন করতে পারবে। আর তারপরেই জেনারেল তরফদার তথা ম্যাগেলান রহস্যের সমাধান। তা-ই না?

ঠিক তা-ই।

সব বুঝে ফেলেছে?

 হ্যাঁ। আর তার পেছনে তোরই সবচেয়ে বড় অবদান।

কীরকম?

 তোর ওই মিনিবাস-সম্পৰ্কীয় মন্তব্য। মিনিবাসে যতক্ষণ না প্যাসেঞ্জার ঠাসা হয়, সে কি নড়তে চায়? চায় না। ঠিক এইটাই ঘটেছিল ম্যাগেলান থ্রি-র ক্ষেত্রে! সাতশোর বেশি যাত্রীবাহী মহাকাশতরি মাত্র দু-শো পঁচাত্তরজনকে নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল। কারেক্ট? আমার আর-একটাই প্রশ্ন, ওই দু-শো পঁচাত্তরজন যাত্রী নিয়ে মঙ্গল গ্রহে পৌঁছোনো ও আবার পৃথিবীতে ফিরে আসার মতো বিপুল ক্ষতি কীভাবে এড়ানো সম্ভব? বল দেখি। একটাই উপায়–পৃথিবী ছেড়ে রওনা হওয়ার পরেই রকেটটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। মানে, রকেটটা ধ্বংস হয়ে গেছে বলে ঘোষণা করা।

কী বলতে চাও তুমি? ম্যাগেলান-এর আসন অর্ধেকেরও বেশি ফাঁকা ছিল বলে যাত্রাটা ইচ্ছে করে বানচাল করে দেওয়া হয়েছিল?

হ্যাঁ। ওই দু-শো পঁচাত্তরজন যাত্রীকে মহাশূন্যের কোনও এক অজানা স্থানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে, জেনারেল তরফদার ম্যাগেলান থ্রি-কে নিয়ে আবার ফিরে এসেছে। ম্যাগেলান থ্রি-র সঙ্গে ওয়ান এবং টু-র কোনও আকৃতিগত তফাত নেই। তাই ওই রকেটটাও আবার ব্যবহার করা যাবে।

এ তো সবই অনুমান। প্রমাণ করবে কী করে?

তার দায়িত্ব ওই ইনশিয়োরেন্স কোম্পানির ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। ম্যাগেলান সংস্থায় কারচুপির জন্য দু-শো পঁচাত্তরটি মানুষ প্রাণ হারালেও কিছু হত না। মানে ম্যাগেলানকে নিয়ে কেউ টানাটানি করত না। কিন্তু বিপুল অর্থ ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছে বিমা কোম্পানিকে। ব্যাবসার দিক থেকে তারাও ম্যাগেলান-এর চেয়ে কম শক্তিশালী নয়। এবার ম্যাগেলান বনাম ইনশিয়োরেন্স শুরু করুক তাদের লড়াই। এই বিশেষ ক্ষেত্রে আমার নৈতিক দায়িত্ব, ইনশিয়োরেন্স কোম্পানিকেই যাবতীয় তথ্য সরবরাহ করা।

[কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, পূজাবার্ষিকী ১৯৯২]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *