[চাপ দিলেন ঝন্টুমামা]
ঝন্টুমামার প্রাচীনপন্থই তাঁর পতনের কারণ হবে। পতন মানে অধঃপতন নয় অবশ্য। বিপত্তি। টাইম মেশিন কি রকেট ইত্যাদি যতই যা উদ্ভাবন করুন তিনি, শেষ অবধি ওই ক্যামেরাই ভরসা। ছবি তুলে যা রোজগার হয়, তাতেই কোনওরকমে দিন কাটে। তা আজকের দিনে ফ্রিলান্স ফোটোগ্রাফার যদি রঙিন ছবি তুলতে না চায়, তার দুর্দশার জন্য অন্যকে দায়ী করে লাভ নেই। যা-ও-বা তবু চলছিল, নতুন বাজেট একেবারে ধরাশায়ী করে ফেলেছে। ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট নেগেটিভ অবধি বাজার থেকে উধাও।
কয়েকদিন ধরেই আমি আর নিলয় ব্যাপারটা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছি। ঝন্টুমামার জীবনের সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর ঘটনাগুলোর সঙ্গে এইরকম পরিস্থিতির একটা যোগসাজশ আছে। এবারও কি…
ঝন্টুমামার মুখোমুখি হওয়ার পর মনটা বেজায় দমে গেল। বয়স বাড়ার জন্যে মানুষের অনেক দোষত্রুটি ক্ষমা করা যায়, কিন্তু তাই বলে আত্মসম্মানবোধও শিথিল হয়ে যাবে?
ঝন্টুমামা বলতেই পারতেন যে, নতুন স্বদেশি ইন্ডাস্ট্রি স্থাপনে মন দিয়েছেন। বিদেশ থেকে নেগেটিভ পেপার আর আসবে না বলে এখানেই তার কারখানা বসানোর স্কিম তৈরি করেছেন। কারখানা চালু হতে ক-বছর লাগবে, সে প্রশ্নটা মাথায় থাকলেও মুখে আনতাম না। জিজ্ঞেস করতাম না তত দিন কি ছবি তোলা বন্ধ।
ঝন্টুমামা বেরোচ্ছিলেন। কাঁধে ক্যামেরা ঝুলছে না যখন, এত তাড়া কীসের? জিজ্ঞেস করলাম।
সরি ব্রাদার। এখনই না বেরোলে বাসে উঠতে পারব না। সন্ধেবেলায় এসো।
যাচ্ছ কোথায়?
কলেজ স্ট্রিট। কয়েকটা বই কিনতে।
কী বই যে, কলেজ স্ট্রিট ছুটতে হবে?
আরে বাবা, শুধু বই কিনলেই তো হবে না! কমিশনটাও তো চাই। তা না হলে ভূতের বেগার খাটব কেন।
ক-টা বই, তার কমিশন থেকে কী-বা রোজগার হবে–এসব প্রশ্ন করার কোনও সুযোগ দেয়নি ঝন্টুমামা। একটা ছাতা-পড়া ক্যাম্বিসের র্যাশন-ব্যাগ হাতে নিয়ে প্রায় ছুট লাগিয়েছে।
চব্বিশ ঘণ্টা পরে ফের দেখা। ঝন্টুমামা সেই ক্যাম্বিস-কাম-র্যাশনের থলিটাকে পাকিয়ে বালিশ বানিয়ে তক্তপোশে সরলরেখা।
ঘুমোচ্ছিল না অবশ্য। পায়ের শব্দ পেয়ে চোখ খুলতেই জিজ্ঞেস করলাম, কী হল, একদিন কলেজ স্ট্রিট ছুটেই হাঁপিয়ে পড়লে?
উঠে বসল ঝন্টুমামা, হাঁপিয়ে পড়িনি, খাবি খাচ্ছি।
কেন? ব্যাবসা জমল না? কমিশনে পোষাচ্ছে না?
পোষাচ্ছে না কী রে! দারুণ মুনাফা। কলেজ স্ট্রিটে দশ টাকায় কিনে ভবানীপুরে পনেরো টাকা পেতে পারি। এক-একটা কপিতে!
যা! তোমার সব তাতেই বাড়াবাড়ি।
বাড়াবাড়ি! বেশ তো, আমায় দশ টাকা দামে সাপ্লাই কর-না একটা বই। দশ হাজার কপি কিনে নেব একসঙ্গে। ডাউন পেমেন্ট।
সে হয়তো একটা কোনও পাঠ্যপুস্তক, যা ছাপা নেই অথচ প্রচুর ডিম্যান্ড।
মোটেই না। ছাপা কপির অভাব নেই। পারবি দিতে?
বইটা কী শুনি?
না, সেটা এখুনি বলতে পারব না। সবেরই তো একটা ট্রেড সিক্রেট বলে ব্যাপার আছে। সবই যদি জেনে ফেলিস তাহলে আমি খাব কী? অনেকে জানে না এমন কিছু কিছু ব্যাপার যদি না থাকে, তাহলে তো বেঘোরে মারা পড়বে ব্যবসায়ীরা। এই ধর, কলেজ স্ট্রিট থেকে বই কিনলে দশ টাকা দামের বইয়ে যে পাঁচ টাকাও প্রফিট হতে পারে, এটা ক-জন জানে বল?
তোমার মোদ্দা কথাটা কী শুনি? একটু ঝেড়ে কাশবে।
নিশ্চয়! তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছি। তোর সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক পর্ষদের সেক্রেটারির কাছে যাব। কখন রেডি হব বল?
পিছিয়ে আসার উপায় ছিল না। স্পষ্ট মনে আছে, তরফদারের পদোন্নতির পর নিজেই একদিন গর্ব করে ঘোষণা করেছিলাম যে, আমরা টালিগঞ্জ সরকারি স্কুলের একদা সহপাঠী। বন্ধুত্বের সম্পর্ক এখনও অমলিন।
বললাম, তরফদারের সঙ্গে দেখা করার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট দরকার নেই। এখনই আমরা যেতে পারি। কিন্তু ব্যাপারটা কী? একটু জানিয়ে রাখতে পারলে ভালো হত।
অসম্ভব! আঁতকে উঠল ঝন্টুমামা, তাহলে আর তোকে বলছি কেন?
ঝন্টুমামাকে নিয়ে তরফদারের অফিসে এসে আগন্তুকের চিরকুট পাঠিয়ে দিলাম। মিনিট তিনেকের মধ্যেই বড়সাহেবের কামরার মধ্যে ঢাকার অধিকার পাওয়া গেছে। ঝন্টুমামাকে ইনট্রোডিউস করালাম। তরফদার চেয়ার ছেড়ে উঠে ঝুঁকে করমর্দন করল হাসিমুখে। ঝন্টুমামা ঠোঁট বেঁকিয়ে এপাশ-ওপাশ মাথা ঘুরিয়ে রীতিমতো আপত্তির স্বরে ও কর্কশ গলায় বলল, আমি নিভৃতে আপনাকে দু-চারটে প্রশ্ন করব বলেই কিন্তু একে সঙ্গে এনেছি।
তরফদারকে কিছু বলতে হয়নি। ভদ্রলোকরাই এসব স্থানে প্রবেশের অধিকার পায়। অফিসঘরে পাঁচজন অতিথি ছিলেন। সকলেই মুখে হাসি ফুটিয়ে আচ্ছা স্যার, পরে কথা হবে এইরকম একটা ভঙ্গি নিয়ে ঘর জুড়ে বেরিয়ে গেল।
রুমাল টেনে ঘাম মুছছি, ঝন্টুমামা বলল, ব্যস্ত লোক আপনি। পাঁচ মিনিটও নষ্ট করব না। ক্লাস সিক্সের পাটিগণিত। আর কয়েকটা প্রশ্ন।
বলুন, বলুন। আপনাদের প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্যই তো রেখেছে আমাদের। তরফদারের মুখে প্রশ্রয়ের হাসি।
আপনাদের প্রথমেই অভিনন্দন জানাই বিনামূল্যে ছাত্রদের জন্য এইরকম পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য।
তরফদার কিছু বলতে যাচ্ছিল। ঝন্টুমামা বাধা দিল।
বলল, কিন্তু আপনি কি জানেন, শূন্য দামের বই এখন যথেচ্ছ দামে বিক্রি হচ্ছে? ঝন্টুমামা পকেট থেকে ময়লা হলদে কাগজের মলাট-দেওয়া একটা বই টেনে বার করল।
তরফদার চেয়ারে ঠেস দিয়েছে। মুখে আর হাসি নেই।
ঝন্টুমামা নির্দয়, ওহ, ত,হলে আপনি জানেন! সেই জন্যই হাত বাড়ালেন না…
দেখুন, আমাদের এ জন্য দায়ী করে লাভ নেই। স্কুল থেকে বিতরণ করার জন্যই ক্লাস সিক্সের গণিত ছাপা হয়েছে। এখন স্কুল যদি…
আপনি বলতে চান, বইগুলো ছাত্রদের না দিয়ে স্কুলই কলেজ স্ট্রিটের দোকানদের কাছে বেচে দিচ্ছে? আবার সেখান থেকে…
এগজ্যাক্টলি!
ঝন্টুমামা উঠে দাঁড়াল, চলে আয়! সব জেনে-শুনে কেউ যদি, নাহ্, আলোচনার পথ দিয়ে আর যাওয়ার উপায় নেই…
তরফদার রীতিমতো ক্ষিপ্ত। চেয়ার ছেড়ে উঠে বলল, শাসাচ্ছেন নাকি? তা ভালো। কিন্তু এবার কোন পথে যাবেন, জানতে পারি?
সার্টেনলি! আমি এবার চাপ দেব!
এই ঘটনার পর মাস দুয়েক ঝন্টুমামা নিখোঁজ। তার চেয়েও দুর্ভাবনার কথা, উনি ঘুরে ঘুরে ধার করে বেড়াচ্ছেন। পাঁচ-দশ টাকা নয়, দু-শো-পাঁচশো করে। চেনাশোনা বেশ কয়েকজনের মুখে শুনেছি। কী ব্যাপার তা-ও বলতে রাজি হননি, পারলে দাও, কৈফিয়ত দিতে পারব না।
সবার কাছে চাইছে, আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে কেন?
সশরীরে উত্তর নিয়ে ঝন্টুমামাই এসেছেন, বুঝলি, ব্যাবসাটা লেগে গেল। অর্ডারটা ধরে ফেলেছি।
বেশি খোঁচাতে হয়নি। পার্টনারশিপে ছাপাখানা খুলেছে। ক্লাস সিক্সের গণিত বইয়ের চল্লিশ হাজার কপির অর্ডারও বাগিয়েছে।
তরফদার এরপরেও দিল তোমায় অর্ডার?
হু! জানবে কী করে, আমি আছি? আর তা ছাড়া অর্ডার পাইয়ে দেওয়ার ক্ষমতা ওর নেই।
তাহলে, পেলে কী করে অর্ডার?
লোয়েস্ট কোটেশন। সব চেয়ে কম রেট দিয়ে।
তার মানে লোকসান করে অর্ডার ধরেছ? দ্যাখো, তুমি যা-ই করো, কিছু বলার নেই। কিন্তু দ্বিতীয়বার কখনও তরফদারের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য বায়না ধোরো না।
বেজায় অপ্রস্তুত হয়ে উঠে দাঁড়াল ঝন্টুমামা, ঠিক ঠিক, তা কক্ষনো করব না। তবে, তরফদার সাহেব আমার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে আবার তুই যেন বাধা দিস না।
জানি, ঝন্টুমামার কোনও কথাই চালবাজি বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তা বলে ভাবিনি যে, মাস দেড়েকের মধ্যেই তরফদার স্বয়ং হাজির হবে আমার ফ্ল্যাটে। ঝন্টুমামার ভবিষ্যদ্বাণী তো মনেই ছিল, তার সঙ্গে তরফদারের এই চেহারা! রীতিমতো বুক দুরদুর করছে।
প্লিজ এখুনি একবার তোমার ঝন্টুমামার কাছে নিয়ে চলো। সর্বনাশ হয়ে গেছে।
গাড়িতে চড়ে যেতে যেতেই কাটা-কাটা বাক্যে বারবার হাহাকার করছে তরফদার। তবে চাকরি যাবে, সেটাও এখন এমন কিছু নয়। হয়তো সরকারের গদি নিয়েই টানাটানি হয়ে যাবে। ঝন্টুমামার ছাপাখানা থেকে বইয়ের বদলে শুধু সাদা কাগজ বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে অথচ পুরো পেমেন্টটাই পেয়ে গেছে তারা। কোম্পানিও ইতিমধ্যে সাইনবোর্ড খুলে উধাও।
ঝন্টুমামা তীব্র প্রতিবাদ জানাল, সাদা কাগজ বাঁধিয়ে দিলাম, আর আপনার লোকেরা অমনি অমনি পেমেন্ট করে দিল? অতই সস্তা? এখন কি বিলের টাকার ফাইভ পারসেন্ট আপনার দপ্তরের লোকেরা মিষ্টি খাবে বলে কেটে রেখেছে, সেটা জানেন?
তরফদার সরাসরি ঝন্টুমামার হাত ধরে ফেলল, আমি জানি, আপনি যা বলছেন, সব সত্যি। এমনকী আমি নিজে দেখেছি ছাপা বই। সুন্দর ঝরঝরে হরফে ছাপা। বিশ্বাস করুন, বিশাল চক্রান্ত। আজ এই অদ্ভুত খবর পাওয়ার পর টেবিলের ওপর থেকে বইটা তুলে দেখি–পুরো ফরসা। একটি হরফ নেই। শুধু রবার স্ট্যাম্পের ছাপটা রয়েছে– কমপ্লিমেন্টারি কপি।
তা আমাকে কী করতে বলছেন?
আমাদের বাঁচান। কাল থেকে বইয়ের বিতরণ শুরু হওয়ার কথা…
উঁহু, কালই একটা স্কুল বই নিয়েছে। এবং তারা বই দেখেই নিয়েছে। কিন্তু আজ যখন বই খুলবে, দেখবে সব ফরসা!
বলছে কী ঝন্টুমামা! স্পষ্ট স্বীকার করে নিচ্ছে যে, একটা কিছু কেলেঙ্কারি সে নিজেই বাধিয়েছে।
এর কি এ থেকেই বুঝতে পারছেন না!–তরফদার কাঁদো-কাঁদো।
কেন বুঝব না? ছাত্রদের কোনও ক্ষতি নেই। বিনি পয়সার বই কুড়ি-পঁচিশ টাকায় কিনত, এবার কিনবে না। কিন্তু…।
অনেক বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি করা হল ঝন্টুমামাকে। তার আগে তরফদারকে কথা দিতে হয়েছে, ছাত্ররা ঠিকমতো বই পাবে।
ঝন্টুমামা বলল, অসুবিধার কিছু নেই। ফার্স্ট লটের মাত্র পাঁচশো বই ভ্যানিশিং ইঙ্ক দিয়ে ছেপে ও বাঁধিয়ে সরবরাহ করা হয়েছে। পেমেন্টও শুধু ওই পাঁচশো কপির নিয়েছি। ভুল বললাম, তার থেকে পাঁচ পারসেন্ট বেআইনিভাবে কাটা গেছে! যা-ই হোক, বাকি কাগজ-সরকারি কাগজ, নিরাপদেই আছে। আপনি অর্ডার দিলেই ছাপতে শুরু করবে। তবে ওই রেটে তো আর হবে না। গত বছরের রেট অ্যাপ্রুভ করে দিন এখুনি।
ঝন্টুমামার কাছ থেকে প্রেসের ঠিকানা নিয়ে তরফদার বিদায় নিয়েছে। কঠিন সমালোচনার সুরে আমি বললাম, ওই পাঁচশো কপি সাদা বইয়ের জন্য দাম নেওয়াটা কি তোমার ঠিক হল? এটাও তো সরকারকে ঠকানো।
বলিস কী? আমার তো সত্যিই ছাপতে খরচ হয়েছে, না কী? শুধু তা-ই নয়, বরং বেশি খরচ হয়েছে। যে-সে কালি দিয়ে তো আর ওই কম্ম হবে না। ফর্মুলা থার্টি সেভেন। পেমেন্ট নিচ্ছি। আর সবচেয়ে বড় হল চাপ–বা এক্ষেত্রে ছাপ ফেলার জন্য কিছু তো বাড়তি খরচা লাগবেই। কিন্তু উপকারিতার কথাটাও তো বিচার করতে হবে!
[কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান, পূজাবার্ষিকী ১৯৯১]