হীরক-রহস্য – ৬

ছয়

ঝটপট কাছের মেট্রো স্টেশনে গিয়ে ট্রেইনে উঠল ছেলে-মেয়েরা।

‘কোথায় যাচ্ছি আমরা ঠিক জানো তো?’ ডানা জানতে চাইল।

‘অবশ্যই। লাইব্রেরি অভ কংগ্রেসে, ওটা ক্যাপিটল বিল্ডিঙের কাছে। ক্যাপিটল লেখা স্টপে নামব আমরা।’

একটু পরেই ওরা পৌঁছে গেল বিশাল ভবনটার সামনে। মর্মরের সিঁড়ির কাছে প্রকাণ্ড এক ফোয়ারা। লম্বা দাড়িওয়ালা এক তামার মূর্তির ওপর ঝরঝর করে ঝরে পড়ছে পানি।

‘লোকটা কে?’ ডানা শুধাল।

মূর্তির সামনে লাগানো একটা সাইন পড়ল কিশোর

‘নেপচুন, রোমানদের সাগরদেবতা,’ জানাল। ‘ডানা, গোমেজ বলেছিলেন না স্পাইডার মাংকি জিনিসপত্র চুরি করে ডক্টর? একটা আইডিয়া এসেছে আমার মাথায়। আচ্ছা, কেউ দামি কিছু চুরি করে ড্রিল করা ওই গর্তটার ভেতরে লুকোয়নি তো?’

‘তারপর অন্য একজন-যে ওয়াশিংটনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে-গর্ত থেকে ওটা বের করে নেয়?’ ডানা বলল।

মাথা ঝাঁকাল কিশোর।

‘হয়তো সেই অন্যজনই ডাম।’

সিঁড়ি ভাঙতে লাগল ওরা। খানিক পরে উঠে এল গ্রেট হল- এ। উঁচু, গম্বুজাকৃতি ছাদটা রঙবেরঙের কাঁচ দিয়ে তৈরি। ব্যাকপ্যাকে উঁকি দিল কিশোর। হ্যাঁ, ওয়াশিংটন নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে।

গম্বুজ ভেদ করে আলো এসে পড়েছে ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম আর দেয়ালচিত্রগুলোর ওপরে। অল্প কিছু মানুষ হেঁটে বেড়াচ্ছে। গুহার মত কামরাটিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে তাদের পদশব্দ।

‘জায়গাটা দারুণ!’ ফিসফিস করে বলল ডানা। ওর গলা শুনে মনে হলো কোন গুহার ভেতর কথা বলছে বুঝি।

‘এটা পৃথিবীর সবচাইতে বড় লাইব্রেরি, বলল কিশোর। ‘ওই যে, ইনফর্মেশন ডেস্ক। এসো।’

ডেস্কের পেছনে বসা লম্বা মহিলাটির মাথায় ছোট, সাদা চুল, অনেকটা ক্রু কাটের মত। ল্যাপেলে লাল এক গোলাপ নিয়ে কালো সুট পরনে তাঁর। ডেস্কে নেম প্লেট: মিসেস হ্যান।

‘বলো, কী করতে পারি তোমাদের জন্যে?’

‘কিশোর আর ডানাকে উদ্দেশ্য করে বললেন।

‘আমরা ওয়াশিংটন মনুমেন্টের স্মৃতিপাথরগুলো নিয়ে পড়াশোনা করছি,’ জানাল কিশোর। ‘মনুমেন্টের দেয়ালে কখন ওগুলো বসানো হয় সে বিষয়ে কি কোন বই আছে?’

‘আছে তো,’ বললেন মিসেস হ্যান। ‘এক মিনিট।’ কম্পিউটারে কটা কমাণ্ড টাইপ করলেন।

ওরা অপেক্ষা করছে, কিশোর ডেস্কের কাছে এক পোস্টে ছোট্ট এক সাইন পড়ল। ভবনটির ইতিহাস দেয়া ওখানে, ১৮১৭ সালে তৈরি হওয়া পাঠাগারটিতে এক কোটি সত্তর লক্ষের বেশি বই রয়েছে।

‘একটু বসো, মিস্টার ম্যাডক তোমাদের জন্যে একটা বই নিয়ে আসবেন,’ বললেন মিসেস হ্যান। এক সার ডেস্ক আর চেয়ার দেখালেন আঙুল ইশারায়।

‘আচ্ছা, ওয়াশিংটন শহরের অমীমাংসিত অপরাধগুলোর বিষয়ে তথ্য কোথায় পেতে পারি আমরা?’ ডানা জিজ্ঞেস করল মিসেস হ্যানকে।

‘কী ধরনের অপরাধ?’ ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন। ‘খুন? অপহরণ?’

‘না, এই ধরুন চুরি-চামারি,’ বলল ডানা। ‘যেমন দলিলপত্র, টাকা কিংবা দামি রত্ন, গয়নাগাটি।’

সামনের দাঁতে পেন্সিল ঠুকলেন মিসেস হ্যান।

‘একটা ওয়েবসাইট আছে,’ মুহূর্তখানেক পরে বললেন, ‘আমাদের কোন একটা কম্পিউটারে www . stillmissing . com টাইপ করে দেখো। লম্বা লিস্টি আসবে।’

ছেলে-মেয়েরা তড়িঘড়ি কম্পিউটারের কাছে গেল এবং কিশোর ওয়েবসাইটটির ঠিকানা টাইপ করল। মিসেস হ্যানের কথাই ঠিক-তালিকায় কয়েকশো তারিখ আর চুরির বিবরণ চলে এল। বছরের পর বছর ধরে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর আর্টিকল থেকে নেয়া হয়েছে এগুলো।

ওরা স্কিপ করছে, পর্দায় যা আসছে পড়ে চলেছে। ১৯০১ সালে কেউ একটা ছাগল চুরি করে। ১৯৮২ সালে বেড শীট আর তোয়ালে চুরি যায় দোকান থেকে। ১৯৫৭ সালে চুরি হয় একশো বাইসাইকেল।

‘স্মৃতিপাথরের ভেতরে কোন ছাগল কিংবা বাইক লুকানো ছিল না এব্যাপারে আমি নিশ্চিত,’ বলল ডানা। হাসল খিলখিল করে।

ছেলে-মেয়েরা তালিকাটা পড়ছে, এক লোক এলেন ওদের কাছে। ইয়াবড় এক বই তাঁর হাতে।

তোমরা কি স্মৃতিপাথর সম্পর্কে জানতে চেয়েছ?’ কিশোরকে প্রশ্ন করলেন।

’জি, জানাল কিশোর। ‘আপনি কি মিস্টার ম্যাডক?’

দাঁত বেরিয়ে পড়ল মানুষটির।

‘হ্যাঁ। সত্তর বছর ধরে আমি জ্যাকব ম্যাডক।’ ওর সামনে, ডেস্কে রাখলেন বইটি। ‘তোমরা দেখো, পরে এসে নিয়ে যাব।’

চেয়ার টেনে কিশোরের আরেকটু কাছে সরে এল ডানা। বইটির নাম-কার্ভড্ ইনটু হিস্ট্রি: দ্য স্টোরি অভ দ্য মেমোরিয়াল স্টোস্।

পাতা উল্টে সূচিপত্রে গিয়ে, স্টেট অভ ওয়াশিংটনের পাথরের তালিকাটা খুঁজে নিল কিশোর। পাতাটায় মস্ত বড় এক ছবি।

‘O’ অক্ষরটা তো ঠিকই আছে দেখছি,’ বলল ডানা।

‘প্লাস্টার করা কিনা জানি না,’ বলল কিশোর। ‘তবে এখানে বলছে তিন জুলাই, উনিশশো চোদ্দ সালে মনুমেন্টে পাথরটা বসানো হয়। ওটা ছিল চার ফিট লম্বা আর দু’ফিট উঁচু। ওজন আটশো পাউণ্ডের বেশি।’

‘বুঝলাম, কিন্তু এটা তো জানলাম না, কে, কখন ওটায় গর্ত করেছে,’ বলল ডানা।

‘গর্তটা খুবই ছোট হলেও, বলল কিশোর, ‘হয়তো গভীর করে খোঁড়া হয়েছিল। লম্বা, সরু কোন কিছু লুকানোর জন্যে।’ ডানার উদ্দেশে হাসল। ‘ধরো ছাগল টাইপের কিছু।’

‘দলিলপত্র, ম্যাপ কিংবা চিঠিপত্র হওয়াটাই স্বাভাবিক,’ বলল ডানা। কম্পিউটার স্ক্রিনে চাইল ও।

তখনও রয়েছে ওয়েবসাইটটা। স্ক্রল করে নেমে এল ১৯১০- এর দশকে। নীরবে কিছুক্ষণ পড়ার পরে জোরে বিস্ময়ধ্বনি করে উঠল।

‘শশশ, ডানা। আমাদের বের করে দেবে তো!’ হিসিয়ে উঠল কিশোর।

‘এটা শোনো,’ বলল ডানা, পড়তে লাগল: ‘বিখ্যাত রত্নব্যবসায়ী কনরাড সাদারল্যাণ্ড সম্প্রতি তাঁর বাড়িতে চুরির অভিযোগ করেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তিনি যখন শহরের বাইরে তখন তাঁর বাড়ি থেকে পুঁটলি ভর্তি আকাটা হীরে চুরি গেছে। পুলিস রাজমিস্ত্রি মিস্টার হামিশ ডামকে জিজ্ঞাসাবাদ করে, হীরে চুরির সময় তিনি সাদারল্যাণ্ডের বাড়িতে মেরামতি কাজ করছিলেন। মিস্টার ডামকে পরে মুক্তি দেয়া হয়, কারণ তিনি প্রমাণ করেন হীরে যখন চুরি যায় তখন তিনি তাঁর বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন। পুলিস চোর এবং চোরাই হীরের সন্ধানে রয়েছে।’