হারানো সুর – ১১

এগারো

চুলে আঙুল চালালেন হেক্টর

‘আপনি এটা লেখেননি?’ বললেন।

‘না, অবশ্যই না,’ জবাব দিলেন সিম্ফনি। ‘কেন লিখব?’

‘ভেবেছিলাম দেখা করে হয়তো অর্কেস্ট্রা নিয়ে কথা বলতে চান,’ জানালেন হেক্টর। ‘আপনি কতটা… অসন্তুষ্ট সে ব্যাপ্যারে।’

সিম্ফনিকে হতভম্ব দেখাল।

‘অসন্তুষ্ট? আপনার কেন মনে হলো আমি…অসন্তুষ্ট, হেক্টর?’

‘কিছু মনে করবেন না, এমনি বললাম আরকী। আপনি এই অর্কেস্ট্রার সাথে বহুদিন আছেন। আমি আপনাকে খুব ভালভাবেই চিনি।’ সিম্ফনির কাঁধ জড়িয়ে ধরলেন তিনি। ‘এখন প্র্যাকটিসে চলুন।’ এবার সিম্ফনিকে পেছনে নিয়ে থিয়েটার অভিমুখে পা চালালেন।

‘এর মানে কী?’ ডনের জিজ্ঞাসা।

‘কে যেন হেক্টরকে চিরকুট পাঠিয়ে সিম্ফনির নাম সই ‘করেছে,’ জবাবটা দিল রবিন।

ডন মাথা নাড়ল। ও এটার কথা বলেনি।

‘সিম্ফনির অসন্তুষ্টির ব্যাপারটা। তাঁকে তো কখনও অসুখী মনে হয়নি।’

‘ও নিয়ে পরে কথা বলা যাবে,’ বলল কিশোর। ‘এখন জানা দরকার চিরকুটটা কে লিখেছে।

‘এবং কেন,’ জুগিয়ে দিল নথি।

এমনিসময় বেহালার শব্দ কানে এল ওদের।

মুসা বলে উঠল, ‘খাইছে, আমরা সিম্ফনির প্র্যাকটিস মিস করছি,’ এবং ত্বরিত গতিতে অডিটোরিয়াম অভিমুখে চলল।

অন্যরাও পিছু নিল। সিম্ফনির একক পরিবেশনা শুনলে হয়তো কোন আইডিয়া আসতে পারে ওদের মাথায়।

সামনের সারির আসনগুলোয় সেঁধিয়ে পড়ল দলটা। আইলের পেছনে, মাথা নুইয়ে, চোখ মুদে বসা হেক্টর, ওরা ভাবল উনি হয়তো ঘুমোচ্ছেন। মঞ্চে, বাজানোর সময় এপাশ-ওপাশ দুলছেন সিম্ফনি। তারের ওপর ছড় বোলাচ্ছেন মোলায়েমভাবে। তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় বেহালাটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

‘আমি কখনওই এমন বাজাতে পারব না,’ ফিসফিস করে বলল মুসা।

‘কেন পারবে না?’ বলল কিশোর। ‘চর্চা করলেই পারবে।’ সহসাই ডন বলে উঠল, ‘বুঝেছি!’

ওর পাশে বসা রবিন বলল, ‘ডন, চুপ করো!’

‘কিন্তু আমি তো জানি কেন!’

ওপাশ থেকে ঝুঁকল মুসা।

‘শশশ!’ বলল।

আপনমনে গজগজ করে সিটে গা এলিয়ে দিল ডন।

একটু পরে, বেহালা থেকে ছড় তুললেন সিম্ফনি। শেষ মূর্ছনাটুকুর রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই সটান উঠে দাঁড়ালেন হেক্টর।

‘দুর্দান্ত!’ তারিফ করলেন। ‘একটা প্যাসেজে শুধু সামান্য কাজ করতে হবে।’ ধাপ ভেঙে মঞ্চে উঠে সিম্ফনিকে দেখালেন কোন্ অংশটায় আরও যত্ন নিতে হবে।

ডন চাইল দলের অন্যদের দিকে।

‘এখন কথা বলা যাবে?’

‘বলো,’ বলল কিশোর।

‘হেক্টরকে চিরকুটটা কেন পাঠানো হয়েছিল জানি আমি। তাঁকে রুম থেকে সরাতে।’

‘যুক্তি আছে তোমার কথায়,’ বলল রবিন। ‘কিন্তু তাঁকে সরিয়ে কার কী লাভ?’

‘খাইছে, কাজটা যে-ই করুক, সে হয়তো ভেবেছে স্বরগ্রামটা এখনও ওখানে রয়েছে,’ বাতলে দিল মুসা।

প্রবল মাথা ঝাঁকাল ডন।

‘হ্যাঁ, আর ওরা ওটা খুঁজতে চায়!’

হেক্টর আর সিম্ফনিকে ওদের সন্দেহের কথাটা জানাবে ভাবল ছেলে-মেয়েরা।

পরম একাগ্রতায় শুনলেন হেক্টর। তারপর মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আমাদের এখুনি হোটেলে যাওয়া উচিত!’ আইল ধরে দৌড় দিলেন।

সিম্ফনি আর ছেলে-মেয়েরা ছুটল তাঁর পেছনে।

কিন্তু দেরি করে ফেলেছে ওরা। হোটেলে গিয়ে দেখল, হেক্টরের দরজাটা হাট হয়ে খোলা। ভেতরটা লণ্ডভণ্ড। ড্রয়ারগুলো টেনে খুলে, ভেতরের জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে রেখেছে মেঝেময়। বিছানা থেকে বেডশীট আর বালিশগুলো ফেলে দিয়েছে। ক্লজিটের মেঝেতে ডাঁই করে রাখা কাপড়চোপড়

হেক্টর ওঁর কাপড়ের ব্যাগটা তুলে নিয়ে চেইন খুললেন। তলায় তালগোল পাকিয়ে পড়ে রয়েছে টাক্সেডোটা।

এসময় ক্রিস গেইল এ কামরায় এসে ঢুকলেন। চশমার ওপর দিয়ে ঘরের বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে বললেন, ‘আপনার এখানেও!’

‘আপনার রুমও তছনছ করেছে নাকি?’ সিম্ফনি জবাব চাইলেন।

‘হ্যাঁ,’ জানালেন ক্রিস। ‘আপনার কথামত নিচে ডাইনিং রুমে দেখা করতে যাই, আর- ‘

‘আমি আবার কখন আপনাকে দেখা করতে বললাম!’ বাধা দিলেন সিম্ফনি। আকাশ থেকে পড়েছেন যেন।

ক্রিস হতচকিত।

‘কিন্তু আপনার চিরকুটটা—ওতে তো লেখা ছিল আমার সাথে এখুনি দেখা করতে চান।’

‘আমি কোন চিরকুট লিখিনি,’ সাফ জানালেন সিম্ফনি।

তখনও তাঁর বিভ্রান্তি কাটেনি, ক্রিস বললেন, ‘আমার তর্কাতর্কির সময় নেই, মেলা কাজ পড়ে আছে।’ চলে যেতে উদ্যত হলেন।

‘এক মিনিট!’ ডাকলেন হেক্টর। ‘ড্রেস রিহার্সালের আগে টাক্সেডোটা লণ্ডিতে দিতে হবে। মনে করে কাজটা করবেন, প্লিজ।’ কাপড়ের ব্যাগটা ক্রিসকে দিলেন।

ভ্রূ কোঁচকালেন ক্রিস।

‘জি, স্যর,’ বললেন। তারপর শ্বাসের নিচে আওড়ালেন, ‘তাঁর সব কিছুই একদম শেষ মুহূর্তে, ছেলে-মেয়েদের শোনার মত যথেষ্ট জোরে।

‘আমরা বরং সিভিক সেন্টারে ফিরি,’ প্রস্তাব দিলেন সিম্ফনি। ‘অর্কেস্ট্রা এসে পড়বে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলুন,’ আপনমনে বলে, গটগটিয়ে কামরা ছাড়লেন হেক্টর।

সিম্ফনি পেছনে রয়ে গেলেন।

‘আপনি যান,’ কিশোর বলল ওঁকে। ‘আমরা সব গোছগাছ করে দিচ্ছি।’

‘তাই? হেক্টর খুব খুশি হবেন,’ বলেই, তড়িঘড়ি বেরিয়ে পড়লেন তিনি।

ডন আর সু কি ড্রয়ারগুলোয় জিনিসপত্র রাখতে লাগল। রবিন আর মুসা বিছানা ঠিকঠাক করল। কিশোর হ্যাঙ্গারে রাখল সব কাপড়চোপড়।

‘এখন একটা নয়, দুটো ভুয়া চিরকুট-রহস্য,’ বলল নথি।

‘বাজি ধরছি দুটোই একজনের লেখা,’ দৃঢ় কণ্ঠে বলল ডন। ‘খাইছে, কিন্তু কার?’ মুসা জিজ্ঞেস করল।

ওটা নিয়ে ভাবল ছেলে-মেয়েরা।

শেষমেশ সু কি বলল, ‘মেরি হপকিন্স নন তো?’

সকালের দৃশ্যটা মনে পড়ল সবার, মেরি হপকিন্সকে কেমন অপ্রস্তুত আর বিচলিত দেখাচ্ছিল। তিনি নাকি ওখানে অটোগ্রাফ শিকারে যান। মিথ্যে বলেননি তো মহিলা?

‘উনিই হয়তো চিরকুট দুটো লিখেছেন,’ বলল রবিন।

‘কিন্তু সিম্ফনির সইটা?’ মুসার প্রশ্ন।

নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটল কিশোর।

‘ওঁর অটোগ্রাফের খাতা থেকে ট্রেস করতে পারেন,’ জবাব দিল গোয়েন্দাপ্রধান।

কাজটা সম্ভব, একমত হলো ওরা।

‘স্বরগ্রামটাও নিশ্চয়ই উনিই নিয়েছেন,’ বলল ডন।

ওর কথায় যুক্তি আছে। স্বরগ্রামটার ব্যাপারে তাঁকে প্রথম দিন, অতি উৎসাহী মনে হচ্ছিল। আর মোযার্টের স্বাক্ষর জোগাড় করতে পারলে তো পোয়াবারো। নিঃসন্দেহে তাঁর সংগ্রহের সেরা সংযোজন হবে ওটা।

‘কিন্তু স্বরগ্রামটা তিনি চুরি করে থাকলে ওটা খুঁজতে যাবেন কেন?’ কিশোর প্রশ্ন রাখল।

‘আর স্বরগ্রামটা খোঁজার প্রয়োজন না থাকলে, চিরকুট লিখেই বা লাভ কী?’ যোগ করল রবিন।

সশব্দে শ্বাস ফেলল ডন।

‘আমাদের প্রশ্ন নয়,’ বলল। ‘উত্তর চাই।’

কিন্তু কারও কাছে কোন জবাব নেই।