হারানো সুর – ১৬

ষোলো

মুসা কাকভোরে উঠেছে। নাশ্তার জন্য সবাই নেমে আসার আগেই, সবার গ্লাসে জুস ঢেলেছে আর কফি বানিয়েছে জ্যাক নানার জন্য।

‘মুসা, তোমার রিহার্সালে থাকতে পারলে ভাল হত,’ জ্যাক নানা বললেন ওকে। ‘কিন্তু আজ সকালে অনেক কাজ আমার।’

মুসা স্বস্তি পেল। শ্রোতাদের মধ্যে জ্যাক নানা থাকলে ঘাবড়ে যেত ও, বাড়তি টেনশনে ভুগত।

‘কোন সমস্যা নেই, নানা,’ বলল। ‘কনসার্টে তো শুনবেনই।’ কফি আর টোস্ট দিয়ে নাস্তা সারলেন জ্যাক নানা। ‘গুড লাক,’ বলে, রওনা হলেন। এবার দোরগোড়ায় থেমে দাঁড়িয়ে, উল্টো ঘুরলেন। ‘তোমরা বাকিরা শোনো, আর কোন রহস্য নয়, কেমন? এক সপ্তাহের জন্য যথেষ্ট রহস্য-সমাধান হয়েছে।’

ওরা জানে তিনি মজা করছেন। গতরাতে সব শুনে জ্যাক নানা বলেছেন, ‘চুম্বক যেভাবে লোহাকে টানে, রহস্যও সেভাবে তোমাদেরকে টানে।’ তবে সর্বশেষ রহস্যটার কিনারা করতে পারায় তিনি মনে-মনে খুশি, জানে ওরা।

কিশোর-কিশোরীদের স্রোতের সঙ্গে মিশে ছেলে-মেয়েরা অডিটোরিয়ামে ঢুকল। ভেতরে, সিম্ফনি তখন মঞ্চে ওদেরকে যার- যার আসন নিতে বলছেন। উত্তেজনার আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে বাতাসে।

আসন নেয়ার সময় মোটেই উৎকণ্ঠিত দেখাল না মুসাকে। আশপাশের বাদকদের উদ্দেশে স্মিত হেসে কেস থেকে বেহালা বের করল ও।

ছেলে-মেয়েরা যে, যার যন্ত্র টিউন করছে। একটু পরেই, থিয়েটারে ধ্বনিকম্পন উঠল।

কানে হাতজোড়া চাপা দিল ডন।

‘ইস, কী বিশ্রী শব্দ! অথচ একটু পরেই কী সুন্দরই না শোনায়,’ বলল ও।

‘অপেক্ষার ফল মিষ্টি,’ বলল রবিন।

‘একদম,’ সায় জানাল কিশোর।

যন্ত্রীদের প্রথম কয়েকটা প্রচেষ্টা সিম্ফনির মোটেই পছন্দ হলো না। একটু পরপরই বাধা দিলেন তিনি।

‘ঐকতান চাই,’ মৃদুকণ্ঠে নির্দেশ দিলেন।

বারে বারে শুরু করল আর থামল ওরা। অবশেষে, গোটা এক বাজনা বাজাতে পারল। এরপর স্বচ্ছন্দে, সুরের ঢেউ তুলল যন্ত্রশিল্পীরা। লাঞ্চ নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো।

‘প্রথমবারের তুলনায় খারাপ নয়,’ বললেন সিম্ফনি। শেষ বিকেলে আবার আসতে বললেন বাজিয়েদের। তারপর বিদায় দিলেন

বিকেলের শুরুতে, শেষ রিহার্সালটা সেরে নিল বড়দের অর্কেস্ট্রা। তারপর আবার ছোটদের পালা। এরপর বড় কনসার্টের প্রস্তুতির জন্য ঘরে ফেরা।

‘আমি আগে কখনও সত্যিকারের কোন কনসার্টে যাইনি,’ বলল ডন। ‘কী পরব বুঝতে পারছি না।’

‘পার্টির সেরা ড্রেসটা পরো,’ বলে দিল রবিন।

জ্যাক নানা সবার শেষে নিচে নামলেন। টাক্সেডো আর কড়া মাড় দেয়া সাদা শার্ট পরেছেন।

‘আপনাকে খুব হ্যাণ্ডসাম লাগছে, জ্যাক নানা,’ প্রশংসার সুরে বলল সু কি।

‘ধন্যবাদ,’ মুচকি হেসে বললেন জ্যাক নানা।

ওদের আসন সামনের সারিতে। অডিটোরিয়াম ভরে উঠতেই, চারধারে চোখ বোলাল ডন।

‘কোন সিট খালি নেই,’ বলল।

‘হ্যাঁ,’ বললেন জ্যাক নানা। ‘সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে।’

অর্কেস্ট্রা শিল্পীরা সার বেঁধে ঢুকে যার-যার আসন নিলেন। শ্রোতারা সব নীরব হয়ে গেল। সবার শেষে প্রবেশ করলেন মহান সঙ্গীতজ্ঞ হেক্টর ক্রুসিয়ানি। সবাই হাততালি দিয়ে স্বাগত জানাল তাঁকে। হেক্টর মাথা নুইয়ে অভিবাদনের জবাব দিয়ে, শ্রোতাদের দিকে পিঠ ফেরালেন। মনোযোগ পেতে ঠুক-ঠুক শব্দ করলেন, সামান্য বিরতি নিলেন এবং ব্যাটন উঁচালেন। সবার দৃষ্টি এখন ওঁর ওপর, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে প্রত্যেকে।

‘শিগগির বাজনা শুরু করুন,’ ফিসফিস করে বলল ডন।

তীক্ষ্ণ ডাউনবিটের সাহায্যে ঠিক সে কাজটিই করলেন হেক্টর। অর্কেস্ট্রায় যেন প্রাণসঞ্চার হলো। হেক্টর বাজনার তালে-তালে দুলছেন, যন্ত্রীদের একেক অংশের দিকে একেকবার ইঙ্গিত করছেন। তাঁর ব্যাটন যেন এক আশ্চর্য জাদুদণ্ড, অপূর্ব সুন্দর ঐকতান তুলেছে ভিন্ন-ভিন্ন সব কটা বাদ্যযন্ত্রে। বেঁধে ফেলেছে সবাইকে সুরের মায়াজালে।

বিরতির সময়, ছেলে-মেয়েরা লবিতে গেল। জ্যাক নানা ক’জন পুরানো আলাপীর সঙ্গে খোশগল্প জুড়লেন। ওরা গেল ডিসপ্লে কেসে রাখা মোয়ার্টের অমূল্য স্বরগ্রামটা দেখতে।

‘খাইছে, মোযার্ট কী অপূর্ব সুরস্রষ্টাই না ছিলেন!’ বলল মুসা। এসময় মেরি হপকিন্স ওদের পাশে এসে দাঁড়ালেন।

‘বাহ, তারমানে স্বরগ্রামটা পাওয়া গেছে,’ এমনভাবে ইতিউতি চাইলেন যেন নিশ্চিত হয়ে নিচ্ছেন কেউ শুনছে না। এবার সামনে ঝুঁকে বললেন, ‘কে নিয়েছিল জানো?’

রবিন জবাব দিতে যাবে, এসময় হেক্টর উদয় হলেন লবিতে। ছেলে-মেয়েদেরকে দেখে ত্বরিত পা বাড়ালেন।

মেরিকে নার্ভাস দেখাল।

‘ওহ, ঈশ্বর, গুরু এসেছেন,’ হেক্টর এগিয়ে আসতেই পিছিয়ে গেলেন তিনি। আসলে মহিলার এই নার্ভাস আচরণের কারণেই ছেলে-মেয়েরা তাঁকে চোর ঠাওরেছিল।

‘তোমাদেরকে ধন্যবাদ জানানোর সুযোগই হয়নি,’ হেক্টর বললেন ওদেরকে। ‘সপ্তাহ জুড়ে তোমরা আমাদেরকে যা সাহায্য করেছ!’

‘ওতেই আমাদের আনন্দ,’ বলল কিশোর।

আমরা রহস্যের সমাধান করতে ভালবাসি,’ বলে উঠল ডন। হেসে উঠলেন হেক্টর।

‘কাজটায় খুব পাকা তোমরা।’

‘অনেক প্র্যাকটিস করতে হয় সেজন্যে,’ বলল ডন।

তখনও হাসছেন, হেক্টর অন্যদিকে চলে গেলেন। এতক্ষণ কাঁচুমাচু হয়ে ছিলেন মেরি, তাঁর গমনপথের দিকে চাইলেন।

‘কী প্রতিভা!’ সপ্রশংস কণ্ঠে বললেন। ‘যাই, কোথাও গিয়ে একটু বসি গে। বড়-বড় মানুষদের কাছ থেকে দেখলে কেমন আড়ষ্ট হয়ে যাই আমি, মাথা কাজ করে না।’

শেষ রহস্যটারও সুরাহা হলো। মেরি অপরাধী বলে স্নায়বিক দুর্বলতায় ভোগেন না। তিনি আসলে নামী মানুষদের সামনে কুঁকড়ে যান।

কনসার্টের দ্বিতীয় অংশ প্রথমটার চাইতে আরও বেশি জমজমাট হলো। সিম্ফনির একক পরিবেশনা অভিভূত করল শ্রোতাদের। পারফর্মেন্স শেষে, শিল্পীদের টানা দশ মিনিট করতালি দিয়ে অভিনন্দন জানালেন সুধীজনেরা।

পরে, রিসেপশনে এলেন হেক্টর। তাঁকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। ‘অসাধারণ পারফরমেন্স!’ জ্যাক নানা বললেন তাঁকে। ‘সত্যিই আপনার কোন তুলনা নেই!’

‘অর্কেস্ট্রা নিখুঁত বাজিয়েছে,’ বললেন হেক্টর। ‘সব প্রশংসা ওদের প্রাপ্য। খারাপ লাগছে ক্রিস নেই বলে।’

পরিষ্কার বোঝা গেল তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্রিস গেইল একাই মানসিক যন্ত্রণায় ভুগবেন না।

ওরা রিসেপশন থেকে দ্রুত ফিরল মুসা যাতে বিশ্রাম পায়। কিন্তু ঘুম এল না ওর চোখে। অন্যরা ঘুমিয়ে পড়ার বহুক্ষণ পরেও, বাড়িতে বেহালার মিষ্টি সুর ভেসে বেড়াল।

পরদিন সকাল। পালক বাবা-মা রবিনসন দম্পতির সঙ্গে লবিতে অপেক্ষা করছে সু কি। সবাই একে-একে মুসাকে আলিঙ্গন করে শুভেচ্ছা জানাল।

হেক্টর আর সিম্ফনি শিশুশিল্পী আর তাদের অভিভাবকদের নিয়ে অডিটোরিয়ামে ঢুকলেন।

‘ছোট্ট বন্ধুরা,’ বললেন হেক্টর, ‘এসো, আমরা সবাই মিলে মন-প্রাণ ঢেলে বাজাই।’

হঠাৎই দরজার কাছে ঊর্ধ্বশ্বাসে ধেয়ে এলেন মেরি হপকিন্স। খোলা খাতা আর কলম ধরলেন মুসার নাকের নিচে।

‘মুসা, আমাকে তোমার অটোগ্রাফ দেবে?’ লাজুক কণ্ঠে বললেন।

মুসা যারপরনাই বিস্মিত।

‘খাইছে, আমি? আমি তো বিখ্যাত কেউ নই!’

মেরি বললেন, ‘কে জানে…’

হেক্টর, সিম্ফনি, জ্যাক নানা, রবিনসন দম্পতি আর ছেলে- মেয়েরা সমস্বরে বলে উঠল, ‘…একদিন হয়তো।’

মুসা মৃদু হেসে নাম সই করল। আমান-এর ‘N’ লিখে, বাহারি টানে দৃষ্টিনন্দন এক নকশা এঁকে দিল।

***