দুঃস্বপ্নভূমি – ২০

বিশ

অসুখী চেহারার এক বাচ্চার ছবির নিচে যে ছোট্ট ট্যাগটি রয়েছে সেটিতে আঙুল রাখল রিনা।

ট্যাগটা পড়ামাত্রই আঁতকে উঠলাম।

‘এফটিডি অর্থ ফ্রাইটেড্ টু ডেথ-মানে আতঙ্কে মৃত্যু,’ বললাম।

অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল সবাই।

আমার কবজির ধার ব্রেসলেটটা খোঁচাচ্ছে আর ক্রমেই. গরম হয়ে উঠছে। অর্থাৎ আমার ভয়ের মাত্রা বাড়ছে। কিন্তু কী করতে পারি আমি? দেয়ালের বিমর্ষ মুখগুলো চেয়ে আছে আমার দিকে।

‘তারমানে-?’ টিনা আরম্ভ করেছিল।

দেয়াল ভর্তি ছবির উদ্দেশে হাত দোলালাম। ‘এদের কেউই অমঙ্গলের হাত থেকে নিস্তার পায়নি,’ বললাম। ‘এই ছবিটার নিচে ছোট্ট চিহ্নটা দেখো। এখানে বলছে ভয়ের মাত্রা একশোতে উঠতেই মারা যায় সব কটা ছেলে-মেয়ে। ভয়কে জয় করতে পারেনি ওরা।’

আমার গা ঘেঁষে বসা মুসার দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

‘খাইছে, তারমানে আমাদেরও কোন সুযোগ নেই?’ বলল ও। ‘চুপ করো!’ চেঁচিয়ে উঠল ডেমি মুর। হড়কে চলে এল মুসার কাছে। ‘এসব কথা বোলো না। আমি সারাজীবন এরকম ছায়া হয়ে থাকব নাকি?’

ওর রাগ দেখে চমকে গেল মুসা।

‘আমরা টিকে যাব-যদি একশোতেও ওঠে ফিয়ার মিটার,’ বলল ডেমি। ‘এবং আমরা বাড়ি ফিরব। সবাই স্বাভাবিক দেহ ফিরে পাব।’

‘ও…ও ঠিকই বলেছে,’ সমর্থন দিল নেলী। শরীরের কাঁপুনির চোটে গলাও কেঁপে গেল ওর। ‘ভয়ঙ্কর বিপদের সাথে লড়ার অভিজ্ঞতা আছে আমাদের প্রত্যেকের। এবং আমরা… তাতে জিতেওছি। এবারও পা-পারব।’

‘চলো, বলল কিশোর। দরজা লক্ষ্য করে পা বাড়াল। ‘ছবি দেখে কোন লাভ নেই।’

ওর পিছু নিয়ে বাইরে বেরোলাম। বাতাস এখন আরও ঠাণ্ডা 1 আকাশ কালো কয়লার মত কুচকুচে। এক ঝাঁক কালো পাখি উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে তীক্ষ্ণস্বরে ডাকতে ডাকতে।

কিশোর আর রায়ান হন্তদন্ত হয়ে জেরি আর এমার নাগাল ধরল।

‘বাড়িটা কোথায় ছিল মনে করতে পারলে?’ ওদেরকে জিজ্ঞেস করল কিশোর।

‘হররল্যাণ্ডে কীভাবে ফিরেছিলে মনে পড়ে?’ জবাব চাইল রায়ান।

এসময় একদম কাছেই ইমনের গলা পেলাম।

‘মন দিয়ে ভাবো,’ মিনতি করে বলল। ‘তোমরা দু’জনেই আর্কেডে এসেছিলে। আমাকে সাথে করে প্যানিক পার্কে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল…..

মেয়ে দুটি চোখ বুজে গভীরভাবে ভাবতে লাগল।

‘সব কেমন ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে,’ শেষমেশ বলল জেরি।

‘সাদা বাড়িটার কথা মনে আছে,’ জানাল এমা। ‘মনে আছে বাড়িটার ভেতর হাঁটতে-হাঁটতে ঢুকেছিলাম। এবং তারপর…’

মাথা নাড়ল।

‘সরি, সব ফাঁকা। কিচ্ছু মনে নেই।’

‘অ্যাই, দাঁড়াও!’ হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল টিনা। ‘ওই দেখো!’ ওর আঙুল অনুসরণ করে তাকালাম। পথের ওপাশে ছোট্ট এক বাড়ির দিকে তর্জনী তাক করেছে ও।

পরিচিত লাগল বাড়িটাকে। এবার প্রবেশপথের ওপরে সাইনটা দেখলাম: আয়নাঘর।

সঙ্গী-সাথীদের কেউ আঁতকাল, কেউ বা আবার আনন্দধ্বনি করে উঠল।

‘হ্যাঁ!’ চিৎকার ছাড়ল ভিভ, বাতাসে মুঠোজোড়া ছুঁড়ল। ‘আমরা এভাবেই এখানে আসি! এই আয়নাগুলোই আবার আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে!’

আমরা দ্বিধা করলাম না। সবাই দৌড়তে লাগলাম।

দরজা বন্ধ। দালানটা কি তালা মারা?

ভিভ সবার আগে পৌঁছল ওখানে। দরজাজোড়ার ওপরে হাত রেখে টেনে সরাল। সহজেই হড়কে খুলে গেল ওগুলো।

লম্বা, সরু কামরাটিতে জটলা পাকিয়ে প্রবেশ করলাম আমরা। দু’পাশে কালো আয়না।

আমার দীর্ঘ এক সার আয়না প্রতিবিম্বের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছি, বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠল

‘এসো সবাই!’ গলা ছাড়ল কিশোর। ‘আয়নার ভেতরে!’

মুসার দিকে চকিতে চাইলাম। ওর মুখের চেহারায় ত্রস্ত অভিব্যক্তি। কিন্তু ও আমাকে মাথা ঝাঁকিয়ে সাহস জোগাল।

গভীর শ্বাস টানলাম-এবং লাফালাম কাঁচের ভেতরে।

একুশ

‘আউউউ!’

সজোরে মাথা ঠুকে গেল আমার, হাতজোড়া চাপড়াল আয়না।

কাঁচটা নিরেট।

আয়নার দীর্ঘ সারিতে দেখলাম, টলটলায়মান ছেলে-মেয়েরা পিছু হটল, বিস্মিত আর হতাশ।

গোটা কামরা গোঙানী আর বেদনার অস্ফুট চিৎকারে ভরে উঠল।

‘খুব এক চোট হলো!’ হালকা রসিকতার চেষ্টা করল কিশোর।

কিন্তু আমরা এতটাই হতাশ যে হাসতে ভুলে গেছি। নিথর দাঁড়িয়ে, নিজেদের কালচে প্রতিফলনের দিকে চেয়ে রইলাম আমরা।

‘খাইছে!’ পেছনে দরজা দড়াম করে লেগে যেতেই আঁতকে উঠল মুসা।

দীর্ঘ, সরু কামরাটা আঁধার হয়ে এল।

কিশোর আর ভিভ ধেয়ে গেল দরজার কাছে। ওদেরকে ওটা

খুলতে আপ্রাণ যুঝতে দেখলাম।

‘আমরা…আটকে গেছি!’ চেঁচাল ভিভ। ‘কেউ আমাদেরকে আটকে দিয়েছে। বন্দি করে রেখে গেছে!

আমার ব্রেসলেটটা কবজিতে হুল বিধিয়ে তিরতির করে কাঁপতে লাগল।

রবিন, শান্ত হও, নিজেকে বললাম। শান্ত হও। কিন্তু হব কীভাবে?

আয়নাগুলো থেকে আমার আতঙ্কিত মুখটা তাকিয়ে রয়েছে আমারই দিকে।

এবং তারপর…আমার চেহারাটা উধাও হয়ে গেল।

ছেলে-মেয়েদের মুখগুলো যেই অদৃশ্য হচ্ছে, চিল চিৎকার ছাড়ছে তারা। একটু পরে, আয়নাগুলো কালো হয়ে গেল।

‘ওহ, না,’ গুঙিয়ে উঠলাম। আয়নায় ফুটে ওঠা সবুজরঙা কুৎসিত মুখোশটার ওপর আমার চোখ সেঁটে রয়েছে আঠার মত। কী ভয়ঙ্কর দেখতে ওটা!

এক আয়নায়, তারপর আরেকটায় ভেসে উঠল মুখোশটা…আরও একটায়। অবশেষে ভৌতিক মুখোশটা সার বাঁধা আমাদের দিকে চেয়ে রইল স্থিরদৃষ্টিতে।

রাবারের ঠোঁটজোড়া এমনভাবে ওঠা-নামা করছে, ওটা যেন কথা বলছে আমাদের সঙ্গে।

এবং এসময় মুখোশটার পেছনে উদয় হলো বুকে নাম লেখা ক্যাপ্টেন সিলভার, একপেয়ে জলদস্যু সর্দার। মুখোশটা কালচে হয়ে ঝাপসা হতেই জলদস্যুর অশুভ মুখখানা আকারে বড় হয়ে উঠল। প্রতিটা আয়না থেকে জ্বলজ্বলে চোখে দেখছে আমাদেরকে ও, বীভৎস হাসছে ক্ষয়াটে দাঁতে।

পরক্ষণে, বিশাল এক সাপ ফণা তুলতেই আর্তচিৎকার ছাড়লাম…এতটাই কাছে…এতটাই কাছে…মনে হচ্ছে এই বুঝি ছোবল মারবে কাঁচের ভেতর থেকে। মাথা উঁচিয়ে হাঁ করল। কটাস করে ওটার চোয়াল লাগল একবার, দু’বার। খোলা মুখটা দিয়ে হিসহিসে শব্দ বেরোচ্ছে, মনে হলো যেন ছোট্ট কামরাটা বিষাক্ত বাষ্পে ভরে উঠছে

‘খাইছে, বিষধর সাপ!’ মুসা বলে উঠল। নাম লেখা: ডক্টর সেকি।

প্রচণ্ড জোরে ঘুসি মারল কাঁচে। কিন্তু অতিকায় সাপটা রয়েই গেল। মাথাটা এক ঝটকায় আমাদের উদ্দেশে বাড়িয়ে রক্ত হিম করা হিসহিস আওয়াজটা করেই চলেছে।

এবার কয়েক হাজার বছরের পুরানো এক মমি টলতে-টলতে আমাদের দিকে এগিয়ে এল। গা থেকে নোংরা মোড়ক খসে খসে পড়ছে। কোটরাগত রক্তচক্ষু মেলে তীব্র দৃষ্টিতে দেখছে আমাদেরকে।

এবার আড়ষ্ট একটা হাত বাড়াল

মমিটা। হাতড়াচ্ছে…আঁকড়াতে চাইছে কিছু… কাঁচের ওপাশ থেকে বেরিয়ে আসবে।

অ্যাণ্ডিনা টলে উঠে পিছিয়ে গেল।

‘না-না!’ চিৎকার ছাড়ল সভয়ে।

কিন্তু ওটার কাছ থেকে পালানোর উপায় নেই। মমিটা আমাদের সামনের আর পিছনের সব কটা আয়না জুড়ে রয়েছে।

‘এরা সবাই অমঙ্গলের দলে! আমাদেরকে ভয় দেখাতে জড় হয়েছে শয়তানগুলো!’ ভয়ার্ত কণ্ঠে বলে উঠল ডেমি মুর।

আমার ব্রেসলেটটা, কবজি পুড়িয়ে দিচ্ছে যেন, যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ছে বাহুতে। প্রতিটা আয়নায় চড়েছে ফিয়ার মিটারের মাত্রা। লাল দাগটা এখন লাফাচ্ছে ৮০-র ঘর ছাড়িয়ে। বাড়ছে…আরও বাড়ছে…

‘এখানে আর নয়!’ গর্জাল কিশোর।

দরজা খুলতে চেষ্টা করল আবারও। বৃথা। এবার কাঁধ নামিয়ে জোর ধাক্কা দিল।

না। কাজ হলো না কোন।

আমি উল্টো ঘুরলাম আয়নাগুলোর দিকে-এবং দেখলাম এক ভৌতিক ভেন্ট্রিলোকুইস্ট পুতুলের আবির্ভাব ঘটেছে সব কটায়। ওটার কাঠের চুলগুলো দাঁড়িয়ে আছে উঁচু ঢেউয়ের মত। পুতুলটা এপাশ-ওপাশ বুনো দৃষ্টি বোলাচ্ছে ক্ষণে-ক্ষণে। ঠোঁটে বিদ্রূপের হাসি। চোয়াল ওঠা-নামা করতেই কেঠো টিক-টিক শব্দ হলো।

‘বাপ রে, কী ভয়ানক পুতুল!’ মলি আর্তনাদ ছাড়ল।

‘ভয় পেলে নাকি? আমি মিস্টার হ্যালি! কিচকিচ করে বলল ওটা।

আমাদের কথা শুনতে পাচ্ছে!

সব কটা আয়নায় এখন ওর অলক্ষুণে মুখটা ফুটে উঠেছে। এবার রায়ানের ওপর দৃষ্টিস্থির হলো ওটার।

‘ছেলে, একটা উপদেশ দিই। সুগন্ধী মেখো!’ তীক্ষ্ণ হাসল। এবার ভয়ঙ্কর পুতুলটার নজর পড়ল কিশোরের ওপর। ‘কোন্‌টা মুখ আর কোন্‌টা পেছনদিক জানো তো? জানো না? আমিও জানি না! হাহাহাহাহা!’

‘এত হাসির কিছু নেই!’ চড়া গলায় বলে উঠল জেরি। ‘কী চাও তুমি?’

কট করে খুলে গেল হ্যালির মুখ। সামনে ঝুঁকে, অশুভ হাসিটা ধরে রেখে পিটপিটিয়ে চাইল জেরির দিকে।

‘জেরি, আমার চোখে তুমি দেখতে খুবই-কুৎসিত! হা-হা। তোমার নাকটা কী সুন্দর! সেভেন আপের ক্যাপ খোলো নাকি ওটা দিয়ে? হা-হা।’

ঘন-ঘন এপাশ-ওপাশ চোখ ঘোরাচ্ছে ভুতুড়ে পুতুলটা।

‘আরে, ইমন কই? অদৃশ্য? হা-হা, ইমন, তোমাকে কিন্তু দারুণ লাগছে! এত সুন্দর কখনও দেখায়নি! তোমরা সবাই এক কাজ করো না, পৃথিবীটাকে আরও অপরূপ করে তোলো-স্রেফ অদৃশ্য হয়ে যাও!’

পুতুলটার প্রতিবিম্ব দেখছি, মাথা চলছে ঝড়ো গতিতে। ও এসব করছে কেন? নিছকই ফালতু রসিকতা এগুলো?

‘তোমরা সবাই ইমনের মত অদৃশ্য হতে চাও?’ কর্কশ কণ্ঠে চেঁচাল হ্যালি। ‘তোমাদের ভয়ের মাত্রা প্রায় একশোতে উঠেছে। এর অর্থ, অমঙ্গল আর আমরা যারা ভাল মানুষ, শীঘ্রিই তারা সবাই পৃথিবীতে ফিরছি।’

কেঠো মুখটা কাছিয়ে আনল ও। চোখজোড়া বিস্ফারিত। ‘তোমাদের কি ধারণা অমঙ্গল তোমাদেরকে বাবা-মার কোলে ফেরত পাঠাবে? আমার তা মনে হয় না!’

‘থামো!’ তীক্ষ্ণ শোনাল জেরির চিৎকারটা। ‘চুপ করো! চুপ করো! তোমাকে ঘৃণা করি আমি!’

আয়নায় দুম করে এক কিল মেরে বসল। পুতুলটাকে আঘাত করতে চাইছে।

‘তুমি একটা জঘন্য কাঠের পুতুল! আমি ঘৃণা করি তোমাকে!’ খিলখিল করে হেসে উঠল হ্যালি। কেঠো এক হাত তুলল। জেরির উদ্দেশে নিশানা করল দুটো আঙুল।

‘অমঙ্গলের শেখানো একটা কায়দা দেখাই তোমাকে!’ পরমুহূর্তে, কড়কড় করে এক শব্দ হলো। অনেকটা বৈদ্যুতিক শকের মতন।

টলে উঠে পিছু হটল জেরি। চিতিয়ে পড়ে গেল পেছনের আয়নাটার ওপরে।

চোখজোড়া ঠিকরে বেরিয়ে আসছে! মুখ হাঁ, ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস নিচ্ছে।

হ্যালি আবারও আঙুল দুটো তাক করল ওর উদ্দেশে। আবারও বৈদ্যুতিক শকের কড়কড়ে আওয়াজ।

গোঙানীর স্বর বেরোল জেরির গলা দিয়ে।

কী যেন হয়ে গেছে ওর চেহারায়। মুখটা হাঁ হয়ে রয়েছে আড়ষ্ট ভঙ্গিতে। চোখের নড়াচড়া বন্ধ। চেহারাটা শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

ভীতিকর এক দৃশ্য! আতঙ্কমাখা চোখে দেখলাম জেরির গোটা দেহ কঠিন হয়ে গেল। পালিশ করা চকচকে কাঠের মত আভা ছড়াচ্ছে ওর গায়ের চামড়া।

‘আঁ-আঁ-আঁ।’ ওর গলা দিয়ে কুৎসিত শব্দ বেরোল।

এক হাত উঁচিয়ে চিবুকের নিচে চাপ দিয়ে ধরল, মুখ বন্ধ করতে লড়ছে সাধ্যমত। কট করে এক শব্দের পর বন্ধ হলো মুখটা ওর।

হেসে উঠল হ্যালি। আঙুল দুটো আরেকবার তাক করল মেয়েটির উদ্দেশে।

‘আঁ-আঁ,’ গোঙাচ্ছে জেরি।

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে এপাশ-ওপাশ নড়াচড়া করছে চোখজোড়া ওর। এবার মাথাটা হেলে পড়ল সামনের দিকে, তারপর পেছনে। কথা বলার চেষ্টা করতেই কটাস করে উঠল ওর মুখ।

‘হা-হা!’ সে কী আনন্দ ভৌতিক পুতুলটার। ‘জেরি সোনা, তুমি না পুতুলের মত সুন্দর!’

জেরির ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি। হাত বাড়ালাম ওর দিকে।

ওর মাথা ছুঁয়ে গেল আমার হাত। শক্ত কাঠ!

ওর মাথাটা এখন কাঠের পুতুলের!

আয়নার দীর্ঘ সারি থেকে উঁকি দিচ্ছে হ্যালি।

‘আমার শোয়ে তোমরা আর কে-কে যোগ দিতে চাও?’ রক্ত হিম করা হুঙ্কার ছাড়ল।

বাইশ

পুতুলটার অট্টহাসি ছড়িয়ে পড়ল সব কটা আয়না থেকে।

বেচারী জেরি দু’হাতে মাথা চেপে ধরল। কটাস করে মুখটা খুলে গেল ওর, কিন্তু স্বর ফুটল না।

সারা দেহে আমার ভয়ের স্রোত বয়ে গেল। কাঁচে পিঠ ঠেকিয়ে ধীরে-ধীরে লম্বা শ্বাস টানলাম।

এবার সন্ত্রস্ত ছেলে-মেয়েদের সারির ওপরে চোখ বুলিয়ে আনলাম।

রয় আর ডেমি ছায়ামানুষ। ইমন অদৃশ্যমানব। অ্যাণ্ডিনা আর নেলীর কাঁপুনি থামছেই না। আর জেরি ওখানে দাঁড়িয়ে, খোঁত- খোঁত করছে আর কাঠের মাথাটা ধরে টানাটানি করে যাচ্ছে।

ঠিক হরর ছায়াছবির মত, মনে-মনে বললাম। এবার নিজেকে শোধরালাম: না। এটা একসঙ্গে দশটা হরর সিনেমায় অংশ নেয়ার মত!

‘আমাদেরকে এখান থেকে বেরোতে হবে,’ হেঁকে বলল কিশোর। ‘সবাই ভাবো তোমরা!’

‘হ্যাঁ! মাথা খাটাচ্ছ না কেন, বাছাধনেরা?’ খেঁকিয়ে উঠল হ্যালি। ‘তোমাদের মাথা দরজায় জোরে-জোরে ঠোকো! হাহাহাহাহা!’

হ্যালি ক্রমেই আয়নায় মিশে গেলে হাসিটা অস্পষ্ট শোনাল। এরপর কে উদয় হলো দেখামাত্রই পিলে চমকে গেল আমার-অমঙ্গল।

কালো হ্যাটটা মুখের ওপর কাত করে রেখেছে। কালো শার্টের কলার তোলা। আয়নার সারিতে বারবার কালো এক চিহ্নের মত ফুটে উঠছে ও।

‘বাছারা আমার—’ গমগমে কণ্ঠে বলে উঠল, ‘তোমরা কিন্তু সাধ্যমত চেষ্টা করছ না।’

হ্যাটটা পেছনে সরাল, কিন্তু মুখ এখনও ছায়ায় ঢাকা। আইলের পেছনে চাইলাম। আমার দিকে পাল্টা তাকিয়ে ডজনখানেক অমঙ্গল।

‘বাছারা, ফিয়ার মিটার সবে মাত্র আশিতে উঠেছে,’ অভিযোগের সুর অমঙ্গলের গলায়। ‘আমি আরও বেশি আশা করেছিলাম তোমাদের কাছ থেকে।’

‘আমাদেরকে বেরোতে দিন!’ চিৎকার ছাড়ল রায়ান।

‘আপনি আমাদের এভাবে আটকে রাখতে পারেন না!’ টিনা গলা মেলাল। ‘আমাদের যেতে দিন! যেতে দিন!’ কয়েকটা ছেলে- মেয়ে চিল চিৎকার জুড়ল।

সবাইকে উপেক্ষা করল অমঙ্গল।

‘তোমরা ভাবছ আমি তামাশা করছি, তাই না?’ বলল। ‘দাঁড়াও…দেখাচ্ছি।’

পাঁই করে ঘুরে গেল মাথাটা ওর। অন্য মুখটা উদয় হলো। ‘আমার ওপর ছেড়ে দাও, এই অকর্মাগুলোকে কীভাবে ভয় দেখাতে হয় জানি আমি!’

এবার প্রথম মুখটা বোঁ করে ঘুরে সামনে চলে এল।

‘তুমি তো সবসময় বাড়াবাড়ি করে ফেলো। বাচ্চাগুলো তো ভয়েই মরে যাবে!’

অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। গির্জার ওই ছেলে- মেয়েগুলোর দুখী চেহারা ভেসে উঠল কল্পনায়। এবং সেই ভীতিকর শব্দগুলো: ফ্রাইটেড্ টু ডেথ, আতঙ্কে মৃত্যু।

‘বেশ…’ দস্তানামোড়া হাতে চিবুক ডলল অমঙ্গল। ‘যা ভাল বোঝো করো,’ অপর মুখটাকে উদ্দেশ্য করে বলল। ‘ক’জনকে মেরে ফেললে যদি ফিয়ার মিটার একশোতে ওঠে, তবে তা-ই সই। তোমাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিলাম…’

তেইশ

ক’জনকে মেরে ফেলবে?

ভয়ঙ্কর শব্দগুলো আমার পিঠ বেয়ে নেমে যাচ্ছে ভয়াল স্রোতের মত।

‘আপনি একটা পাগল!’ চিৎকার ছাড়ল রায়ান। আয়না চাপড়াল ডান হাতে।

কিশোর ওকে টেনে সরাতে চাইল। কিন্তু নিজের ওপর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে রায়ান।

‘আস্ত পাগল একটা! উন্মাদ! বদ্ধ উন্মাদ!’ আয়নাগুলোর ছায়াময় মুখটার উদ্দেশে গজাচ্ছে। এতটাই খেপেছে রায়ান, ওর ঘাড়ের রগ ফুলে উঠে দপদপ করছে। বারবার ঘুষি মারছে আয়নাটায়।

অমঙ্গলের চোখে নির্লিপ্ত দৃষ্টি। হ্যাটের নিচে, চোখজোড়া ওর যেন সরু ফাটল।

‘তুমি সাহসী ছেলে,’ রায়ানকে বলল। ‘বন্ধুরা তোমাকে দানব বলে জানি। তোমার কথা শুনেছি। আমার বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছ, তোমার দুঃসাহসের প্রশংসা করতেই হয়।’

এবার মাথাটা বন করে ঘুরে গেল।

‘এতটাই মুগ্ধ হয়েছি যে বমি পাচ্ছে!’ লাল মুখটা বলে উঠল ‘কিন্তু সত্যিই…এখানে আসলে পাগল কে?’ কোমল কণ্ঠে বলল প্রথম মুখটা। ‘আমি নই নিশ্চয়ই?’

‘আমাদের যেতে দিন!’ গর্জাল রায়ান। ‘আমি পরোয়া করি না, যদি—’ থেমে গেছে ও।

সাদা আলোর চোখ ধাঁধানো এক ঝলকানি আমাদের সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়েছে।

চোখ বুজে ফেললাম। আলোটা এতটাই তীব্র, আমার মাথা ভেদ করে বয়ে গেল যন্ত্রণার জ্বলন্ত এক ঢেউ।

ধীরেসুস্থে চোখ মেললাম। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আয়নাগুলোর দিকে।

সব কটা আয়না ঘুরতে শুরু করেছে। বনবনিয়ে ঘুরছে, এতটাই জোরে, আয়নার মুখটা একসময় ঝাপসা হয়ে গেল।

রায়ান হাঁ করল দীর্ঘ বিলাপধ্বনি করতে।

সব কটা আয়নায় এখন রায়ানের মুখ। কয়েক ডজন ঘূর্ণি প্রতিফলন। রায়ানের মুখ খোলা… আর্তনাদ করছে…প্রতিটা আয়নায় সক্রোধে রাগ ঝাড়ছে। আর্তচিৎকার করছে, চোখ বিস্ফারিত, চরম ক্ষোভে মুখের চেহারা বিকৃত, ঘুরছে ও…ঘুরেই চলেছে…

এবার আচমকা আয়নাগুলোর ঘোরা থামতেই আর্তনাদের শব্দটা মরে গেল। আঁধার ঘিরে ফেলল আমাদের।

নিস্তব্ধতা। লম্বা কামরাটায় আতঙ্কজনক নীরবতা।

একটু পরে, আলোগুলো উজ্জ্বল হলো। শ্বাস নিতে হাঁসফাঁস করছি। অন্যদেরকে মাথা ঝাঁকাতে দেখলাম। চোখ পিটপিট করছে, হতবিহ্বল সবাই।

এবার আমার দৃষ্টি স্থির হলো রায়ানের ওপর। সামনের আয়নাটায় চেয়ে রয়েছে ও, ঘন-ঘন চোখের পাতা ফেলছে।

এবং রায়ানের মাথার পেছনে…মাথার পেছনে…মাথার পেছনে…হৃৎপিণ্ড একটা স্পন্দন হারাল আমার।

রায়ানের মাথার পেছনে আরেকটা মুখ।

ঠেলে বেরিয়ে আসা চোখ আর লম্বা নাক নিয়ে ভয়াবহ এক দানবের মুখ। এবড়োখেবড়ো, চোখা দাঁত আর সরীসৃপের মত কালো চেরা জিভ।

আয়না থেকে রায়ানকে উঁকি মেরে দেখছে অমঙ্গল, ওর ছায়ামুখে অশুভ হাসি।

‘কী, এবার খুশি তো, পার্টনার? আর কোন নালিশ নেই তো?’

চব্বিশ

রায়ানের দ্বিতীয় মুখটা বিকট হাঁ করে দানবীয় গর্জন ছাড়ল।

আর্তনাদ ছাড়লাম আমি। সইতে পারছি না।

কয়েকটা ছেলে-মেয়ে বেরনোর দরজার কাছে পড়িমরি ছুটে গিয়ে পাগলের মত ওটায় কিল মারতে লাগল।

রায়ান আয়নায় দৃষ্টি রেখে, মাথা এপাশ-ওপাশ কাত করছে। চোখ আতঙ্কে ছানাবড়া, তবে মুখে টু শব্দটি নেই।

‘রায়ান, বাছা আমার,’ হেঁকে বলল অমঙ্গল, ‘দানবের মত কাজ করলে চেহারাটাও দানবের মত হওয়া চাই!’ হেসে উঠল ঠা- ঠা করে।

‘ভাল বলেছ!’ অমঙ্গলের অপর মুখটা বলল।

রায়ান অবিরাম মাথা ঘোরাচ্ছে। মাথার পেছনের দানব মুখটা পরখ করছে।

অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে দেখছে ওটাকে সামান্য দূর থেকে।

‘যেতে দিন আমাদের! যেতে দিন!’ চেঁচামেচি করছে ছেলে- মেয়েরা।

হ্যাটের ছায়ার আড়াল থেকে আমাদেরকে মাপছে অমঙ্গল। ‘খুব মজা পাচ্ছি, বাছারা,’ বলল। ‘ফিলিংটা দারুণ! হ্যাঁ, হেভি ফিলিংস! আরেকটু জোরে চেঁচানো যায় না?’

আয়নাগুলোতে ঝলমলে ফিয়ার মিটার। লাল দাগটার দিকে চাইলাম। ৯৫-এর কাছে লাফাচ্ছে।

‘আরেকটু!’ গর্জন ছাড়ল অমঙ্গল। ‘আমার সাধের পার্কটা ফিরে এসেছে প্রায়! আমার আর তর সইছে না!’

‘আমাদের কী হবে?’ ডেমি মুর জবাব চাইল। ছায়া থেকে কোমল স্বর ভেসে এল ওর। ‘আপনার পার্কটাকে ফিরিয়ে আনলে, আমরা কী পাব?’

মুখের ওপর হ্যাটের কানা আরেকটু টেনে নামাল অমঙ্গল। ‘জানতে চাও? সত্যিই জানতে চাও?’

সাঁই করে সামনে চলে এল লালচান।

‘এফটিডি!’ ঘাউ করে উঠল। ‘এফটিডি! এফটিডি!’

সংকীর্ণ আইলটা ধূসর আলোর বন্যায় ভেসে যেতেই সভয়ে শ্বাস চাপলাম। ক’মুহূর্ত পর টের পেলাম বাইরের দরজাটা খুলে গেছে।

আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে চেয়ে রইলাম খোলা দরজাটার দিকে।

‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে থেকো না তোমরা!’ অমঙ্গল বলে উঠল। ‘আমাকে অপেক্ষায় রাখলে কী হয় জানই তো।’

অপেক্ষায় রাখলে…

শেষবার যখন অমঙ্গলকে অপেক্ষা করানো হয়, ও সেই আবছায়াটিকে স্রেফ শুষে নিয়েছিল। শ্লথগতির কারণে ওকে খতম করে দিয়েছিল।

মনে পড়তেই কেঁপে উঠলাম। ও কি আমাদেরকেও অমন করবে? এবং এবার হঠাৎই মাথায় অন্য একরাশ চিন্তা ভিড় জমাল…আমরা জোর করে শান্ত থাকলে কী ঘটবে?

ফিয়ার মিটার ক্রমেই পড়ে গেলে কী করবে অমঙ্গল? আমাদেরকে ভয় দেখাতে না পারলে কি ছেড়ে দেবে? ও নিয়ে ভাবার সময় নেই। অমঙ্গলের দুটো মুখই এখন বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচাচ্ছে: ‘বাইরে যাও, ভয় পাও! সাঙ্ঘাতিক ভয় পাও! যাও! যাও! যাও!’

দরজা দিয়ে হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলাম আমরা। বাইরের ভুতুড়ে, মরাটে আলোয়।

‘আমাদের একটা লুকানোর জায়গা চাই!’ গর্জাল রায়ান। ওর দানবমুখটা নিচু খোঁত শব্দ করে উঠল।

‘রায়ান ঠিকই বলেছে,’ সায় দিল কিশোর। ‘আমাদের রিগ্রুপ করতে হবে। আমাদের-’

থেমে গেল ও। চোখ সরাসরি সামনে নিবদ্ধ। দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

ঘুরে দাঁড়ালাম। ভেন্ট্রিলোকুইস্ট পুতুলটাকে দেখলাম। হ্যালি-পরনে ওর ধূসর সুট আর লাল বো টাই।

পুতুলটা একাই দাঁড়িয়ে রয়েছে, হাঁটুজোড়া সামান্য ভাঁজ করে। বাহুজোড়া দুলছে দু’পাশে। সামনে কদম বাড়াতেই ওর রঙ করা ঠোঁটের হাসিটা যেন আরেকটু ছড়াল।

এবার রঙ্গমঞ্চে উদয় হলো অন্যরা। এক সারে এগোচ্ছে আমাদের উদ্দেশে—সেই কুৎসিত খলনায়কগুলো। ওরা এবার সঙ্ঘবদ্ধ। একসঙ্গে এগিয়ে আসছে…একটিমাত্র অশুভ শক্তিতে রূপ নিয়ে।

মুসার গা ঘেঁষে দাঁড়ালাম। আয়নাঘরের দিকে পিঠ দিয়ে আমরা সব ক’জন স্থাণু হয়ে গেলাম। আতঙ্কে জমে গেছি, আগুয়ান ভিলেনদের দেখছি নিঃশব্দে…

ড. স্নেকি, বিষাক্ত সাপটা, ফণা তুলে কটাস করে চোয়াল বন্ধ করল। সাদা ল্যাব কোট পরা গবেষক স্কেলিটনের বাহু পেঁচিয়ে রয়েছে ওটা।

বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্ন দেখছি যেন, কটা অতিকায় ডিম ফুটে সবুজ সরীসৃপের মত দানবরা টলতে-টলতে এগিয়ে আসছে আমাদের ধরতে…ক্যাপ্টেন সিলভার; পেভমেন্টে কেঠো পায়ের ঠক-ঠক শব্দ তুলে, তার কঙ্কাল জলদস্যুবাহিনীকে পেছনে নিয়ে যোগ দিয়েছে ওদের সঙ্গে।

কুৎসিত, ভৌতিক মুখোশটা বিড়বিড় করে কীসব আওড়াচ্ছে আর ভাসছে অন্যদের ওপরে। ওটার পাশে এক টলটলায়মান ক্ষয়িষ্ণু মমি। এবং ড. ক্রেজি, পতপত করে আলখিল্লা উড়িয়ে, সামনে ভেসে এল। ওর সবুজ পালকের বুটজোড়া বাতাসে লাথি ছুঁড়ছে।

পালাবার পথ নেই। পিছিয়ে গেলাম আমরা, যতক্ষণ না দেয়ালে পিঠ ঠেকল।

মুসা ফিসফিস করে আমার কানে-কানে বলল, ‘খাইছে, আমরাও আতঙ্কে মরতে চলেছি, ঠিক সেই গির্জার ছেলে- মেয়েগুলোর মত!

মুখ খুললাম, কিন্তু স্বর ফুটল না।

অ্যাণ্ডিনা আর নেলীকে দেয়ালের ওমাথায় দেখলাম। থরথর কাঁপুনি থামাতে পারছে না কোনমতেই। ডেমি মুর আর রয় ছাইরঙা মেঘের মত ভাসছে আমাদের সামনে। জেরি দু’হাতে ওর কাঠের মাথাটা চেপে ধরেছে। রঙ করা গালজোড়া বেয়ে অশ্রু গড়াচ্ছে দরদর করে।

গবেষক স্কেলিটন বলে উঠল, ‘বাহ, বাহ।’ হাতজোড়া পরস্পর ঘষে নিল। ওর দেড়েল মুখে ছড়িয়ে পড়ল ক্ষীণ, অশুভ মৃদু হাসির রেখা।

‘বাহ, বাহ, আমরা সবাই একসাথে। এবার শেষ অধ্যায়।’