হারানো সুর – ৩

তিন

সিম্ফনি ওদেরকে পেছনে নিয়ে লবিতে গেলেন। দেয়ালে বসানো এক কাঁচের কেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন।

ভেতরে বেশ কটা মিউযিক শিট, সেদিকে তর্জনী দেখিয়ে বললেন, ‘দেখো!’

‘দুর্দান্ত না?’ ওদের দিকে এতক্ষণ চেয়ে ছিলেন এক মহিলা, তিনি বলে উঠলেন।

কাগজগুলোর কোন বিশেষত্ব খুঁজে পেল না ডন। কথাটা বলতে গিয়েও চেপে গেল।

মুসা কাছিয়ে গেল ভাল করে দেখতে।

‘খাইছে, অসাধারণ,’ বলল ও।

মহিলা ওদের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়ালেন। সিম্ফনিকে দেখে মুখের চেহারা লাল হয়ে গেল তাঁর।

‘হায়, ঈশ্বর,’ অস্ফুটে বলে উঠলেন। ‘আপনি-আপনি মিস মেলানি?’

স্মিত হাসলেন সিম্ফনি।

‘হ্যাঁ,’ বললেন। ‘জানলেন কীভাবে?’

‘আমি-উম-আপনার ছবি দেখেছি,’ ব্যাখ্যা করলেন মহিলা। ভয়ানক নার্ভাস শোনাচ্ছে তাঁর কথাগুলো। ‘আমি মেরি হপকিন্স, বলে চললেন। ‘শহরে এক অ্যান্টিক স্টোর আছে আমার।’

মুচকি হাসলেন সিম্ফনি।

‘মোযার্টের এই স্কোরটা নিঃসন্দেহে এক দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিক,’ বললেন।

ফুটবল খেলায় স্কোরের কথা শুনেছে ডন, কিন্তু গান-বাজনার সঙ্গে এর কী সম্পর্ক কিছুই বুঝল না।

‘মোযার্টের স্কোর মানে কী, মুসাভাই?’ প্রশ্ন করল।

‘স্কোর মানে স্বরগ্রাম। বাজনার লিখিত পিস, ওটা থেকেই শিল্পীরা বাজান আরকী,’ মুসা খুলে বলল।

‘আর এটায় এমনকী মোযার্টের স্বাক্ষরও রয়েছে,’ বললেন

মেরি হপকিন্স। ‘এখানটায় দেখো। সুন্দর না?’

‘হ্যাঁ,’ রবিন রীতিমত চমকিত। ‘সত্যিই অপূর্ব।’

কারও নাম একটা কাগজে আছে তো এমন কী হলো, মনে- মনে বলল ডন। পায়ের পাতায় ভর দিয়ে উঁচু হলো ভালমত দেখার উদ্দেশ্যে।

‘কী নাম ওনার?’ বলল।

মুসা কম্পোজারের নামের শেষাংশের অক্ষরগুলো দেখাল ওকে।

‘মোযার্ট,’ বলল।

‘ব্যস, এটুকুই নাম?’ ডন প্রশ্ন করল।

‘আরও আছে,’ হেক্টর ক্রুসিয়ানির কণ্ঠস্বর গমগম করে উঠল। ‘তাঁর পুরো নাম জোয়ানেস ক্রিসোসটোমাস উগ্যাঙ গোটিলেব মোযার্ট।’

ডনের চোখজোড়া বিস্ফারিত।

‘বাব্বা, নাম বটে একখান!’ বলল।

হেসে উঠলেন হেক্টর।

‘ভাগ্যিস আমার নাম অতবড় নয়। তাহলে জীবনেও মনে রাখতে পারতাম না,’ বললেন। তারপর আবার একদিকে হাঁটা দিলেন, গুনগুন করতে-করতে।

‘কেউ তাঁকে পুরো নামে ডাকত না,’ মেরি হপকিন্স জুগিয়ে দিলেন। ‘সবাই চিনত উগ্যাঙ অ্যামাডিউস মোযার্ট নামে।’

‘এই অ্যামাডিউসটা এল কীভাবে?’ ডনের প্রশ্ন।

‘অ্যামাডিউস হচ্ছে গোটিলেবের লাতিন প্রতিশব্দ,’ ব্যাখ্যা করলেন সিম্ফনি। ‘তাঁর পরিবার হয়তো ওটাই বেশি পছন্দ করেছিল।’

‘আপনারা স্বরগ্রাম পেলেন কীভাবে?’ মেরি জবাব চাইলেন। ‘এটা তো বিরল জিনিস।’

‘সেজন্যে ধন্যবাদ প্রাপ্য ক্রিস গেইলের,’ জবাবে বললেন সিম্ফনি। ‘আমরা মোযার্টের বাজনা অনেক বাজাই। ক্রিস এক জাদুঘর থেকে আমাদের এই টুরের জন্যে অরিজিনাল স্কোরটা ধার করেছে।’

‘গোটা বিষয়টাই দারুণ রোমাঞ্চকর,’ বললেন মেরি হপকিন্স। এমনভাবে কাছে ঝুঁকলেন যেন গোপন কোন কথা বলছেন। ‘আমি অটোগ্রাফ কালেক্ট করি।’ হাতে ধরা খাতাটা মেলে ধরলেন। প্রতি পাতায় একটা করে স্বাক্ষর। ‘এটা জগদ্বিখ্যাত হেক্টর ক্রুসিয়ানির,’ সগর্বে বললেন। খাতাটা এগিয়ে দিলেন সিম্ফনির দিকে। ‘একটা অটোগ্রাফ দেবেন?’

অপ্রস্তুত সিম্ফনি পিছিয়ে গেলেন।

‘আমি?! আমার অটোগ্রাফ নিয়ে কী করবেন!’ বলে উঠলেন। ‘আমি তো বিখ্যাত কেউ নই।’

‘এক সময় হতেও তো পারেন,’ বললেন মেরি। ‘কে জানে। মোযার্ট কি জানতেন একদিন তাঁর জগৎজোড়া খ্যাতি হবে?’

সিম্ফনি খাতা-কলম নিলেন মেরির কাছ থেকে।

‘বেশ, আপনি এত করে যখন বলছেন,’ বলে, অটোগ্রাফ দিলেন।

মেরি হপকিন্স স্বাক্ষরটা দেখলেন। তর্জনী বোলালেন সইটার ওপর।

‘ধন্যবাদ,’ জানালেন।

পাল্টা ধন্যবাদ দিলেন সিম্ফনি।

‘আপনিই প্রথম কেউ যিনি আমার অটোগ্রাফ চাইলেন।’

মেরি আবারও মোযার্টের স্বরগ্রামটা নিরীখ করলেন।

‘এটা যেহেতু মহামূল্যবান জিনিস, চুরি যেতে পারে কিন্তু,’ বললেন। ‘সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে তো? কেউ দায়িত্ব নিয়ে দেখেশুনে রাখছে নিশ্চয়ই?’

সিম্ফনি শুধু বললেন, ‘ওটা সম্পূর্ণ নিরাপদ।’

‘আরি!’ হঠাৎই বলে উঠলেন মেরি। ‘ওই যে, ইয়ান অ্যাণ্ডারসন!’ অটোগ্রাফ বইয়ের সাদা পাতা মেলে রীতিমত ধেয়ে গেলেন তিনি।

‘ইয়ান অ্যাণ্ডারসন কে?’ ডনের প্রশ্ন।

‘উনি দেশের সেরা পারকাশনিস্ট,’ জানালেন সিম্ফনি। ‘পারকাশন? ড্রামের মত কিছু?’ রবিন জিজ্ঞেস করল।

সিম্ফনি হ্যাঁ-সূচক মাথা ঝাঁকালেন।

ডন ড্রাম পেটানোর ভঙ্গি করল।

‘ইস, আমি যদি বাজাতে পারতাম!’ বলল।

শব্দ করে হাসল কিশোর।

‘তুমি এমনিতেই আওয়াজের ওস্তাদ, ডন,’ ঠাট্টা করে বলল।

‘আনাড়ি কেউ বাজালে কান ঝালাপালা হয়ে যাবে,’ বললেন সিম্ফনি। ‘তবে ডন নিশ্চয়ই ভাল বাজাবে।’

ডন কিশোরের দিকে ‘কী বুঝলে’ গোছের চাউনি দিল। হেসে উঠল সবাই।

হাতঘড়ি দেখলেন সিম্ফনি।

‘হায়, ঈশ্বর,’ বলে উঠলেন। ‘আমিও তো দেখি হেক্টরের মত ভুলোমনা হয়ে গেছি। কাজের কথা বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছি। যাই। প্র্যাকটিস না করলে সোলো বাজাতে পারব না।’ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে, শীঘ্রি আবার দেখা হবে কথা দিয়ে, তড়িঘড়ি পা চালালেন।

ছেলে-মেয়েরা মোযার্টের স্বরগ্রামটিতে নজর ফেরাল।

‘ওই ভদ্রমহিলা এটাকে মহামূল্যবান বললেন কেন?’ সু কির জিজ্ঞাসা।

‘স্বরগ্রামটা অমূল্য,’ জানাল কিশোর।

‘কেন, কিশোরভাই?’ ডন জানতে চাইল। ‘এটা তো মিউযিকাল নোটসহ স্রেফ এক গোছা কাগজ।’

‘এটা অনেক পুরানো আর দুষ্প্রাপ্য জিনিস,’ বলল কিশোর। ‘মোযার্টের জন্ম ১৭৫৬ সালে, আড়াইশো বছরেরও বেশি আগে। তবেই বোঝো…’

‘বাপ রে!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল ডন।

‘মোযার্ট হচ্ছেন পৃথিবীর সর্বকালের সেরা কম্পোজারদের একজন,’ জানাল নথি। ‘আর এটা কপি নয়, তাঁর নিজের হাতে লেখা অরিজিনাল।’

‘খাইছে, তোমরা বিশ্বাসই করবে না তিনি প্রথম কত বছর বয়সে মিউয়িক লিখতে শুরু করেন,’ ডন আর সু কির উদ্দেশে বলল মুসা।

‘কত?’ ডন প্রশ্ন করল।

‘পাঁচ বছর বয়সে,’ মুসা বলল। ‘তাঁর মাথায় হয়তো তার আগেই মিউযিক কম্পোজিশন চলছিল।’

হতবাক ডন আর সু কি পরস্পর মুখ তাকাতাকি করল। মোযার্ট তখন ওদের চাইতেও ছোট ছিলেন!

স্বরগ্রামটা খুঁটিয়ে দেখতে ঝুঁকল ডন।

‘মোযার্ট পাঁচ বছর বয়সে এটা লেখেননি,’ বলল। ‘তাহলে কাটাকুটি থাকত। এটা তো একদম নিখুঁত।’

’মোযার্টের ভুল হত না,’ বলল মুসা। ‘মিউযিক তাঁর মন থেকে স্রেফ ঝরনার মত বয়ে যেত কাগজে।’

মাথা নাড়ল ডন।

‘আমি হলে কস্মিনকালেও পারতাম না,’ বলল। ‘আমার মনের মধ্যেও ভুল হয়ে যায়!’