দুঃস্বপ্নভূমি – ১

এক

আগাগোড়া কালো পোশাকে ঢাকা অমঙ্গলের দেহ। ওর শার্ট, টাই, প্যান্ট, জ্যাকেট আর জুতোজোড়া বেশি কালো। হাতে কালো দস্তানা, চওড়া কানাওয়ালা কালো হ্যাটের ছায়ায় পুরোপুরি ঢাকা পড়েছে ওর মুখখানা।

আমাদেরকে দীর্ঘ, অন্ধকার হল ধরে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেখলাম এখানকার দেয়ালগুলো ধূসর। প্লাস্টার ফেটে খসে পড়ছে। কোন জানালা নেই।

সুপ্রশস্ত, ফাঁকা এক চেম্বারে ঢোকার পর যাত্রা সমাপ্ত হলো আমাদের। পাথুরে মেঝেতে ঘষা খেয়ে জোরাল শব্দ তুলল আমাদের জুতো।

ধূসর দেয়ালগুলো নগ্ন। ওগুলো লম্বালম্বি উঠে গেছে এক ব্যালকনিতে, চেম্বারটা দেখা যায় যেখান থেকে।

কামরার সামনের দিকে এক মঞ্চ। আর এক পোডিয়াম। এবং কৃষ্ণবসন সেই লোকটি। মঞ্চের সামনে একটা চেয়ারও নেই। আমরা বিদঘুটে ভঙ্গিতে গাদাগাদি করে দাঁড়িয়ে রইলাম।

আমাদের পেছনে, দরজা আগলাচ্ছে ছায়ামানুষের দল। ওরা নীরবে অমঙ্গলকে দস্তানা পরা হাতজোড়া দিয়ে পোডিয়ামটা আঁকড়ে ধরতে দেখল।

‘বেশ, বেশ, বেশ…তোমরা খুব ভয় পেয়েছ দেখছি!’ বলল। উঁচু পাথরের দেয়ালগুলোতে বাজল ওর গমগমে কণ্ঠস্বর।

কিশোর মঞ্চের দিকে ধেয়ে গিয়ে গর্জে উঠল রীতিমত। ‘আপনি আমাদেরকে এখানে ধরে এনেছেন কেন? কী চান আপনি?’

শব্দ করে নিষ্প্রাণ, শীতল হাসি হাসল অমঙ্গল।

‘তোমার গলায় ভয়ের সুর শুনে খুব ভাল লাগছে!’ হুঙ্কার ছাড়ল। ‘ভাল! ভাল!’

পিছিয়ে গেল কিশোর। ডেমি মুরকে নিচুস্বরে কীসব যেন বলল। ছোটখাট গড়নের বারো বছরের ডেমি মেয়েটাকে বয়সের তুলনায় অনেক বাচ্চা দেখায়।

মুসা আর আমি ওদের পেছনে দাঁড়িয়ে। কিশোরের কথা শুনতে পাইনি আমি।

অমঙ্গলের কথাগুলো এখনও বাজছে আমার কানে। ওর কণ্ঠস্বর একইসঙ্গে গভীর আর কর্কশ শুনিয়েছে।

আমার ঘাড়ের রোম খাড়া করে দিয়েছে ওর হিমশীতল হাসিটা।

‘ভয়ে থরহরিকম্প হলে কেমন লাগে শুনি?’ প্রশ্ন করল। ‘আচ্ছা, বলো তো ভয়ে কি কেউ মারা যায়? যাকগে, বন্ধুরা আমার…আমরা তারই পরীক্ষা নিতে চলেছি!’

মুসা ফিসফিস করে বলল, ‘খাইছে, ও কি সত্যিই আসল, নাকি অমন সেজেছে?

জবাব দিতে গেলাম, কিন্তু কথা আটকে গেল গলায়। রয় গিলক্রিস্ট আর ওর বোন টিনা মঞ্চের কাছ থেকে গুটি-গুটি ক’পা পিছিয়ে গেল। বারবার চকিতে পেছনে চাইছে দরজাটার উদ্দেশে। সম্ভবত ঝেড়ে দৌড় দেবে কিনা ভাবছে।

জেরি হ্যালিওয়েল আর ওর বান্ধবী এমা বানটন চেহারা থেকে আতঙ্কের ছাপ লুকোতে পারেনি। বুকে বাহুজোড়া ভাঁজ করে, চোয়াল শক্ত করে দাঁড়িয়ে ওরা।

‘আমরা হররল্যাণ্ড থেকে পালিয়ে কিনা এখানে মরতে এলাম!’ মঞ্চের উদ্দেশে গর্জন ছাড়ল কিশোর। ‘অথচ বলা হয়েছিল আমরা এখানে নিরাপদ।’

‘নিরাপদ?’ উত্তর দিল অমঙ্গল। ‘আমার পার্কে কেউই নিরাপদ নয়!’ দু’হাতে পোডিয়াম চাপড়াল ও। ‘মনে হয় কেউ তোমাদের মিছে কথা বলেছে।’

ওর কথা শেষ হতেই শোরগোল উঠল। আমরা সবাই একসঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছি।

এবার কিশোর আর রায়ান হার্ভে কেটি আর ওর যমজ ভাই রবসনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কিশোর দু’হাত মুঠো পাকাল।

‘তোমরা আমাদেরকে মিথ্যে বলেছ!’ হুঙ্কার ছাড়ল। আমরা কেটি আর রবসনকে ঘিরে ফেললাম। সবাই ভয়ানক ক্রুদ্ধ।

‘তোমরা আমাদেরকে ভুলিয়ে ভালিয়ে প্যানিক পার্কে নিয়ে এসেছ,’ ডেমি বলল। ‘রবিন ঠিক কথাই বলেছিল-আমরা হররল্যাণ্ডেই ভাল থাকতাম। কিন্তু তুমি বলেছিলে ও মিথ্যে বলছে।

‘ভেবেছিলাম তোমরা আমাদের বন্ধু!’ ডেমির বান্ধবী রিনা ইস্টন কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল। ‘কেন করলে এমন?’

রায়ান হার্ভে দশাসই চেহারার শক্তিশালী ছেলে। ছোটখাট এক দানব যেন।

কেটির মুখের কাছে মুখ নিয়ে গেল ও।

‘তোমরা আমাদেরকে বোকা বানিয়ে এখানে নিয়ে এসেছ, ‘ ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল। ‘কারণ তোমরা দু’ভাই-বোন প্রথম থেকেই অমঙ্গলের হয়ে কাজ করছ। ঠিক কিনা বলো!’

‘না!’ চিৎকার করে উঠল কেটি। টলমল পায়ে পিছু হটল, সরে পড়ার চেষ্টায়। কিন্তু রায়ান ওর মুখের সামনে থেকে নড়ল না।

‘তোমার কথা ভুল!’ চেঁচিয়ে উঠল রবসন। ‘আমার বোনকে ছেড়ে দাও!’

‘আ-আমরা কখনওই অমঙ্গলের পক্ষে কাজ করিনি,’ তুতলে বলল কেটি, মুখের চেহারা লাল টকটকে। ‘এটা মিথ্যে কথা! মিথ্যে কথা!’

‘কিন্তু এটাই সত্যি!’ মঞ্চ থেকে গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে এল। ঢোক গিললাম। মস্ত কামরাটায় এখন পিন পতন নীরবতা। ‘এটাই সত্যি!’ যমজদের উদ্দেশে হেঁকে বলল অমঙ্গল।

‘বন্ধুদেরকে মিথ্যে বোলো না।’

‘কিন্তু…কিন্তু…’ তোতলাচ্ছে কেটি।

অমঙ্গল দস্তানামোড়া এক হাত তুলে থামাল ওকে।

‘তোমাদের বিশেষ ক্ষমতা কোত্থেকে এল? কাঠের ওই ভবিষ্যৎ বক্তার কাছ থেকে? মোটেই না। তোমরা ক্ষমতা পেয়েছ একমেবাদ্বিতীয়ম্ এই অমঙ্গলের কাছ থেকে!

‘না!’ চিৎকার ছেড়ে বারবার মাথা নাড়তে লাগল কেটি। ‘না! না!’

‘আমরা জানতাম না!’ চেঁচিয়ে উঠল রবসন। কিশোর, রায়ান এবং আমাদের সবার উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল ও। ‘বিশ্বাস করো, আমরা জানতাম না অমঙ্গলকে সাহায্য করছি!’

‘তোমরা দুটোই মিথ্যুক!’ গর্জে উঠল রায়ান।

‘না—’ ঝট করে মাথা নোয়ানোর চেষ্টা করল রবসন।

কিন্তু রায়ান দুম করে ঘুষি মেরে বসল ওর পেটে, তারপর পেড়ে ফেলল পাথুরে মেঝেতে। খোঁত-খোঁত শব্দ করছে, গোঙাচ্ছে, আমাদের পায়ের কাছে কুস্তি লড়তে লাগল দু’জনে।

‘থামো! থামো!’ আর্তনাদ ছাড়ল কেটি, গাল চেপে ধরেছে দু’হাতে।

‘চালিয়ে যাও! চালিয়ে যাও!’ গর্জাল অমঙ্গল, দস্তানামোড়া হাতে পোডিয়ামে দুমাদুম কিল মারছে। ‘এ ঘরে ভয়ের গন্ধ পাচ্ছি আমি!’

রায়ান শেষ ঘুষিটা মেরে, এক লাফে উঠে দাঁড়াল।

রবন হাত-পা ছড়িয়ে চিতিয়ে পড়ে রয়েছে, ককাচ্ছে আর পেট ডলে ব্যথা তাড়াতে চাইছে।

‘কী হলো? থামলে কেন?’ বলে উঠল অমঙ্গল। ‘এত মজা পাচ্ছিলাম!’ চোখ পিটপিট করে চেয়ে, ওর চওড়া কানাওয়ালা কালো হ্যাটের নিচে ঢাকা পড়া মুখখানা দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু দেখলাম শুধু ছায়া।

ওখানে কি সত্যিই কোন মুখ আছে?

অমঙ্গল এক হাত তুলে কামরার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা ছায়ামানুষদের উদ্দেশে দোলাল।

‘এদিকে এসো, আবছায়ারা। কেটি আর রবসনকে নিয়ে যাও।’

‘মানে?’ চেঁচিয়ে উঠল আতঙ্কিত কেটি।

‘ওদেরকে নিয়ে যাও,’ আদেশ করল অমঙ্গল।

‘ওরা খুব ভালভাবেই ওদের কাজ করেছে। কিন্তু…আমার আর ওদেরকে প্রয়োজন নেই।’

‘দাঁড়াও—’ চিৎকার করে উঠল রবসন। ‘কী বলছেন এসব?’

‘আমাদেরকে নিয়ে কী করতে চান?’ হাহাকার করে উঠল কেটি।

কিন্তু কেউই জবাব পেল না।

ছায়ামানুষেরা ওদেরকে ঘিরে ফেলল। মুড়ে দিল অন্ধকার চাদরে। তারপর মঞ্চের পেছনের এক সরু দরজা দিয়ে তাড়িয়ে নিয়ে ঘর ছাড়ল।

শিউরে উঠলাম আমি। দরজার ওপাশ থেকে এখনও শুনতে পাচ্ছি যমজদের আর্তচিৎকার।

অমঙ্গল পোডিয়ামের ওপর দিয়ে ঝুঁকল আমাদের উদ্দেশে।

‘কেমন ভয় পেলে?’ বলল ও। ‘ওহ্, আমার তো এখনও গা কাঁপছে। আত্মা উড়ে গেছে। তবে মজা তো এখনও শুরুই হয়নি!’

একটা শব্দ শুনলাম। ফিরে চাইতেই দেখি রয় গিলক্রিস্ট পাঁই করে ঘুরেই দৌড় দিয়েছে দরজা অভিমুখে, কঠিন মেঝেতে খট- খট আওয়াজ করছে ওর জুতো।

‘চলে এসো সবাই!’ চিৎকার করে ডাকল।

টিনা ওকে অনুসরণ করল।

‘থামো!’ চেঁচালাম আমি। ‘রয়-থামো!’

বিপদটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। রয় সম্ভবত ওসব পরোয়া করছে না।

দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে প্রায়, এসময় ছায়ামানুষদের একটা দল ভেসে এল ওর সামনে।

ওকে ঢেকে ফেলল ওরা। দীর্ঘ একটি মুহূর্ত আমরা দেখতে পেলাম না রয়কে। ছায়ার আড়ালে স্রেফ উধাও হয়ে গেছে ও।

শ্বাস আটকে অপেক্ষা করছি। এবার ছিটকে বেরোল ও-ছায়ামানুষদের ভেদ করে।

সবাই দেখলাম ওকে। দেখলাম কী হাল হয়েছে ওর।

কিন্তু ওর বোন টিনা সবার আগে গগনবিদারী চিৎকারটা ছাড়ল।

‘নাআআআ! হায়, হায়! আপনারা আমার ভাইকে এটা কী করেছেন?’

দুই

রয় থমকে দাঁড়িয়ে বোঁ করে আমাদের দিকে ঘুরল।

আর্তচিৎকার ছাড়লাম আমি। ওটা ঠেকাতে পারিনি কোনমতেই, আমরা সবাই আতঙ্কে চিৎকার-চেঁচামেচি করছি।

ছায়ামানুষেরা দোরগোড়ায় ফের ভেসে চলে গেল। রয় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল ওখানে, হাপরের মত ওঠা-নামা করছে বুক, বাহু দুটো দু’পাশে অসাড় ঝুলছে।

রয়ের মুখের চেহারা ধূসর, ছাইয়ের মত। ওর বাহুজোড়া…হাত… ছায়াময়। দেহটা কাঁপছে ধোঁয়ার মতন।

ওর নাক-মুখ-চোখ দেখতে পাচ্ছি না। কালো ছোপের আড়ালে ঢাকা পড়েছে! ছায়া। রয় এখন স্রেফ ছায়া।

‘ওকে কী করেছেন আপনারা?’ করুণ চিৎকার ছেড়ে ভাইয়ের কাছে ছুটে গেল টিনা। ‘রয়-তুমি ঠিক আছ? দেখতে পাচ্ছ? এখানে আছ তো?’

ঢোক গেলার মত কোঁত করে এক শব্দ বেরোল রয়ের গলা দিয়ে। চারপাশে বিভ্রান্তির দৃষ্টি বোলাচ্ছে। ওর কী দশা হয়েছে টের পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।

শেষমেশ, দু’হাত তুলে ও দুটোর দিকে চেয়ে রইল।

‘আ-আমি ছায়া হয়ে গেছি,’ তুতলে বলল। ‘বাপ রে, কী ঠাণ্ডা…আমাকে বাঁচাও, টিনা। ভীষণ ঠাণ্ডা লাগছে আমার, শরীরটা কেমন জানি লাগছে।’

‘খুব খারাপ কথা,’ মঞ্চ থেকে গলা ছাড়ল অমঙ্গল। জিভে আর টাকরায় চুক-চুক শব্দ করল। ‘খুবই খারাপ। আহা রে, রয় বাছা আমার দেখতে আগে কত সুন্দরই না ছিল…আর এখন…!’

ওকে আগের মত করে দিন!’ টিনার আর্তনাদ। ‘আমার ভাইকে আগের চেহারা ফিরিয়ে দিন!’

আমরা গলা মেলালাম ওর সঙ্গে।

‘আগের মত করে দিন! আগের মত করে দিন!’

অমঙ্গল দু’হাত তুলে আমাদেরকে শান্ত করতে চাইল। ‘আচ্ছা, ঠিক আছে,’ বলল ও। ‘কথাটা মাথায় রাখলাম। প্রথম সুযোগেই ওর আগের রূপ ফিরিয়ে দেব।’

ও ঠা-ঠা করে বরফশীতল হাসিটা হাসতেই শিরদাঁড়া বেয়ে হিমস্রোত নামল আমার।

গুঙিয়ে উঠল রয়।

‘কিন্তু…আমি তো আর আমি নেই! একদম হালকা হয়ে গেছি…মনে হচ্ছে বুঝি ধোঁয়ার মত উড়ে যাব।’

‘দারুণ বলেছ তো,’ অমঙ্গল বলল ওর উদ্দেশে। ‘তুমি ভাল কবিতা লিখতে পারবে, রয় বাছা। তবে তোমাকে একটা উপদেশ দিই। পরেরবার আমার আবছায়াদের কাছে এত সহজে ধরা দিয়ো না, অন্তত লড়ার চেষ্টাটা কোরো। আমি তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখতে চাই। কঠিন লড়াই। সত্যি বলছি।’

‘খাইছে, ও একটা বদ্ধ উন্মাদ!’ মুসা ফিসফিস করে আমার কানে-কানে বল।

‘আর শয়তান,’ যোগ করলাম আমি। ‘ও ভাবছে ওর রসিকতায় খুব মজা পাচ্ছি আমরা।’

‘ও এসবের থোড়াই পরোয়া করে,’ ফিসফিস করে বলল মুসা। তারপর শিউরে উঠল। ‘বেচারা রয়…’

রয়ের ধূসর কাঁধ আঁকড়ে ধরতে চাইল রায়ান, কিন্তু হাতটা ছেলেটিকে ভেদ করে চলে গেল। বুক ভরে দম নিল ও।

‘ভয় পেয়ো না,’ বলল। ‘আমরা তোমাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ঠিক ফিরিয়ে আনব।’

অমঙ্গলের উদ্দেশে ঘুরে দাঁড়াল ও।

‘চলো সবাই!’ গর্জাল। ‘ইচ্ছের বিরুদ্ধে আপনি আমাদেরকে এখানে আটকে রাখতে পারেন না!’

‘অবশ্যই পারি,’ বলল অমঙ্গল, পোডিয়ামে ঝুঁকল, ‘আমি যা খুশি তা-ই করতে পারি।’

‘আমরা বাসায় যাব—এক্ষুণি!’ ডেমি মুর মুখ খুলল। কণ্ঠে তীব্র তাচ্ছিল্য ঝরাল অমঙ্গল।

কোন ধারণা আছে বাসা থেকে কতটা দূরে তোমরা? হুঁশে ফেরো, বাছারা। তোমাদেরকে আমার অত বোকা মনে হয় না। আমি অমঙ্গল। আমি চাইলে তোমাদেরকে এখানে চিরদিন আটকে রাখতে পারি।’

হ্যাটটা চেপে বসাল মাথায়।

‘আমি যা খুশি তা-ই করতে পারি,’ আবারও বলল। ‘কারণ এই পুরো দুনিয়াটাই আমার!’

ছায়ামানুষেরা দোরগোড়া থেকে হর্ষধ্বনি করে উঠল। মনে হলো আনন্দধ্বনি নয়, কাতর গোঙানির শব্দ শুনলাম যেন।

অমঙ্গল ওদের উদ্দেশে মাথা নোয়াল।

‘ধন্যবাদ। আমার লোকেরা অন্তত জানে তাদের কী কাজ। আমার সব কথায় বাহবা দেয়া আর মুখ বুজে আদেশ পালন করা!’

‘আপনি আমাদেরকে এখানে কেন ধরে এনেছেন? কী চান আপনি?’ জবাব চাইল ডেমি মুর।

‘খুব সোজা, বাছারা আমার,’ বলল অমঙ্গল। ‘আমি তোমাদের ভয় পাওয়াতে চাই।’

‘কেন?’ চেঁচিয়ে উঠলাম। গলা কেঁপে গেল আমার। ‘আমাদের ভয় পাওয়াতে চান কেন?’

‘শীঘ্রি জানতে পারবে,’ উত্তর দিল ও। ‘এমন আর্তনাদ করবে তোমাদের গলা ভেঙে যাবে।’ এবার আমাদের দিকে ঝুঁকে এল। ‘কোন সমস্যা আছে তাতে?’

তিন

হতভম্বের মত ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে মুখ তুলে চেয়ে রইলাম।

প্যানিক পার্কে আমরা ইতোমধ্যেই বেশ কিছু আতঙ্কের নমুনা দেখেছি। ও কি আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে আরও অত্যাচার করতে চায়?

আমরা এ কোন্ ভয়ঙ্কর ফাঁদে পা রেখেছি?

মঞ্চের উদ্দেশে কাছিয়ে গেল কিশোর।

‘আমরা সবাই আগেও শয়তানের সাথে লড়েছি,’ অমঙ্গলকে বলল। ‘মুখোমুখি হয়েছি ভয়ানক সব ভিলেনের-এবং তাদেরকে কুপোকাতও করেছি।’

‘হ্যাঁ,’ বলল রায়ান। কিশোরের সঙ্গে আঙুলের গাঁটে গাঁট ঠুকল। তারপর চাইল অমঙ্গলের দিকে। ‘কালো কাপড় পরে শক্ত- শক্ত কথা বললেই আমরা ভয় পাব ভাবছেন? এই দেখুন, আমরা এখানে সতেরোজন-এবং কেউই আপনাকে ডরাই না।’

ভয়ে ঠকঠকিয়ে কাঁপার ভান করল অমঙ্গল।

‘ওরে, বাপ রে, আমার গা কাঁপছে রে।’

আমাদের পেছনে, হেসে উঠল ছায়ামানুষেরা-প্রাণহীন, গোমরানো হাসি।

দস্তানা পরা হাতজোড়া ঘষল অমঙ্গল।

‘তোমার সাহস আছে, রায়ান বাছা আমার। কিন্তু আগে অশুভর সাথে মোলাকাত হয়েছে তোমাদের? আমার তো মনে হয় না। সত্যিকারের ভয় কাকে বলে জাগই না তোমরা।’

দু’হাতে দুমাদুম কিল মারল পোডিয়ামে।

‘আমি বছরের পর বছর ধরে অশুভ ব্যাপারস্যাপার নিয়ে গবেষণা করেছি,’ বলল ও। ‘অনেক সাধনার পরে খাঁটি আতঙ্কের জন্ম দিয়েছি।’

মুহূর্তের বিরতি নিল। এবার মৃদুস্বরে বলল, ‘তোমরা নমুনা দেখতে চাও? প্রমাণ?’

মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামল আমার।

ও দরজা আগলানো এক আবছায়াকে ডাকল হাতছানি দিয়ে। ‘হোল্ডিং চেম্বারে যাও,’ আদেশ করল। ‘আমার নতুন ট্রফিটা নিয়ে এসো।’

ছায়ামানুষটি মুখহীন, ধূসর মাথাটা ঝাঁকিয়ে ধীর গতিতে সামনে ভেসে গেল। মঞ্চের কাছে পৌঁছে গেছে প্রায়, এসময় ওকে থামাল অমঙ্গল।

‘দাঁড়াও,’ শান্তস্বরে বলল। ‘তুমি বড্ড বেশি স্লো, জনাব। আমি কোন আদেশ দিলে আরও তাড়াতাড়ি পালন করতে হবে। সেজন্যেই ওটা হাতের কাছে রাখি।’

পোডিয়ামের পেছনে হাত বাড়িয়ে কালো এক নল তুলে নিল অমঙ্গল। ভ্যাকিউম ক্লিনার হোসের মত দেখতে জিনিসটা। নটা উঁচিয়ে তাক করল ছায়ামানুষটির উদ্দেশে। একটা বোতাম টিপতেই, শোঁ-শোঁ গর্জনের শব্দ শুনলাম।

‘না-দোহাই লাগে!’ আবছায়াটি আর্তনাদ ছাড়ল। ‘দয়া করুন!’

মাথাটা পেছনে ঝাড়া মেরে হা-হা করে হেসে উঠল অমঙ্গল। ভ্যাকিউমের গর্জন ছাপিয়ে শোনা গেল ওর হাসিটা।

আবছায়াটা দু’হাত তুলে আত্মরক্ষার চেষ্টা করল। পিছে সরে যেতে প্রাণপণ যুঝছে। কিন্তু ভ্যাকিউমটা মারাত্মক শক্তিশালী।

গর্জনশীল হোসটার ভেতরে ওর মাথা অদৃশ্য হয়ে গেলে সভয়ে চিৎকার করে উঠলাম। টিস্যু পেপারের মত ভাঁজ হয়ে গেল ওর কাঁধজোড়া-এবং ভ্যাকিউমের নযলের ভেতরে থপ শব্দে মিলিয়ে গেল।

এরপর ওর বাহু, বুক….এবং গোটা দেহ।

আমি দেখতে চাইনি। কিন্তু চোখ ফেরাতে পারলাম না ভয়ঙ্কর – দৃশ্যটা থেকে। একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম, আতঙ্কে কাঠ, যতক্ষণ না ওর পাজোড়া গিলে নিল হোসটা। এবং উধাও হয়ে গেল ও।

নিস্তব্ধতা।

আরেকটি আবছায়াকে হাতছানি দিল অমঙ্গল। ওটাকে আর কিছু বলতে হলো না। মঞ্চের পাশ দিয়ে রীতিমত উড়ে গিয়ে পেছনের দেয়ালের দরজাটা দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল।

বুক ধড়ফড়াচ্ছে আমার। ঝিমঝিম করছে মাথা।

অমঙ্গল ওই ছায়ামানুষটাকে কত সহজেই না খতম করে দিল। কাজটা করার সময় সে কী হাসি তার, এর চাইতে মজার যেন আর কিছু হয় না!

ও শক্তিশালী আর প্রাণঘাতী, ভাবলাম। এবং খুনে উন্মাদ। ব্যাটা কী চায় আমাদের কাছে? স্রেফ আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে মেরে মজা নিতে চায়? আমোদিত হতে চায় এসব করে?

দরজার দিকে ঘুরল অমঙ্গল।

‘নিয়ে এসো ওটা!’ গর্জাল। ‘আমার নতুন ট্রফিটা কই?’ ছায়ামানুষটির আবির্ভাব ঘটল দোরগোড়ায়।

চোখ পিটপিট করে দেখার চেষ্টা করলাম ওর হাতে কী, কিন্তু

আঁধারের কারণে কিছুই দেখলাম না।

আমাদের কাছে ভেসে আলোয় চলে এল ও। এবার ট্রফিটা উঁচাল।

চরম আতঙ্কে হাঁ হয়ে গেল আমার মুখ।

ওর হাতে কেটির মাথা!

চার

কাঁপা হাতে চোখজোড়া ঢাকলাম।

অন্যান্য ছেলে-মেয়েদের চিৎকার-চেঁচামেচি শুনতে পাচ্ছি। অবিশ্বাসের ফোঁপানী আর অস্ফুট আর্তনাদ কানে আসছে।

চোখ ঢেকে রাখলেও, পেছনে বাদামী চুলে ভরা কেটির মাথাটা ঠিকই দেখতে পাচ্ছি। কালো, বিস্ফারিত চোখজোড়া…আর হাঁ হয়ে থাকা মুখ।

‘না…না…না…’ আমার পাশ থেকে গুঙিয়ে উঠল ডেমি মুর। চোখ মেললাম। রিনাকে নুয়ে পড়ে বমি করতে দেখলাম মেঝেতে, অ্যাণ্ডিনা আর নেলি পরস্পরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে, গাল বেয়ে দরদর করে অশ্রু গড়াচ্ছে ওদের।

‘ভেবেছিলাম ট্রফিটা তোমাদের ভাল লাগবে!’ অমঙ্গল বলল। ‘জিনিসটা সুন্দর না? বাদামী চুলগুলো কী অপূর্ব!’

ছায়ামানুষটির হাত থেকে কেটির মাথাটা নিল সে। দীর্ঘ দু’মুহূর্ত চেয়ে রইল ওটার দিকে।

‘দেখলেই তো,’ বলল, চাইল আমাদের দিকে। ‘যা খুশি তা-ই করতে পারি আমি। যে কোন কিছু!’

মুসা কাছ ঘেঁষে এল, আমার কাঁধে হাত রেখে অভয় দিতে চাইল। বারবার ঢোক গিলে বমি ঠেকাতে চাইছে।

চুলের মুঠি ধরে কেটির মাথাটা উঁচাল অমঙ্গল।

‘জলদি ভাবো!’ হুঙ্কার ছাড়ল।

এবং মাথাটা আমাদের উদ্দেশে ছুঁড়ে মারল!

আমি তারস্বরে আর্তচিৎকার ছাড়লাম। মুসা মাথা নোয়াল।

ইমন আরমান মাথাটা লুফে নিল। তারপর চিৎকার ছেড়ে টলমল পায়ে পিছু হটল। আতঙ্কে ছানাবড়া চোখজোড়া ওর।

এবার কাছ থেকে দেখার পর অভিব্যক্তি পাল্টে গেল। ‘আরি!’ চেঁচিয়ে উঠল। ‘এটা তো রাবারের! আসল নয়!’ ছেলে-মেয়েরা সবিস্ময়ে শ্বাস চাপল। স্বস্তির দীর্ঘশ্বাস পড়ল আমার।

‘রাবার?’

অট্টহাসি হাসল অমঙ্গল।

‘এপ্রিল ফুল, বোকার দল। এর পরেরবার কিন্তু আর নকল নয়, আসল জিনিস দেখবে,’ বলল। ‘তবে সেই কুৎসিত মাথাটা কার হবে কে জানে!’

‘খাইছে!’ বলে উঠল মুসা। মুখের চেহারা ফ্যাকাসে।

‘কেন এসব করছেন?’ অমঙ্গলের উদ্দেশে গলা ছেড়ে জবাব চাইলাম। ‘কেন বাসায় যেতে দিচ্ছেন না আমাদেরকে?’

‘রবিন, তুমি বয়রা নাকি?’ পাল্টা শুধাল ও। ‘বলেছি না-তোমাদেরকে আমার এখানে আটকে রাখা দরকার? ভয়ঙ্কর আতঙ্কের বিরুদ্ধে তোমাদের টিকে থাকতে হবে। তোমাদের ভীতি সংগ্রহ করব আমি!’

এবার কামরার প্রবেশদ্বারে পাহারারত আবছায়াদের ডাকল হাতছানি দিয়ে।

কুয়াশার মত গড়িয়ে সামনে চলে এল ওরা।

দলটা আমাদেরকে ঘেরাও করতেই বাতাস হয়ে উঠল মৃত্যুশীতল। ঠাণ্ডায় রীতিমত কাঁপতে লাগলাম আমি।

এক আবছায়া আমার কবজিতে রুপোলী এক ব্রেসলেট পরিয়ে খুট করে লাগিয়ে দিল। উহ, চামড়ায় চেপে বসল ওটা।

‘ক্ব-কী এটা?’ তুতলে বললাম।

ব্রেসলেটের ধাতব খটাস-খটাস শুনলাম। সবাইকেই পরানো হচ্ছে।

‘ভয় পেয়ো না তোমরা,’ বলল অমঙ্গল। ‘অন্তত এখনই আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই!’

নিজের রসিকতায় নিজেই সশব্দে হেসে উঠল, এবং আবছায়ারা ওর সঙ্গে যোগ দিল, চাপা হাসি হাসছে।

‘ব্রেসলেটগুলো তোমাদের ভীতি মাপবে,’ জানাল অমঙ্গল। ‘যখনই তোমরা ভয় পাবে, ওগুলো গরম হয়ে চামড়ায় কাঁটার মত বিধবে। দারুণ না? এখনই খোঁচা টের পাচ্ছি আমি!’

কিশোর ওর ব্রেসলেট ধরে জোরসে টানল, কবজি থেকে টেনে খুলতে চাইছে।

‘ব্রেসলেট খোলার চেষ্টা কোরো না,’ অমঙ্গল বলল। ‘বেশি টানাটানি করলে কিন্তু পুড়ে শরীরের সাথে মিশে যাবে।’ পোডিয়ামের ওপর দিয়ে ঝোঁক দিল অমঙ্গল।

‘টানো, টানো,’ কিশোরকে বলল। ‘কাবাবের গন্ধ দারুণ লাগে আমার। তোমার লাগে না?’

ভ্রূকুটি হেনে, ব্রেসলেটটা ছেড়ে দিল কিশোর। শক্ত করে দু’মুঠো পাকিয়ে দু’পাশে ধরে রাখল।

‘বাহ, এই তো বুদ্ধিমানের কাজ,’ বলল অমঙ্গল। ‘এখন শো শুরু হোক, কেমন?’

পেছনে ছেলে-মেয়েদের সারির দিকে চেয়ে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল আমার। সবাইকে ফ্যাকাসে আর ভীতচকিত দেখাচ্ছে।

ইমনের হাতে এখনও শক্ত করে ধরা কেটির মাথাটা। ডেমি মুর জড়িয়ে ধরেছে রিনাকে। ভিভ রিচার্ডসের চোখ বোজা।

অমঙ্গল ওর পেছনের দরজাটার দিকে ঘুরল।

‘ফিয়ার মিটারটা নিয়ে এসো তো।’ গর্জাল।

ভারী কোন আসবাবপত্র সরানোর মত গুড়গুড় আওয়াজ পেলাম।

কামরায় ফিয়ার মিটারটা গড়িয়ে নিয়ে এলে শব্দটা জোরাল হলো। দেখতে অনেকটা গ্র্যাণ্ডফাদার ঘড়ির মত লম্বা আর সরু জিনিসটা।

চাকা বসানো মিটারটাকে ঠেলে নিয়ে যাওয়া হলো মঞ্চের সামনে। এবার যে কর্মীটি ঠেলছিল সে বেরিয়ে এল ওটার আড়াল থেকে।

পরমুহূর্তে, অস্ফুট বিস্ময়ধ্বনি বেরোল সবার মুখ দিয়ে। কর্মচারীটির বেগুনী পশমে ঢাকা শরীর আর মাথার হলদে শিং দুটোর দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম আমরা।

মিল্টন!