দুঃস্বপ্নভূমি – ১৫

পনেরো

তলপেট আঁকড়ে আসছে আমার। এলিভেটরের দরজার দিকে চেয়ে রয়েছি। কারও মুখে কথা নেই।

প্রতিটা মুহূর্ত এখন একেক ঘণ্টার সমান।

শেষমেশ, মৃদু এক গুঞ্জন শুনলাম-এবং দরজাজোড়া হড়কে খুলে গেল।

কয়েকটা ছেলে-মেয়ে আনন্দধ্বনি করে উঠল। হাসতে লাগলাম আমি। পাগলাটে, উত্তেজিত হাসি।

এলিভেটর থেকে তীরের মত ছুটে বেরোলাম। পাশাপাশি বেরনোর সময় আমাকে আরেকটু হলেই ল্যাং মেরে বসত মুসা, টলতে টলতে বেরিয়ে এল ও আমার সঙ্গে। ওখান থেকে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালালাম আমরা সবাই।

কোথায় আমরা? চারধারে চাইলাম।

বাইরে। ধূসর সূর্যালোকে চেয়ে রয়েছি। অমঙ্গলের অট্টালিকার পেছন দেয়ালের ছায়ায় দাঁড়িয়ে।

‘চলো,’ বলল কিশোর।

আর কিছু বলার দরকার পড়ল না ওর। দৌড় দিলাম আমরা। দালানটার কাছ থেকে যথাসম্ভব দূরে পালাতে চাই।

পার্কটায় ফিরলাম ছুটতে ছুটতে, আগের মতই বিষণ্ণ, ধূসর ওটার চেহারা। দূরে ফেরিস হুইলটা দেখতে পাচ্ছি, বিবর্ণ আকাশের বিপরীতে কালচে দেখাচ্ছে ওটাকে। মৃত, ফাঁকা দোকানগুলো পাশ কাটিয়ে ছুটছি…রাইডগুলো নিথর…খাবারের গাড়িগুলো পরিত্যক্ত।

‘আমরা যাচ্ছিটা কোথায়?’ ডেমি মুরের প্রশ্ন। ‘একটা প্ল্যান তো থাকা দরকার।

কেউ জবাব দিতে পারার আগেই, আমাদের সামনে ভেসে এল এক ছায়ামানুষ।

মেয়েটি এতটাই ধূসর আর ধোঁয়াটে, ক’মুহূর্ত লেগে গেল ওকে চিনতে। সেই ছোট্ট মেয়েটা। এখানে আসার পর যে ছোট মেয়েটির বিষাদময় ছায়া দেখেছিলাম আমরা।

ডেমির দিকে দু’হাত তুলে ধরল ও।

‘আমাকে খুঁজে নাও,’ মিহি, ফিসফিসে কণ্ঠে আওড়াল। ‘আমাকে দেখতে পাচ্ছ? দেখতে পাচ্ছ?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলল ডেমি মুর। হাত বাড়াল মেয়েটির দিকে। ওকে জড়িয়ে ধরতে গেল।

‘খুঁজে পেলে আমাকে?’ চেঁচিয়ে উঠল ছোট মেয়েটি।

আরেকটি ছায়া উদয় হলো এসময়। ছোট্ট আরেকটি মেয়ে। ‘আমাকে খুঁজে পাওনি? জানো আমি কোথায়? আমাকেও কি জড়িয়ে ধরতে পারবে? পারবে জড়িয়ে ধরতে?’

আরেকটি ছায়া ভেসে এল ওর পাশে। তারপর চার-পাঁচটি ছায়া ঘিরে ফেলল ডেমি মুরকে।

‘জড়িয়ে ধরো…বুকে টেনে নাও… টেনে নাও…’ সবাই ফিসফিস করছে।

ভীত-সন্ত্রস্ত ডেমি টলমল পায়ে পিছিয়ে গেল।

‘না, প্লিজ-’ শুরু করেছিল ও।

কিন্তু ছায়ামানুষরা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর উপরে।

‘জড়িয়ে ধরো…জড়িয়ে ধরো…জড়িয়ে ধরো…’

‘ডেমি-’ গলা ছেড়ে ডাকলাম। ওকে দেখতে পাচ্ছি না।

ফিসফিসানো আবছায়ারা ঢেকে ফেলেছে ওকে।

‘আমাকে খুঁজে পেলে?

‘আমাকে জড়িয়ে ধরলে?’

‘আমাকে বুকে টেনে নাও…নাও… প্লিজ! জড়িয়ে ধরো!’ ভারী চাদরের মতন ওকে মুড়ে ফেলল ওরা।

ভয়ে জমে গেছি আমি, ঘুরপাক খাওয়া ছায়ামানুষদের দিকে চেয়ে রয়েছি। ওরা সবাই কাতর অনুনয়-বিনয়, কাকুতি-মিনতি করছে।

এবং তারপরই চাপা কণ্ঠস্বরগুলো ছাপিয়ে শোনা গেল ডেমি মুরের আর্তচিৎকার।

‘বাঁচাও! বাঁচাও! ওদেরকে আমার ওপর থেকে সরাও! আমি শ্বাস নিতে পারছি না!’

ষোলো

কাঠপুতুল হয়ে গেছি। আবারও আর্তনাদ ছাড়ল ডেমি মুর।

আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছি, কিশোর, ইমন আর টিনা আবছায়াদের উদ্দেশে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ডেমির ওপর থেকে ওদেরকে সরাতে যুঝতে লাগল রীতিমত।

‘জড়িয়ে ধরো…জড়িয়ে ধরো…জড়িয়ে ধরো…. একটানা বলে চলেছে ওরা মন্ত্রোচ্চারণের মত।

ওরা তিনজন হাতের ঝটকায় সরিয়ে দিতে চাইছে ছায়ামানুষদের, টেনে সরাতে চাইছে ডেমির ওপর থেকে।

কিন্তু ব্যাপারটা যেন মেঘ খামচানোর মত। ছায়ামানুষদের ভেদ করে চলে যাচ্ছে ওদের হাত।

কিশোর, ইমন আর টিনা পিছু হটতে বাধ্য হলো, মাথা নাড়ছে অসহায় ভঙ্গিতে।

তখনও মন্ত্রপাঠ করে চলেছে, শেষমেশ ভেসে চলে গেল আবছায়ার দল। ছোট মেয়েটা গেল সবার পরে। মাথাটা পেছনে ঝাঁকি মেরে কুৎসিত চাপা হাসি হেসে উঠল।

তারপর ভেসে সরে গেল ও-ও-

-এবং আর্তচিৎকার ছাড়লাম আমি।

‘ওহ, নাআআআআ!’

আমাদের ভয়ার্ত দৃষ্টির সামনে ভাসছে ডেমির কালচে ছায়া। ও ছায়ামানুষ হয়ে গেছে, হারিয়ে গেছে…ও আর আমাদের মত স্বাভাবিক মানুষ নেই।

হাতজোড়া তুলে চেয়ে রইল মেয়েটি ওদুটোর দিকে।

‘না, না,’ বিড়বিড় করে বলল। ‘প্লিজ…না।’

রয় ভেসে চলে গেল ওর পাশে। একসঙ্গে দাঁড়াল দু’জনে। ধূসর দুটো ছায়া।

‘সব ঠিক হয়ে যাবে,’ সান্ত্বনা দিয়ে বলল রয়। মনে হলো বহু দূর থেকে শুনছি ওর কণ্ঠ। ‘আমরা আবার আগের মত হয়ে যাব, ডেমি, যখন এ পার্ক থেকে বেরোতে পারব।’ এবার ক্ষীণস্বরে যোগ করল, ‘আশা করি।’

কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘের ভেতরে, ডেমির ছায়াদেহটিকে কাঁপতে দেখলাম। নতমুখ।

‘একদম হালকা হয়ে গেছি, ঠিক পালকের মত,’ বলল ও। ‘তোমাদেরকে, ভালমত দেখতেও পাচ্ছি না। মনে হচ্ছে… তোমরা সবাই ঘন কুয়াশার ভেতর দাঁড়িয়ে আছ।’

‘ভয়ানক ঠাণ্ডা,’ বলল রয়। ‘গা কখনওই গরম হয় না। তবে একসময় নিশ্চয়ই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

নিজের বাহুজোড়া ঘষার চেষ্টা করল ডেমি।

‘গায়ে চামড়া আছে কিনা টের পাচ্ছি না!’ ফুঁপিয়ে উঠল ‘চামড়া নেই আমার গায়ে!’

রিনা কাছিয়ে গেল ডেমির উদ্দেশে।

‘তুমি আগেও অশুভর সাথে লড়েছ,’ বলল বান্ধবীকে। ‘তাকে পরাজিত করেছ। এবারও পারবে।

জবাব দিল না ডেমি মুর। বাহুজোড়া স্রেফ ডলে চলল, যেন ধোঁয়া রগড়াচ্ছে ধোঁয়াকে।

‘আরি!’ হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠলে ইমন। জেরি আর এমার উদ্দেশে নির্নিমেষে তাকিয়ে রয়েছে। ‘এইমাত্র একটা কথা মনে পড়ল,’ বলল ও।

ওর দিকে ফিরল মেয়ে দুটি। ওদেরকে আপন বোনের মত দেখায়। দু’জনের মাথাতেই তামাটে চুল, চোখের মণির রঙ বাদামী। এমা খানিকটা লম্বা আর গম্ভীর-ওকে অনেকটা বড় বোনের মত লাগে।

‘আমাদের ব্যাপারে বলছ?’ জেরি জিজ্ঞেস করল।

মাথা ঝাঁকাল ইমন।

‘তোমরা দু’জন ইতিমধ্যেই প্যানিক পার্ক থেকে হররল্যাণ্ডে গেছ,’ বলল ও। ‘মনে নেই? তোমরা গেম আর্কেডে এসেছিলে। আমি ওখানে ঝামেলায় পড়েছিলাম।’

জেরি চিবুক তুলে গভীর ভাবনায় মগ্ন হলো।

‘হ্যাঁ,’ বলল শেষ পর্যন্ত। ‘হ্যাঁ, একটু-একটু মনে পড়ছে…’

তোমরা হররল্যাণ্ডে ফিরেছিলে,’ বলল ইমন।

‘তোমরা, আমাকে সাথে করে প্যানিক পার্কে আনতে চেয়েছিলে।’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,’ বলে উঠল এমা। ‘আমার স্মৃতি….কী আজব কাণ্ড! মনে হচ্ছে সেই কবেকার কথা!’

‘কীভাবে গেছিলে ওখানে?’ জবাব চাইল ইমন। ‘ভালমত ভাবো। তোমাদের মনে করতেই হবে। প্যানিক পার্ক থেকে তোমরা বেরিয়েছিলে কীভাবে? সেরাতে কীভাবে গেছিলে হররল্যাণ্ডে?’

মেয়ে দুটির দৃষ্টি পরস্পরের ওপর স্থির। ওরা মন দিয়ে ভাবার চেষ্টা করছে, মনে করতে চাইছে।

‘অদ্ভুত,’ বিড়বিড় করল জেরি। ‘মনে পড়ছে না…’

‘আমারও,’ বলে, মাথা নাড়ল এমা। ‘আমরা কীভাবে গিয়েছিলাম হররল্যাণ্ডে?’

‘ভাবো,’ জোর তাগিদ দিল ইমন। ‘পারবে তোমরা মনে করতে পারবে।’

‘মনে পড়ছে…খুব বাতাস ছিল সেদিন,’ বলল জেরি। ‘বাতাস?’ এমা বলে উঠল। ‘হ্যাঁ, মনে হয় ঠিকই বলছ তুমি।

মাথার চুল উড়িয়ে নিচ্ছিল মনে পড়ছে। চোখ বুজে রেখেছিলাম। হ্যাঁ, প্রচণ্ড বাতাস ছিল।’

‘মনে আছে এক বাড়ির ভেতর দিয়ে হেঁটে যাই আমরা, ‘ জেরি বলল, গভীর একাগ্রতায় ভাবছে। ‘সাদা এক বিল্ডিং। অনেকটা ওটার মত।’

তর্জনী দেখাল। আমরা সবাই ঘুরে চাইলাম সমতল কালো ছাদের এক নিচু, সাদা বাড়ির দিকে। খোলা এক দরজার পাশে কালচে এক জানালা ওটার। সামনে কোন চিহ্ন চোখে পড়ল না। ভেতরে কী আছে কে জানে।

‘হ্যাঁ, ঠিক ওটার মতই,’ বলল জেরি। ‘যদ্দূর মনে পড়ে।’

‘আমরা কি ওটায় তল্লাশী চালাব?’ ইমনের প্রশ্ন।

সবাই নিরুত্তর। আমরা ইতোমধ্যেই পা চালাচ্ছি বাড়িটি অভিমুখে।

খোলা দরজাটার পাশে থামলাম সবাই। ভেতরটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। দেখা যাচ্ছে না কোন কিছুই।

‘এটা ছোট একটা বাড়ি, বলল কিশোর। ভ্রূ কোঁচকাল। ‘প্যানিক পার্কের মাঝখানে এমন একটা বাড়ি থাকবে কেন?’

‘তোমরা কি নিশ্চিত যে বাড়িটা দিয়ে পালিয়েছিলে সেটা দেখতে এরকমই?’ ইমন জবাব চাইল জেরি আর এমার কাছে।

কপাল কুঁচকে গেল জেরির।

‘আ…আমার তো…তাই মনে হচ্ছে…’ তুতলে বলল। মাথা ঝাঁকাল এমা।

‘মনে রাখা খুবই শক্ত। হয়তো…হয়তো অমঙ্গল আমাদের সমস্ত স্মৃতি গুলিয়ে দিয়েছে।’

‘ভেতরে যাই, চলো,’ বলল রায়ান। কাউকে তর্ক করার সুযোগ দিল না। দোরগোড়ায় পা রেখে গটগটিয়ে ঢুকে পড়ল ভেতরে।

আমরা অনুসরণ করলাম ওকে।

‘এটা ওয়েটিং রুম,’ অস্পষ্ট আলোয় চোখ সয়ে আসতেই বললাম আমি। কটা চেয়ার, একটা কৌচ, ম্যাগাজিনের স্তূপ নিয়ে এক টেবিল আর কাঁচের জানালার পেছনে এক রিসেপশন কাউন্টার দেখলাম।

কোন ডাক্তারের ওয়েটিং রুম।

পুরু ধুলোর আস্তরণ সব কিছুর ওপরে। টেবিল থেকে কয়েকটা পত্রিকা তুলে নিলাম। হলদেটে হয়ে এসেছে পাতাগুলো। সবগুলোই ১৯৭৪ সালের।

‘ওয়্যাক,’ গুঙিয়ে উঠল অ্যাণ্ডিনা।

দেয়ালের এক মাছের ট্যাঙ্কের দিকে চোখ ওর। ট্যাঙ্কের গোল্ডফিশগুলো স্রেফ হাড়-গোড় হয়ে গেছে-একপাশে কাত হয়ে ভাসছে ওদের কঙ্কাল।

‘খাইছে, এখানে বহু বছর কেউ আসেনি,’ মুসা নিচু স্বরে আওড়াল।

এসময় রিসেপশন ডেস্ক থেকে একটি কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল। ‘ডাক্তার এখুনি দেখবেন তোমাদের!’

মানে?

ওয়েটিং রুমে দুদ্দাড় করে এসে ঢুকল উদ্ভট সুপারহিরোর সাজে সজ্জিত এক লোক।

‘হায়, আল্লাহ,’ ভয়ার্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ইমন। ‘এ তো ডক্টর ক্রেজি!’

সতেরো

‘আ…আপনি আমাদের ফলো করেছেন হররল্যাণ্ড থেকে?’ ইমন চিৎকার ছাড়ল।

বাঘছালের আলখিল্লাটা পেছনে সরাল ড. ক্রেজি। ওর পরনে লাল-নীল টাইট্স আর লাল-সোনালী টপ। দস্তানা আর বুটজোড়া গাঢ় হলুদ।

লাল মুখোশটার আড়ালে বনবন করে ঘুরছে চোখজোড়া। ‘কিপারের হাত থেকে পালাতে পারবে ভেবেছিলে?’ হুঙ্কার ছাড়ল।

‘আপনি এখানে কী করছেন?’ জবাব চাইল ইমন। ‘আমাদের পিছু নিয়ে এসেছেন কেন?’

‘কারণ আমি ক্রেজি!’ হেঁড়ে গলায় বলল ও। মাথাটা পেছনে ঝটকা মেরে তীক্ষ্ণ, হায়েনার হাসি হাসল।

কিশোর বুক চিতিয়ে এগিয়ে গেল ক্রেজির উদ্দেশে।

‘আপনি এক্ষুণি বিদেয় হন।’ গর্জন ছাড়ল।

কিশোরের দিকে চেয়ে শয়তানী হাসি হাসল ক্রেজি। ‘কোন্ হাতে রুটিতে মাখন মাখাও?’ জিজ্ঞেস করল। ‘তার মানে?’ কিশোর চোখ পিটপিট করছে।

‘ডান না বাম, কোন্ হাতে রুটিতে মাখন লাগাও?’ জবাবের তোয়াক্কা করল না ড. ক্রেজি।

‘মজার ব্যাপার হচ্ছে,’ বলল, ‘আমি হাত দিয়ে না, বাটার নাইফ দিয়ে মাখন মাখাই!’ আবারও মাথাটা পেছনে ঝাড়া মেরে দীর্ঘ, চড়া হাসি হাসল।

‘আপনি একটা কমিক চরিত্র, আসল নন,’ বলে উঠল ইমন। ‘ভাগুন!’

‘তুমি আসল নও!’ কঠোর কণ্ঠে ঘোষণা করল ক্রেজি। ‘আমি চোখ বুজলেই তোমাকে অদৃশ্য করে দিতে পারি, তা জানো?’

‘বাজে কথা ছেড়ে, এই পার্ক থেকে কীভাবে বেরনো যায় সেটা বলুন, বলল কিশোর। ‘আমাদেরকে কী করতে হবে?’

‘মাথা নিচে পা ওপরে দিয়ে শিস বাজাতে পারবে? মুখ ভর্তি ক্র্যাকার নিয়ে?’ প্রশ্ন করল ক্রেজি।

ইমনের দিকে ফিরল কিশোর।

‘ও আমাদের কোন কাজে আসবে না। চলো, বেরোই এখান থেকে।’

‘কিন্তু আমি তো তোমাদের সাহায্য করতেই চাই,’ ড. ক্রেজি বলল, ঝটপট দরজা আগলাতে গেল। বাঘছালের আলখিল্লাটা পতপত করছে। হাত দিয়ে সরাল ওটা সামনে থেকে।

দেয়ালের কাছে গিয়ে এক ক্যাবিনেটের দরজা খুলল। ক্যাবিনেটের তাকে এক ফিয়ার মিটার রাখা। লাল দাগটা ৫০-এর একটু ওপরে চড়েছে।

জিভে চুক-চুক শব্দ করল ক্রেজি।

‘ভয়ের মাত্রা দেখো। তোমরা মাত্র অর্ধেকটা পথ পেরিয়েছ। ভয়ের চোটে নিশ্চয়ই খিদে আর তেষ্টা পেয়েছে তোমাদের। এসো আমার সাথে।’

‘আমরা আপনার সাথে যাব না-চলে যাব!’ হেঁকে বলল কিশোর। ওর সঙ্গে দরজা অবধি গেলাম। কিন্তু সবাই থমকালাম ছায়ামানুষদের দেখে।

অন্তত বারোজন। দরজার কাছে ভেসে থেকে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।

ওরা ছায়াময় বাহু বাড়িয়ে দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই নিমেষে মৃত্যুশীতল হয়ে উঠল কামরাটা। এবার নিঃশব্দে আমাদেরকে ঘিরে ঘুরপাক খেতে লাগল।

ত্বকে ওদের বরফশীতল ছোঁয়া টের পেলাম। পরমুহূর্তে, আঁধারের ভারী এক পর্দা নেমে এল আমার ওপরে।

ওরা আমাদেরকে চালাচ্ছে…হাঁটতে বাধ্য করছে…কুয়াশামাখা থাবায় বন্দি করেছে।

ছায়াগুলো সরে যেতেই শিউরে উঠলাম। ছোট এক ডাইনারের সামনে দাঁড়িয়ে আমরা। জানালা দিয়ে তাকাতেই সামনে এক সার টুল নিয়ে লম্বা এক লাঞ্চ কাউন্টার দেখলাম।

কাঁচের দরজার ওপরে ঝলসাচ্ছে ধূসর এক নিয়ন সাইন। সাইনে লেখা: ঝাঁকিগৃহ।

আবছায়ারা আমাদেরকে ভেতরে ঢুকতে বাধ্য করল। দরজাটা সশব্দে লেগে গেল পেছনে।

চারধারে চাউনি বোলালাম। সব কটা দেয়াল বিফবার্গার আর মিল্ক শেকের উঁচু-উঁচু গ্লাসের পোস্টারে ঢাকা।

লাল মুখোশের নিচে, চওড়া হাসি ফুটল ড. ক্রেজির মুখে। ‘সবাই এসেছ তো?’ চেঁচিয়ে বলল। ‘ওকে, শেক খাও!’ দরজার কাছে এক লিভার, ওটার কাছে গিয়ে টেনে নামাল।- নিচু গুঞ্জন শুনলাম। ক্রমেই জোরাল হলো গুঞ্জনধ্বনি। ‘আরিহ!’ মেঝেটা উঠে যাচ্ছে। না-দাঁড়াও। গোটা রেস্টুরেন্টটাই উঠছে।

দেয়ালগুলো যেই কাঁপতে শুরু করল, চিৎকার-চেঁচামেচি জুড়ে দিল সবাই। থরথর করে কাঁপছে মেঝেটা-ক্রমেই বাড়ছে কম্পনের মাত্রা।

ডাইনার বাঁয়ে হেলে পড়ল। ছেলে-মেয়েরা হুমড়ি খেয়ে দেয়ালের ওপর পড়ল। রায়ান আর নেলী ছিটকে পড়ে গেল মেঝেতে। আমি ভারসাম্য ধরে রাখতে যুঝছি প্রাণপণ।

কিন্তু কামরাটার অপর প্রান্ত দুলে উঠল। এবার গোটা ডাইনার প্রবলবেগে কাঁপতে লাগল।

আর্তনাদ ছেড়ে মুসাকে চেপে ধরতে গেলাম। কিন্তু দু’জনেই ধপাস করে পড়ে গেলাম মেঝেতে।

আমরা হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠে দাঁড়ানোর আগেই, ‘ঘরটা আচমকা কাত হয়ে গেল-এবং দেয়ালে আছড়ে পড়লাম আমরা।

নিরেট প্লাস্টারে আমার বাহু ঠুকে যেতেই আর্তচিৎকার বেরোল গলা চিরে। তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল বাহু…আর কাঁধে।

কামরার দুলুনির বেগ বাড়তেই তারস্বরে চিৎকার জুড়ল সবাই।

‘ভূমিকম্প!’ রিনা চেঁচিয়ে উঠল। আমার কাঁধ চেপে ধরল। আমরা তাল সামলাতে চাইছি। কিন্তু আরেকটা জোর ধাক্কায় কিশোর আর ভিভের গায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম আমরা।

ঘুরে চাইতেই দেখি, ড. ক্রেজি ঘর্ঘর শব্দ করা, কম্পমান মেঝের ওপরে নির্বিকারচিত্তে ভাসছে।

‘দুর্দান্ত একটা শেকের সাথে কোন কিছুরই তুলনা চলে না!’ হুঙ্কার ছাড়ল। তারপর তীক্ষ্ণ, কুৎসিত হাসিটা হাসতে লাগল।

‘ওহ্হ্!’ রায়ান আমার গায়ে ঢলে পড়তেই চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। পরমুহূর্তে, দু’জনেই আছড়ে পড়লাম দেয়ালে।

‘আমার হাতটা মনে হয় ভেঙে গেছে!’ বিলাপ করে উঠল কে যেন।

‘থামুন! আমার মাথা…ঘুরছে!’ নেলী চিৎকার করে উঠল 1 জোরাল আরেকটা ঝাঁকুনি-ওপরে আর নিচে-এবং আমরা মেঝের ওপর লাফাতে লাগলাম টেনিস বলের মত।

‘পেট গুলিয়ে উঠল। বমি পাচ্ছে।

মুখে হাত চাপা দিলাম। তলপেটের গা গোলানো অনুভূতিটা ঠেকাতে চাইলাম। এসময় আবারও দেয়ালে ঠুকে গেল মাথা।

হাঁটু ভাঁজ হয়ে গেল আমার। পরক্ষণে, থরথরিয়ে কাঁপতে থাকা মেঝেতে হাঁটুজোড়া ঠুকে গেল সজোরে।

‘থামান!’

‘প্লিজ! থামান!’

‘এভাবেই বল লাফায়!’ চেঁচিয়ে উঠল ক্রেজি। এবার মাথাটা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে কম্পনশীল ছাদের দিকে চেয়ে হাসতে লাগল খিলখিলিয়ে।

‘উম!’ দেয়ালে মাথা ঠুকে যেতেই আর্তনাদ ছাড়ল ভিভ। মেঝের ওপর লাফাচ্ছে ও, ব্যথায় চোখ বুজে, মাথা চেপে ধরে।

দেয়ালের বিপরীতে কাঁপছে, হাঁটু মুড়ে গেল অ্যাণ্ডিনার। মেঝের ওপর ঝুঁকে হড়হড় করে বমি করে দিল।

আমি এপাশ-ওপাশ টলছি। চোখ তুলে চাইতেই দেখি, ক্রেজি তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে।

‘ওহ!’ ওর কঠোর দৃষ্টির সামনে জোর ঝাঁকুনি খেলাম। এবং উড়ে চলে গেলাম পেছনে। কাউন্টারে ঠুকে গেল মাথা। সর্বাঙ্গে তীব্র বেদনা ছড়িয়ে পড়ল।

তারা দেখছি। সত্যিকারের তারা।

এবং পরমুহূর্তে, সব ঢেকে গেল সূচীভেদ্য আঁধারে।

আঠারো

‘রবিন-ওঠো! ওঠো!’

মুসার গলা পেলাম। বহুদূর থেকে আসছে যেন।

আস্তে-আস্তে চোখ মেললাম, গুঙিয়ে উঠলাম ব্যথায়। মুসা হাঁটু গেড়ে আমার পাশে বসা। হাতজোড়া আমার কাঁধে।

‘তুমি ঠিক আছ তো?’

‘ম…মনে হয়, কর্কশ, ফিসফিসে স্বর বেরোল গলা দিয়ে আমার।

উঠে বসলাম। ঘরটা ধীরে-ধীরে স্পষ্ট হলো চোখে। দুলুনি থেমেছে।

যন্ত্রণাকাতর ছেলে-মেয়েরা চারপাশে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে। হতভম্ব দেখাচ্ছে ওদেরকে। ভিভ তখনও দু’হাতে শক্ত করে মাথার ওপরটা চেপে ধরে রয়েছে। কিশোর নুয়ে পড়েছে কাউন্টারের ওপরে।

কামরার মাঝ বরাবর গা ঘেঁষাঘেঁষি করে উড়ে বেড়াচ্ছে ডেমি মুর আর রয়। এখনও ছায়ামানুষ ওরা, ফ্যাকাসে ধূসর, যেন নিভন্ত ক্যাম্পফায়ারের ক্ষীণ ধোঁয়া।

লাঞ্চ কাউন্টারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নেলী আর অ্যাণ্ডিনা। দু’জনেই ঠকঠক করে কাঁপছে।

ওদের দাঁতে দাঁত বাড়ি খাওয়ার খটাখট শব্দ পাচ্ছি। ‘কাঁপুনি…থা-থামাতে…পা-পারছি না!’ নেলী তো-তো করে বলল।

পরস্পরকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে রেখেছে মেয়ে দুটি। কিন্তু ওদের সারা দেহ এমনভাবেই কাঁপছে যেন আস্ত কামরাটাই পাগল হয়ে গেছে।

ড. ক্রেজি হো-হো করে হাসছে ওদের উদ্দেশে।

‘কাঁপা কাকে বলে দেখো!’ চিৎকার ছাড়ল। পরমুহূর্তে, ওর হাসি মুছে গেল। ‘ভয় পেয়ো না, মেয়েরা। মরে গেলে, দুই সপ্তাহের মধ্যেই দেখবে কবরে কাঁপাকাঁপি থেমে যাবে তোমাদের!’

অ্যাণ্ডিনা গোঙানীর শব্দ করল।

‘আমি…আমি…আমি…’ এতটাই কাঁপছে, কথা বলতে পারছে না।

হা-হা করে হেসে উঠল আবারও ক্রেজি।

এসময় টলমল পায়ে উঠে দাঁড়াল ইমন। দু’বাহু বাড়িয়ে ভারসাম্য ঠিক রাখতে চাইছে। স্খলিতচরণে এগোল ড. ক্রেজির উদ্দেশে।

‘আপনি একটা কমিক চরিত্র,’ ক্রুদ্ধ কণ্ঠে চেঁচাল। ‘আপনাকে ধ্বংস করার উপায় আমি জানি!’

আমার মনে হলো ও ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে।

ড. ক্রেজি দস্তানামোড়া তর্জনী তুলে নাক খুঁটল।

‘বাপ রে, ভীষণ ভয় লাগছে আমার!’ কপট আতঙ্কে বলল। ‘আমি না ভয় পেলে নাক খুঁটি!’

‘আমাদেরকে এখান থেকে বেরনোর ব্যবস্থা করে দিন,’ বলল ইমন। ‘আমাদের সাহায্য করুন-বিনিময়ে আপনাকেও বাঁচতে দেব!’

নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নাক খুঁটছে ক্রেজি, দৃষ্টি ধরে রেখেছে ইমনের ওপর।

‘নিজেকে কী ভাবো তুমি, অ্যাঁ?’ তাচ্ছিল্যের সঙ্গে বলল। ‘আমাকে যে শিল্পী সৃষ্টি করেছে তারও আমাকে ধ্বংস করার ক্ষমতা নেই। আর আমি নিজেও তো একজন শিল্পী, ইমনবাবু। এই দেখো।’ লাঞ্চ কাউন্টারের পেছনে চলে গেল ও।

হাত বাড়িয়ে ইয়াবড় এক পেইন্টব্রাশ টেনে নিল ও। ওটা নিয়ে গেল ইমনের কাছে।

‘আমি ব্রাশ দিয়ে কাজ করতে ভালবাসি,’ বলল। ‘ঠিক অন্য শিল্পীদের মত। দেখো, একজন আর্টিস্ট কীভাবে কাজ করে!’

ব্রাশটা বোলাল ইমনের মুখে এবং পলকে অদৃশ্য হয়ে গেল মুখটা।

সভয়ে ঢোক গিললাম, ক্রেজি যখন ব্রাশটা ইমনের গলায় আলতো হাতে বোলাল। এবার ওটা নেমে এল বুক সোজা।

প্রতি পরশে, ইমনের শরীরের খানিকটা করে অংশ স্রেফ উবে যাচ্ছে!

ক’মুহূর্তের মধ্যেই, ইমনকে পুরোপুরি মুছে দিল শয়তানটা। ‘কেমন লাগল?’ হেঁড়ে গলায় হাঁকল ড. ক্রেজি। ‘আমার শিল্পকর্ম পছন্দ হয়েছে তো? হাহাহাহাহা!’

ভয়াতুর দৃষ্টি মেলে চেয়ে রইলাম। ইমন যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল সেদিকে।

কিন্তু নিজেকে আর সামলানো গেল না। চিৎকার করে বললাম, ‘ইমন- তুমি কোথায়? আছ তো এখানে?’

এবার ঘুরে দাঁড়ালাম একান-ওকান হাসতে-থাকা ক্রেজির দিকে-এবং চেঁচিয়ে উঠলাম। ‘ওকে কী করেছেন আপনি?’

উনিশ

ড. ক্রেজি জবাব দিল না। ঠায় দাঁড়িয়ে পেইন্টব্রাশটা দোলাচ্ছে বাতাসে।

‘তোমরা আর কেউ আমাকে দিয়ে পোর্ট্রেট করাতে চাও?’ চিৎকার ছাড়ল। দৃষ্টি আমার ওপর স্থির।

ঘরের ভেতর এখন পিন পতন নীরবতা।

মেঝেতে ঠাস করে ব্রাশটা পড়ে যেতে দিল ক্রেজি। হেঁটে এল লাঞ্চ কাউন্টারের কাছে। ঝুঁকে ওটার পেছন থেকে কী যেন টেনে বের করল।

ফিয়ার মিটার।

গলায় শ্বাস আটকাল আমার। লাল দাগটা এখন ৭৫-এ উঠেছে।

পর্দার দিকে চাইল ক্রেজি।

‘খুব ভাল, বিড়বিড়িয়ে বলল। ‘কাজ হচ্ছে, বাছারা।’ এবার আমাদের উদ্দেশে উল্টো ঘুরল।

‘আমার এই ছোট্ট ডাইনারে ভয়ের অনেক উপকরণ ছিল। আমার কাজ আমি ভালভাবেই করতে পেরেছি। এখন বিদায়!’

আলখিল্লাটা পেছনে ছুঁড়ে দিয়ে তড়িঘড়ি বেরিয়ে গেল দরজা দিয়ে

‘ইমন? তুমি আছ এখানে?’ আবারও চেষ্টা করলাম।

‘আমাকে দেখতে পাচ্ছ না তোমরা?’ অস্পষ্ট, দূরাগত শোনাল ইমনের কণ্ঠস্বর। ‘আমি এখানেই, দেখতে পাচ্ছ না?’

এবার আর্ত গোঙানী বেরোল ওর মুখ দিয়ে।

‘ওহহহ। আমার হাত। হাত দেখতে পাচ্ছি না, আমি…’ কণ্ঠস্বরটি যেদিক থেকে আসছে সেদিকে নিশ্চুপে চেয়ে রইলাম। বুক ফাটা আহাজারি করছে ইমন।

‘ও আমার এ কী করে দিল?! নিজেকে দেখতে পাচ্ছি না আমি! কী করল এটা?’

‘তোমার কথা শুনতে পাচ্ছি আমরা,’ ইমনকে বললাম। ‘তুমি এখনও এখানে রয়েছ। তবে অদৃশ্য। দেখো আমরা তোমাকে ঠিক ফিরিয়ে আনব। একটু ধৈর্য ধরো।’

ডেমি আর রয় ভেসে চলে গেল ইমন যেখানটায় দাঁড়িয়ে ছিল। ছায়াময় মুখ দুটো ওদের মনের আতঙ্ক লুকোতে পারেনি।

‘নিজেদের দেখো!’ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। বাহু দোলাল কামরার চারপাশে। ‘অমঙ্গল আমাদের কী অবস্থা করেছে দেখো!’

কিশোরের দৃষ্টি অনুসরণ করলাম। ইমন অদৃশ্য। ডেমি মুর আর রয় স্রেফ ছায়ামানুষ। নেলী আর অ্যাণ্ডিনা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে রয়েছে, থরহরিকম্প দশা বেচারীদের।

ভিভ মাথা ঝাঁকাল।

‘আমরা এ পরিস্থিতিতেও বীরত্ব আর সাহস দেখাতে চাইছি, ‘ বলল, ‘কিন্তু…আমরা হয়তো শেষমেশ টিকতে পারব না। হার মানতেই হবে।’

‘আমাদেরকে টিকে থাকতেই হবে,’ জোর গলায় বললাম। ‘অমঙ্গল আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে চায়-ঠিক না?’

‘ঠিক,’ সায় জানাল রিনা। ‘অমঙ্গল চায় ফিয়ার মিটারে আমাদের আতঙ্কের মাত্রা ১০০-তে উঠুক। তাই আমাদেরকে ওর বাঁচিয়ে রাখতেই হবে। আমরা যেহেতু এখনও একশোতে পৌছইনি, ওর এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই। ও আমাদের বাঁচিয়ে রাখবে নিজের স্বার্থেই।’

‘কাউকে-কাউকে,’ আওড়াল ইমন।

‘ইমন, এভাবে বোলো না। হতাশ হলে চলবে না,’ বলল ডেমি। ‘বাঁচতে হলে প্যানিক পার্ক থেকে পালাতেই হবে আমাদের।’

অ্যাণ্ডিনা আর নেলীকে দাঁড়াতে সাহায্য করল কিশোর। পা ল্যাগব্যাগ করছে ওদের, দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হচ্ছে। দাঁতে দাঁত বাড়ি খেয়ে চলেছে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে টলমল করতে- করতে ক’পা এগোল।

শেক শ্যাক ছাড়লাম আমরা। পার্কের আকাশ যথারীতি নিখাদ ধূসর। আবছায়ারা বিদেয় হয়েছে। কাউকে আশপাশে দেখলাম না।

দল বেঁধে হাঁটছি আমরা। আরও কটা ফাঁকা দোকানপাটের পাশ কাটালাম…অন্ধকার আর সুনসান… এক গেম রুম…বর্ণহীন, ন্যাড়া গাছপালা নিয়ে ছোট্ট এক পার্ক।

রায়ান সবার সামনে। হঠাৎই থেমে দাঁড়িয়ে আঙুল নির্দেশ করল।

‘আরেকটা সাদা বাড়ি,’ বলল। জেরি আর এমার দিকে চাইল। ‘তোমরা কি ওটা থেকে পালিয়েছিলে?’

মেয়ে দুটি শ্রাগ করল।

‘হতে পারে।’

কাছিয়ে গেলাম আমরা। বাড়িটার কাঁচের জানালাটা মলিন, তাতে ধূসর আর কালো রঙের ছড়াছড়ি। দরজাটা ধনুক আকৃতির খিলানের মত।

‘গির্জা নাকি?’ বলল মুসা। ‘কিন্তু এখানে তো গির্জা থাকার কথা নয়।’

দরজার পাশে এক সাইন বলছে: দুঃখনিবাস।

একদৃষ্টে লেখাটির দিকে চেয়ে থেকে মাথা নাড়লাম আমরা। এর মানে কী?

জানার একটাই পথ।

খিলান পেরিয়ে খোলা দরজায় পৌঁছলাম সবাই। আরেকটি লম্বা, সরু কামরায় ঢুকেছি এখন আমরা। মাঝখানটায় সারকে সার কাঠের বেঞ্চি। দু’পাশে জ্বলতে-থাকা মোমবাতিগুলোই আলোর একমাত্র উৎস।

এসময় দূরের দেয়ালের কাছ থেকে গুরুগম্ভীর অর্গানের বাজনার শব্দ কানে এল। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার যন্ত্রসঙ্গীতের মত শোনাচ্ছে। গভীর নোটগুলো দেয়ালগুলোকে কাঁপাচ্ছে রীতিমত।

‘এটা কোন ধরনের গির্জা,’ মুসাকে বললাম ফিসফিস করে। ‘কেমন আজব!’

দেয়ালগুলো পরখ করতে আরেকটু কাছিয়ে গেলাম। ফটোগ্রাফ দিয়ে ঢাকা ওগুলো। সবই আমাদের বয়সী ছেলে- মেয়েদের ছবি।

ছোট-ছোট ফ্রেমবন্দি সারি-সারি ফটোগ্রাফ। প্রতিটা ছবির নিচে, নামের ছোট্ট এক ট্যাগ।

গির্জার আরও ভেতরে ঢুকে নামগুলো পড়লাম। জন আব্রাহাম…জনি ওয়াকার… অলিভিয়া নিউটন….হেমা রায়…

এবং প্রতিটা নামের নিচে, এফটিডি অক্ষরগুলো নজর কাড়ল।

‘খাইছে,’ পাশ থেকে বিড়বিড়িয়ে বলল মুসা, ‘এদের কাউকেই তো খুশি মনে হচ্ছে না।’

‘দেয়ালে ওদের ছবি লাগানো কেন?’ প্রশ্ন করলাম। ‘আর এফটিডি মানে কী?’

সহসাই সভয়ে শ্বাস চাপল রিনা। সংকীর্ণ গির্জাটিতে প্রতিধ্বনিত হলো শব্দটা।

‘কী হলো?’ জিজ্ঞেস করলাম।

দেয়ালে বাচ্চাদের এক সার ফটোর পাশে, রুপোলী এক ফলকে দৃষ্টিনিবদ্ধ ওর।

‘কী হয়েছে, রিনা?’

ফলকটা পড়ার সময় মুখে হাত চাপা দিল ও। এবার ঘুরে দাঁড়াল আমাদের উদ্দেশে।

‘এফটিডি মানে কী বুঝতে পেরেছি,’ অতিকষ্টে আওড়াল। ‘ভয়ঙ্কর ব্যাপার!’