দূর ভবিষ্যৎ (২০৭০ – ২১০০)

দূর ভবিষ্যৎ (২০৭০ – ২১০০)

পুঁজিবাদের উপর প্রভাব

এইসব নতুন প্রযুক্তিসমূহ যা এই বইয়ে আমরা আলোচনা করেছি সেগুলো এতই শক্তিশালী যে এই শতাব্দীর শেষে, এগুলো নিজেরাই পুঁজিবাদের উপর প্রভাব ফেলতে পারে। যোগান এবং চাহিদার সূত্র সবসময়ই একই থাকে কিন্তু বিজ্ঞান এই প্রযুক্তির উত্থান অ্যাডাম স্মিথের পুঁজিবাদ তত্ত্বকে নানাভাবে পরিবর্তিত করে, পণ্যদ্রব্য নিজেই সম্পদের প্রকৃতি অনুসারে ছড়িয়ে পড়ে। খুব দ্রুত যেসব বিষয় পুঁজিবাদকে প্রভাবিত করবে এর কিছু নিম্নে উল্লেখ করা হলো :

পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদ

অ্যাডাম স্মিথের পুঁজিবাদ চাহিদা ও যোগানে সূত্রের উপর ভিত্তি করে : যখন কোন পণ্য বা সেবার যোগান, চাহিদায় সাথে মিলে যায় তখন দাম নির্ধারিত হয়। যদি কোনো পণ্যের অভাব সৃষ্টি হয় এবং এর চাহিদা বাড়ে, তখন এর দাম বেড়ে যায়। কিন্তু ভোক্তাকে এবং উৎপাদনকারীদের আংশিক এবং অপূর্ণাঙ্গ ধারণা থাকে যোগান এবং চাহিদার বিষয়টি বোঝার এবং এ কারণে দাম একেক জায়গায় একেক রকম হয়। সুতরাং, অ্যাডাম স্মিথের পুঁজিবাদ তত্ত্বটি ছিলো অপূর্ণাঙ্গ। কিন্তু এটি ভবিষ্যতে নিয়মিত পরিবর্তিত হবে।

পূর্ণাঙ্গ পুঁজিবাদ হলো যখন উৎপাদনকারীরা ও ভোক্তারা বাজার সম্পর্কে অসীম জ্ঞান রাখবে যাতে করে মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া সঠিক হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভবিষ্যতে ভোক্তারা তাদের ইন্টারনেটের মাধ্যমে কন্টাক সেন্সের সাহায্যে এবং প্রচুর তথ্যসহ পণ্যের মূল্য, কর্মক্ষমতা বুঝতে পারবে সহজ। ইতোমধ্যে যেকেউ ইন্টারনেট ব্যবহার করে বিমানের ভাড়া সম্পর্কে সর্বোত্তমটি বেছে নিতে পারেন। এটি মূলত পুরো পৃথিবীতে পণ্য দ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে। এমনকি চোখের চশমা, দেয়াল স্ক্রীন, অথবা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভোক্তরা পণ্যটির সম্পর্কে জানতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ একটি মুদির দোকানে গিয়ে তখনই বিভিন্ন পণ্যদ্রব্য স্ক্যান করতে পারবে ডিসপ্লেতে এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে তোমার যোগাযোগ লেন্স তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করে দেবে যে পণ্যটির দাম নিয়ে দরাকষাকষি করতে হবে নাকি হবে না। এই সুবিধাটি ভোক্তাদের পক্ষে যাবে কারণ তারা একটি পণ্য সম্পর্কে সবকিছুই জানতে পারবে-এর ইতিহাস, এর কার্যকারিতার তথ্য, অন্যদের তুলনায় এর দাম কম না বেশি এবং এটির ভালো ও মন্দ দিকগুলো।

উৎপাদনকারীরাও এই তথ্য ব্যবহার করতে পারবে যেমন ভোক্তাদের চাহিদা ও প্রয়োজনীয় বিষয় কী কী সে সব তথ্য জেনে নিতে পারবে এবং ইন্টারনেটে স্ক্যানিং করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করতে পারবে। এটি অনেক ধারণামূলক কর্মকাণ্ড কমিয়ে দিবে মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়ায়। কিন্তু এসবের মধ্যে মূল বিষয়টি হলো ঐসব ভোক্তারা যারা এই সুবিধাটি নিয়েছেন, যাদের যেকোনো পণ্য সম্পর্কে তুলনামূলক দামের বিষয়ে তাৎক্ষণিক জ্ঞান আছে এবং কে কে সস্তা পণ্য খুঁজছেন এদের তথ্য উৎপাদনকারীরা জেনে নিতে পারবেন। পরবর্তীতে উৎপাদনকারীরা নিয়মিতভাবে ভোক্তাদের চাহিদার পরিবর্তনের সঠিক প্রতিক্রিয়া দেখতে পারবেন।

উৎপাদন প্রাচুর্যতা থেকে চাহিদা মোতাবেক পণ্য উৎপাদন

বর্তমানে, পণ্যদ্রব্য সৃষ্টি হয় উৎপাদনশীলতা থেকে। হেনরি ফের্ডের একসময়ের বিখ্যাত উক্তি ছিলো যে ভোক্তাদের যেকোনো রঙের মডেলটি থাকতে পারে এমনকি এটি কালো রঙেরও। গণউৎপাদনশীলতা প্রচুর পরিমাণে দাম কমিয়ে দেয় এবং অকার্যকর, পুরাতন সিস্টেমের শিল্পপণ্য ও হস্তশিল্প পণ্যকে বাজার থেকে দূর করে। কিন্তু কম্পিউটারের বিপ্লব এদের সবকিছু পরিবর্তন করে দেবে।

বর্তমানে, যদি কোনো ক্রেতা একটি পেশাক দেখে যা সঠিক রঙের এবং স্টাইলের কিন্তু আকার সঠিক নয় তাহলে তা আর বিক্রি হবে না। কিন্তু ভবিষ্যতে আমাদের থ্রিডি পরিমাপের মাধ্যমে এটি আমাদের ক্রেডিট কার্ড বা ওয়ালেটের মাধ্যমে কেনা হতে পারে। যদি কোনো পোশাক বা অন্য গামেন্টর্স ভুল পরিমাপে তৈরি হয়, তুমি ইমেইল করে তোমার পরিমাপ ফ্যাক্টরিতে জানিয়ে দেবে এবং সঠিক পরিমাপের একটি পোশাক তারা দ্রুত তৈরি করে দেবে। ভবিষ্যতে সবকিছুই হবে সঠিক।

গণ সঙ্গতিকরণ বর্তমানে অবাস্তব, যেহেতু এটি বেশ ব্যয়বহুল নতুন কোনো পণ্য একজনের জন্য তৈরি করা। কিন্তু যখন সবাই ইন্টারনেটে ঝুঁকে পড়বে, কারখানাগুলোসহ, চাহিদামতো তৈরি বস্তু তখন একই রকম দামে উৎপাদিত হবে যেমন গণউৎপাদনশীল পণ্যসমূহ তৈরি করা হয়।

উপযোগ হিসেবে গণ প্রযুক্তি

যখন প্রযুক্তিসমূহ বিশদভাবে ছড়িয়ে পড়বে যেমন বিদ্যুৎ এবং চলমান জল, সেগুলো সঙ্গতকরণে নিত্যব্যবহার্য উপযোগে পরিণত হবে। পুঁজিবাদের তত্ত্ব অনুসারে মূল্য কমে যাবে এবং প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি করবে, এসব প্রযুক্তি উপযোগের মতো বিক্রি হবে। তেমনটি হবে কোথা থেকে পণ্যটি এসেছে তা আমরা ভাবব না আমরা শুধু দাম পরিশোধ করব যখন আমরা ঐগুলো ব্যবহার করব। কম্পিউটেশনেও একই ঘটনা ঘটবে। “ক্লাউড কম্পিউটিং” যা ইন্টারনেটের উপর নির্ভরশীল বেশিরভাগ কম্পিউটিং কার্যসম্পাদন করার জন্য এগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ক্লাউড কম্পিউটিং কম্পিউটিংকে উপযোগে পরিণত করবে, যখন আমাদের প্রয়োজন হবে তখন শুধু মূল্য প্রদান করব। এবং কোনটি আমাদের দরকার নেই আমরা তা নিজেরাই চিন্তা করব।

বর্তমান সময় থেকে এটি ভিন্ন অবস্থা। যখন আমাদের বেশির ভাগ লোকজন টাইপিং, শব্দ প্রক্রিয়াকরণ অথবা অংকন করে একটি ডেস্কটপ বা ল্যাপটপকে এবং তারপর ইন্টারনেটে সংযুক্ত হয় যখন আমরা কোন তথ্য সন্ধান করি। ভবিষ্যতে, আমরা নিয়মিতভাবে কম্পিউটার যুগ থেকে মোটামুটি বাইরে চলে যাব, এবং সব তথ্যের জন্য সরাসরি ইন্টারনেট ব্যবহার করব যায় জন্য কেবল চার্জ প্রদান করব যতটুকু আমরা ডাটা ব্যয় করব। সুতরাং, কম্পিউটেশন, উপযোগের মতো মিটারে পরিমাণ করা হবে। পানি ও বিদ্যুৎ বিলের মতো আমরা এমন একটি বিশ্বে বাস করব যেখানে আমাদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আসবাবপত্র, পোশাক ইত্যাদি বুদ্ধিমান হবে এবং আমরা এদের সাথে কথা বলতে পারব যখন এগুলোয় প্রয়োজন হবে আমাদের। ইন্টারনেট স্ক্রীন লুকিয়ে থাকবে সর্বত্র এবং কিবোর্ড থাকবে থাকবে যখন আমরা চাইব। কার্যপদ্ধতি ‘পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সুতরাং, নির্মম হলেও সত্য, কম্পিউটার বিপ্লব প্রকৃতপক্ষে কম্পিউটারকেই অদৃশ্য করে দেবে ক্লাউড সার্ভিসের মাধ্যমে।

কাস্টমার চিহ্নিতকরণ

কোম্পানিগুলো ঐতিহাসিকভাবে নিউজপেপার, রেডিও, টিভি ইত্যাদিতে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে এমনকি প্রায়ই বিজ্ঞাপনগুলোর প্রভাব প্রতিক্রিয়া বিবেচনা না করেও। তারা কেবলমাত্র বিজ্ঞাপনের প্রতিক্রিয়া পরিমাপ করে বিক্রির উপর নির্ভর করে। কিন্তু ভবিষ্যতে, কোম্পানিগুলো ভবিষ্যতে সহজেই জানতে পারবে কতজন মানুষ তাদের পণ্যটি দেখেছে এবং ডাউনলোড করেছে। যদি তুমি কোন ইন্টারনেট, রেডিও সাইট এর সাক্ষাৎকার নেন উদাহরণস্বরূপ, এটি মোটামুটি নির্ধারণ করতে পারে সম্ভবত কতজন লোক তাদের দেখেছে। এটি কোম্পানিসমূহকে তাদের শ্রোতাদের টার্গেট করতে বিশেষভাবে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

যাহোক, এটি আরেকটি প্রশ্নে উত্থাপন করে

ব্যক্তিগত নিরাপত্তার সংবেদনশীলতা যা ভবিষ্যতে প্রচুর বির্তকের একটি হবে। অতীতে, একটি উদ্বিগ্নের কারণ ছিলো কম্পিউটার বিগ ব্রাদার সৃষ্টি সম্ভব করতে পারে। জর্জ ওয়েলের উপন্যাস ১৯৮৪ একটি স্বৈরাচারী শাসন পুরো পৃথিবী দখলে নেয়, একটি নারকীয় ভবিষ্যৎ বয়ে নিয়ে আসে সর্বত্র তার গোয়োন্দারা ক্রিয়াশীল থাকে, সব ধরনের স্বাধীনতা ধূলিস্যাৎ হয় এবং জীবন একটি অনিঃশেষ অধঃপতনের মধ্যে প্রতিত হয়। এক্ষেত্রে, ইন্টারনেট একটি সর্বত্র গমনকারী গোয়েন্দার মতো হতে যাচ্ছে। যাহোক, ১৯৮৯ সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাবার পরে, দ্য-ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন এই প্রতিক্রিয়াটি উন্মোচিত করেছে। প্রাথমিকভাবে একটি সামরিক প্রজেক্ট যা পরিবর্তিত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমনকি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেটওয়ার্কের আওতাভুক্ত হয়েছে যা ১৯৯০ এর দশকে একটি ইন্টারনেট বিস্ফোরণ ঘটায়। বর্তমানে বিগব্রাদার সম্ভব নয়। মূল সমস্যাটি হলো ‘লিটিল ব্রাদার’ যা খুব ব্যস্ত ব্যক্তি, কিছুটা অপরাধী, ট্যাবলয়েড নিউজ পেপার এবং এমন কর্পোরেশন না আমাদের ব্যক্তিগত সুবিধা বা পছন্দের তথ্যগুলো সংগ্রহ করে নিচ্ছে। পরবর্তী অধ্যায়ে আমরা যেমন এখানে একটি সমস্যা আছে তা হলো ইচ্ছা কখনো শেষ হয় না বরং সময়ের সাথে সাথে সৃষ্টি হয়। যেমন ধরা যেতে পারে একটি চিরন্তন ইঁদুর-বিড়াল খেলা সফটওয়ার নির্মাতাদের মাঝে যেমন কেউ একটি প্রোগ্রাম তৈরি করছেন নিরাপত্তা সংরক্ষণের এবং অন্য সফটওয়্যার নির্মাতা তা ভাঙ্গার প্রোগ্রামত তৈরি করছেন।

পণ্যকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ থেকে বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদ

যত দূর সম্ভব, আমরা শুধু যে বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন করছি- তা শুধুমাত্র কীভাবে প্রযুক্তি পুঁজিবাদকে পরিবর্তন করে পরিচালিত করে। কিন্তু উন্নত প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে একটি হাঙ্গামা সৃষ্টি হতে পারে পুঁজিবাদ তত্ত্বে এবং তা পুঁজিবাদের প্রকৃতিকে কিরূপ প্রভাব ফেলবে? সমস্ত হাঙ্গামা যা এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের মাধ্যমে সৃষ্টি হবে তা সংক্ষেপে একটি ধারণা দিয়ে প্রকাশ করা যায়: পণ্যকেন্দ্রিক পুঁজিবাদ রূপান্তরিত হবে বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদে।

অ্যাডাম স্মিথের সময়কালে— সম্পদ পরিমাপ করা হতো পণ্য বা সেবার মূল্যে। পণ্যের মূল্যের পরিবর্তন ঘটে কিন্তু সাধারণত গত ১৫০ বছর ধরে পণ্যের মূল্য ক্রমাগত কমে যাচ্ছে। বর্তমানে তুমি ইংল্যান্ডের রাজার মতো নাস্তা করতে পারছ যা ১০০ বছর আগে পারতে না। বিদেশি বিভিন্ন সুস্বাদু খাবার সারা পৃথিবীর সুপার মার্কেটগুলোতে নিয়মিত পাওয়া যায়। পণ্যদ্রব্যের এই দরপতনের জন্য বিভিন্ন বিষয় জড়িত; যেমন-বৃহৎ পরিসরে গণউৎপাদন ও সংরক্ষণ পদ্ধতি, পরিবহন, যোগাযোগ এবং প্রতিযোগিতা।

উদাহরণস্বরূপ, আজকের হাই স্কুলের ছাত্ররা পর্যন্ত ভাবে- কেন কলম্বাস ঝুঁকিপূর্ণ জীবন নিয়ে সময় কটিয়েছেন এবং পূর্বের দিকে বাণিজ্যের সহজ রাস্তা আবিষ্কারের চেষ্টা করেছেন? কেন তিনি সাধারণভাবে একটি সুপার মার্কেটে যাননি যেখানে তারা প্রশ্ন করতে পারে কিছু ওরেগানো পাওয়া যাবে? কিন্তু কলম্বাসের সময়ে, মসলা ও ঔষধি পণ্য প্রচুর ব্যয়বহুল ছিলো। তাদের ঐ সময়ে কোনো ফ্রিজ ছিলো না তাই তারা পচা গন্ধযুক্ত খাবার খেয়েও সন্তুষ্ট থাকত। এমনকি ঐ সময়ে রাজা এবং সম্রাটদেরও রাতে বাসি খাবার খেতে হতো। তখন কোনো শীতল গাড়ি ছিলো না, কন্টেইনার ছিলো না, অথবা জাহাজ ছিলো না যে সমুদ্র পাড়ে দিয়ে দূর দূরান্ত থেকে মসলা সংগ্রহ করবে তারা)। এসব কারণে পণ্যদ্রব্যের মূল্য খুব বেশি ছিলো যা কলম্বাসকে এসব জিনিসের খোঁজে নামিয়ে তার জীবনকে কষ্টকর করেছিলো। যদিও আজ সেসব পণ্য মাত্র কিছু পয়সা দিয়েই কেনা যায়।

যা পণ্যভিত্তিক পুঁজিবাদকে বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদে পরিণত করবে? বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদ ঐসব বিষয়ের সাথে জড়িত যা রোবট এবং কৃত্রিম বুদ্ধি সম্পন্ন যন্ত্রপাতির দ্বারা পাওয়া সম্ভব নয়, প্যাটার্ন শনাক্তকরণ এবং সাধারণ জ্ঞান।

এমআইটির অর্থনীতিবিদ লেস্টার থ্রোব এর মতে, “বর্তমানে, জ্ঞান এবং দক্ষতা একসাথে যা তুলনামূলক সুবিধার উৎস… সিলিকন ভ্যালি এবং রুট ১২৮ যেখানে সাধারণ মস্তিষ্কের শক্তির অবস্থান যেন তাদের কিছু নেই তাদের জন্য চাওয়ার।” কেন এই ঐতিহাসিক রূপান্তর পুঁজিবাদের ভিত্তিকে নাড়া দিচ্ছে? খুবই সাধারণ উত্তর মানুষের মস্তিষ্ক প্রচুর উৎপাদিত হতে পারে না। কিন্তু হার্ডওয়্যার প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং টনকে টন বিক্রি হয়। মানুষের মস্তিষ্ক পারে না মানে হলো সাধারণ জ্ঞান হবে ভবিষ্যতের মুদ্রা। পণ্যদ্রব্যের মতো বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিকে তোমার যত্ন নিতে হবে, চাষ করতে হবে, এবং কেননা মানুষকে শিক্ষা দিতে কয়েক দশক লাগে একজন মানুষের পক্ষে।

থ্রোব বলেন, “প্রতিযোগিতার সমীকরণে সবকিছুই হারিয়ে যায়, শুধু জ্ঞান হলো টেকসই সুবিধা অর্জনের একমাত্র উৎস।”

উদাহরণস্বরূপ, সফটওয়্যার ক্রমাগতভাবে হার্ডওয়্যারের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কম্পিউটার চিপ এর দাম কমে ট্রাকে ট্রাকে বিক্রি হবে পানির মতো দামে কিন্তু সফটওয়্যার পুরাতন ফ্যাশনেই চলবে যেমন একজন মানুষ পেন্সিল এবং কাগজ নিয়ে কাজ করে একটি চেয়ারের উপর বসে শান্তভাবে। উদাহরণস্বরূপ, তোমার ল্যাপটপে ফাইল সংরক্ষণ করা যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনা, পান্ডুলিপি এবং তথ্যের সম্ভার যার মূল্য হয়তো কয়েক শত শত হাজার ডলার, কিন্তু তোমার ল্যাপটপের মাত্র কয়েক শত ডলার মূল্য। অবশ্যই, সফটওয়্যার সহজে কপি করা যায় এবং প্রচুর উৎপাদনও করা যায় কিন্তু নতুন কোন সফটওয়্যার তৈরি করা বেশ কঠিন। এটির জন্য প্রয়োজন মানুষের গভীর চিন্তা।

ইউকে এর অর্থনীতিবিদ হামিশা এমসিরয় এর মতে, “১৯৯১ সালে ব্রিটেন দেশ হিসেবে সেরা রপ্তানিতে প্রথম হয় যা দৃশ্যমান সেবা থেকে অদৃশ্যমান সেবার পরিমাণ থেকে বেশি আয় করেছিলো।”

যেখানে ইউএস এবং অর্থনীতিতে উৎপাদনশীল খাতের শেয়ার গত কয়েক দশক ধরে দ্রুতগতি কমে যাচ্ছে, কিন্তু বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদের খাতে (হলিউড মুভি, সঙ্গীত শিল্প, ভিডিও গেম, কম্পিউটার, তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি ইত্যাদি) বাড়ছে। পণ্যভিত্তিক পুঁজিবাদ থেকে বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদে রূপান্তর একটি নিয়মিত ঘটনা যা গত শতাব্দীতে শুরু হয়েছে এবং প্রতি দশকেই তা বেড়ে চলেছে। এমআইটির অর্থনীতিবিদ থ্রোব লিখেছেন, “সাধারণ মুদ্রাস্ফীতি সঠিক করার পরে, প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ মোটামুটি ৬০ শতাংশ কমে গেছে ১৯৭০ এর মাঝ থেকে ১৯৯০ এর দশক পর্যন্ত।

কিছু দেশ বা জাতি এটি বুঝতে পেরেছে। জাপানের কথা ধরা যেতে পারে। গত শতকে জাপানের কোনো বড় ধরনের প্রাকৃতিক সম্পদ নেই। কিন্তু দেশটি বিশ্বের বড় অর্থনীতির একটি দেশ। বর্তমানে জাপানের মূল সম্পদ হলো তাদের পরিশ্রম এবং জনগণের একতা, জমির নিচে তাদের সম্পদের চেয়ে

দুর্ভাগ্যক্রমে, অনেক দেশ বা জাতি এই মৌলিক বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে এবং তাদের জনগণকে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারেনি; তারা কেবল পণ্যদ্রব্য ভিত্তিক অর্থনীতির উপর নির্ভরশীল। এর মানে হলো যেসব দেশ বা জাতি ধনী হয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদে কিন্তু এই নীতি বুঝতে পারছে না তারা ভবিষ্যতে দারিদ্র্যের মধ্যে পতিত হবে।

ডিজিটাল বৈষম্য

কিছু মানুষ তথ্য বিপ্লবের সমালোচনা করেন এই বলে, আমরা কি ডিজিটাল ধনী এবং ডিজিটাল গরিব সৃষ্টি করছি যে যারা কম্পিউটার ব্যবহার করছে আর যারা ব্যবহার করছে না। এই বিপ্লব তাদের মতে সমাজে একটি প্রশস্ত ফাটল সৃষ্টি করবে, নতুন বৈষম্য সৃষ্টি করবে সম্পদের ক্ষেত্রে এবং অসমতা সৃষ্টি করবে যা সমাজের জালকে ছিঁড়ে ফেলতে পারে।

কিন্তু এটি একটি সত্য সমস্যার ক্ষুদ্র চিত্র। প্রতি আঠারো মাসে কম্পিউটার শক্তি দ্বিগুণ হয়, এমনকি গরিব মানুষেরা পর্যন্ত কম্পিউটার ব্যবহার করার সুযোগ পাচ্ছে। সদৃশ্যপূর্ণ চাপ এবং সস্তা দামের কারণে কম্পিউটার ও ইন্টারনেট গরিব শিশুদের দ্বারাও ব্যবহৃত হচ্ছে। এমনকি পরীক্ষায়, প্রত্যেক ক্লাসরুমের জন্য একটি করে ল্যাপটপ কেনার জন্য অনুদান দেওয়া হচ্ছে। সুদূর চিন্তার অভাবে, এই প্রোগ্রামটি ব্যর্থ হয়। প্রথমত, ল্যাপটপ এক কোণে পড়ে থাকত ব্যবহৃত না হয়ে কারণ শিক্ষকেরা জানত না এটি কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বন্ধুদের সাথে অনলাইনে সংযুক্ত তাই তারা সাধারণত ক্লাসের ল্যাপটপ ব্যবহার করতে উৎসাহী ছিল না।

সমস্যাটি ব্যবহার সুবিধার নয় বরং মূল সমস্যা হলো চাকরি। চাকরির বাজার এটি ঐতিহাসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং ঐসব জাতি ভবিষ্যতে ভালো করবে যারা এই সুবিধাটি গ্রহণ করবে।

উন্নয়নশীল জাতিগুলোর জন্য, একটি কৌশল হলো পণ্যদ্রব্য ব্যবহার করে একটি শক্ত ভিত্তি গঠন করা এবং পরবর্তীতে বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদ এই রূপান্তরের জন্য ধীরে ধীরে পদক্ষেপ গ্রহণ। উদাহরণস্বরূপ, চীন এই সুপদক্ষেপটি সুন্দরভাবে আয়ত্ন করেছে : চীন প্রথমে হাজার হাজার কারখানা স্থাপন করেছে পণ্যদ্রব্য উৎপাদনের জন্য বিশ্ব বাজারের জন্য কিন্তু তারা এর থেকে যে লাভ করছে তা আবার বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদের পিছনে বিনিয়োগ করছে। আমেরিকায়, ৫০ শতাংশ পদার্থবিজ্ঞানের পিএইচডির ছাত্র বিদেশী জাতীয়তার। মোটা দাগে আমেরিকা এদের নিজস্ব নাগরিকদের মধ্য থেকে পিএইচডি করার মতো ছাত্র তৈরি করছে না)। এই বিদেশি পিএইচডি রত ছাত্ররা বেশিরভাগ চীন এবং ভারতের। তাদের অনেকে নিজেদের দেশে ফিরে গিয়ে সম্পূর্ণ নতুন নতুন কারখানা স্থাপন করছে।

প্রবেশ স্তরের চাকরি

প্রবেশ স্তরের চাকরিগুলো রূপান্তরিত হয়ে যাবে। প্রত্যেক দেশ নতুন নতুন প্রযুক্তির চালু করছে যা অর্থনৈতিক স্থানান্তর ঘটছে এবং মানুষের জীবনের পরিবর্তন আনছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৮৫০ সালে, ৬৫ শতাংশ আমেরিকার শ্রমিকেরা কারখানায় কাজ করতো (বর্তমানে মাত্র ২.৪ শতাংশ কাজ করে)। এই শতাব্দীতেও এটি সত্য।

১৮০০ সালের দিকে, আমেরিকায় বিদেশিদের একটি ঝাঁক প্রবেশ করে যারা তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তাদের নিজেদের জন্য। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্কে অভিবাসী শ্রমিকেরা গার্মেন্টেস এবং লাইট উৎপাদনকারী কোম্পানিতে চাকরি করত। শিক্ষাগত কথা চিন্তা না করে, তাদের যেকোনো ধরনের কাজ করতে ইচ্ছা ছিলো যাতে করে তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি করতে পারে। এটির অনেকেই ছিলো অভিবাসী যারা ইউরোপের নিম্নবর্ণ এবং দাস ছিলো যাদের কোমরে একজন বাহকের বেল্ট বাধা থাকত তারাই আমেরিকায় তাদেরকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে রূপান্তরিত করেছে।

অর্থনীতিবিদ জেমস গ্রান্ট বলেছিলেন, “এই দীর্ঘ অভিবাসন প্রক্রিয়া যা হাতের ও মনের উভয়ের অভিবাসন। মাঠ থেকে কারখানায় অফিস এবং ক্লাসরুম সবক্ষেত্রে উৎপাদন বাড়িয়েছে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি আধুনিক অর্থনীতির জন্য একই আত্মরক্ষার উপায়। তারপর আবার, এটি গত ২০০ বছর ধরে এটি সত্য বিষয়। “

বর্তমানে এসব ক্ষেত্রের অনেক প্রবেশ স্তরের চাকরি চলে গেছে। এছাড়াও অর্থনীতির প্রকৃতি পরিবর্তিত হয়েছে। বেশির ভাগ প্রবেশ স্তরের চাকরি বিদেশে চলে গেছে সস্তায় শ্রমিকের পাওয়ার জন্য। পুরাতন উৎপাদনকারী কারখানাগুলো অনেক আগেই অদৃশ্য হয়ে গেছে। এখানে একটি ব্যতিক্রম হচ্ছে। অনেক বছর ধরে, অনেক মানুষ একই সমতল ক্ষেত্র কামনা করছে এক্ষেত্রে, স্বজনপ্রীতি এবং বৈষম্য বাদে। কিন্তু চাকরিকে যদি একটি বোতাম চাপার মতো বিষয়ে পরিণত করে রপ্তানি করতে হয়েছে যা চীন এবং ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সুতরাং, প্রবেশ স্তরের চাকরিসমূহ মধ্যবিত্তদের জন্য একটি পাঠবাহকের মতো যা সারা বিশ্বে রপ্তানিযোগ্য। এটি বিদেশি শ্রমিকদের জন্য ভালো, কারণ তারা সমতল খেলার মাঠ পেয়েছে কিন্তু এটি আমেরিকার অভ্যন্তরীণ শহরগুলোতে একটি চাকরিশূন্যতা সৃষ্টি করছে।

ভোক্তারা ও এর সুবিধা ভোগ করছে। পণ্য ও সেবার মূল্য কমেছে এবং উৎপাদন ও বিপণন বেশ দক্ষ হয়েছে, কারণ এখানে একটি বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা রয়েছে। সাধারণত চেষ্টার মাধ্যমে সেকেলে ব্যবসা এবং অধিক বেতনের চাকরির আত্মতৃপ্তি, অপচয় ও অদক্ষতা থেকে ঠেকানো গিয়েছে। অক্ষম শিল্প কারখানাকে ভার্তুকি দেওয়ায় মানে হলো বৃথা এড়ানোর চেষ্টা, দেউলিয়া হওয়ার কষ্ট দীর্ঘ করা এবং যা সত্যিকারে আরও খারাপ বিষয়ে পরিণত হয়।

এখানে আরও একটি পরিহাসের বিষয় রয়েছে। অনেক উচ্চ বেতনের চাকরি, অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চাকরির জন্য যথাযথ যোগ্যতা সম্পন্ন লোক পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায়ই, শিক্ষা ব্যবস্থা যথেষ্ট অভিজ্ঞ কর্মী তৈরি করে না, তাই অনেক কোম্পানিকে কম যোগ্যতা সম্পন্ন লোক দিয়ে চালোতে হয়। কর্পোরেশনসমূহ যে ধরনের অভিজ্ঞ কর্মী চায় শিক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই ধরনের কর্মী সৃষ্টি হচ্ছে না। এমনকি অর্থনৈতিক দুঃসময়েও এসব চাকরি অভিজ্ঞ লোকজনের অভাবে পূরণ হয় না।

কিন্তু একটি বিষয় স্পষ্ট। শিল্প অর্থনীতির পরবর্তী সময়ে অনেক নীল কলার চাকরি চিরতরে হারিয়ে যায়। বেশ কয়েক বছর ঘরে অর্থনীতিবিদেরা “শিল্পভিত্তিক আমেরিকার” চেষ্টা করেছে যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বুঝতে সক্ষম হয়েছে তারা পিছনের সময়ে ফিরে যেতে পারবে না। আমেরিকা ও ইউরোপ বিশদ পরিসরে শিল্পভিত্তিক অর্থনীতি থেকে সেবাভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ঝুঁকেছে কয়েক দশক ধরে এবং ঐতিহাসিক রূপান্তর কখনো উল্টে দেওয়া যায় না। শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির সুসময় অতিবাহিত হয়েছে এবং তা চিরদিনের জন্যই।

পক্ষান্তরে, ঐ সব ক্ষেত্রে পুনরায় সাজাতে এবং পুনরায় বিনিয়োগে শক্তি ব্যয় করা উচিত যা বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিপদকে প্রসারিত করবে। সরকারসমূহের জন্য এটি একটি ভীষণ কষ্টের কাজ। দ্বাবিংশ শতাব্দী যেখানে কোন দ্রুত এবং সহজ সমাধান বলে কিছু নেই।

অন্যদিকে এর মানে হলো- শিক্ষাব্যবস্থার একটি ঢেলে সাজানোর ব্যাপার যাতে করে শ্রমিকেরা কাজ পায় এবং হাই স্কুল গ্রাজুয়েটরা বেকরত্বের লাইনে না দাঁড়ায়। বুদ্ধিভিত্তিক পুঁজিবাদের ফলে এই নয় শুধু সফটওয়্যার নির্মাতাদের কাজ থাকবে বা বিজ্ঞানীদের কাজ থাকবে বরং একটি বিশাল জনগোষ্ঠী যারা সৃজনশীল, শৈল্পিক কাজে সক্ষম, উদ্ভাবনী নেতৃত্বের গুণাবলি এবং বিশ্লেষণ সক্ষমতা মানে সাধারণ জ্ঞান উত্তরণ করে তাদের সবারই কাজ থাকবে। একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কার্যক্ষমতা অর্জনে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে কিন্তু তাদের চিৎকার করতে হবে না। বিশেষত, বিজ্ঞানের কারিকুলাম ঢেলে সাজাতে হবে এবং শিক্ষকদের ট্রেনিং দিতে হবে যাতে তারা ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিনির্ভর সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেন (এটি দুঃখের বিষয় আমেরিকায় একটি পুরনো কথা প্রচলিত আছে-”যারা পারে তারা কাজ করে, এবং যারা পারে না তারা শিক্ষক হয়।”)

এম আাইটি এর অর্থনীতিবিদ লেস্টার থ্রোবের মতে, “সফলতা যা ব্যর্থতা নির্ভর করে দেশগুলো কতটা সফলতার সাথে মানুষের মস্তিষ্ককে শিল্প কারখানায় রূপান্তর করতে পারবে কোনো বিশেষ কারখানার আকার-আকৃতির উপর নয়।” এর মানে হলো নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি করা যারা নতুন ধরনের শিল্প এবং নতুন সম্পদ সৃষ্টি করবে প্রযুক্তিগত নতুন ব্যবহারের মাধ্যমে। শক্তি এবং এই ব্যক্তিদের মেয়াদ কখনো উত্তীর্ণ হয় না। তাদেরকে বাজারে নতুন নেতৃত্ব দিতে সুযোগ দেওয়া চাই।

বিজয়ী এবং বিজেতা : জাতি বা দেশ

দুর্ভাগ্যক্রমে, অনেক দেশ এই পথ অবলম্বন করছে না, পক্ষান্তরে পণ্যভিত্তিক পুঁজিবাদের উপর ভীষণভাবে নির্ভরশীল। কিন্তু যেহেতু গড়ে পণ্যদ্রব্যের মূল্য কমে যাচ্ছে এবং গত ১৫০ বছর ধরেই দরপতন ঘটছে, সময়ের সাথে সাথে তাদের অর্থনীতি সংকুচিত হয়ে পড়ছে যেহেতু বিশ্ব তাদের এড়িয়ে যায়।

এই প্রক্রিয়া এড়ানো সম্ভব নয়। জার্মানি ও জাপানের কথা ধরা যাক, ১৯৪৫ সালে, যখন তাদের সব জনসংখ্যা মোটামুটি দুর্ভিক্ষের কবলে ছিল, শহরগুলো ছিলো ধ্বংসস্তূপ এবং তাদের সরকারগুলোর পতন ঘটেছিলো। এক প্রজন্মেই তারা বিশ্ব অর্থনীতির সম্মুখ সারিতে এসে পড়ে। আজকের চীনের দিকে তাকান তারা ৮ থেকে ১০ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ৫০০ বছরের অর্থনৈতিক নিম্নমুখিতা উল্টে দিয়েছে। এক সময় চীনকে বলা হতো “এশিয়ার রুগ্ন মানুষ” এক প্রজন্ম পরেই এটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হবে।

কিন্তু কোনো বিষয়টি এই বিশেষ রাষ্ট্রকে একটি সুসংহত জাতিতে পরিণত করেছে তা হলো পরিশ্রমী জনগণ, এবং এমন পণ্য সৃষ্টি করছে যা কিনতে পুরো বিশ্ব হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এই দেশ তিনটি তাদের শিক্ষার উপর জোর দিয়েছেন, দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, দেশের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেছে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর জোড় দিয়েছে।

ইউকে এর অর্থনীতিবিদ ও সাংবাদিক এমসি রয় লিখেছেন, ‘অগ্রগতির পুরোনো চালক-ভূমি, মূলধন, প্রাকৃতিক সম্পদ-এখন আর ক্রিয়াশীল নয়। ভূমির অবদান এখন কমে গেছে। কৃষি উৎপাদনের অগ্রগতি এটি এই শিল্পনির্ভর পৃথিবীর মোট প্রয়োজনীয়তার বেশি উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। মূলধনের প্রভাবও কমে গেছে। কারণ মূল্যের ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক বাজার প্রায় অসীম পরিমাণে এটি বিদ্যমান যেসব প্রকল্প থেকে আয় করা সম্ভব। এই পরিমাণগত সম্পদ যা একটি দেশকে ধনীতে পরিণত করত তা এখন কিছু গুণগত সম্পদ দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছে যা এর গুণ, প্রতিষ্ঠান, প্রণোদনা এবং ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল যারা সেখানে বাস করে। যা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় মানুষের দক্ষতার স্তরই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন সেক্টরে, প্রাইভেট সেক্টরে এবং পাবলিক সেক্টরেও।”

যাহোক, প্রত্যেক দেশ জাতি এই পথ অবলম্বন করছে না। কিছু দেশ অদক্ষ নেতা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যারা সাংস্কৃতিক এবং জাতিগতভাবে বিভক্ত হয়ে অক্ষম হয়ে পড়ছে এবং কোনো পণ্য উৎপাদন করছে না যা বিশ্বের অন্যান্য দেশের প্রয়োজন। শিক্ষার বিনিয়োগ ছাড়া, তারা প্রচুর পরিমাণে বিনিয়োগ করছে সেনাবাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্রের পিছনে তাদের জনগণকে সন্ত্রাসী বানাতে এবং তাদের নিজস্ব সুবিধার্থে। শিল্প ক্ষেত্রকে উন্নত করার জন্য অবকাঠামোতে বিনিয়োগ না করে তারা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয় এবং তাদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখে, মেধাতন্ত্র না সৃষ্টি করে বরং দুর্নীতিগ্রস্ত ধনতন্ত্র সৃষ্টি করছে।

দুঃখজনক হলো, এসব দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারগুলোর পিছনে পশ্চিমারা সাহায্যের নামে অপচয় করছে তা যতো ছোট পরিমাণই হোক। ভবিষ্যৎ বক্তা এলভিন এবং হৈইদি টফলার বলেছেন ১৯৫০ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি গরিব দেশগুলোকে ধনী দেশগুলো দ্বারা দান করা হয়েছে। কিন্তু তারা উল্লেখ করেন, “আমরা বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে এখনও শুনতে পাই প্রায় ২.৮ বিলিয়ন মানুষ যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যায় প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি তারা দৈনিক ২ ডলার বা কম খরচে প্রতিদিন জীবন অতিবাহিত করছে। এদের মধ্যে ১.১ বিলিয়ন মানুষ চরম দরিদ্রতার সাথে বসবাস করছে দিনে ১ ডলারের চেয়েও কম খরচে জীবন চালাচ্ছে।”

উন্নত রাষ্ট্রসমূহ অবশ্য মুখে খাদ্য তুলে না দেওয়ার চেয়ে বরং উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত করতে সাহায্য করতে পারে। কিন্তু এসব বলার ও করার পরে, মূল পরিবর্তনটি আসতে হবে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোর নিজের থেকেই দক্ষ ও বুদ্ধিমান নেতৃত্ব নির্বাচনের মাধ্যমে। এটি একটি প্রবাদের মতো-”আমাকে একটি মাছ দাও, আমি এটি খাব এক বেলায়। আমাকে মাছ ধরতে শেখাও আমি প্রতি বেলায় খেতে পারব।”

এর মানে হলো সাধারণত একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রকে সাহায্য করার চেয়ে তাদের শিক্ষা ও শিল্প প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করা যাতে তারা স্বনির্ভরশীল হতে পারে।

বিজ্ঞানের সুবিধা গ্রহণ

উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের সুবিধা নিতে পারে। নীতিগতভাবে, তারা অনেক ক্ষেত্রে উন্নত দেশের উপরেও পৃষ্ঠ লাফ দিতে পারে। উন্নত বিশ্বে, টেলিফোন কোম্পানিকে ঘরবাড়ি বা প্রতিষ্ঠানসমূহকে ব্যয়বহুল সংযোগ দিতে দিতে ক্লান্ত কিন্তু একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে এটি করতে হয় না, কারণ সেল ফোন প্রযুক্তি প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোও কোনো রাস্তা বা অবকাঠামো ছাড়া কাজ করতে সক্ষম।

এছাড়াও, উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহের একটি সুবিধা আছে তাদের কোনো বয়স্ক অবকাঠামোকে পুনঃনির্মাণ করতে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, নিউইয়র্কের উপরাস্তাগুলো এবং লন্ডনের উপরাস্তাগুলো প্রায় এক শতাব্দী পুরনো এবং পুনঃনির্মাণ প্রয়োজন। বর্তমানে পুনঃনির্মাণ, কাজ নতুন কাজের চেয়ে ব্যয়বহুল। একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র তাদের উপরাস্তাগুলো সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণ করতে পারে, ধাতবসমূহের বিশাল অগ্রগতির সুবিধা নিতে পারে, নির্মাণ কৌশল এবং প্রযুক্তির সুবিধা নিতে পারে। একটি সম্পূর্ণ নতুন উপরাস্তা বর্তমানে কম ব্যয়বহুল গত শতাব্দীর চেয়ে।

উদাহরণস্বরূপ, চীন পেরেছে উন্নত বিশ্বের সব ভুলের বিপরীতে সুবিধা নিতে—যখন কোনো শহর তৈরি করেছে একেবারে নিচ থেকে শুরু করেছে। বেইজিং এবং সাংহাই তৈরি হয়েছে পশ্চিমের কোনো বড় শহরের আংশিক ব্যয়ের সমান খরচে। বেইজিং একটি অন্যতম বড় শহর যার উপরাস্তাসমূহ বিশ্বের মধ্যে বেশি আধুনিক পশ্চিমাদের তৈরি হতে। কম্পিউটার প্রযুক্তি থেকে সকল সুবিধা নিয়ে তারা তাদের শহরের বিশাল জনগোষ্ঠীকে সেবা দিচ্ছে।

ইন্টারনেট আরেকটি সুবিধার বস্তু যা দিয়ে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রসমূহ তাদের উন্নয়নের শটকার্ট তৈরি করতে পারে। পশ্চিমাদের ভুলত্রুটিকে অতিক্রম করে বিশেষ করে বিজ্ঞানে। পূর্বে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা সেকেলে ডাক সার্ভিসের উপর নির্ভর করে বিজ্ঞান জার্নালগুলো যেতো, যা প্রকাশের কয়েক মাস বা বছর পরে আসত-যদি আদৌ তা আসত। এই জার্নালগুলো ব্যয়বহুল এবং উচ্চমানে বিশেষায়িত ছিলো যা কেবলমাত্র বড় লাইব্রেরি এর ব্যয় বহন করতে পারত। পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের সাথে কাজ করা অসম্ভব ছিলো। কারও পক্ষে খুবই ধনী হলে এবং উচ্চমাত্রায় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পশ্চিমের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিখ্যাত বিজ্ঞানীয় অধীনে কাজ করায় সুযোগ পাওয়া যেত। এখন এটি সম্ভব যেকোনো বিজ্ঞানীর পক্ষে বৈজ্ঞানিক পত্রগুলো সংগ্রহ করা। কয়েক সেকেন্ডের কম সময়ে এগুলো সংগ্রহ করা। কয়েক সেকেন্ডের কম সময়ে যখন তারা এটি ইন্টারনেট টার্গেট করে প্রকাশকৃত পৃথিবীর সর্বত্র এটা ছড়িয়ে পড়ে বিনা খরচে। এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে যার সাথে কখনো দেখা হয়নি এমন পশ্চিমা বিজ্ঞানীর সাথেও কাজ করা সম্ভব হয়েছে এখন।

ভবিষ্যৎ উন্মুক্ত দখলের জন্য

ভবিষ্যও উন্মুক্ত বিস্তর পরিসরে। আমরা যেভাবে বলেছি, সিলিকন ভ্যালি কয়েক দশকে এর মধ্যে মরিচার স্তূপে পরিণত হতে পারে, যেহেতু, সিলিকন যুগের শেষ হতে চলছে এবং সার্চ লাইটের আলো অন্য কোনো উদ্যোক্তার দিকে। কোন জাতি ভবিষ্যতের নেতৃত্ব দেবে? স্নায়ুযুদ্ধের সময়কালে, পরশক্তি ছিলো তারা যারা বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক সামরিক শক্তি রাখত। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙ্গে যাবার পরে। এটি স্পষ্ট, ভবিষ্যতে ঐ রাষ্ট্রটি শীর্ষে অবস্থান নিবে যার অর্থনীতি বড় হবে এবং তা নির্ভর করে বিজ্ঞান এ প্রযুক্তির চাষ এবং যত্নের উপর।

সুতরাং আগামীর নেতা কারা? যে জাতি এই সত্যকে আয়ত্ত করবে তারা। উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে আধিপত্য বিস্তার অব্যহত রেখেছে যদি ও আমেরিকার শিক্ষার্থীরা খারাপ ফল করে যখন বিজ্ঞান ও গণিতের বিষয় আসে। ১৯৯১ সালে দক্ষতা নির্ণয় পরীক্ষায়, উদাহরণস্বরূপ, আমেরিকার তের বছরে ছাত্ররা ১৫ পায় গণিতে এবং ১৪ পায় বিজ্ঞানে তার উপরে জর্দানের ছাত্ররা যারা দুটোটেই আঠারো স্কোর করে। পরীক্ষাটি নেওয়া হয় যখন তার দার্শনিক সংখ্যা বুঝতে পারে। (এটি উল্লেখ করা প্রয়োজন পরীক্ষাটির ব্যাংকিং করার ক্ষেত্রে স্কুলে কত দিন ছাত্ররা উপস্থিত হয় তারও সম্পর্ক রয়েছে। চীন যারা এক নম্বর স্থান দখল করে, গড়ে বছরে ২৫১ দিন উপস্থিত থাকত তারা, সেখানে আমেরিকার ছাত্ররা উপস্থিত থাকে বছরে ১৭৮ দিন)।

এটি একটি রহস্যময় ঘটনা, এত তির্যক অবস্থানের পড়েও কীভাবে আমেরিকা বিশ্বের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে ভালো করছে, এর কারণ হলো আমেরিকার বেশিরভাগ বিজ্ঞান আসে প্রবাস থেকে। এটি বুঝতে হবে। এটি হলো “ব্রেইন ড্রেইন”। আমেরিকার একটি গোপন অস্ত্র আছে তা হলো এইচ ওয়ান ভিসা, যা জিনিয়াস ভিসা নামে পরিচিত। যদি তুমি দেখাতে পার তোমার বিশেষ কোন গুণ আছে, সম্পদ আছে, অথবা বৈজ্ঞানিক জ্ঞান আছে তুমি লাফ দিয়ে এগিয়ে যেতে পার এবং একটি এইচ-ওয়ান ভিসা পেতে পার। এটি নিয়মিতভাবে আমেরিকায় বিজ্ঞানের অবস্থানকে নবায়ন করছে। উদাহরণস্বরূপ, সিলিকন ভ্যালি যেখানে ৫০ শতাংশ মানুষ বিদেশি বংশোদ্ভূত, বেশিরভাগ তাইওয়ান এবং ইন্ডিয়ান। জাতীয়ভাবে ৫০ শতাংশ পিএইচডি ছাত্ররা যারা পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করে তারা বিদেশ থেকে আমেরিকায় আসা ছাত্র। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় দি সিটি ইউনির্ভাসিটি অব নিউইয়র্ক প্রায় ১০০ শতাংশই বিদেশি বংশোদ্ভূত।

কিছু কংগ্রেসম্যান এইচ ওয়ান বি ভিসাকে উঠিয়ে দিতে চায়, কারণ তারা যুক্তি দেখায় এটি আমেরিকানদের চাকরি ছিনিয়ে নিয়েছে, নিচ্ছে। কিন্তু তারা বোঝে না এই ভিসা কীভাবে কাজ করছে। সাধারণত, এখানে কোনো আমেরিকান যোগ্য ব্যক্তি নেই যিনি সিলিকন ভ্যালিতে সর্বোচ্চ চাকরি নিতে পারেন-যেসব আমরা সর্বদাই শূন্য পড়ে থাকতে দেখি। এই বিষয়টি সামনে আসে যখন সাবেক চ্যান্সেলর গেরহার্ড শ্রোয়েডার জার্মানির ইমিগ্রেশন আইন এইচ ওয়ান বি ভিসা পাস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু জার্মানির বাইরে লোকজনের দ্বারা চাকরি হারানোর অজুহাতে এটি ব্যর্থ হয়। আবারও সমালোচকেরা বুঝতে ব্যর্থ হয় এখানে ভয়, কারণ জার্মানি নাগরিকদের নেই যিনি উচ্চস্তরের চাকরির স্থান পূর্ণ করতে পারেন যা পরবর্তীতে শূন্যই থেকে যায়। এই ইইচ ওয়ান বি ভিসা-ধারীরা কোনো চাকরি ছিনিয়ে নেয় না, বরং তারা সম্পূর্ণ নতুন শিল্প স্থাপন করে।

কিন্তু এই এইচ ওয়ান বি ভিসা মূলত অন্তর্বর্তী একটি ব্যবস্থা। আমেরিকার বেশিরভাগ বিদেশি বিজ্ঞানীদের জীবন চালিয়ে নিতে সাহায্য করতে পারে না, তারা চীন ও ভারতে ফিরে গিয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছেন। সুতরাং ‘ব্রেইন ড্রেইন’ টেকসই হচ্ছে না। এর মানে আমেরিকাকে তার পুরাতন, সেকেলে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানে, খুব কম হাই স্কুল ছাত্ররা চাকরি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং একটি স্থির জটের সৃষ্টি করছে। চাকরিদাতারা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন নতুন নিয়োগকারীদেরকে কর্মক্ষম করতে কমপক্ষে এক বছর তাদের ট্রেনিং দিতে হয়। এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নতুন অপ্রয়োজনীয় কোর্স চালু করতে হয় এই খারাপ হাই স্কুল শিল্প ব্যবস্থাকে সমন্বয় করতে।

সৌভাগ্যক্রমে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় এবং ব্যবসা প্রকৃতপক্ষে একটি প্রশংসনীয় কাজ করছে হাই স্কুল শিল্প ব্যবস্থার জন্য যে ক্ষতি হয়েছে তা মেরামত করতে কিন্তু এটি সময় ও মেধার অপচয়। ভবিষ্যতেও আমেরিকাকে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে প্রতিষ্ঠানিক হাই স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে।

সত্য কথা হলো, আমেরিকার এখনো উল্লেখযোগ্য সুবিধাসমূহ রয়েছে। আমি একবার আমেরিকান মিউজিয়ামের ককটেল পার্টিতে উপস্থিত ছিলাম এবং আমি একজন বেলজিয়াম বায়েটেক উদ্যোক্তার সাথে পরিচিত হই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন তিনি বেলজিয়াম ত্যাগ করলেন যেখানে বেলজিয়ামের নিজের অনেক বড় বায়াটেক শিল্প রয়েছে। তিনি বললেন, ইউরোপে তুমি দ্বিতীয়বার কোনো সুযোগ পাবে না। যেহেতু মানুষেরা জানে তুমি কে এবং তোমায় পরিবারকে, যদি তুমি একবার ভুল কর, তুমি শেষ হয়ে যেতে পার। তোমার ভুল তোমার পিছুই থাকবে তুমি যেথায় যাও। কিন্তু আমেরিকায়, তিনি বলেন, তুমি নিজেকে বারবার নতুন করে আবিষ্কার করতে পার। মানুষেরা তাদের পূর্বপুরুষদের নিয়ে ভাবে না। তারা শুধু ভাবে আজকেই তুমি কী করতে পার তাদের জন্য। এটি শান্তিদায়ক তিনি বলেন এবং এটিই একমাত্রকারণ যে কারণে ইউরোপের বিজ্ঞানীরা আমেরিকায় চলে আসেন।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষা

পশ্চিমে একই কথা প্রচলিত আছে “যত তেল দেবে চাকা তত দ্রুত ঘুরবে।” কিন্তু প্রাচ্যে অন্য একটি প্রবাদ আছে, “নখ উঠে গেলে হাতুড়ি ফেলে দাও।” এই দুটি প্রবাদ একটি অন্যটির বিপরীত কিন্তু এটি প্রাচ্য ও পশ্চাত্যের চিন্তার মাঝে পার্থক্যের ধরন তুলে ধরে।

এশিয়াতে ছাত্ররা তাদের পশ্চিমা প্রতিযোগী ছাত্রদের চেয়ে ভালো স্কোর করে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগ শিক্ষা বই পড়া এবং মুখস্ত বিদ্যা যা তাদের একটি নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত নিতে পারে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উচ্চ স্তরে পৌঁছাতে হলে তোমার সৃজনশীলতা, কল্পনা ও উদ্ভাবনী শক্তি দরকার কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলোতে এই বিষয়ে যত্নবান নয়।

সুতরাং, যদিও চীন পশ্চিমাদের চেয়ে সস্তায় কারখানার মাধ্যমে পণ্য উৎপাদনে সমকক্ষ যা পশ্চিমের কোনো পণ্যের নকল, এটি আসলে পশ্চিমাদের চেয়ে কয়েক দশক পিছনে থাকার নির্দেশ করে নতুন পণ্য বা কৌশল উদ্ভাবনের চেয়ে।

সৌদি আরবের একটি কনফারেন্সে আমি এক সময় বক্তব্য রেখেছিলাম যেখানে অন্য একজন বক্তা ছিলেন লি কুয়ান ইউ যিনি ১৯৫৯ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে একজন রক স্টার যেহেতু তিনি সিঙ্গাপুরকে একটি আধুনিক রাষ্ট্রে উন্নীত করেছেন যা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অন্যতম শীর্ষ একটি জাতি। প্রকৃত পক্ষে, সিঙ্গাপুর পনেরতম ধনী দেশ বিশ্বের মাঝে, যদি তুমি তাদের মাথাপিছু আয় হিসাব করো মোট জাতীয় উৎপাদন অনুসারে। শ্রোতারা এই বিখ্যাত ব্যক্তির বক্তব্য শোনার জন্য ধৈর্য ধরে বসে ছিলো।

তিনি যুদ্ধের পরবর্তী দিনের স্মৃতিচারণ করেন যখন সিঙ্গাপুর একটি সাধারণ বন্দর- বিশেষ করে চোরাকারবারি, দস্যুতা, মধ্যপ নাবিকদের এবং অন্যান্য খারাপ কাজের স্থান হিসেবে পরিচিত ছিলো। যাহোক তিনি, তার কিছু সহযোগী নিয়ে স্বপ্ন দেখতে থাকেন এমন একটি দিনের যখন এটি একটি সমুদ্রবন্দর হবে যা পশ্চিমাদের সাথে প্রতিযোগিতা করবে। যদিও সিঙ্গাপুরের কোনো প্রাকৃতিক সম্পদ নেই এটির বড় সম্পদ ছিলো তাদের জনগণ যারা কঠোর পরিশ্রমী এবং অধদক্ষ। তাদের গ্রুপটি একটি উল্লেখযোগ্য যাত্রা শুরু করল এই পানির নিচের ডুবন্ত জাতিকে নিয়ে এবং এক প্রজন্মেই এটিকে একটি বৈজ্ঞানিক শক্তি ঘরে পরিণত করলেন। এটি সম্ভবত ইতিহাসের অন্যতম একটি আগ্রহের বিষয়-সামাজিক প্রকৌশল।

তিনি এবং তার দল একটি সদৃশ্যপূর্ণ বিপ্লবের জন্য পুরো জাতিকে নিয়ে কাজ করেছিলেন, বিজ্ঞান এবং শিক্ষার উপর জোর দেন এবং হাইটেক শিল্পের দিকে মনোনিবেশ করেন। কয়েক দশকের মধ্যে সিঙ্গাপুর একটি উচ্চ শিক্ষিত প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন জাতিতে পরিণত হয়ে যায়। এই দেশটিকে অন্যতম একটি রপ্তানী কারক দেশে পরিণত করে যারা ইলেকট্রনিক্স, কেমিক্যালস্ এবং বায়োমেডিকেল সরঞ্জামাদি রপ্তানিতে শীর্ষে অবস্থায় নেয়। ২০০৬ সালে কম্পিউটারের মূল ওয়েফারের ১০ শতাংশ উৎপাদন করে।

তিনি স্বীকার করেন, একটি জাতিকে আধুনিক করার পিছনে অনেকগুলো সমস্যা বিদ্যমান। বিভিন্ন সামাজিক আদেশ প্রদান, কঠিন আইনের ব্যবহার এই পথকে বিচ্ছিন্নকারী সবকিছুকে বাদ দেওয়া বেত্র ঘাতের শাস্তি দেওয়া এবং মাদক ব্যবস্থাকে (মৃত্যুদণ্ড দেওয়া)। কিন্তু তিনি আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খেয়াল করেন। তিনি দেখলেন, সেরা বিজ্ঞানীরা সিঙ্গাপুর ভ্রমণে ইচ্ছুক হয়ে পড়ে, এখানে কিছুদিনের জন্য অবস্থান করার জন্য। পরবর্তীতে তিনি দেখেন কারণটি কী? এখানে কোনো সাংস্কৃতিক সুবিধা নেই এবং এমন কোনো আকর্ষণ নেই যা তাদের সিঙ্গাপুরে টেনে নিয়ে আসবে। এটি তাকে নতুন ধারণা দেয় : পরিকল্পিতভাবে একটি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী সৃষ্টি করেন আধুনিক জাতির মতো (ব্যালে কোম্পানি, সুমধুর অর্কেস্ট্রা ইত্যাদি) যাতে করে সেরা বিজ্ঞানীরা তাদের শিকড় সিঙ্গাপুরেই গড়েন। প্রায় রাতারাতি সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং অনুষ্ঠান পুরো দেশে বসন্তের মতো ছড়িয়ে পড়ে বৈজ্ঞানিক বিশেষ ব্যক্তিদের এখানে আঁকড়ে ধরতে।

পরবর্তীতে তিনি বুঝতে পারেন, সিঙ্গাপুরের শিশুরা তাদের শিক্ষকদের যুগের কথারই পুনরাবৃত্তি করে থাকে অন্ধভাবে, কিন্তু প্রচলিত জ্ঞানকে চ্যালেঞ্জ করে না এবং নতুন ধারণা সৃষ্টি করে না। তিনি বুঝতে পারেন, প্রাচ্যদেশগুলো সবসময় পাশ্চাত্য দেশগুলোয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জায়গা এখানে তারা এমন বিজ্ঞানী সৃষ্টি করেন যারা কেবল তাদের নকল করতে পারে। সুতরাং তিনি শিক্ষাব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটানোর চিন্তা করলেন সৃজনশীল ছাত্রদের একা করে দেওয়া এবং তাদের স্বপ্নকে তাদের মতো করে তৈরি করার ক্ষেত্রে। বুঝতে পারলেন বিল গেটস বা স্টিভ জবসের মতো কোনো একজন সিঙ্গাপুরকে পরিবর্তন করে দিতে পারে তাই তিনি স্কুলশিক্ষকদের নির্দেশ দিলেন এমন ভবিষ্যৎ মেধাবীদের চিহ্নিত করতে যারা বৈজ্ঞানিক কাল্পনা দ্বারা অর্থনীতিকে পুনরুস্থিত করতে পারে।

সিঙ্গাপুরের শিক্ষা সবার জন্য নয়। এটি একটি ছোট শহরে রাষ্ট্র, যেখানে অল্প কিছু দূরদর্শী লোক পুরো জাতিকে পরিবর্তন করে দিতে পারে। এবং প্রত্যেক রাস্তায় পড়ে কান্নাকাটি করে না। যাহোক এটি তোমাকে দেখায় তুমি কীভাবে পদ্ধতিগতভাবে তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লবের সম্মুখ সারিতে চলে আসতে পার।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

আমি একসময় প্রিন্সটনে দি ইনিস্টিটিউট ফর অ্যাডভ্যান্স স্টাডি-এর ফ্রিমান ডেসন-এর সাথে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম। তিনি বিজ্ঞানে তার দীর্ঘ ক্যারিয়ার নিয়ে স্মৃতিচারণ করলেন এবং পরবর্তীতে উল্লেখ করলেন একটি ডিসটার্বিং বিষয় নিয়ে। যুদ্ধের পূর্বে যখন তিনি ইউকে এর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে তরুণ ছাত্র, তিনি ইংল্যান্ডের উজ্জ্বল মানসিকতা দেখতে পেয়েছিলেন কঠিন বিজ্ঞানের পথে ফিরে যেতে পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়নের মতো বিষয়ে, বৈদ্যুতিক এবং রাসায়নিক কেন্দ্রে গঠনের লক্ষ্যে এবং নতুন ইলেক্ট্রো মেকানিক্যাল মেশিন তৈরি করতে, পরবর্তী প্রজন্ম তৈল মর্দনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে এবং অন্যের অর্থ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন এটি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতনের লক্ষণ। ইংল্যান্ড তাকে বিশ্বশক্তি হিসেবে ধরে রাখতে পারবে না যদি এটি বিজ্ঞানের ভিত্তি শক্ত করে আঁকড়ে না ধরে। তিনি বলেন একটি বিষয় আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

তিনি মন্তব্য করেন যে তিনি তার জীবনে এটি দ্বিতীয়বার লক্ষ্য করেছেন। প্রিন্সটনের উজ্জ্বল মানসিকতা আর নেই যে পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতের কঠিন সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করবে বরং তারা ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিংয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। আবার তিনি ভাবছেন এটি অবক্ষয়ের একটি লক্ষণ যখন সমাজের নেতারা উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিকে সমর্থন করে না যা সমাজেই মহান করে তোলে।

এটি আমাদের ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ।

.

“মানুষ যারা এখন জীবিত তারা একটি মধ্যাবস্থায় রয়েছে যাদের পরবর্তী প্রজন্ম তিন বা

চার শতাব্দী পরে মানব ইতিহাসের সবচেয়ে অসাধারণ মনে হবে।”-জুলিয়ান সিমন

“যেখানে কোন স্বপ্ন নেই সেখানে মানুষ মৃত।”-প্রবাদ ২৯ ৪ ১৮