৯. সংযোজন – ইতিহাসের গোড়ার কথা

দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
সংযোজন

১. বাঙালীর ইতিহাসে নরগোষ্ঠী ও জন

ভারতবাসীর ও বাঙালীর নরগোষ্ঠীগত আলোচনা ইতিমধ্যে আর বেশি অগ্রসর হয়নি; বস্তুত পণ্ডিতদের মধ্যে এ বিষয়ে গবেষণা আলোচনা-বিশ্লেষণে উৎসাহ ও ঔৎসুক্যে যেন একটু ভাটা পড়েছে বলে মনে হয়। যা হোক, এ বিষয়ে যারা আরও জানতে আগ্রহী তারা শ্ৰীযুক্ত অতুল সুর রচিত ‘বাঙালীর নৃতাত্ত্বিক পরিচয়’ (জিজ্ঞাসা, কলকাতা, ১৯৭৭) বইখানা পড়তে পারেন। এই ছোট বইখানাতে সাম্প্রতিকতম জ্ঞাতব্য সমস্ত তথ্যই সুশৃঙ্খলায় সুবিন্যস্ত করা হয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই লেখকের বই ‘বাঙলার সামাজিক ইতিহাস’ (কলকাতা, ১৯৭৬) বইখানাও পাঠকদের কাজে লাগতে পারে বলে আমার ধারণা।

নরগোষ্ঠীর প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি একটু অন্য কারণে। এ ব্যাপারে আমার চিন্তা বেশ কিছু দিন যাবৎ একটু অন্য খাতে বইছে, এবং আমারই মতো অনেকের, অন্তত র্যারা মানুষের সামাজিক ইতিহাস নিয়ে চিন্তা করেন, তাদের। Race অর্থাৎ নরগোষ্ঠী প্রাণীবাচক (zoological) শব্দ, সংস্কৃতিবাচক নয়। এ অর্থে বিশুদ্ধ কোনও ‘race’ বা নরগোষ্ঠীর কোথাও কিছু অস্তিত্ব কখনও ছিল এমন তথ্য কারও জানা নেই। রক্তের গুণাগুণের এবং কতকগুলো বিশেষ শারীরসাদৃশ্যর উপর নির্ভর করে নৃতাত্ত্বিকেরা পৃথিবীর যাবতীয় মানুষকে কয়েকটি বিভিন্ন নরগোষ্ঠীতে ভাগ করেছেন এবং বিভিন্ন পণ্ডিতেরা বিভিন্ন নামে তাদের চিহ্নিত করেছেন। বিশুদ্ধ ভূমধীয়, অ্যালপীয় বা আদি-অষ্ট্রেলয়েড় বা ভেড়িড় বা ইন্ডিডের কোথাও কেউ সাক্ষাৎ পেয়েছেন, এমন জানা নেই। নামকরণ ক্রিয়াটি যে সাদৃশ্যের তারতম্য-নির্ভর, তা সহজেই অনুমেয়, অর্থাৎ, যে সব মানবগোষ্ঠীর শারীর-পরিমিতি গণনা করা হয়েছে, বা রক্ত পরীক্ষা করা হয়েছে তারা সভ্য সমাজ থেকে যত দূরেই হোক, যত বন্য, যত আদিমই হোক না কেন, তাদের কারও মধ্যেই রক্তের অবিমিশ্র বিশুদ্ধতা তখন আর ছিল না, অল্পবিস্তর সংমিশ্রণ সর্বত্রই ঘটেছে। এই সংমিশ্রণই তারতম্যের হেতু। যা হোক, একথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, মানব সমাজে বিশুদ্ধ race-এর অস্তিত্ব একান্তই প্রকল্পিত (hypothetical); এর বাস্তব অস্তিত্ব কখনও কোথাও কিছু ছিল, এমন কোনো প্রমাণ নেই। দ্বিতীয়ত, নরগোষ্ঠীগত গবেষণা-আলোচনাদির সার্থকতা নিশ্চয়ই আছে, কারণ পৃথিবীর কোথায়, কোন সমাজে কোন নরগোষ্ঠীর কতটা বিস্তৃতি, কতটা প্রভাব তা ঐতিহাসিকের ও সমাজবিজ্ঞানীর জানা প্রয়োজন, দেশকালকৃত মানব-সমাজকে বোঝবার জন্যই। কিন্তু তার চেয়েও অনেক বেশি প্রয়োজন, কোথায় কখন কোন নরগোষ্ঠী বাস্তব, ব্যবহারিক ও সাংস্কৃতিক প্রয়োজন-পরিবেশের প্রভাবে কিভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়ে নূতন রূপে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। প্রধানত এই রূপান্তরই নরগোষ্ঠী থেকে জন-এ রূপান্তর, race থেকে people-এ। এবং জন বা people-রচনার সূচনা থেকেই যথার্থ ইতিহাসের ভিত্তি রচনার সূত্রপাত।

জন সাংস্কৃতিক শব্দ, প্রাণীবাচক নয়। যে কোনও raceবা নরগোষ্ঠীর বেশ কিছু সংখ্যক লোক কোনও একটা স্থানে স্থিত হয় কোনও এক কালে; তখন সেই কাল ও স্থানের প্রয়োজন-পরিবেশ, ব্যবহারিক-প্রতিবেশিক রীতিপদ্ধতি ইত্যাদি অনুযায়ী বিশেষ এক জীবনচর্যায় তাদের অভ্যস্ত হতে হয়; কখনও কখনও নিজস্ব নরগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অন্যতর নরগোষ্ঠীর সম্মুখীনও হতে হয়, ক্রমে ক্রমে রক্ত ও ভাষার মিশ্রণও ঘটে। স্থান ও কালের সাংস্কৃতিক প্রভাবে নরগোষ্ঠী তখন জন-এ বা people এ বিবর্তিত-পরিবর্তিত হয়, নরগোষ্ঠীগত পার্থক্য তখন বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভারতীয় ধ্যানধারণায় নরগোষ্ঠীর ধারণা নেই বললেই চলে, কিন্তু জন-এর ধ্যানধারণা অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রাচীন। প্রাচীন পুরাণ গ্রন্থে, বিশেষ ভাবে মার্কণ্ডেয় পুরাণে, ভারতবর্ষের জন-সমূহের একটি তালিকা আছে; হয়ত তালিকাটি সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু সুদীর্ঘ। লক্ষণীয় এই যে, সর্বত্রই নামগুলি দেওয়া হয়েছে বহুবচনে, অর্থাৎ people অর্থে, যেমন মগধাঃ, অঙ্গাঃ ইত্যাদি। অঙ্গজন ও মগধজনের লোকেরা যেখানে বাস করেন সেই স্থানের নাম অঙ্গজনপদ, মগধ জনপদ। এই জন ও জনপদ রচনা ঋগ্বেদ রচনার কাল থেকেই, হয়ত তার আগে থেকেই দেখা দিয়েছিল, কিন্তু তার কোনও লিখিত প্রমাণ নেই।

প্রাচীন বঙ্গদেশেও এই জনদের কথাই লিখিত ইতিহাসের আদিতম পর্বে। বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ, সুহ্মাঃ, পুণ্ড্রাঃ এদের নিয়েই বাঙালীর ইতিহাসের কথা শুরু। এদের আগে ছিল কোন জনেরা, তা আমাদের জানা নেই; অনুমান করা যেতে পারে শবর ও নিষাদ জনেরা, কোল্প-ভিল্ল-কিরাত জনেরা। এদের কে কোন নরগোষ্ঠীর বা raceর, এ-প্রশ্নের উত্তর প্রাচীন কোনও সাক্ষ্য প্রমাণে নেই।

২. বাঙালীর প্রাক ও আদি ইতিহাস

[এই অনুচ্ছেদটি নাতিদীর্ঘ একটি অধ্যায় বলেও গণিত হতে পারতো, কিন্তু যেহেতু প্রাক ও আদি ইতিহাস ইতিহাসেরই গোড়ার কথা, সেই হেতু অনুচ্ছেদটিকে দ্বিতীয় অধ্যায়েই সংযোজন করা হলো। ]

মূল গ্রন্থটি যখন রচিত ও প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল তখন সৃজ্যমান বাঙালীর প্রাক ও আদি ইতিহাসের কোনও তথ্যই আমাদের জানা ছিল না বললেই চলে। গত পঁচিশ বৎসরে পশ্চিমবঙ্গ ও বাঙলাদেশে প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার যা হয়েছে তা গুণে ও পরিমাণে সুপ্রচুর। বাঙলাদেশের আবিষ্কার প্রধানত ঐতিহাসিক কাল সংক্রান্ত, এবং সে আবিষ্কারের ফলে পঞ্চম খ্ৰীষ্ট শতাব্দী থেকে শুরু করে ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত বাঙালীর ইতিহাসের প্রচুর নূতন তথ্য ও তার অর্থনির্দেশ আমাদের গোচরে এসেছে। এ গ্রন্থের এই পরিশিষ্টে যথাস্থানে তা উল্লিখিত হবে, অবশ্যই যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ততায়।

তবে বিস্ময়কর আবিষ্কার ঘটেছে পশ্চিম বঙ্গে, এবং সে আবিষ্কার অনুসরণ করে নূতন নূতন অনুসন্ধান আজও চলছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই যা পাঠকসাধারণের এবং বিশেষজ্ঞদের গোচরে এসেছে তার যোগফল বাঙালীর ইতিহাসে নূতন একটি অধ্যায় রচনার সূচনা করেছে, এমন একটি অধ্যায় যার শুরু খ্ৰীষ্টপূর্ব একহাজার বৎসরেরও আগে এবং যাকে বাঙালীর বাস্তব ইতিহাসের প্রাক উষা অধ্যায় বলে অভিহিত করা যেতে পারে। এ অধ্যায় পরম্পরাগত শ্রুতির উপর প্রতিষ্ঠিত নয়, সাহিত্যধৃত অস্পষ্ট স্মৃতি বা কাহিনীর উপরও নয়; এ অধ্যায় প্রতিষ্ঠিত প্রাথমিক বাঙালী কৃষি-সমাজের দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব উপাদান-উপকরণের উপর।

প্রাচীন রাঢ়দেশের কেন্দ্রভূমি বর্তমান বীরভূম ও বর্ধমান জেলা। এই দুই জেলার প্রাণপ্রবাহ ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-কোপাই-অজয়-কুকুর-দামোদর নদনদীমালা। এই দুই জেলার সংলগ্ন সুবর্ণরেখা ও কংসাবতী বিধৌত মেদিনীপুর, বাকুড়া ও পুরুলিয়া। এই নদনদীগুলির প্রত্যেকটিরই উৎসস্থল বিন্ধা-শুক্তিমান কুলাচল দুটির পূর্বতম বিস্তৃতি ছোটনাগপুর-ওড়িশার নিম্নশায়ী পাহাড়গুলি। শীতে ও গ্রীষ্মে এই নদনদীগুলি শীর্ণকায়া, ক্ষীণধারা, কিন্তু বর্ষায় স্ফীতকায়া, খরস্রোতা, দুর্বার, ভীষণা ও দুকুলপ্লাবিনী। হাজার হাজার বছর ধরে প্রতি বর্ষার দুর্বার খরস্রোত ছোটনাগপুর-ওড়িশার পাহাড়গুলি থেকে ছোটবড় কাকর মেশানো লাল-গেরুয়া মাটি বয়ে এনে ঢেলে দিয়েছে নদীগুলির তীরে তীরে, প্লাবনের স্রোত সেই মাটিকে ঠেলে নিয়ে গেছে দূরে দূরান্তরে, কোথাও বেশি, কোথাও কম; যত দূরে তত কম, যত কাছে তত বেশি। বীরভূম, বর্ধমান, বাকুড়া, পুরুলিয়া, পশ্চিম মেদিনীপুরের ইহাই ভূপ্রকৃতি; পশ্চিম বঙ্গের ইহাই পুরাভূমি। এই ভূমি কঠিন, রুক্ষ, প্রান্তর জুড়ে কাকর-লালমাটির ঢেউ, কোথাও কোথাও ছোটবড় পাথর-স্তুপের উৎক্ষেপ। জৈন আচারঙ্গ সূত্রের একটি কাহিনীতে বলা হয়েছে, মহাবীর জিন এসেছিলেন রাঢ়দেশের কোনও এক অঞ্চলে, যে অঞ্চলের নাম বলা হয়েছে বজ্রভূমি। বর্ধমান-বীরভূম-বাঁকুড়া-পুরুলিয়ার ভূমি যথার্থতই বজ্রভূমি।

অথচ, কিছু কিছু অংশ বাদ দিলে এই বজ্রভূমি আজও উর্বরা, শস্যপ্ৰসূ। গত পনেরো-বিশ বৎসরের প্রত্নানুসন্ধান ও উৎখননের ফলে আমরা আজ যেন জেনেছি, এই ভূমির প্রাণদাত্রী নদনদীগুলির তীরে তীরেই বাঙালীর প্রাচীনতম সংস্কৃতির অভ্যুদয় ঘটেছিল, বাঙালীর চাষবাস, ধান্য শস্যোৎপাদন, ঘরবাড়ি নির্মাণ, জীবনোপায়ের নানা পথ। এ জানা সম্ভব হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে ও বিভাগীয় অধিকর্তা, আমার প্রাক্তন ছাত্রদের অন্যতম পরেশচন্দ্র দাশগুপ্তের কৃতিত্বে। উৎখননের যত দোষক্ৰটি থাকুক, তার বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার সঙ্গে যতোমত-পার্থক্যই পণ্ডিতদের থাকুক, পরেশচন্দ্রই বাঙালীর ইতিহাসে এই নূতন অধ্যায় যোজনার প্রথম ও প্রধান নায়ক।

বীরভূম জেলার বোলপুর শহরের অদূরেই অজয়তীরবর্তী বনকাটি গ্রাম। প্রায় তারই সংলগ্ন ইলামবাজার, একটু দূরেই অধুনা বিখ্যাত পাণ্ডুরাজার টিবি। প্রত্নানুসন্ধানের ফলে এই বনকাটিতে আবিষ্কৃত হয়েছে প্রত্নাশ্মীয়পর্বসুলভ অশ্মীভূত কাঠের এবং স্ফটিকে তৈরী অনেক ছোটবড় কারুযন্ত্র। দামোদর নদের তীরে বীরভনপুর গ্রাম। এই গ্রামের একটি স্থানে উৎখননের ফলে অসংখ্য স্ফটিক ও অন্যান্য গুড়ো পাথরের তৈরী ক্ষুদ্রাশ্মীয় কারুযন্ত্র পাওয়া গেছে, তিনফুট মাটির নীচে। তারও নীচে নবাশ্মীয় পর্বের সমভূমিতে গোচর হয়েছে কয়েকটি গর্ত; গর্তগুলি যে বাশের বা কাঠের বা পাথরের খুঁটির তা সহজেই অনুমেয়। এ অনুমানেও বাধা নেই যে, খুঁটির উপর একটি চালও ছিল। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, এখানে ক্ষুদ্রাষ্ট্ৰীয় যন্ত্রপাতি নির্মাণের একটি কারখানা ছিল। যাই হোক, প্রত্নানুসন্ধানের ফলে জানা গেছে যে, এই উৎখনিত স্থানটির আশে পাশে প্রায় এক বর্গমাইল জুড়ে একটি ক্ষুদ্রাশ্মীয়পর্বের প্রত্নস্থান বিস্তৃত।

স্ফটিক ও অন্যান্য পাথরের তৈরী এই ধরনের ক্ষুদ্রাষ্ট্ৰীয় কারুযন্ত্র পূর্বোক্ত পুরাভূমি নানা জায়গা থেকেই পাওয়া গেছে, কোথাও পরবর্তী কালের কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের সঙ্গে, কোথাও বা কোনও অনুষঙ্গ ছাড়াই। ক্ষুদ্রাশ্মীয় কারুষন্ত্রের ব্যবহার মানব ইতিহাসের নবাশ্মীয় পর্বের সঙ্গেই জড়িত, সন্দেহ নেই, কিন্তু টুকরোটাকরা এই সব বিচ্ছিন্ন কিছু কিছু তথ্যাদি ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে এখনও এমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি, একমাত্র বীরভানপুর গ্রাম ছাড়া, যার ফলে আমরা প্রাগৈতিহাসিক নবাশ্মীয় পর্বের বঙ্গীয় সমাজের মোটামুটি একটা ধারণা করতে পারি। এ পর্বের যা যা বিশিষ্ট লক্ষণ, যেমন শস্যোৎপাদনের প্রবর্তনা, বন্যপশুকে গৃহপালিত পশুতে পরিণত করা, ইত্যাদির কোনও প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না।

আপেক্ষিক ভাবে সুস্পষ্ট ও কতকটা সুসংবদ্ধ রূপ প্রথম ধরা যায়, প্রত্নতাত্ত্বিকেরা যাকে বলেন তাম্রশীয় পর্ব বা পর্যায়, সেই কাল থেকে। পশ্চিমবঙ্গে সেই পর্বের সূচনা খ্ৰীষ্টপূর্ব প্রায় ১৩০০-১২০০ বৎসর থেকে। নবাশ্মীয় পর্বের যে দু’চারটি লক্ষণ ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে সেগুলি এই তাম্রাশ্মীয় পর্বেও লক্ষ্য করা যায়; সেজন্য কোনও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক এই পর্বকে নবাশ্মীয়-তাম্রাশ্মীয় পর্ব বা পর্যায় বলেও চিহ্নিত করে থাকেন। এই হচ্ছে মানুষের সামাজিক ইতিহাসের সেই পর্ব যখন সে যন্ত্রপাতি নির্মাণে শুধু পাথর মাত্র আর ব্যবহার করছেনা সঙ্গে সঙ্গে এবং ক্রমবর্ধমান পরিমাণে ধাতুও ব্যবহার করছে, এবং সে ধাতু হচ্ছে তাম্র বা তামা এবং মিশ্রধাতু ব্রোঞ্জ। এই দুই ধাতুনির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলেই সমাজের একটি নূতন রূপ দেখা দেয়; সে রূপের প্রধান লক্ষণ চাষের প্রবর্তনা, স্থায়ী বসতি ও বাস্তুনির্মাণ, গৃহপশু পালন, সমাজ-নির্মাণ। এই নুতন রূপটি প্রথম ধরা পড়েছে পাণ্ডুরাজার ঢিবি উৎখননের ফলে। এই রূপই বাঙালীর আদি-ইতিহাসের রূপ।

পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননের পদ্ধতি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে কিছু মতবিরোধ যে আছে, সে সম্বন্ধে আমি একেবারে অনবহিত নয়। তবু, আমার জ্ঞানবুদ্ধি অনুযায়ী পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমার ধারণা হয়েছে, এই উৎখনন নির্গত প্রত্নতথ্যাদি মোটামুটি নির্ভরযোগ্য এবং তার আশ্রয়ে বাঙালীর আদি-ইতিহাসের একটা কাঠামো দাড় করানো কঠিন নয়।

যে কোনও প্রত্নোৎখননের নিম্নতম স্তর প্রাসঙ্গিক প্রত্নেতিহাসের আদিতম বা প্রথম স্তর। পাণ্ডুরাজার ঢিবির এই আদিতম স্তর বালিময় পলিমাটির স্তর। এই স্তরের উপর পাওয়া গেছে নানা প্রকারের মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের টুকরোটাকরা যার ভেতর উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ছোট ছোট টুকরো। সবচেয়ে উল্লেখ্য হচ্ছে, নরকঙ্কাল সমেত কয়েকটি শবসমাধি। এই কঙ্কালগুলির উপরাধ পাওয়া যায়নি, কিন্তু শবদেহগুলি যে পূর্বশিরে শায়িত ছিল, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। এই স্তরটি ঢাকা পড়েছে একটি শ্বেত-হরিদ্রাভ পাতলা বালির আস্তরণে; উৎখনক অনুমান করেছেন, আস্তরণটি অজয়ের কোনও প্লাবনের পলিমাটি। আস্তরণটির উপর পাওয়া গেছে কিছু কাঠকয়লার টুকরো, কয়েকটি ক্ষুদ্রাশ্মের তৈরী কারুযন্ত্র এবং শ্বেতাভ চিত্ররেখাঙ্কিত ঘনধুসর রঙের মৃৎপাত্রের কয়েকটি টুকরো।

পাণ্ডুরাজার ঢিবির দ্বিতীয় স্তরে আহৃত প্রত্নবস্তু ও প্রত্নতথ্য অর্থবহ। এ স্তরে যে সব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তার মধ্যে আছে নানা আকৃতি-প্রকৃতির ক্ষুদ্রাশীয় কারুযন্ত্র, চিত্রিত এবং ছিদ্রকৃত লাল ও কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, জলনালীযুক্ত মৃৎজলপাত্র, তামার তৈরী নানা অলংকার (তার ভেতর আছে পেচানো সর্পিল বালা, আংটি ও কাজল লাগাবার কাঠি) তামার মাছ ধরবার বঁড়শি ইত্যাদি। মৃৎপাত্রগুলির রং, গড়ন ও অলংকরণ, এগুলির আকৃতি-প্রকৃতি এবং তামার ব্যবহার, এসব লক্ষণ সন্দেহের কোনও অবকাশ রাখে না যে, রাঢ়ের এই অঞ্চল তখন মানব-সভ্যতার তাম্রাশ্মীয় পর্বে উন্নীত হয়েছে। তার আরও প্রমাণ পাওয়া যায় এই স্তরে বাস্তুনির্মাণের যে নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে তার ভেতর। সরলরেখায় সুবিন্যস্ত অনেকগুলি গৃহতল এখানে গোচর হয়েছে; এই গৃহতল তৈরী করা হয়েছে গেরুয়া কাকর মাটি দিয়ে এবং তার উপর খুঁটি পোতার গর্তের চিহ্ন সুস্পষ্ট। একটি সরু বাধানো গলির কিছুটা চিহ্ন এখনও আছে; আর আছে একটি বিস্তৃত শব-সমাধিস্থান যেখানে পূর্ব-পশ্চিমশায়ী করে মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হতো। এই স্তরেই পাওয়া গেছে কিছু মাটির বড় বড় তাল যার উপর ছাপ লেগে আছে নলখাগড়ার, আর পাওয়া গেছে পোড়ামাটির টালির বড় বড় টুকরো। এ অনুমানে বাধা নেই যে, এই স্তরের মানুষ যে-ঘরে বাস করতো তার বেড়া ছিল নলখাগড়ার যার উপর থাকতো মাটির আস্তরণ, আর চাল ছিল পোড়ামাটির টালির। উত্তর ভারতবর্ষের অন্যত্র তাম্রাশ্মীয় যুগের যে সব লক্ষণ দেখা যায়, এই স্তরেও তার বেশ কিছু লক্ষণ স্পষ্টতই ধরা পড়েছে।

যে শব-সমাধিস্থানটির কথা এই মাত্র বলা হলো তার সমস্তর থেকে কুড়িয়ে নেয়া এক খণ্ড কাঠকয়লা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বীক্ষণাগারে পাঠানো হয়েছিল, তেজস্ক্রিয়অঙ্গারক পরীক্ষা করে তার তারিখ নির্ণয়ের জন্য। সে পরীক্ষায় যে-তারিখ নির্ণত হয়েছে তা হচ্ছে খ্ৰীষ্টপূর্ব ১২১০±১২০, অর্থাৎ ১২০ বৎসর কম বা বেশি খ্ৰীষ্টপূর্ব ১০১২ বৎসর। আদি-ইতিহাসের যুক্তিতেও এ তারিখ সম্বন্ধে আপত্তি করবার কিছু নেই। এর অর্থ এই যে, পাণ্ডুরাজার ঢিবির আদিস্তরের তারিখ আনুমানিক আরও দুশ বছর আগে, অর্থাৎ খ্ৰীষ্টপূর্ব ১২৫০/১২০০। অনুমান করা চলে, এই অঞ্চলেই এই সময়ে মানুষের প্রথম সমাজ-রচনার সুষ্ঠু প্রকাশ এবং সংস্কৃতির পথে প্রথম পদক্ষেপ।

এই উৎখননের তৃতীয় স্তরে বাস্তব সংস্কৃতির যে সব উপাদান উপকরণ পাওয়া গেছে তা মোটামুটি দ্বিতীয় স্তরেরই মতো। বস্তুত, আমার দৃষ্টিতে দ্বিতীয় ও তথাকথিত তৃতীয় স্তরে ভেদ কিছু আছে, এমন মনে হয় না। জলনালীযুক্ত মৃৎজলপাত্র, একপদী মৃৎভাণ্ড, নানা আকৃতি-প্রকৃতির চিত্রিত ও নকশাযুক্ত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, লোহিত ও কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভাঙ্গা টুকরো, তামার তৈরী অলংকারাদি এবং প্রচুর ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতিও পাওয়া গেছে। তা ছাড়া পাওয়া গেছে পশুর হাড় বা শিং-এর তৈরী কিছু যন্ত্র, কিছুটা বড় সূচ জাতীয়। এ ধরনের সূচ দ্বিতীয় স্তরেও কিছু পাওয়া গেছে; কিন্তু এই তৃতীয় স্তরে এমন সংখ্যায় পাওয়া গেছে যাতে সন্দেহ হয়, এখানে এ ধরনের যন্ত্র-নির্মাণের ছোটখাটাে একটা কারখানাই বুঝি বা ছিল। পোড়ামাটির তৈরী একটি নারীমূর্তির দেহের কিয়দংশ এবং দুটি বিজাতীয় পুরুষ-মূর্তির মাথাও পাওয়া গেছে এই স্তর থেকেই। রান্নার উনুনের নিদর্শনও আছে। কিন্তু তৃতীয় স্তরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও অর্থবহ আবিষ্কার হচ্ছে একদিকে মসৃণ তীক্ষাগ্র নবাশ্মীয় কয়েকটি cells এবং অন্যদিকে লোহার তৈরী ছোট কয়েকটি ফলা ও তীক্ষাগ্র সূচ। খুব তুচ্ছ পরিমাণে হলেও এই স্তরে লোহার এই ব্যবহার একটু বিস্ময়কর, বোধ হয়, সন্দেহজনক। এই তৃতীয় স্তরেই অনেকটা জায়গা জুড়ে প্রচুর ছাই-এর চাপ উৎখনকদের গোচরে এসেছে। এ থেকে তারা অনুমান করেছেন, কোনও এক সময়ে বড় একটা অগ্নিকাণ্ডে এখানকার অনেক ঘরবাড়ি পুড়ে গিয়েছিল; ছাইয়ের চাপ সেই অগ্নিদাহের। বিস্ময়ের কথা এই যে, এই ছাই-এর চাপের উপরই পাওয়া গেছে আরও প্রচুর লোহার তৈরী যন্ত্রপাতি এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়া যাচ্ছে একেবারে নূতন ধরনের মৃৎপাত্রশিল্পের প্রচুর নিদর্শন, যা সাধারণত পাওয়া যায় ৬০০–২৫০ খ্ৰীষ্টপূর্ব কালের ভূগর্ভ স্তরে। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, অগ্নিদাহের পর জায়গাটি পরিত্যক্ত হয়েছিল; পরে ৬০০-২৫০ খ্ৰীষ্টপূর্ব তারিখের ভেতর কোনও নূতন আগন্তুকেরা এখানে এসে বসবাস শুরু করেন; মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষগুলি তাদেরই সংস্কৃতির পরিচায়ক। কিন্তু লোহার যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র যা তৃতীয় স্তরে পাওয়া গেছে তা নিয়ে এ ধরনের কোনও সন্দেহ নেই, অন্তত উৎখনকদের মনে; তাদের দৃঢ় ধারণা, খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ১০০০ বৎসরের কাছাকাছি, তৃতীয় স্তরে একই সঙ্গে ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতি, তামার অলংকারাদি এবং লোহার যন্ত্রপাতি ও অস্ত্রশস্ত্র একই সঙ্গে ব্যবহৃত হতো। উল্লেখ প্রয়োজন যে, লোহার অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে পাওয়া গেছে বাটসহ তীক্ষ্ণমূখ একটি ছোট তরোয়াল, নাতিক্ষুদ্র তীরের শিরাগ্র এবং একটি নাতিক্ষুদ্র bar celt | ব্যক্তিগতভাবে আমি এ সম্বন্ধে উৎখনকদের মতামতে গভীর সন্দিহান। আমার ধারণা, তৃতীয় স্তরের লৌহ-অভিজ্ঞান যা কিছু সমস্তই কিছুটা পরবর্তী কালের; নূতন ধরনের মৃৎপাত্র নিয়ে যে সব নূতন আগন্তুক এসেছিল এখানে নূতন বসতি স্থাপন করতে তারাই নিয়ে এসেছিল লোহার ব্যবহার, লোহার যন্ত্রপাতি, লোহার অস্ত্রশস্ত্র। এবং এ ব্যাপারটা খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০ শতকের আগে ঘটেছিল বলে একেবারেই আমার মনে হয় না।

আমার সন্দেহের প্রথম কারণ, পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননের চতুর্থ স্তরে লোহার তৈরী কোনও যন্ত্রপাতি, কোনও অস্ত্রশস্ত্ৰ-নিদর্শনের সন্ধান পাওয়া যায়নি, যা, উৎখনকের যুক্তিতে, পাওয়া উচিত ছিল। অন্তত পরেশচন্দ্রের বিবরণে তার কোনও উল্লেখ নেই। তৃতীয় স্তরে লোহা ব্যবহারের প্রচলন থাকলে চতুর্থ স্তরে তার অভিজ্ঞান আরও অনেক বেশি থাকবার কথা; বস্তুত তা নেই। সন্দেহের দ্বিতীয় কারণ, ভারতবর্ষে, বিশেষ করে উত্তর ভারতে লোহার ব্যবহারের সূচনা ও বিস্তৃতির দীর্ঘ ইতিহাস এবং অন্যদিকে মানব-সংস্কৃতির বিকাশে লোহা-ব্যবহারের প্রভাব ও প্রতিপত্তির ইতিহাস। এই উভয় ইতিহাসের আলোচনার স্থান এই গ্রন্থের পরিশিষ্ট্রের পরিমিত সীমার মধ্যে সম্ভব নয়; হয়ত প্রয়োজনও নেই। শুধু এটুকু বলাই বোধ হয় যথেষ্ট যে, পশ্চিম এশিয়া থেকে শুরু করে লোহার ব্যবহার তক্ষশীলা ভেদ করে (খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ১১০০/১০০০), পশ্চিম যুক্ত-প্রদেশের আত্রাঞ্জিখেরা হয়ে (আনুমানিক ৯০০), বিহার ছুয়ে (আনুমানিক ৮০০/৭০০) রাঢ়দেশে পৌছুতে আনুমানিক খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০’র আগে হবার কথা নয়। অবশ্য আমি অবহিত আছি যে, ছোটনাগপুর অঞ্চলে আকরিক লৌহবালুকা থেকে লোহা গলাবার আদিম একটা পদ্ধতি স্থানীয় আদিম অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত ছিল। কিন্তু এই ঢিবির তৃতীয় স্তরে পাওয়া লৌহ যন্ত্রগুলির লোহা এই আদিম পদ্ধতির লোহা বলে মনে হয় না। আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু এই স্তরে লোহা ব্যবহারের যে তারিখ (খ্ৰীষ্টপূর্ব ১০০০) পরেশচন্দ্র ধার্য করতে চান সে সম্বন্ধে আমার সন্দেহ রয়ে গেল। আমার সন্দেহের তৃতীয় কারণ, বোলপুর সন্নিহিত মহিষদলে লোহা ব্যবহারের তারিখ; তেজস্ক্রিয়-অঙ্গারক পরীক্ষায় এখানকার যে তারিখ নির্ণীত হয়েছে তা খ্ৰীষ্টপূর্ব ৭০০’র আগে নয়।

যাই হোক, পাণ্ডুরাজার ঢিবির চতুর্থ স্তরের উৎখনন বিবরণ পড়ে আশঙ্কা হয়, এখানকার ভূমিস্তর একাধিকবার বেশ আবর্তিত হয়েছে; কখন হয়েছে বলা কঠিন; এই স্তরের দুই পর্যায়ে যে সব প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে তা একই সংস্কৃতির লক্ষণে চিহ্নিত, এমন মনে হয় না। ত্রিকোণাকৃতি পোড়ামাটির বাটি, সাধারণ মৃৎভাণ্ড, লাল রঙের মৃৎপাত্র, মুদ্রিত অথবা খোদিত নানা নকশাযুক্ত মৃৎভাণ্ড, জলের ঝাঁঝরি, কয়েকটি পোড়ামটির পশু ও স্ফীতবক্ষ নারীমূর্তি, সুবিন্যস্ত একসারি মাছ ও তার উপর তির্যক রেখায় খোদাই করা একটি মৃৎভাণ্ড প্রভৃতির ভগ্নাবশেষ এই স্তর থেকে আহত হয়েছে। এ সমস্তই অল্পবিস্তর পরিচিত ঐতিহাসিক কালের; এই সব বস্তু আদি ইতিহাসের লক্ষণে চিহ্নিত নয়, এবং সে-ঐতিহাসিক কাল মোটামুটি খ্ৰীষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৩০০/২৫০ পর্যন্ত বিস্তৃত। চতুর্থ স্তরের একটি গর্তে কালো steatite পাথরের একটি গোল শীলমোহর পাওয়া গেছে; এই প্রত্নদ্রব্যটি নিঃসন্দেহে মূল্যবান। শীলমোহরটির উপর তিনভাগে বিভক্ত তিনটি উচ্চাবচ (relief) চিত্র যার বিষয় উদ্ধার করতে আমি অপারগ। পরেশচন্দ্র এই চিত্রগুলির একটা বর্ণনা দিয়েছেন; সে-বর্ণনা আমি ছবির সঙ্গে ঠিক মেলাতে পারছিনে। জনৈক ইংরেজ প্রত্নতাত্ত্বিক বলেছেন, শীলমোহরটির উৎস প্রাচীন মিনোয়া (Minoan) সংস্কৃতি। এ উৎস আমি দেখতে পাচ্ছিনে, সখেদে তা স্বীকার করছি। এই শীলমোহরটির এবং একটি মৃৎফলকের অভিজ্ঞান, তমলুকে প্রাপ্ত কয়েকটি মৃৎভাণ্ডের ভগ্নাবশেষ,চব্বিশ পরগণা জেলার হরিনারায়ণপুর ও চন্দ্রকেতুগড়ে প্রাপ্ত কয়েকটি শীলমোহর ও মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের মধ্যে পরেশচন্দ্র প্রাচীন ক্রিটিয় (cretan) ও মিশরীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির লক্ষণ লক্ষ করেছেন এবং তা থেকে অনুমান করেছেন, পাণ্ডুরাজার ঢিবির এবং বাঙালীর আদি-ইতিহাসের সংস্কৃতি ও জীবনচর্য প্রধানত ব্যবসা-বাণিজ্য নির্ভর ছিল এবং সে-ব্যবসাবাণিজ্য বৈদেশিক, ভূমধ্যসাগরীয় দেশগুলির সঙ্গে। এ অনুমান যথার্থ কি অযথার্থ, তা বলা আমার পক্ষে আপাতত কঠিন, যেহেতু আমি পরেশচন্দ্র কথিত সাদৃশ্যগুলি সম্বন্ধে কিছুটা সন্দিহান, এবং এই অনুমিত সাদৃশ্য ছাড়া এ পর্বে এ ধরনের বিস্তৃত বৈদেশিক বাণিজ্যের অন্য কোনও প্রমাণ এখনও দেখতে পাচ্ছিনে।

প্রাচীন রাঢ়ের, বিশেষভাবে পূর্বোক্ত নদনদীগুলির তীরে তীরে নানা জায়গায় তাম্রাশ্মীয়-নবাশ্মীয় পর্বের নানা প্রত্ন-নিদর্শন পাওয়া গেছে, কিন্তু পাণ্ডুরাজার ঢিবির উৎখননই এই সব আবিষ্কারের সূচনায়। বস্তুত, এই ঢিবিই বাঙালীর আদি ইতিহাসের কুঞ্চিকা। এই কারণেই এই উৎখননের বিবরণ একটু সবিস্তারেই বলতে হলো।

এই উৎখনন-বিবরণের পরই বলতে হয় বোলপুর সন্নিহিত কোপাই-তীরবর্তী মহিষদল গ্রামে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের উৎখননের কথা। এখানকার প্রথম স্তর একান্তই তাম্রাশ্মীয়। পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে যেমন, এখানেও সেই মাটির আস্তরণযুক্ত নলখাগড়ার দেয়ালওয়ালা ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ, পাথরের ধারালো ফলার যন্ত্রপাতি, তামার তৈরী চ্যাপ্টা cell, কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, লাল মৃৎপাত্রের টুকরো, নালিযুক্ত জলপাত্র। তা ছাড়া উল্লেখ্য হচ্ছে, এখানে পাওয়া গেছে বেশ কিছু পরিমাণে পোড়া ধান-চালের অঙ্গার। তেজস্ক্রিয় অঙ্গর পরীক্ষায় এই স্তরের তারিখ নির্ণত হয়েছে খ্ৰীষ্টপূর্ব ১৩৮০ থেকে ৮৫৫’র ভেতর। দ্বিতীয় স্তরেও একই ধরনের মৃৎপাত্র নিদর্শন, তবে এই স্তরের পাত্রগুলির প্রকৃতি একটু স্থূল। কিন্তু এই স্তরের বিশিষ্ট লক্ষণ হচ্ছে লোহার আবির্ভাব। এই স্তরেও তেজস্ক্রিয় অঙ্গার পরীক্ষা হয়েছে; তারিখ পাওয়া গেছে খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৭০০।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব সংস্থা অজয়-কুন্নুর-কোপাইর অববাহিকার, নানা প্রত্নস্থানে প্রচুর প্রত্নানুসন্ধান করেছেন। বসন্তপুর, রাজার ডাঙ্গা, গোস্বামীখণ্ড, মঙ্গলকোট, গঙ্গাডাঙ্গা, কীর্ণহার, চণ্ডীদাস-নানুর, বেলুটি, সুপুর, মন্দিরা, শালখানা, সুরথরাজার ঢিবি, যশপুর প্রভৃতি নানা জায়গায় প্রত্নানুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে তা প্রায় সবই তাম্রাশ্মীয় পর্বের এবং মোটামুটি পাণ্ডুরাজার টিবি ও মহিষদলের সাংস্কৃতিক জীবনের সমর্থক। বস্তুত, সন্দেহের কোনও কারণ নেই যে, এই অঞ্চলেই ইতিহাসের তাম্রাশ্মীয় পর্বের বাঙালী বসতিস্থাপন করে বাস্তু তৈরী করে শস্যোৎপাদন, পশুপালনে এবং সমাজগঠনে প্রথম অভ্যস্ত হয়েছিল।

১৯৭৪-এ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব-সংস্থা বর্ধমান শহর থেকে ২৮/২৯ কিলোমিটার উত্তরে বড়বেলুন গ্রামের বানেশ্বরডাঙ্গায় কিছু প্রত্নোৎখনন করেছিলেন। এই খননেরও প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরে তাম্রাশ্মীয় পর্বের বাস্তব সভ্যতার নানা নিদর্শন পাওয়া গেছে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ডক্টর শ্রীমতী অমিতা রায়ের সৌজন্যে এবং পরেশচন্দ্রের অনুগ্রহে পরেশচন্দ্রেরই রচিত এই খননের একটি সংক্ষিপ্ত (অপ্রকাশিত) বিবরণ আমার দেখার সুযোগ হয়েছে। তাতে দেখতে পাচ্ছি, এখানে প্রাপ্ত নানা আকৃতি-প্রকৃতির মৃৎপাত্রাবশেষ প্রাচুর্য যেন পাণ্ডুরাজার ঢিবির চেয়েও বেশি। ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতির ভগ্নাংশ, হাড় ও তামার তৈরী দ্রব্যাদি এবং ঘরবাড়ির ধবংসাবশেষও পাওয়া গেছে, যেমন পাওয়া গেছে এই পর্বে পাণ্ডুরাজার টিবি ও মহিষদলে। কিছু কিছু অভিজ্ঞান থেকে মনে হয়, এই পর্বে এখানকার মানুষ ধান চাষ করতো, মাছ এবং পশু শিকারও করতো; প্রচুর মাছ ও পশুর কাটা ও হাড় পাওয়া গেছে এই প্রত্নস্থানের প্রথম দুই স্তরেই। তৃতীয় স্তরে পাওয়া গেছে লোহা ব্যবহারের কিছু অভিজ্ঞান | চতুর্থ স্তরে ঐতিহাসিক পর্ব শুরু হয়ে গেছে।

১৯৭৫-৭৬-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ডক্টর অমিতা রায়-এর নেতৃত্বে এক বিস্তৃত প্রত্নানুসন্ধানাভিযান চালিয়েছিলেন ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর ও অজয়-কুন্নুর-দামোদরের অববাহিকার নানা অঞ্চলে। আমার প্রাক্তন ছাত্রী অমিতা রায় এই অভিযানের যে-প্রতিবেদন রচনা করেছেন তার একটি প্রতিলিপি তিনি আমায় ব্যবহার করতে দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের প্রাচীন রাঢ়ের বিস্তৃত অংশে বাঙালীর আদি-ইতিহাসের চেহারাটা কী ছিল তার একটা মোটামুটি সামগ্রিক পরিচয় এ-যাবৎ অপ্রকাশিত এই প্রতিবেদনটিতে পাওয়া যায়।

পাণ্ডুরাজার ঢিবি, বানেশ্বরভাঙ্গা, মহিষদল, ভরতপুর ও অন্যান্য প্রত্নস্থান থেকে আদি-ইতিহাসের যে-চিত্র দৃষ্টিগোচর, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযানের আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তু সমস্তই সে-চিত্রকে আরও স্ফুটতর করেছে। তবে, এ অভিযান থেকে মনে হচ্ছে, ময়ূরাক্ষী বক্রেশ্বর-কোপাই-অজয়-কুকুর-দামোদরবিধৌত রাঢ়দেশেও তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির বিস্তার সর্বত্র সমান নয়। ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বরের উপর দিকের প্রবাহে, অর্থাৎ বীরভূম জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশে এ সংস্কৃতির বিস্তার অপেক্ষাকৃত কম, মধ্য ও দক্ষিণাংশে বেশি, এবং পূর্বদিকে, অর্থাৎ বক্রেশ্বর-অজয়-দামোদরের সংযোগ স্থলের দিকে এগিয়ে গেলে মনে হয়, তাম্রাশ্মীয় পর্বের লোকেরা যেন ক্রমশ সেইদিকেই বিস্তৃত হতে থাকে। যাইহোক, এ বিষয়ে কোনও সংশয় নেই যে, তাম্রাশ্মীয় সংস্কৃতির কেন্দ্র ছিল এই ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-অজয়-কুমুর-দামোদরের অববাহিকা অঞ্চল। এই উর্বর, শস্যপ্রসূ অঞ্চলের সঙ্গে জলপথে ও স্থলপথে দেশের ও বিদেশের অন্যান্য অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল, এ সম্বন্ধেও সন্দেহ নেই, এবং এই কারণেই এই অঞ্চলে এতগুলি তাম্রাশ্মীয় প্রত্নস্থান ইতস্তত প্রকীর্ণ। এই অঞ্চলে নবাশ্মীয় celts অনেকগুলির প্রত্নস্থান থেকেই পাওয়া গেছে, কিন্তু নবাশ্মীয় প্রাথমিক কৃষি-সংস্কৃতি থেকে কী করে তাম্রাশ্মীয় পর্বের বিবর্তিত বিস্তৃত কৃষি-সংস্কৃতির উদ্ভব হলো তার কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক অভিজ্ঞান আজও আমাদের জানা নেই। পাণ্ডুরাজার ঢিবির প্ৰথম স্তরের প্রত্নবস্তুর মধ্যেও এ সম্বন্ধে যা অভিজ্ঞান পাওয়া যায়, তা খুব স্পষ্ট ও পরিষ্কার নয়; সেখানে নবাশ্মীয় ও তাম্রাশ্মীয় অভিজ্ঞান এমনভাবে মিশে আছে যে, তা থেকে সুস্পষ্ট কোনও ধারণা করা যায় না |

তাম্রাশ্মীয় পর্বের প্রধান লক্ষণ যে কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্র, অমিতা রায়-এর অভিযানের পর এ সম্বন্ধে আর সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে, এই ধরনের মৃৎপাত্রের বিস্তৃতি এ অঞ্চলের সর্বত্র সমান নয়। যা হোক, তার এ অনুমান হয়ত যথার্থ যে, তাম্রাশ্মীয় এই সংস্কৃতিই গামা-সমাজ সংঘটন ও উন্নততর, বিস্তৃততর কৃষিকর্মের দ্যোতক। কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এই সংস্কৃতির সঙ্গে নাড়ীর যোগ ছিল গাঙ্গেয় ভারত, মধ্যভারত ও রাজস্থানের তালাশ্মীয় সংস্কৃতির। কিন্তু, এমনও তো হতে পারে যে, এই যোগাযোগটা ঘটেছিল গাঙ্গেয় ভারতের মাধ্যমে নয়, ওড়িশার মাধ্যমে। এই প্রসঙ্গে অমিতা রায় আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন কিছু কিছু ক্ষুদ্রাশ্মীয় যন্ত্রপাতি এবং কৃষ্ণ-লোহিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষের প্রতি, যা পাওয়া গেছে বীরভূম-বর্ধমানে নয়, পাওয়া গেছে কংসাবতী-বিধৌত মেদিনীপুর-ধাকুড়া-পুরুলিয়ায়, অর্থাৎ যার ইঙ্গিত ওড়িশামুখী।

মহিষদল-উৎখননের প্রথম স্তরে তামার তৈরী ভাঙা একটি কুড়োল মতো জিনিস পাওয়া গেছে। ঠিক এই ধরনের তামার তৈরী কুড়ালোপম প্রত্নবস্তু কিছু কুড়িয়ে পাওয়া গেছে মেদিনীপুর-ধাকুড়া-পুরুলিয়ার নানা প্রত্নস্থান থেকে। ইতিহাসের আদিপর্বে এই অঞ্চলে তামার তৈরী যন্ত্র, অস্ত্র প্রভৃতির ব্যবহার প্রচলিত হয়েছিল, সন্দেহ নেই, কিন্তু এর পূর্বাপর – কী, এই বিশিষ্ট ধাতুশিল্পটির কী স্থান ছিল এই অঞ্চলের সমসাময়িক জীবনে, সে সম্বন্ধে কোনও ধারণা করবার উপায় এখনও নেই।

অমিতা রায়-এর অভিযান-প্রতিবেদন থেকে একটি তথ্য যেন কিছুটা স্পষ্টতর হয়ে ধরা পড়েছে। দেখা যাচ্ছে, ময়ূরাক্ষী-বক্রেশ্বর-অজয় অঞ্চলে তাম্রাশ্মীয় পর্বের এবং লোহা ব্যবহারকারী লোকদের পর নিরবচ্ছিন্ন জনবসতি আর যেন নেই। যে কারণেই হোক, এ অঞ্চল থেকে মানুষ যেন অন্যত্র সরে গেছে। কিন্তু অজয়-কুনুর-দামোদর- ভাগীরথী অঞ্চলের আদি-ঐতিহাসিক চিত্রটা যেন বেশ অন্য প্রকারের। এ অঞ্চলে ক্রমবর্ধমান লোহার যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ফলে বেশ একটু লক্ষণীয় বৈষয়িক সমৃদ্ধি যেন দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। পাণ্ডুরাজার ঢিবির তৃতীয় স্তরেই তা কিছুটা দেখা গেছে, কিন্তু তা স্পষ্টতর হয়েছে অজয়-কুমুর-ভাগীরথীর সংযোগস্থলের প্রত্নস্থানগুলিতে। এ অঞ্চলে দেখা যাচ্ছে, লৌহ-ব্যবহার-চিহ্নিত সমৃদ্ধ জনবসতি নিরবচ্ছিন্নতায় ঐতিহাসিক কালে এসে মিশে গেছে। খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ৩০০ নাগাদ এই অঞ্চল যে সমসাময়িক উত্তর-ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে এ সম্বন্ধে সন্দেহের আর কোনও অবকাশ নেই। যে সব প্রত্নবস্তু এ অঞ্চলের প্রত্নস্থানগুলিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে, যেমন, উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণচিক্কণ মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, নানা চিহ্নে মুদ্রিত মুদ্রা, ছোটবড় bead ও অন্যান্য শিল্পদ্রব্য, তার ভেতরই সে-সাক্ষ্য নিহিত। বস্তুত, খ্ৰীষ্টপূর্ব মোটামুটি ৩০০ থেকে শুরু করে খ্ৰীষ্ট-পরবর্তী ২০০ বৎসরের মধ্যে পূর্ব বীরভূম (যেমন, কোটাসুর গ্রাম) থেকে শুরু করে সমুদ্রশায়ী মেদিনীপুর, (যেমন, তাম্রলিপ্ত বা তমলুক), নিম্নগাঙ্গেয় ২৪ পরগণা (যেমন, চন্দ্রকেতুগড়), ভাগীরথীঘৃত মুর্শিদাবাদ (যেমন, চিরুটি), গাঙ্গেয় উত্তরবঙ্গ (যেমন, মহাস্থান গড়) পর্যন্ত যে একটি বিস্তৃত সমৃদ্ধ সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল তার প্রচুর প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ গত ২৫/৩০ বৎসরের মধ্যে আহৃত হয়েছে, কিছু উৎখননের ফলে, অধিকাংশ প্রত্নানুসন্ধানের ফলে। কোটাসুর, চন্দ্রকেতুগড় ও মহাস্থানে প্রাপ্ত আরোপিত অলংকরণযুক্ত পোড়ামাটির শিল্পদ্রব্য, অজয় কুন্নুর-ভাগীরথীর ব-দ্বীপ অঞ্চলে এবং নিম্নগাঙ্গেয় ২৪ পরগণা, মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ ও পূর্ব-বীরভূমের বহু প্রত্নস্থলে প্রচুর পরিমাণে প্রাপ্ত উত্তর-ভারতীয় কৃষ্ণচিকণ মৃৎপাত্রের ভগ্নাবশেষ, চিহ্নমুদ্রিত মুদ্রা, ঢালাই করা তাম্রমুদ্রা, পোড়ামাটির ঝাঝরা, ধূসর মৃৎপাত্রের টুকরো, নানা রকমের পোড়ামাটির নরনারী ও পশুমূর্তি, খেলনা, কুণ্ডলীকৃত নকশাযুক্ত মৃৎপাত্র প্রভৃতি প্রত্নদ্রব্যের মধ্যেই সে প্রমাণ সোচ্চারে বিদ্যমান। এ অনুমানে বোধ হয় বাধা নেই যে, এই সমৃদ্ধ সমাজ-জীবন ও সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল প্রধানত মৌর্যযুগে বঙ্গদেশ মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রভাব-পরিধির অন্তর্ভুক্ত হবার সময় থেকে এবং এর মূলে ছিল ক্রমবর্ধমান লৌহ-যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং ধানচাষের বিস্তার। এর প্রস্তুতি-পর্বের শুরু অবশ্য তাম্রাশ্মীয় পর্ব থেকেই, বিশেষভাবে লোহার যন্ত্রপাতির প্রচলন (খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক ৭০০/৬০০) থেকে।