৪. গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্ব : আঃ ৩৫০-৭৫০ খ্রীঃ ॥ বিবর্তন
বাঙলাদেশের সর্বতোভদ্র আর্যীকরণ গভীর ভাবে এবং সার্থকরূপে আরম্ভ হইল গুপ্তপর্বেই। এই আরম্ভ হওয়ার মূলে সর্বভারতীয় ইতিহাসের একটি প্রেরণা সক্রিয়, কিন্তু সবিস্তারে তাহা বলিবার ক্ষেত্র এই গ্রন্থ নয়। শুধু ইঙ্গিতটুকু রাখা চলে মাত্র।
গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্ব : আঃ ৩৫০-৭৫০ খ্রীঃ ॥ বিবর্তন
খ্রীষ্ট শতকের প্রায় দেড়শত বৎসর পূর্ব হইতে আরম্ভ করিয়া খ্রীষ্টোত্তর দেড়শত-দুইশত বৎসর ধরিয়া ভূম্যধীয় যাবনিক এবং মধ্য এশীয় শক কুষাণ ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রবাহ ভারতীয় প্রবাহে নূতন নূতন ধারা সঞ্চার করিতেছিল। সূচনাতেই এই সব বিচিত্র ধারাগুলিকে সংহত ও সমন্বিত করিয়া মূল প্রবাহের সঙ্গে একই খাতে প্রবাহিত করা সম্ভব হয় নাই; তাহা স্বাভাবিকও নয়। তাহা ছাড়া, গ্রামীণ কৃষি সভ্যতার ধীর মন্থর জীবনে এই সমন্বয়ের ও সংহতির গতিও ধীর মন্থর হইতে বাধ্য। বৌদ্ধ ধর্মে মহাযান-বাদের উদ্ভব, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধ্যানে অনেক নূতন দেবদেবীর সৃষ্টি ও রূপকল্পনা, ধর্মীয় ও সামাজিক আচারানুষ্ঠানে কিছু কিছু নূতন ক্রিয়াকর্ম প্রভৃতি এই কালে দেখা দেয়। ইহাদের তরঙ্গাভিঘাত ভারতীয় জীবনের তটে আলোড়ন সৃষ্টি করিয়াছিল সন্দেহ নাই। ভারতীয় অর্থনৈতিক জীবনেও এই সময় একটি গুরুতর রূপান্তর দেখা দেয়। প্রথম খ্রীষ্ট শতকের তৃতীয় পাদ হইতেই ভূম্যধীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের এক ঘনিষ্ঠতর সম্বন্ধ স্থাপিত হয় এবং তাহার ফলে ভারতবর্ষের অর্থনৈতিক কাঠামোর বিরাট পরিবর্তনের সূচনা হয়। যে-দেশ ছিল প্রধানত ও প্রথমত কৃষিনির্ভর সেই দেশ, রোম সাম্রাজ্যের সকলপ্রান্ত হইতে প্রচুর সোনা আগমের ফলে, ক্রমশ আপেক্ষিকত শিল্প-বাণিজ্য নির্ভরতায় রূপান্তরিত হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে ভারতবর্ষের সর্বত্র সমৃদ্ধ নগর, বন্দর, হাট-বাজার ইত্যাদি গড়িয়া উঠিতে আরম্ভ করে। বিদেশী নানা ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির তরঙ্গাভিঘাত, নানা জাতি ও জনের সংঘাত এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর এই বিবর্তন, এই দুইএ মিলিয়া ভারতীয় জীবন-প্রবাহে এক গভীর চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এই চাঞ্চল্য শুধু জীবনের উপরের স্তরেই নয়, বরং ইহার ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিহিত চিন্তার ও কল্পনার গভীরতর স্তরে, জীবনের বিস্তারে। সংহতি ও সমন্বয়ের সজাগ প্রয়াস দেখা দেয় খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতক হইতেই; ঐ শতকেই দেখিতেছি সাতবাহনরাজ গৌতমীপুত্র ‘সাতকর্ণী বিনিবর্তিত চাতুর্বর্ণা সকরম’ চাতুর্বর্ণ সাংকর্য নিবারণ করিয়া তদানীন্তন বর্ণ-ব্যবস্থাকে একটা সমন্বিতরূপের মধ্যে বাঁধিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কিন্তু এই প্রয়াস জীবনের সকল ক্ষেত্রে বিস্তৃত হইয়া ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির নব রূপান্তর ঘটাইতে পারিল শুধু তখনই যখন ভারতবর্ষের এক সুবৃহৎ অংশ গুপ্তবংশীয় সম্রাটদের রাষ্ট্রবন্ধনে এবং তাঁহাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বাঁধা পড়িল। রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক জীবনের এই সংহতিই ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সংহতিকে দ্রুত অগ্রসর করিয়া দিল। উপরোক্ত সমন্বয় ও সংহতির সর্বশ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞান হইতেছে ব্রাহ্মণ্য পুরাণ, বৌদ্ধ ও জৈন পুরাণ। এ গুলির সংকলন কাল গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগ।
ভারতীয় ইতিহাসের এই বিস্তৃত ও গভীর বিবর্তনের সঙ্গে সমসাময়িক বাঙলার ইতিহাস ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িত। গুপ্ত সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক সংহতির মধ্যে ধরা পড়িবার সঙ্গে সঙ্গেই সর্বভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির স্রোত সবেগে বাঙলাদেশে প্রবাহিত হইতে আরম্ভ করে এবং দেখিতে দেখিতে এই দেশ ক্রমশ নিখিল ভারতীয় সংস্কৃতির এক প্রত্যন্ত অংশীদার হইয়া উঠে। গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের বাঙলার ইতিহাসে এই তথ্য গভীর অর্থবহ।
বৈদিক ধর্ম
প্রথমেই চোখে পড়ে বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা ও প্রসার প্রাক গুপ্তপর্বে কিন্তু তাহার অস্তিত্ব কোথাও সহজে ধরা পড়ে না। একটির পর একটি তাম্রপটে দেখিতেছি, বাঙলাদেশের নানা জায়গায় ব্রাহ্মণেরা আসিয়া স্থায়ী বাসিন্দা হইয়া যাইতেছেন। ইহারা কেহ ঋগ্বেদীয়, কেহ বাজসনেয়ী শাখাধ্যায়ী, কেহ যজুর্বেদীয়, কেহ বা সামবেদীয়; কাহারও গোত্র কাম্ব বা ভার্গব বা কাশ্যপ, কাহারও ভরদ্বাজ বা অগস্ত্য বা বাৎসা বা কৌণ্ডিণ্য। ভূমিদান যাহা হইতেছে তাহার অধিকাংশই ব্রাহ্মণদের এবং দানপুণ্যের অধিকারী হইতেছেন দাতা এবং তাহার পিতামাতা। দানের উদ্দেশ্য দেবমন্দির নির্মাণ, মন্দির-সংস্কার, বিগ্রহের নিতা নিয়মিত সেবা ও পূজার বিচিত্র উপকরণ ব্যয়-সংস্থান, বলি-চরু-সত্র, ধূপ-দীপ পুষ্প-চন্দন-মধুপর্ক প্রভৃতির সংস্থাপন, অগ্নিহোত্ৰ ও পঞ্চমহাযজ্ঞের (অধ্যাপনা, হোম, তর্পণ, বলি ও অতিথি-পূজা) বায়-সংস্থান, ইত্যাদি। একাধিক লিপিতে দেখিতেছি, গ্রামবাসী কোনও গৃহস্থ ভূমি কিনিয়া ব্রাহ্মণদের আহ্বান করিয়া আনিয়া ভূমিদান করিয়া তাঁহাদের গ্রামে বসাইতেছেন। ষষ্ঠ শতকে এই বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহ বাঙলার পূর্বতম প্রান্তে পৌঁছিয়া গিয়াছে। ভাস্করবর্মার নিধনপুর-লিপিতে দেখি ভূক্তিবর্মার রাজত্বকালেই শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড গ্রামে দুই শতেরও উপর ব্রাহ্মণ পরিবার আহ্বান করিয়া আনিয়া বসানো হইতেছে। ইহারা কেহ ঋগ্বেদীয় বাহুবচা শাখাধ্যায়ী, কেহ বা সামবেদীয় ছান্দোগ্য শাখাধ্যায়ী, আবার কেহ কেহ বা যজুর্বেদীয় রাজসনেয়ী, চারকা বা তৈত্তিরীয় শাখাধ্যায়ী : প্রত্যেকের ভিন্ন ভিন্ন গোত্র ও প্রবর। সপ্তম শতকে লোকনাথ-পট্রোলীতে দেখিতেছি, সমতট দেশে বর্তমান ত্রিপুরা জেলায় জঙ্গল কাটিয়া নূতন বসতির পত্তন হইতেছে এবং সেই পত্তনে যাঁহাদের বসানো হইতেছে তাঁহারা সকলেই চতুর্বেদবিদ ব্রাহ্মণ। সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই যে, এই পর্বে বাঙলার সর্বত্র বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতি বিস্তার লাভ করিতেছে।
বৈষ্ণব ধর্ম
কিন্তু বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তারাপেক্ষাও লোকায়ত জীবনের দিক হইতে অধিকতর অর্থবহ পৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার। ইহারও বিশেষ কিছু অস্তিত্ব প্রাক্-গুপ্ত বাঙলায় দেখিতেছি না। অথচ, চতুর্থ শতকেই দেখিতেছি, বাঙলার পশ্চিমতম প্রান্তে বাঁকুড়া জেলার শুশুনিয়া পাহাড়ের এক গুহার প্রাচীরগাত্রে একটি বিষ্ণুচক্র উৎকীর্ণ এবং চক্রের নীচেই যাঁহার লিপিটি বিদ্যমান সেই রাজা চন্দ্রবর্মা লিপিতে নিজের পরিচয় দিতেছেন চক্রস্বামীর পূজক বলিয়া। চক্রস্বামী যে বিষ্ণু এবং গুহাটি যে একটি বিষ্ণুমন্দির রূপেই কল্পিত, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও কারণ নাই। পঞ্চম শতকের প্রথমার্ধে বগুড়া জেলার বালিগ্রামে এক গোবিন্দস্বামীর মন্দির প্রতিষ্ঠার খবর পাওয়া যাইতেছে। বৈগ্রাম-লিপিতে এবং ঐ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উত্তরবঙ্গে, দুর্গম হিমবচ্ছিখরে শ্বেতবরাহস্বামী ও কোকামুখস্বামী নামে দুই দেবতার দুই মন্দির প্রতিষ্ঠার খবর পাওয়া যাইতেছে ৪ নং ও ৫ নং দামোদরপুর-পট্রোলীতে। গোবিন্দস্বামী বিষ্ণুরই অন্যতম নাম সন্দেহ নাই; শ্বেতবরাহস্বামীও বরাহ অবতার বিষ্ণুরই অন্যতম রূপ বলিয়া মনে হয়। কোকামুখস্বামীকে কেহ মনে করেন বিষ্ণুর অন্যতম রূপ, কেহ মনে করেন শিবের। বরাহপুরাণ মতে কোকামুখ স্থাননাম; ইহার অবস্থিতি কৌশিকী ও ত্রিস্রোতার অনতিদূরে হিমালয়ের কোনও অংশে; স্থানটি বিষ্ণুর পরম প্রিয় এবং এখানকার বিষ্ণু প্রতিমাই শ্রেষ্ঠ বলিয়া দাবি করা হইয়াছে। দামোদরপুর-লিপির হিমবচ্ছিখরস্থ কোকামুখস্বামীর মন্দির কি বরাহপুরাণ-কথিত এই বিষ্ণু-প্রতিমার মন্দির? শ্বেতবরাহরূপী বিষ্ণু সহজবোধ্য; কোকামুখ বিষ্ণু কি কৃষ্ণ বা রক্তবরাহরূপী বিষ্ণু? বোধ হয় তাহাই। যাহাই হউক, ইহার কিছুদিন পরই ত্রিপুরা জেলার গুণাইঘর-পট্রোলীতে এক প্রদ্যুম্নেশ্বরের মন্দিরের খবর পাইতেছি। প্রদ্যুম্নেশ্বরও বিষ্ণুর অন্যতম রূপ। সপ্তম শতকের লোকনাথ-পট্রোলীতে ত্রিপুরা-জেলায় ভগবান অনন্ত নারায়ণের (অনন্তশয়ান বিষ্ণু) পূজার খবর পাওয়া যাইতেছে। এই সপ্তম শতকেই কৈলান-পট্রোলীতে দেখিতেছি, শ্রীধারণরাত ছিলেন পরম বৈষ্ণব এবং পুরুষোত্তমের ভক্ত উপাসক; তিনি আবার পরম কারুণিকও ছিলেন এবং শাস্ত্রনিয়ম ছাড়া অযথা প্রাণীবধের বিরোধী ছিলেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, পৌরাণিক বিষ্ণুর বিভিন্ন রূপ ও ধ্যানের সঙ্গে সমসাময়িক বাঙালীর পরিচয় ক্রমশ অগ্রসর হইতেছে। কারণ লিপিগত উল্লেখই তো শুধু নয়, সঙ্গে সঙ্গে বাঙলার বিভিন্ন অঞ্চল হইতে বিভিন্ন বৈষ্ণব-প্রতিমার সাক্ষ্যও বিদ্যমান। বাঙলার সমসাময়িক সাহিত্যে বা পুরাণে বা অন্য কোনও গ্রন্থে পৌরাণিক দেবদেবীদের তত্ত্ব ও প্রকৃতির ব্যাখ্যা বা বিবরণ জানিবার মতন উপকরণ যখন নাই তখন এই সব প্রতিমা – সাক্ষ্যই বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়গত দেবদেবীদের এবং পৌরাণিক ধর্মের ধ্যান ও কল্পনার একমাত্র পরিচয়। সৌভাগ্যের বিষয়, প্রাচীন বাঙলায় এই ধরনের সাক্ষ্যের অভাব নাই, বিশেষ ভাবে অষ্টম শতক এবং অষ্টম শতকের পর হইতে। গুপ্ত এবং গুপ্তোত্তর যুগেরও অন্তত কয়েকটি বৈষ্ণব-প্রতিমার কথা এখানে উল্লেখ করা যাইতে পারে। রংপুর জেলায় প্রাপ্ত একাধিক ধাতু নির্মিত বিষ্ণু মূর্তি ও একটি অনন্তশয়ান বিষ্ণু মূর্তি, বিষ্ণু-মূর্তি, বরিশাল জেলার লক্ষণকাটির গরুড়বাহন এবং সপরিবার বিষ্ণু, রাজশাহী জেলায় যোগীর সওয়ান গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তি, মালদহ জেলার হাঁকরাইল গ্রামে প্রাপ্ত বিষ্ণু মূর্তি ঢাকা জেলার সাভার গ্রামে প্রাপ্ত পোড়ামাটির ফলকে উৎকীর্ণ এক বিষ্ণুর প্রতিমা প্রভৃতি সমস্তই এই পর্বের। এই প্রতিমাগুলির রূপ-কল্পনা ও লক্ষণ আলোচনা করিলে স্পষ্টই বুঝা যায়, পৌরাণিক বিষ্ণু তাঁহার নিজস্ব মর্যাদায় এবং সপরিবারে সমস্ত লক্ষণ ও লাঞ্ছন লইয়া বাঙলাদেশে আসিয়া আসন লাভ করিয়া গিয়াছেন গুপ্তপর্বেই।
গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বের বাঙলায় বিষ্ণুর যে কয়েকটি রূপের সঙ্গে আমাদের পরিচয় (গোবিন্দস্বামী, কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী, প্রদ্যুম্নেশ্বর, অনন্ত নারায়ণ, পুরুষোত্তম) তাহাদের মধ্যে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য কিছু নাই। দেবতার নামের সঙ্গে স্বামী নামের যোগ সমসাময়িক ভারতীয় লিপিতে অজ্ঞাত নয় (তুলনীয়, চক্রস্বামী চিত্রকূটস্বামী, স্বামী মহাসেন, যথাক্রমে বিষ্ণু, বিষ্ণু ও কার্তিক)। পঞ্চরাত্রীয় চতুর্ব্যহবাদের কোনও আভাসও এই পর্বের লিপিগুলিতে কোথাও দেখিতেছি না। চতুর্রাহের প্রদানের সঙ্গে উপরোক্ত প্রদানেশ্বরের কোনও সম্বন্ধ আছে বলিয়া তো মনে হয় না। গুপ্ত-পর্বের রাজা-মহারাজেরা নিজেদের পরিচয়ে সাধারণত ‘পরমভাগবত’ পদটি ব্যবহার করিতেন; মনে হয়, তাঁহারা সকলেই ছিলেন বৈষ্ণব ভাগবদ্ধর্মে দীক্ষিত। আদিতে যাহাই হউক, অন্তত গুপ্ত-পর্বে এই ভাগবদ্ধর্মের সঙ্গে পঞ্চরাত্রীয় ব্যুহবাদের কোনও সম্বন্ধ ছিল না। বস্তুত, এই পর্বের ভাগবদ্ধর্ম ঋগ্বেদীয় বিষ্ণু, পঞ্চরাত্রীয় নারায়ণ, মথুরা অঞ্চলের সাত্বত-বৃষ্ণিদের বাসুদেব কৃষ্ণ, পশুপালক আভীর প্রভৃতি কোমের গোপাল ইত্যাদি সমন্বিত এক রূপ বলিয়াই মনে হয়। এই ভাগবদ্ধর্মই গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বে বাঙলাদেশে প্রচার লাভ করে এবং পালপর্বে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। পরমভাগবত পরিচয় ছাড়া, এই পর্বের একজন রাজা-সপ্তম শতকের রাতবংশীয় সমতটেশ্বর শ্রীধারণ— আত্মপরিচয় দিতেছেন পুরুষোত্তমের পরমভক্ত পরম বৈষ্ণব রূপে। পুরুষোত্তম তো ও অন্যতম নাম ও রূপ।
বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে যুক্ত কৃষ্ণায়ণ ও রামায়ণ-কাহিনী যে গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বেই বাঙলাদেশে প্রচার ও প্রসার লাভ করিয়াছিল তাহার কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় পাহাড়পুর মন্দিরের পোড়া মাটির ও পাথরের ফলকগুলিতে। শ্রীকৃষ্ণের গোবর্ধন ধারণ, চার ও মুষ্টিকের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরামের মল্লযুদ্ধ, যমালার্জুন অথবা জোড়া অর্জুন বৃক্ষ উৎপাটন, কেশী রাক্ষসবধ, গোপীলীলা, কৃষ্ণকে লইয়া বাসুদেবের গোকুল গমন, রাখাল বালকদের সঙ্গে কৃষ্ণ ও বলরাম গোকুলে কৃষ্ণের বালাজীবনলীলা প্রভৃতি কৃষ্ণায়ণের অনেক গল্প এই ফলকগুলিতে উৎকীর্ণ হইয়াছে, শিল্পীর এবং সমসাময়িক লোকায়ত জীবনের পরম আনন্দে। বলরাম ও দেবী যমুনার স্বতন্ত্র প্রতিকৃতিও বিদ্যমান। একটি ফলকে প্রভামণ্ডলযুক্ত, লাস্যভঙ্গীতে দণ্ডায়মান একজোড়া মিথুনমূর্তি উৎকীর্ণ—দক্ষিণে নারীমূর্তি, বামে নরমূর্তি। কেহ কেহ এই মূর্তি দুইটিকে রাধা-কৃষ্ণের লাস্যরূপ বলিয়া চালাইতে চাহিয়াছেন; কিন্তু এরূপ মনে করিবার সঙ্গত কোনও কারণ নাই। রাধা কল্পনার ঐতিহ্য এত প্রাচীন নয়। কালিদাসের “গোপবেশস্য কৃষ্ণ”-পদ রাধার অস্তিত্বের সূচক এ-কথা বলা কঠিন; এমন কি দ্বাদশ শতকীয় রাজা ভোজবর্মার বেলাব-লিপিতে কৃষ্ণের বিচিত্র মিথুনলীলার উল্লেখ থাকিলেও সে-লীলার সঙ্গে রাধার কোনও সম্বন্ধ দেখিতেছি না। হালের গাথা সপ্তশতীতে রাধার উল্লেখ আছে বটে, কিন্তু সে উল্লেখের প্রাচীনত্ব নিশ্চয় করিয়া নির্ধারণ কঠিন। তবে, জয়দেবের (দ্বাদশ শতক) পূর্বেই কোনও সময়ে, এই বাঙলাদেশেই রাধাতত্ত্ব ও রাধার রূপ-কল্পনা সৃষ্টিলাভ করিয়াছিল, এ-সম্বন্ধে বোধ হয় সন্দেহ করা চলে না। বস্তুত, বৈষ্ণব ধর্মের রাধা শাক্তধর্মের শক্তিরই বৈষ্ণব রূপান্তর ও নামান্তর মাত্র। শিবের মতো কৃষ্ণ বা বিষ্ণুই বৈষ্ণবধর্মে পরমপুরুষ এবং এই পুরুষের প্রকৃতি বা শক্তি হইতেছেন রাধা; এই পৃথিবী বা প্রকৃতি যে বিষ্ণুর শক্তি বা বৈষ্ণবী, এই ধ্যান ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই কতকটা প্রসার লাভ করিয়াছিল। হয়তো এই ধ্যানেরই বিবর্তিত রূপ হইতেছেন রাধা। পাহাড়পুরের যুগলমূর্তি কৃষ্ণ ও রুক্মিণী বা সত্যভামার শিল্পরূপ বলিয়াই মনে হয়। স্মরণ রাখা প্রয়োজন, পাহাড়পুরের কৃষ্ণায়ণের এই গল্পগুলি মন্দিরের অলংকরণ উদ্দেশ্যেই উৎকীর্ণ হইয়াছিল, পূজার জন্য নহে। রামায়ণের কয়েকটি গল্পের যে প্রতিকৃতি আছে (যেমন, বানরসেনা কর্তৃক সেতু নির্মাণ, বালী ও সুগ্রীবের যুদ্ধ ইত্যাদি) সে-সম্বন্ধেও এ-উক্তি প্রযোজ্য। তবে, বোধ হয় সংশয় করা চলে না যে, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর যুগের লোকায়ত বাঙালী জীবনে কৃষ্ণায়ণ ও রামায়ণের কাহিনী যথেষ্ট প্রসার ও সমাদর লাভ করিয়াছিল এবং এই কৃষ্ণায়ণ ও রামায়ণ আশ্রয় করিয়া বৈষ্ণব ধর্মের সীমাও বিস্তৃত হইয়াছিল।
শৈব-ধৰ্ম
এই পর্বের বাঙলায় শৈবধর্মের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা এতটা কিন্তু দেখা যাইতেছে না। যদিও যে-শৈবধর্মের দেখা পাইতেছি তাহা পুরোপুরি সমৃদ্ধ পৌরাণিক শৈবধর্ম। শিবের বিভিন্ন নাম ও রূপ কল্পনার সঙ্গে পরিচয় সূচনাতেই ঘটিতেছে এবং বস্তুলিঙ্গ ও মুখলিঙ্গ শিবলিঙ্গের এই দুই রূপের পরিচয়ই বাঙলাদেশে পাওয়া যাইতেছে। ৪নং দামোদরপুর-লিপিতে দেখিতেছি, পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গের এক দুর্গম প্রান্তে লিঙ্গরূপী শিবের পূজা প্রবর্তিত হইয়া গিয়াছে। ষষ্ঠ শতকের গোড়ায় শৈবধর্ম মহাদেব পাদানুধ্যাত মহারাজ বৈন্যগুপ্তের রাজপ্রসাদ লাভ করিয়া পূর্ব-বাঙলার বিস্তৃতি লাভ করিতেছে। সপ্তম শতকে গৌড়-রাজ শশাঙ্ক ও কামরার রাজ ভাস্করবর্মা দুইজনই পরম শ্বৈ। শশাঙ্কের মুদ্রায় মহাদেবের এবং নন্দীবৃষের প্রতিকৃতি; তিনি যে শৈবধর্মাবলম্বী ছিলেন তাহার পরোক্ষ একটু ইঙ্গিত য়ান-চোয়াঙও রাখিয়া গিয়াছেন। ষষ্ঠ শতকের সমাচারদেবের মুদ্রায়ও নন্দীবৃষের শৈব লাঞ্ছন : অনুমান হয় ফরিদপুরের এই প্রাচীন রাজপরিবারটিও শৈব। আস্রফপুর-পট্রোলীর সাক্ষ্যে মনে হয় খড়্গা-বংশীয় রাজারা বৌদ্ধ হইলেও শৈবধর্মের প্রতি তাঁহাদের যথেষ্ট অনুরাগ ছিল : তাহাদের রাজকীয় পট ও মুদ্রায় বলাঞ্ছন। তাহা ছাড়া রাজা দেবখড়োর পট্টমহিষী রানী প্রভাবতী একটি অষ্টধাতুনির্মিত সর্বাণীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, এ তথ্যও সপরিজ্ঞাত। এই শতকেরই অন্যতম ব্রাহ্মণ নরপতি ভরদ্বাজ গোত্রীয় করণ লোকনাথও বোধ হয় ছিলেন শৈব। রাজবংশীয় রাজারা যে ব্রাহ্মণ ছিলেন এ সম্বন্ধে তো সন্দেহের অবকাশই নাই; তাঁহারা বোধ হয় ছিলেন পরম বৈষ্ণব। রানী প্রভাবতী প্রতিষ্ঠিত প্রতিমাটির পাদপীঠে উৎকীর্ণ লিপিতে দেবীকে বলা হইয়াছে সর্বাণী বা সর্বের শক্তি এবং সর্ব হইতেছেন অথর্ববেদীয় রুদ্রদেবতার অষ্টরূপের অন্যতম রূপ। কিন্তু এই সর্বাণী প্রতিমাটির লক্ষণ ও লাঞ্ছন ইত্যাদির সঙ্গে পরবর্তীকালের শারদাতিলক গ্রন্থবর্ণিত ভদ্রকালী, অম্বিকা, ভদ্র দর্গা, ক্ষেমংকরী প্রভৃতি দেবী বা শক্তি মূর্তির কোনও পার্থক্য নাই। নাম যাহাই হউক, সর্বাণী যে শিবেরই শক্তিরূপে কল্পিতা হইয়াছেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে, এতগুলি রাজা ও রাজবংশের পোষকতায় বাঙলাদেশে শৈবধর্মের প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে বিশেষ বেগ পাইতে হয় নাই।
শৈবধর্মের প্রসার ও প্রতিপত্তির কিছু প্রমাণ পাহাড়পুরের ফলকগুলিতেও পাইতেছি। বস্তুলিঙ্গ ও মুখলিঙ্গরূপী শিব দুইই বিদ্যমান এবং যে দুইটি ফলকে নিঃসন্দেহে শিবলিঙ্গের প্রতিকৃতি সে দু’টিতেই ব্রহ্মসূত্রের বেষ্টনও সুস্পষ্ট। পাহাড়পুর মন্দিরের পীঠ-প্রাচীর গাত্রের ফলবে . য়কটি চন্দ্রশেখর-শিবের প্রতিকৃতিও আছে। তৃতীয় নেত্র, ঊর্ধ্বলিঙ্গ, জটমুকুট কোনও কোনও ক্ষেত্রে বৃষবাহন, ত্রিশূল, অক্ষমালা এবং কমণ্ডলু প্রভৃতি লক্ষণ দেখিলে সন্দেহ করিবার উপায় থাকে না যে, এই ধরনের প্রতিমা হইতেই ক্রমশ পাল ও সেনপর্বের পূর্ণতর শিব-প্রতিমার উদ্ভব। চলিশ পরগণা জেলার জয়নগরে প্রাপ্ত সপ্তম শতকীয় একটি ধাতব প্রতিমাতেও তৃতীয় নেত্র, বৃরাহন, সমপদস্থানক চন্দ্রশেখর-শিবের লক্ষণ সুস্পষ্ট।
শৈব গাণপত্য ধর্মের প্রসারের কোনও প্রমাণ অন্তত এই পর্বে বাঙলাদেশে কিছু দেখা যায় না; কিন্তু গণপত্তি বা গণেশের প্রতিকৃতি এই পর্বে সুপ্রচুর। এক পাহাড়পুরেই পাথরের, পোড়ামাটির ও ধাতব কয়েকটি উপবিষ্ট ও দণ্ডায়মান গণেশ-প্রতিমা পাওয়া গিয়াছে। মূর্তিতত্ত্বের দিক হইতে ইহাদের প্রত্যেকটিই মূল্যবান। ইহাদের মধ্যে একটি নৃত্যপর-গণেশের প্রতিমা এবং এই প্রতিমাটিতে লোকায়ত চিত্তের সরল সরস কৌতুকের শিল্পময় প্রকাশ সুস্পষ্ট। গণেশের যাহা কিছু প্রধান লক্ষণ ও লাঞ্ছন তাহা তো এই প্রতিমাগুলিতে আছেই, কিন্তু একটি উপবিষ্ট গণেশের এক হাতে প্রচুর পত্রসংযুক্ত একটি মূলার লক্ষণও বিশেষ লক্ষণীয়।
শৈব কার্তিকেয়ের কোনও লিপি প্রমাণ বা মূর্তি-প্রমাণ এই পর্বে কিছু দেখা যাইতেছে না। তবে, অষ্টম শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে কার্তিকেয়ের এক মন্দিরের উল্লেখ পাইতেছি কলহনের রাজতরঙ্গিণীতে। কিন্তু গণেশ বা কার্তিকেয়, বা পরবর্তী বাঙলার ইন্দ্র, অগ্নি, রেবন্ত, বৃহস্পতি, কুবের, গঙ্গা, যমুনা বা মাতৃকাদেবী প্রভৃতি যাঁহাদের লিপি মূর্তি বা গ্রন্থ-প্রমাণ বিদ্যমান তাঁহাদের আশ্রয় করিয়া কোনও বিশিষ্ট ধর্মসম্প্রদায় বাঙলাদেশে কখনও গড়িয়া উঠে নাই।
সৌরধর্ম
প্রাচীন ভারতবর্ষে যে সূর্যমূর্তি ও সূর্যপূজার পরিচয় আমরা পাই তাহা একান্তই উদীচ্য দেশ ও উদীচ্য সংস্কৃতির দান; এই দান বহন করিয়া আনিয়াছিলেন ঈরানী ও শক অভিযাত্রীরা এবং ভারতবর্ষ এই দান হাত পাতিয়া গ্রহণ করিয়াছিল। বৈদিক সূর্যধ্যান-কল্পনার সঙ্গে যেমন এই সূর্যের কোনও যোগ নাই, তেমনই নাই লোকায়ত জীবনের সূর্যধ্যান ও ব্রতাচারের সঙ্গে। এই উদীচ্যদেশী সূর্যের সঙ্গে বাঙলাদেশের পরিচয় ঘটে গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বেই। রাজশাহী জেলার কুমারপুর ও নিয়ামতপুরে প্রাপ্ত দুইটি সূর্যমূর্তি কুষাণ-পর্বের না হইলেও অন্তত আদি গুপ্ত পর্বের। বগুড়া জেলার দেওড়া গ্রামে প্রাপ্ত সূর্যমূর্তিও প্রায় এই যুগেরই। ২৪ পরগণা জেলার কাশীপুর গ্রামের সূর্যমূর্তি এবং ঢাকা চিত্রশালার ক্ষুদ্রাকৃতি ধাতব সূর্যপ্রতিমাও গুপ্ত-পর্বেরই। ইহাদেরই পূর্ণতর বিবর্তিত মূর্তিরূপ দেখিতেছি পাল-সেন-পর্বের অসংখ্য সূর্যমূর্তিতে। মনে হয়, গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর পর্বেই বাঙলাদেশে সৌরধর্ম কিছুটা প্রতিপত্তি লাভ করিয়াছিল এবং বিশিষ্ট একটি সৌর সম্প্রদায়ও গড়িয়া উঠিয়াছিল।
জৈনধর্ম
পূর্বেই বলিয়াছি, বাঙলার আদিতম আর্যধর্মই হইতেছে জৈনধর্ম এবং গুপ্ত-পর্বের আগেই বাঙলাদেশে, বিশেষভাবে উত্তরবঙ্গে, জৈনধর্ম বিশেষ প্রসার ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিল। কিন্তু গুপ্ত পর্বে জৈনধর্মের উল্লেখ বা জৈন মূর্তি-প্রমাণ বিশেষ কিছু দেখিতেছি না। একটি মাত্র অভিজ্ঞান পাইতেছি পাহাড়পুর-পট্টোলীতে; এই পট্রোলীতে দেখা যাইতেছে, পঞ্চম শতকের বটগোহালীতে (পাহাড়পুর সংলগ্ন বর্তমান গোয়ালভিটা) একটি জৈন-বিহার ছিল; বারাণসীর পঞ্চস্তূপীয় শাখার নির্গ্রন্থনাথ আচার্য গৃহনন্দীর শিষ্য ও শিষ্যানুশিষ্যবর্গ এই বিহারের অধিবাসী ও অধিকর্তা ছিলেন এবং তাঁহারা প্রতিবাসী এক ব্রাহ্মণ-দম্পতির নিকট হইতে কিছু ভূমিদান লাভ করিয়াছিলেন, বিহারের অর্হৎদের নিত্য পূজা ও সেবার ফুল, চন্দন, ধূপ ইত্যাদির ব্যয় নির্বাহের জন্য।
অথচ, প্রায় দেড়শত বৎসর পরই (সপ্তম শতকের দ্বিতীয় পাদে) য়ুয়ান্-চোয়াঙ বলিতেছেন, (বৈশালী, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কলিঙ্গে) দিগম্বর নির্গ্রন্থ জৈনদের সংখ্যা ছিল সুপ্রচুর। দিগম্বর নির্গ্রন্থদের এই সুপ্রাচুর্য ব্যাখ্যা করা কঠিন। বাঙলাদেশ এক সময় আজীবিক সম্প্রদায়ের প্রসিদ্ধ কেন্দ্র ছিল; এবং এ তথ্য সুপরিজ্ঞাত যে, বৌদ্ধদের চক্ষে আজীবিকদের সঙ্গে নির্গ্রন্থদের অশন-বসন-আচারানুষ্ঠানের পার্থক্য বিশেষ ছিল না। সেই হেতু দিব্যাবদান-গ্রন্থে দেখিতেছি, নির্গ্রন্থ ও আজীবিকদের নির্বিচারে একে অন্যের ঘাড়ে চাপাইয়া তালগোল পাকানো হইয়াছে। যুয়ান-চোয়াঙের সময়ে, বোধ হয় তাঁহার আগেই, অন্তত বাঙলাদেশে আজীবিকেরা নির্গ্রন্থ-সম্প্রদায়ে একীভূত হইয়া গিয়াছিলেন এবং তাঁহাদের সংখ্যা পুষ্ট করিয়াছিলেন; অথবা দিব্যাবদানের মতো য়ুয়ান্-চোয়াঙও আজীবিক ও নির্গ্রন্থের পার্থক্য ধরিতে না পারিয়া সকলকেই নির্গ্রন্থ বলিয়াছেন। কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও স্মর্তব্য যে, প্রাচীন বাঙলায় আজীবিকদের স্বতন্ত্র কোনও অস্তিত্বের প্রমাণ নাই।
পাল ও সেন-পর্বে নির্গ্রন্থ জৈনদের কোনও লিপি-প্রমাণ বা গ্রন্থ প্রমাণ দেখিতেছি না, যদিও প্রাচীন বাঙলার নানা জায়গায় কিছু কিছু জৈন মূর্তি-প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের কথা পরে যথাস্থানে বলিতেছি। নির্গ্রন্থ জৈন সম্প্রদায়ের, স্বল্পসংখ্যক হইলেও কিছু লোক নিশ্চয়ই ছিলেন; তাহা না হইলে এই সব মূর্তি-প্রমাণের ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে, মনে হয়, পাল-পর্বের শেষের দিক হইতে বীরভূম, পুরুলিয়া অঞ্চলে নানা জায়গায় নির্গ্রন্থ জৈনদের সমৃদ্ধ কেন্দ্র গড়িয়া উঠিয়াছিল। এইসব অঞ্চলে দশম-একাদশ-দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকের অনেক জৈন মূর্তি ও মন্দির আবিষ্কৃত হইয়াছে।
গুপ্ত ও গুপ্তোত্তর বাঙলাদেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার না হউক প্রভাব ও প্রতিপত্তি সকলের চেয়ে বেশি। তৃতীয় শতকের শেষপাদে বা চতুর্থ শতকের সূচনাতেই দেখিতেছি, চীনা বৌদ্ধ শ্রমণেরা বাঙলাদেশে, বিশেষভাবে উত্তরবঙ্গে, যাতায়াত করিতেছেন। ইৎ-সিঙ বলিতেছেন, চীনা শ্রমণদের ব্যবহারের জন্য মহারাজ শ্রীগুপ্ত একটি ‘চীন মন্দির’ নির্মাণ করাইয়া তাহার সংরক্ষণের জন্য চব্বিশটি গ্রাম দান করিয়াছিলেন; মন্দিরটি ছিল মৃগস্থাপন (মি-লি-কিয়া-সি-কিয়া-পো-নো) স্তূপের সন্নিকটেই এবং নালন্দা হইতে গঙ্গাতীর ধরিয়া ৪০ যোজন দূরে। এই শ্রীগুপ্ত খুব সম্ভব গুপ্তবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ শ্রীগুপ্ত বা গুপ্ত এবং মৃগস্থাপন । স্তূপ বরেন্দ্র বা উত্তরবঙ্গের কোনও স্থানে। পঞ্চম শতকের গোড়ায় চীনা বৌদ্ধ শ্রমণ ফা-হিয়েন চম্পা হইতে গঙ্গা বাহিয়া বাঙলাদেশেও আসিয়াছিলেন এবং তাম্রলিপ্তি বন্দরে দুই বৎসর বৌদ্ধ সূত্র ও বৌদ্ধ প্রতিমাচিত্র নকল করিয়া কাটাইয়াছিলেন। তাঁহার সময়ে তাম্রলিপ্তিতে অসংখ্য ভিক্ষু অধ্যুষিত বাইশটি বৌদ্ধ বিহার ছিল এবং বৌদ্ধ ধর্মের সমৃদ্ধিও ছিল খুব। এই সমৃদ্ধির কিছু প্রমাণ পাওয়া যায় প্রায় সমসাময়িক কয়েকটি বৌদ্ধ মূর্তিতে। পূর্ব-ভারতীয় গুপ্তশৈলীর একটি বিশিষ্ট নিদর্শন রাজশাহী জেলার বিহারৈল গ্রামে প্রাপ্ত দণ্ডায়মান বুদ্ধমূর্তিটি মহাযানী যোগাচারের শিল্পময় রূপ। বগুড়া জেলার মহাস্থানে বলাইধাপ-স্তূপের নিকট প্রাপ্ত ধাতব মঞ্জুশ্রী মূর্তিটিও এই যুগেরই এবং ইহাও মহাযান বৌদ্ধধর্মের অন্যতম প্রত্যক্ষ প্রমাণ। এই প্রমাণ আরও দৃঢ়তর হইতেছে ষষ্ঠ শতকের প্রথম দশকে উৎকীর্ণ মহারাজ বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর-পট্রোলীর সাহায্যে। সামন্ত-মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে মহারাজ বৈন্যগুপ্ত কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন; উদ্দেশ্য ছিল, ১. মহাযানী ভিক্ষু শান্তিদেবের জন্য রুদ্রদত্ত নির্মিত ও আর্য-অবলোকিতেশ্বরের নামে উৎসর্গীকৃত আশ্রম-বিহারের সংরক্ষণ, ২. এই বিহারে শান্তিদেব কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং অবৈবর্তিক মহাযানী ভিক্ষুসংঘ কর্তৃক স্থাপিত বুদ্ধমূর্তির প্রতিদিন তিনবার ধূপ, গন্ধ, পুষ্প সহকারে পূজার সংস্থান এবং ৩. ঐ বিহারবাসী ভিক্ষুদের অশন, বসন, শয়ন, আসন এবং চিকিৎসার সংস্থান। এই পটোলীতেই খবর পাইতেছি, উক্ত আশ্রম-বিহার প্রতিষ্ঠার আগেই উহার নিকটেই রাজবিহার নামে আর একটি বিহার ছিল; এই বিহারের প্রতিষ্ঠাতা যে কে তাহা বলিবার উপায় নাই। রাজবিহার ছাড়া আরও একটি বৌদ্ধ বিহারের উল্লেখ এই লিপিতে আছে। যাহাই হউক, ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই বাঙলার পূর্বতম প্রান্তে ত্রিপুরা জেলায় মহাযান বৌদ্ধধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, গুণাইঘর-লিপিই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। অথচ, স্মরণ রাখা প্রয়োজন, মহারাজ বৈন্যগুপ্ত নিজে ছিলেন ‘মহাদেবপাদানুখ্যাত’ অর্থাৎ শৈব। ত্রিপুরা-জেলারই কেলান-পট্রোলীতে দেখিতেছি, শ্রীধারণরাতের মহাসান্ধিবিগ্রহিক জয়নাথ কিছু ভূমি দান করিয়াছিলেন একটি রত্নত্রয়ে অর্থাৎ বৌদ্ধবিহারে, বিহারস্থ আর্যসংঘের লিখন-পঠন, চীবর এবং শ্রীধারণরাত আহারাদির সংস্থানের জন্য। অথচ, স্মরণ রাখা প্রয়োজন, নিজে ছিলেন পরম বৈষ্ণব।
চীনা শ্রমণদের কৃপায় সপ্তম শতকে বাঙলাদেশে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্বন্ধে প্রচুর তথ্য আমাদের আয়ত্তে। এঁদের মধ্যে য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীই সব চেয়ে প্রসিদ্ধ এবং তথ্যবহুল। তিনি বাঙলাদেশে আসিয়াছিলেন আনুমানিক ৬৩৯ খ্রীষ্ট শতকে এবং বৌদ্ধ ধর্ম ও সাধনার প্রসিদ্ধ কেন্দ্রগুলি স্বচক্ষে দেখিবার জন্য কজঙ্গল, পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট, কর্ণসুবর্ণ ও তাম্রলিপ্তি, বাঙলার এই কয়টি জনপদ পরিক্রমা করিয়াছিলেন। কজঙ্গলে তিনি ছ’সাতটি বৌদ্ধ সংঘারাম দেখিয়াছিলেন এবং তাহাতে প্রায় ছয় শত ভিক্ষু বাস করিতেন। কজঙ্গলের উত্তর অংশে গঙ্গার অনতিদূরে বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর প্রতিমাসম্বলিত, নানা কারুকার্যখচিত ইট ও পাথরের তৈরি একটি বৃহৎ মন্দিরের কথাও তিনি বলিয়াছেন। পুণ্ড্রবর্ধনে ছিল বিশটি বিহার এবং মহাযান ও হীনযান উভয়পন্থী তিন হাজারেরও উপর ভিক্ষু এই বিহারগুলিতে বাস করিতেন। সর্বাপেক্ষা বৃহদায়তন বিহারটি ছিল পুণ্ড্রবর্ধন রাজধানীর তিন মাইল পশ্চিমে এবং তাহার নাম ছিল, পো-সি-পো বিহার। এই বিহারে ৭০০ মহাযানী ভিক্ষু এবং পূর্ব-ভারতের বহু জ্ঞানবৃদ্ধ খ্যাতনামা শ্রমণ বাস করিতেন; বিহারের অনতিদূরেই ছিল অবলোকিতেশ্বরের একটি মন্দির। পো-সি-পো বিহার বোধ হয় মহাস্থান সংলগ্ন ভাসু বিহার। য়ুয়ান-চোয়াঙ সমতটে দুই হাজার স্থবিরবাদী শ্রমণাধ্যূষিত ত্রিশটি বিহার দেখিয়াছিলেন। যথার্থত ইহারা বোধ হয় ছিলেন মহাযানী। কর্ণসুবর্ণে দশাধিক বিহারে সম্মতীয় শাখার দুই হাজার ভ্রমণ বাস করিতেন। সম্মতীয় বৌদ্ধরা ছিলেন সর্বাস্তিবাদী। কর্ণসুবর্ণ রাজধানীর অনতিদূরে ছিল সুবিখ্যাত লো-টো-মো-চিহ্ বা রক্তমৃত্তিকা বিহার; বহু কৃতী পণ্ডিত শ্রমণ ছিলেন এই বিহারের অধিবাসী। য়ুয়ান-চোয়াঙ জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিয়া বলিতেছেন, কর্ণসুবর্ণে বৌদ্ধ ধর্ম সুপ্রচারিত হইবার আগেই জনৈক দক্ষিণ-ভারতীয় বৌদ্ধ শ্রমণের সম্মানার্থে দেশের রাজা কর্তৃক এই বিহার নির্মিত হইয়াছিল। তাম্রলিপ্তিতেও দশাধিক বিহার ছিল এবং এই বিহারগুলিতে এক হাজারেরও বেশি শ্রমণ বাস করিতেন। অথচ, তাম্রলিপ্তিতে ফা-হিয়েনের কালে বিহার ছিল বাইশটি। প্রায় পঞ্চাশ বৎসর পর ইৎ-সিঙ যখন তাম্রলিপ্ত জানে সর্বাস্তিবাদের প্রবল প্রতাপ; য়ুয়ান-চোয়াঙের সময়ও বোধ হয় তাহাই ছিল। য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্যে মনে হয় তাহার সময়ে অধিকাংশ বাঙালী শ্রমণই ছিলেন হীনযানপন্থী; এক চতুর্থাংশের কিছু উপর ছিলেন মহাযানপন্থী। কিন্তু, স্মরণ রাখা প্রয়োজন, আজ আমরা হীনযান ও মহাযান বৌদ্ধ ধর্মে যে-ভাবে পার্থক্য বিচার করিয়া থাকি, যুয়ান-চোয়াঙের সময়ে সে-ধরনের বিচার ছিল না। ভারতবর্ষের বহু জায়গায় শ্রমণদের কথা বলিতে গিয়া যুরান চোয়াঙ তাহাদের পরিচয় দিয়াছেন, “স্থবিরশাখার মহাযানবাদী” বলিয়া। এই জন্যই তিনি পুণ্ড্রবর্ধনের অধিকাংশ শ্রমণদের পরিচয় দিয়াছেন হীনযান ও মহাযান উভয় মতাবলম্বী বলিয়া। সংস্কৃত বৌদ্ধশাস্ত্রে বহু ক্ষেত্রে এই দুই মতবাদে আজিকার দিনের মতো পার্থক্য কিছুই করা হয় নাই; এইসব শাস্ত্র মতে শ্রাবকযান বা হীনযান মহাযানেরই নিম্নতর স্তর মাত্র। প্রাচীন চীনা ও জাপানী বৌদ্ধদের মতও তাহাই। আজ পণ্ডিত মহলে এ-তথ্য সুপরিজ্ঞাত যে, বৌদ্ধ মহাযানপন্থী, সর্বাস্তিবাদী, ধর্মগুপ্তবাদী, মহাসাংঘিকবাদী প্রভৃতি শ্রমণেরা যথার্থত হীনযানবাদের বিনয়-শাসন মানিয়া চলিতেন। খুব সম্ভব, এই অর্থেই য়ুয়ান-চোয়াঙ “ স্থবির শাখার মহাযানবাদী” পদটি ব্যবহার করিয়াছেন এবং হীনযান এবং মহাযান উভয় মতাবলম্বী বলিতেও তাহাই বুঝিয়াছেন। পঞ্চাশ বৎসর পর ইৎ-সিঙ বলিতেছেন, পূর্ব-ভারতে মহাসাংঘিক, স্থবিরবাদী, সম্মতীয়বাদী এবং সর্বাস্তিবাদী এই চারি বর্গের বৌদ্ধরাই অন্যান্য শাখার বৌদ্ধদের সঙ্গে পাশাপাশি বাস করিতেন। কিন্তু, মহাযানী বৌদ্ধরা ছাড়া অন্য কোন শাখাপন্থী বৌদ্ধ ছিলেন, এমন প্রমাণ নাই; অন্তত তাম্রলিপ্তিতে ছিলেন না। সপ্তম শতকের তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধধর্মের অবস্থা সম্বন্ধে আরও কিছু চীনা সাক্ষ্য বিদ্যমান। তা-চেং-টেং নামে এক বৌদ্ধ শ্রমণ সুদীর্ঘ বারো বৎসর তাম্রলিপ্তিতে বসিয়া সংস্কৃত বৌদ্ধ শাস্ত্ৰ আয়ত্ত করিয়াছিলেন; চীনদেশে ফিরিয়া গিয়া তিনি নিদানশাস্ত্রের ব্যাখ্যা প্রচার করিয়াছিলেন। তও-লিন নামে আর এক বৌদ্ধ শ্রমণ এই তাম্রলিপ্তিতেই সর্বাস্তিবাদে দীক্ষা গ্রহণ করিয়া তিন বৎসর ধরিয়া সংস্কৃত শিখিয়াছিলেন। ইৎ-সিঙ তাম্রলিপ্তিতে আসিয়াছিলেন ৬৭৩ খ্রীষ্ট শতকে। পো-লো-হো বা বরাহ (?) – বিহারে উপরোক্ত তা চোং-টেংর সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছিল। তিনিও তাম্রলিপ্তিতে কিছুকাল বাস করিয়া সংস্কৃত ও শব্দবিদ্যা অধ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং নাগার্জুন-বোধিসত্ত্ব-সুহৃল্লেখ নামে অন্তত একটি সংস্কৃত গ্রন্থ চীনা ভাষায় অনুবাদ করিয়াছিলেন। বরাহ-বিহারে তখন রাহুলমিত্র নামে ত্রিশ বৎসর বয়স্ক এক শ্রমণ বাস করিতেন; তাঁহার জ্ঞানের গভীরতা ছিল অসীম। পো-লো-হো বা বরাহ-বিহারে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জীবনযাত্রার একটি ছবি ইং-সিঙ রাখিয়া গিয়াছেন। কঠোর নিয়ম-সংযমে তাঁহাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত ছিল : সংসার-জীবন তাঁহারা পরিহার করিয়া চলিতেন এবং জীবহত্যার পাপ হইতে তাঁহারা মুক্ত ছিলেন। ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীর দেখা হইলে তাহারা উভয়েই অত্যন্ত সংযত ও বিনয়-সম্মত আচরণ করিতেন। ভিক্ষুণীরা যখনই বাহিরে যাইতেন অন্তত দুইজন একসঙ্গে যাইতেন; কোনও গৃহস্থ-উপাসকের বাড়ি যাইবার প্রয়োজন হইলে অন্যূন চারজন একত্র যাইতেন। একবার একজন শ্রমণ একটি বালকের হাত দিয়া এক গৃহস্থ উপাসকের স্ত্রীকে কিছু চাল পাঠাইয়াছিলেন। এই ব্যাপারটি যখন সংঘের গোচরীভূত হইল তখন শ্রমণটি এত লজ্জিত হইলেন যে, চিরতরে সেই বিহার পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন। এই বিহারেরই ভিক্ষু রাহুলমিত্র মুখোমুখি কখনও স্ত্রীলোকের সঙ্গে কথা বলিতেন না, মাতা ও ভগিনী ছাড়া। তাঁহারাও যখন দেখা করিতে আসিতেন, সাক্ষাৎকার্যটা হইত তাঁহার ঘরের বাহিরে!
অথচ, ইহার তিন শত শত বৎসর পরই বৌদ্ধ সংঘে-বিহারে—এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মকর্মানুষ্ঠানেও—যে নৈতিক অনাচার এবং যৌন জীবনে যে শিথিলতা দেখা দিয়াছিল তাহার আভাসমাত্রও এই পর্বে কোথাও দেখা যাইতেছে না।
এই ইৎ-সিঙই সংবাদ দিতেছেন, ৬৪৪ খ্রীষ্ট শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙের ভারত ত্যাগ এবং ৬৭৩ খ্রীষ্ট শতকে ইৎ-সিঙের ভারত আগমন, এই দুই তারিখের মধ্যে বহু চীন পরিব্রাজক ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন; তাঁহাদের মধ্যে ৫৬ জনের উল্লেখ ইৎ-সিঙ নিজেই করিয়াছেন।
এই ৫৬ জনের মধ্যে প্রসিদ্ধতম হইতেছেন সেঙ-চি; তিনি সমতটে আসিয়া কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন এবং তাহার এই প্রবাসের বিবরণও তিনি রাখিয়া গিয়াছেন। সপ্তম শতকের প্রথম পাদে শশাঙ্ক যখন গৌড় ও কর্ণসুবর্ণের রাজা তখন সমতটে ছিল এক ব্রাহ্মণ বংশের রাজত্ব; সেই রাজবংশে নালন্দার প্রধানাচার্য স্বনামখ্যাত মহাপণ্ডিত শীলভদ্রের জন্ম। শীলভদ্রের কথা পরে আর এক অধ্যায়ে বলিবার সুযোগ হইবে। আপাতত এ-কথা বলিলেই যথেষ্ট হইবে যে, এই শীলভদ্রই ছিলেন নালন্দায় য়ুয়ান-চোয়াঙের গুরু। শীলভদ্রের এক ভ্রাতুষ্পুত্র বোধিভদ্র নালন্দার অন্যতম আচার্য ছিলেন। যাহাই হউক, শশাঙ্কের সময়ে যে সমতটে ছিল ব্রাহ্মণ রাজবংশের রাজত্ব, সেই সমতটেই প্রায় ৫০ বৎসর পর সেঙ-চি আসিয়া দেখিলেন এক বৌদ্ধ রাজবংশের প্রতিষ্ঠা। রাজবংশের পরিবর্তন হইয়াছিল, না পুরাতন রাজবংশের সমসাময়িক প্রতিনিধি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা বলা কঠিন। যাহা হউক, সেঙ-চি বলিতেছেন, সিংহাসনাসীন রাজার নাম ছিল রাজভট। ঐতিহাসিকেরা অনেকেই মনে করেন, এই রাজভট আর খড়গ বংশীয় তৃতীয় রাজা দেবখড়্গপুত্র রাজরাজ বা রাজরাজভট্ট একই ব্যক্তি। যাহাই হউক, সে-চি রলেন, রাজভট ছিলেন পরমোপাসক এবং ত্রিরত্নের প্রতি ভক্তিমান। তিনি প্রত্যহ বুদ্ধের এক লক্ষ মৃন্ময় মূর্তি গড়াইতেন, মহাপ্রজ্ঞাপারমিতা-সূত্রের এক লক্ষ শ্লোক পাঠ করিতেন এবং এক লক্ষ সদাচয়িত ফুলে পূজা করিতেন। দানধ্যানও ছিল তাঁহার প্রচুর। মাঝে মাঝে তিনি বুদ্ধের সম্মানার্থে শোভাযাত্রা বাহির করিতেন; সম্মুখে থাকিত অবলোকিতেশ্বরের এক প্রতিমা, পশ্চাতে সারি সারি চলিতেন ভিক্ষু ও উপাসকেরা; সকলের পশ্চাতে চলিতেন রাজা। সমতটের রাজধানীতে তখন চার হাজার ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, বৌদ্ধধর্মের প্রতিপত্তির দিক হইতে সেঙ-চি’র সমতট য়ুয়ান-চোয়াঙের সমতট অপেক্ষা সমৃদ্ধতর এবং মহাযানের প্রভাব উত্তরোত্তর অধিকতর সক্রিয়। তাহার কারণও আছে। এইমাত্র যে খড়া-রাজবংশের কথা বলিলাম, এই বংশের রাজত্ব ছিল বঙ্গ এবং সমতটে : লিপি সাক্ষ্যে জানা যায়, এই বংশের সকল রাজাই ছিলেন বৌদ্ধ এবং তাঁহাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের পরম পৃষ্ঠপোষক।
এই শতকেরই রাতবংশীয় রাজা শ্রীধারণের নবাবিষ্কৃত তাম্রশাসনে দেখিতেছি, সমতটের পরমবৈষ্ণব রাজা শ্রীধারণের মহাসন্ধিবিগ্রহাধিকারী বৌদ্ধ জয়নাথ তথাগত, ত্রিরত্ব এবং ব্রাহ্মণার্যগণের পঞ্চমহাযজ্ঞ প্রবর্তনের জন্য কিছু ভূমিদান করিতেছেন। সমতটে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিপত্তির ইহাও আর একটি প্রমাণ।
বাঙলার অন্যত্র কী হইতেছিল বলা যায় না, তবে চীনা শ্রমণদের বিবরণ পড়িলে মনে হয়, অন্তত তাম্রলিপ্তিতে বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিপত্তি ক্রমশ হ্রাস পাইতেছিল। ফা-হিয়েনের কালে তাম্রলিপ্তিতে বিহার ছিল বাইশটি; য়ুয়ান-চোয়াঙের সময় দশটি; ইৎ-সিঙের কালে মাত্র পাঁচ-ছয়টি। বোধ হয়, বাঙলার অন্যত্রও তাহাই হইতেছিল, একমাত্র সমতট ছাড়া। মহারাজ বৈন্যগুপ্তের সময় হইতেই সমতটে মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার লক্ষ করা যায়। য়ুয়ান-চোয়াঙ যেখানে দেখিয়াছিলেন ত্রিশটি বিহার ও মাত্র দুই হাজার শ্রমণ — সে-চি’র কালে সেখানে শ্রমণের সংখ্যা দাঁড়াইয়াছিল চার হাজার। সমতটে বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের এই ক্রমবর্ধমান প্রতিপত্তির প্রধান কারণ মহাযানী বৌদ্ধ খড়্গা-বংশীয় রাজাদের সক্রিয় পোষকতা ও সমর্থন। এই খড়্গ বংশ ছাড়া পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকের বাঙলাদেশে আর কোনও রাজবংশই বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন না। সমতটে মহাযানের প্রতিপত্তি বৈন্যগুপ্তর সময় হইতেই এবং সে-প্রতিপত্তি ত্রয়োদশ শতকের রণবঙ্কমল্ল হরিকালদের পর্যন্ত অক্ষুণ্ণ ছিল। য়ুয়ান্-চোয়াঙ্ কেন যে তৎকালীন সমতটীয় ভিক্ষুদের স্থবিরবাদী বলিয়াছেন, বুঝিতে পারা কঠিন। খুব সম্ভব স্থবিরবাদী বলিতে তিনি স্থবির বিনয়াশ্রয়ী মহাযানীদের বুঝাইতে চাহিয়াছেন।
বিভিন্ন ধর্মের মিলন ও সংঘাত
আগে দেখিয়াছি, বৌদ্ধ জয়নাথ পরমবৈষ্ণব রাজা শ্রীধারণের অন্যতম প্রধান রাজকর্মচারী; তিনি ভূমিদান বৌদ্ধসংঘে যেমন করিতেছেন, ব্রাহ্মণদেরও তেমনই। য়ুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণীতেও দেখিতেছি, বৌদ্ধ শ্রমণ ও গৃহস্থোপাসক এবং ব্রাহ্মণ্য দেবপূজক সকলেই একই সঙ্গে বাস করিতেছেন, নির্বিবাদে। য়ুয়ান-চোয়াঙ হয়তো শশাঙ্কের মৃত্যুর কিছুকাল পরেই ভারতবর্ষে আসিয়াছিলেন। তিনি কিন্তু বলিতেছেন, শশাঙ্ক ছিলেন নিদারুণ বৌদ্ধ-বিদ্বেষী এবং তিনি বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদসাধনেও সচেষ্ট হইয়াছিলেন। সেই উদ্দেশ্যে তিনি কী কী অপকর্ম করিয়াছিলেন তাহার একটি নাতিবৃহৎ তালিকাও দিয়াছেন। য়ুয়ান্-চোয়াঙের এই বিবরণের পরিণতির—অর্থাৎ দুরারোগ্য চর্মরোগে শশাঙ্কের মৃত্যুকাহিনীর—একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি মঞ্জুশ্রীমূলকল্প-গ্রন্থেও আছে; এবং খুব আশ্চর্যের বিষয়, মধ্যযুগীয় ব্রাহ্মণ্যকুলপঞ্জীতেও আছে। বৌদ্ধ-বিদ্বেষী শঙ্কা প্রতি বৌদ্ধ লেখকদের বিরাগ স্বাভাবিক, কিন্তু বহুযুগ পরবর্তী ব্রাহ্মণ্যকুলপঞ্জীতে তাহার প্রতিধ্বনি শুনিতে পাওয়া একটু আশ্চর্য বই কি! যুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণের বিস্তৃত আলোচনা অন্যত্র করিয়াছি; এখানে এইটুকু বলাই যথেষ্ট যে, বুয়ান্-চোয়াঙের বিবরণ অতিরঞ্জিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়, গালগল্পের ভেজাল থাকাও কিছু অসম্ভব নয় এবং শৈব-ব্রাহ্মণ্য রাজার প্রতি, বিশেষত যে-রাজা ছিলেন হর্ষবর্ধনের শত্রু তাঁহার প্রতি, বিরাগ থাকাও কিছু আশ্চর্য নয়। কিন্তু তাঁহার বিবরণ সর্বথা মিথ্যা এবং শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ একেবারেই ছিল না, এ-কথা বলিয়া শশাঙ্কের কলঙ্কমুক্তির চেষ্টাও আধুনিক ব্রাহ্মণ্য-মানসের অসার্থক প্রয়াস। এ প্রশ্ন সত্য যে, শশাঙ্ক যদি যথার্থই বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদে সচেষ্ট হইয়াছিলেন, তাহা হইলে মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই যুয়ান-চোয়াঙ শশাঙ্কেরই রাজধানী কর্ণসুবর্ণে (এবং বাঙলা-বিহারের অন্যত্রও) এতগুলি বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বিহার দেখিলেন কিরূপে? কিন্তু, সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও বিবেচনা করা প্রয়োজন যে, যে কেহ এক জীবনে উচ্ছেদের যত চেষ্টাই করুন না কেন, তাঁহার পক্ষে এতদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত ও সুবিস্তৃত একটি ধর্মের এবং সেই ধর্মাবলম্বী লোকদের সম্পূর্ণ নির্মূল, এমনকি খুব বেশি ক্ষতি করাও সম্ভব নয়। ঔরংজীবও তাহা পারেন নাই; তাই বলিয়া ঔরংজীবের ধর্মান্ধতা ও হিন্দু-বিদ্বেষ একেবারে ছিল না, এ কথা কি জোর করিয়া বলা যায়? য়ুয়ান-চোয়াঙ শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষের যে ক’টি দৃষ্টান্ত দিয়াছেন তাহাতে তাঁহার বৌদ্ধ-বিদ্বেষ অনস্বীকার্য, কিন্তু তাহা দ্বিগুণিত হইলেও একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সুবিস্তৃত ধর্মের উচ্ছেদের পক্ষে যথেষ্ট নয়। কাজেই য়ুয়ান্-চোয়াঙের সময়ে বৌদ্ধধর্মের সমৃদ্ধ অবস্থা শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষের বিপক্ষ যুক্তি বলিয়া উপস্থিত করা যায় না। এমন কি, ভারতীয় কোনও রাজা বা রাজবংশের পক্ষে পরমধর্মবিদ্বেষী হওয়া অস্বাভাবিক, এ যুক্তিও অত্যন্ত আদর্শবাদী যুক্তি : বিজ্ঞানসম্মত যুক্তি তো নয়ই। অন্য কাল এবং ভারতবর্ষের অন্য প্রান্তের বা দেশখণ্ডের দৃষ্টান্ত আলোচনা করিয়া লাভ নাই; প্রাচীনকালের বাঙলাদেশের কথাই বলি। বঙ্গাল-দেশের সৈন্য-সামন্তরা কি সোমপুর মহাবিহারে আগুন লাগায় নাই? বর্মণ রাজবংশের জনৈক প্রধান রাজকর্মচারী ভট্ট-ভবদেব কি বৌদ্ধ পাষণ্ড বৈতণ্ডিকদের উপর জাতক্রোধ ছিলেন না? সেন-রাজ বল্লালসেন কি ‘নাস্তিক (বৌদ্ধ)-দের পদোচ্ছেদের জন্যই কলিযুগে জন্মলাভ’ করেন নাই? বস্তুত, শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ অপ্রমাণ করিতে হইলে অন্য যুক্তির প্রয়োজন। বরং, অন্যদিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায়, সমসাময়িক পূর্ব-ভারতে সর্বত্রই নব ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রসার এবং দেব-পূজকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। রাজবংশগুলি প্রায় সমস্তই ব্রাহ্মণ্য-ধর্মাবলম্বী; গৌড়-কর্ণসুবর্ণে ব্রাহ্মণ্য রাজবংশ, কামরূপ ও মগধে তাহাই, ওড়িষ্যার তাহাই। অথচ বৌদ্ধ ধর্ম বিভিন্ন শাখাপ্রশাখায় ক্রমবিস্তারমান। যে পুষ্যভূতি বংশ ছিল ব্রাহ্মণ্য দেবপূজক সেই বংশের রাজা হর্ষবর্ধনও বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী ও পৃষ্ঠপোষক হইয়া পড়িয়াছেন। নব ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম যেমন নববলে বলীয়ান হইয়া সীমা ও প্রতিপত্তি বিস্তারে প্রাগ্রসর, বৌদ্ধধর্মও তেমনই যোগাচারে সমৃদ্ধ হইয়া সমান প্রাগ্রসর। এই দুই ধর্মই তখন পরস্পর পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী; জনসাধারণের মধ্যে সীমা ও প্রতিপত্তি বিস্তার উভয়েরই লক্ষ্য। কাজেই এমন অবস্থায় কোনও বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়ী রাজা বা রাজবংশের পক্ষে অন্য ধর্মের উপর বিদ্বেষী হওয়া কিছু মাত্র অস্বাভাবিক নয়, বিশেষত যে-ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিদ্বেষের কারণ সক্রিয়। বৌদ্ধধর্মের রাজকীয় মুখপাত্র তখন হর্ষবর্ধন, ব্রাহ্মণ্যধর্মের শশাঙ্ক; রাষ্ট্রক্ষেত্রে উভয়ে উভয়ের প্রতিদ্বন্দ্বী এবং উভয়েই সংগ্রামরত। এই অবস্থায় শশাঙ্কের পক্ষে গয়ার বোধিদ্রুম কাটিয়া পোড়াইয়া ফেলা, বুদ্ধ-প্রতিমাকে অন্য মন্দিরে স্থানান্তরিত করা এবং সেইস্থানে শিবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করা, কুসীনারার এক বিহার হইতে ভিক্ষুদিগকে তাড়াইয়া দিয়া বৌদ্ধধর্মের উচ্ছেদ সাধনের চেষ্টা, পাটলিপুত্রে বুদ্ধপদাঙ্কিত একটি প্রস্তরখণ্ডকে গঙ্গায় নিক্ষেপ করা প্রভৃতি কিছুই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু, কোনও ব্যক্তি বিশেষের, এমন কি সমস্ত সম্প্রদায় বিশেষের এই কয়েকটি অপকর্মের ফল একটি সুপ্রতিষ্ঠিত সুবিস্তৃত ধর্মের শাখাগ্রও স্পর্শ করে না, মূলোৎপাটন তো দূরের কথা। হিন্দু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের উপর প্রাচীন ও সাম্প্রতিক কালে এ-ধরনের অভিঘাত তো কম হয় নাই, কিন্তু তাতে ক্ষতি কতটুকু হইয়াছে?
কিন্তু শশাঙ্ক বৌদ্ধ-বিদ্বেষী হউন বা না হউন, জনসাধারণের ধর্মগত আচরণ-ব্যবহারের মধ্যে পরধর্মবিদ্বেষের কোনও প্রমাণ অন্তত এই পর্বে কোথাও কিছু নাই। ইতিহাস আলোচনায় সর্বত্রই সাধারণত দেখা যায়, পরধর্মবিদ্বেষ বা পরমত অসহিষ্ণুতা শ্রেণীস্বাৰ্থভোগী উচ্চকোটি লোকদের শ্রেণীস্তরেই সৃষ্টি লাভ এবং সেই স্তরেই পুষ্টিলাভও করে এবং তাঁহারাই নিজেদের স্বার্থসংরক্ষণের জন্য ক্রমশ তাহা অজ্ঞ নিরক্ষর নিম্নতর লোকস্তরে সংক্রামিত করিতে চেষ্টা করেন; সাধারণত এ-ধরনের বিদ্বেষের পশ্চাতে সক্রিয় থাকে অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক কোনও স্বার্থ, লাভালাভ বিবেচনা। আমাদের দেশে তাহার ব্যতিক্রম হইয়াছিল, এমন মনে করিবার কারণ নাই, প্রমাণও নাই। শ্রেণীস্বার্থ বা অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক স্বার্থ যেখানে সক্রিয় নয় সেখানে বিদ্বেষের কোনও কারণও নাই। গুপ্ত-বংশ ব্রাহ্মণ্য রাজবংশ; তাঁহারা ছিলেন পরম ভাগবত। সেই বংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত চীনা শ্রমণদের জন্য চীনা মন্দির নির্মাণ এবং তাহার সংরক্ষণের জন্য ২৪টি গ্রাম দান করিয়াছিলেন; পঞ্চম শতকে পাহাড়পুর অঞ্চলের এক ব্রাহ্মণ দম্পতি এক জৈন-বিহারে ভূমিদান করিয়াছিলেন; ষষ্ঠ শতকের প্রথম ভাগে সামন্ত মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে শৈবধর্মাবলম্বী মহারাজ বৈন্যগুপ্ত ভূমিদান করিয়াছিলেন বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বৌদ্ধ বিহারের সেবা, পূজা ইত্যাদির জন্য; প্রসিদ্ধ আচার্য শীলভদ্র ও বোধিভদ্রের জন্মবংশ ছিল ব্রাহ্মণ্য রাজবংশ; সপ্তম শতকের বৌদ্ধ খড়্গা-বংশীয় রাজা দেবখড়োর স্ত্রী প্রভাবতী দেবী একটি সর্বাণী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন; এই শতকেই সমতটের পরম বৈষ্ণব রাজা শ্রীধারণের অন্যতম প্রধান রাজকর্মচারী বৌদ্ধ জয়নাথ একই সঙ্গে বৌদ্ধ রত্নপ্রয় ব্রাহ্মণ্য পঞ্চমহাযজ্ঞের জন্য ভূমিদান করিয়াছিলেন। বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের লোকেরা পাশাপাশি একই জায়গায় বাস করিতেছেন, একে অন্যের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধিত ও অনুরক্ত এবং প্রয়োজন হইলে পোষকতাও করিতেছেন, কোথায় কাহারও ধর্মমতে কিংবা বিশ্বাসে বাধিতেছে না— ইহাই পরস্পর সম্বন্ধের মোটামুটি চিত্র। কিন্তু ব্যতিক্রম একেবারে ছিল না, এ কথাও জোর করিয়া বলা যায় না।
বুদ্ধদেব প্রবর্তিত ধর্মের বিরোধী ধর্ম-সম্প্রদায়ের মধ্যে ছবগ্গীয় বা ষড়বর্গীয় ভিক্ষুদের কথা মহাস্থান-শিলাখণ্ডলিপি হইতেই জানা যায়। পুণ্ড্রবর্ধনের রাজধানী পুণ্ড্রনগরে ইঁহাদের কিছুটা প্রতিপত্তিও ছিল বলিয়া মনে হয়। ষড়বর্গীয় সম্প্রদায় বুদ্ধপ্রবর্তিত বিনয় শাসন স্বীকার করিতেন না। কিন্তু পরবর্তী কালের বাঙলাদেশে কোথাও কোনও সূত্রেই এই ষড়বর্গীয়দের আর কোনও উল্লেখই পাওয়া যায় নাই। পরিবর্তে আর একটি ধর্মসম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিতেছে গুপ্তোত্তর পর্বে; এই সম্প্রদায় দেবদত্ত-সম্প্রদায় নামে খ্যাত। ইঁহারা শাক্যমুনির বুদ্ধত্ব স্বীকার করিতেন না, কিন্তু গৌতম-পূর্ববর্তী তিনজন বুদ্ধের পূজা করিতেন। দেবদত্ত-সম্প্রদায়ের ভিক্ষুরা লোকালয় হইতে দূরে বাস করিতেন, জীর্ণ চীবর ছিল তাঁহাদের পরিধেয়, ভিক্ষান্ন ছিল তাঁহাদের একমাত্র ভক্ষ্য এবং কৃচ্ছসাধন ছিল তাঁহাদের সাধনার অঙ্গ। দুগ্ধজাত দ্রব্য তাঁহারা ভক্ষণ করিতেন না। ৪০৫ খ্রীষ্ট শতকে ফা-হিয়েন শ্রাবস্তীতে এই সম্প্রদায়ের ভিক্ষুগণের দেখা পাইয়াছিলেন। য়ুয়ান্-চোয়াঙ কর্ণসুবর্ণে এই সম্প্রদায়ের ভিক্ষুদের তিনটি সংঘারাম দেখিয়াছিলেন। ইহারা দেবদত্তের মত অনুসরণ করিয়া দুগ্ধজাত ক্ষীর ভক্ষণ করিতেন না। কিন্তু, য়ুয়ান-চোয়াঙের পর ইহাদের আর কোনও উল্লেখই আর কোথাও দেখিতেছি না। বোধ হয়, ইহারাও ষড়বর্গীয়দের মতই বৌদ্ধদের অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে বিলীন হইয়া গিয়াছিলেন।
য়ুয়ান্-চোয়াঙের কালে বাঙলার নির্গ্রন্থ জৈনধর্মের প্রসার ছিল যথেষ্ট অথচ পরবর্তী কালে এই ধর্মের প্রভাব প্রতিপত্তির কথা লিপিমালায় বা সাহিত্যে আর বিশেষ শোনা যাইতেছে না। কিন্তু পাল ও সেনপর্বে বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া অঞ্চলে বেশ কিছু মূর্তি-প্রমাণ বিদ্যমান। কিছু সংখ্যক জৈন ভিক্ষু ও উপাসক বোধ হয় বৌদ্ধ ধর্ম ও সংঘের কুক্ষিগতও হইয়া থাকিবেন; এর পর বাকী যাঁহারা রহিলেন তাঁহারা বোধ হয় পরে ক্রমশ কাপালিক-অবধৃতদের সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছিলেন।