৩. প্রাক-গুপ্তপর্বের ধর্মকর্ম ইত্যাদি ।। আর্যধর্মের-বিস্তার

৩. প্রাক-গুপ্তপর্বের ধর্মকর্ম ইত্যাদি ।। আর্যধর্মের-বিস্তার

জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধ ধর্মের পূর্বাভিযানকে আশ্রয় করিয়াই প্রাচীন বাঙলায় আর্য-ধর্মকর্মের প্রাথমিক সূচনা ও বিস্তার। এই তিন ধর্মমতই বেদবিরোধী, বেদের অপৌরুষেয়ত্বে অবিশ্বাসী, কিন্তু ইহাদের প্রত্যেকটিই মূলত আর্যধর্মাশ্রয়ী; আর্য ধ্যান-ধারণাই ইহাদের জীবনমূল। এই তিন ধর্মের মধ্যে আবার জৈন ও আজীবিক ধর্মের সঙ্গেই কৌম বাঙালীর প্রথম আর্য ধর্ম-পরিচয়।

জৈনধর্ম

জৈন-পুরাণের ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয়, মানভূম, সিংভূম, বীরভূম ও বর্ধমান এই চারিটি স্থাননামই জৈন তীর্থঙ্করদের নামের সঙ্গে জড়িত। জৈন-পুরাণ মতে ২৪ জন তীর্থঙ্করের মধ্যে বিশ জনেরই নির্বাণস্থান হাজারিবাগ জেলার পরেশনাথ বা পার্শ্বনাথ পাহাড়ের সমেশিখর বা সমাধিশিখর। আয়ারঙ্গ বা আচারঙ্গ সূত্রকথিত মহাবীর ও তাঁহার শিষ্যবর্গের রাঢ়দেশ (বজ্রভূমি) পরিভ্রমণ, সেখানকার দুঃখ, দুর্গতি ও লাঞ্ছনাভোগের কথা এবং তাঁহাদের পশ্চাতে কুকুর লেলাইয়া দিবার গল্প সুবিদিত। এই গল্পেই সুপ্রমাণ যে, প্রাক্-আর্য কৌমসমাজবদ্ধ রাঢ়দেশে আর্যধর্মের প্রসার খুব সহজে হয় নাই। এখানকার খাদ্য, ভাষা, আচার-ব্যবহার আর্যদের কাছে সব কিছুই ছিল অরুচিকর এবং স্থানীয় লোকেরাও আর্যধর্মের প্রসার খুব প্রীতির চক্ষে দেখে নাই। যাহা হউক, যত অপ্ৰিয়ই হউক, জৈনধর্মের অগ্রগতিকে ঠেকাইয়া রাখা বেশি দিন সম্ভব হয় নাই। হরিসষেণের বৃহৎকথাকোষ গ্রন্থে (৯৩১ খ্রীঃ) বর্ণিত আছে, মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তের গুরু প্রখ্যাত জৈনসুরী ভদ্রবাহু ছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনান্তর্গত দেবকোটের এক ব্রাহ্মণের সন্তান। ভদ্রবাহুর শৈশবে চতুর্থ শতকেবলী গোবর্ধন একবার দেবকোটে বেড়াইতে আসিয়া শিশু ভদ্রবাহুকে দেখিয়া মুগ্ধ হন এবং পিতার অনুমতি লইয়া শিশুটিকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যান। এই শিশুই কালক্রমে দীক্ষিত হইয়া শ্রুতকেবলী পদে উন্নীত হন। দিব্যাবদানের একটি গল্পে জানা যায়, অশোক একবার পুণ্ড্রবর্ধনের নির্গ্রন্থদের (জৈনদের) অপরাধে (ভুল করিয়া?) পাটলীপুত্রের ১৮,০০০ হাজার আজীবিকদের (চীনা অনুবাদ মতে, নির্গ্রন্থ পুত্রদের) হত্যা করিয়াছিলেন। এই দুই গ্রন্থের উক্তি প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে বাধা নাই যে, খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ-তৃতীয় শতকেই পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গে জৈনধর্মের যথেষ্ট প্রসার লাভ ঘটিয়াছিল। বৌদ্ধদের অপেক্ষা জৈনরা যে বাঙলাদেশ সম্বন্ধে বেশি খবরাখবর রাখিতেন তাহা জৈন ভগবতী-সূত্রের সাক্ষ্যেই প্রমাণ। ষোড়শ মহাজনপদের তালিকায় বৌদ্ধ অঙ্গুত্তর নিকায়-গ্রন্থে প্রাচ্যদেশের দু’টি মাত্র জনপদের নামোল্লেখ পাইতেছি—অঙ্গ এবং মগধ। জৈন ভগবতী-সূত্রে পাইতেছি তিনটির উল্লেখ—অঙ্গ, বঙ্গ এবং লাঢ় (রাঢ়)। জৈন সূত্র-গ্রন্থগুলিতে বঙ্গের উল্লেখ বারবারই পাওয়া যায়। আরও সুনির্দিষ্ট ও বিশ্বাস্য তথ্য পাওয়া যাইতেছে জৈন কল্প-সূত্র-গ্রন্থে। এই গ্রন্থে তামলিত্তিয়া, কোডিবর্ষীয়া, পোংডবর্ধনীয়া এবং (দাসী) খব্বডিয়া নামে জৈন গোদাস-গণীয় ভিক্ষুদের চারিটি শাখার উল্লেখ আছে। বলা বাহুল্য, প্রত্যেকটি শাখার নামকরণ স্থাননাম হইতে এবং এই স্থাননামগুলি যথাক্রমে তাম্রলিপ্তি (মেদিনীপুর), কোটীবর্ষ (দিনাজপুর), পুণ্ড্রবর্ধন (বগুড়া) এবং খর্বাট বা কর্বাট (পশ্চিমবঙ্গেরই কোনও স্থান)। জৈনধর্মের বহুল বিস্তৃতি না থাকিলে এতগুলি শাখা বাঙলাদেশে কেন্দ্রীকৃত হওয়ার কোনও সুযোগ থাকিত না। খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতক ও খ্রীষ্টোত্তর প্রথম শতকের একাধিক লিপিতে এই সব শাখাগুলির উল্লেখ হইতে মনে হয়, গোদাস-গণীয় জৈনদের চারিটি শাখা ততদিনে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। (আনুমানিক) খ্রীষ্টোত্তর দ্বিতীয় শতকের মথুরার একটি শিলালিপি হইতে জানা যায়, রারা (রাঢ়দেশ) জনপদের অধিবাসী এক জৈনভিক্ষু মথুরায় একটি জৈনপ্রতিমা নির্মাণ ও প্রতিষ্ঠা করাইয়াছিলেন।

আজীবিক ধর্ম

জৈনদের মতো-এতটা না হউক, আজীবিকেরাও সঙ্গে সঙ্গে বাঙলাদেশে কিছুটা প্রসার প্রতিপত্তিলাভ করিয়াছিলেন বলিয়া মনে হয়। আজীবিক ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মখলিপুত্ৰ গোসাল ও মহাবীর ছিলেন সমসাময়িক (খ্রীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক) এবং পরস্পর পরম বন্ধু : ভগবতী-গ্রন্থমতে তাঁহারা দুইজনে একসঙ্গে ছয় বৎসর কাটাইয়াছিলেন বজ্রভূমির অন্তর্গত পণিত ভূমিতে। রাঢ়দেশ-পরিব্রজ্যায় আসিয়া মহাবীর এই ধর্মসম্প্রদায়ের দীর্ঘ বংশদণ্ডধারী অনেক ভিক্ষুর দেখা পাইয়াছিলেন; তাঁহারাও তখন ধর্মপ্রচারোদ্দেশে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিলেন। পাণিনি রাঢ়িদেশে মস্করী সম্প্রদায়ের যে-বিবরণ রাখিয়া গিয়াছেন তাহাদের সঙ্গে এই ভিক্ষুবিবরণ বেশ মিলিয়া যায় এবং মনে হয়, তিনি যেন আজীবিকদের কথাই বলিয়াছিলেন। আর, আজীবিকেরা যে প্রাচ্যদেশে বেশ প্রভাবশালী সম্প্রদায় ছিলেন তাহা তো বিহারের নাগার্জুন ও বরাবর পাহাড়ের গুহাবলী এবং মৌর্যসম্রাট অশোক ও দশরথের একাধিক শিলালিপি -সাক্ষ্যেই সপ্রমাণ। ভগবতী-গ্রন্থের মতে পুণ্ড্ররাজ মহাপৌম আজীবিকদের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এই পুণ্ড বিন্ধ্যপর্বতের পাদদেশে বলিয়া বর্ণিত : মহাপৌমের রাজধানীর একশতটি ছিল প্রবেশ তোরণ। কোনও কোনও পণ্ডিত মনে করেন, এই পুণ্ড পাটলীপুত্র, কিন্তু আমার তো মনে হয়, ভগবতী-গ্রন্থকার পুণ্ড্র বলিতেই পুণ্ড্র বুঝিয়াছেন। দিব্যাবদানে অনেক স্থানেই আজীবিক ও নির্গ্রন্থদের মধ্যে তালগোল পাকাইয়া গিয়াছে; অশোকের সেই ১৮,০০০ হাজার আজীবিক বা নির্গ্রন্থ পুত্র হত্যার গল্পেও তাহা হয় নাই, এ-কথা নিশ্চয় করিয়া বলা যায় না। সম্ভবত, দিব্যাবদান রচনা কালে পুণ্ড্রবর্ধনে নির্গ্রন্থ জৈনদের এবং আজীবিকদের বহুদিন এক সঙ্গে বসবাসের ফলে এবং তাহাদের ধর্মমত, আচারানুষ্ঠান এবং বসনভূষণ অনেকটা এক রকম হইবার ফলে বৌদ্ধদের দৃষ্টিতে ইহাদের মধ্যে পার্থক্য বিশেষ কিছু ছিল না!

বৌদ্ধধর্ম

বৌদ্ধ জনশ্রুতির ঐতিহাসিকত্ব স্বীকার করিলে বলিতে হয়, জৈন ও আজীবিকদের সমসাময়িক কালে বৌদ্ধধর্মও প্রাচীন বাঙলায় বিস্তার লাভ করিতে আরম্ভ করে। সংযুক্তনিকায়-গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, বুদ্ধদেব একবার সুম্ভভূমি (সুহ্মভূমি) অন্তর্গত শেতক নগরে কিছুদিন বাস করিয়াছিলেন। অঙ্গুত্তর নিকায় গ্রন্থে বঙ্গান্তপুত্ত নামে এক বৌদ্ধ আচার্যের উল্লেখ পাইতেছি। বোধিসত্ত্বাবদান কল্পলতা গ্রন্থের অনাথপিণ্ডকসূতা সুমাগধার কাহিনীতে জানা যায় যে, বুদ্ধদেব স্বয়ং একবার ধর্মপ্রচারোদ্দেশে পুণ্ড্রবর্ধনে আসিয়া ছয় মাস বাস করিয়া গিয়াছিলেন। চীনা পরিব্রাজক য়ুয়ান-চোয়াও বলিতেছেন, বুদ্ধদের পুণ্ড্রবর্ধন, সমতট ও কর্ণসুবর্ণে আসিয়া ধর্মপ্রচার করিয়াছিলেন। কিন্তু এতগুলি উল্লেখ সত্ত্বেও বুদ্ধদেবের বাঙলাদেশে আসা ঐতিহাসিক সত্য বলিয়া মনে হয় না; পূর্বদিকে তিনি দক্ষিণ-বিহারের সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন এমন কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ নাই। দীক্ষাদান সম্পর্কে পালি বিনয় পিটক গ্রন্থে আর্যাবর্তের পূর্বতম সীমা টানা হইয়াছে কজঙ্গলে; সংস্কৃত বিনয়-গ্রন্থে এই সীমা বিস্তৃত হইয়াছে পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত। এই দু’টি সাক্ষ্য হইতে মনে হয়, বুদ্ধদেব স্বয়ং বাঙলাদেশে আসুন বা না আসুন, মৌর্যসম্রাট অশোকের আগেই বৌদ্ধধর্ম প্রাচীন বাঙলায় কোনও কোনও স্থানে বিস্তার লাভ করিয়াছিল। আর, অশোকের বৌদ্ধধর্মপ্রচার যে অন্তত কিছুটা বাঙলাদেশের চিত্রজয় করিয়াছিল তাহার প্রমাণ তো দিব্যাবদান-গ্রন্থ এবং য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতেই পাইতেছি। য়ুয়ান-চোয়াঙ বলিতেছেন, অশোকের স্মৃতিবিজড়িত অনেকগুলি স্তুপ তিনি দেখিয়াছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনে, সমতটে, কর্ণসুবর্ণে এবং তাম্রলিপ্তিতে। পুণ্ড্রবর্ধন বোধ হয় সুবিস্তৃত অশোক সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্তই ছিল; অন্তত খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম যে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছিল মহাস্থান-শিলাখণ্ড-লিপিতে তো তাহার পাথুরে প্রমাণও বিদ্যমান। এই লিপিতে ছবীয় বা ষড়বর্গীয় থেরবাদী ভিক্ষুদের উল্লেখ তো আছেই, অত্যায়িক বা আপদকালে তাঁহাদিগকে রাজকীয় কোষাগার এবং শস্যভাণ্ডার হইতে তৈল, ধান্য, গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রা সাহায্যদানের কথাও আছে। তাহারা যে রাষ্ট্রের পোষকতা লাভ করিতেন, সন্দেহ নাই। খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে বৌদ্ধধর্ম প্রসারের একটি পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় সাঁচী স্তূপের দুইটি দানলিপি হইতে; এই লিপি দু’টিতে জানা যায়, পুঞবতন বা পুণ্ড্রবর্ধনবাসী বৌদ্ধধর্মানুরাগী দুইটি ব্যক্তি—একটি মহিলা, নাম ধর্মদত্তা, অপরটি পুরুষ, নাম ঋষিনন্দন—সাঁচী স্তূপের বেষ্টনী ও তোরণ নির্মাণে কিছু দান করিয়াছিলেন। কিন্তু খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতকে সিংহলরাজ দুঠগামণি মহাস্তূপ প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে যে বিরাট উৎসব রচনা করিয়াছিলেন সেই উৎসবে আমন্ত্রিত ও আগত থেরবাদী বৌদ্ধদের সুদীর্ঘ তালিকায়, আশ্চর্যের বিষয়, বাঙলাদেশের কোনও উল্লেখ নাই। তবে, তিব্বতী জনশ্রুতি মতে নাগার্জুন বাঙলা দেশে বঙ্গাল ও পুণ্ড্রবর্ধনে—অনেকগুলি বিহার তৈরি করাইয়াছিলেন। বাঙলাদেশে (এক্ষেত্রে বঙ্গে, অর্থাৎ পূর্ব বঙ্গে) বৌদ্ধধর্ম প্রসারের আরও নির্ভরযোগ্য ঐতিহাসিক প্রমাণ পাইতেছি, খ্রীষ্টোত্তর তৃতীয় শতকের নাগার্জুনীকোত্তর একটি শিলালিপিতে। সিংহলী থেরবাদী বৌদ্ধদের চেষ্টা ও উৎসাহে ভারতবর্ষের অনেক জনপদ বৌদ্ধধর্মে দীক্ষালাভ করিয়াছিল; এই সব দেশের একটি দীর্ঘ তালিকা এই লিপিটিতে দেওয়া হইয়াছে এবং তালিকাটিতে বঙ্গের উল্লেখ আছে। মহাযান সাহিত্যের মতে বৌদ্ধদের প্রাচীন ষোড়শ মহাস্থবিরের মধ্যে অন্তত একজন ছিলেন বাঙালী; তিনি তাম্রলিপ্তিবাসী স্থবির কালিক। কিন্তু তাঁহার আবির্ভাব কাল নির্ণয় করা কঠিন। মনে হয়, তিনি প্রাক্-গুপ্তপর্বের লোক।

প্রাক্-গুপ্তপর্বে বাঙলার জৈন, আজীবিক ও বৌদ্ধধর্মের প্রসারের অল্পবিস্তর প্রমাণ যদি বা পাওয়া যায়, আর্য-বৈদিক বা ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রসারের নির্ভরযোগ্য প্রমাণ প্রায় কিছুই নাই। বেদ-সংহিতায় বাংলাদেশের তো কোনও উল্লেখই নাই; ঐতরেয় আরণ্যক গ্রন্থে যদি বা আছে(?), তাহাও নিন্দাচ্ছলে। এমন কি বৌধায়নের ধর্মসূত্র রচনাকালেও বাঙলাদেশে আর্য-বৈদিক সংস্কৃতিবহির্ভূত। অথচ, মিথিলা পর্যন্ত বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির বিস্তার তো উপনিষদ-ৰুগেই হইয়া গিয়াছিল এবং বাঙলাদেশে সেই ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রসারের পথে কোনও ভৌগোলিক বাধা ছিল না। দু’একটি সূত্রগ্রন্থে প্রাচীন বাঙলায় বৈদিক সংস্কৃতি আদৃতির একটু পরোক্ষ প্রমাণও পাওয়া যায়। বশিষ্ঠ-ধর্মসূত্রে জানা যায়, এক বিশিষ্ট ধর্ম সম্প্রদায়ের মতে বৈদিক ধর্মের প্রসার কৃষ্ণসার মৃগের বিচরণ ভূমির সীমা পর্যন্ত—পশ্চিমে সিন্ধু নদী এবং পূর্বদিকে সূর্যোদয়স্থান (অর্থাৎ পূর্বসমুদ্র)। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, সূত্রগ্রন্থ রচনাকালেও বাঙলাদেশে বৈদিকধর্ম বিস্তার লাভ করিয়াছিল, এ-কথা বলিবার মতো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ কিছুই নাই। বস্তুত, ভাষাগত ও জনগত তথ্যপ্রমাণ হইতে মনে হয়, খ্রীষ্টোত্তর তৃতীয়-চতুর্থ শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশে আর্য-বৈদিক ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার কিছু হয় নাই; প্রাক্-আর্যভাষী কৌমজনের বাসভূমি যেমন ছিল এই দেশ তেমনই তাহাদের ধ্যান-ধারণা ধর্মকর্মই ছিল এই দেশের ধর্ম ও সংস্কৃতি। কখনও কখনও কোনও কোনও আর্য-বৈদিক নেতা বা সম্প্রদায়ের শুভাগমন হইত কি-না বলা কঠিন, কিন্তু হইলেও তাঁহারা যে খুব সমাদৃত হইতেন এমন মনে হয় না; মহাবীরের গল্প হইতে এই অনুমান করা চলে। জৈন-বৌদ্ধ-আজীবিকেরা প্রসারের চেষ্টা কিছু করিয়াছিলেন এবং অল্পবিস্তর সার্থকতাও লাভ করিয়াছিলেন; কিন্তু বৈদিক ধর্মের দিক হইতে সে চেষ্টা বিশেষ হইয়াছিল বলিয়া মনে হয় না, সার্থকতা লাভ তো দূরের কথা। বরং বৈদিক ব্রাহ্মণ্য উন্নাসিকতা বাঙলাদেশকে বহুদিন অবজ্ঞার দৃষ্টিতেই দেখিত।

তাহা সত্ত্বেও প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে কোথাও কোথাও আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে স্থানীয় ধ্যান-ধারণার সংঘর্ষের কিছু কিছু ইঙ্গিত প্রচ্ছন্ন। হরিবংশ-গ্রন্থে যাদব-কৃষ্ণের সঙ্গে পুণ্ড্র-বাসুদেবের এক সংঘর্ষের কাহিনীর পরিচয় পাওয়া যায়। শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী পৌণ্ড্রক বাসুদেব কৃষ্ণের বাসুদেবত্বের দাবিতে অবিশ্বাসী ছিলেন; সংঘর্ষে পৌণ্ড্র পরাস্ত ও নিহত হন। মহাভারতে ভীমের পূর্বাভিযান প্রসঙ্গে এক পৌণ্ড্রক বাসুদেবের পরাজয়-কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। এই পৌণ্ড্রক-বাসুদেবই বোধ হয় শ্রীকৃষ্ণ-বিদ্বেষী পুণ্ড্র-বাসুদেব। স্বতঃই প্রশ্ন জাগে মনে, বাসুদেব কি পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনের অধিবাসী ছিলেন? তাহার ধর্মমত ও বিশ্বাস কী ছিল? সে যত ও বিশ্বাস কাহাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল? ঐতিহাসিক গবেষণার বর্তমান অবস্থায় এই জাতীয় কোনও প্রশ্নেরই উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়।

বস্তুত, প্রাক্-গুপ্তপর্বের বাঙলায় আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অভ্যুদয় ও প্রসারের নির্ভরযোগ্য কোনও প্রমাণই আমাদের নাই। প্রাচ্যদেশে, অবৈদিক ব্রাত্যধর্মের প্রসার ছিল এ তথ্য সুবিদিত। অথর্ববেদের একটি ব্রাত্যস্তোত্রের ব্যাখ্যায় মনে হয়, ব্রাত্যধর্মের সঙ্গে যোগধর্মের সম্বন্ধ বোধ হয় ছিল ঘনিষ্ঠ এবং এই যোগধর্মের অভ্যাস ও আচরণ প্রাচীন বাঙলায়ও হয়তো অজ্ঞাত ছিল না। কিন্তু, যোগধর্মের সঙ্গে বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কোনও ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল, এমন মনে করিবার কারণ নাই; বরং সিন্ধু-সভ্যতার আবিষ্কারের পণ্ডিতেরা মনে করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, যোগধর্ম প্রাক্-বৈদিক, এবং শৈব ও তান্ত্রিক ধর্মের সঙ্গে যোগের সম্বন্ধ ঐতিহাসিক পর্বের।

একটি অর্বাচীন, অজ্ঞাতনামা লেখকের একটি শ্লোকের উপর নির্ভর করিয়া রমাপ্রসাদ চন্দ মহাশয় অনুমান করিয়াছিলেন, শক্তিধর্মের অভ্যুদয় হইয়াছিল গৌড়ে, প্রসার লাভ ঘটিয়াছিল মিথিলায়, এখানে সেখানে কিঞ্চিৎ মহারাষ্ট্রের, জীর্ণত্ব প্রাপ্তি গুজরাটে। তাঁহার ধারণা, বৈদিক ও বেদোত্তর আর্যভূমির প্রত্যন্ত সীমায় যে-সব মাতৃতন্ত্রীয় কৌমজনেরা বাস করিতেন তাঁহাদের মধ্যে গিরিকাস্তারময়ী একজাতীয়া নারীশক্তির পূজা প্রচলন ছিল; বিন্ধ্যবাসিনী, শাকম্ভরী, কান্ডারী প্রভৃতি নামে পরিচিতা দেবীরা এই নারীশক্তিরই প্রতীক, এবং শক্তিধর্মের অভ্যুদয় ও প্রসার ইহাদের আশ্রয় করিয়াই। চন্দ মহাশয় মনে করেন, বাঙলাদেশও পূর্বতম প্রত্যন্ত দেশ হিসাবে এই ধর্মের অংশীদার ছিল। কিন্তু শক্তিধর্মের ধ্যান-ধারণাগত ইতিহাস চন্দ মহাশয়ের এই অনুমানের বিরোধী। শক্তিধর্মের শিব ও শক্তি সাংখ্য- ধ্যানোক্ত পুরুষ ও প্রকৃতিরই নামান্তর মাত্র এবং এই পুরুষ-প্রকৃতি ধ্যান আর্য-ব্রাহ্মণ্য সৃষ্টি ধ্যানের মূল রহস্য; সে রহস্যে পুরুষ ধ্যানের বাহিরে বিশুদ্ধ একক শক্তি বা প্রকৃতির কোনও স্থান নাই। একবার যখন ভারতীয় ধ্যানে পুরুষ-প্রকৃতি সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া

গেলেন এবং ক্রমশ শিব-শক্তিতে রূপান্তরিত হইলেন তখন কৌম-সমাজের মাতৃকা দেবীরা ধীরে ধীরে আসিয়া শক্তিকে অর্থাৎ প্রকৃতিকে আশ্রয় করিবেন এবং তাঁহার সঙ্গে এক হইয়া যাইবেন, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। সেই জন্যই, পরবর্তীকালে আমরা যাহাকে শক্তিধর্ম বলিয়া জানি তাহা প্রাক্-গুপ্তপর্বে বাঙলাদেশে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, এ কথা বলিবার মতো কোনও প্রমাণ আমাদের জানা নাই। তবে, কৌম-সমাজের মাতৃকাতন্ত্রের দেবীরা নিশ্চয়ই ছিলেন এবং শক্তিধর্ম প্রসারের পর তাঁহারা শক্তিরূপিণী বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে, বিশেষভাবে দুর্গা, তারা প্রভৃতি দেবীর সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছিলেন।