দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর জনসাধারণের দেহগঠনের, বিশেষভাবে কেশবৈশিষ্ট্য, চোখ ও চামড়ার রং, নাসিকা, কপাল ও নরমুণ্ডের আকৃতি ইত্যাদির পরিমিতি গ্রহণ করিয়া এ পর্যন্ত যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা সংক্ষেপে জানিয়া লওয়া যাইতে পারে। সকলের পরিমিতি একই মানদণ্ড অনুসারে গৃহীত হয় নাই; পণ্ডিতদের মধ্যে পরিমিতি গণনার যে বিভিন্নতা দেখা যায় ইহা তাহার অন্যতম কারণ। তবে, মোটামুটি বৈশিষ্ট্যগুলি ধরিতে পারা খুব কঠিন নয়। সর্বত্রই প্রধান প্রধান ধারার কথাই উল্লেখ করা সম্ভব; উপধারাগুলির ইঙ্গিতমাত্র দেওয়া চলে। অথচ প্রধান প্রধান ধারার সঙ্গে উপধারা মিলিয়া এক হইয়াই বাঙালীর জন-সাংকর্যের সৃষ্টি হইয়াছে, এ কথা ভুলিলে চলিবে না।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ একটি উপপুরাণ; ইহার তারিখ আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক; তুর্কি-বিজয়ের অব্যবহিত পরেই রাঢ়দেশে ইহা রচিত হইয়াছিল এমন অনুমান করিলে খুব অন্যায় হয় না। ব্রাহ্মণ-বর্ণ বাদ দিয়া সমসাময়িক বাঙলাদেশের জনসাধারণ যে ছত্রিশটি জাত-এ বিভক্ত ছিল, তাহার একটু পরিচয় এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রন্থটির রচয়িতা ব্রাহ্মণেতর শূদ্রবর্ণের লোকদিগকে তদানীন্তন বর্ণবিভাগানুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন :
১. উত্তম সংকর বিভাগ : করণ (সৎশূদ্র), অম্বষ্ঠ (বৈদ্য), উগ্র, মাগধ, গান্ধিক, বণিক, শান্থিক, কংসকার, কুম্ভকার, তন্তুবায়, কর্মকার, গোপ, দাস (চাষী), রাজপুত্র, নাপিত, মোদক, বারজীবী, সূত (সূত্রধর), মালাকর, তামুলী ও তৌলিক। (২০)
২. মধ্যম সংকর বিভাগ : তক্ষণ, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তৈলকারক, ধীবর, শোণ্ডিক, নট, শাবাক (শাবার), শেখর ও জালিক। (১২)
৩. অন্ত্যজ বা অধম সংকর (বর্ণাশ্রম-বহিস্কৃত) : মলেগ্রহী, কুড়ব, চণ্ডাল, বরুড়, চর্মকার, ঘণ্টজীবী বা ঘট্টজীবী, ডোলাবাহী, মল্ল ও তক্ষ। (৯)
ইহা ছাড়া তিনি অবাঙালী ও বৈদেশিক ম্লেচ্ছ কয়েকটি কোমের নামও করিয়াছেন স্বতন্ত্র বিভাগের অধীনে, যথা, দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ, গণক-গ্রহবিপ্ৰ, বাদক, পুলিন্দ, পুককশ, খশ, যবন, সুহ্ম, কম্বোজ, শবর, খর ইত্যাদি। উপরের তালিকা হইতে দেখা যাইবে, বৃহদ্ধর্মপুরাণ যদিও বলিতেছেন ছত্রিশটি জাত বা বর্ণ-উপবর্ণের কথা, নাম করিবার সময় করিতেছেন একচল্লিশটির। পাচটি যে পরবর্তী কালের যোজনা, এ অনুমান সেই হেতু অসংগত নয়। এখনও আমরা ছত্রিশ জাত-এর কথাই তো প্রসঙ্গত বলিয়া থাকি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডও খুব সম্ভব বাঙলাদেশের রচনা এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণের প্রায় সমসাময়িক। এই পুরাণেও সমসাময়িক বাঙলার বিভিন্ন জাত-এর একটা অনুরূপ তালিকা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেরই বর্ণবিন্যাস অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যাইবে; এখানে বর্তমান প্রয়োজনে সে তালিকার আর কোনও প্রয়োজন নাই।
বর্ণ ও জনের দিক হইতে এই বিভাগ যে কৃত্রিম এ কথা অনস্বীকার্য, তাহা ছাড়া বর্ণ তো কিছুতেই জন-নির্দেশক হইতে পারে না। আর, একটু মনোযোগ করিলেই দেখা যাইবে, ইহার প্রথম দুইটি বিভাগ ব্যবসায়-কর্মগত এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বিভাগ দুইটি কতকটা জনগত। প্রথম বিভাগটি জলচল ও দ্বিতীয় বিভাগটি জল-অচল বর্ণের বলিয়া অনুমেয়; কাজেই কি কর্মবিভাগ কি জনবিভাগ, কোনও দিক হইতেই ইহার মধ্যে ঐতিহাসিক যুক্তি হয়তো মিলিবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, স্বর্ণকার ও স্বর্ণবণিক কেনই বা মধ্যম সংকর, আর গন্ধবণিক ও কংসবণিক কেনই বা উত্তম সংকর, অথবা তৈলকার কেনই বা মধ্যম সংকর। বস্তুত, বর্ণবিভাগ যেখানে ব্যবসায়-কর্মগত সেখানে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যেই বিভিন্ন জনের বর্ণ আত্মগোপন করিয়া থাকিবেই; এই বর্ণগুলি সেইজন্যই সংকর এবং স্মৃতি ও পুরাণে বারবার যে বর্ণসংকর ও জাতিসংকরের কথা বলা হইয়াছে ইহার ইঙ্গিত ইতিহাস ও নরতত্ত্বের দিক হইতে নিরর্থক ও অযৌক্তিক নয়। রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সাংকর্যের কথা যে বলা হয় নাই তাহার কারণ হয়তো এই যে, এইসব পুরাণ ও স্মৃতি প্রায়শ তাহাদেরই রচনা; অথচ নরতত্ত্বের দিক হইতে দেখা যাইবে এই জাতিসাংকর্য অম্বষ্ঠ ও করণদের সম্বন্ধে যতখানি সত্য ঠিক ততখানি সত্য ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধেও। নরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই কথাটা ভালো করিয়া ধরা পড়িবে এবং তখন দেখা যাইবে, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা যে পরিমাণে সংকর, বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম এবং মধ্যমে সংকর বিভাগের অধিকাংশ বর্ণই সেই পরিমাণে এবং প্রায় একই বৈশিষ্ট্যে সংকর।
বাঙালী ব্রাহ্মণদের দেহদৈর্ঘ্যও মধ্যমাকৃতি; মুণ্ডের আকৃতিও মাধ্যমিক (mesocephalic), অর্থাৎ গোলও নয়, দীর্ঘও নয়; নাসিকা তীক্ষ্ণ ও উন্নত। বিরজাশংকর গুহ মহাশয় রাঢ়ীয় বাহ্মণদের যে পরিমিতি গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে এই বৈশিষ্ট্যগুলি ধরা পড়িয়ছিল। কিন্তু, সাম্প্রতিক কালে যাহারা এই বর্ণের মুণ্ডাকৃতি বিশ্লেষণ করিয়াছেন তাহারা মনে করেন যে, উত্তর বা দক্ষিণ রাঢ়ীয়, বারেন্দ্র বা বৈদিক—সকল পর্যায়ের ব্রাহ্মণদের মধ্যেই গোল মাথার (brachycephalic) একটা সুস্পষ্ট ধারা একেবারে অস্বীকার করা য়ায় না; কায়স্থদের মধ্যেও তাহাই সঙ্গে সঙ্গে এই তিন পর্যায়ের ব্রাহ্মণদের মধ্যে আবার চ্যাপটা বিস্তৃত নাসার (platyrhine) একটা অস্পষ্ট ধারাচিহ্নও অনস্বীকার্য, যদিও গোল এবং মধ্যমাকৃতির মুণ্ড ও উন্নত সুগঠিত নাসাই সাধারণ বৈশিষ্ট্য। কিন্তু এই বিশ্লেষণের পরেও এ কথা বলা প্রয়োজন যে, ব্রাহ্মণদের মধ্যে দীর্ঘ মস্তিষ্কাকৃতি(dococephaic) স্বল্প হইলেও একটা অনুপাত ধরা পড়ে। এ কথা সাধারণভাবে অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গের পরিমিতিবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও সত্য; কারণ, আগেই বলিয়াছি, প্রধান ধারার উল্লেখই সম্ভব, উপধারাগুলির ইঙ্গিত দেওয়া যায় মাত্র।
ব্রাহ্মণদের দেহগঠন সম্বন্ধে আমরা যাহা জানি, বাঙালী কায়স্থদের দেহবৈশিষ্ট্য সম্বন্ধেও তাহা সত্য। বস্তুত, মুণ্ড ও নাসাকৃতির দিক হইতে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের মোটামুটি কোনও পার্থক্যই নৃতত্ত্ববিদের চোখে ধরা পড়ে না; নরতত্ত্বের দিক হইতে ইহারা সকলেই একই নরগোষ্ঠী। রাহ্মণদের মতো ইহারাও মধ্যমাকৃতি, ইহাদেরও চুলের রং কালো, চোখের মণি মোটামুটি পাতলা হইতে ঘন বাদামী যাহা সাধারণ দৃষ্টিতে কালো বলিয়াই মনে হয়। গায়ের রং পাতলা বাদামী হইতে আরম্ভ করিয়া পাতলা গৌর। কাহারও কাহারও মতে রাঢ়ীয় কায়স্থদের মধ্যে দীর্ঘ অনুন্নত করোটির প্রাধান্য দেখা যায়, মূধ্যমাকৃতির বৈশিষ্ট সেখানে কম। কিন্তু এই কমবেশি যেহেতু মানদণ্ডনির্ভর এবং যেহেতু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানদণ্ড ব্যবহার করিয়া পরিমিতি গ্রহণ করা হইয়াছে, সেই হেতু শেষোক্ত মত সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলা যায় না।
বাহ্মণেতর অন্যান্য যে সমস্ত জাতির দেহবৈশিষ্ট্য-পরিমিতি গ্রহণ করা হইয়াছে, তাঁহাদের মধ্যে কায়স্থ, গোয়ালা, কৈবর্ত, পোদ, বাগদী, বাউরী, চণ্ডাল, মালো, মালী, মুচি, রাজবংশী, সদগোপ, বুনা, বাঁশফোঁড়, কেওড়া, যুগী, সাঁওতাল, নমঃশূদ্র, ভূমিজ, লোহার মাঝি (বেদে), তেলি, সুবর্ণবণিক, গন্ধবণিক, ময়রা, কলু, তত্ত্ববায়, মাহিষ্য, তাম্লী, নাপিত এবং রজকই প্রধান। ইহা ছাড়া যশোহর ও খুলনা অঞ্চলের নলুয়া (মুসলমান) এবং পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের কিছু কিছু পরিমিতিও গণনা করা হইয়াছে। কিন্তু সমস্ত জাত-এরই পরিমিতি-গণনা সমসংখ্যায় হইয়াছে এবং দেশের সর্বত্র সমভাবে বিস্তৃত হইয়াছে, এ কথা বলা যায় না। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও পাদদের পরিমিতি গণনা করিয়াছেন বিরজাশংকর গুহ মহাশয়। পশ্চিম বাঙলার কয়েকটি জেলার সাঁওতাল, ভূমিজ, বাউর, বাগদী, লোহার মাঝি, তেলি, সুবর্ণ ও গন্ধ-বণিক, ময়রা, কলু, তন্তুবায়, মাহিষ্য, তামলী, নাপিত, রজক ইত্যাদি গণনা করিয়াছেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মহাশয়; পারেন্দ ব্রাহ্মণদের পরিমিতি লইয়াছেন তারকচন্দ্র রায়চৌধুরী এবং হারাণচন্দ্র চাকলাদার লইয়াছেন কলিকাতার ব্রাহ্মণ ও বীরভূমের মুচিদের। রিজলি গণনা করিয়াছেন সদগোপ, রাজবংশী, মুচি, মালী, মালো, কৈবর্ত, গোয়ালা, চণ্ডাল, বাউরী, বাগদী এবং পূর্ব বাঙলার মুসলমানদের, কিন্তু অমুসলমান নিদর্শনগুলি কোথা হইতে আহৃত তাহা বলেন নাই। মীনেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় গণনা করিয়াছেন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বাঙলার আটটি জেলার, বুনা, নলুয়া (মুসলমান), বাঁশফোঁড়, মুচি, রাজবংশী, মালো (এই দুই বর্ণেরই ব্যবসা মাছ ধরা ও মাছ বিক্রি), কেওড়া ও যুগীদের। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সদগোপ, কৈবর্ত, রাজবংশী, পোদ এবং বাগদীদের পরিমিতি গণনা করিয়াছেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। মোটামুটিভাবে এইসব বর্ণ ও শ্রেণীগুলির মধ্যে বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম সংকর, মধ্যম সংকর ও অন্ত্যজ—এই বিভাগ তিনটির প্রতিনিধিদের অনেকেরই সন্ধান মিলিবে। নমঃশূদ্রবর্ণের যে অসংখ্য জনসাধারণ মধ্য ও বর্তমান যুগের একটি বলিষ্ঠ বর্ণ ও শ্রেণী-স্তর তাহাদের দেহগঠনের পরিমিতি যাহারা গ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের মধ্যে হাটন ও রিজলির নাম করিতেই হয়।
ইঁহাদের সকলের সম্মিলিত বিশ্লেষণ হইতে দেহগঠন, চোখ ও চামড়ার রং, কেশ-বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্বন্ধে কতকগুলি তথ্য সহজেই ধরা পড়ে। ইহাদের মধ্যে সর্বাগ্রে নমঃশূদ্রদের কথা বলিতেই হয়, কারণ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকদের সঙ্গে নরতত্ত্বের দিক হইতে ইহাদের কোনও পার্থক্য নাই এ কথা প্রায় নিঃসন্দেহে বলা যায়। উচ্চবর্ণের লোকদের মতো ইহারাও দৈর্ঘ্যে মধ্যমাকৃতি, মুণ্ডের গঠন মাধ্যমিক, এবং নাসা তীক্ষ্ণ ও উন্নত; ইহাদের চোখ ও চামড়ার রঙও মোটামুটিভাবে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থদেরই মতো, অথচ স্মৃতিশাসিত হিন্দুসমাজে ইহাদের স্থান এত নিচে যে নরতত্ত্বের পরিমিতি-গণনার মধ্যে তাহার কোনও যুক্তি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। সে যুক্তি হয়তো পাওয়া যাইবে জাত-সংঘর্ষের ইতিহাসের মধ্যে অথবা রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক ইতিহাসের মধ্যে।
ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও নমঃশূদ্রদের ছাড়া আর যে সব বর্ণের উল্লেখ আগে করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে গান্ধিক বণিক, সদগোপ ও গোয়ালা (গোপ), কৈবর্ত (চাষী ও মাহিষ্য), নাপিত, ময়রা (মোদক), বারুই (বারজীবী অর্থাৎ পানের বরজ যাহার উপজীবিকা), তামূলী (তাম্বুলী-যে পান বিক্রয় করে) এবং যুগী (তন্তুবায়) নিঃসন্দেহেই বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম সংকর পর্যায়ভুক্ত, এবং কলু বা তেলি (তৈলকারক), রজক, সুবর্ণবণিক এবং মালী মধ্যম সংকর পর্যায়ভুক্ত। চণ্ডাল বা চাঁড়াল, মুচি (চর্মকার), দুলিয়া (ডোলাবাহী), মালো, কেওড়া, মল্ল, ধীবর, প্রভৃতি অন্ত্যজ পর্যায়ের।
এইগুলি ছাড়া আরও কয়েকটি জাতের লোকদের সম্বন্ধে এবং উল্লিখিত জাতগুলি সম্বন্ধেও অতিরিক্ত কিছু কিছু পরিমিতি-গণনা বিভিন্ন নৃতত্ত্ববিদেরা করিয়াছেন। এইসব নরতত্ত্বগত পরিমিতি-গণনায় যাহা পাওয়া যায় তাহা বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-বর্ণের বাঙালী দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে মধ্যমাকৃতি; নমঃশূদ্রেরাও তাহাই। উত্তম সংকর বিভাগের বাঙালীও সাধারণত মধ্যমাকৃতি, কিন্তু খর্বতার দিকেও একটা ঝোঁক খুব স্পষ্ট। মালী ছাড়া মধ্যম সংকর বর্ণের লোকেরাও তদনুরূপ; মালীরা খর্বাকৃতি। অন্ত্যজ পর্যায়ের বা বর্তমানের তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতের লোকেরা সাধারণত খর্বাকৃতি; কিন্তু ইহাদের মধ্যেও কোনও কোনও জাত স্পষ্টতই মধ্যমাকৃতি এবং অনেক জাতের মধ্যেই মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। মুণ্ডাকৃতির দিক হইতে দেখিতে গেলে, সাধারণ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চবর্ণ এবং নমঃশূদ্ররা যেমন গোলাকৃতি, উত্তম সংকর পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণ তেমনই। আবার কোনও কোনও নিম্ন উপবর্ণের মধ্যে, যেমন পশ্চিম বাঙলার ভূমিজ ও সাঁওতালদের মধ্যে গোলের দিকেও একটু ঝোঁক উপস্থিত। এই ধরনের ঝোঁক, অবশ্য কিছু কিছু অন্য বর্ণের মধ্যেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। তেমনই আবার কতকগুলি বর্ণের মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিকে ঝোঁক অত্যন্ত স্পষ্ট, যেমন মাহিষ্য, নাপিত, ময়রা, সুবর্ণবণিক, মুচি, বুনা, বাগদী, বেদে, পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান প্রভৃতিদের মধ্যে। কতগুলি বর্ণ তো স্পষ্টতই দীর্ঘমুণ্ডাকৃতি, যেমন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গের নাসাকৃতির দিক হইতে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও নমঃশূদ্র বর্ণের লোকেরা সকলেই সাধারণত তীক্ষ্ণ ও উন্নতনাসা। সুবর্ণবণিকদের মধ্যে তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসা হইতে চ্যাপটা পর্যন্ত সব ধারাই সমভাবে বিদ্যমান; পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যেও তাহাই। ময়রাদের নাসাকৃতি মধ্যম কিন্তু তীক্ষ্ণতার দিকে ঝোঁক স্পষ্ট। উত্তম ও মধ্যম সংকর পর্যায়ের, এমন-কি অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণেরই নাসাকৃতি মধ্যম, তবে কোনও কোনও বর্ণের কোমদের মধ্যে, যেমন গন্ধবণিক, নাপিত, তেলি, কলু, মালো প্রভৃতির চ্যাপটার দিকেঝোঁক সহজেই ধরা পড়ে। আবার কতগুলি বর্ণের নাসাকৃতি একেবারেই চ্যাপটা, যেমন, বেদে ভূমিজ, বাগদী, বাউর, তামলী, তন্তুবায়, রজক, মালী, মুচি, বাশফেড়, মাহিষ্য প্রভৃতি। সাঁওতালদের নাসিকাকৃতিও চ্যাপটা, কিন্তু মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক আছে।
কয়েকটি ধারণা এইবার মোটামুটি কিছুটা স্পষ্ট হইল। সাধারণভাবে বলা যায়, বাঙালীর চুল। কালো, চোখের মণি পাতলা হইতে ঘন বাদামী, বা কালো, গায়ের রং সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী, নিম্নতম শ্রেণীতে চিকণ ঘনশ্যাম পর্যন্ত দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে বাঙালী মধ্যমাকৃতি, খর্বতার দিকে বোকও অস্বীকার করা যায় না। বাঙালীর মুণ্ডাকৃতি সাধারণত দীর্ঘ উচ্চবর্ণস্তরে গোলের দিকে বেশি ঝোঁক। নাসাকৃতিও মোটামুটি মধ্যম, যদিও তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসাকৃতি উচ্চতর বর্ণের লোকদের ভিতর সচরাচর সুলভ।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর উচ্চ ও নিম্নজাতের এবং বাঙালী মুসলমানদের কিছু কিছু রক্তবিশ্লেষণ কোথাও কোথাও হইয়াছে। মিসেস ম্যাকফারলেন, রবীন্দ্রনাথ বসু, মীনেন্দ্রনাথ বসু, শশাঙ্কশেখর সরকার, অনিল চৌধুরী, মাখনলাল চক্রবর্তী প্রভৃতি কয়েকজন তাঁহাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করিয়াছেন। ইঁহাদের সম্মিলিত গবেষণার ফল মোটামুটি বাঙালীর জন-সাংকর্যের ইঙ্গিত সমর্থন করে। ডক্টর ম্যাকফারলেনের মতে, বর্ণ, বর্ণেতর ও অস্পৃশ্য বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে যে রক্তবৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যেও তাঁহাই। বাঙালী মুসলমানেরা যে বাঙালী হিন্দুদেরই সমগোত্রীয় ইহা তাহার আর একটি প্রমাণ।
কিন্তু এতক্ষণ বাঙালী জাতির দেহ-গঠনের যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হইল, তাহা আসিল কোথা হইতে? এ প্রশ্নের উত্তর পাইতে হইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতবর্ষে যে সব জন ছিল ও পরে যে সব জন একের পর এক এদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছে, প্রবহমান রক্তস্রোতে নিজেদের রক্ত মিশাইয়াছে, মৈত্রী ও বিরোধের মধ্য দিয়া একে অন্যের নিকটতর হইয়াছে, তাঁহাদের হিসাব লইতে হয়। কিন্তু তাহা করিবার আগে একটি সুপ্রচলিত মতবাদ সম্বন্ধে একটু বিচারের অবতারণা করা প্রয়োজন। এই মতটি নরতাত্ত্বিক হার্বার্ট রিজলির।
বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণগুলির ভিতর এবং অন্যান্য বর্ণের ভিতরও চওড়া নাসিকাকৃতি এবং গোল মুন্ডাকৃতির একটা সুস্পষ্ট ধারা বিদ্যমান, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে। বাঙালীর এইসব বৈশিষ্ট্যের যুক্তি খুঁজিতে গিয়া বহুদিন আগে রিজলি সাহেব বলিয়াছিলেন, বাঙালীরা প্রধানত মোঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উৎপন্ন। তিব্বত-চৈনিক গোষ্ঠীর চীনা, বর্মী, ভোটিয়া, নেপালী প্রভৃতি জনের লোকেরা তো আমাদের সুপরিচিত। ইহারা খর্বকায়, স্বল্পশ্মশ্রু এবং পীতাভবর্ণ। ইহাদের করোটি প্রশস্ত, নাসাকৃতি সাধারণত চ্যাপ্টা। আর, রিজলি যাহাদের বলিয়াছেন দ্রাবিড় সেই নরগোষ্ঠী তাহার মতে সিংহল হইতে গঙ্গার উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহারা কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, ইহাদের মুন্ডাকৃতি দীর্ঘ, নাসাকৃতি চ্যাপ্টা। রিজলি মনে করেন, এই দুই নরগোষ্ঠীর মিশ্রণে উৎপন্ন মোঙ্গোল-দ্রাবিড় নরগোষ্ঠী বিহার হইতে আরম্ভ করিয়া আসাম পর্যন্ত এবং উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহাদের মাথা গোল হইতে মধ্যমাকৃতি, নাসা মধ্যম হইতে চ্যাপ্টা। ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের ভিতর উন্নত ও সুগঠিত নাসার প্রাধান্য দেখা যায়। মোঙ্গলীয়দের মাথা প্রশস্ত (অর্থাৎ চওড়া, brachycephalic); কিন্তু তাহাদের নাক চ্যাপ্টা; বাঙালীদের প্রশস্ত মুন্ডের ধারা মোঙ্গালীয় শোণিতের দান, আর বাহ্মণ-কায়স্থদের উন্নত সুগঠিত নাসা ভারতীয় আর্যরক্তের দান, ইহাই হইতেছে রিজলির মত। এই মত অনুসরণ করিয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর পর্যন্ত সমস্ত পূর্ণভারতে মোঙ্গোলীয় প্রভাব উপস্থিত; দ্রাবিড় বলিয়া একটি নরগোষ্ঠী আছে এবং ইহাদের মাথা দীর্ঘ– এই দুই নরগোষ্ঠীর সাংকর্যে বাঙালীর উৎপত্তি। কাজেই বাঙালীর মুন্ডাকৃতি মধ্যম এবং তাহার মধ্যে দুই প্রান্তের গোল ও দীর্ঘ দুই ধারাই বর্তমান। উচ্চবর্ণের লোকদের মধ্যে যে উন্নত সুগঠিত নাসামান দেখা যায় তাহা ভারতীয় আর্যরক্তের দান।
রিজলির মত যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য মনে না করিবার কারণ অনেক। প্রথমত, দ্রাবিড় কোনও নরগোষ্ঠীর নাম নয়, এমন কি জনের নামও নয়, ভাষাতাত্ত্বিক শ্রেণীবিভাগের অন্যতম নাম মাত্র। দ্বিতীয়ত, গঙ্গাতট হইতে আরম্ভ করিয়া সিংহল পর্যন্ত দ্রাবিড় ভাষা প্রচলিত নাই; মধ্যভারতের জঙ্গলময় আটবী ও পার্বত্য ভূমিতে অস্ট্রিক-ভাষাভাষী লোকের বাস এখনও বিদ্যমান। তৃতীয়ত, রিজলি যে সব তথাকথিত দ্রাবিড় উপজাতিদের নাম করিয়াছেন, মস্তিষ্কাকৃতির দিক হইতে তাহারা সকলেই মোটামুটি দীর্ঘমুণ্ড হইলেও প্রত্যেক সমাজের উচ্চতম কোমগুলিতে গোল মুণ্ডাকৃতিরও কিছু অভাব নাই। নাসাকৃতিও মোটামুটি উন্নত ও তীক্ষ্ণ হইতে একেবারে চ্যাপটা পর্যন্ত। কাজেই দ্রাবিড় ভাষাভাষী বিচিত্র জন লইয়া সমগ্র সমষ্টিটাকেই দ্রাবিড় বলাটা খুব যুক্তিসংগত নয়। চতুর্থত, রিজলি যাহাঁদের বলিয়ছিলেন দ্রাবিড়, নরতত্ত্বের বিশ্লেষণে তাঁহাদের মধ্যে অন্তত দুইটি বিভিন্ন জনের অস্তিত্ব ধরা পড়ে : ১. আদি-নিগ্রোবটু : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও উচ্চ, নাক তীক্ষ্ণ ও সুউচ্চ, ২ আদি-অষ্ট্রেলীয় : ইহাদের মাথা দীর্ঘ ও অনুচ্চ, নাক মধ্যম। ইহাদের সঙ্গে বাঙালীর জনতত্ত্বের সম্বন্ধ কী এবং কোথায়, এবং থাকিলে কতটুকু সে আলোচনা পরে করা যাইবে। আপাতত এইটুকু বলা চলে, রিজলি কথিত দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব নৃতত্ত্ববিজ্ঞানীদের কাছে অগ্রাহ্য। রিজলি কথিত মোঙ্গলীয় প্রভাব সম্বন্ধে প্রথমেই বলিতে হয়, বাঙলার ও ভারতের পূর্ব ও উত্তর-শায়ী প্রত্যন্তদেশগুলির সকল ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরাই গোলমুণ্ডাকৃতি নয়। দ্বিতীয়ত, আর্যদের ভারতীগমনের পূর্বে আর্যভাষা বিস্তৃতিলাভের আগে, বাঙলা, উড়িষ্যা, ছোটনাগপুর পর্যন্ত মোঙ্গোলীয় গোষ্ঠীর লোকেরা বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, ইতিহাসে এমন কোনও প্রমাণ খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। দীর্ঘকরোটি কোচ, পলিয়া, বা উত্তর-বাঙলার বাহে, রাজবংশী প্রভৃতি ভোট-চৈনিক গোষ্ঠীর লোকেরা হিমালয় অঞ্চল বা ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকা হইতে আসিয়া ঐতিহাসিক যুগেই উপনিবিষ্ট হইয়াছে। তৃতীয়ত, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এইসব মোঙ্গোলীয়ের বেশির ভাগই দীৰ্ঘমুণ্ড; কাজেই, বাঙালীর মধ্যে যে গোল মুণ্ডাকৃতি দেখা যায় তাহা এইসব মোঙ্গোলীয় জাতির প্রভাবের ফলে হইতেই পারে না। উত্তরের লেপচা, ভোটানী, চট্টগ্রামের চাকমা প্রভৃতি লোকেরা গোলমুণ্ড বটে, কিন্তু ইহাদেরই রক্তপ্রভাবে যদি বাঙালীর মাথা গোল হইত তাহা হইলে স্বভাবতই এইসব দেশের কাছাকাছি দেশখণ্ডগুলিতেই গোলমুণ্ড, প্রশস্তনাস বাঙালীদের দেখা যাইত, কিন্তু যথার্থ তথ্য এই যে, এই বৈশিষ্ট্যগুলি বেশি দেখা যায় দক্ষিণে, পূর্বে ও উত্তরে নয়। চতুর্থত, মোঙ্গোলীয় জাতির লোকদের বঙ্কিম চক্ষু, শক্ত চুল, অক্ষিকোণের মাংসের পর্দা, উন্নত গণ্ডাস্থি, কেশস্বল্পতা, চ্যাপটা নাসাকৃতি এবং পীতাভ বর্ণ বাঙলাদেশে আমরা আরও বেশি করিয়া গভীর ও ব্যাপকভাবে পাইতাম, যদি যথার্থই মোঙ্গোলীয় প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে থাকিত। পঞ্চমত, বিরজাশংকর গুহ মহাশয় বাঙলার উত্তর ও পূর্ব-প্রান্তশায়ী মোঙ্গোলীয় অধিবাসীদের পরিমিতি গণনা করিয়া দেখাইয়াছেন যে, গারো, খাসিয়া, কুকী, এমন কি মৈমনসিংহের উত্তরতম প্রান্তের গারোদের এবং অন্যান্য কোমের লোকদের মুণ্ডাকৃতি মধ্যম, খুব বড় জোর গোলের দিকে একটু ঝোঁক আছে। কাজেই বাঙালীদের মধ্যে যে গোলমুন্ডের দিকে ঝোঁক তাহা মোঙ্গোলীয় জনদের গোলমুণ্ড অথবা মধ্যমমুণ্ডের প্রভাবের ফল হইতে পারে না। এইসব নানা কারণে রিজলির মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সাংকর্যের মত এখন আর গ্রাহ্য নয়।
কিন্তু, রিজলি বাঙালীর জনতত্ত্বগত বৈশিষ্ট্যনির্দেশে খুব ভুল কিছু করেন নাই; ভুল করিয়াছিলেন সেই বৈশিষ্ট্যের মূল অনুসন্ধানে। মূল যে মোঙ্গোলীয়-দ্রাবিড় সংমিশ্রণের মধ্যে নাই, এ বিষয়ে নরতত্ত্ববিদেরা এখন আর কিছু সন্দেহ করেন না; সেই মূলের সন্ধান পাওয়া যায় ভারতীয় নরতত্ত্বের নব-নির্ণত ইতিহাসের মধ্যে। কাজেই, তাহার পরিচয় অপ্রাসঙ্গিক নয়। এই নব-নির্ণীত ইতিহাস পূর্ণাঙ্গ ও নির্দোষ নয়, কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারতীয় নরতত্ত্বের এবং সঙ্গে সঙ্গে বাঙালীর জনরহস্যের কাঠামোটা আমাদের দৃষ্টিতে ধরা পড়িতে বাধে না।