ভূমি-সংক্রান্ত কয়েকটি সাধারণ মন্তব্য
ভূমির চাহিদা সমাজে ক্রমশ কী করিয়া বাড়িয়াছে তাহার কিছু কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ আগেই উল্লেখ করিয়াছি; এই চাহিদা বৃদ্ধির ইঙ্গিত বাস্তু, ক্ষেত্র, খিল সর্বপ্রকার ভূমি সম্বন্ধেই প্রযোজ্য। খুব প্রাচীন কালে কী হইয়াছিল, বলা কঠিন; কিন্তু অনুমান করা কঠিন নয় যে, লোকবসতি এবং কৃষিকর্ম সাধারণত নদ-নদীপ্রবাহ অনুসরণ করিয়াই বিস্তৃত ছিল। কৃষিকর্মের উপরই জনসাধারণের জীবিকা নির্ভর করিত, এবং সেই কৃষির প্রধান নির্ভরই ছিল নদনদী। যাহারা এদেশে লাঙ্গল প্রবর্তন করিয়াছিল, ধান্যকে লোকালয়ের কৃষিবস্তু করিয়াছিল, কলা, বেগুন, পান, হরিদ্রা, লাউ, সুপারি, নারিকেল, তেঁতুল প্রভৃতির সঙ্গে দেশের পরিচয় ঘটাইয়াছিল, সেই আদি-অস্ট্রেলীয় বা অস্ট্রিক-ভাষাভাষী লোকেদের সময়ই এই অবস্থা কল্পনা করা কঠিন নয়। নদনদী অনুসারী বসতি ও কৃষিক্ষেত্রের পরই বোধ হয় ছিল হয়। বনভূমি বা উষর পার্বত্যভূমি, অথবা নিম্ন হাজিক জলাভূমি এবং সেই হেতু খিল বা ‘পতিত্ব’। লোকবসতি এবং কৃষি বিস্তার কখন কি গতিতে অগ্রসর হইয়াছে, বলিবার মতো প্রমাণ নাই; দেশের সর্বত্র সকল সময়ে একই ভাবে হইয়াছে তাহাও বলা যায় না। শাসন ও বাণিজ্যকেন্দ্ৰ যে সব জায়গায় গড়িয়া উঠিয়াছে সেইখানে লোকবসতি এবং কৃষিক্ষেত্রের বিস্তারও অন্যান্য স্থান অপেক্ষা বেশি হইয়াছে, এরূপ অনুমান করা কঠিন নয়। লোকসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাহির হইতে আর্যভাষাভাষী লোকেদের এই দেশে বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদাও ক্রমশ বাড়িয়া গিয়াছে, ইহাও খুব স্বাভাবিক।
এই লোকবসতি ও কৃষিবিস্তারের প্রথম নিঃসংশয় প্রমাণ পাওয়া যায় পঞ্চম শতক হইতে; ভূমি সম্পর্কিত কোনও সাক্ষ্য ইহার আগে আর উপস্থিত নাই। লক্ষণীয় এই যে, পঞ্চম হইতে সপ্তম অষ্টম শতক পর্যন্ত যতগুলি ভূমিদানি-বিক্রয়ের পট্টোলী আছে, তাহার অধিকাংশ দত্ত এবং বিক্ৰীত ভূমি “অপ্ৰদ’ অর্থাৎ যাহা তখনও পর্যন্ত দেওয়া হয় নাই, বিলি বন্দােবস্ত হয় নাই, “অপ্ৰহত’, অর্থাৎ যাহা তখনও পর্যন্ত কৰ্ষিত হয় নাই এবং ‘খিলা, অর্থাৎ যাহা তখনও পর্যন্ত পতিত্ব, পড়িয়া আছে। ১ নং দামোদরপুর পট্টোলীর ভূমি “অপ্ৰদাপ্ৰহতখিল ক্ষেত্ৰ”; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলীর ভূমি “অপ্ৰদখিলক্ষেত্র; বৈগ্রাম-পট্টোলীর ভূমিও পতিত পড়িয়াছিল, রাজার কোনও আয় তাহা হইত না; গুণাইঘর পট্টোলীর ভূমি একেবারে “শূন্যপ্রতিকরহজ্জিকখিলভূমি”, রাজার কোনও আয়বিহীন হাজা পতিত জমি; সমাচারদেবের ঘুগ্রাহাটি পট্টোলীর ভূমিও গর্ত পরিপূর্ণ বন্যপশুর আবাসস্থল এবং সেই হেতু রাষ্ট্রের দিক হইতে নিস্ফল হইয়া পড়িয়া ছিল। ৫ নং দামোদরপুর পট্টোলীর ভূমি তো একেবারে অরণ্যময় প্রদেশে; আর ত্রিপুরা লোকনাথ পট্টোলীর ভূমিও হরিণ-মহিষ-ব্যাঘ্র বরাহ-সৰ্প আধুষিত এক অরণ্যের মধ্যে। নূতন নূতন বাস্তু ও ক্ষেত্রভূমি যেমন সৃষ্ট ও পত্তন হইতেছে, তেমনই পুরাতন ব্যবহৃত ভূমির উপরও নূতন চাপ পড়িতেছে, এরকম দৃষ্টান্তও দু-একটি এই যুগের লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। আস্রফপুর পট্টোলীতে দেখিতেছি, ভোগ করতেছে এমন লোকের নিকট হইতে ভূমি কাড়িয়া লইয়া (যথা-ভুঞ্জনার্দীপনীয়) অন্যত্র দান করা হইতেছে। ভূমির চাহিদা বৃদ্ধির ইহাও অন্যতম প্রমাণ।
পাল ও সেন আমলের লিপিগুলি সম্বন্ধে অধিক বলা নিম্প্রয়োজন। গ্রামগুলির যে আভাস লিপিগুলিতে পাওয়া যায়, ধান্যশস্যের যে ইঙ্গিত ইহাদের মধ্যে প্রচ্ছন্ন এবং “রামচরিতে” সুস্পষ্ট, সুপারি-নারিকেল হইতেই ভূমির আয়ের পরিমাণের যে আভাস পাওয়া যায়, তাহাতে কোনও সন্দেহ থাকে না যে, এই আমলে লোকবসতি ও কৃষির বিস্তার বেশ বাড়িয়া গিয়াছে। লোকসংখ্যার বৃদ্ধি, রাজা, রাজপরিবার এবং সমৃদ্ধ লোকদের ভূমিদান করিয়া পুণ্যলাভের ইচ্ছা, ব্রাহ্মণপুরোহিতদের ভূমি সংগ্রহের লোভ প্রভৃতির প্রেরণায়ই দেশে ক্রমশ বসতি ও কৃষির বিস্তার হইয়াছে, লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যের ইহাই ইঙ্গিত।
“শাসন” ও “অগ্রহার” অর্থাৎ দত্তভূমি যাঁহারা ভোগ করিতেন তাহারা ভূমিদানের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি-সম্পর্কিত অন্যান্য কতগুলি অধিকারও রাজা বা রাষ্ট্রের নিকট হইতে লাভ করিতেন; এই সব অধিকারের কিছু কিছু বিবরণ আগেই উল্লেখ করিয়াছি। সাধারণ প্রজাদের কী কী দায় ও অধিকার ছিল, তাহার কিছু কিছু আভাসও তাহা হইতেই পাওয়া যায়। ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য এই চারি প্রকার কর তো তাহাদের দিতেই হইত। উপরিকর নামেও একপ্রকার রাজস্ব দিতে হইত। দশ রকম অপরাধের কোনও অপরাধে অপরাধী হইলে জরিমানা দিতে হইত। হাটবাজার, খেয়াঘাট ইত্যাদির জন্যও কর ছিল। চোরাডাকাত হইতে রক্ষণাবেক্ষণের ভার রাষ্ট্র লেইত বলিয়া সেজন্যও একটা কর নির্দিষ্ট ছিল। এইগুলি নিয়মিত কর। তাহা ছাড়া, সময় সময় কোনও বিশেষ উপলক্ষেও রাজাকে বা রাষ্ট্রকে অন্যপ্রকারে কর দিতে হইত; লিপিতে এগুলিকে বলা হইয়াছে ‘পীড়া’। পীড়া যে এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই! ছোট বড় নানান্তরের নানা রাজপুরুষেরা বিচিত্র কার্যোপলক্ষে গ্রামে অস্থায়ী ছত্রবাস স্থাপন করিয়া বাস করিতেন; মনে হয়, তখন গ্রামবাসীদেরই তাঁহাদের আহার্য ও পানীয়ের ব্যবস্থা করিতে হইত। সমসাময়িক কামরূপের লিপিতে তো এগুলিকে উপদ্ৰবই বলা হইয়াছে। চাটভাটেরাও গ্রামে প্রবেশ করিয়া নানাপ্রকার উৎপাত উপদ্রব করিত। রাজপুত্রের জন্ম, রাজকন্যার বিবাহ প্রভৃতি উপলক্ষে রাজ্যকে প্রজার কিছু দেয় তো চিরাচরিত বিধি। বাঙলাদেশেও যে তাহার ব্যতিক্রম ছিল মনে হয় না। রাজা বা রাষ্ট্র যে ইচ্ছা করিলে বা প্রয়োজন হইলে প্রজার উচ্ছেদ সাধন করিতে পারিতেন এ সম্বন্ধে তো লিপি-প্রমাণ আগেই উল্লেখ করিয়াছি। ভূমিতে অধিকারবিহীন চাষী প্ৰজাও যে ছিল সে প্রমাণও বিদ্যমান। রাষ্ট্রে ও সমাজে ভূমির ব্যক্তিগত যৌথ অধিকার স্বীকৃত হইত, ব্যক্তিগত অধিকারের তুমি হস্তান্তরিত হইত, ভূমির ব্যক্তিগত যৌথ অধিকার (এজমালি স্বত্ব) স্বীকৃত হইত, নারীরা তুসম্পত্তির অধিকারী হইতে পারিতেন, মধ্যস্বত্বাধিকারিত্বও অস্বীকৃত ছিল না, এইসব তথ্যও সাক্ষ্য প্রমাণসহ আগেই উদ্ধার করা হইয়াছে। যে-ভূমি দান করা হইয়াছে সেই ভূমির উপর ও নীচের সমস্ত স্বত্ব-উপস্বত্বই রাজা ও রাষ্ট্র দান করিয়া দিতেছেন- একেবারে হাট ঘাট আকাশ জলস্থল মাছ গাছ ইত্যাদি সহ-, কিন্তু সাধারণ প্রজারা ভূমির নীচের অধিকার ভোগ করিত কি না, সংলগ্ন জলের অধিকার লাভ করিত কি না, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ আছে। কৌটিল্যের মতে ভূগর্ভস্থ খনি, লবণ ইত্যাদি রাষ্ট্রের সম্পত্তি; ভূমি বিক্ৰয়কালে রাজা কি ভূগর্ভের অধিকারওঁ বিক্রয় করিতেন? অবশ্য লিপিগুলি, বিশেষভাবে, অষ্টম শতকপূর্ব লিপিগুলি পাঠ করিলে মনে হইতে পারে, দান ও বিস্ময় উভয় ক্ষেত্রেই সর্বপ্রকার ভোগাধিকারই প্রজার উপর অপিত হইত।