সংযোজন (গ্রাম ও নগর-বিন্যাস)
কী পশ্চিমবঙ্গে কী বাঙলাদেশে ইতোমধ্যে এমন কোনও উৎখনন বা প্রত্নানুসন্ধান কোথাও হয়নি’ যাতে নগর ও নগরের আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে বস্তুনির্ভর ধারণা কিছু করা যেতে পারে। এ-গ্ৰন্থ রচনাকালে এক রামপাল ছাড়া এ ধরনের বস্তুনির্ভর সাক্ষ্য আর কোথাও ছিল না; রামপালের সাক্ষ্যও প্রত্নবিজ্ঞানের দিক থেকে যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। তা যাই হোক, নগর সম্বন্ধে গ্রন্থের পূর্ববর্তী সংস্করণ দু’টিতে যা বলা হয়েছিল তা প্রায় সমস্তই হয় লিপি না হয় কাব্য-সংক্ষ্যের উপর নির্ভর করে; যেমন, রামাবতী বা বিজয়পুরের বর্ণনা প্রধানত যথাক্রমে রামচরিত ও পবনদূত-নির্ভর। অন্যান্য নগরের সাক্ষ্য হয়। য়ুয়ান-চোয়াঙের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত, না হয় গ্ৰীক বা লাতিন বৃত্তান্ত, না হয় প্রাচীন পালিগ্রন্থ বা এই জাতীয় কিছু। বলা বাহুল্য এ-সব সাক্ষ্য নির্ভরযোগ্য হ’লেও অত্যন্ত অপ্রচুর, কিছুটা অস্পষ্টও বটে। আর, লিপিমালার সাক্ষ্য কাব্য-সংক্ষ্যেরই অনুরূপ; উচ্ছসময় অত্যুক্তি ও অলংকারপ্রিয় কবিদের বস্তুসম্বন্ধবিহীন কল্পনা ভেদ করে নগরের যথার্থ চিত্র বা আকৃতি-প্রকৃতি নির্ণয় প্রায় দুঃসাধ্য।
ইতোমধ্যে পশ্চিমবঙ্গে চন্দ্ৰকেতুগড়ে ও কর্ণসুবৰ্ণে কিছু উৎখনন হয়েছে। কিন্তু চন্দ্ৰকেতুগড়ের উৎখননে যদিও নগর-নির্মাণের আভাস কিছু পাওয়া যায়, সে-আভাস অত্যন্ত অস্পষ্ট, প্রচুর তো নয়ই; আর, কর্ণসুবর্ণের রাজবাড়ীড়াঙ্গার উৎখননে যা পাওয়া গেছে তা একটি বৌদ্ধ-বিহারের, ঠিক নগরের নয়। বাঙলাদেশে ময়নামতী-উৎখনন সম্বন্ধেও একই উক্তি প্রযোজ্য। এখানকার তথাকথিত শালবনবিহার যথার্থত ভবদেবী-মহাবিহার। বিহার নগরোপম হলেও তার চরিত্র ঠিক নগরের চরিত্র নয়; সে-চরিত্র সোমপুর মহাবিহার বা নালন্দা বা বিক্রমশিলা মহাবিহারেরই অনুরূপ। তা ছাড়া, দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যেতে পারে, চন্দ্ৰবংশীয় রাজা শ্ৰীচন্দ্রের পশ্চিমভাগ পট্টোলীতে জানা যাচ্ছে যে, রাজা শ্ৰীচন্দ্ৰ শ্ৰীহট্ট মণ্ডলে তার নিজের নামাঙ্কিত শ্ৰীচন্দ্রপুরে একটি বিরাট ‘ব্ৰাহ্মণপুর’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই ব্ৰাহ্মণপুর আর কিছুই নয়, নৃত্যুনাধিক ৬০০০ ব্ৰাহ্মণ-আধুষিত এবং প্রায় সমসংখ্যক কী তারও বেশি সেবক-সেবিত একটি বিস্তৃতায়তন ব্ৰাহ্মণ্য মঠ, বোধ হয়, বৌদ্ধ নালন্দা মহাবিহারেরই মতো। সন্দেহ নেই, শ্ৰীহট্ট-সুরমা-বরাক উপত্যকা অঞ্চলকে এইভাবেই সর্ব-ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাঙ্গীকৃত করা হচ্ছিল, যার প্রাচীনতর সাক্ষ্য ভাস্করবর্মর নিধনপুর লিপি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও, শ্ৰীচন্দ্রপুর-ব্রাহ্মণপুর নগরোপম হওয়া সত্ত্বেও, তাকে যথার্থতা নগর বলা কঠিন।
মানব-সভ্যতার ইতিহাসে নগর-নির্মাণের একটি বিশেষ তাৎপর্য আছে, যার সঙ্গে সামাজিক ধনোৎপাদনের, তার রীতি-পদ্ধতির এবং উদ্ধৃত্তি ধনের সম্বন্ধ অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এই তাৎপর্যের উপরই গ্রাম ও নগরের চেহারা ও চরিত্রের যত পার্থক্য তা নির্ভর করে। এ-গ্রন্থের পূর্ববর্তী সংস্করণে এই চেহারা ও চরিত্র-পার্থক্যের দিকে আমি কিছু ইঙ্গিত করেছিলাম। প্রাচীন বঙ্গদেশে একদিকে সপ্তম-অষ্টম শতাব্দী পূর্ববর্তী এবং অন্যদিকে তার পরবতী নগরগুলি সম্বন্ধে যে পার্থক্য বিদ্যমান তার দিকেও কিছুটা ইঙ্গিত করেছিলাম। সে-ইঙ্গিতের পশ্চাতে ছিল আমার মনে তদানীন্তন বাঙালী-সমাজের ধনোৎপাদন ও উদ্ধৃত্তি ধনের ভাবনা। কিন্তু, যে-ভাবে আমি নগর-বৃত্তান্ত বলেছিলাম তাতে আমার এই ভাবনা স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি; তা ছাড়া, লিপি-সাক্ষ্য ও কাব্য-সাক্ষ্য সম্বন্ধে আমার আরও সন্দিহান হওয়া উচিত ছিল।
ইতোমধ্যে ভারতবর্ষের নানা জায়গায় প্রত্ন-উৎখনন। বেশ কিছু হয়েছে, প্রধানত প্রাগৈতিহাসিক ও আদি-ঐতিহাসিক প্রত্নস্থানগুলিতে, কিন্তু স্বল্প হলেও ঐতিহাসিক কালের কিছু কিছু প্রাচীন নগরের প্রত্ন-উৎখননও হয়েছে, যেমন অহিচ্ছত্রায়, উজ্জ্বয়িনীতে, কৌশাম্বীতে। নগর-নির্মাণের ইতিহাস, অর্থনীতি, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি নিয়ে গবেষণা-বিশ্লেষণ-আলোচনাও কিছু হয়েছে, বিদেশে, ভারতবর্ষেও। এ-সবের প্রেক্ষাপটে কিছুদিন আগে আমি নিজেও কিছু বিশ্লেষণ-আলোচনা করেছিলাম, প্রধানত প্রত্নবিষ্কারের উপর নির্ভর করে, যেহেতু বাধ্য হয়ে আমি এ সিদ্ধান্তে আগেই পৌঁছেছিলাম যে, সাহিত্য-নির্ভর নগর-নির্মাণ-সাক্ষ্যের উপর পুরাপুরি বিশ্বাস স্থাপন করা বড় কঠিন। উজ্জ্বয়িনীর প্রত্নখননলব্ধ বৃত্তান্ত আর ‘মেঘদূত”-এ কালিদাসের উজ্জ্বয়িনী-বর্ণনার পার্থক্য দুস্তর; ঐতিহাসিকের পক্ষে এই দুস্তর ব্যবধান পার হওয়া বড়ই মুশকিল!
কিছুদিন আগে সদ্যকথিত আমার আলোচনা-বিশ্লেষণ সম্বলিত বিস্তৃত নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছে (“Rural-Urban Dichotomy in Indian Tradition and History,” in Annals of the Bhandarkar Oriental Research Institute, Golden Jubilee Volume, 1977-78, pp. 863 892)। সে নিবন্ধের বক্তব্য এখানে পুনরুল্লেখের কোনও প্রয়োজন নেই। তবে, সে-বক্তব্য অনুসরণ করে প্রাচীন বাঙলার নগরগুলি সম্বন্ধে সংক্ষেপে দু’চার কথা বলা যেতে পারে।
মোটামুটি দ্বিতীয় খ্ৰীষ্টােব্দ থেকে শুরু করে সপ্তম-অষ্টম শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাঙলার বাণিজ্যসমৃদ্ধি ভালই ছিল; বাণিজ্যলব্ধ উদ্ধৃত্তি ধনও ছিল। তাম্রলিপ্তি ও Ganges বা গঙ্গাবিন্দর নগর, পুঞ্জনগর, কোটীবর্ষ, পঞ্চনগরী, কর্ণসুবর্ণ, প্রভৃতি সমস্তই সপ্তম-অষ্টম শতক পূর্ববর্তী। এ-সমস্ত নগরই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল হয় বাণিজ্যিক কারণে না হয় রাষ্ট্রশাসনের প্রয়োজনে, কিন্তু যে-প্রয়োজনেই হোক, নগরগুলি নির্মিত হয়েছিল বাণিজ্যলব্ধ উদ্ধৃত্তি ধনে। তাম্রলিপ্তি, পুণ্ড্রনগর (মহাস্থান), কোটীবর্ষ (বাণগড়), চন্দ্ৰকেতুগড় (= Gange গঙ্গানগর?); প্রভৃতি স্থানের প্রত্নাবশেষই তার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রমাণ বহন করে। এসব জায়গার পোড়ামাটির যে-সব নিদর্শন ইত্যাদি পাওয়া গেছে তার মধ্যে নাগরিকতার ছাপ তো সুস্পষ্ট। গঙ্গাবিন্দরের বিলুপ্তি বোধ হয় কিছু আগেই ঘটে থাকবে; অষ্টম শতক থেকে তাম্রলিপ্তি বন্দর নগরের কথাও আর শোনা যাচ্ছে না। অন্য প্রকৃতির, প্রধানত রাজধানী বা রাষ্ট্রশাসনের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে নগরের কথা অবশ্যই শোনা যাচ্ছে, যেমন চন্দ্ররাজাদের রাজধানী সমতটান্তর্গত ক্ষীরোদানদী তীরবর্তী (বর্তমান কুমিল্লা শহরের অদূরে)। চণ্ডীমুড়া পাহাড়ের উপর দেবপর্বত, বিক্রমপুর (বজ্রযোগিনী-পাইকপাড়া-রামপাল), রামাবতী, লক্ষ্মণাবতী, বিজয়পুর, বিজয়নগর প্রভৃতি। কিন্তু এ-সব নগরের এমন কোনও প্রত্নাবশেষ আমাদের সামনে নেই যা থেকে এদের আকৃতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে সুস্পষ্ট ধারণা কিছু করা যেতে পারে। ঐতিহাসিকের বিস্ময় এই যে, পালসম্রাটদের মতো প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী রাজবংশেরও কেহ কোনও রাজধানী নির্মাণ করেননি, এমন কি ধর্মপাল-দেবপালও নন। জয়স্কন্ধাবার (military encampment) থেকেই তারা রাজকাৰ্য নির্বাহ করতেন; সেখান থেকেই তাদের যাবতীয় শাসননির্দেশ নিৰ্গত হত। তাদের ও চন্দ্র-বর্মণ-সেন রাজাদের ভূমিদানি পট্টোলীগুলিরও অধিকাংশই নিৰ্গত হয়েছিল “বিজয়স্কন্ধাবার” থেকে। এর কারণ কী? এ-পর্বের নগরগুলি কি ছিল গ্রামেরই বৃহত্তর, সমৃদ্ধতির সংস্করণ মাত্র? আকৃতিতে পার্থক্য ছিল নিশ্চয়ই কিন্তু প্রকৃতিতেও কি তা-ই ছিল? বোধ হয় তাই! একান্ত গ্রাম-নির্ভর কৃষিনির্ভর অর্থবিন্যস্ত সমাজে নগরের রূপ ও চরিত্র অন্য কিছু হবার কথা নয়।