মন্তব্য ও সংযোজন – রাষ্ট্রবিন্যাস
বিভিন্ন পর্বে বর্ণের সঙ্গে রাষ্ট্রের এবং শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধের বিস্তারিত আলোচনা অন্যত্র করা হইয়াছে। এখানে আর পুনরুক্তি করিব না। তবে, রাষ্ট্র-বিন্যাস সম্বন্ধেই সাধারণভাবে দুই চারিটি উক্তি হয়তো অবান্তর হইবে না।
দৃশ্যত, মহারাজা-মহারাজাধিরাজের ক্ষমতা, ও অধিকারের কোনও সীমা ছিল না; আঁহাদের রাজদণ্ডের প্রতাপ ছিল অব্যাহত, অপ্ৰতিহত। তিনি শুধু দণ্ডমুণ্ডের সর্বময় প্রভু নহেন, শুধু শাসন, সমর ও বিচার-ব্যাপারের কর্তা নহেন, সর্বপ্রকার দায় ও অধিকারের উৎসই তিনি। রাষ্ট্র-বিন্যাসগত ব্যাপারে অর্থশাস্ত্ৰ-দণ্ডশাস্ত্রোক্ত মতবাদের দিক হইতে এ-সম্বন্ধে কোনও আপত্তিই কেহ তোলে নাই; অস্তুত বাঙলার প্রাচীন রাজবৃত্তের ইতিহাসে তেমন কোনও প্রমাণ নাই। কিন্তু কার্যত রাজার ব্যক্তিগত ইচ্ছা বা সংস্কারের উপর কিছু কিছু বাধা-বন্ধন ছিলই, একেবারে পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী হইবার উপায় তাহার ছিল না। প্রথম বাধা-বন্ধন, মহামন্ত্রী এবং অপরাপর প্রধান প্রধান মন্ত্রীবর্গ। ইহাদের উপদেশ সর্বত্র সকল সময় না হউক, অন্তত অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানিতেই হইত। বাদল-প্রশস্তি কিংবা কর্মৌলি-লিপির বর্ণনায় কবিজনোচিত যত অতিশয়োক্তিই থাকুক না কেন, উহার পশ্চাতে খানিকটা ঐতিহাসিক সত্য লুক্কায়িত নাই, এমন বলা চলে না। সেন-আমল সম্বন্ধেও এই উক্তি প্রযোজ্য। আদিদেব, ভবদেব, হলায়ুধ ইত্যাদি ব্যক্তির ইচ্ছা ও মতামত অগ্রাহ্য করা কোনও রাজার পক্ষেই সম্ভব ছিল না। অন্যান্য মন্ত্রী, সভাপণ্ডিত যাহারা থাকিতেন তাঁহারাও রাজা এবং রাজপরিবারের অন্যান্য ব্যক্তির অন্যায়। আচরণের কতকটা বাধা স্বরূপ ছিলেন, সন্দেহ নাই। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি গোবর্ধন আচার্য সম্বন্ধে সেখ শুভোদয়া-গ্রন্থে একটি গল্প আছে। লক্ষ্মণসেনের এক শ্যালক—কুমারদত্ত-কামপরায়ণ হইয়া একবার এক বণিকবধূর উপর বলপ্রয়োগ করিয়াছিলেন। বণিকবধূ মন্ত্রীদের নিকট এই অত্যাচারের প্রতিকারের প্রার্থনা করিয়াছিলেন, কিন্তু তাহারা রাজমহিষীর এবং রাজ-শ্যালকের ক্ৰোধাভাজন হইতে সাহসী হন নাই, তবে বণিকবধূকে তাহারা লক্ষ্মণসেন সমীপে উপস্থিত করিয়া রাজার নিকট বিচার প্রার্থনা করিতে বলেন। রাজসভায় মন্ত্রী ও সভাসদ বর্গের সম্মুখে বণিকবধু মাধবীর বিবৃতি শেষ হইলে রাজমহিষী বল্লভা নিজের ভ্রাতাকে রক্ষা করিবার জন্য ভ্রাতার দোষ অপরের (কবি উমাপতিধরের) স্কন্ধে আরোপ করেন। লক্ষ্মণসেনকে মহিষী ও শ্যালক উভয় সম্বন্ধেই দুর্বলতাপরবশ হইয়া বিচারমর্যাদা রক্ষায় অনিচ্ছুক দেখিয়া ক্ষব্ধ বণিকবধু শ্লেষমিশ্রিত ভাষায় নিজের মনের ক্ষোভ ব্যক্ত করেন। মহিষী বল্লভা ক্রুদ্ধা হইয়া রাজসভার মধ্যেই মাধবীকে চুল ধরিয়া টানিয়া পদাঘাত করেন। তাহাতেও মহারাজকে অবিচলিত দেখিয়া সভায় উপস্থিত কবি গোবর্ধনাচার্যের ব্রাহ্মণ্য দৰ্প ও ন্যায়বোধ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠে; তিনি ক্রুদ্ধ প্ৰদীপ্ত কণ্ঠে মহারাজাধিরাজকে ভৎসৰ্না করিয়া মহিষীকে আঘাত করিতে যান, কিন্তু নিরস্ত হইয়া মহিষীকে ভৎসৰ্পনা এবং রাজাকে অভিশাপ দিয়া রাজসভা ছাড়িয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হন। তখন লক্ষ্মণসেন সিংহাসন ছাড়িয়া উঠিয়া আসিয়া ক্ষুব্ধ ক্রুদ্ধ ব্ৰাহ্মণ-কবির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাঁহাকে নিরস্ত করেন। নীরব মন্ত্রীদের লক্ষ করিয়া বণিকবধু মাধবী তখন বাক্যবাণ নিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। লজ্জায় ও ঘূণায় উৎপীড়িত লক্ষ্মণসেন তখন খড়গ লইয়া কুমারদত্তকে হত্যা করিতে যাইতেছেন, এমন সময় মাধবী মহারাজকে প্ৰণাম করিয়া বলিলেন, “মহারাজ, আপনার শ্যালক আমার হাত ধরিয়াছিল বলিয়া আমি মরিয়া যাই নাই, আমার জাতও যায় নাই। আমারই স্বকৰ্মফলে এই ঘটনা ঘটিয়াছে। আপনার আচরণে উহার অপরাধের প্রতিকার হইয়াছে, আপনি উহাকে ক্ষমা করুন।” মাধবীর কথা শুনিয়া সভাস্থ সকলে সাধুবাদ করিল। মহারাজ কুমারদত্তকে রাজ্য হইতে নির্বাসিত করিলেন।
গল্পটি অক্ষরে অক্ষরে সত্য না হইতে পারে, কিন্তু হইতেও কোনও বাধা নাই; কারণ, সমসাময়িক কালের প্রতিচ্ছবি এই গল্পে সুস্পষ্ট। তাহা ছাড়া বর্তমান প্রসঙ্গে, অর্থাৎ রাজার যথেচ্ছ বা দুর্বল আচরণের উপর সভাকবি ও পণ্ডিতদের বাধা-বন্ধনের দৃষ্টান্ত হিসাবেও ইহার মূল্য আছে। দ্বিতীয় মহীপাল মন্ত্রীদের শুভ পরামর্শে কর্ণপাত না করিয়া সামন্ত-চক্রের বিরোধিতা করিতে গিয়া নিজের প্রাণ ও বরেন্দ্রী উভয়ই হারাইয়াছিলেন।
আর এক বাধা-বন্ধনের কারণ ছিলেন সামন্ত-মহাসামন্তরা। বর্তমান নিবন্ধে এবং অন্যত্র বারবার ইহা বলিতে চেষ্টা করিয়াছি যে, অন্তত গুপ্ত আমল হইতে আরম্ভ করিয়া আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত বাঙলার, তথা সমগ্ৰ ভারতবর্ষের, রাষ্ট্র ও সমাজ-বিন্যাস একান্তই সামন্ততান্ত্রিক এবং সামস্ততান্ত্রিক রাষ্ট্রই একদিকে সমাজের শক্তি এবং অন্যদিকে দুর্বলতাও। বস্তুত, প্রাচীন ভারতের যে কোনো বৃহৎ রাজ্য বা সাম্রাজ্য। ১. কতকগুলি ক্ষুদ্রতর মিত্ররাজ্য, ২১ ক্ৰমসংকুচীয়মান। জনপদাধিকার এবং ক্ষমতার তারতম্য লইয়া স্তরে উপস্তরে বিভক্ত বহুতর সামন্ত-মহাসামন্ত এবং ৩ কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রের নিজস্ব জনপদভূমি—এই তিন প্রধান অঙ্গের সম্মিলিত রূপ। বাঙলাদেশের গুপ্ত, পাল বা সেনবংশের রাজ্য-সাম্রাজ্যেও, এমন কি ক্ষুদ্রতর চন্দ্র-বর্মণ-কম্বোঞ্জ-দেবরাজ্যেও এই রূপের কিছু ব্যতিক্রম নাই। এই সব মিত্র ও সামন্ত-মহারাজদের একেবারে অবজ্ঞা করিয়া চলা কোনও মহারাজের পক্ষেই সম্ভব ছিল না। রামপাল যখন কৈবর্ত ক্ষেীণীনায়ক ভীমের কবল হইতে বরেন্দ্রী পুনরুদ্ধারের আয়োজন করিতেছিলেন তখন সাহায্য ভিক্ষা করিয়া তাহাকে সামস্তদের দুয়ারে দুয়ারে প্রায় করজোড়ে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছিল, অর্থ ও রাজ্য লোভ দেখাইতে হইয়াছিল।
ঐতিহাসিক কালে বাঙলাদেশে—তথা ভারতবর্ষে –কোনও রাজ্যই দেখিতেছি না যিনি রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নূতন করিয়া গড়িতে বা নূতন ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন। কোনও রাজা বা রাজবংশ ব্যক্তিগত রুচি, প্রবৃত্তি ও সংস্কার দ্বারা রাষ্ট্র ও রাষ্ট্র-বিন্যাসকে প্রভাবান্বিত করিয়াছেন, এমন দৃষ্টান্ত একেবারে বিরল নয়, কিন্তু অর্থনীতি-দণ্ডনীতি বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা তাহাতে বদলাইয়া যায় নাই , মোটামুটি তাহা অপরিবর্তিতই থাকিয়া গিয়াছিল। রাজা, রাষ্ট্রদেহ, সমাজদেহ, ধর্ম, শিক্ষা, সংস্কৃতি সমস্ত কিছুরই ধারক, পোষক ও বর্ধক ছিলেন, সন্দেহ নাই, কিন্তু তাহাদের স্রষ্টা ছিলেন না। বরং তাঁহাকে চিরাচরিত সংস্কার, শাস্ত্রনির্দেশ, ধর্মনির্দেশ মানিয়া চলিতেই হইত; সাধারণত ইহার অন্যথা হইবার উপায় ছিল না। বৌদ্ধ পালরাজারাও বারবার এ-সম্বন্ধে আশ্বাস দিয়াছেন; তাঁহারা যে শাস্ত্রনির্দেশ, বর্ণ ও সমাজ-ব্যবস্থা, ধর্মনির্দেশ ইত্যাদি মানিয়া চলিয়াছেন বলিয়া একাধিকবার লিপিগুলিতে বলা হইয়াছে, তাহার ইঙ্গিত নিরর্থক নয়। শাসন-ব্যবস্থা যে মোটামুটি বিস্তৃত, সুবিন্যস্ত ও সুপরিচালিত ছিল, এ-সম্বন্ধে দুই একটি ইঙ্গিত প্রাচীন সাক্ষ্যে পাওয়া যায়। দীপঙ্কর-শ্ৰীজ্ঞান-অতীশ প্রসঙ্গে একটি কাহিনী তিব্বতী গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে; কাহিনীটি উল্লেখযোগ্য। নয়পালের রাজত্বকালে, আনুমানিক ১০৩০-৪০ খ্ৰীষ্ট শতকে কোনও সময়ে নগন্টচো বাঙলাদেশে আসিতেছিলেন, দীপঙ্করকে সঙ্গে করিয়া তিব্বতে লইয়া যাইবার জন্য। বিক্রমশিলা-বিহারের অনতিদূরে গঙ্গাতীরে আসিয়া যখন তাঁহারা পৌঁছিলেন তখন সূর্য অস্ত গিয়াছে, যাত্রী বোঝাই খেয়ানৌকা ঘাট ছাড়িয়া নদী পাড়ি দিতে আরম্ভ করিয়াছে। দুই বিদেশী পথিক মাঝিকে ডাক দিয়া তাঁহাদের ঐ নৌকায়ই নদী পার করিয়া দিতে অনুরোধ করিলেন; কিন্তু বোঝাই নৌকায় মাঝি আর লোক লইতে অস্বীকার করিয়া বলিল, এখন আর সম্ভব নয়, পরে আবার সে, ফিরিয়া আসিবে। নৌকা চলিয়া গেল; এদিকে রাত্রি হইয়া আসিতেছে, অন্যতম পথিক বিনয়ধর মনে করিলেন, মাঝি নৌকা লইয়া আর ফিরিবে না। কিন্তু, বেশ খানিকক্ষণ পরে মাঝি নৌকা লইয়া ফিরিল; বিনয়ধর মাঝিকে বলিলেন, “আমি তো ভাবিয়াছিলাম, এত রাত্রে তুমি আর ফিরিয়া আসিবে না।” মাঝি উত্তর করিল, “আমাদের দেশে ধর্ম আছে, আমি যখন আপনাকে ফিরিয়া আসিব বলিয়া গিয়াছি, তখন অন্যথা কী করিয়া হইবে।” মাঝি বিনয়ধরকে পরামর্শ দিল, এতরাত্রে নদী পার হইয়া কাজ নাই, অদূরবর্তী বিহারের দ্বারমঞ্চের নীচে রাত্রিবাস করাই যুক্তিযুও”, সেখানে চোরের উপদ্রব নাই।
খেয়া পারাবার-বিভাগের কর্তার নাম পাল-লিপিমালায় পাইতেছি ‘তরিক; তাহার বিভাগের সুশাসনের একটু ইঙ্গিত এই গল্পে ধরিতে পারা যায়।
কিন্তু উপরোক্ত গল্প হইতে মনে করিবার প্রয়োজন নাই যে, সমস্ত রাজপুরুষরাই কর্তব্য ও নীতিপরায়ণ ছিলেন। বিষয়পতিরা যে মাঝে মাঝে লোভী হইয়া অত্যাচারী হইতেন, প্রজাসাধারণকে উৎপীড়ন করিতেন তাহার একটু পরোক্ষ ইঙ্গিত পাইতেছি সদুক্তিকর্ণামৃত ধূত একটি শ্লোকে। পল্লীবাসী কৃষিজীবী গৃহস্থের সুখ ও শান্তিলাভের চারিটি উপায়ের মধ্যে একটি উপায় বিষয়পতির (সাধারণ ভাবে, স্থানীয় শাসনকর্তার) লোভহীনতা। নিম্নের শ্লোকটির রচয়িতা হইতেছেন কবি শুভাঙ্ক।
বিষয়পতিরলক্কো ধেনুভির্ধাম পুতং
কতিচিন্দভিমতায়াং সীমি সীরা বহন্তি।
শিথিলয়তি চ ভাৰ্য নাতিথেয়ী সপর্যাম
ইতি সুকৃতমানেন বাঞ্জিতং নঃ ফলেন ৷।
অন্যান্য রাজপুরুষেরাও জনপদবাসীদের উপর নানাভাবে উৎপীড়ন করিতেন। এই সব নানা জাতীয় পীড়ার উল্লেখ প্রতিবাসী কামরূপের সমসাময়িক লিপিতে কিছু কিছু পাওয়া যায়। বাঙলার ভূমি দান-বিক্রয় সম্পর্কিত লিপিগুলিতেও “পরিহািত-সর্বপীড়া” পদটির উল্লেখ আছে। অর্থাৎ, ভূমি যখন দান করা হইতেছে তখন দানকর্তা দানগ্রহীতাকে উল্লিখিত ‘সর্বপীড়া’ হইতে মুক্তি দিতেছেন। ইঙ্গিতটা এই যে, সাধারণত সকল প্রজাদেরই এই সব পীড়া বা উৎপীড়ন অল্পবিস্তর ভোগ করিতে হইত। চাটভাট প্রভৃতি “উপদ্রককারীদের” সংখ্যাও কম ছিল না। অন্যত্র (ভূমি-বিন্যাস অধ্যায় দ্রষ্টব্য) সবিস্তারে ইহাদের উল্লেখ করিয়াছি। রাষ্ট্রকে দেয় কর-উপকরও কম ছিল না; সম্পন্ন ও বিত্তবান গৃহস্থদের পক্ষে এই সব কর-উপকর দেওয়া ক্লেশকর ছিল না, এরূপ অনুমান করা যায়; কিন্তু সমাজের অর্থনৈতিক নিম্ন শ্রেণীর পক্ষে করভার একটু বেশিই ছিল বই কি? বিভিন্ন প্রকারের কারের তালিকা হইতে তো তাঁহাই মনে হয়। তাহা ছাড়া, রাজপুরুষেরা নানা প্রকারের পুরস্কার-উপহার গ্রহণ করিতেন—অর্থে, ফলে, শস্যে এবং অন্যান্য দ্রব্যে।
পাল ও সেন-আমলের ভূমি ও কৃষিনির্ভর রাষ্ট্র ও সমাজে ভূমিবান মহত্তর, কুটুম্ব-সাধারণ গৃহস্থদের অবস্থা মোটামুটি স্বচ্ছল ছিল বলিয়াই মনে হয়; কিন্তু, বৃহৎ ভূমিহীন গৃহস্থ এবং সমাজ-শ্রমিক গোষ্ঠীর আর্থিক অবস্থা যে খুব স্বচ্ছল ছিল, এমন মনে হয় না। যে দুঃখ-দারিদ্র্যের চেহারা শ্রেণীবিভক্ত সমাজের নিম্নতম স্তরে, “বাঙলার পল্লীগ্রামে, শহরের দুঃস্থ পল্লীতে আজও দৃষ্টিগোচর হয় তাহা তখনও ছিল। চর্যাগীতিতে (দশম-দ্বাদশ শতক) ঢ়েণঢণপাদের একটি গীতিতে আছে :
টালিটে মোর ঘর নাহি পড়িবেশী
হাঁড়ীতে ভাত নাহি নিতি আবেশী ৷।
বেঙ্গ সংসার বড়হিল জা অ।
দুহিল দুধু কি বেণ্টে সমাঅ ।৷ (হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর পাঠ)
ইহার গূঢ় গুহ্য ব্যাখ্যা যাহাই হউক, বস্তুগত, ইহগত ব্যাখ্যা এইরূপ : টিলাতে আমার ঘর, প্রতিবেশী নাই। ইয়াড়িতে ভাত নাই; নিত্যই ক্ষুধিত। (অথচ আমার) ব্যাঙ-এর সংসার বাড়িয়াই চলিয়াছে (ব্যাঙের যেমন অসংখ্য ব্যাঙচি বা সন্তান আমারও সন্তান তেমনই বাড়িয়া যাইতেছে); দোহা দুধ আবার বাটে ঢুকিয়া যাইতেছে (অর্থাৎ, যে—খাদ্য প্রায় প্রস্তুত তাহাও নিরুদ্দেশ হইয়া যাইতেছে)।
কিন্তু, দারিদ্র্যের আরও নিষ্কারুণ বৰ্ণনা পাওয়া যায় সদুক্তিকর্ণামৃতদৃত নিম্নোক্ত তিনটি শ্লোকে। তিনটিই বাঙালী কবির রচনা; বাঙলাদেশের দারিদ্র্যের ধূসর চিত্র। প্রথম শ্লোকটি অজ্ঞাতনামা এক কবির।।
ক্ষুৎকামা শিশবঃ শবাইব তনুমন্দাদরো বান্ধবো
লিপ্ত জর্জর কর্করী জললবৈনোমাং তথা বাধতে।
গেহিন্যাঃ ফুটিতাংশুকং ঘাটয়িতুং কৃত্বা সকাকুস্মিতং
কুপান্তী প্রতিবেশিনী প্রতিমুহুঃ সূচীং যথা যাচিত ৷।
শিশুরা ক্ষুধায় পীড়িত, দেহ শবের মত শীর্ণ, বান্ধবেরা গ্ৰীতিহীন, পুরাতন জীর্ণ জলপাত্রে স্বল্পমাত্রা জল ধরে-এ সকলও আমায় তেমন কষ্ট দেয় নাই, যেমন দিয়াছিল যখন দেখিয়াছিলাম। আমার গৃহিণী করুণ হাসি হাসিয়া ছিন্ন বস্ত্র সেলাই করিবার জন্য কুপিত প্রতিবেশিনীর নিকট হইতে সূচ চাহিতেছেন।
দারিদ্র্যের এই বাস্তব কাব্যময় চিত্ৰ সাহিত্যে সত্যই দুর্লভ। অথচ, ইহার ঐতিহাসিক সভ্যতা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। সমসাময়িক আর একটি অনুরূপ বাস্তব অথচ কাব্যময় চিত্র আঁকিয়া গিয়াছেন কবি বার। এই চিত্র আরও নির্মম, আরও নিষ্কারুণ।
বৈরাগ্যৈকসমুন্নতা তনুতনুঃ শীর্ণস্বরং বিভ্রতী
ক্ষুৎক্ষামেক্ষণ কুক্ষিভিশ্চ শিশুভির্ভোণ্ডুংসমূভার্থিতা।
দীনা দুঃস্থ কুটুম্বিনী পরিগলদবাষ্পায়ূধৌতাননা–
প্যেকং তণ্ডুলমানকং দিনশতকং নেতুং সমাকাঙক্ষতি ৷।
বৈরাগ্যে (আনন্দহীনতায়?) তাহার সমুন্নত দেহ শীর্ণ, পরিধানে জীর্ণবস্ত্র; ক্ষুধায় শিশুদের চক্ষু কুক্ষিগত হইয়া এবং উদর বসিয়া গিয়াছে; তাহারা আকুল হইয়া খাদ্য চাহিতেছে। দীনা দুঃস্থ গৃহিণী চোখের জলে মুখ ভাসাইয়া প্রার্থনা করিতেছেন, এক মান তণ্ডুলে যেন তাহাদের একশত দিন চলিতে পারে।
আরও একটি কাব্যময় অথচ বস্তৃগর্ভ বর্ণনা রাখিয়া গিয়াছেন কবি বার। এই শ্লোকটিও সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্ৰন্থ হইতেই উদ্ধৃত করিতেছি।
চলৎকাষ্ঠং গলৎকুড়মুক্তানতৃণসঞ্চয়ম।
গণ্ডুপদার্থিমণ্ডুকাকীর্ণং জীর্ণং গৃহং মম ৷।
কাঠের খুঁটি নড়িতেছে, মাটির দেয়াল গালিয়া পড়িতেছে, চালের খড় উড়িয়া যাইতেছে; কেঁচোর সন্ধানে নিরত ধ্যাঙের দ্বারা আমার জীর্ণ গৃহ আকীর্ণ।
সমাজের এই দারিদ্র্য, এই দুঃখ দৈন্য সম্বন্ধে রাষ্ট্র যথেষ্ট সচেতন ছিল বলিয়া মনে হয় না।
অথবা শ্রেণীবিন্যস্ত, ব্যক্তিগত অধিকার নির্ভর, সামন্ততন্ত্র ও আমলাতন্ত্র ভারগ্রস্ত, একান্ত ভূমি ও কৃষিনির্ভর সমাজের ইহাই হয়তো সামাজিক প্রকৃতি!
সেনরাজ বিজয়সেনের প্রশস্তি গাহিয়া কবি উমাপতিধর বলিতেছেন। “-ভিক্ষা-ভুজেস্যাক্ষয়ং লক্ষ্মীং স ব্যািতনোদরিদ্র-ভরণে সুজ্ঞো হি সেনান্বিয়”, অর্থাৎ “[বিজয়সেনের কৃপায়] ভিক্ষাই ছিল যাহার উপজীব্য সে হইয়াছে লক্ষ্মীর অধিকারী। কী করিয়া দরিদ্রের ভরণপোষণ করিতে হয় সেনবিংশ তাহা ভালই জানে”। ব্যক্তিগতভাবে রাজারা দান-ধ্যান করিতেন, পাত্ৰাপাত্র বিবেচনা করিয়া কৃপাবৰ্ষণও করিতেন, সন্দেহ নাই; উমাপতিধরও সে কৃপালাভ করিয়াছিলেন এবং লক্ষ্মীর প্রিয়পাত্ৰ হুইয়াছিলেন। কিন্তু রাষ্ট্র জনসাধারণের দুঃখ-দারিদ্র্য দূর করা সম্বন্ধে বা দুঃস্থপীড়িতদের সম্বন্ধে কোনও দায়িত্ব স্বীকার করিত বলিয়া মনে হয় না। অন্তত চর্যাগীতি ও সদুক্তিকর্ণামৃত-গ্রন্থের শ্লোকগুলিতে যে ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে তাহাতে এই স্বীকৃতির ইঙ্গিত নাই।
সংযোজন
এ-অধ্যায়ে সংযোজন করবার মতো নূতন তথ্য তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। নূতন দু’একটি রাজপুরুষের নাম এখানে সেখানে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তা এমন কিছু অর্থবহ নয়। একটি নাম আমার একটু কৌতুহলোদ্দীপক মনে হয়েছে; সেটি উল্লেখ করছি। চন্দ্ৰবংশী রাজা শ্ৰীচন্দ্রের (দশম শতাব্দী) পশ্চিমভাগ পট্টোলীতে পাদমূলক নামে একটি রাজপুরুষের উল্লেখ আছে। দীনেশচন্দ্র সরকার মশায় মনে করেন, পাদমূলক হচ্ছেন একান্ত সচিব বা Private Secretary। আমার মনে হয় দীনেশবাবুর অনুমান-অনুবাদ যথাৰ্থ। যদি তা হয় তাহলে আমাদের সমসাময়িক শাসক-কর্তৃপক্ষ শব্দটিকে কাজে লাগাতে পারেন। (Epigraphic Discoveries in East Pakistan by D. C. Sirkar, Sanskrit College, Calcutta, 1973, p. 30)।