ভূমির উপস্বত্ব, কর, উপরিকর ইত্যাদি
সপ্তশতকপূর্ব লিপিগুলির কোনও কোনওটিতে আমরা ভূমি-দানের অন্যান্য শর্তের মধ্যে একটি শর্ত দেখিয়াছি, “সমুদয়বাহ্যাপ্রতিকর” অথবা “সমুদয়বাহ্যাদি…অকিঞ্চিৎপ্রতিকর”, অর্থাৎ রাজা ভূমি দান করিতেছেন কেবল তখনই, যখন তিনি তাহা সকল প্রকারের কর বিবর্জিত করিয়া দিতেছেন; তাহা না হইলে মূল্য লইয়া যে ভূমি বিক্রয় করিতেছেন, তাহাই দান করিতেছেন। বলিয়া উল্লেখের আর কোনও অর্থ হয় না। যাহা হউক, রাজা যখন ভূমি-কর বিবর্জিত করিতেছেন, তখন রাজা দান ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রেই ভূমির ভোক্তাদের নিকট হইতে কর গ্ৰহণ করিতেন, ইহা তো প্রায় স্বতঃসিদ্ধ, এবং এই কর যে নানা প্রকারের ছিল, তাহার ইঙ্গিতও “সমুদয়বাহা” এই কথার মধ্যে প্রচ্ছন্ন। কর্ষণযোগ্য ও কৃষ্ট ভূমির কর ছিল, বাস্তুভূমিরও ছিল, কিন্তু খিল অর্থাৎ কর্ষণের অযোগ্য ভূমির বোধ হয় কোনও কর ছিল না, এই ধরনের ইঙ্গিত আমি আগেই করিয়াছি। বৈদ্যদেবের কমৌলি লিপিতে তাহার প্রমাণও আছে। কর কত প্রকারের ছিল, কী কী ছিল, তাহা এই যুগের লিপিগুলি হইতে জানিবার উপায় নাই, তবে উৎপন্ন শস্যের এক-ষষ্ঠ ভাগ যে বাষ্ট্রের প্রধান প্রাপ্য ছিল, এ সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ নাই। পাহাড়পুর ও বৈগ্রাম লিপিতে পরিষ্কার বলা হইয়াছে, কোনও ব্যক্তিবিশেষ যদি রাজার নিকট হইতে ভূমি ক্রয় করিয়া ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে সেই ভূমি দান করেন, তাহা হইলে রাজা শুধু যে ভূমির মূল্যটুকুই লাভ করেন তাহা নয়, ক্রেতা ভূমিদানের ফলস্বরূপ যে পুণ্য লাভ করেন, দত্ত ভূমি সর্বপ্রকার কর বিবর্জিত করিয়া দেওয়াতে রাজা সেই পুণ্যের এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকারী হন। অর্থাৎ, সেই ভূমির উপস্বত্বের এক-ষষ্ঠ ভাগ যে রাজার তাহা এই উল্লেখের মধ্যে সুস্পষ্ট। ধর্মদিত্যের ১নং পট্টোলীতে এই কথা আরও স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে। অন্যান্য করা যাহা ছিল তাহার দু-একটি অনুমান করা যাইতে পারে। যে ভূমি বিক্রয় করা হইতেছে এবং পরে ক্রেতা দান করিতেছেন, তাহা অনেক ক্ষেত্রেই লবণাকর, খেয়া পারাপার ঘাট, হাটবাজার, অরণ্য ইত্যাদি সংবলিত। এগুলির উল্লেখ নিরর্থক নয়। কৌটিল্য ও অন্যান্য অর্থশাস্ত্রকারদের মতে লবণ, অরণ্য ইত্যাদিতে রাষ্ট্রের একচেটিয়া অধিকার ছিল এবং তাহা হইতে রাজার তথা রাষ্ট্রের নিয়মিত আয় ছিল; এইসব যাহারা ভোগ করিতেন, রাজসরকারে তাহাদের কর দিতে হইত। হাটবাজার, খেয়াঘাট হইতেও একপ্রকারের রাজস্ব আদায় হইত, জনসাধারণকেই এই কারভার বহন করিতে হইত। রাজা যেখানে ভূমি দান করিতেছেন, এইসব আয়ের স্বাৰ্থ ত্যাগ করিয়াই দান করিতেছেন; অর্থাৎ, প্রতিপক্ষে ইহাই প্রমাণিত হয় যে, উৎপাদিত শস্যের এক-ষষ্ঠাংশ ছাড়া অন্যপ্রকারের করও ছিল এবং পূর্বোক্ত করাগুলি তাহাদের মধ্যে অন্যতম।
রাজা যখন ভূমি দান করিলেন, তখন তিনি সর্বপ্রকার করা বিবর্জিত করিয়াই দান করিলেন; তাহার অর্থ এই যে, যিনি বা যে প্রতিষ্ঠান এই দান গ্রহণ করিলেন, তিনি বা সেই প্রতিষ্ঠান সেই ভূমির সকল প্রকারের উপস্বত্ব ভোগ করবেন। নিম্নপ্রজা যদি কেহ সেই ভূমি ভোগ করেন, তাহা হইলে তিনি দানগ্রহীতা ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে সর্বপ্রকার কর, উৎপাদিত শস্যের ভাগ ইত্যাদি নিয়মিতভাবে প্রদান করিবেন, রাজা বা রাষ্ট্রকে নয়। ইহা ছাড়া রাজার ভূমিদানের কোনও অন্য অর্থ হইতে পারে না। এই কথাটা পরবর্তী কালের লিপিগুলিতে খুব স্পষ্ট করিয়া বলা হইয়াছে।
ভূমির উপস্বত্ব সম্বন্ধে উপরে যাহা বলিয়াছি, তাহার প্রত্যেকটি কথারই সবিস্তার সমর্থন * পাওয়া যাইতেছে। পরবর্তী কালের লিপিগুলিতে। প্রথমেই দেখিতেছি, রাজা যখন ভূমি দান করিতেছেন, তখন সমস্ত রাজভাগভোগকরহিরণ্যপ্রত্যায়” স্বাৰ্থ ত্যাগ করিয়া দান করিতেছেন, অর্থাৎ দানগ্রহীতাকে এ-সব কিছুই রাষ্ট্রকে বা রাজাকে দিতে হইবে না, সুস্পষ্ট বলিয়া দিতেছেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই কথাও বলিয়া দিতেছেন যে, সেই ভূমির ক্ষেত্রকর ইত্যাদি অন্যান্য প্রকারের ভোক্ত যাহারা আছে বা হইবে, তাহারা যেন রাজাজ্ঞা শ্রবণ করিয়া বিধিমত যথােচিত করপিণ্ডকাদি এবং অন্যান্য সকল প্রকার প্রত্যয় দানগ্রহীতাকে অৰ্পণ করেন (“প্রতিবাসিভিঃ ক্ষেত্ৰকরৈশ্চাজ্ঞাশ্রবণবিধেয়ৈৰ্ভুত্বা সমুচিতকরপিণ্ডকাদিসর্বপ্রত্যায়োপনায়ঃ ১. কার্য – ইতি” — খালিমপুর লিপি)। রাজভোগ্য রাষ্ট্রকে দেয়। কয়েকটি উপস্বত্বের উল্লেখ এই লিপিগুলিতে পাওয়া যায়; ভাগ, ভোগ, কর, হিরণ্য। এই কথা কয়টির অর্থ জানা প্রয়োজন।
ভাগ ।৷ ভাগ বলিতে রাজার বা রাষ্ট্রের প্রাপ্য উৎপাদিত শস্যের ভাগ বুঝায়। ধর্মপালের খালিমপুর লিপিতে “ষষ্ঠাধিকৃত’ নামে একজন রাজপুরুষের উল্লেখ আছে; খুব সম্ভব, ইনিই রাজার প্রাপ্য এক-ষষ্ঠ ভাগ সংগ্ৰহ করিতেন। শুধু কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র বা অন্যান্য স্মৃতিগ্রন্থেই যে রাজার এই ষষ্ঠ ভাগ প্রাপ্তির উল্লেখ আছে, তাহাই নয়; আগেরকার লিপি-প্রমাণের মধ্যেও দেখিয়াছি, উৎপাদিত শস্যের এক-ষষ্ঠ ভাগই ছিল রাজার প্রাপ্য।
ভোগ ।৷ খুব সম্ভব, ফল ফুল কাঠ ইত্যাদি যে সব দ্রব্য মাঝে মাঝে রাজাকে তাহার ব্যক্তিগত ভোগের জন্য দেওয়া হইত, তাহারই নাম ছিল ভোগ। বাঙলাদেশের লিপিগুলিতে সর্বত্রই উল্লেখ আছে, ভূমিদানকালে তৎসংলগ্ন মহুয়া, আম, কঁঠাল, সুপারি, নারিকেল প্রভৃতি গাছ ও অন্যান্য ঝাটবিটপ ইত্যাদি সমস্তই সঙ্গে সঙ্গে দান করা হইত। তাহা হইতে এ অনুমান অসংগত নয় যে, এইসব ফল ফুল কাঠ বাঁশ হইতে একটা নিয়মিত আয়ের অংশ রাজার ভোগ্য ছিল।
কর ।। মুদ্রায় দেয় রাজস্ব অর্থে কর। অর্থশাস্ত্রে তিন প্রকার করের উল্লেখ” আছে। ১. রাজার প্রাপ্য শস্যভাগ ছাড়া নির্ধারিত কালে নিয়মিত ভাবে দেয় মুদ্রাকর; ২. আপৎকালে অথবা অত্যায়িক কালে দেয় মুদ্রাকর; ৩. বণিক ও ব্যবসায়ীদের লাভের উপর দেয় কর। প্রাচীন বাঙলায়ও বোধ হয়, এই তিন প্রকার করই প্রচলিত ছিল।
হিরণ্য ৷। হিরণ্য অর্থে স্বর্ণ। এই হিরণ্য সর্বদাই উল্লিখিত হইয়াছে ভাগ-ভোগ-করের সঙ্গে। কিন্তু ইহার সবিশেষ অৰ্থ বুঝিতে পারা কঠিন। কোনও কোনও পণ্ডিত অর্থ করিয়াছেন, রাজা সব শস্যের ভাগ গ্রহণ করিতেন না, তাহার বদলে গ্রহণ করিতেন মুদ্রা, সেই মুদ্রাই হিরণ্য। পূর্ববর্তী কালে কী হইত বলা কঠিন, কিন্তু সেনরাজাদের আমলে ভূমি রাজস্ব যে মুদ্রায় দিতে হইত, এ অনুমান বোধ হয় করা যায়, যদিও সে মুদ্রা যে কী বস্তু তাহা আমরা আজও জানি না।
উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু এই রাজস্বের ক্রম ও পরিমাণ জানিবার কোনও উপায় নাই লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর পট্টোলীতে দেখা যাইতেছে, দত্ত ভূমির প্রতি দ্রোণের আয় ছিল ১৫ পুরাণ। কিন্তু বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষৎ-লিপিতে দেখা যায়, একই জায়গায় সমপরিমাণ ভূমির আয় সমান ছিল না। কর্ষণযোগ্য ভূমির উৎপাদিত শস্যসম্পদের কমবেশির উপর আয়ের পরিমাণ নির্ভর করিত, এবং ইহা সহজেই অনুমেয় যে, ভূমির রাজস্বও সেই অনুযায়ীই নির্ধারিত হইত।
যাহাই হউক, ভাগ, ভোগ, কর ও হিরণ্য ছাড়া জনসাধারণকে অন্যান্য করাও দিতে হইত। এই জাতীয় সব করের উল্লেখ লিপিগুলিতে নাই। কিন্তু কয়েকটি সম্বন্ধে পরোক্ষ অনুমান সহজেই করা যায়। পাল ও সেন আমলের প্রায় প্রত্যেকটি লিপিতেই ‘সচৌরোদ্ধারণ কথাটির উল্লেখ আছে, অর্থাৎ দানগ্রহীতাকে যে সব সুবিধা ও ক্ষমতা দান করা হইত, তাহার মধ্যে চৌরোদ্ধারণ একটি! কথাটির অর্থ করা হইয়াছে এই মর্মে যে, অন্যান্য ক্ষমতার সহিত শান্তিরক্ষার ক্ষমতাও দানগ্রহীতাকে অৰ্পণ করা হইত। কেহ কেহ অর্থ করিয়াছেন, দানগ্রহীতাকে শান্তিরক্ষার জন্য অর্থাৎ চোর-ডাকাতের হাত হইতে রক্ষা করিবার জন্য কোনও প্রকার করা রাজাকে দিতে হইত না। শেষোক্ত অর্থটিই যেন সমীচীন মনে হয়।
আগেই দেখিয়াছি, ‘সঘট্ট সতর অর্থাৎ ঘাট, খেয়াপারাপার ঘাট ইত্যাদিসহ ভূমি দান করা: হইত। এই খেয়াপরাপর ঘাটের একটা রাজস্ব ছিল, এবং পরোক্ষভাবে জনসাধারণকে তাহা বহনও করিতে হইত। যে সব রাজকর্মচারী এই কর সংগ্ৰহ করিতেন এবং এইসব ঘাটের তত্ত্বাবধান করিতেন, তাহাদের নাম ছিল তারক অথবা তারপতি। হাট হইতেও এক প্রকারের রাজস্ব আদায় হইত; তাহা সংগ্রহ এবং হাটবাজারের তত্ত্বাবধান যিনি করিতেন, তাহার নাম ছিল হট্টপতি (ঈশ্বরঘোষের রামগঞ্জলিপি)। খালিমপুর এবং অন্যান্য আরও দুই একটি লিপিতে হাটের রাজস্বও যে দানগ্রহীতার প্রাপ্য, তাহার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। ধর্মপালের খালিমপুর-লিপিতে অন্যান্য করের সঙ্গে পিণ্ডক কথার উল্লেখ আছে। সম্ভবত এই পিণ্ডক এবং কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের পিণ্ডকর একই বস্তু। টীকাকার ভট্টস্বামী বলিতেছেন, সমগ্র গ্রামের উপর যে কর চাপানো হইত, তাহাই পিণ্ডকর ৷ বাট, গোবাট, গোচর ইত্যাদির উপরেও বোধ হয় নির্ধারিত হারে কর ছিল; ভূমিদানি যখন করা হইতেছে, তখন দানগ্রহীতা এ সমস্তই ভোগের অধিকার পাইতেছেন, অর্থাৎ নিম্ন প্রজাদের দেয় কর রাজার বদলে তিনিই ভোগ করিবার অধিকার পাইতেছেন। দশ প্রকার অপরাধের জন্যও প্রজাকে জরিমানা দিতে হইত, তাহাও একপ্রকারের রাজস্ব; আগেই সে কথা উল্লেখ করিয়াছি। উপরিকর নামে আর একটি করের উল্লেখ লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। এই কারটি যিনি সংগ্ৰহ করিতেন, তাহার বৃত্তি-নাম ছিল ঔপরিকারক; প্রতিবাসী কামরূপ রাজ্যের নওগাঁ-লিপি হইতে এ কথা জানা যায়, এবং তিনি যে রাষ্ট্রের অন্যতম কর্মচারী ছিলেন, তাহাও ঐ লিপিটিতে সুস্পষ্ট। উপরিকর বোধ হয়–additional tax, অর্থাৎ নিয়মিত করা ছাড়া সময়ে অসময়ে রাষ্ট্র যে-সব কর নির্ধারণ করিতেন, অথবা ভূমিরাজস্ব ছাড়া অন্যান্য যে সব অতিরিক্ত কর রাষ্ট্রকে দিতে হইত, তাহাই বোধ হয় উপরিকর। অথবা, নিম্নপ্রজাদের নিকট হইতে রাষ্ট্র যে সব কর সংগ্ৰহ করিতেন, তাহাও হইতে পারে। কেহ কেহ মনে করেন, অস্থায়ী প্রজাকে যে রাজস্ব দিতে হইত। তাহাই উপরিকর। যে ভাবেই হউক, এই উপরিকর রাষ্ট্রের প্রাপ্য ছিল, মধ্যস্বত্বাধিকারীর নয়, তাহা নওগাঁ লিপিটির সাক্ষ্য হইতেই সপ্রমাণ।