সেন-বর্মণ যুগ : বর্ণ বিন্যাসের চতুর্থ পর্ব
পাল-চন্দ্ররাষ্ট্রে ও তাহাদের কালে ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসেব আদর্শ ছিল উদার ও নমনীয়; কম্বোজ সেন-বৰ্মণ আমলে সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সক্রিয় সচেতন চেষ্টার ফলে সেই আদর্শ হইল সুদৃঢ়, অনমনীয় ও সুনিদিষ্ট। যে বর্ণ-বিন্যস্ত সমাজব্যবস্থা আজও বাংলাদেশে প্রচলিত ও স্বীকৃত তাহার ভিত্তি স্থাপিত হইল এই যুগে দেড় শতাব্দীর মধ্যে। বাংলার সমাজ ব্যবস্থার এই বিবর্তন প্রায় হাজার বৎসরের বাংলাদেশকে ভাঙ্গিয়া নৃতন করিয়া ঢালিয়া সাজাইয়াছে। কি করিয়া এই আমূল সংস্কার, এত বড় পরিবর্তন সাধিত হইল তাহা একে একে দেখা যাইতে পারে।
কম্বোজ-রাজবংশকে অবলম্বন করিয়াই এই বিবর্তনের সূচনা অনুসরণ করা যাইতে পারে। এই পার্বত্য কোমটি বোধ হয় বাংলা দেশে আসার পর আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি আশ্রয় করেন। প্রথম রাজা রাজ্যপাল ছিলেন ‘পরমসুগত’ অর্থাৎ বৌদ্ধ; কিন্তু তাঁহার পুত্র নারায়ণপাল হইলেন বাসুদেবের ভক্ত। নারায়ণপালের ছোট ভাই সম্রাট নয়পাল একবার নবমী দিবসে পূজাস্নান করিয়া শঙ্কর ভট্টারকের (শিবের) নামে জনৈক ব্রাহ্মণকে বর্ধমানভুক্তিতে কিছু ভূমি দান করেন। বৌদ্ধ রাজার বংশধরদের ব্রাহ্মণ্যধর্মের ছত্রছায়ায় আশ্রয় লইতে দেখিয়া স্পষ্টই বুঝা যায় সমাজচক্র কোন দিকে ঘুরিতেছে। পালবংশের শেষের দিকেও একই চিহ্ন সুস্পষ্ট। শেষ অধ্যায়ে পালরাষ্ট্রও এই ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের স্পর্শে আসিয়াছিল। পালবংশ ও পালরাষ্ট্রকে বিলুপ্ত করিয়া, সেনবংশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হইল; চন্দ্রবংশকে বিলুপ্ত করিয়া হইল বর্মনবংশের প্রতিষ্ঠা। যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র বিলুপ্ত হইল তাহারা উভয়ইে বাঙালী ও বৌদ্ধ, এবং যে দুটি বংশ ও রাষ্ট্র নূতন প্রতিষ্ঠিত হইল তাহারা উভয়েই ভিন প্রদেশাগত। উভয়েই অত্যন্ত নৈতিক ও গোঁড়া ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী। বাঙালীর সামাজিক ইতিহাসের দিক হইতে এই দু’টি তথ্যই অত্যন্ত গভীর ও ব্যাপক অর্থবহ।
সেন-রাজবংশ কর্ণাটাগত; তাঁহারা আগে ছিলেন ব্রাহ্মণ, পরে যোদ্ধবৃত্তি গ্রহণ করিয়া হইলেন ক্ষত্রিয়, এবং পরিচয় হইল ব্রহ্মক্ষত্র রূপে। বর্মণ-বংশ কলিঙ্গাগত বলিয়া অনুমিত, অন্ততঃ ভিন্ন প্রদেশী এবং দক্ষিণাগত, সন্দেহ নাই; এবং বর্ণহিসাবে ক্ষত্রিয়। দক্ষিণদেশ সাতবাহন এবং তৎপরবর্তী সালঙ্কায়ন, বৃহৎফলায়ন, আনন্দ, পল্লব, কদম্ব প্রভৃতি রাজবংশের সময় হইতেই নৈষ্ঠিক ব্রাহ্মণ্যধর্মের কেন্দ্র, যাগযজ্ঞহোম প্রভৃতি নানাপ্রকার ব্রাহ্মণ্য পূজানুষ্ঠানে গভীর বিশ্বাসী, এবং প্রচলিত বর্ণাশ্রমের উৎসাহী প্রতিপালক। দক্ষিণদেশের এই নিষ্ঠাপূৰ্ণ ব্রাহ্মণ্য সংস্কারের সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার লইয়া সেন ও বর্মণ রাজবংশ বাংলা দেশে আসিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত হইল। দেখিতে দেখিতে বাংলা দেশ যাগযজ্ঞহোমক্রিয়ার ধূমে ছাইয়া গেল, নদ-নদীর ঘাটগুলি বিচিত্র পুণ্যস্নানার্থীর মন্ত্রগুঞ্জরণে মুখরিত হইয়া উঠিল, ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীর পূজা, বিভিন্ন ব্রতানুষ্ঠান দ্রুত প্রসারিত হইল। সহজ স্বাভাবিক বিবর্তনের ধারায় এই দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয় নাই; পশ্চাতে ছিল রাষ্ট্রের ও রাজবংশের সক্রিয় উৎসাহ, অমোঘ ও সচেতন নির্দেশ। এই যুগের লিপিমালা, অসংখ্য পুরাণ, স্মৃতি, ব্যবহার ও জ্যোতিষগ্রন্থ ইত্যাদিই তাহার প্রমাণ।
ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের সূচনা
লিপি প্রমাণগুলিই আগে উল্লেখ করা যাইতে পারে। বমন-বংশ পরম বিষ্ণুভক্ত। এই রাজবংশের যে বংশাবলী ভোজবর্মণের বেলার লিপিতে পাওয়া যাইতেছে তাহার গোড়াতেই ঋষি অত্রি হইতে আরম্ভ করিয়া পৌরাণিক নামের ছড়াছড়ি, ইহাদেরই বংশে নাকি বৰ্মণ পরিবারের অভ্যুদয়। রাজা জাতবর্মণ অনেক দেশ বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যকেও পর্যুদস্ত করিয়াছিলেন বলিয়া দাবি করিয়াছেন। এই দিব্য যে বরেন্দ্রীর কৈবর্ত নায়ক দিব্য ইহা বহুদিন স্বীকৃত হইয়াছে। দিব্যর সৈন্য আক্রমণকালে জাতবর্মণকে নিশ্চয়ই উত্তরবঙ্গে অভিযান করিতে হইয়াছিল। এই অভিযানের একটু ক্ষীণ প্রতিধ্বনি বোধ হয় নালন্দার একটি লিপিতে পাওয়া যায়। সোমপুরের বৌদ্ধ মহাবিহার জাতবর্মণের সৈন্যরা পুড়াইয়া দিয়াছিল বলিয়া মনে হয়। “সোমপুরের একটি বৌদ্ধ ভিক্ষুর গৃহ যখন বঙ্গাল-সৈন্যরা পুড়াইয়া দিতেছিল, ভিক্ষুটি তখন বুদ্ধের চরণকমল আশ্রয় করিয়া পড়িয়াছিলেন; সেইখানে সেই অবস্থাতেই তিনি স্বৰ্গত হইলেন।” বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি বর্মণ-রাষ্ট্রের মনোভাব কিরূপ ছিল এই ঘটনা হইতে তাহার কিছু পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। শুধু মাত্র এই ঘটনাটি হইতেই এতটা অনুমান নিশ্চয়ই করা চলিত না; কিন্তু যুগ-মনোভাবটাই ছিল এইরূপ। পরবর্তী সাক্ষ্য হইতে ক্রমশঃ তাহা আরও সুস্পষ্ট হইবে। এই বৰ্মণ রাষ্ট্রেরই অন্যতম মন্ত্রী স্মার্ত ভট্ট ভবদেব অগস্ত্যের মত বৌদ্ধ-সমুদ্রকে গ্রাস করিয়াছিলেন, এবং পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের (বৌদ্ধদের নিশ্চয়ই, নাথপন্থীরাও বটে) যুক্তিতর্ক খণ্ডনে অতিশয় দক্ষ ছিলেন বলিয়া গর্ব অনুভব করিয়াছেন। সেই রাষ্ট্রের সৈন্যরা যুদ্ধব্যপদেশে বৌদ্ধবিহারও ধ্বংস করিবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়! জাতবর্মণের পরবর্তী রাজা সামলবর্মণের কুলজীগ্রন্থের রাজা শ্যামলবর্মণ; স্মরণ রাখা প্রয়োজন যে, এই শ্যামলবর্মণের নামের সঙ্গেই এবং অন্যমতে তাঁহারই পূর্ববর্তী রাজা হরিবর্মণের সঙ্গে কান্যকুব্জাগত বৈদিক ব্রাহ্মণদের শকুনসত্র যজ্ঞের কিংবদন্তী জড়িত। সামলবর্মণের পুত্র ভোজবর্মণ সাবর্ণ গোত্রীয়, ভৃগু-চ্যবন-আপ্লুবান-ঔব-জমদগ্নি প্রবর, বাজসনেয় চরণ এবং যজুৰ্বেদীয় কাণ্বশাখ, শান্ত্যাগারাধ্যক্ষ ব্রাহ্মণ রামদেবশর্মাকে পৌণ্ড্র ভুক্তিতে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। রামদেব শর্মার পূর্বপুরুষ মধ্যদেশ হইতে আসিয়া উত্তর-রাঢ়ার সিদ্ধলগ্রামে বসতি স্থাপন করিয়াছিলেন। সিদ্ধলগ্রামে সাবর্ণ গোত্রীয় ব্রাহ্মণদের বসতির কথা বর্মণ-রাজ হরিবর্মণ-দেবের মন্ত্রী ভট্ট ভবদেবের লিপিতেও দেখা যাইতেছে। এই লিপিতে সমসাময়িক কালের ভাবাদশ, সমাজ ও শিক্ষাদর্শ, বর্ণ-ব্যবস্থা ইত্যাদি সংক্রাস্ত অনেক খবর পাওয়া যায়। ভবদেবের মাতা সাঙ্গোক ছিলেন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের কন্যা। এই সময়ে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের “গাঞী”-পরিচয় বিভাগ সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্টরূপে প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিযাছে, এ সম্বন্ধে আর তাহা হইলে কোনও সন্দেহই রহিল না। ভবদেব সমসাময়িক কালের বাঙালী চিন্তানায়কদের অন্ততম; তিনি ব্রহ্মবিদ্যাবিদ্, সিদ্ধান্ত-তন্ত্র-গণিত-ফলসংহিতায় সুপণ্ডিত, হোরা শাস্ত্রের একটি গ্রন্থের লেখক, কুমারিলভট্টের মীমাংসা গ্রন্থের টীকাকার, স্মৃতিগ্রন্থের প্রখ্যাত লেখক, অর্থশাস্ত্র, আয়ুর্বেদ, আগমশাস্ত্র এবং অস্ত্রবেদেও তনি সুপণ্ডিত। রাঢ়দেশে তিনি একটি নারায়ণ মন্দির স্থাপন করিয়া তাহাতে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহের মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কুমারিলভট্টের তন্ত্রবাতিক নামক মীমাংসা গ্রন্থের ভবদেবকৃত তৌতাতিতমত-তিলক নামক টীকাগ্রন্থের পাণ্ডুলিপির কিছু অংশ আজও বর্তমান। তাঁহার কর্মানুষ্ঠান পদ্ধতি বা দশকর্মপদ্ধতি ও প্রায়শ্চিত্ত প্রকরণ নামক দুইখানি স্মৃতিগ্রন্থ আজ ও প্রচলিত। পরবর্তী বাঙালী স্মৃতি ও মীমাংসা লেখকের ভবদেবের উক্তি ও বিচার বারবার আলোচনা করিয়াছেন। বাঙালীর দৈনন্দিন ক্রিয়াকম, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু, শ্ৰাদ্ধ বিভিন্ন বর্ণের বিচিত্র স্তর উপস্তর বিভাগের সীমা উপসীমা, প্রত্যেকের পারস্পরিক আহার বিহার, বিবাহ ব্যাপারে নানা বিধি নিষেধ, এক কথায় সর্বপ্রকার সমাজকর্মের রীতিপদ্ধতি নিয়মবিধি সুনিদিষ্ট সূত্রে গ্রথিত হইয়া সমাজশাসনের একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক, পুরোহিত-তান্ত্রিক নির্দেশ এই সর্বপ্রথম দেখা দিল। ভবদেবভট্ট পালযুগের শেষ আমলের লোক; এই সময় হইতেই এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সমাজশাসনের সূচনা এবং ভবদেব ভট্টই তাহার আদি গুরু। বর্মণরাষ্ট্রকে অবলম্বন করিয়াই এই ব্রাহ্মণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রসারিত হইতে আরম্ভ করিল। ভূমি প্রস্তুত হইয়াই ছিল; রাষ্ট্রের সহায়তা এবং সক্রিয় সমর্থন পাইয়া সেই ভূমিতে এই শাসন প্রতিষ্ঠালাভ করিতে বিলম্ব হইল না। এই শাসনের প্রথম কেন্দ্রস্থল হইল একদিকে রাঢ়দেশ, আর একদিকে বিক্রমপুর।
বর্মণরাষ্ট্রে যাহার সুচনা সেনবাষ্ট্রে তাহার প্রতিষ্ঠা। ব্রাহ্মণ্য সমাজ এই সময় হইতেই আত্মসংরক্ষণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য যেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ও দৃঢ়কম হইয়া উঠিল। এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তির একটা কারণ অনুমান করা কঠিন নয়। আগে দেখিয়াছি, ভবদেব ভট্ট বৌদ্ধদের প্রতি মোটেই সন্তুষ্ট ছিলেন না; ইহাদের ও পাষণ্ডবৈতণ্ডিকদের বিরুদ্ধে ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি ভবদেবভট্টের রচনাতেই সুস্পষ্ট। সেন আমলে এই মনোবৃত্তি তীব্রতর হইয়া দেখা দিল। পাল আমলে বৌদ্ধ দেবদেবীব কিছু কিছু ব্রাহ্মণ্য দেবদেবীদের সঙ্গে মিশিয়া যাইতেছিলেন, এবং শেষোক্ত দেবদেবীরাও বৌদ্ধ ও শৈবতন্ত্রে স্থান পাইতেছিলেন। বৌদ্ধসাধনমালায় ব্রাহ্মণ্য মহাকাল ও গণপতির স্থান, বৌদ্ধতন্ত্রে ব্রাহ্মণ্য লিঙ্গ এবং শৈব দেবদেবীদের স্থানলাভ এই যুগেই ঘটিয়াছিল। তাহা ছাড়া, বৌদ্ধ-তান্ত্রিক বজ্রযান, মন্ত্রযান, কালচক্রযান, সহজযান ইত্যাদির আচারানুষ্ঠান, সাধনপদ্ধতি, সাধনাদশ প্রভৃতি ক্রমশঃ ব্রাহ্মণ্যধর্মের সাধনপদ্ধতি ও পূজানুষ্ঠান প্রভৃতিকে স্পর্শ করিতেছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রতিভূদের কাছে তাহা ভাল লাগিবার কথা নয়, বিশেষতঃ ভিন্নপ্রদেশাগত বর্মণ ও সেনারাষ্ট্রের প্রভূদের কাছে। বাংলাদেশের তন্ত্রধর্মের সমাজ-প্রকৃতি সম্বন্ধে তাহাদের জ্ঞানও খুব সুস্পষ্ট থাকিবার কথা নয়। যে-ভাবেই হউক, সেন আমলের ব্রাহ্মণ্য সমাজ এইখানেই হয়ত ভবিষ্যৎ বিপদের সম্ভাবনা, এবং সমসাময়িককালের ব্রাহ্মণ্যসমাজের সামাজিক নেতৃত্ব-হীনতার কারণ খুঁজিয়া পাইয়া থাকিবেন।
স্মৃতি ও ব্যবহার শাসনের বিস্তার
যাহাই হউক, ধর্মশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্র রচনাকে আশ্রয় করিয়াই ব্রাহ্মণ্যসমাজের এই সংরক্ষণী মনোবৃত্তি আত্মপ্রকাশ করিল। আদি ধর্মশাস্ত্র লেখক জিতেন্দ্রিয় ও বালকের কোনও রচনা আজ আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই; কিন্তু শুভাশুভকাল, প্রায়শ্চিত্ত, ব্যবহার ইত্যাদি সম্বন্ধে এই দুজনেরই মতামত আলোচনা করিয়াছেন জীমূতবাহন, শূলপাণি, রঘুনন্দন প্রভৃতি পরবর্তী বাঙালী স্মার্ত ও ধর্মশাস্ত্র লেখকেরা। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ পারিভদ্রীয় গাঞী মহামহোপাধ্যায় জীমূতবাহনও এই যুগেরই লোক, এবং তিনি সুবিখ্যাত ব্যবহার মাত্রিকা, দায়ভাগ এবং কালবিবেক গ্রন্থের রচয়িতা। কুলজীগ্রন্থের মতে পারিহাল শাণ্ডিল্য গোত্রীয় রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অন্যতম গাঞী। জীমূতবাহনের পরেই নাম করিতে হয় বল্লালসেনের গুরু, হারলতা এবং পিতৃ-দয়িতা গ্রন্থদ্বয়ের রচয়িতা অনিরুদ্ধভট্টের। তিনি শুধু মহামহোপাধ্যায় রাজগুরু ছিলেন না, সেনরাষ্ট্রের ধর্মাধ্যক্ষও ছিলেন। অনিরুদ্ধের বসতি ছিল বরেন্দ্রীর অন্তর্গত চম্পাহিটি গ্রামে, এবং তিনি চম্পাহিটি মহামহোপাধ্যায় আখ্যায় পরিচিত ছিলেন। কুলজীগ্রন্থের মতে চম্পটি শাণ্ডিল্য গোত্রীয় বারেন্দ্র গাঞীদের অন্যতম গাঞী। অনিরুদ্ধশিষ্য রাজা বল্লালসেন স্বয়ং একাধিক স্মৃতিগ্রন্থের লেখক। তদ্রচিত আচারসাগর ও প্রতিষ্ঠাসাগর আজও অনাবিষ্কৃত; কিন্তু দানসাগর ও অদ্ভুতসাগর বিদ্যমান। দানসাগর তিনি রচনা করিয়াছিলেন গুরু অনিরুদ্ধের আদেশে; অসম্পূর্ণ অদ্ভুতসাগর পিতার আদেশে সম্পূর্ণ করিয়াছিলেন পুত্র লক্ষ্মণসেন। ছান্দোগ্য মন্ত্রভাষ্য রচয়িতা গুণবিষ্ণুও এই যুগের লোক। কিন্তু এই সব স্মৃতি-ব্যবহার-ধর্মশাস্ত্র রচয়িতাদের মধ্যে সব প্রধান হইতেছেন ধর্মাধ্যক্ষ ধনঞ্জয়ের পুত্র, লক্ষ্মণসেনের মহাধর্মাধ্যক্ষ হলায়ূধ। হলায়ূধের এক ভাই ঈশান আহ্নিকপদ্ধতি সম্বন্ধে একখানি গ্রন্থ এবং অপর ভ্রাতা পশুপতি দুইখানি গ্রন্থ রচনা করেন, একখানি শ্রাদ্ধপদ্ধতি এবং অন্য একখানি পাকযন্ত্র সম্বন্ধে। হলায়ূধ স্বয়ং সুবিখ্যাত ব্রাহ্মণ সর্বস্ব, মীমাংসা সর্বস্ব, বৈষ্ণব সর্বস্ব, শৈব সর্বস্ব এবং পণ্ডিত সর্বস্ব প্রভৃতি গ্রন্থের রচয়িতা। কিন্তু আর নামোল্লেখের প্রয়োজন নাই। এক কথায় বলা যাইতে পারে, যে ব্রাহ্মণ্য স্মৃতি ও ব্যবহার শাসন পরবর্তীকালে শূলপাণি-রঘুনন্দন কর্তৃক আলোচিত ও বিধিবদ্ধ হইয়া আজও বাংলাদেশে প্রচলিত তাহার সূচনা এই যুগে— বর্মণ ও সেনরাষ্ট্রের ছত্রছায়ায়। এই যুগে রচিত স্মৃতি-ব্যবহার গ্রন্থগুলিতে ব্রাহ্মণসমাজের সংরক্ষণী মনোবৃত্তি সুস্পষ্ট। দন্তধাবন, আচমন, স্নান, সন্ধ্যা, তর্পণ, আহ্নিক, যাগযজ্ঞ, হোম, পূজানুষ্ঠান, ক্রিয়াকর্মের শুভাশুভকালবিচার, অশৌচ, আচার, প্রায়শ্চিত্ত, বিচিত্র অপরাধ ও তাহার শাস্তি, কৃচ্ছ্র, তপস্যা, গর্ভধান-পুংসবন হইতে আরম্ভ করিয়া শ্রাদ্ধ পর্যন্ত সমস্ত ব্রাহ্মণ্য সংস্কার, উত্তরাধিকার, স্ত্রীধন, সম্পত্তি-বিভাগ, আহার বিহারের বিচিত্র বিধিনিষেধ, বিচিত্র দানের বিবৃতি, দান-কর্মের বিচিত্ৰতর বিধিনিষেধ, তিথিনক্ষত্রের ইঙ্গিত বিচার, দৈবিক, বায়ুবিক ও পার্থিব বিচিত্র উৎপাত, লক্ষ্মণাদির শুভাশুভ নির্ণয়, বেদ ও অন্যান্য শাস্ত্রপাঠের নিয়ম ও কাল—এক কথায় দ্বিজবর্ণের জীবনশাসনের কোনও নির্দেশই এইসব গ্রন্থ হইতে বাদ পড়ে নাই। সমাজের বিচিত্র স্তর ও উপস্তরের, বিচিত্ৰতর বর্ণ ও উপবর্ণের পারস্পরিক সম্বন্ধ নির্ণয়, বিশেষভাবে ব্রাহ্মণদের সঙ্গে তাহদের সম্বন্ধের অসংখ্য বিধি নিষেধও এইসব স্মৃতিকর্তাদের আলোচনার বিষয়। শুধু তাহাই নয়, ইহাদের নির্দেশ অমোঘ ও সুনির্দিষ্ট। এই যুগের স্মৃতি-শাসনই পরবর্তী বাংলার ব্রাহ্মণতন্ত্রের ভিত্তি।
ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক সেনরাষ্ট্র
রাষ্ট্রে এই একান্ত ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন সুস্পষ্ট। তাহা না হইবারও কারণ নাই, কারণ ভবদেবের বংশ, হলায়ূধের বংশ, অনিরুদ্ধ ইঁহারা তো সকলেই রাষ্ট্রেরই সৃষ্টি এবং সে রাষ্ট্রের নায়ক হরিবর্মণ, সামল (শ্যামল) বর্মণ, বল্লালসেন, লক্ষ্মণসেন। শেষোক্ত দুইজন তো নিজেরাই ভাবাদর্শে সমাজাদর্শে অনিরুদ্ধ-হলায়ূধের সমগোত্রীয, নিজেরাই স্মৃতিশাসনের রচয়িতা। তাহা ছাড়া, শান্ত্যাগারিক, শান্ত্যাগারিধিকৃত, শান্তিবারিক, পুরোহিত, মহাপুরোহিত, ব্রাহ্মণ-রাজপণ্ডিত, ইঁহারা রাজপুরুষ হিসাবে স্বীকৃত হইতেছেন এই যুগেই—কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রে। রাষ্ট্রে ইঁহাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়িতেছে, ইঁহারা রাষ্ট্রের অজস্র কৃপালাভ করিতেছেন, নানা উপলক্ষ্যে অপরিমিত ভূমিদান ইঁহারাই লাভ করিতেছেন। কাজেই রাষ্ট্রে ব্রাহ্মণ-তান্ত্রিক স্মৃতিশাসনের প্রতিফলন দেখা যাইবে, ইহা তো বিচিত্র নয়।
বিজয়সেন ও বল্লালসেন উভয়েই ছিলেন পরম মাহেশ্বর অর্থাৎ শৈব; লক্ষ্মণসেন কিন্তু পরম বৈষ্ণব এবং পরম নারসিংহ (অর্থাৎ বৈষ্ণব); লক্ষ্মণসেনের দুই পুত্র বিশ্বরূপ ও কেশব উভয়েই সৌর অর্থাৎ সূর্যভক্ত। সেন-বংশের আদিপুরুষ সামন্তসেন শেষ বয়সে গঙ্গাতীরস্থ আশ্রমে বানপ্রস্থে কাটাইয়া ছিলেন; এইসব আশ্রম-তপোবন ঋষিসন্ন্যাসী দ্বারা অধ্যুষিত এবং যজ্ঞাগ্নিসেবিতঘৃতধূমের সুগন্ধে পরিপূরিত থাকিত; সেখানে মৃগশিশুরা তপোবন-নারীদের স্তন্যদুগ্ধ পান করিত এবং শুকপাখীরা সমস্ত বেদ আবৃত্তি করিত! কবিকল্পনা সন্দেহ নাই, কিন্তু বস্তুসম্পর্কবিহীন কবি-কল্পনাও রাষ্ট্রের সমাজাদর্শকেই ব্যক্ত করিতেছে এবং প্রাচীন তপোবনাদর্শের দিকে সমাজের মনকে প্রলুব্ধ করিবার, সেই স্মৃতি জাগাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিতেছে, সে-বিষয়েও সন্দেহ নাই। সামন্তসেনের পৌত্র বিজয়সেন বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদের উপর এত রূপ বর্ষণ করিয়াছিলেন এবং সেই কৃপায় তাঁহারা এত ধনের অধিকারী হইযাছিলেন যে, তাহাদের পত্নীদিগকে নাগরিক রমণীরা মুক্তা, মরকত, মণি, রৌপ্য, রত্ন এবং কাঞ্চনের সঙ্গে কার্পাস বীজ, শাকপত্র, অলাবুপুষ্প, দাড়িম্ববীচি এবং কুষ্মাণ্ডলতপুষ্পের পার্থক্য শিক্ষা দিত। যজ্ঞকার্যে বিজয়সেনের কখনও কোনও ক্লান্তি ছিল না। একবার তাঁহার মহিষী মহাদেবী বিলাসদেবী চন্দ্র গ্রহণের সময়ে কনক-তুলাপুরুষ অনুষ্ঠানের হোমকার্যের দক্ষিণাস্বরূপ রত্নাকর দেবশর্মার প্রপৌত্র, রহস্কর দেবশর্মার পৌত্র, ভাস্কর দেবশর্মার পুত্র, মধ্যদেশাগত, বৎসগোত্রীয়, ভাগব-চ্যবনআপ্লুবান-ঔর্ব-জামদগ্ন্য প্রবর, ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়ন শাখার ষড়ঙ্গধ্যায়ী ব্রাহ্মণ উদয়কর দেবশর্মাকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বল্লালসেনের নৈহাটিলিপি আরম্ভ হইয়াছে অৰ্দ্ধনারীশ্বরকে বন্দনা করিয়া; তাঁহার মাতা বিলাসদেবী একবার সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে গঙ্গাতীরে হেমাশ্বমহাদান অনুষ্ঠানের দক্ষিণাস্বরূপ ভরদ্বাজ গোত্রীয়, ভরদ্বাজআঙ্গিরস-বার্হস্পত্য প্রবর, সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী ব্রাহ্মণ শ্রীওবাসুদেবশর্মাকে ভূমিদান করিয়াছিলেন। বল্লালসেন এই লিপি দ্বারা এই দান অনুমোদিত ও পট্টিকুত করেন। লক্ষ্মণসেনের আনুলিয়া লিপির ভূমিদানগ্রহীতা হইতেছেন কৌশিক গোত্রীয়, বিশ্বামিত্র-বন্ধুল-কৌশিক প্রবর, যজুর্বেদীয় কান্বশাখাধ্যায়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত রঘুদেব শর্মণ। লক্ষ্মণসেন যে অসংখ্য ব্রাহ্মণকে ধান্যশস্যপ্রসূ উপবনসমৃদ্ধ বহু গ্রামদান করিয়াছিলেন তাহাও এই লিপিতে উল্লিখিত আছে। এই রাজার গোবিন্দপুর পট্টোলির ভূমিদান গ্রহীতাও একজন ব্রাহ্মণ, উপাধ্যায় ব্যাসদেব শর্মণ—বৎসগোত্রীয় এবং সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী। এই ্ভূমিদান কার্য প্রথম করা হইয়াছিল লক্ষ্মণসেনের অভিষেক উপলক্ষে। সামবেদীয় কোঠমশাখাচরণানুষ্ঠায়ী, ভরদ্বাজ গোত্রীয় আর এক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণও কিছু ভূমিদান লাভ করিয়াছিলেন রাজা কর্তৃক হেমাশ্বরথমহাদান যজ্ঞাতুষ্ঠানে আচার্যক্রিয়ার দক্ষিণাস্বরূপ। এই ভূমির সীমানির্দেশ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে, পূর্বদিকে বৌদ্ধ বিহারদেবতার এক আঢ়বাপ নিষ্কর ভূমির পূর্ব সীমা আলি (বৌদ্ধবিহারী দেবতা নিকরদেয়ম্ মালভূম্যাটাবাপ-পূর্বালিঃ)। সেন বংশের লিপিমালার মধ্যে এই একটি মাত্র স্থানে বৌদ্ধধর্মের উল্লেখ পাওয়া গেল; বরেন্দ্রীতে তাহা হইলে দ্বাদশ শতকের শেষপাদেও বৌদ্ধধৰ্ম্মের প্রকাশ্য অস্তিত্ব ছিল। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর লিপি সর্বত্র সুম্পষ্ট ও সুপাঠ্য নয়; মনে হয় রাজা তাহার মূল অভিষেকের সময় ঐন্দ্ৰীমহাশান্তি যজ্ঞানুষ্ঠান উপলক্ষে কৌশিকগোত্রীয়, অথর্ববেদীয় পৈপ্পলাদশাখাধ্যায়ী শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণ গোবিন্দ দেবশর্মণকে যে ভূমিদান করিয়াছিলেন তাহাই এই শাসন দ্বারা অনুমোদিত ও পট্টিকৃত করা হইয়াছে। আর একবার এই রাজাই সূর্যগ্রহণ উপলক্ষে জনৈক কুবের নামীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। এই রাজার সুন্দরবন লিপিতেও কয়েকজন শান্ত্যাগারিক ব্রাহ্মণকে ভূমিদানের খবর পাওয়া যায়, যথা, প্রভাস, রামদেব, বিষ্ণুপাণি গড়োলী, কেশব গড়োলি এবং কৃষ্ণধর দেবশর্মা; ইঁহারা প্রত্যেকেই শান্ত্যাগারিক। শেষোক্তটি গার্গগোত্রীয় এবং ঋগ্বেদীয় আশ্বলায়নশাখাধ্যায়ী। লক্ষ্মণসেনের পুত্র কেশবসেন ধান্য শস্যক্ষেত্র ও অট্টালিকা পূর্ণ বহু প্রসিদ্ধ গ্রাম ব্রাহ্মণদের দান করিয়াছিলেন। তদনুষ্ঠিত যজ্ঞাগ্নির ধূম চারিদিকে এমন বিকীর্ণ হইত যেন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়া যাইত। তিনি একবার তাঁহার জন্মদিনে দীর্ঘজীবন কামনা করিয়া একটি গ্রাম বাৎস্যাগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ ঈশ্বরদেবশর্মণকে দান করিয়াছিলেন। লক্ষ্মণসেনের আর এক পুত্র বিশ্বরূপসেন শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফললাভের আকাঙ্ক্ষায় বাৎস্যগোত্রীয় নীতিপাঠক ব্রাহ্মণ বিশ্বরূপ দেবশমর্শকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। এই রাজারই অন্য আর একটি লিপিতে দেখিতেছি হলায়ূধ নামে বাৎস্যগোত্রীয় যজুর্বেদীয়, কান্বশাখাধ্যায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ আবল্লিক পণ্ডিত রাজপরিবারে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের প্রধান প্রধান রাজকর্মচারীদের নিকট হইতে প্রচুর ভূমিদান লাভ করিতেছেন— উত্তরায়ণ-সংক্রান্তি, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থানদ্বাদশীতিথি, জন্মতিথি ইত্যাদি বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে।
ত্রিপুরা-নোয়াখালি-চট্টগ্রাম অঞ্চলের দেববংশের লিপিগুলিতেও অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। এই রাজবংশ ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কারাশ্রয়ী এবং বিষ্ণুভক্ত। এই বংশের অন্যতম রাজা দামোদর একবার জনৈক যজুর্বেদীয় ব্রাহ্মণ পৃথ্বীধরশর্মণকে কিছু ভূমিদান করিয়াছিলেন। বোধ হয়, এই বংশেরই আর একজন রাজা, অরিরাজ দনুজমাধব শ্ৰীদশরথদেবের (= কুলজী গ্রন্থের দনুজমাধব = মুসলমান ঐতিহাসিকদের সোনারগাঁর রাজা, দনুজ রায়) আদাবাড়ী লিপি দ্বারা যে সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করা হইয়াছে তাহাদের গাঞী পরিচয় আছে; যথা, সন্ধ্যাকর, শ্রীমাক্রি (দিণ্ডী গাঞী), শ্রীশক্র, শ্রীসুগন্ধ (পালি গাঞী), শ্ৰীসোম (সিউ গাঞী), শ্ৰীবাদ্য (পালি গাঞী) শ্ৰীপণ্ডিত (মাসচটক গাঞী), শ্ৰীমাণ্ডী (মূল গাঞী), শ্রীরাম (দিণ্ডী গাঞী), শ্ৰীলেঘু (সেহন্দায়ী গাঞী), শ্ৰীদক্ষ (পুতি গাঞী), শ্ৰীভট্ট (সেউ-গাঞী,), শ্রীবালি (মহান্তিযাড়া গাঞী), শ্ৰীবাসুদেব (করঞ্জ গ্রামী), এবং শ্রীমিকো (মাসচড়ক গাঞী), ইত্যাদি। গাঞীপ্রথার প্রচলন ভবদেবভট্টের কালেই আমরা দেখিয়াছি; বোধ হয় তাহারও বহু পূর্বে গুপ্ত আমলেই এই প্রথা প্রবর্তিত হইয়া থাকিবে (গুপ্ত আমলের লিপিগুলিতে ভট্ট, বন্দ, চট্ট, প্রভৃতি ব্রাহ্মণ্য পদবী-পরিচয গাঞী-পরিচয় হওয়াই সম্ভব)। ত্রয়োদশ শতকে এই প্রথা একেবারে সুপ্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে। আদাবাড়ী লিপির গাঞী তালিকায় রাঢ়ীয় ও বারেন্দ্র উভয গাঞী পরিচয়ই মিলিতেছে।
বৌদ্ধধর্ম ও সংঘের প্রতি ব্রাহ্মণ-তন্ত্রের ব্যবহার
এই সুবিস্তৃত লিপি-সংবাদ হইতে কযেকটি তথ্য সুস্পষ্ট হইয়া দেখা দিতেছে। প্রথমত, বিভিন্ন বাষ্ট্রের ও রাজবংশের সুদীর্ঘ দানতালিকায় বৌদ্ধধৰ্ম্ম ও সংঘে একটি দানের উল্লেখও নাই। অথচ বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্ব তখনও ছিল, লক্ষ্মণসেনের তর্পণদীঘি লিপিতেই তাহার প্রমাণ আমরা দেখিয়াছি। তাহা ছাড়া রণবঙ্কমল্ল হরিকাল দেবের (১২২০) পট্টিকেরা লিপিও তাহার অন্যতম সাক্ষ্য; এই লিপিতে হরিকাল কর্তৃক পট্টিকেরা নগরের এক বৌদ্ধবিহারে একখণ্ড ভূমিদানের উল্লেখ আছে। এই লিপিতেই দুর্গোত্তারা নামক বৌদ্ধ দেবীমূর্তির এবং সহজধর্মেরও উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। (১) আরও প্রমাণ আছে। পঞ্চরক্ষা নামক মহাযানগ্রন্থের একটি পাণ্ডুলিপির পুষ্পিকা অংশে(২) “পরমেশ্বর পরমসৌগত-পরমমহারাজাধিরাজ শ্ৰীমন্ গৌড়েশ্বর-মধুসেন-দেবপাদানাং বিজয়রাজ্যে” উল্লেখ হইতে জানা যায় ১২১১ শকে (= ১২৮৯) মধুসেন নামক একজন বৌদ্ধ রাজা গৌড়ে রাজত্ব করিতেছিলেন। বর্মণরাষ্ট্রেও বৌদ্ধ মহাযান মতের অস্তিত্ব ছিল। “লঘু কালচক্র” নামক মহাযান গ্রন্থের “বিমলপ্রভা” নামীয় টীকার একটি পুঁথি লেখা হইয়াছিল হরিবর্মদেবের ৩৯ রাজ্যাঙ্কে, এবং ৪৬ রাজ্যাঙ্কে অর্থাৎ সাত বৎসর পর, “পূর্বোত্তর দিশাভাগে বেংগদ্যাস্তথা কূলে” গৌরী নামে একটি (বৌদ্ধ?) মহিলা স্বপ্নে আদিষ্ট হইয়াছিলেন গ্রন্থটি নিয়মিত বাচনের জন্য।(৩) এই বেংগ নদী, মনে হয়, যশোর কি ফরিদপুর জেলার কোনও নদী। এই অঞ্চলেই পঞ্চদশ শতকেও বৌদ্ধধর্মের অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায় ১৪৯২ সংবতের (= ১৪৩৬) মহাযান মতের বিখ্যাত গ্রন্থ বোধিচযাঁবতারের একটি অতুলিপি হইতে।(৪) পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের আমলে বৌদ্ধ রাজবংশের যে ঔদার্য ছিল সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের সে ঔদার্যের এতটুকু চিহ্ন কোথাও দেখা যাইতেছে না। কান্তিদেবের পিতা বৌদ্ধ ধনদত্ত একজন পরম শিবভক্ত রাজকুমারীকে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং নিজের সুভাষিত-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণে ব্যুৎপত্তির কথা বলিতে গিয়া গবর্ণনুভব করিয়াছিলেন। তাহার পুত্ৰ কান্তিদেব নিজে বৌদ্ধ হইয়াও তাঁহার রাজকীয় শীলমোহরে বৌদ্ধ পিতা ও শৈব মাতা উভয়ের ধর্মের সমন্বিত রূপ উদ্ভাবন করিয়াছিলেন। এই ধরণের বহু দৃষ্টান্ত আগেও উল্লেখ করিয়াছি। কিন্তু রাষ্ট্রের সামাজিক আদর্শের সেই উদারতার যুগ আর ছিল না। সেন-বর্মণদের আমলে এই ঔদার্যের এতটুকু দৃষ্টান্ত কোথাও নাই। দ্বিতীয়তঃ, সেন-বর্মণ-দেব রাষ্ট্র ও রাজবংশ বাংলার অতীত সামাজিক বিবর্তনের ধারা, বিশেষভাবে, গৌরবময় পাল-চন্দ্র যুগের ধারা, গতি প্রকৃতি ও আদর্শ একেবারে অস্বীকার করিয়া বৈদিক ও পৌরাণিক যুগ বাংলাদেশে পুনঃপ্রবর্তন করিতে চাহিয়া ছিলেন। রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ-কালিদাস-ভবভূতি যে প্রাচীন ব্রাহ্মণ্য আদর্শের কথা বলিয়াছেন সেই ব্রাহ্মণ্য আদর্শ সমাজ-জীবনে সঞ্চার করিবার প্রয়াস লিপিগুলিতে এবং সমসাময়িক সাহিত্যে সুস্পষ্ট।(৫) কনক-তুলাপুরুষ মহাদান, ঐন্দ্ৰীমহাশাস্তি, হেমাশ্বমহাদান, হেমাশ্বরথদান প্রভৃতি যাগযজ্ঞ; সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, উত্থান দ্বাদশীতিথি, উত্তরায়ণ সংক্রান্তি প্রভৃতি উপলক্ষে স্নান, তৰ্পণ, পূজানুষ্ঠান; শিবপুরাণোক্ত ভূমিদানের ফলাকাঙ্ক্ষা; বিভিন্ন বেদাধ্যায়ী ব্রাহ্মণের পুঙ্খানুপুঙ্খ উল্লেখ; গোত্র, প্রবর, গাঞী প্রভৃতির বিশদ বিস্তৃত পরিচয়োল্লেখ; দুর্বাতৃণ জলসিক্ত করিয়া দানকার্য সমাপন; নীতিপাঠক শান্ত্যাগারিক, প্রভৃতি ব্রাহ্মণদের উপর রাষ্ট্রের কৃপাবৰ্ষণ ইত্যাদির সামাজিক ইঙ্গিত অত্যন্ত সুস্পষ্ট—সে ইঙ্গিত পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য আদশের প্রচলন এবং পাল-চন্দ্র যুগের সমন্বয় ও সমীকরণাদশের বিলোপ। বিভিন্ন বর্ণ, বিভিন্ন ধর্মণদশের সহজ স্বাভাবিক বিবর্তিত সমন্বয় নয়, ঔদার্যময় বিন্যাস নয়, এক বর্ণ, এক ধর্ম ও সমাজাদশের একাধিপত্যই সেন-বৰ্মণ যুগের একতম কামনা ও আদর্শ। সে বর্ণ ব্রাহ্মণ বর্ণ। সে ধর্ম ব্রাহ্মণ্য ধর্ম। এবং সে সমাজাদর্শ পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য সমাজের আদর্শ। এই কালের স্মৃতি-ব্যবহার-মীমাংসা গ্রন্থে আগেই দেখিয়াছি ব্রাহ্মণ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শের জয়জয়কার; লিপিমালায়ও তাহাই দেখিলাম। সেই আদর্শই হইল সমাজ-ব্যবস্থার মাপকাঠি। রাষ্ট্রের শীর্ষে যাহারা আসীন সেই রাজার, এবং রাষ্ট্রের যাহারা প্রধানতম সমর্থক সেই ব্রাহ্মণের দুইয়ে মিলিয়া এই আদর্শ ও মাপকাঠি গড়িয়া তুলিলেন—পরস্পরের সহযোগীতায়, পোষকতায় ও সমর্থনে, এবং মূর্তিতে, মন্দিরে, রাজকীয় লিপিমালায়, স্মৃতি, ব্যবহার ও ধর্মশাস্ত্রে, সর্বথা সর্ব উপায়ে এই আদর্শ ও মাপকাঠি সবলে সোৎসাহে প্রচার করিলেন। পশ্চাতে যেখানে রাষ্ট্রের সমর্থন সেখানে এই প্রচার কার্য ও ঈপ্সিত সমাজ-ব্যবস্থার দ্রুত প্রচলন সার্থক হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়।
————
(১) IH Q. lX, 282 pp.
(২) Sastri H. P.-Cat of Mss. Nepal, I, 117 p, Mss. No, 4078.
(৩) Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal.
(৪) এই অনুলিপিটি প্রস্তুত করিয়াছিলেন সোহিথতরী গ্রামনিবাসী কুটুম্বিক উচ্চমহত্তম শ্ৰীমাধবমিত্রের পুত্ৰ মহত্তম স্ত্রীরামদেবের স্বার্থ-পরার্থের জন্য “সদ্বৌদ্ধ করণ কায়স্থ ঠকুর” শ্ৰীঅমিতাভ। কোন এক সময়ে পুঁথিখানা গুণকীর্তি “ভিক্ষুপাদানাং” অধিকারে ছিল। Sastri, H. P.–Cat. of Mss. Nepal.
(৫) এই যুগের ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রতিনিধি হলায়ূধ সন্দেহ নাই। তাঁহার “ব্রাহ্মণ সর্বস্বের” গোড়াতেই আত্মপ্রশস্তিমূলক কয়েকটি শ্লোক আছে, তাহার একটি এই :–
পাত্ৰং দারুময়ং ক্কচিদ্ বিজয়তে ক্কচিৎ ভাজনং
কুত্রাপ্যস্তি দুকূলমিন্দুধবলং কুত্রাপি কৃষ্ণাজিনম্।
ধূপঃ ক্বাপি বষট্কৃতাহুতিকৃতো ধূমঃ পরঃ ক্বাপ্যভূদ্
অগ্নে কর্মফলং চ তস্য যুগপজ্জাগতি ষন্মন্দিরে।।
[ হলযুধের নিজের গৃহে ] কোথায়ও কাঠের [ যজ্ঞ ] পাত্র [ ছড়াইয়া আছে ], কোথাও বা স্বর্ণপাত্র [ ইতাদি)। কোথাও ইন্দূধবল দুকুলবস্ত্র; কোথাও কৃষ্ণমৃগচৰ্ম্ম। কোথাও ধূপের [গন্ধময় ধূম] কোথাও বষট্কার ধ্বনিময় আহুতির ধূম। [ এইভাবে তাঁহার গৃহে ] অগ্নির এবং [তাঁহার নিজের ] কর্মফল যুগপৎ জাগ্রত।
ইহাই ব্রাহ্মণ্য সেন-রাষ্ট্রের ভাবপরিমণ্ডল। হলায়ূধ-গৃহের ভাবকল্পনাই সমসামরিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির ভাবকল্পনা।