মানবতার প্রতি প্ৰাচীন বাঙালীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ
যে হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার কথা এই মাত্র বলিলাম তাহারই রূপান্তরে পাইতেছি মানবতার প্রতি প্রাচীন বাঙালীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ। এই যে দেবদেবীদেরও মাটির ধূলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মধ্যে বাধিয়া তাহাদিগকে ইহগত মানবিক আবেগে দেখা ও পাওয়া, ইহার মধ্যে তো উষ্ণ মানবপ্রীতির আভাসই সুস্পষ্ট। সদুক্তিকর্ণামৃত, কবীন্দ্রবচনসমুচ্চয়, প্রাকৃতপৈঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থে বাঙালীকবিকুল রচিত হরিভক্তি, গঙ্গাস্তব, শিবস্তোত্র প্রভৃতি বিষয়ক যে-সব শ্লোক ইতস্তত বিক্ষিপ্ত এবং যাহাদের দুই-একটি এই গ্রন্থে উদ্ধার করিয়াছি তাহাদের বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগ একান্তই মানবিক রসে অভিসঞ্চিত। এই গ্রন্থগুলির বাঙালী কবি রচিত অসংখ্য প্রকীর্ণ শ্লোকে সাধারণ মানুষের সুখদুঃখের ও আনন্দবেদনার যে সূক্ষ্ম স্পর্শালু বোধ সুস্পষ্ট গোচর, চর্যাগীতির গুহ্য সংকেতময় অধ্যাত্ম পদগুলিতেও সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের নানা মানবী লীলার যে-পরিচয় তাহার মধ্যেও তো একই মানবিক আবেদন সমান প্রত্যক্ষ। পাহাড়পুর ও ময়নামতীর মৃৎফলকগুলি সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে, এবং কোনও কোনও প্রতিমা-ফলক সম্বন্ধেও। বাঙলার প্রতিমা-লক্ষণ শাস্ত্রশাসিত প্রতিমাশিল্পেও মানসিক ইন্দ্ৰিয়ালুতা এবং হৃদয়াবেগ যতটা ধরা পড়িয়াছে, এমন যেন আর কোথাও নয়। ধৰ্মগত এবং শাস্ত্রশাসিত ব্যাপারেও একান্ত মানবিক রসের সঞ্চার, মানবিক আবেগ ও আবেদনের অভিসিঞ্চন প্রাচীন বাঙলার সংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন ভারতের অন্যান্য প্রান্তের সুবিস্তৃত সংস্কৃত ও প্রাকৃত সাহিত্যের অনেক স্থানে এই ধরনের মানবিক আবেদন প্রত্যক্ষ, বিশেষ ভাবে মহাভারতের নানা কাহিনীতে, ভাস ও কালিদাসের রচনায়। কিন্তু প্ৰাচীন বাঙলার ধর্মকর্মে শিল্পে ও সাহিত্যে এই মানবিক আবেদন যতটা বিস্তৃত ও সুস্পষ্ট, সেখানে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ছোটখাট সুখদুঃখের প্রতিও গভীর অনুরাগ যে-ভাবে ধরা পড়িয়ছে, এমন আর কোথাও যেন নয়। বস্তুত, বাঙলার সাধনায় দেবতারা ধরা দিয়াছেন মানুষের বেশে, মানুষের মতো হইয়া; মানুষের মাপেই যেন দেবতার পরিমাপ। তাহার প্রমাণ এই গ্রন্থেই নানা স্থানে নানা সূত্রে সংগ্ৰহ করা হইয়াছে। মানবিকতার প্রতি বাঙালী চিত্তের এই আকর্ষণের আভাস প্রাচীন কালেই নানাদিকে সুস্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছিল।
মানবতার প্রতি সুগভীর শ্রদ্ধা ও অনুরাগ উপনিষদ্ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য। বৈষ্ণব ভাগবদ্ধর্মেও এই শ্রদ্ধা ও অনুরাগের ধারা বহমান। মহাভারতেও তাঁহাই; সেখানে তো স্পষ্টই বলা হইয়াছে, মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর জীব আর কেহ নাই। কিন্তু সাধারণ ভাবে ও সামগ্রিক দৃষ্টিতে আর্য ভারতের ধর্ম ও সংস্কৃতি সাধনায় সর্বশ্রেষ্ঠ জীব এই মানুষের স্থান প্রধানত গৌণ। দেবতা ও শাস্ত্র সেখানে মানুষের প্রায় সমস্ত চিত্ত জুড়িয়া বিস্তৃত। যাহাই হউক, বাঙলাদেশে মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এবং বাঙালীর ধর্ম ও অধ্যািত্মসাধনায় মহাভারতের বাণী যেন আবার নূতন করিয়া শোনা গেল এবং সাধক কবি চণ্ডীদাসের কণ্ঠে তাহা মূর্তিলাভ করিলা : ‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। কিন্তু চণ্ডীদাস বলিলেন সেই কথাই যাহা ছিল প্রাচীন বাঙালীর চিত্তের গভীরে, তাহার সাধনায়, বিশেষভাবে সহজযানী সিদ্ধাচার্যদের আদর্শ ও ভাবকল্পনায়। এই সিদ্ধাচার্যরা বর্ণ, শ্রেণী, ধর্ম ও আচারানুষ্ঠানের ভেদাভেদের উর্ধে মানুষের যে মানবমহিমা তাহার সুস্পষ্ট ঘোষণা জানাইয়াছেন। বেদ, বেদাঙ্গ, বেদান্ত, আগম কোনও কিছুরই অভ্রান্ততায় ইহারা বিশ্বাস করিতেন না। ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর, মহাযান, মন্ত্রযান, জৈনধর্ম, নাথধর্ম কোনও কিছুতেই ইহাদের শ্রদ্ধা ছিল না; যোগী-সন্ন্যাসীদের প্রতি ছিল ইহাদের নিদারুণ অবজ্ঞা! বৈরাগ্য ইহারা সাধন করিতেন না, বলিতেন বিরাগাপেক্ষা পাপ আর কিছু নাই, সুখ অপেক্ষা পুণ্য নাই। শরীরের মধ্যেই অশরীরীর গুপ্তলীলা, এই মানবদেহেই মোক্ষের বাস, মানুষই সকল সাধনার পরমাদর্শ, পরমাশ্রয়। ভবিষ্য-পুরাণের ব্রাহ্মখণ্ডেও জাতিভেদের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ যুক্তি দিয়া জাত-বর্ণের উর্ধের্ব মানুষের আপন মহিমারই জয়গান করা হইয়াছে। বজ্ৰসুচিকোপনিষদেও একুই ঘোষণা। দোহাকোষের টীকায় তো সুস্পষ্টই বলা হইয়াছে, সকল লোকই একজাতি, ইহাই সহজ ভাব। এই জাতি যে মানবজাতি তাহাতে আর সন্দেহ কি!