প্রাচীন বাঙলায় আর্যপ্রবাহ ক্ষীণ
নানা সূত্রে নানা অধ্যায়ে বলিয়াছি, আর্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধনের প্রবাহ বাঙলাদেশে আসিয়া লাগ্নিয়াছে অপেক্ষাকৃত পরবর্তী কালে এবং যখন লাগিয়াছে তখনও খুব সবেগে, সবিস্তারে লাগে নাই। প্রবাহটি কখনো খুব গভীরতা বা প্রসারিতা লাভ করিতে পারে নাই; সাধারণত বর্ণসমাজের উচ্চতর স্তরে এবং অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত, মার্জিত ও সংস্কৃত সম্প্রদায়ের মধ্যে তাহা আবদ্ধ ছিল, বিশেষত আর্য ব্ৰাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতি। একমাত্র আর্য বৌদ্ধ ধর্ম ও সংস্কৃতিই সদ্যোক্ত সীমার বাহিরে কিছুটা বিস্তার লাভ করিয়াছিল, কিন্তু তাহা আরও পরবর্তী কালে— সপ্তম-অষ্টম শতকের পর হইতে। তাহা ছাড়া, আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহ গঙ্গার পশ্চিম তীর পর্যন্ত, অর্থাৎ মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গে যদি বা কিছুটা বেগবান ছিল, গঙ্গার পূর্ব ও উত্তর-তীরে সে-প্রবাহ ক্রমশ ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া গিয়াছে, বিস্তৃতি এবং গভীরতা উভয়ত।
প্রাচীন বাঙলায় আর্যপ্রবাহ ক্ষীণ
ইহার কারণ একাধিক। প্রথমত, বাঙলাদেশ প্রত্যন্ত দেশ বলিয়া আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবাহ এত দূরে আসিয়া পৌঁছতে সময় লাগিয়াছে। দ্বিতীয়ত, বহুদিন পর্যন্ত বাঙলাদেশের প্রতি আর্যমানসের একটা উন্ন্যাসিকতা, একটা ঘূণা ও অবজ্ঞার ভাব সক্রিয় ছিল। এদেশে আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার পরও সে উন্নাসিকতা একদিনে, একেবারে কাটিয়া যায় নাই, তাহার কারণ, যে সংকীর্ণ সীমার মধ্যে এই ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রসার সেই ধর্ম ও সংস্কৃতির শুচিতা রক্ষার একটা স্বাভাবিক ইচ্ছা। তৃতীয়ত, বাঙলার স্থানীয় আদিম, কৌমাবদ্ধ মানবসমোজও বহুদিন পর্যন্ত আর্য ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি খুব শ্রদ্ধিতচিত্ত ছিল না, বরং সক্রিয় বিরোধিতাও করিয়াছে, যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে সে-স্রোত ঠেকাইয়া রাখিতে। তাহার পর পরাভব যখন অনিবার্য হইয়াছে তখনও সেই মানবসমাজ একেবারে স্রোতে গা ভাসাইয়া দেয় নাই; নিজের ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধন পরিত্যাগ করিয়া আর্য ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধন পুরোপুরি মানিয়া লয় নাই, বরং দিনের পর দিন ধরিয়া বুঝাপড়া করিয়া একটা সমন্বয় গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছে। মধ্যগাঙ্গেয় ভারত যে-ভাবে আর্য, বিশেষভাবে আর্য ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও সংস্কৃতিকে পুরাপুরি মানিয়া লইয়াছে বাঙলাদেশ সে-ভাবে তাহা করে নাই। ভারতবর্যের বুকে যে কয়টি অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ধর্ম ও সংস্কৃতির উদ্ভব ও প্রসার লাভ করিয়াছে তাহার প্রত্যেকটিই মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের অর্থাৎ আর্যাবর্তের সীমার বাহিরে। বৌদ্ধ ও জৈনধর্ম প্রভৃতি যে বর্তমানে বিহারের সীমার মধ্যে উদ্ভূত হইয়াছিল এবং পরবর্তী কালে তন্ত্রধর্ম, বজ্রযান, মন্ত্রযান, সহজযান, কালচক্ৰযান প্রভৃতির উদ্ভবও যে আর্যাবর্তের সীমার বাহিরে, ইতিহাসের এই ইঙ্গিত তুচ্ছ করিবার মতন নয়। বস্তুত, বাঙলাদেশ আর্যধর্ম ও সংস্কৃতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও, ব্ৰাহ্মণ ও উচ্চতর দুই একটি সম্প্রদায়ের বাহিরে এই ধর্ম ও সংস্কৃতির বন্ধন শিথিল, তাহার প্রতি শ্ৰদ্ধা কুষ্ঠিত। চতুর্থত, বাঙলাদেশে নানা নরগোষ্ঠীর সমন্বয়ে, প্রচুর রক্তমিশ্রণের ফলে এবং নানা ঐতিহাসিক কারণে জাতিভেদ-বৰ্ণভেদের বৈষম্য আর্যাবর্ত বা দক্ষিণ ভারতের মতো এত কঠোর হইয়া উঠিতে পারে নাই; বস্তুত, বাঙলার সমাজবন্ধনে তথাকথিত শূদ্র জাতির লোকদেরই প্রাধান্য। আজও বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্যের সংখ্যা স্বল্প। বৰ্ণবিন্যাসে ও সামাজিক আচার-বিচারে যাহা কিছু কঠোরতা বা আর্য ব্রাহ্মণ্য সনাতনত্বের যে আদর্শ বাঙলায় আজও সক্রিয় তাহা প্রধানত দক্ষিণী সেনা-বংশীয় রাজাদের প্রভাবে ও আনুকূল্যে এবং গৌণত মধ্যভারতীয় আর্য ব্ৰাহ্মণ্যাদর্শের প্রেরণায়।
সনাতনত্বের প্রতি বাঙালীর বিরাগ
এই সব কারণে বাঙালীর ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজবন্ধনে এমন কতগুলি বৈশিষ্ট্য গড়িয়া উঠিয়াছে যাহা মধ্যগাঙ্গেয় ভারত, অর্থাৎ আর্য-ভারত হইতে পৃথক। আর্য ভারতবর্ষ সনাতনত্বের আদর্শে স্থির ও অবিচল, সমস্ত আচারানুষ্ঠান, অধ্যাত্ম সাধনা, সমাজ ও পরিবারবন্ধন প্রভৃতি সমস্তই সেখানে শাস্ত্ৰ দ্বারা শাসিত। আৰ্য-ভারত রক্ষণশীল, যাহা সে পাইয়াছে তাহা সে আঁকড়াইয়া ধরিয়া থাকিতে চায়। মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের মন তাই বহুলাংশে পরিবর্তন বিমুখ। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরিয়া যে মধ্যগাঙ্গেয় ভারতের ধর্মে, রাষ্ট্রে বা সমাজে কোনও বৈপ্লবিক আলোড়ন দেখা দেয় নাই, বা দিলেও তাহা সার্থক রূপ পরিগ্রহ করিতে পারে নাই, ইতিহাসের এ-তথ্য বিস্ময়কর, কিন্তু দুর্বোধ্য নয়। ইহার প্রধান কারণ, আর্য ব্ৰাহ্মণ্য ধর্মের সনাতনী ও রক্ষণশীল মনোভাব। বাঙলাদেশে হইয়াছে তাহার বিপরীত। মহাযানী বৌদ্ধধর্মের বোজযানী-মন্ত্রযানী-কালচক্রযানী ও সহজযানী রূপান্তর; সহজযানো সহজ মানবতার এবং প্ৰাণধর্মের আবেদন; ব্রাহ্মণ্য শক্তিধর্মের তান্ত্রিক রূপান্তর; বৈষ্ণবধর্মে বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগের সঞ্চার; শিব ও উমার ভাবকল্পনায় পারিবারিক জামাতা-কন্যার রূপ ও আবেগ সঞ্চার; দুর্গা, তারা, ষষ্ঠী, মারীচী, পর্ণশবরী প্রভৃতি মাতৃকাতন্ত্রের দেবীদের প্রতি শ্রদ্ধা, আবেগ ও অনুরাগ; শিব ও বিষ্ণুর মতন দেবতাকেও ঘনিষ্ঠ মানব সম্বন্ধে বাধিয়া তাহাদের প্রতি পারিবারিক আত্মীয়তার এবং মানবী লীলার আবেগ সঞ্চার, তান্ত্রিক কায়াসাধনের প্রতি অনুরাগ এবং সেই সাধনের রীতিপদ্ধতি; শাস্ত্রচর্চা ও জ্ঞানচর্চায় বুদ্ধি ও যুক্তি অপেক্ষা প্ৰাণধর্ম ও হৃদয়াবেগের প্রাধান্য; বাঙলার ব্যবহার-শাস্ত্ৰে দায়াধিকারের আদর্শ ও ব্যবস্থা; বাঙলার পরিবার ও সমাজবন্ধন প্রভৃতি সমস্তই আৰ্যমানসের দিক হইতে বৈপ্লবিক ও সনাতনত্বের বিরোধী। দুঃসাহসী সমন্বয়, স্বাঙ্গীকরণ ও সমীকরণ যেন বাঙালীর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য; সনাতনত্বের প্রতি একটা বিরাগ যেন বাঙলার ঐতিহ্য ধারায়। ইহার মূল প্রধানত বাঙালীর জনগত ইতিহাসে, কিছুটা তাহার ভৌগোলিক পরিবেশে, তাহার নদনদীর ভাঙা গড়ায়, কিছুটা ইতিহাসের আবর্তন-বিবর্তনের মধ্যে। বাঙালীর বৃত্তি যথার্থতি বৈতসী; যে-আদর্শ, যে-ভাবস্রোতের আলোড়ন, ঘটনার যে-তরঙ্গ যখন আসিয়া লাগিয়াছে, বাঙলাদেশ তখন বেতস-লতার মতো নুইয়া পড়িয়া অনিবার্য বোধে তাহাকে মানিয়া লাইয়াছে এবং ক্রমে নিজের মতো করিয়া তাহাকে গড়িয়া লইয়া, নিজের ভাব ও রূপদেহের মধ্যে তাহাকে সমন্বিত ও সমীকৃত করিয়া লইয়া আবার বেতস লতার মতোই সোজা হইয়া স্ব-রূপে দাঁড়াইয়াছে। যে দুর্মর অন্তর্নিহিত প্রাণশক্তি বেতস গাছের, সেই দুর্মর প্রাণশক্তিই বাঙালীকে বার বার বাঁচাইয়াছে।
বাঙলীর দেবায়তনে দেবীদের প্রাধান্য
সাম্প্রতিক বাঙলার বিচিত্র ধর্মকর্মানুষ্ঠানের গভীরে একটু দৃষ্টিপাত করিলে দেখা যাইবে, এদেশে দেবতাদের চেয়ে দেবীদের সমাদর ও প্রতিষ্ঠা বেশি; মধ্যযুগেও তাঁহাই ছিল। প্রাচীন বাঙলা সম্বন্ধে এ-কথা হয়তো সমান প্রযোজ্য নয়; কারণ, প্রতিমা-সাক্ষ্যে দেখা যায়, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় দেবায়তনে দেবমূর্তির সংখ্যাই বেশি। তবু, মধ্যপর্ব ও সাম্প্রতিক পর্বে দেবীদের যে প্রাধান্য তাহার সূচনা যেন আদিপর্বেই দেখা দিয়াছিল। আদিম কৌম সমাজের মাতৃকাতন্ত্রের দেবীদের প্রাধান্য কৌম সমাজে তো ছিলই; বিচিত্র নামে তাহারা নানাস্থানে পূজাও লাভ করিতেন। পরে যখন আর্য-ব্রাহ্মণ্য পুরুষপ্রকৃতি ধ্যান সুপ্রতিষ্ঠিত হইল তখন সেই মাতৃকাতন্ত্রের দেবীরা প্রকৃতি বা শক্তিরূপিণী বিভিন্ন দেবীর সঙ্গে, বিশেষভাবে দুর্গ ও তারার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া গেলেন। যাহাই হউক, আদিপর্বের শেষ পর্যায়ে দেখিতেছি। দুর্গ, তারা, ষষ্ঠী, হারীতী, মনসা, মারীচী, চুণ্ডা, পৰ্ণশবরী প্রভৃতি, বিশেষভাবে দুর্গ ও তারা ক্রমশ সমাদৃতা ও সুপ্রতিষ্ঠিত হইতেছেন এবং তারার ধ্যানে তাঁহাকে একই সঙ্গে বেদমাতা অর্থাৎ সরস্বতী, গিরিজ অর্থাৎ উমা বা দুর্গ, পদ্মাবতী এবং বিশ্বমাতা বলিয়া আহ্বান করা হইয়াছে। এই ক্রমবর্ধমান মৃত্যুকৃত্যুর প্রধান আদিম মাতৃতাত্মিক কৌম সমাজান্দর্শের এবং কৌম মানসের পুনঘোষণা, সন্দেহ কি!
নারী বা মাতৃকাতন্ত্র
প্রাচীন বাঙলার প্রতিমা-সাক্ষ্যে দেখা যায়, উমা-মহেশ্বরের যুগল মূর্তিরূপ এবং শিবের বৈবাহিক বা কল্যাণসুন্দর রূপ সমসাময়িক বাঙালীর চিত্তহরণ করিয়াছিল। তাহা ছাড়া দুৰ্গা বা দেবীও নানা রূপ ও নানা নামে পূজা লাভ করিতেছিলেন। শিব-গৌরীর বিবাহ-প্রসঙ্গ লইয়া মধ্যযুগীয় বাঙলা-সাহিত্যে যে-ধরনের পারিবারিক ও সংসারগত ভাবকল্পনা বিস্তৃত তাহার আভাসও প্রাচীনকালেই পাওয়া যাইতেছে। ইহাদের মধ্যে একদিকে যেমন সমসাময়িক বাঙালীর হৃদয়াবেগ ও চিত্তের স্পর্শালুতা প্রত্যক্ষ গোচর তেমনই অন্যদিকে বাঙালী চিত্তে নারীর প্রাধান্য ও নারীভাবনার প্রসারও সমান প্রত্যক্ষ। আর, বিজযান-সহজযান প্রভৃতি ধর্মের কায়সাধন তো নারী বা শক্তি ছাড়া সম্ভবই নয়। তাহা ছাড়া, রাধাকৃষ্ণের রূপ ও ধ্যান-কল্পনার মধ্যেও এই নারীভাবনা অনিবাৰ্য্যভাবে সক্রিয়; অর্থাৎ, কোনও দেবতাই যে দেবী ছাড়া সম্পূর্ণ নহেন, নর যে নারী ছাড়া সম্পূর্ণ নহে কেবল তাঁহাই নয়; সে-ভাবনা তো পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য দেবায়তন-কল্পনার মধ্যেই ছিল, কিন্তু নারীকে শক্তিস্বরূপিনী বলিয়া দেখা ও ভাবা, সৃষ্টিরহস্যের মূল বলিয়া কল্পনা করা:- ইহার মধ্যে বস্তুনিষ্ঠ, সংসারগত ইন্দ্ৰিয়ালুতার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত অনস্বীকার্য এবং এই ইঙ্গিত প্রাচীন-ভারতের, বিশেষভাবে বাঙলায় সৃষ্টি এবং আদিম মাতৃতান্ত্রিক সমাজের দান। কৃষ্ণ-রাধা কল্পনার রাধাই হইতেছেন শিবের শক্তি, বজ্রযানীর নিরাত্মা, সহজযানীর শূন্যতা, কালচক্রযানীর প্রজ্ঞা। এই কৃষ্ণ-রাধার কল্পনা তো একান্তই প্রাচীন বাঙলার শেষ পর্যায়ের রচনা; বস্তুত, বাঙালী চিত্তের গভীরে যেন সেই অনার্য আদিম তমসাচ্ছন্ন তন্ত্রসাধনার নিগূঢ় কামনা; তাহার তাড়নাতেই যেন সমস্ত ধর্মমতের গড়ন। সংখ্যাধ্যান-কথিত পুরুষ-প্রকৃতি কল্পনার এই যে তান্ত্রিক রূপান্তর, সনাতন আর্য মানসে ইহার আবেদন স্বল্প, অথচ বাঙলাদেশে এই ভাবনা অত্যন্ত সত্য ও ব্যাপক। গোপন দেহযোগ বা কায়সাধন, নারীসাধন, শবসাধন, শূন্যধ্যান, দেহতত্ত্বের অভিনব ব্যাখ্যা, বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য উভয় ধর্মেরই শাক্ত তান্ত্রিক রূপে ভীষণ ও ভয়াল সাধন-পদ্ধতি মৃত্যুঃ সর্বত্রই অধ্যায় জীবনের একটি বিশেষ ভঙ্গি বর্তমান বাহা আর্য ব্রাহ্মণ ধর্ম অনুপস্থিত।
বাঙালীর হৃদয়াবেগ। প্ৰাণধর্ম ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা।
প্রাচীন বাঙালীর হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার ইঙ্গিত তাহার প্রতিমা-শিল্পে এবং দেবদেবীর রূপ-কল্পনায় ধরা পড়িয়াছে। এ-কথা অন্যত্র বলিয়াছি, একটু আগেও ইঙ্গিত করিয়াছি। মধ্যযুগের গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে সহজিয়া সাধনায়, বাউলদের সাধনায় যে বিশুদ্ধ ভক্তিরস ও হৃদয়াবেগের প্রসার, তাহার সূচনা দেখা গিয়াছিল আদি পর্বেই এবং তোহা শুধু বৌদ্ধ বজ্রযানী-সহজযানীদের মধ্যেই নয়, তান্ত্রিক শক্তি সাধনার মধ্যেই নয়, বৈষ্ণব সাধনায়ও বটে। এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা যে বহুলাংশে আদিম নরগোষ্ঠীর দান তাহা আজিকার র্সাওতাল, শবর প্রভৃতিদের জীবনযাত্রা, পূজানুষ্ঠান, সামাজিক আচার, স্বপ্নকল্পনা, ভয়-ভাবনার দিকে তাকাইলে আর সন্দেহ থাকে না। আর্য ব্ৰাহ্মণ্য এবং বৌদ্ধ ও জৈন সাধনাদর্শে কিন্তু এই ঐকাস্তিক হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতার এতটা স্থান নাই। সেখানে ইন্দ্ৰিয়-ভাবনা বস্তুসম্পর্কবিচুত, ভক্তি জ্ঞানানুগ, হৃদয়াবেগ বুদ্ধির অধীন। বস্তুত, বাঙলার অধ্যাত্ম সাধনার তীব্র আবেগ ও প্রাণবন্ত গতি সনাতন আর্য ধর্মে অনুপস্থিত।
এই হৃদয়াবেগ ও ইন্দ্ৰিয়ালুতা প্রাচীন বাঙালী জীবনের অন্য দিকেও ধরা পড়িয়াছে। মধ্যযুগে দেখিতেছি, দেবই হউন, আর দেবীই হউন, বাঙালী যথাসম্ভব চেষ্টা করিয়াছে তাহদের মর্ত্যের ধূলায় নামাইয়া পরিবার-বন্ধনের মধ্যে র্বাধিতে এবং ইহগত সংসার-কল্পনার মধ্যে জড়াইতে, হৃদয়াবেগের মধ্যে তাঁহাদের পাইতে ও ভোগ করিতে, দূরে রাখিয়া শুধু পূজা নিবেদন করিতে নয়। এই কামনার সূচনা আদি পর্বেই দেখা যাইতেছে। ষষ্ঠী, মনসা, হারাতী, কৃষ্ণ-যশোদা প্রভৃতির রূপ কল্পনায়ই যে এই ভাবনা অভিব্যক্তি তাঁহাই নয়; কার্তিকের শিশুলীলা বর্ণনা, পিতা শিবের বেশভূষা অনুকরণ করিয়া শিশু-কর্তিকের কৌতুক, দরিদ্র শিবের গৃহস্থলীর বর্ণনা, নেশাগ্ৰস্ত শিবের সংসারে উমার দুঃখ এবং জামাতা ও কন্যারূপে শিব ও গৌরীকে সমস্ত হৃদয়াবেগ দিয়া আপন করিয়া বাধা, সপরিবারে বিষ্ণু ও শিবকে প্রত্যক্ষ করা প্রভৃতির মধ্যেও একই ভাবনা সক্রিয়।
বাঙালীর দায়াধিকার ও স্ত্রীধন
বাঙলার ব্যবহার-শাস্ত্ৰে দায়াধিকারের যে আদর্শ ও ব্যবস্থা বিশেষ ভাবে স্ত্রী-ধনের যে স্বীকৃতি ও বিধিব্যবস্থা জীমূতবাহনের দায়ভাগ-গ্রন্থে বর্ণিত এবং পরে রঘুনন্দন কর্তৃক ব্যাখ্যাত ও সমর্থিত তাহার পশ্চাতেও মাতৃতান্ত্রিক সমাজের এবং সেই পরিবার-বন্ধনের স্মৃতি বহমান। আর্য সমাজ ও পরিবার-ব্যবস্থার দায়ভাগ ব্যবস্থার প্রচলন নাই; সেখানে মিতাক্ষরার রাজত্ব।