জনপদ বিভাগ, বাঙলা নামের উৎপত্তি
আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাঙলাদেশ। মুঘল আমলে এই দেশ সুবা বাঙলা নামে পরিচিত ছিল। আবুল ফজল তাহার ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাঙলা-বাঙ্গালা নামের ব্যাখ্যাও দিয়াছেন। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে আলী (সংস্কৃত আলি, পূর্ববঙ্গীয় আইল) যুক্ত হইয়া বাঙ্গাল বা বাঙ্গালা শব্দ নিম্পন্ন হইয়াছে, ইহাই আবুল ফজলের ব্যাখ্যা। আল শুধু শস্যক্ষেত্রের আলি নয়, আল ছোটবড় বাঁধও বটে। এই নদীমাতৃক বারিবহুল দেশে বৃষ্টি, বন্যা এবং জোয়ারের স্রোত ঠেকাইবার জন্য ছোটবড় বাঁধ বাঁধা ছিল কৃষি ও বাস্তুভূমির যথার্থ পরিপালনের পক্ষে অনিবার্য। যে-সব ভূখণ্ডের বারিপাত কম, ভূমি সাধারণত উষর, সেখানেও বর্ষার জল ধরিয়া রাখিবার জন্য ছোটবড় বাঁধ বাঁধা প্রয়োজন হইত, এখনও হয়, যেমন বীরভূম অঞ্চলে। প্রাচীন লিপিতে এই ধরনের বাঁধের পুনঃপুন উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়, যেমন, বিশ্বরূপসেনের মদনপাড়া লিপিতে এবং অন্যান্য অসংখ্য লিপিতে। এ-রকম দুটি চারটি বৃহৎ বাঁধ এখনও প্রাচীন অভ্যাসের স্মৃতি বহন করিতেছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ রংপুর-বগুড়ার ভীমের (কৈবর্তরাজ ভীমের?) জাঙ্গাল বা ভীমের ডাইঙ্গ, বীরভূমের সিউড়ি অঞ্চলের দুই চারটি বাধের উল্লেখ করা যায়। আমার অনুমান, আবুল ফজলের ব্যাখ্যার অর্থ এই যে বঙ্গদেশ আল বা আলিবহুল, যে বঙ্গদেশের উপরিভূমির বৈশিষ্ট্যই হইতেছে আল সেই দেশই বাঙ্গালা বা বাঙলাদেশ। এই আলগুলিই আবুল ফজলের সবিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছিল; তাহার ব্যাখ্যা পড়িলে এই কথাই মনে হয়। Gastaldi (1560), Hondivs (1613), Hermann Moll (1710), Van den Broucke (1660), Izzak Tirion (1730), F. de Witt (1726) প্রভৃতির নকশায়, মধ্যযুগের যুরোপীয় পর্যটকদের বিবরণীতে, সর্বত্রই এই দেশের নাম পাইতেছি Bengala, এবং ইহারা দক্ষিণের সাগরটির নাম Golfo of Bengalবা Gulf of Bengal বলিয়া। মধ্যযুগের বাঙলা-বাঙ্গালা-Bengala একই নাম। Marco Polo এই দেশের নাম বলিতেছেন। Bengala, যদিও তাহার অবস্থিতিনির্দেশ স্পষ্টই ভ্ৰমাত্মক। যাহাই হউক, বাঙ্গালা-Bengala-Bangala-বাঙলা নাম বর্তমান বঙ্গদেশের মোটামুটি প্রায় সমস্তটারই; কোনও কোনও দিকে বর্তমান সীমা অতিক্রমও করিয়াছে, মধ্যযুগীয় সাক্ষ্যে তাহা সুস্পষ্ট। কিন্তু প্রাচীন বাঙলায় বঙ্গ বঙ্গাল বলিতে যে দেশখণ্ড বুঝাইত তাহা বর্তমান বঙ্গ বা বাঙলাদেশের সমার্থক নয়; তাহার একটি অংশ মাত্র। প্রাচীন বাঙলাদেশ যে-সব জনপদে বিভক্ত ছিল বঙ্গ ও বঙ্গাল তাহার দুইটি বিভাগ মাত্র। এই দুইটি বিভাগের নাম হইতেই বর্তমান এবং মধ্যযুগীয় সমগ্র বাঙলাদেশ নামটির উৎপত্তি। কাজেই, প্রাচীন বাঙলার জনপদ-বিভাগের কথা বলিতে গিয়া সর্বাগ্রে এই বিভাগ দুইটির কথাই বলিতে হয়।
কিন্তু তাহার আগে জনপদ-বিভাগ সম্বন্ধে সাধারণ দু’একটি কথা বলিয়া লওয়া দরকার। অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষত প্রাচীনতর সাক্ষ্যে, জনপদগুলির নাম যেভাবে আমরা পাই, তাহা ঠিক জনপদ বা স্থানের নাম নয়-কোমের নাম যথা-বঙ্গাঃ, রাঢ়াঃ, পুণ্ড্রাঃ, গৌড়াঃ, অর্থাৎ বঙ্গ জনাঃ, গৌর জানাঃ, পুণ্ড্র জনাঃ, রাঢ়া জনাঃ, বঙ্গ-গৌড়-পুণ্ড্র-রাঢ় কোম (tribe অর্থে)। এইসব জনাঃ বা কোম যে-সব অঞ্চলে বাস করিত, পরে তাহাদের, অর্থাৎ সেই সেই অঞ্চলের নাম হইল বঙ্গ, গৌড়, পুণ্ড্র ইত্যাদি। এইভাবে বহুবচনে জনবাচক অর্থে এইসব নামের ব্যবহার একাদশ-দ্বাদশ শতকের সাক্ষ্যপ্রমাণেও দেখা যায়। দু-এক ক্ষেত্রে তাহার ব্যতিক্রমও আছে, যেমন সুবভি বা সুহ্মভূমি, বজজ বা বজ্রভূমি (ব্ৰহ্মভূমি?)। দ্বিতীয়ত, জন হইতে বা জনকে কেন্দ্ৰ করিয়া গঠিত এক-একটি জনপদে এক এক সময়ে এক-একটি রাষ্ট্র বা রাজবংশের আধিপত্য স্থাপিত হইয়াছে, এবং অনেক সময়ে তাহাদের রাষ্ট্ৰীয় আধিপত্য সংকোচ বা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জনপদটির সীমাও সংকুচিত বা বিস্তারিত হইয়াছে। পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্রদের জনপদকে কেন্দ্ৰ করিয়া গড়িয়া উঠিয়াছিল পুণ্ড্রবর্ধন রাজ্য (সপ্তম শতক) এবং পরে পাল ও সেন রাজাদের আমলে পুণ্ড্র-পৌণ্ড্রবর্ধনভূক্তি বা পৌণ্ড্রভুক্তি। এই ভুক্তিটি এক সময় হিমালয়-শিখর হইতে আরম্ভ করিয়া (দামোদরপুর লিপি, পঞ্চম শতক) সমূদ্র পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল। (খাদশ শতকে বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ লিপি দ্রষ্টব্য)। ১২৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দের মোহার লিপি অনুসারে ত্রিপুরা জেলাও এই ভুক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। অথচ প্রাচীন পুণ্ড্র বা পীেণ্ড জনপদ গড়িয়া উঠিয়াছিল বগুড়া-দিনাজপুর-রাজশাহী-রংপুর জেলাকে কেন্দ্ৰ করিয়া। বর্ধমান রাঢ়দেশের একটি অংশমাত্র ছিল, অথচ এক সময় এই বর্ধমান রাষ্ট্রবিভাগে রূপান্তরিত হইয়া বর্ধমানভুক্তি নাম লইয়া শুধু উত্তর ও দক্ষিণ রাঢ়ন্দেশকেই নয়, দণ্ডভুক্তিমণ্ডলকেও গ্রাস করিয়াছিল। দণ্ডভুক্তি মেদিনীপুর জেলার বর্তমান দাতন অঞ্চল; এই অঞ্চল সপ্তম শতকে তাম্রলিপ্তি রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ হইতে তাহা অনুমান করা কঠিন নয়। সুহ্মদেশ মোটামুটি দক্ষিণ-রাঢ়ের সমার্থক; মহাভারতে তাম্রলিপ্তিকে সুহ্মদেশ হইতে পৃথক বলা হইয়াছে; অধিকাংশ প্রাচীন সংক্ষ্যের ইঙ্গিতও তাঁহাই। কিন্তু ‘দশকুমার-চরিত’ গ্রন্থে দামলিপ্ত বা তাম্রলিপ্তকে সুহ্মের অন্তর্ভুক্ত বলা হইয়াছে। জৈন প্রজ্ঞাপনায় তাম্রলিপ্তি বা তাম্রলিপ্তকে আবার বঙ্গের অন্তর্ভুক্তও বলা হইয়াছে, অথচ প্রাচীন সাক্ষের সর্বত্রই ইঙ্গিত এই যে, বঙ্গ ভাগীরথীর পূর্ব-তীরে। এই দৃষ্টান্ত হইতে সহজেই বুঝা যায়, রাষ্ট্র-পরিধির বিস্তার ও সংকোচের সঙ্গে সঙ্গে এক এক সময় এক এক জনপদের সীমাও বিস্তারিত ও সংকুচিত হইয়াছে, সব জনপদের সীমা সকল সময় এক থাকে নাই। আসল কথা, প্রাকৃতিক সীমা ও রাষ্ট্রসীমা সর্বত্র সকল সময় এক হয় না, প্রাচীন বাঙলায় হয় নাই। জনপদ বৃত্তান্ত পাঠের সময় এ কথা মনে রাখা প্রয়োজন। এই জনপদ কথা বলিবার সময় সেইজন্য প্রাকৃতিক সীমা-নির্ধারণর চেষ্টাই প্রথম কর্তব্য, যদিও তোহা সহজসাধ্য নয়, সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রায়শ সুদূর্লভ। দ্বিতীয় কর্তব্য, বিভিন্ন সময়ে নির্দিষ্ট জনপদের রাষ্ট্রসীমার বিস্তার ও সংকোচ, এবং তাহার বিভিন্ন রাষ্ট্রগত ও সংস্কৃতিগত বিভাগের নির্দেশ। এ কাজ অত্যন্ত কঠিন; কারণ এ ক্ষেত্রেও সাক্ষ্য-প্রমাণ সুলভ নয়। তবু, যতটা সম্ভব মোটামুটি একটা ধারণা গড়িয়া তোলার চেষ্টা করা যাইতে পারে। তৃতীয়ত, খুব প্রাচীন কাল হইতেই নানা প্রসঙ্গে বাঙলার বিভিন্ন জনপদের উল্লেখ প্রাচীন গ্রন্থাদি এবং লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। এইসব উল্লেখ সুবিদিত এবং বহু আলোচিত। কাজেই, এ প্রসঙ্গে তাহার পুনরালোচনার কিছু প্রয়োজন নাই। যে সব উল্লেখ্য, যে সব সাক্ষ্য-প্রমাণ জনপদগুলির সীমা ও অবস্থিতি নির্ণয়ের সহায়ক, শুধু তাহাদের উল্লেখ ও আলোচনাই এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। তাহা ছাড়া, প্রাচীনতর উল্লেখ যাহা পাইতেছি তাহা সমস্তই আর্যভাষাভাষী আর্য-সংস্কৃতিসম্পন্ন লোকদের গ্রন্থ হইতে, যাহারা আর্যপূর্ব বা অনার্য ভাষা ও সংস্কৃতির উপর শ্রদ্ধাবান ছিলেন না এমন লোকদের নিকট হইতে, এ কথাও মনে রাখা দরকার।
বঙ্গ, বঙ্গের পশ্চিম সীমা
বঙ্গ অতি প্রাচীন দেশ। ‘ঐতরেয় আরণ্যক’ গ্রন্থে বোধহয় সর্বপ্রথম এই দেশের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়; “বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ” পদে বঙ্গজনদের বগধদের সঙ্গে যুক্ত করা হইয়াছে। বগধ বোধহয় মগধ, এই অনুমান অনৈতিহাসিক না-ও হইতে পারে। এই গ্রন্থের ঋষিরা বঙ্গকে মগধের প্রতিবেশী জনপদ বলিয়াই জানিতেন বলিয়া মনে হয়। বোধায়নের ‘ধর্মসূত্রে’ বঙ্গ জনপদটিকে কলিঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে, এমন অনুমান করিলে ভুল হয় না; আরট্র, পুণ্ড্র, সৌবীর, বঙ্গ ও কলিঙ্গাজনেরা একেবারে বৈদিক সংস্কৃতিবহির্ভূত, এবং তাহাদের দেশে যাতায়াত করিলে ফিরিয়া আসিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়, বোধায়ন এইরূপ নির্দেশ দিয়াছেন। মহাভারতে দেখিয়াছি, ভীম দিগ্বিজয়ে বাহির হইয়া মুদগগিরি (মুঙ্গের) রাজকে হত্যা করিয়া কোশীনদী-তীরবর্তী পুণ্ড্ররাজকে পরাজিত করেন; তাহার পর, পর পর তিনি বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কৰ্কট, সুহ্ম, প্রসুহ্ম রাজাদের এবং অনেক স্লেচ্ছ কোমদের পরাভূত করেন। মহাভারতের আদিপর্বে বঙ্গজনপদের উল্লেখ করা হইয়াছে অঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র এবং সুহ্মজনদের সঙ্গে; সভাপর্বে পুণ্ড্রদের সঙ্গে! ‘রামায়ণে’ও অন্যান্য জনদের সঙ্গে বঙ্গজনদের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়; সকলেই অযোধ্যার অভিজাত-বংশীয়দের সঙ্গে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ ছিলেন, এইরূপ ইঙ্গিত পাওয়া যায়। সিংহলী মহাবংশ’ গ্রন্থে বঙ্গাজনেরা লাল (রাঢ়)-জনপদের সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘প্রজ্ঞাপনা’-নামক একটি জৈন উপাঙ্গে বঙ্গজনদের সঙ্গে লাল (রাঢ়)-জনদের উল্লেখ করিয়া উভয়কেই আর্য বলা হইয়াছে। এই প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তিকে বঙ্গ জনদের অধিকারে বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। ‘মহাভারতের উল্লেখ হইতে স্পষ্টই বুঝা যায়, বঙ্গ পুণ্ড্র, তাম্রলিপ্ত ও সুহ্মের সংলগ্ন দেশ, এবং প্রত্যেকটি দেশই স্ব-স্বতন্ত্র; কিন্তু জৈন উপাঙ্গটির ইঙ্গিত হইতে মনে হয়, কোনও সময়ে তাম্রলিপ্ত বোধ হয় বঙ্গের অধিকারভুক্ত হইয়া থাকিবে। বঙ্গের উল্লেখ গুন্টুর জেলার নাগাৰ্জনীকোণ্ড (খ্ৰীষ্টীয় তৃতীয় শতক) শিলালিপিতে, রাজা চন্দ্রের (চতুর্থ শতক) মেহেরৌলি স্তম্ভলিপি এবং বাতাপীর (বাদামী) চালুক্যরাজ পুলকেশীর মহাকুট স্তম্ভলিপি (সপ্তম শতক)-কেও দেখিতে পাওয়া যায়, কিন্তু ইহাদের একটিতেও বঙ্গের অবস্থিতি-নির্দেশ পাওয়া যায় না। কালিদাসের (চতুর্থ শতক?)। “রঘুবংশে এই নির্দেশ দেন। অনেকটা স্পষ্ট। এই কাব্যের চতুর্থ সর্গে রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে পর পর পাঁচটি শ্লোক আছে। প্রথম দুইটি শ্লোকে তালীবিনশ্যাম উপকূলে সুহ্ম-জনপদের পরাজয়ের কথা আছে; তারপরেই তিনি নৌ-সাধনোদ্যত বঙ্গজনদের পরাভূত করিয়া ‘গঙ্গাস্রোতহস্তরে জয়স্তম্ভ স্থাপন করিয়াছিলেন। বঙ্গজনদের উৎখাত এবং প্রতিরোপিত করিয়া পরে তিনি কপিশা (কসাই)-নদী পার হইয়া উৎকলাদিগের প্রদর্শিত পথে কলিঙ্গ অভিমুখে গিয়াছিলেন। টীকাকার মল্লিনাথ ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু, পদটির টাকা করিয়াছেন ‘গঙ্গায়াঃ প্রবাহনাম দ্বীপেযু; এবং আধুনিক ঐতিহাসিকেরাও ‘গঙ্গাস্রোতের মধ্যে এই অর্থই করিয়াছেন। এই অর্থ মানিয়া লইলে স্বীকার করিতে হয়, কালিদাসের সময়েও তাম্রলিপ্তি বঙ্গজনপদেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল এবং রঘু সুহ্ম অর্থাৎ মোটামুটি দক্ষিণ রাঢ় জয় করিয়া বঙ্গ জয় করেন, এবং কপিশা পার হইয়া উৎকলে যান। কিন্তু মহোদধির তালীবিনশ্যামোপকণ্ঠে উপনীত হইয়া সুহ্ম জয়ের উল্লেখ হইতে আমার মনে হয়, তদানীন্তন তাম্রলিপ্তি সুহ্মদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল৷ ‘দশকুমারচরিত’ গ্রন্থে দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) সুহ্মের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। তাহা হওয়াই স্বাভাবিক; উভয়েই গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিমান্ত সংলগ্ন দেশ, এবং তাম্রলিপ্তিই যথার্থতি সমুদ্রতীরবর্তী তালীবনশ্যাম ভূখণ্ড বলিয়া বর্ণিত হওয়া যুক্তিযুক্ত। তাহা হইলে, বঙ্গ গঙ্গাস্রোতের বামে বা পূর্বদিকে হওয়া উচিত; আমার মনে হয়, ‘গঙ্গাস্রোতোহন্তরেষু’ বলিয়া কালিদাস গঙ্গাস্রোতের অপর দিকে বুঝাইতে চাহিয়াছেন; অন্তরেষু। অর্থাৎ পার হইয়া। পরবর্তী সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণে গঙ্গা-ভাগীরথীই যে বঙ্গের পশ্চিম সীমা, এই ইঙ্গিত বারবার পাওয়া যায়। বঙ্গ-জয়ের পর রঘু আবার পশ্চিমদিকে ফিরিয়া সুহ্মের ভিতর দিয়া, কপিশা পার হইয়া উৎকল-কলিঙ্গে গিয়াছিলেন।
উপবঙ্গ বঙ্গ, প্রবঙ্গ, অনুত্তর-বঙ্গ
‘বৃহৎসংহিতা’য় উপবঙ্গ-নামে একটি জনপদের উল্লেখ আছে। আনুমানিক ষোড়শ-সপ্তদশ শতকে রচিত ‘দিগ্বিজয়-প্রকাশ’-নামক গ্রন্থে উপবঙ্গ বলিতে যশোর ও তৎসংলগ্ন কয়েকটি কাননময় অঞ্চলের দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে (উপবঙ্গে যশোরাদ্যাঃ দেশাঃ কাননসংযুক্তাঃ)। ‘মনোরথপুরণি এবং অপাদান’-নামক পালি বৌদ্ধগ্রন্থে বঙ্গান্তপুত্ত এবং বঙ্গীশ এই দুইটি অভিধান হইতে মনে হয়, বঙ্গ শব্দটির সঙ্গে এই দুইটি অভিধার কোনও প্রকার যোগ ছিল, কিন্তু তাহাতে বঙ্গ, উপবঙ্গ, বঙ্গান্তদেশের অবস্থিতির কোনও পরিচয় পাওয়া যায় না। প্রবঙ্গ-নামেও আর একটি জনপদের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রবঙ্গ পরবর্তীকালের অনুত্তর বঙ্গ বা দক্ষিণ-বঙ্গের মতো বঙ্গেরই একটি অংশ হয়তো ছিল; কিন্তু ইহারও অবস্থিতি সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত আমাদের জানা নাই।
গুপ্ত আমলে বঙ্গের দুইটি বিভাগ ছিল বলিয়া মনে হয়। সমাচার দেবের ঘুগ্রহাটি লিপিতে দেখিতেছি, সুবর্ণবীথিতে একজন উপরিকের শাসনকেন্দ্র ছিল। এই সুবর্ণবীথি নব্যাবকাশিকার ছিল বলিয়া মনে হয়। নব্যাবকাশিকা যে ঢাকা-ফরিদপুর অঞ্চলের (ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের।) न्म ভূমি তাহা তো আগেই বলিয়াছি। ঢাকা জেলার বর্তমান সুবর্ণগ্রাম (সোনার গাঁ), সোনারাং, সোনাকান্দি প্রভৃতি স্থানের সঙ্গে প্রাচীন সুবর্ণবীথির একটি অর্থগত যোগ আছে, এ অনুমান বোধহয় সংগত। সুবর্ণবীথির অন্তর্গত ছিল বারকমণ্ডল, এবং লিপিতে উল্লেখ করা হইয়াছে বারকমণ্ডল ছিল প্রাক-সমুদ্রশায়ী। বারকমণ্ডল-মধ্যবর্তী খুঁবিলাটি বর্তমান ফরিদপুর শহরের নিকটবর্তী ধুলট।
পাল ও সেন আমলে বঙ্গ পুণ্ড্রবর্ধনভূমির অন্তর্গত বলিয়া বার বার বলা হইয়াছে, কিন্তু গুপ্ত আমলে বঙ্গ এবং পুণ্ড্রবর্ধন দুই পৃথক রাষ্ট্রবিভাগে ছিল বলিয়া মনে হয়।
পাল ও সেন আমলের লিপিগুলিতে বঙ্গের উল্লেখ বারবার পাওয়া যায়। প্রতিহাররাজ ভোজদেবের গওআলিয়র প্রশস্তিতে দ্বিতীয় নাগভট কর্তৃক বঙ্গপতিকে (ধর্মপাল) পরাভূত করিবার কথা উল্লিখিত আছে (নবম শতক)। পালরাজ রামপালের মন্ত্রীপুত্র কুমারপালের প্রধানামাত্য বৈদ্যদেবের কমীেলি লিপিতে (একাদশ শতক) অনুত্তর-বঙ্গের সমরবিজয়-ব্যাপারের উল্লেখ আছে; সেই প্রসঙ্গে ‘নৌবাটহীহীরব এবং কিঞ্চোৎ-পাতুক-কেনিপাত-পতন-গ্ৰীতসপিতৈঃ শীকরৈঃ’ পদ দুইটির উল্লেখ হইতে অনুত্তর-বঙ্গ যে দক্ষিণ-বঙ্গ এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ থাকে না। মনে হয়, একাদশ শতকের শেষাশেষি বঙ্গের দুইটি বিভাগ কল্পিত হইয়াছিল; একটি বঙ্গের উত্তরাঞ্চল, আর একটি অনুত্তর বা বঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল। অনুমান হয়, বঙ্গের উত্তরাঞ্চলের উত্তর সীমা ছিল পদ্মা এবং সমুদ্রশায়ী খােলনোলা সমাকীর্ণ দক্ষিণাঞ্চল ছিল অনুত্তর-বঙ্গ। অথবা এমনও হইতে পারে, অনুত্তর-বঙ্গ কোনও বিশিষ্ট স্থানের নাম (proper name) নয়, দক্ষিণ ও পূর্ব-দক্ষিণাঞ্চলের বর্ণনাত্মক নাম মাত্র। যাহাই হউক, কেশব সেন ও বিশ্বরূপ সেন এই দুই সেনরাজের আমলে বঙ্গের অন্তত দুইটি বিভাগের নাম পাওয়া যাইতেছে; একটি বিক্রমপুর-ভাগ, অপরটি নাব্য (ভাগ) বা নাব্য (?) মণ্ডল। চন্দ্র ও সেন রাজাদের অনেক লিপিই তো বিক্রমপুর জয়স্কন্ধাবার হইতে উৎসারিত। কেশব সেনের ইদিলপুর লিপি ও বিশ্বরূপ সেনের মদনপাড়া লিপিতে বিক্রমপুর-ভাগ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষদ-লিপিতে পাইতেছি নাব্যভাগের উল্লেখ; তাহাও পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি বঙ্গ বিভাগের অন্তৰ্গত, এবং সেই পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির এবং নাব্যভাগের পূর্বতম সীমায় সমুদ্র, তাহা সাহিত্য-পরিষদের লিপিটিতে উল্লিখিত হইয়াছে। এই লিপিটির নাব্যভাগের অন্তর্গত রামসিদ্ধি পাটক বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী অঞ্চলের একটি গ্রাম। চন্দ্ররাজ শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-পট্টোলীর নাব্যমণ্ডল এবং তদন্তর্ভুক্ত নেহকাঠি যথাক্রমে নাব্যমণ্ডল এবং নৈকাঠি (বাখরগঞ্জ জেলা) হওয়াও কিছুই বিচিত্র নয়। এই প্রসঙ্গে ষষ্ঠ-সপ্তম শতকের ফরিদপুর লিপির নব্যাবকাশিকার সঙ্গে নাব্যের সম্ভাব্য সম্বন্ধেরও উল্লেখ করা যাইতে পারে। যাহাই হউক, এইসব লিপিপ্রমাণ হইতে বুঝা যাইতেছে, বাখরগঞ্জ জেলা এবং আরও পূর্বদিকে সমুদ্র পর্যন্ত অঞ্চল সমস্তটাই নাব্য নামে পরিচিত হইয়াছিল, এবং বর্তমান বিক্রমপুর পরগনার সমগ্র এবং ইদিলপুর পরগনার কিয়দংশ লাইয়া ছিল বিক্রমপুর-ভাগ (কেশব সেনের ইদিলপুর লিপি)। সেন লিপিতে বঙ্গ তো শুধু বঙ্গ নয়, সে যে ‘মধুক্ষীরক বঙ্গ-প্রচুর পয়ঃ যে দেশে সে দেশকে কবি মধুক্ষীরক বালিবেন, আশ্চর্য কি?
বঙ্গের অবস্থিতি সম্বন্ধে বাৎস্যায়ন-কামসূত্রের টীকাকার যশোধর তাহার ‘জয়মঙ্গল’ নামীয় টীকায় বলিতেছেন : “বঙ্গা লৌহিত্যাৎ পূর্বেন’ অৰ্থাৎ বঙ্গ লৌহিত্যের পূর্বদিকে। যশোধরের এই উক্তি বিশ্বাস করা কঠিন। প্রথমত, প্রাচ্যদেশগুলি সম্বন্ধে যশোধরের জ্ঞান অত্যন্ত সীমাবদ্ধ; কতকগুলি অত্যন্ত মারাত্মক রকমের ভুল তাহার টীকায় দেখা যায় এবং সেগুলি ইতিপূর্বেই পণ্ডিতদের লক্ষ্যগোচর হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, ইতিপূর্বেই আমরা দেখিয়াছি, সমস্ত বিক্রমপুর পরগনা এবং ফরিদপুর-বাখরগঞ্জেরও কিয়দংশ বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল, এবং এই সমস্ত ভূখণ্ডই ব্ৰহ্মপুত্রের পশ্চিম দিকে। বর্তমান যমুনাও যদি ব্ৰহ্মপুত্রের প্রাচীনতর কোনও প্রবাহপথ হইয়া থাকে তাহা হইলেও ফরিদপুর-বাখরগঞ্জ প্রাচীন বঙ্গ বহির্ভূত হইয়া পড়ে। কাজেই যশোধরের উক্তি অবিশ্বাস্য বলিয়া মনে হয়।
হরিকেল, হরিকেলি, হরিকোলা
কোষকার হেমচন্দ্ৰ তাঁহার ‘অভিধান-চিন্তামণি’তে (দ্বাদশ শতক) বঙ্গ ও হরিকেলি-জনপদ এক ও সমাৰ্থক বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন; “চম্পাস্তু অঙ্গা বঙ্গাম্ভ হরিকেলিয়াঃ”। প্রাচ্যদেশের পূর্বতম সীমায় হরিকেল, দুই চীন পরিব্রাজকের (সপ্তম শতক) বিবরণীতে এই খবর জানা যায়। আনুমানিক অষ্টম শতকে রচিত আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প গ্রন্থে বঙ্গ, সমতট ও হরিকেল তিনটি স্ব-স্বতন্ত্র কিন্তু প্রতিবেশী জনপদ বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে; এই তিনটি জনপদেই অসুর বুলি প্রচলিত ছিল, তাহাও বলা হইয়াছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত ‘রুদ্রাক্ষ মাহাত্য’ (ত্ম্য) এবং ‘রূপচিন্তামোণিকোষ’ (‘রূপচিন্তামণিকোষ’; পঞ্চদশ শতক) নামক দুইটি পাণ্ডুলিপিতে শ্ৰীহট্ট এবং হরিকোলা-নামক জনপদ দুইটিকে এক এবং সমার্থক বলা হইয়াছে। রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জুরী-গ্রন্থে (নবম শতক) হরিকেলি-জনপদের নারীদের খুব স্তুতিবাদ করা হইয়াছে, এবং তাহারা পূর্বদেশবাসিনী তাহাও ইঙ্গিত করা হইয়াছে। ‘ডাকার্ণব’-গ্রন্থে বর্ণিত চৌষট্টিটি তান্ত্রিক পীঠের একটি পীঠ হারিকেল, এবং এই হরিকেল টিক্কর, খাড়ি, রাঢ় এবং বঙ্গালদেশ হইতে পৃথক। হরিকেলদেশে বৌদ্ধ দেবতা লোকনাথের একটি মন্দিরও বোধহয় ছিল। টিক্কর ‘রামচরিত’ কাব্যের ঢেক্করীয়-ঢেকুরী, কাটোয়ার কাছে, বর্ধমান জেলায়। শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতে শ্ৰীচন্দ্রের পিতা ত্ৰৈলোক্যচন্দ্ৰদেবকে আগে হরিকেল এবং পরে চন্দ্ৰদ্বীপেরও (বাখরগঞ্জ) রাজা বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে। অনুমান হয়, হরিকেল চন্দ্ৰদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চলের সংলগ্ন ছিল। কান্তিদেবের চট্টগ্রাম-লিপিতে হরিকেলকে একটি মণ্ডল বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে। এইসব সাক্ষ্য প্রমাণ হইতে মনে হয়, হরিকেল সপ্তম-অষ্টম শতক হইতে দশম-একাদশ শতক পর্যন্ত বঙ্গ (চন্দ্ৰদ্বীপ ও বঙ্গে) এবং সমতটের সংলগ্ন কিন্তু স্বতন্ত্র রাজ্য ছিল, কিন্তু ত্ৰৈলোক্যচন্দ্রের চন্দ্ৰস্বীপ অধিকারের-পর হইতেই হরিকেলকে মোটামুটি বঙ্গের অর্ন্তভুক্ত বলিয়া গণনা করা হয়। “ডাকার্ণব এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি-দুইটির সাক্ষ্য একত্ৰ করিলে হরিকেল বা হরিকোলা যে শ্ৰীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাহা স্বীকার করিতে আপত্তি হইবার কারণ নাই। আর কাস্তিদেবের লিপি সাক্ষ্যে মনে হয়, সমসাময়িক কালে চট্টগ্রামও হরিকেল-অন্তর্ভুক্ত থাকা কিছু বিচিত্র নয়। শ্ৰীহট্ট চৌষট্টি তান্ত্রিক পীঠের অন্যতম পীঠ। দ্বাদশ শতকে গুজরাতে বসিয়া হেমচন্দ্র যখন তাহার অভিধান লিখিতেছিলেন তখন তাহার পক্ষে বঙ্গ এবং হরিকেল সমার্থক বলা হয়তো খুব অন্যায় হয় নাই। তাহা ছাড়া, তাহার উক্তি একটু শিথিলভাবেই প্রযোজ্য, কারণ, চম্পা অঙ্গদেশের একটি অংশ মাত্র, অবশ্য কেন্দ্রীয় অংশ, অথচ তিনি বলিতেছেন, ‘চম্পাস্তু অঙ্গাঃ’। হরিকেলও সেই হিসাবে বঙ্গের অংশ মাত্র, অবশ্যই রাজা ত্ৰৈলোক্যচন্দ্র দেবের রাজ্যের আদিকেন্দ্র; সে ক্ষেত্রেও তিনি বলিতেছেন, “বঙ্গাস্তু হরিকেলিয়াঃ”। একটু শিথিলভাবে বলা, সন্দেহ কী!
চন্দ্ৰদ্বীপ
এইমাত্র আমরা শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল-লিপিতে ত্ৰৈলোক্যচন্দ্রদেবের প্রসঙ্গে চন্দ্ৰদ্বীপের উল্লেখ দেখিয়াছি (দশম-একাদশ শতক)। ১০১৫ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি পাণ্ডুলিপিতেও চন্দ্রদ্বীপের তারামূর্তি ও মন্দিরের ইঙ্গিত আছে। বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষদ-লিপিতেও বোধহয় চন্দ্রদ্বীপের উল্লেখ আছে (ত্ৰয়োদশ শতক); এই চন্দ্ৰদ্বীপের ঘাঘরকাট্টিপাটক নিশ্চয়ই ঘাঘরনদীর তীরবর্তী ঘাঘরকাটি-নামক কোনও গ্রাম (বরিশাল জেলার ঝালকাটি প্রভৃতি কাটি-পদান্ত নাম লক্ষণীয়); এই ঘাঘরনদীর তীরেই ফুল্লশ্ৰীগ্রামে মনসার পাঁচালীর কবি বিজয়গুপ্তের (পঞ্চদশ শতক) বাসভূমি ছিল।
“পশ্চিমে ঘাঘর নদী পূর্বে ঘণ্টেশ্বর।
মধ্যে ফুল্লশ্ৰী গ্রাম পণ্ডিত-নগর।
স্থানগুণে যেই জন্মে সেই গুণময়।
হেন ফুল্লশ্ৰী গ্রামে বসতি বিজয়৷”
মধ্যযুগে চন্দ্ৰদ্বীপ সুপ্রসিদ্ধ স্থান। ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের বাকলা পরগনার বাকলা সরকার (বর্তমান বাখরগঞ্জ জেলায়) আর চন্দ্ৰদ্বীপ একই স্থান বলিয়া বহুদিনই স্বীকৃত হইয়াছে। এই চন্দ্ৰদ্বীপ বা বাখরগঞ্জ অঞ্চল যে অন্তত ত্ৰয়োদশ শতকে বঙ্গের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহা তো আগেই দেখিয়াছি।
সমতট
সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ স্তম্ভলিপিতে (চতুর্থ শতক) ডবাক-নেপাল–কর্তৃপুর-কামরূপের সঙ্গে, এবং বরাহমিহিরের (ষষ্ঠ শতক) ‘বৃহৎ-সংহিতায় পুণ্ড্র-তাম্রলিপ্তক–বর্ধমান-বঙ্গের সঙ্গে, সমতট-নামে একটি জনপদের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যাইতেছে। সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী পাঠে মনে হয়, সমতট ছিল কামরূপের দক্ষিণে। এই শতকেরই শেষাশেষি ইৎসিঙ সমতট রাজভটি-নামে এক রাজার উল্লেখ করিতেছেন; রাজভটি এবং আম্রফপুর পট্টোলীর (সপ্তম শতক) রাজরাজীভট্ট একই ব্যক্তি বলিয়া বহুদিন পণ্ডিতসমাজে স্বীকৃত হইয়াছেন। রাজরাজ্যভট্টের অন্যতম রাজধানী ছিল কর্মান্ত বা ত্রিপুরা জেলার বড়োকামতা। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী পাঠে মনে হয়, মধ্য-বাঙলার অন্তত কিয়দংশ এই সমতটের অংশ ছিল। অথচ, বর্তমান ত্রিপুরাও যে সমতটেরই অংশ ছিল, সপ্তম হইতে আরম্ভ করিয়া দ্বাদশ শতক পর্যন্ত, তাহা অনস্বীকার্য; এ সম্বন্ধে সাক্ষ্যপ্রমাণ সুপ্রচুর। সপ্তম শতকের কথা বলিয়াছি। দশম শতকে প্রথম মহীপালের রাজত্বের তৃতীয় সম্বৎসরে নির্মিত এবং ত্রিপুরা জেলার বাঘাউরাগ্রামের প্রাপ্ত মূর্তিলিপি, আনুমানিক একাদশ-দ্বাদশ শতকের একটি চিত্রিত পাণ্ডুলিপিতে “চম্পিতলা লোকনাথ সমতটে অরিষষ্টান”-উক্তি (চম্পিতলা বর্তমান ত্রিপুরায়), ১২৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দের দামোদর দেবের অপ্রকাশিত মোহার পটোলী ইত্যাদির সাক্ষোর ইঙ্গিত হইতে মনে হয়, ত্রিপুরা জেলাই ছিল সমতটের প্রধান কেন্দ্ৰ।
পট্টিকেরা
এই কেন্দ্ৰস্থলটি যে একাদশ হইতে ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত পট্টিকেরা-রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে ‘অষ্টসাহস্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতা’র একটি পাণ্ডুলিপিতে (১০১৫ খ্ৰীষ্টাব্দ; চুণ্ডাদেবীর ছবির নিচে “পট্টিকেরে চুণ্ডাবর ভবনে চুণ্ডা”-পরিচয় দ্রষ্টব্য; এই চুণ্ডাবর ভবন ও চুণ্ডাদেবীর সঙ্গে বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার চুন্টটাগ্রামের একটু যোগ আছে বলিয়া মনে হইতেছে), ব্ৰহ্মদেশীয় রাজবৃত্ত হিমনান গ্রন্থে, এবং ১২২০ খ্ৰীষ্টাব্দের রণবঙ্কমল্ল শ্ৰীহরিকালদেবের একটি লিপিতে। কিন্তু, অন্তত দ্বাদশ শতকে সমতটের পশ্চিম সীমা বোধহয় মধ্য-বঙ্গ অতিক্রম করিয়া একেবারে বর্তমান চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা (প্রাচীন খাড়িমণ্ডল) পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। বিজয়সেনের বারাকপুর পট্রেলীতে দেখিতেছি, খাড়িমণ্ডলের ভূমির পরিমাপ করা হইতেছে। ‘সমতাটিয় নলেন। সেন-লিপিগুলিতে ভূমিপরিমাপের যে অভ্যাসের পরিচয় আমরা পাই তাহাতে মনে হয়, যে ভূখণ্ড যে জনপদের অন্তর্ভুক্ত সেই জনপদে ব্যবহৃত নলেই ভূখণ্ডের পরিমাপ করা হইত। সেইজন্য মনে হয়, খাড়িমণ্ডল তখন সমতটেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল। এরূপ হওয়া কিছুতেই অস্বাভাবিক নয়, অসম্ভব তো নয়ই। সমতটের অর্থই হইতেছে তটের সঙ্গে যাহা সমান, অর্থাৎ সমুদ্রশায়ী নিম্নদেশ। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীর হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে মেঘনা-মোহনা পর্যন্ত সমুদ্রশায়ী ভূখণ্ডকেই বোধহয় বলা হইত সমতট, যাহা মুসলমান ঐতিহাসিকদের এবং মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের ভাটি, তারনাথের বাটি। যাহা হউক ত্রিপুরা ও মধ্য-বঙ্গ –যে বঙ্গেরই অন্তর্ভুক্ত, তাহা তো আমরা আগেই দেখিয়াছি।
নারায়ণপালদেবের ভাগলপুর-শাসনে সৎসমতটজন্মা শুভদাসপুত্ৰ শ্ৰীমান সংখদাস নামে এক শিল্পীর উল্লেখ আছে; সৎসমতট কোন জায়গা তাহা নির্ণয় করা কঠিন, তবে নিশ্চয়ই সমতট-সম্পূক্ত কোনও স্থান। অথবা, সৎ শুধু সমতটের একটি বিশেষণ মাত্র।
বঙ্গাল
একাদশ শতক হইতে প্রাচীন বঙ্গের একটি বিভাগের নূতন একটি নাম পাইতেছি, বঙ্গাল। বিজ্জল কলচুর্যের অবলুর লিপি, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপি এবং আরও কয়েকটি দক্ষিণী লিপিতে প্রথম বঙ্গালদেশের নামের উল্লেখ দেখিতেছি। অবলুর লিপি এবং আরও অন্তত দুটি দক্ষিণী লিপিতে বঙ্গ ও বঙ্গাল দুটি জনপদই একই সঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে। এ অনুমান স্বাভাবিক যে, বঙ্গ ও বঙ্গল একাদশ শতকে দুই পৃথক জনপদ ছিল। পরেও ইহাদের পৃথকভাবেই গণ্য করা হইত। নয়চন্দ্র সূরীর “হাম্মির মহাকাব্য (পঞ্চদশ শতক) এবং সামশ-ই-সিরাজ আফিফা -র তারিখ-ই-ফিরুজস্যহী”-গ্রন্থেও এই দুই জনপদকে পৃথক ভাবে গণ্য করা হইয়াছে। কিন্তু, এই একাদশ শতকেরই রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপি পাঠে মনে হয়, চোল সৈন্য দণ্ডভুক্তি (তাম্রলিপ্তি অঞ্চল, বর্তমান দাতন) ও তককণ লাঢ় (দক্ষিণ-রাঢ়) জয় করিবার পর বঙ্গালদেশের রাজা গোবিন্দচন্দ্ৰকে পলায়নপর করেন; বঙ্গের কোনও উল্লেখ এই লিপিতে নাই। স্বতঃই অনুমান হয়, দক্ষিণ-রাঢ়ের পরই ছিল, বঙ্গলদেশ, এবং এই দুই দেশের মধ্যসীমা ছিল বোধহয় গঙ্গা-ভাগীরথী। রাজা গোবিন্দচন্দ্ৰ যে বংশের রাজা সেই বংশ যে হরিকেল-ত্রিপুরা চন্দ্ৰদ্বীপের অধিপতি ছিলেন, এ তথ্য ঐতিহাসিকদের কাছে সুবিদিত। বিক্রমপুর অঞ্চলেও গোবিন্দ চন্দ্রের অন্তত দুইটি লিপি প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে এবং এই অঞ্চলও গোবিন্দচন্দ্রের রাজ্যভুক্ত ছিল। দেখা যাইতেছে, একাদশ শতকে বঙ্গালদেশ বলিতে প্রায় সমস্ত পূর্ব-বঙ্গ এবং দক্ষিণ-বঙ্গের সমুদ্রতটশায়ী সমস্ত দেশখণ্ডকে বুঝাইত। ইহার সম্পূর্ণ না হউক কতক অংশকে যে সমতট বলা হইত, তাহা তো আগেই দেখিয়াছি। চন্দ্ৰদ্বীপ-হরিকেলও তখন বঙ্গালদেশেরই অংশ। দ্বাদশ শতকে না হউক, ত্ৰয়োদশ শতকে এইসব অংশই আবার বঙ্গের। বিক্রমপুর এবং নাব্যভাগের অন্তর্গত। মানিকচন্দ্র রাজার গানের “ভাটি হইতে আইল বাঙ্গাল লম্বা লম্বা দাড়ি” পদে অনুমান হয়, ভাটি ও বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশ এক সময়ে প্রায় সমার্থকই ছিল। কিন্তু বঙ্গাল বা বাঙ্গালদেশের কেন্দ্ৰস্থান বোধহয় ছিল পূর্ববঙ্গে। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষদ -লিপিতে রামসিদ্ধি পাটকের দক্ষিণে বাঙ্গালবড়া-নামে একখণ্ড ভূমির উল্লেখ আছে। রামসিদ্ধি পাটক যে বর্তমান বাখরগঞ্জ জেলার গৌরনদী অঞ্চলের একটি গ্রাম তাহা এখন স্বীকৃত এবং আগেই তাহা উল্লেখও করিয়াছি। বাঙ্গালিবাড়াও বাখরগঞ্জ জেলার কোনও স্থান হওয়াই স্বাভাবিক। Gastaldi-র (১৫৬১) নকশায় Bengala-র অবস্থিতি যেন এই অঞ্চলেই দেখান হইয়াছে; কিন্তু ষোড়শ শতক হইতে যতো নকশা প্রায় প্রত্যেকটিতেই দেখিতেছি Bengala-র অবস্থান আরও পূর্বদিকে। এই Bengala-বন্দর যে কোন বন্দর তাহা বলা কঠিন; কেহ বলেন চট্টগ্রাম, কেহ বলেন প্রাচীন ঢাকা। ঢাকা শহরে বাঙ্গালাবাজার এখনও প্রসিদ্ধ পল্লী ও বাজার; বাঙ্গালাবাজার মধ্যযুগীয় Bengala-বন্দরের স্মৃতি বহন করা অসম্ভব নয়। ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’-গ্রন্থে (সংকলন কাল ১২০৬; সংকলন-কর্তা শ্ৰীধর দাস) জনৈক অজ্ঞাতনামা বঙ্গল=বাঙ্গাল=পূর্ববঙ্গীয় কবির রচিত একটি গঙ্গাস্তোত্র স্থান পাইয়াছে। এই কবি নিজের বাণীকে গঙ্গার সহিত উপমিত করিয়াছেন। উপমাচাতুর্যে স্তোত্রটি এত সুন্দর যে, বঙ্গ-বাঙ্গাল প্রসঙ্গে ইহা উদ্ধৃত করিবার লোভ সংবরণ করা কঠিন :
ঘনরসময়ী গভীরা বক্রিম-সুভগোপজীবিত কবিভিঃ।
অবগাঢ়া চ পুনীতে গঙ্গা বঙ্গাল-বাণী চ।—বঙ্গালস্য। (সদুক্তিকর্ণামৃত, ৫।৩১৷২)
পুণ্ড্র
পুণ্ড্রজনদের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণে, এবং তারপরে বোধায়ন-ধর্মসূত্রে। প্রথমোক্ত গ্রন্থের মতে ইহারা আর্যভূমির প্রাচ্য-প্রত্যন্তদেশের দস্যু কোমদের অন্যতম; দ্বিতীয় গ্রন্থের মতে ইহারা সংকীর্ণযোনী, অপবিত্র; বঙ্গ এবং কলিঙ্গাজনদের ইহারা প্রতিবেশী। ‘ঐতরেয়-ব্ৰাহ্মণের শুনঃশেপ-আখ্যানের এই উল্লেখে দেখা যায়, পুণ্ড্রারা অন্ধ, শবর, পুলিন্দ ও মুতিব কোমদের সংলগ্ন এবং আত্মীয় কোম। এই ধরনের একটি গল্প ‘মহাভারতের আদিপর্বে আছে, একাধিক পুরাণেও আছে; সেখানে কিন্তু পুণ্ড্রারা অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ এবং সুহ্মদের ঘনিষ্ঠ জ্ঞাতি। মানবধর্মশাস্ত্ৰে পুণ্ড্রদের বলা হইয়াছে ব্রাত্য ক্ষত্রিয়, যদিও “মহাভারতের সভাপর্বে বঙ্গ ও পুণ্ড্র উভয় কোমকেই শুদ্ধজাত ক্ষত্ৰিয় বলিয়া বর্ণনা করা হইয়াছে। কৰ্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমের যুদ্ধ এবং দিগ্বিজয় প্রসঙ্গেও মহাভারতে পুণ্ড্রকৌমের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। কৰ্ণ সুহ্ম, বঙ্গ এবং পুণ্ড্রদের পরাজিত করিয়াছিলেন এবং বঙ্গ ও অঙ্গকে একটি শাসন-বিষয়ে পরিণত করিয়া নিজে তাহার অধ্যক্ষ হইয়াছিলেন। কৃষ্ণও একবার বঙ্গ ও পুণ্ড্রদের পরাজিত করিয়াছিলেন। কিন্তু, ভীমের দিগ্বিজয়ই সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি মুদগগিরির (মুঙ্গের) রাজাকে নিহত করিয়া প্রতাপশালী পুণ্ড্ররাজ ও কোশীনদীর তীরবর্তী অন্য একজন ভূপালকে পরাভূত করেন, এবং তাহার পর বঙ্গরাজকে আক্রমণ করেন। যাহাই হউক, উপরোক্ত উল্লেখগুলি হইতে বুঝা যাইতেছে, পুণ্ড্রদের জনপদ অঙ্গ, বঙ্গ এবং সুহ্ম কোমদের জনপদের সংলগ্ন, এবং হয়তো ইহারা সকলেই একই নিবগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, এই জনপদের অবস্থান মুদগগিরি বা মুঙ্গেরের পূর্বদিকে এবং কোশীতীর-সংলগ্ন। জৈনদের অন্যতম প্রাচীন গ্রন্থ ‘কল্পসূত্রে গোদাসগণ-নামীয় জৈন সন্ন্যাসীদের তিন-তিনটি শাখার উল্লেখ আছে; তাম্রলিপ্তি শাখা, কোটিবর্ষ শাখা, পুণ্ড্রবর্ধন শাখা। এই তিনটি শাখার নামই বাঙলার দুইটি জনপদ এবং একটি নগর হইতে উদ্ভূত। কোটিবর্ষ পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত প্রসিদ্ধ নগর। খ্ৰীষ্টপূর্ব আনুমানিক দ্বিতীয় শতকের মহাস্থান-ব্ৰাক্ষী লিপিতে এক পুন্দনগল বা পুণ্ড্রনগরের উল্লেখ আছে। এই পুন্দনগলই বোধহয় ছিল তদানীন্তন পুণ্ড্রের রাজধানী বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থান, যাহার পুরাতন ধ্বংসাবশেষ ঘেষিয়া এখনও করতোয়ার ক্ষীণধারা বহমান। এই করতোয়ারই তীৰ্থমহিমা ‘মহাভারতে’র বনপর্বের তীর্থযাত্রা অধ্যায়ে উল্লিখিত হইয়াছে। ‘লঘুভারতে’র কথায় “বৃহৎপরিসরা পুণ্যা করতোয়া মহানদী”।
পুণ্ড্রবর্ধন
এইসব প্রাচীন সাক্ষ্য পরবর্তী সাক্ষ্যদ্বারাও সমর্থিত হইতেছে। ক্রমবর্ধমান সমৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুণ্ড্র পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে পুণ্ড্রবর্ধনে রূপান্তরিত হইয়াছে, এবং গুপ্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান ভুক্তিতে পরিণত হইয়াছে। ধনাইদহ, বৈগ্রাম, পাহাড়পুর এবং দামোদরপুর, তাম্রপটোলী কয়টিতে এবং য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণে এই পুণ্ড্রবর্ধন নামই পাওয়া যাইতেছে। উপরোক্ত পট্টোলীগুলিতে অ্যালিখিত বিভিন্ন স্থানের নাম হইতে এ তথ্য আজ নিঃসংশয় যে, তদানীন্তন পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তি অন্তত বগুড়া-দিনাজপুর এবং রাজশাহী জেলা জুড়িয়া বিস্তৃত ছিল। মোটামুটি সমস্ত উত্তরবঙ্গই বোধহয় ছিল পুণ্ড্রবর্ধনের অধীন, একেবারে রাজমহল-গঙ্গা-ভাগীরথী তীর হইতে আরম্ভ করিয়া করতোয়া পর্যন্ত। কারণ, য়ুয়ান-চোয়াঙ কাজঙ্গল হইতে আসিয়াছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনে এবং করতোয়া পার হইয়া— গিয়াছিলেন কামরূপ। কজঙ্গল এবং করতোয়া-মধ্যবর্তী ভূভাগই তাহা হইলে পুণ্ড্রবর্ধন; উত্তরে ‘হিমবচ্ছিখর’; দক্ষিণে সীমা কালে কালে বিভিন্ন।
পরবর্তীকালে পৌণ্ড্রভুক্তি, পুণ্ড্র বা পৌণ্ড্রবর্ধনভূক্তির রাষ্ট্রসীমা উত্তরোত্তর বাড়িয়াই গিয়াছে। ধর্মপালের (অষ্টম শতক) খালিমপুর-লিপিতেই দেখিতেছি পুণ্ড্রবর্ধনান্তর্গত ব্যাঘ্রতটীমণ্ডলের উল্লেখ। এই ব্যাঘ্রতটীমণ্ডল যে দক্ষিণ-সমুদ্রতীরবর্তী ব্যাঘ্ৰ্যাধুষিত বনময় প্রদেশ হওয়া অসম্ভব নয়, সে কথা আগেই বলিয়াছি। সেন-আমলে দেখিতেছি পুণ্ড্রবর্ধনের দক্ষিণতম সীমা পশ্চিম দিকে খাড়িবিষয়—খাড়িমণ্ডল (বর্তমান খাড়ি পরগনা, ২৪ পরগনা), অন্যদিকে ঢাকা-বাখরগঞ্জের সমুদ্রতীর পর্যন্ত। বঙ্গের নাব্য এবং বিক্রমপুর ভাগও তখন পুণ্ড্রবর্ধনের অন্তর্গত। সদ্যোক্ত খাড়ি নিশ্চয়ই ভাগীরথীর পূর্ব তীরের (পূর্ব) খাড়ি বা ১১৯৬ খ্ৰীষ্টাব্দের ডোম্মনপালের পট্টোলীর পূর্ব-খাটিকা। কারণ, লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর-পট্টোলীতে পশ্চিম-খাটিকারও উল্লেখ পাইতেছি; এই পশ্চিম-খাটিকা বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত, ভাগীরথীর পশ্চিমতীরে। রাঢ়দেশের কোনও অঞ্চল বোধহয় কখনও পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্ভুক্ত হয় নাই। পশ্চিম-খাটিকার অন্তর্গত বেতডচতুরক। বর্তমান হাওড়া, জেলার বেতড়ে পরিণত হইয়াছে। বেতড় ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে।
বরেন্দ্র, বরেন্দ্রী
পুণ্ড্রবর্ধনের কেন্দ্র বা হৃদয়স্থানের একটি নূতন নাম পাইতেছি। দশম শতক হইতে; এ নাম বরেন্দ্র অথবা বরেন্দ্রী। ৯৬৭ খ্ৰীষ্টাব্দের একটি দক্ষিণী লিপিতে ‘বারেন্দ্ৰদ্যুতিকারিণী এবং ‘গৌড়চূড়ামণি নামক জনৈক ব্ৰাহ্মণের উল্লেখ আছে। কিন্তু প্ৰসিদ্ধতম উল্লেখ সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিত’ কাব্যের কবি-প্রশস্তিতে, এবং গায়াড় তুঙ্গদেবের তালচের পট্টোলীতে। কবি সন্ধ্যােকর বরেন্দ্রীকে পালরাজাদের জনকভূ অর্থাৎ পিতৃভূমি বলিয়া ইঙ্গিত করিয়াছেন, এবং গঙ্গা-করতোয়ার মধ্যে সিলিমপুর-শিলালিপি, তৰ্পণদীঘি এবং মাধ্যাইনগর-পট্টোলী তিনটিতে স্পষ্ট উল্লিখিত আছে যে, বরেন্দ্রী পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্ভুক্ত ছিল। সেন রাজাদের পট্টোলীগুলিতে বরেন্দ্রীর অন্তর্গত স্থানগুলির অবস্থিতি হইতে এ অনুমান নিঃসংশয়ে করা যায় যে, বর্তমান বগুড়া-দিনাজপুর ও রাজশাহী জেলা, এবং হয়তো পাবনাও (পদুম্বা?) প্রাচীন বরেন্দ্রীর বর্তমান প্রতিনিধি৷ বরেন্দ্রীই মধ্যযুগীয় মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ, তবে বরিন্দ প্রাচীন বরেন্দ্রী অপেক্ষা সংকীর্ণতর বলিয়া মনে হয়। ‘তবাকাত-ই-নাসিরী”-গ্রন্থে গঙ্গার পর্বতীরবর্তী এবং লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের একটি অংশ মাত্র বলা হইয়াছে। এই গ্রন্থের মতে লক্ষ্মণাবতী রাজ্যের দুই বিভাগ গঙ্গার দুই তীরে; পশ্চিমে রাল (=রাঢ়), পূর্বে বরিন্দ (=বরেন্দ্রী বা বরেন্দ্র)। প্রাচীন বাঙলার আর একটি বিভাগে লক্ষ্মণসেনের বংশধরেরা তখনও (অর্থাৎ, ১২৪২-৪৫ খ্ৰীষ্টাব্দের মিনহাজের লক্ষ্মণাবতী প্রবাসকালে) রাজত্ব করিতেছিলেন; এই বিভাগটির নাম বঙ্গ (=বঙ্গ)। যাহা হউক, মধ্যযুগীয় সাহিত্য, ইতিহাস এবং কুলজী গ্রন্থে বরেন্দ্র-বরেন্দ্রীর উল্লেখ প্রচুর; লোকস্মৃতিতেও বরেন্দ্র এবং বরেন্দ্রীর ঐতিহ্য বরাবর জাগরূক ছিল। ইহাদের ইঙ্গিতেও বরেন্দ্রী উত্তরবঙ্গের কেন্দ্ৰস্থলে।
রাঢ়া
রাঢ়া-জনপদের প্রাচীনতম উল্লেখ পাইতেছি প্রাচীন জৈনগ্রন্থ ‘আয়ারাঙ্গ’ বা ‘আচারাঙ্গ’ সূত্রে মহাবীর তাঁহার কয়েকজন শিষ্যসহ রাঢ়া-জনপদে আসিয়াছিলেন বা ধর্মপ্রচারের জন্য (খ্ৰীঃ পূঃ ষষ্ঠ শতক); এই জনপদ তখন পথবিহীন, আচারবিহীন, এবং লোকেরাও একটু নিষ্ঠুর ও রূঢ় প্রকৃতির। তাঁহারা এইসব অহিংস যতিদের পিছনে কুকুর লেলাইয়া দিয়াছিল। জৈন ‘প্রজ্ঞাপনা’-গ্রন্থে রাঢ় ও বঙ্গজনদের একত্র গ্রথিত করিয়া উভয়কেই আর্য বলা হইয়াছে। কোটিবর্ষ (বা পরবর্তী কোটিবৰ্ষ) ছিল তাঁহাদের রাজধানী। কোটিবর্ষ দিনাজপুর জেলায়, এবং দামোদরপুর-পট্টেলীর (পঞ্চম-ষষ্ঠ শতক) মতে কোটিবর্ষ পুণ্ড্রবর্ধনভূক্তির অন্তর্গত; পাল-আমলেও তাঁহাই। ‘আচারাঙ্গ সূত্রে রাঢ়া-জনপদের দুইটি বিভাগ : বজ্জ বা বজাতৃভূমি, সুবভি বা সুহ্মভূমি। বজ্রভূমিতে জৈন সন্ন্যাসীদের অপরিস্কৃত নিকৃষ্ট খাদ্য খাইয়া দিন কটাইতে হইয়াছিল। সিংহলী পালিগ্রন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশ-কথিত বিজয়সিংহের কাহিনী সুবিদিত। বঙ্গরাজ সীহরাহু (সিংহবাহু) লাড়দেশে সীহপূর-নামে এক নগরের পত্তন করিয়াছিলেন বলিয়া এই কাহিনীতে উল্লিখিত আছে। কেহ কেহ বলেন, এই লাড়দেশ কাথিয়াবাড়ি অঞ্চলের প্রাচীন লাটদেশ, এবং সীহপুর বর্তমান সীহোর। কাহারও মতে লাড়দেশ প্রাচীন লাঢ় বা রাঢ়-জনপদ এবং সীহপুর বর্তমান হুগলী জেলার সিঙ্গুর। সীহবাহু লাড়দেশে নগর পত্তন করিবার সময় বঙ্গ-জনপদেরই রাজা ছিলেন। বঙ্গের সঙ্গে লাড়ের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ এবং নৈকট্য দেখিয়া মনে হয়, লাড়দেশে বঙ্গের রাঢ়দেশ হওয়া অসম্ভব নয়। রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জরী-গ্রন্থে রাঢ়া-জনপদের সৌন্দর্যের উল্লেখ আছে; হলায়ুধের অভিধান-গ্রন্থেও অনুরূপ উল্লেখ পাওয়া যায়।
সুহ্মভূমি
রাঢ়-জনপদের বিভাগের মধ্যে সুবভ=সুহ্মবিভাগ সমধিক প্রসিদ্ধ এবং সম্ভবত প্রাচীন। সুহ্ম-জনদের উল্লেখ আছে ‘মহাভারতে, কর্ণ ও ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে। কর্ণদেব সুহ্ম, পুণ্ড্র ও বঙ্গজনদের যুদ্ধে পরাজিত করিয়াছিলেন। ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গেও ভীমকর্তৃক মুদগগিরি, পুণ্ড্র, বঙ্গ, তাম্রলিপ্তি, এবং সুহ্মজন ও রাজাদের পরাজয়ের কথা আছে। ‘দশকুমারচরিত’-গ্ৰন্থ কিন্তু সুহ্ম ও তাম্রলিপ্তিকে পৃথক জনপদ বলিতেছে না, বরং তাম্রলিপ্তিকে সুহ্মের অন্তৰ্গত বলিয়া বলিতেছে। রঘুবংশে রঘুর দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে মহোদধির তালিবনশ্যামপকণ্ঠে সুহ্মদের পরাজয়ের উল্লেখ আছে। এই শ্লোকদ্বয়ের পূর্বেই আর একটি শ্লোক আছে
সে সেনা মহতীং কর্যন পূর্বসাগর গামিনীম।
বভৌ হরজটাভ্ৰষ্টাং গঙ্গামিব ভাগীরথঃ। (৪।৩২)
এই শ্লোকটির ব্যঞ্জনা হইতে মনে হয়, রঘু গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম উপকূল বাহিয়া দক্ষিণসাগরের দিকে অগ্রসর হইয়াছিলেন, এবং ইহারই দক্ষিণ অংশের ভূভাগ সুহ্ম-নামে পরিচিত ছিল। ধোয়ী কবির ‘পবনদূতেও গঙ্গা-তীরবর্তী সুহ্মের উল্লেখ আছে এবং এই দেশে গঙ্গা-যমুনা সংগমে ত্রিবেণী অতিক্ৰম করিয়া লক্ষণসেনের রাজধানী বিজয়পুরের পথের ইঙ্গিত আছে। এই গঙ্গা-যমুনা সংগম ও ত্ৰিবেণী বর্তমান হুগলী জেলায়। এইসব সাক্ষ্য-প্রমাণ হইতে অনুমান করা চলে যে, গঙ্গা-ভাগীরথীর পশ্চিম তীরবর্তী দক্ষিণতম ভূখণ্ড, অর্থাৎ বর্তমান বর্ধমানের দক্ষিণাংশ, হুগলীর বহুলাংশ পশ্চিম এবং হাবড়া জেলাই প্রাচীন সুহ্ম-জনপদ; মোটামুটি ইহাই পরবর্তী কালের দক্ষিণ-রাঢ়। ‘মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠ অবশ্য বলিতেছেন, সুহ্ম এবং রাঢ়া এক এবং সমার্থক। হয়তো কখনও সুহ্মজনপদের প্রভাবসীমা সমস্ত রাঢ়দেশেই বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল, যেমন ‘দশকুমারচরিত’-মতে এক সময় সেই প্রভাব তাম্রলিপ্তিতেও বিস্তৃত হইয়াছিল; কিন্তু সাধারণত সুহ্মভূমি রাঢ়ভূমির দক্ষিণতম অংশ বলিয়াই পরিচিত ছিল। বৌদ্ধ পালি গ্রন্থ “সংযুক্ত-নিকায় এবং ‘তেলপত্ত-জাতকেও সুমভি বা সূহ্মাজনদের উল্লেখ আছে, কিন্তু তাহাদের অবস্থিতির কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায় না।
প্রসুহ্ম, সুহ্মোত্তর, ব্ৰহ্ম, ব্ৰহ্মোত্তর, বজ্জভূমি
মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে সুহ্মজন এবং সমুদ্রশায়ী অন্যান্য স্লেচ্ছদের সঙ্গে প্রসুহ্ম-নামীয় আর একটি কোমের উল্লেখ আছে। প্রাচীন সাহিত্যে সুহ্ম-জনপদের উল্লেখ বারবার পাওয়া যায়, এবং সঙ্গে সঙ্গে সুহ্ম।জন-সম্পূক্ত আর একটি কোমের নামও শোনা যায়; তাহার নাম ব্ৰহ্ম বা ব্রহ্মোত্তর। ব্রহ্মোত্তর খুব সম্ভব ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের বরমহত্তর। কেহ কেহ মনে করেন ব্রহ্মোত্তর পাঠ যথার্থই সুহ্মোত্তর (সুহ্মের উত্তরে যে জনপদ) হওয়া উচিত। প্রসুহ্ম এবং সুহ্মোত্তর কোন জনপদ তাহা নিশ্চয়ই করিয়া বলিবার উপায় নাই; তবে অনুমান হয়, দুইটি নামই একই জনপদের দ্যোতক, এবং এই জনপদটি সুহ্মজনপদের উত্তরে, ‘আচারঙ্গ-সূত্রে যে ভূমিকে বলা হইয়াছে বজজ বা বর্জভূমি, অর্থাৎ রাঢ়ের উত্তরাংশ। এই বজাতৃভূমিই বোধহয় “কাব্যমীমাংসা’ এবং “পবনদূত’-গ্রন্থের ব্ৰহ্ম (ভূমি) বা ব্রহ্মোত্র (সমাসবদ্ধ ব্ৰহ্ম ও উত্তর) জনপদ। এই ব্ৰহ্ম যে রাঢ়েরই একটি অংশ তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় “পবনদূতে; এই গ্রন্থে সুহ্ম ও ব্ৰহ্ম দুটি জনপদই গঙ্গার পশ্চিমতীরে অবস্থিত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। শুধু তাঁহাই নয়, ব্ৰহ্ম যে সুহ্মের উত্তরে এবং ত্ৰিবেণী সংগম এবং বিজয়পুর যে ব্ৰহ্মভূমিরই অন্তর্গত তাহাও বলা হইয়াছে। খুব সম্ভব ‘মহাভারতের প্রসুহ্ম এই ব্ৰহ্ম বা ব্ৰহ্মোত্তরেরই নামান্তর মাত্র। ‘মার্কণ্ডেয় পুরাণের ব্রহ্মোত্তর যদি সুহ্মোত্তরও হয় তাহা হইলে তাহারও অর্থ সুহ্মের উত্তরস্থ জনপদ, অর্থাৎ যে-ভূমিকে “কাব্যমীমাংসা’ ও ‘পবনদূতে বলা হইয়াছে ব্ৰহ্ম, আচারাঙ্গ সূত্রে বলা হইয়াছে বাজ, পরবর্তী লিপিতে মোটামুটিভাবে যে দেশকে বলা হইয়াছে উত্তর রাঢ়। যাহাই হউক, রাঢ়দেশে সুহ্মজনপদের উত্তরে যে ব্ৰহ্ম-নামে এক সময়ে একটি জনপদ ছিল এ সম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না।
উত্তর-রাঢ়
‘দিগ্বিজয়প্রকাশ’-গ্রন্থে (ষোড়শ শতক) রাঢ়দেশের দক্ষিণসীমায় পাইতেছি দামোদর-নদ—“দামোদরোত্তরভাগে–রাঢ়দেশঃ প্রকীর্তিতঃ”। হয়তো তখন তাম্রলিপ্তজনপদের উত্তর সীমা ছিল দামোদর পর্যন্ত, কিন্তু পরবর্তী সাক্ষ্য এবং লিপি-প্রমাণ হইতে মনে হয় রাঢ়ের দক্ষিণ সীমা দামোদরের আরও দক্ষিণে বিস্তৃত ছিল। নবম-দশম শতক হইতেই রাঢ়ের দুইটি সুস্পষ্ট বিভাগ জানা যাইতেছে—উত্তর রাঢ় ও দক্ষিণ রাঢ়—প্রচীনতম কালের মোটামুটি বজজ বা ব্ৰহ্মভূমি ও সুহ্মভূমি। রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয়-লিপিতে (একাদশ শতকের প্রথম পাদ) উত্তীর-লাঢ়ম (উত্তর রাঢ়) এবং তাঙ্কণ লাঢ়ম (দক্ষিণ রাঢ়) নাম একসঙ্গেই পাওয়া যাইতেছে।
উত্তর-রাঢ়ের প্রথম উল্লেখ পাইতেছি আনুমানিক নবম শতকের গঙ্গরাজ দেবেন্দ্ৰবৰ্মণের একটি লিপিতে, এবং তারপর একাদশ শতকের রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয়লিপিতে। রাজেন্দ্রচোলের সৈন্য ওড্ডবিষয় (ওড়িয়া) এবং কোশলৈনাডু জয় করিয়া পরে অধিকার
“Tandabutti in whose gardens bees abounded… (land, which be acquired after having destroyed Dharmapala (in) hot battle; Takkanaladam whose fame reached (all) directions, (and which he occupied) after having forcibly attacked Ranasura; Vanagala desa-where the rain water never stopped, (and from which) Govindachandra fled, having descended (from his) male elephant; elephants of rare strength, women and treasure (which he seized) after having pleased to frighten the strong Mahipal on the field of hot battle with the (noise of the) conches (got) from the deep sea. Uttiraladam (on the shore of) the expansive ocean (producing), pearls [অনুবাদান্তর Uttiraladam, as rich in pearis as the ocean, কিংবা Uttiraladam, close to the Sea yielding pearis.) and the Ganga whose waters bearing fragrant flowers dashed against the bathing places.”
রাজা ভোজবৰ্মার বেলাব-লিপিতে উত্তর-রাঢ় এবং তদন্তৰ্গত সিদ্ধলগ্রামের উল্লেখ আছে। সিদ্ধলগ্রাম বর্তমান বীরভূমের অন্তর্গত সিধলগ্রাম। এই সিদ্ধলগ্রামই পণ্ডিত-মন্ত্রী ভট্ট ভবদেবের জন্মভূমি। তথাকথিত ভুবনেশ্বর-লিপিতে ভবদেব ভট্ট তাঁহার জন্মভূমি সিদ্ধলগ্রামের কথা বলিয়াছেন, এবং রাঢ়ের এই অঞ্চল যে অজলা এবং জাঙ্গলময়, তাহাও ইঙ্গিত করিয়াছেন। রাঢ়ের অজলা ও জাঙ্গলময় এই অঞ্চলে তিনি একটি দীঘি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। বল্লালসেনের নৈহাটি-পট্টোলীতেও উত্তর-রাঢ় এবং তদন্তৰ্গত বাল্লহিটুঠা, জলসোথী, খাণ্ডয়িল্লা, অম্বয়িল্লা, এবং মোেলাদণ্ডীগ্রামের উল্লেখ আছে। বাল্লহিটুঠা বর্তমান বর্ধমান জেলার প্রায় উত্তর সীমায় বালুটিয়াগ্রাম (কাটোয়া মহকুমার অন্তৰ্গত নৈহাটির ছয় মাইল পশ্চিমে); জলসোখী মুর্শিদাবাদ জেলার জলসোখীগ্রাম (বালুটিয়ার উত্তরে); খাণ্ডয়িল্লা বর্তমান খারুলিয়া (জলসোথীর দক্ষিণে); অম্বয়িল্লা বর্তমান অম্বলগ্রাম, খারুলিয়ার পূর্ব-দক্ষিণে; মোলদন্তী বর্তমান মুরুণ্ডি (খারুলিয়ার পশ্চিমে) { সব ক’টি গ্রামই বর্তমান বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ জেলার যোগসীমায়। নৈহাটি-লিপি অনুসারে উত্তর-রাঢ় বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত। কিন্তু লক্ষণসেনের আমলে দেখিতেছি উত্তর-রাঢ়মণ্ডল কঙ্কগ্রামভুক্তির অন্তর্গত হইয়া গিয়াছে; শক্তিপুরপট্টোলীতে এই খবর পাওয়া যাইতেছে। এই শাসনে উল্লিখিত উত্তর রাঢ়মণ্ডলের অন্তৰ্গত যে-সব গ্রামের নাম পাওয়া যাইতেছে তাহাতে প্রমাণ হয় যে, বর্তমান মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি মহকুমার অনেকাংশ উত্তর-রাঢ়ের অন্তর্গত ছিল। য়ুয়ান-চোয়াঙের কজঙ্গলও এই উত্তর-রাঢ়ে। “ভবিষ্যপুরাণের ব্ৰহ্মখণ্ড অধ্যায়ে ভাগীরথীর পশ্চিমে রাঢ়ীখণ্ড-জাঙ্গিল নামে এক জনপদ এবং তদন্তৰ্গত বৈদ্যনাথ, বক্ৰেশ্বর, বীরভূমি প্রভৃতি স্থান এবং অজয় প্রভৃতি নদনদীর উল্লেখ আছে। এই রাঢ়ীখণ্ডজঙ্গলও উত্তর-রাঢ়েরই অন্তর্গত বলিয়া মনে না করিবার কোনও কারণ নাই। অনুমান হয়, বর্ধমান মুর্শিদাবাদ জেলার উত্তর-পশ্চিমাংশ অর্থাৎ কান্দি মহকুমা, সমগ্র বীরভূম জেলা (সঁওতালভূমিসহ) এবং বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমার উত্তরাংশ, এই লইয়া উত্তর-রাঢ়। মোটামুটি অজয় নদী এই উত্তর-রাঢ়ের দক্ষিণ সীমা এবং দক্ষিণ-রাঢ়ের উত্তর সীমা। উত্তর রাঢ়ের উত্তর সীমা বোধহয় কোনও সময় গঙ্গা পার হইয়া আরও উত্তরে বিস্তৃত ছিল। জৈন “প্রজ্ঞাপনা’-গ্রন্থে কোড়ীবর্ষ বা কোটিবৰ্ষকে রাঢ়ের অন্তর্গত বলা হইয়াছে, তাহা আগেই উল্লেখ করিয়াছি। ইহারই যেন প্রতিধ্বনি শোনা যাইতেছে ভরতমল্লিকের “চন্দ্ৰপ্ৰভ’-গ্রন্থের “উত্তরগঙ্গ-রাঢ়াম” পদটিতে। কিন্তু, অকাট্য লিপি প্রমাণ এবং ঐতিহাসিক গ্রন্থে গঙ্গা-ভাগীরথীই রাঢ়ের উত্তরতম সীমা, এ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিতে পারে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ ‘তবকাত-ই-নাসিরীর সাক্ষ্য উল্লেখ করা যাইতে পারে।
দক্ষিণ-রাঢ়
রাজেন্দ্রচোলের সৈন্য ওড্ডবিষয় এবং কোশলৈনাডু (দক্ষিণ-কোশল) জয় করিয়া পরে তন্ডবুত্তি (=দন্ডভুক্তি=বর্তমান দাঁতন) অধিকার করিয়াছিল, এবং দন্ডভুক্তির পরেই দক্ষিণ-রাঢ়। দেশগুলির ভৌগোলিক অবস্থিতি সুস্পষ্ট; দন্ডভুক্তি এবং বঙ্গের মধ্যবর্তী জনপদ-রাষ্ট্রেই দক্ষিণ-রাঢ় বা তককণলাঢ়ম। দক্ষিণ-রাঢ়ের প্রাচীনতম উল্লেখ মিলিতেছে বাকপতি মুঞ্জের একটি লিপিতে, এবং শ্ৰীধরাচার্যের ‘ন্যায়কন্দলী’-গ্রন্থে (৯৯১-৯২)। “ন্যায়কন্দলী’-গ্রন্থে আছে ‘আসীদক্ষিণারাঢ়ায়াং দ্বিজানাং ভূরিকর্মণাম। ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্ঠিজনাশ্রয়ঃ’৷ শ্ৰীধরের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন দক্ষিণ-রাঢ়ের অধিপতি গুণরত্নাভরণ কায়স্থ কুলতিলক’ পাদ্ভুদাস। এই পাড়ুদাসই পাণ্ডুভূমি-বিহার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন। কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্ৰবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে (একাদশ-দ্বাদশ শতক) রাঢ়ের এবং একটি দক্ষিণী লিপিতে দক্ষিণ-রাঢ়ের উল্লেখ আছে; কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই এই জনপদটিকে গৌড় বা গৌড়দেশান্তর্গত বলা হইয়াছে। মধ্যপ্রদেশের নিমার জেলান্তর্গত মান্ধাতা অঞ্চলের অমরেশ্বর মন্দিরের একটি লিপিতে, এবং মুকুন্দরামের “চন্ডীমঙ্গল কাব্যেও (১৫৯৩-৯৪) দক্ষিণ-রাঢ়ের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। শ্ৰীধর এবং কৃষ্ণমিশ্র দক্ষিণ-রাঢ়ের দুইটি প্রসিদ্ধ গ্রামের নাম করিতেছেন : ভূরিসৃষ্টি বা ভূরিশ্রেষ্ঠিক এবং নবগ্রাম; আর মুকুন্দরাম বলিতেছেন। দামুনাগ্রামের কথা, যে দামুন্যা বা দামিন্যা ছিল তাহার জন্মভূমি (“সহর সেলিমাবাজ তাহাতে সজ্জনরাজ নিবসে নেউগী গোপীনাথ। তাহার তালুকে বসি দামিন্যায় চাষ-চযি নিবাস পুরুষ ছয় সাত৷”) ভূরিসৃষ্টি বা ভূরিশ্রেষ্ঠিক (যেখানে ছিল অনেক শ্ৰেষ্ঠীর বাসস্থান=ভূরিশ্ৰেষ্ঠী জনাশ্রয়) বর্তমান হাওড়া জেলার ভুরসুট (বা ভূরিশিষ্ট্র বা ভুরসিট)-গ্রাম। নবগ্রাম বর্তমান হুগলী জেলায়, এবং দামুন্যা দামোদরের পশ্চিমে বর্তমান বর্ধমান জেলায়। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, বর্তমান হাওড়া এবং হুগলী ও বর্ধমানের অধিকাংশ দক্ষিণ-রাঢ়ের অন্তর্গত। দ্বাদশ শতকের ওড়িশার চোড়গঙ্গরাজাদের আধিপত্য মিথুনপুর (নিঃসন্দেহে, বর্তমান মেদিনীপুর) পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল, এবং অনন্তবৰ্মন চোড়গঙ্গ গঙ্গাতীরে মন্দার-রাজকে পরাভূত করিয়া তাহার দুর্গনগর আরম্য ধ্বংস করিয়াছিলেন। মিথুনপুর না হউক, মন্দার এবং আরম্য বোধহয় সেই সময় দক্ষিণ-রাঢ়ের অন্তর্গত ছিল। মন্দার নিঃসন্দেহে বর্তমান মন্দারণ বা মদারণ, মধ্যযুগের সরকার মন্দারণ বা গড় মন্দারণ; আরমও বর্তমান আরামবাগ। দুইই বর্তমান হুগলী জেলায়।
বর্ধমানভুক্তি, কঙ্কগ্রামভুক্তি
রাঢ়দেশের দুইটি রাষ্ট্রবিভাগের পরিচয় পাওয়া যায়। ষষ্ঠ শতকের মল্লসরুল-লিপি, দশম শতকের ইর্দা-লিপি, লক্ষ্মণসেনের নৈহাটি ও গোবিন্দপুর-লিপিতে বর্ধমানভুক্তির সাক্ষাৎ মেলে। ইর্দালিপিতে দেখিতেছি, দন্ডভুক্তিমন্ডল অর্থাৎ দীর্তন পর্যন্ত বর্ধমানভুক্তির সীমা বিস্তৃত; কিন্তু পঞ্চম ষষ্ঠ শতকে বোধহয় দক্ষিণে বর্ধমানভুক্তির এত বিস্তার ছিল না; কারণ, বরাহমিহির গৌড়ক, বর্ধমান ও তাম্রলিপ্তক পৃথক পৃথক জনপদ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। পাল ও সেন-আমলে দন্ডভুক্তি-মণ্ডল ছাড়া বর্ধমান-ভূক্তির আরও তিনটি বিভাগ ছিল উত্তর-রাঢ়, দক্ষিণ-রাঢ়, মণ্ডল এবং পশ্চিম-খাটিকা। বর্ধমানভুক্তির অন্যতম রাষ্ট্রবিভাগ হিসাবে দক্ষিণ-রাঢ় মণ্ডলের উল্লেখ কোন লিপিতে নাই, কিন্তু এই মণ্ডলটিও যে বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত ছিল তাহা সহজেই অনুমান করা যাইতে পারে। যাহাই হউক, এই তিনটি জনপদ-রাষ্ট্রের কথা আগেই বলা হইয়াছে। পাল ও সেন-আমল ছাড়া দন্ডভুক্তি সাধারণত তাম্রলিপ্ত জনপদেরই অন্তর্ভুক্ত বলিয়া অনুমিত; সেইজন্য দন্ডভুক্তির কথা তাম্রলিপ্ত প্রসঙ্গেই বলা যাইবে। তবে, এইখানে বলিয়া রাখা চলে যে, ইর্দা-লিপি ছাড়া রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয়-লিপিতে এবং সন্ধ্যাকর নন্দীর “রামচরিতে যথাক্রমে তন্ডবুত্তি=দন্ডভুক্তি ও দন্ডভুক্তি-মণ্ডলের উল্লেখ আছে। দন্ডভুক্তি বর্তমান মেদিনীপুর (প্রাচীন মিথুনপুর) জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম অংশ; বর্তমান দাতন প্রাচীন দন্ডভুক্তির স্মৃতিবহ। পশ্চিম-খাটিকা যে মোটামুটি বর্তমান হাওড়া জেলা, এবং গঙ্গার পশ্চিম তীরে সে ইঙ্গিত তো আগেই করা হইয়াছে। লক্ষ্মণসেনের শক্তিপুর-পট্টোলীতে রাঢ়ের আর একটি বিভাগের খবর পাওয়া যায়; ইহার নাম কঙ্কগ্রামভুক্তি, এবং উত্তর-রাঢ় এই ভুক্তির অন্তর্গত। কঙ্কগ্রাম কাহারও মতে রাজমহল নিকটবর্তী কাকজোল, কাহারও মনে মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার কাগ্রাম। যাহাই হউক শাসনোল্লিখিত স্থানগুলির অবস্থিতি হইতে মনে হয়, বর্তমান মুর্শিদাবাদ এবং বীরভূম জেলার অধিকাংশ এবং সাঁওতাল পরগনারও কিয়দংশ এই কঙ্কগ্রামভুক্তির অন্তর্গত ছিল।
তাম্রলিপ্ত, দন্ডভুক্তি
মহাভারতে ভীমের দিগ্বিজয়-প্রসঙ্গে তাম্রলিপ্তের উল্লেখ সর্বপ্রথম পাওয়া যায়; পুরাণে তো বারবারই এই জনপদটির দেখা মেলে। বঙ্গ, কর্বট ও সুহ্মজনেরা ছিলেন তাহাদের প্রতিবেশী। জৈন ‘কল্পসূত্র’-গ্রন্থে গোদাসগণ-নামীয় জৈন সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের অন্যতম শাখার নাম তাম্রলিপ্তি শাখা। জৈন প্রজ্ঞাপনাগ্রন্থেও তামলিত্তি (তাম্রলিপ্তি) বঙ্গজনদের অধিকারে ছিল বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। দশকুমারচরিত-গ্ৰন্থ দামলিপ্ত (তাম্রলিপ্ত) আবার সুহ্মের অন্তর্গত বলিয়া বর্ণিত হইয়াছে। জাতকের গল্পে, বৌদ্ধগ্রন্থে বারবার তাম্রলিপ্তির উল্লেখ পাওয়া যায় সুবৃহৎ নৌ-বাণিজ্যের কেন্দ্ররূপে। পেরিপ্লাস-গ্রন্থে, টলেমির বিবরণে, ফাহিয়ানায়ুয়ান-চোয়াঙ ও ইৎসিঙের বিবরণে তাম্রলিপ্ত বন্দরের বর্ণনা সুবিদিত। টলেমির সময়ে তাম্রলিপ্ত জনপদের রাজধানীই ছিল তাম্রলিপ্ত (Tamalites) বন্দর; সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ বলিতেছেন, তাম্রলিপ্ত বন্দর সমুদ্রের একটি উপবাহুর তীরে অবস্থিত ছিল (near an inlet of sea)। অষ্টম শতকের পর হইতেই তাম্রলিপ্ত বন্দরের সমৃদ্ধির পতন ঘটে, এবং বোধহয় তাহার আগে সপ্তম শতক হইতেই দন্ডভুক্তিজনপদের নামেই তাম্রলিপ্ত জনপদের পরিচয়। ইহাও হইতে পারে, এই সময় তাম্রলিপ্ত কিছুদিনের জন্য সুহ্মজনপদদ্বারা প্রভাবান্বিত হয়। যাহাই হউক, ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে বরাহমিহির তাম্রলিপ্তকজনপদকে গৌড়ক (মুর্শিদাবাদ-বীরভূম এবং সম্ভবত পশ্চিম-বর্ধমান ও মালদহ) এবং বর্ধমান হইতে পৃথক জনপদ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু সপ্তম শতকে দণ্ডভুক্তি গৌড়-কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কের করতলগত। সম্প্রতি আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর-লিপি দুইটিতে দেখিতেছি, দণ্ডভুক্তি বা দণ্ডভুক্তিদেশ একজন শাসনকতাঁর (সামন্ত-মহারাজ সোমদত্ত এবং মহাপ্ৰতীহার শুভকীর্তি) অধীনে, এবং উৎকলদেশ এই রাষ্ট্রবিভাগের অন্তৰ্গত। দশম শতকের ইর্দা-লিপিতে দন্ডভুক্তিমন্ডল বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত। একাদশ শতকের প্রথম পাদে রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয়-লিপিতে তন্ডবুত্তি বা দন্ডভুক্তি দক্ষিণ-রাঢ়, বঙ্গালদেশ, এবং উত্তর-রাঢ় হইতে পৃথক জনপদ-রাষ্ট্র; দ্বাদশ শতকের মধ্যপাদে আবার এই দন্ডভুক্তি বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত। দন্ডভুক্তির রাজা পালরাজ রামপালের অন্যতম বিশ্বস্ত বন্ধু এবং সহায়ক ছিলেন।
গৌড়
গৌড়পুর-নামক একটি স্থানের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে পাণিনি-সূত্রে; কিন্তু এই গৌড়পুর বর্তমান বঙ্গদেশের কোনও স্থান। কিনা নিঃসংশয়ে বলা যায় না। কৌটিল্য বঙ্গদেশের অনেক জনপদেরই খবরাখবর রাখিতেন; তাহার ‘অর্থশাস্ত্ৰে গৌড়, পুণ্ড্র, বঙ্গ এবং কামরূপে উৎপন্ন অনেক শিল্প ও কৃষিদ্রব্যাদির খবর পাওয়া যায়; অন্যত্র তাহা উল্লিখিত হইয়াছে। পাণিনির টীকাকার পতঞ্জলিও গৌড়দেশের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। তৃতীয়-চতুর্থ শতকে বাৎস্যায়ন গৌড়দেশের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন; গৌড়ের নাগরিকদের বিলাসব্যসন, নারীদের মৃদুবাক্য ও মৃদু অঙ্গের সবিশেষ পরিচয় তাহার ছিল; বঙ্গ এবং পৌণ্ডের সঙ্গেও তঁাহার পরিচয় ছিল। তাহাও যথাস্থানে যথাপ্রসঙ্গে উল্লিখিত হইয়াছে,। পুরাণে এক গৌড়দেশের উল্লেখ আছে (যেমন, “মৎস্যপুরাণে), কিন্তু সে গৌড়দেশ কৌশলীজনপদে বলিয়া অনুমিত হয়। বরাহমিহির (আনুমানিক, ষষ্ঠ শতক) গৌড়ক, পৌণ্ড্র, বঙ্গ, সমতট, বর্ধমান এবং তাম্রলিপ্তক নামে ছয়টি স্বতন্ত্র জনপদের উল্লেখ করিয়াছেৰ্ম্ম। ভাষায় গৌড়ীরীতির খবর পাওয়া যাইতেছে দণ্ডীর কাব্যাদর্শে, রাজশেখরের ‘কাব্যমীমাংসা’য়; বস্তুত, প্রাচীন সাহিত্যে গৌড়ের উল্লেখ সুপ্রচুর। কিন্তু সর্বত্র গৌড়দেশের অবস্থিতির ইঙ্গিত পাওয়া যায় না। বরাহমিহিরের ‘বৃহৎ-সংহিতার উল্লেখ হইতে খানিকটা আভাস অবশ্য পাওয়া, যাইতেছে, এবং সে আভাস যেন মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-পশ্চিম বর্ধমানের দিকে। মুরারির ‘অনৰ্ঘারাঘবে’ (অষ্টম শতক) চম্পা গৌড়জনপদের রাজধানী বলিয়া কথিত হইয়াছে; এই চম্পা কি ভাগলপুর জেলার প্রাচীন চম্পা না মন্দারণ সরকারের অন্তর্গত বর্ধমান-শহরের উত্তর-পশ্চিমে, দামোদরের বামতীরের চম্পানগরী, বলা কঠিন। অষ্টম শতকের শেষার্ধে (ধর্মপালের প্রায় সমসাময়িক) গৌড়ের রাষ্ট্রাধিকার প্রাচীন অঙ্গদেশে বিস্তৃত ছিল ইহা একেবারে অসম্ভব নয়। মুদগগিরি বা মুঙ্গেরে যে একটি পাল-জয়স্কন্ধাবার ছিল তাহা তো সুবিদিত; তীরভুক্তি বা তিরহুতেও একটি ভুক্তি ছিল। কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্ৰবোধচন্দ্রোদয়’ নাটকে রাঢ়া বা রাঢ়াপুরী এবং ভূরিশ্রেষ্ঠিক গৌড়রাষ্ট্রের অন্তর্গত বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। একটি দক্ষিণী লিপিতেও রাঢ়দেশকে গৌড়দেশের অন্তর্ভুক্ত বলা হইয়াছে; কিন্তু যাদবরাজ প্রথম জৈন্তুগির মনগোলি লিপিতে অবার লাল (রাঢ়) এবং গৌল (গৌড়) পৃথক জনপদ বলিয়া ইঙ্গিত করা হইয়াছে। কামসূত্রের টীকাকার যশোধর কিন্তু বলিতেছেন, গৌড়দেশ একেবারে কলিঙ্গ পর্যন্ত বিস্তৃত। ‘ভবিষ্য-পুরাণের মতে গৌড়দেশের উত্তর সীমায় পদ্মা, দক্ষিণ সীমায় বর্ধমান। ত্ৰয়োদশ-চতুর্দশ শতকের কোনও কোনও জৈনগ্রন্থে জানা যায়, বর্তমান মালদহ জেলার প্রাচীন লক্ষ্মণাবতী গৌড়ের অন্তর্গত ছিল। সমসাময়িক মুসলমান ঐতিহাসিকদের ইঙ্গিতও তাঁহাই; বস্তুত, লক্ষ্মণাবতী নগরকেই তাহারা বলিয়াছেন গৌড় এবং এই গৌড় রাঢ়দেশে। মনে রাখা দরকার লক্ষ্মণাবতী-গৌড় তখন গঙ্গার পশ্চিম বা দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছিল; গঙ্গা তখন ঐখানে আরও উত্তর ও পূর্ববাহিনী হইয়া পরে দক্ষিণবাহিনী হইত। “ভবিষ্য-পুরাণ’ বা “ত্রিকাণ্ডশেষ গ্রন্থে গৌড়কে (লক্ষ্মণাবতী নগরী?) যে যথাক্রমে পুণ্ড্র বা বরেন্দ্রীর অন্তর্গত বলা হইয়াছে, তাহা এই কারণেই। শক্তিসংগমতন্ত্রে গৌড়দেশ বঙ্গ হইতে একেবারে ভুবনেশ (ভুবনেশ্বর) পর্যন্ত বিস্তৃত বলিয়া বলা হইয়াছে; ‘কথাসরিৎসাগরে বর্ধমানকে গৌর (= গৌড়)-জনপদের অন্তর্ভুক্ত বলিয়া বলা হইয়াছে। এক গৌড় ছিল কৌশলে (বর্তমান যুক্তপ্রদেশের গোণ্ডণ জেলা)। আর এক গৌড়ের খবর পাওয়া যায় শ্রীহট্ট জেলায়, গৌড়ের রাজার সঙ্গে পীর শাহজালালের যুদ্ধকাহিনী-প্রসঙ্গে। ‘রাজতরঙ্গিণী-গ্রন্থে প্রথম পাওয়া যাইতেছে পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ, এবং পরে একাধিক গ্রন্থে দেখা যায় গৌড়, সারস্বত, কান্যকুব্জ, মিথিলা এবং উৎকল লইয়া পঞ্চগৌড়। পালসম্রাট ধর্মপাল-দেবপালের সময় গৌড়েশ্বরের রাষ্ট্ৰীয় প্রভুত্ব বিস্তারের ইতিহাস এই পঞ্চগৌড় নামটির মধ্যে পাওয়া যাইতেছে বলিয়া মনে করিলে বোধহয় কিছু অন্যায় হয় না। আর এক গৌড়-উপনিবেশের খবর পাওয়া যাইতেছে দক্ষিণ ব্রহ্মের পেগু শহরের নিকটবর্তী কল্যাণী লিপিমালায়; এই লিপিতে গোল বা গৌড়দের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়।
কিন্তু এইসব উল্লেখ ও বিবরণের মধ্যে গৌড়জনপদের সঠিক অবস্থিতি সুস্পষ্ট জানা গেন্স না; শুধু এইটুকু বুঝা গেল, মুর্শিদাবাদ-বীরভূমই এই জনপদের আদি কেন্দ্র; পরে মালদহ এবং বোধহয় বর্ধমানও এই জনপদের সঙ্গে যুক্ত হয়। বর্তমানের এই কয়টি জেলা লইয়াই প্রাচীন গৌড়। এই গৌড়ের রাষ্ট্ৰীয় আধিপত্য যখন যেমন বিস্তৃত হইয়াছে-কখনও কলিঙ্গ, কখনও ভুবনেশ্বর-জনপদসীমাও তখন তেমনই বিস্তারিত হইয়াছে। ধর্মপাল-দেবপালের আমলে ভারতীয় ঐতিহাসিক ও জনসাধারণের পঞ্চমুখে শুনা যাইতেছে পঞ্চগৌড়ের কথা; বাঙলা অর্থই যেন গৌড়।
কর্ণসুবর্ণ
গৌড়ের অবস্থিতি সম্বন্ধে বঙ্গীয় লিপি-প্রমাণ কী আছে দেখা যাইতে পারে; সমসাময়িক ও নিঃসংশয় বিশ্বাসযোগ্য ভিনাপ্রদেশী লিপি এবং ইতিবিবরণও এই সম্পর্কে আলোচ্য। ঈশানবৰ্মণ মৌখরীর হড়াহা লিপিতে (৫৫৪ খ্ৰীষ্টাব্দ) গৌড়জনদের বর্ণনা করা হইয়াছে ‘গৌড়ান। সমুদ্রাশ্রয়ান বলিয়া। এই কথার সমর্থন পাওয়া যায় একাদশ শতকের গুৰ্গি লিপিতে; এই লিপিতে বলা হইয়াছে, “the lord of Gauda lies in the watery fort of the sea’। এই উক্তি হইতে মনে হয়, গৌড়াজনপদের দক্ষিণ সীমা ষষ্ঠ শতকে সমুদ্র হইতে খুব বেশি দূর ছিল না। সপ্তম শতকে গৌড়-কর্ণসুবর্ণরাজ শশাঙ্কের নবাবিষ্কৃত মেদিনীপুর-লিপিদুইটিতে দেখা যাইতেছে, গৌড়রাষ্ট্রের আধিপত্য সমুদ্রসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত; উৎকলসহ দণ্ডভুক্তিদেশ গৌড়-রাষ্ট্রসীমার অন্তর্গত বলিয়া এই লিপিদুইটিতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ এবং বাণভট্টের “হর্ষচরিতে শশাঙ্কের যে ইতিহাস বর্ণিত আছে তাহাতে স্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, শশাঙ্ক ছিলেন গৌড়ের রাজা; এবং কর্ণসুবর্ণ (=বর্তমান কনসোনা, মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি অঞ্চল) ছিল তাহার রাষ্ট্রকেন্দ্র বা রাজধানী, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ অঞ্চলই ছিল গৌড়ের কেন্দ্ৰভূমি।
প্ৰতীহার-রাজ ভোজদেবের গওআলিয়ার-লিপিতে দেখিতেছি, পালরাজ (ধর্মপাল)কে বলা হইয়াছে “বঙ্গপতি। দ্বিতীয় নাগভট যখন চক্রায়ুধকে পরাজিত করেন তখন ধর্মপাল বঙ্গপতি কিন্তু অন্যত্র সর্বত্রই সকল লিপিতেই পালরাজারা ‘গৌড়েশ্বর। রাষ্ট্রকূটরাজ প্রথম অমোঘবর্ষের (৮১৪-৮৭৭) কানহেরী-লিপিতে গৌড়জনপদ গৌড়বিষয় বলিয়া উল্লিখিত হইয়াছে। যাহাই হউক, ধর্মপালের রাজত্বকাল হইতেই গৌড়েশ্বর উপাধি পালরাজাদের নাম-ভূষণরূপে ব্যবহৃত হইতে থাকে, যদিও তখন বঙ্গজনপদ পৃথক স্বতন্ত্রভাবে বিদ্যমান এবং পালেরা বঙ্গেরও অধিপতি। রাজা অমোঘবর্ষের নীলগুণ্ড-লিপিতে বঙ্গজনপদ-রাষ্ট্রের এবং কর্করাজের বড়োদা পট্টোলীতে (৭১১-১২) একই সঙ্গে বঙ্গ ও গৌড়জনপদ রাষ্ট্রের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। ভট্ট ভবদেবের ভুবনেশ্বর-লিপিতেও গৌড় নৃপ এবং বঙ্গরাজ পৃথকভাবে উল্লিখিত হইয়াছেন। সেনরাজ বিজয়সেনের সময়ে গৌড়রাষ্ট্র স্বতন্ত্র রাজার করায়ত্ত্ব ছিল, কিন্তু বিজয়সেন তাঁহাকে পরাভূত করিয়াছিলেন (দেওপাড়ালিপি)। আবার বল্লালসেনের আমলে বর্ধমানভুক্তির অন্তর্গত উত্তর-রাঢ়মণ্ডল সেন রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হইয়া গিয়াছিল (নৈহাটি-লিপি)। লক্ষ্মণসেনের মাধাইনগর-লিপিতে দেখিতেছি, তিনি সহসা গৌড় রাজ্য আক্রমণ ও জয় করিয়াছিলেন, এবং বোধহয়, এইজন্যই এই লিপিতে তিনি গৌড়েশ্বর বলিয়া অভিহিত হইতেছেন। এইসব প্রমাণ হইতে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত করা চলে যে, গৌড় বঙ্গ ও পুণ্ড্রবর্ধন হইতে স্বতন্ত্র জনপদ, এবং আমরা মোটামুটি পশ্চিমবঙ্গ বলিতে (অর্থাৎ মালদহ-মুর্শিদাবাদ বীরভূম-বর্ধমানের কিয়দংশ) এখন যাহা বুঝি তাহাই ছিল প্রাচীন গৌড়জনপদ।। দক্ষিণ-রাঢ়মণ্ডল বা তাম্রলিপ্ত-দণ্ডভুক্তি বোধহয় গৌড়জনপদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না, যদিও গৌড়ের রাষ্ট্রসীমা কখনও কখনও উৎকল দণ্ডভুক্তি পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, এবং গৌড় বলিতে এক এক সময় হয়তো সমগ্র বাঙলাদেশকেও বুঝাইত।
প্রাচীন জনপদ ও বাঙলা নামকরণ
প্রাচীন বাঙলার বিভিন্ন জনপদগুলি সম্বন্ধে উপরে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা হইতে মোটামুটি ভাবে, একটু শিথিল ভাবেই, কয়েকটি কথা বলা চলে। প্রাচীনতম ঐতিহাসিক কাল হইতে আরম্ভ করিয়া আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত প্রাচীন বাঙলাদেশ পুণ্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, বজ (অথবা ব্ৰহ্ম), তাম্রলিপ্তি, সমতট, বঙ্গ প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত। এই জনপদগুলি প্রত্যেকেই স্ব-স্বতন্ত্র ও পৃথক; মাঝে মাঝে বিরোধ-মিলনে একের সঙ্গে অন্যের যোগাযোগের সম্বন্ধও দেখা যায়, কিন্তু প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র-পরায়ণ। সপ্তম শতকের প্রথম পাদে শশাঙ্ক গৌড়ের রাজপদে প্রতিষ্ঠিত হন এবং বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ-মালদহ-মুর্শিদাবাদ হইতে আরম্ভ করিয়া একেবারে উৎকল পর্যন্ত সর্বপ্রথম এক রাষ্ট্ৰীয় ঐক্য লাভ করে। কিন্তু বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জনপদগুলি এক নাম লইয়া এক ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ হইবার সূচনা বোধহয় দেখা দেয়। শশাঙ্কের আগেই, খ্ৰীষ্টীয় ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি হইতে (হীড়হা-লিপির ‘গৌড়ােন)। শশাঙ্ক তাহাকে পূর্ণ পরিণতি দান করেন। এই সময় হইতেই গৌড় নামটির ঐতিহাসিক ব্যঞ্জনা যেন অনেকখানি বাড়িয়া গিয়াছিল; এবং পাল-রাজারা বঙ্গপতি হওয়া সত্ত্বেও গৌড়াধিপ, গৌড়েন্দ্র, গৌড়েশ্বর-নামে পরিচিত হইতেই ভালোবাসিতেন। লক্ষ্মণসেন সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। যাহাই হউক, শশাঙ্কের পর হইতে, অর্থাৎ মোটামুটি অষ্টম শতক হইতেই, বাঙলাদেশের তিনটি জনপদই যেন সমগ্র বাঙলাদেশের সমার্থক হইয়া উঠে-পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধন, গৌড় ও বঙ্গ। এ কথা সত্য, আগে যেমন পরেও তেমনই, দেশে বিভিন্ন জনপদ এবং তাহাদের নামস্মৃতি ছিলই, নূতন নূতন স্থানের বিভাগীয় নামের উদ্ভবও হইতেছিল (যেমন, পূর্ব ও দক্ষিণ বাঙলা অঞ্চলে বঙ্গল হরিকেল, চন্দ্ৰদ্বীপ, সমতট; উত্তর-বঙ্গ অঞ্চলে বরেন্দ্রী; তাম্রলিপ্তি অঞ্চলে দন্ডভুক্তি; পশ্চিম বাঙলা অঞ্চলে রাঢ়ের উত্তর ও দক্ষিণ বিভাগ) এবং এইসব বিভাগের আবার নূতন নূতন উপবিভাগও নূতন নূতন নাম লইয়া দেখা দিতেছিল। কিন্তু আর সমস্তই যেন এই তিনটি জনপদের কাছে স্নান বলিয়া মনে হয়; আর সকলেই যেন ধীরে ধীরে ইহাদের মধ্যেই নিজেদের সত্তা বিলোপ করিয়া দিতেছিল। রাঢ়ের মতন প্রাচীন জনপদও যেন ক্রমশ গৌড়-নামের মধ্যেই বিলীন হইয়া যাইতেছিল। শশাঙ্ক এবং পাল-রাজারা সমগ্র পশ্চিম-বঙ্গের অধিকারী হইয়াও নিজেদের রাঢ়াধিপতি বা রাঢ়েশ্বর না বলিয়া নিজেদের পরিচয় দিলেন গৌড়াধিপ এবং গৌড়েশ্বর বলিয়া, এবং ভিন-প্রদেশীরাও তাহা মানিয়া লইল। ‘হর্ষচরিত’ ও ‘রাজতরঙ্গিণী-গ্ৰন্থ এবং নবম শতকের ভিন-প্রদেশী লিপিগুলিই তাহার প্রমাণ। পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। পুণ্ড্রবরেন্দ্রীর স্মৃতি পুণ্ড্রবর্ধনের মধ্যে বঁচিয়া ছিল সেন আমলের প্রায় শেষ পর্যন্ত; কিন্তু এই পুণ্ড্রও যেন তাহার স্বতন্ত্র নামসত্তা গৌড়ের মধ্যে বিসর্জন দিতে যাইতেছিল; একজন পাল রাজা যদি বা একবার অন্তত বঙ্গপতি বলিয়া অভিহিত হইয়াছেন, পুণ্ড্রাধিপ বা পুণ্ড্র-বর্ধনেশ্বর বা বরেন্দ্রী-অধিপতি বলিয়া কোথাও তঁাহাদের উল্লেখ করা হয় নাই, যদিও বরেন্দ্রী ছিল তাহাদের জনকভূমি বা পিতৃভূমি। ইহার ঐতিহাসিক ইঙ্গিত লক্ষ্য করিবার মতন। পাল এবং সেন রাজাদের লক্ষ্য ও আদর্শ ছিল গৌড়েশ্বর বলিয়া পরিচিত হওয়া। বঙ্গপতি যে মুহুর্তে গৌড়ের অধিপতি সেই মুহূর্তেই তিনি গৌড়েশ্বর। লক্ষ্মণসেন যে মুহুর্তে গৌড় অধিকার করিলেন সেই মুহুর্তে তিনিও হইলেন গৌড়েশ্বর। শশাঙ্কের সময় হইতেই একটি মাত্র নাম লইয়া প্রাচীন বাঙলার বিভিন্ন জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টার সজ্ঞান সূচনা দেখা দিয়াছিল পাল ও সেন রাজাদের আমলে তাহা পূর্ণ পরিণতি লাভ করিল, যদিও বঙ্গ তখনও পর্যন্ত আপন স্বতন্ত্র-জনপদপ্রতিষ্ঠা বজায় রাখিয়াছে। এক গৌড় নাম লক্ষ্য ও আদর্শ হওয়া সত্ত্বেও বঙ্গ নাম তখনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বিদ্যমান; পুণ্ড্র, পুণ্ড্রবর্ধনের রাষ্ট্রসত্তা আছে, কিন্তু স্বতন্ত্র পৃথক জনপদ-সত্তা তখন আর নাই। পরবর্তী কালেও গৌড় নামে বাঙলাদেশের কিয়দংশের জনপদ সত্তা বুঝাইবার চেষ্টা হইয়াছে; বাঙলার বাহিরে বাঙালী মাত্রেই গৌড়বাসী বা গৌড়ীয় বলিয়া পরিচিত হইয়াছেন, এমন প্রমাণও দুর্লভ নয়। ঔরঙ্গ জীবের আমলে সুবা বাঙলার যে অংশ নবাব শায়েস্তা খাঁর শাসনাধীন ছিল তাহাকে বলা হইত। গৌড়মণ্ডল। উনবিংশ শতকে যখন মধুসূদন দত্ত মহাশয় লিখিয়াছিলেন :
‘রচিব এ মধুচক্ৰ গৌড়জন যাহে
আনন্দে করিবে পান সুধা নিরবধি’
তখন গৌড়জন বলিতে তিনি সমগ্র বাঙলাদেশের অধিবাসীকেই বুঝাইয়াছিলেন। সেন-রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই; গৌড় নামের ললাটে সেই সৌভাগ্যলাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘূণিত ও অবজ্ঞাত, এবং যে বঙ্গ নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও আদরের। কিন্তু, সমগ্র বাঙলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই; তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাঙলাদেশ সুবা বাঙলা নামে পরিচিত হইল। ইংরাজ আমলে বাঙলা নাম পূর্ণতার পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে, যদিও আজিকার বাঙলাদেশ আকবরী সুবা বাঙলা অপেক্ষা খর্বীকৃত।