চন্দ্র ও কম্বোজ রাজ্যের সামাজিক আদর্শ
পালরাষ্ট্র সম্বন্ধে যাহা বলা হইল, চন্দ্র ও কম্বেজি রাষ্ট্র সম্বন্ধেও তাহা সমভাবে প্রযোজ্য। বৌদ্ধ রাজা শ্ৰীচন্দ্র যথারীতি পবিত্র বারি স্পর্শ করিয়া কোটিহোমকর্তা শাণ্ডিল্যগোত্রীয় ত্রিঋষিপ্রবর শান্তিবারিক ব্রাহ্মণ পীতবাস গুপ্ত শর্মাকে ভূমিদান করিতেছেন, আর একবার এই রাজাই হোমচতুষ্টয়ক্রিয়াকালে অদ্ভূত-শান্তি নামক মঙ্গলানুষ্ঠানের পুরোহিত কাণ্বশাখীয় বার্দ্ধকৌশিকগোত্রীয় ত্রিঋষিপ্রবর শান্তিবারিক ব্রাহ্মণ ব্যাসগঙ্গশর্মাকে ভূমিদান করিতেছেন—উভয় ক্ষেত্রেই দানকার্যটি হইতেছে বুদ্ধভটারকের নামে এবং ধর্মচক্রদ্বারা শাসনথানা পট্টীকৃত করিয়া। কঙ্গোজরাজ পরমসুগত নয়পালদের একটি গ্রাম দান করিতেছেন ভট্টাদিবাকর শর্মার প্রপৌত্র, উপাধ্যায় প্রভাকর শর্মার পৌত্র এবং উপাধ্যায় অনুকূল মিশ্রের পুত্র, ভট্টপুত্র পণ্ডিত অশ্বত্থ শর্মাকে; এবং এই দানকার্যের যাঁহারা সাক্ষী তাঁহাদের মধ্যে পুরোহিত, ঋত্বিক এবং ধর্মজ্ঞ অন্যতম। এই দুই রাষ্ট্রেই ঋত্বিক, ধর্মজ্ঞ, পুরোহিত, শান্তিবারিক ইত্যাদি ব্রাহ্মণেরা রাজপুরুষ, এই তথ্য ও লক্ষণীয়।
বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য আদর্শ
বস্তুতঃ, ইহাতে আশ্চর্য্য হইবার কিছু নাই। পূর্ব পর্ব যুগে যাহাই হউক, এই যুগে সমাজ-ব্যবস্থা ব্যাপারে বৌদ্ধ-ব্রাহ্মণে কিছু পার্থক্য ছিল না। সামাজিক ব্যাপারে বৌদ্ধেরা ও মনুর শাসন মানিয়া চলিতেন, ঠিক আজও বৌদ্ধধর্মানুসারী ব্রহ্ম ও শ্যামদেশ সামাজিক শাসনানুশাসনের ক্ষেত্রে যেমন কতকটা ব্রাহ্মণ্য শাসনব্যবস্থা মানিয়া চলে। তারানাথের বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস এবং অন্যান্য তিব্বতী বৌদ্ধগ্রন্থের সাক্ষ্য হইতে ও অনুমান হয়, বর্ণাশ্রমী হিন্দু ও বৌদ্ধদের মধ্যে কোন সামাজিক পার্থক্যই ছিল না। যাঁহারা বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা লইয়া প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতেন, বিহারে সংঘারামে বাস করিতেন, তাঁহাদের ক্ষেত্রে বর্ণাশ্রম-শাসন প্রযোজ্য ছিল না, থাকিবার কোন ও প্রযোজনও ছিল না। কিন্তু যাঁহার উপাসক মাত্র ছিলেন, গৃহী বৌদ্ধ ছিলেন তাঁহারা সাংসারিক ক্রিয়াকর্মে প্রচলিত বর্ণ-শাসন মানিয়াই চলিতেন। বৌদ্ধপণ্ডিতে ব্রাহ্মণপণ্ডিতে ধর্ম ও সামাজিক মতামত লষ্টয়া দ্বন্দ্ব-কোলাহলের প্রমাণ কিছু কিছু আছে, কিন্তু বৌদ্ধর পৃথক সমাজ সৃষ্টি করিয়াছিলেন এমন কোনও প্রমাণ নাই। বরং সমসাময়িক কাল সম্বন্ধে তারানাথ এবং অন্যান্য বৌদ্ধ আচাৰ্যর যাহা বলিতেছেন, তাহাতে মনে হয়, পালযুগের মহাযানী বৌদ্ধধর্ম ক্রমশ তন্ত্রধর্মের কুক্ষিগত হইয়া পড়িতেছিল, এবং ধর্মাদর্শ ও ধর্মানুষ্ঠান, পূজা প্রকরণ প্রভৃতি ব্যাপারে নূতন নূতন মত ও পথের উদ্ভব ঘটিতেছিল। তন্ত্রধর্মের স্পর্শে ব্রাহ্মণ্যধর্মেরও অনুরূপ বিবর্তন ঘটিতেছিল, এবং বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রভেদ কোনও কোনও ক্ষেত্রে ঘুচিয়া যাইতেছিল।
সমাজের গতি ও প্রকৃতি
ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাস পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল, এবং বর্ণাশ্রম রক্ষণ ও পালনের দায়িত্ব এই যুগের বৌদ্ধরাষ্ট্রও স্বীকার করিত, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোনও অবকাশ সত্যই নাই। কিন্তু বর্ণবিন্যাস এবং প্রত্যেক বর্ণের সীমা পরবর্তী কালে যতটা দৃঢ়, অনমনীয় এবং নানা বিধিনিষেধের সূত্রে শক্ত ও সুনির্দিষ্ট রূপে বাঁধা পড়িয়াছিল, এই যুগে তাহা হয় নাই। তাহার প্রধান কারণ, বাংলাদেশ তখনও পর্যন্ত তাহার নিজস্ব স্মৃতিশাসন গডিয়া তোলে নাই; বস্তুত, স্মৃতিশাস্ত্র রচনার সূত্রপাতই তখনও হয় নাই। দ্বিতীয়তঃ, এই যুগের সব ক’টি রাষ্ট্র এবং রাজবংশই বৌদ্ধধমাবলম্বী এবং বৌদ্ধ সংস্কারাশ্রয়ী; ইঁহারা ব্রাহ্মণ্যধর্মের পৃষ্ঠপোষক এবং ব্রাহ্মণ্য-সমাজ ব্যবস্থার ধারক ও পালক হইলেও —হিন্দুরাষ্ট্ৰীয় আদর্শে রাজার অন্যতম কর্তব্যই প্রচলিত সমাজ-ব্যবস্থার ধারণ ও পালন—উত্তর বা দক্ষিণ ভারতের ব্রাহ্মণ্য স্মৃতিশাসন ইঁহাদের নিকট একান্ত হইয়া উঠিতে পারে নাই। তৃতীয়তঃ, পালবাজবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভব নয়; বর্ণ-হিসাবে ইহাদের ক্ষত্ৰিয়ত্বের দাবি “রামচরিত” ছাড়া আর কোথাও নাই, এবং তাহা রামপালের পিতা সম্বন্ধে। গোপাল বা ধর্মপাল বা দেবপাল সম্বন্ধে এ দাবি কেহ করে নাই; দশ-বার পুরুষ রাজত্ব করার পর একজন রাজা ও তাঁহার বংশ ক্ষত্ৰিয় বলিয়া পরিগণিত হইবেন ইহা কিছু আশ্চর্য নয়। যাহাই হউক, পালবংশ উচ্চবর্ণোদ্ভভ ছিলেন না বলিয়াই বোধ হয় তাঁহারা বর্ণশাসনের স্মৃতি-সুলভ সুদৃঢ় আচার-বিচার বা স্তরউপস্তরভেদ সম্বন্ধে খুব নিষ্ঠাপরায়ণও ছিলেন না। চতুর্থতঃ, বঙালী সমাজের অধিকাংশ লোকই তখনও বর্ণাশ্রম বহির্ভূত, অল্প সংখ্যক উচ্চশ্রেণীর লোকেরাষ্ট বর্ণাশ্রমের অন্তর্গত ছিল, যদি ও তাহার সীমা ক্রমশই প্রসারিত হইয়া চলিয়াছিল। কিন্তু ক্ৰমবৰ্দ্ধমান সীমার মধ্যে যাহারা আসিয়া অন্তর্ভূক্ত হইতেছিল তাহারা সকলেই আর্যপূর্ব কোম-সমাজের ও সেই সমাজগত সংস্কার ও সংস্কৃতির লোক। ব্রাহ্মণ্য সমাজ-ব্যবস্থা, সংস্কার ও সংস্কৃতি তাহারা মানিয়া লইতেছিল অর্থনৈতিক আধিপত্যের চাপে পড়িয়া। ব্রাহ্মণ্য বর্ণবিন্যাসের সূত্রের মধ্যে তাহাদের গাঁথিয়া লওয়া খুব সহজ হয় নাই; অন্তত পাল ও চন্দ্ররাষ্ট্র সচেতন ও সক্রিয়ভাবে সেদিকে চেষ্টা কিছু করিয়াছিল বলিয়া তো মনে হয় না, প্রমাণও কিছু নাই। রাষ্ট্রীয় চাপ সেদিকে কিছু ছিল না; রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টিও এবিষয়ে উদার ছিল। আমার এই শেষোক্ত অনুমানের সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ কিছু নাই, তবে সমসময়িক রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থায় সমাজ-ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি যাহা হওয়া সম্ভব ও স্বাভাবিক তাহাই অনুমানের রূপে ও আকারে ব্যক্ত করিলাম। হিন্দুধর্ম ও সমাজের স্বাঙ্গীকরণক্রিয় আজও যে যুক্তিপদ্ধতি অনুসারে চলিতেছে বিভিন্ন আর্যপূর্ব গোষ্ঠী ও কোম গুলিতে, সেই যুক্তিপদ্ধতিই এই অল্পমানের সাক্ষ্য ও সমর্থক। তাহা ছাড়া, এই অনুমানের পশ্চাতে রহিয়াছে, পরবর্তী যুগের বিশেষভাবে সেন-বর্মণ আমলের বাংলার বর্ণ ও সমাজ-বিন্যাসের ইতিহাস এবং বাংলার মধ্যযুগের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য।