ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু : লোক-প্রকৃতি
নদনদী ও পাহাড়-পর্বত মিলিয়া বাঙলার ভূ-প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে, এবং তোহা ইতিহাস আরম্ভ হইবার পূর্বেই। ঐতিহাসিক কালেও ভূ-প্রকৃতির কিছু পরিবর্তন ঘটিয়াছে, সন্দেহ নাই, বিশেষত নবগঠিত ভূমিতে—” new alluvium-এ। নদীর পলি পড়িয়া, বন্যার দ্বারা তাড়িত মাটি উচ্চভূমিতে বাধা পাইয়া, কিংবা ভূমিকম্প বা অন্য কোনও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে নূতন ভূমির সৃষ্টি বা পুরাতন ভূমি পরিত্যক্ত হয়। বাঙলাদেশেও তাহা হইয়াছে; নূতন ভূমির সৃষ্টি হইয়াছে অল্পবিস্তর, কিন্তু তাহাতে প্রাগৈতিহাসিক কালের নবগঠিত ভূমি বা new alluvium-ই প্রসারিত হইয়াছে। পুরাতন ভূমি পরিত্যক্তও হইয়াছে, বিনষ্ট হইয়াছে— সাধারণত নদীর প্রবাহপথের পরিবর্তনের ফলে; কিন্তু তাহাতে ভূ-প্রকৃতির মৌলিক কোনও পরিবর্তন ঘটে নাই, পুরাভূমিতেও (old alluvium) নয়, নবভূমিতেও (new alluvium) নয়।
পশ্চিমাংশের পুরাভূমি এবং নবভূমি
ভূ-প্রকৃতির দিক হইতে বাঙলাদেশের চারিটি বিভাগ সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্ট। পশ্চিম বাঙলার একটা সুবৃহৎ অংশ পুরাভূমি। রাজমহলের দক্ষিণ হইতে আরম্ভ করিয়া এই পুরাভূমি প্রায় সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত। রাজমহল, সাঁওতালভূম, মানভূম, সিংহভূম, ধলভূমের পূর্বশায়ী মালভূমি এই পুরাভূমির অন্তর্গত; তাহারই পূর্বদিক ঘেষিয়া মুর্শিদাবাদ-বীরভূম-বর্ধমান–বাঁকুড়া-মেদিনীপুর জেলার পশ্চিমাংশের উচ্চতর গৈরিকভূমি; ইহাও সদ্যোক্ত পুরাভূমির অন্তর্গত। মালভূমি অংশ একান্তই পার্বত্য, জাঙ্গলময়, অজলা এবং অনুর্বর। এখনও এই অংশে গভীর শালবন, পার্বত্য আকর ও কয়লার খনি এবং ইহা সাধারণত অনুর্বর। প্রাচীন উত্তর-রাঢ়ের অনেকখানি অংশ, দক্ষিণ-রাঢ়ের পশ্চিমাংশ এবং তাম্রলিপ্তি রাজ্যেরও কিয়ৎ-পশ্চিমাংশ এই মালভূমি এবং উচ্চতর গৈরিক ভূমির অন্তর্গত। দক্ষিণ-রাঢ়ের রাণীগঞ্জ-আসানসোলের পার্বত্য অঞ্চল, বাঁকুড়ার শুশুনিয়াপাহাড় অঞ্চল, বনবিষ্ণুপুর রাজ্য, মেদিনীপুরের শালবনী-ঝাড়গ্রাম-গোপীবল্লভপুর অঞ্চল সমস্তই এই পুরাভূমিরই নিম্ন অংশ। এইসব পার্বত্য ও গৈরিক অঞ্চল ভেদ করিয়াই ময়ূরাক্ষী, অজয়, দামোদর, রূপনারায়ণ, দ্বারকেশ্বর, শিলাবতী (শিলাই), কপিশা (কসাই), সুবর্ণরেখা প্রভৃতি নদনদী সমতল ভূমিতে নামিয়া আসিয়াছে। এখনও ইহারা ইহাদের জলস্রোতে পার্বত্য লাল মাটি বহন করিয়া আনে। সমতলভূমি এই নদনদীগুলির জল পলিতে উর্বর। এই উর্বর সমতলভূমি নবগঠিত ভূমি, সদ্যোক্ত নদনদীগুলি এবং ভাগীরথী-প্রবাহদ্বারা সৃষ্ট ভূমি। মুর্শিদাবাদের বহুলাংশ, বর্ধমানের পূর্বাংশ, বাঁকুড়ার স্বল্প অংশ, হুগলি-হাওড়া এবং মেদিনীপুরের পূর্বাংশ এই নবসৃষ্ট ভূমি—বৃক্ষশ্যামল, শস্যবহুল।
কজঙ্গল
পশ্চিমবঙ্গের এই যে ভূ-প্রকৃতি ইহার প্রাচীন সমর্থন কিছু কিছু পাওয়া যায়। ভট্ট ভবদেব রাজা হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ছিলেন (একাদশ শতক)। তিনি তাহার ভুবনেশ্বর শিলালিপিতে রাঢ়দেশের অজলা জাঙ্গলময় প্রদেশের উল্লেখ করিয়াছেন। ভবিষ্য-পুরাণের ব্ৰহ্মখণ্ড অংশে রাঢ়ীখণ্ডজঙ্গল নামে এক দেশের উল্লেখ আছে। বৈদ্যমাথ, বক্ৰেশ্বর, বীরভূম ও অজয় নদ এই দেশের অন্তর্গত; ইহার তিনভাগ জঙ্গল, একভাগ গ্রাম ও জনপদ, অধিকাংশ ভূমি উষর, স্বল্পমাত্র ভূমি উর্বর। এখানে কোথাও কোথাও লৌহ আকর আছে। আমি অন্যত্র দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, “ভবিষ্যপুরাণ ও ভবদেবভট্ট-কথিত এই দেশের একাংশে য়ুয়ান চোয়াঙ-রামচরিত-বৌদ্ধধর্মগ্রন্থ প্রভৃতি কথিত কয়ঙ্গল—কজঙ্গল—কজাঙ্গল-ক-চু-ওয়েন-কি-লো। বর্তমান কঁকজোল এই ভূখণ্ডের স্মৃতিমাত্র বহন করে। য়ুয়ান-চোয়াঙ চম্পা হইতে কজঙ্গল গিয়াছিলেন। এই দেশের ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু সম্বন্ধে তাহার কিছু বক্তব্য আছে। তিনি বলিতেছেন (সপ্তম শতক), এই স্থানের উত্তরসীমা গঙ্গা হইতে খুব বেশি দূরে নয়; ইহার দক্ষিণের বনপ্রদেশে বন্য হন্তী প্রচুর। তাহার সময়ে এই রাজ্য পররাষ্ট্রের অধীন, রাজধানীতে লোক ছিল না এবং লোকেরা গ্রামে এবং নগরেই বাস করিত। তাহারা স্পষ্টাচারী (straight forward), গুণবান এবং বিদ্যাচর্চার প্রতি ভক্তিমান ছিল। দেশটি সমতল, ভূমি জলীয় এবং সুশস্যপ্রসু, বায়ু উষ্ণ। য়ুয়ান-চোয়াঙের বর্ণনা হইতে মনে হয়, তিনি কাজঙ্গলের যে অংশে দামোদর-অজয়-ভাগীরথী উপত্যকা সেই অংশের উপত্যক-ভূমির কথা বলিতেছেন, যে অংশে বৈদ্যনাথ-বক্ৰেশ্বর-বীরভূম সেই অংশের কথা নয়। দক্ষিণের বনপ্রদেশ বনবিষ্ণুপুর অঞ্চল বলিয়াই তো মনে হইতেছে। দামোদর-অজয়-ভাগীরথী উপত্যকার ভূমি সমতল, জলীয়, সুশস্যপ্রসূ এবং বায়ু উষ্ণ।
তাম্রলিপ্তি
য়ুয়ান-চোয়াঙ তাম্রলিপ্তি রাজ্যেও গিয়াছিলেন, এবং তাহার বর্ণনাও রাখিয়া গিয়াছেন। তাম্রলিপ্তির ভূমিও সমতল এবং জলীয়; বায়ু উষ্ণ; ফুল ফল শস্য প্রচুর। লোকের আচার-ব্যবহার রূঢ়, কিন্তু তাহারা খুব সাহসী। এই দেশে স্থল ও জলপথের সমন্বয়, এবং ইহার রাজধানী তাম্রলিপ্তির বন্দর সমুদ্রের একটি খাড়ির উপর অবস্থিত। এক্ষেত্রেও য়ুয়ান-চোয়াঙ মেদিনীপুরের পূর্ব ও পূর্ব-দক্ষিণ অংশের কথা বলিতেছেন, পশ্চিমের পার্বত্য অংশের কথা নয়।
কর্ণসুবর্ণ, পুরাভূমি বা রাঙ্গামাটির বিস্তৃতি
য়ুয়ান-চোয়াঙ তাম্রলিপ্তি হইতে গিয়াছিলেন কর্ণসুবর্ণ রাজ্যে। কর্ণসুবর্ণ তাঁহার সময়ে লোকবহুল জনপদ, এবং জনসাধারণের আর্থিক সমৃদ্ধিও তিনি লক্ষ করিয়াছিলেন। ভূমি ছিল সমতল এবং জলীয়, ফল ফুল শস্য ছিল প্রচুর; কৃষিকর্ম ভালো; বায়ু নাতিশীতোষ্ণ। জনসাধারণ সুচরিত্র এবং জ্ঞানবিজ্ঞানের পোষক। য়ুয়ান-চোয়াঙের কর্ণসুবর্ণ মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা বলিয়া অনুমিত হইয়াছে। এই অনুমানের সমর্থন চীন পরিব্রাজকের বিবরণীতেই পাওয়া যায়। কর্ণসুবর্ণের রাজধানীর সন্নিকটেই তিনি লো-টো-মো-চিহ্ন নামক এক সুবৃহৎ বৌদ্ধবিহারের উল্লেখ এবং বর্ণনা করিয়াছেন। লো-টো-মো-চিহ্ন (=রাত্তমত্তি=রক্তমৃত্তিকা) বর্তমান রাঙ্গামাটি; রাঙ্গামাটি মুর্শিদাবাদের অন্তর্গত। রাঙ্গামাটি নামটি অর্থব্যঞ্জক। এই রাঙ্গামাটি সমতলভূমি হইলেও রাজমহল-সঁওতালভূমের পার্বত্য গৈরিক মাটি এই ভূমির নিম্ন ও উপরিস্তরে অপ্রতুল নয়। পুরাভূমি বা old alluvium-র কিছু কিছু চিহ্ন যে মুর্শিদাবাদ পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে তাহার ইঙ্গিত রাঙ্গামাটি, লালবাগ প্রভৃতি নামের স্মৃতির মধ্যে পাওয়া যায়। বাঙলার অন্যত্রও যেখানে-যেখানে স্থান-নামের সঙ্গে রাঙ্গা, লাল, রং প্রভৃতি শব্দ জড়ির সেইসব স্থান লক্ষণীয়। চট্টগ্রামের পার্বত্য অঞ্চল ঘেষিয়া রাঙ্গামাটি জনপদ এখনও বিদ্যমান। হয়তো ইহাই মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের রক্তমৃত্তিকা। কুমিল্লা শহরের পঁাচ মাইল পশ্চিমে লালমাটি বা লালমাইপাহাড় (ইহাই কি শ্ৰীচন্দ্রের রামপাল ও ধুল্লা লিপির রোহিতাগিরি?)। রেনেলের নকশায় দেখা যাইবে, ব্ৰহ্মপুত্রের উত্তর প্রবাহের পশ্চিমে (রংপুর জেলা), উত্তরে (গোয়ালপাড়া-কামরূপ জেলা), এবং দক্ষিণে (গোয়ালপাড়া কামরূপ জেলা) একাধিক রাঙ্গামাটির উল্লেখ ও পরিচয় (Rangamata, Rangamaty, Rangamati= রাঙামাটি, সন্দেহ থাকিতে পারে না)। ইহার কিছু সমর্থন করতোয়ামাহাত্ম্য গ্রন্থেও পাওয়া যায়—“পশ্চিমে করতোয়ায়া লোহিনী যাত্র মৃত্তিকা”। বর্তমান রংপুর জেলার রংপুর নামও এই রাঙ্গামাটির স্মৃতিবহ বলিয়া আমি মনে করি। ব্লাঙ্গাপুর=বিদেশী Fungpour (যেমন,রেনেলের নকশায়)=রঙ্গপুর=বংপুর হওয়া একেবারে অসম্ভব কিছুই নয়। তাহা ছাড়া, আমিনগাও-এর পথে রাঙ্গিয়া রেল স্টেশন, তেজপুরের পথে রাঙ্গাপাড়া স্টেশন, রাঙ্গাগ্রাম প্রভৃতি সমস্তই রেনেলের রাঙ্গামাটির সমর্থক; কারণ এগুলি সমস্তই ব্ৰহ্মপুত্রের পূর্বে, উত্তরে এবং দক্ষিণে। রংপুরের দক্ষিণ পশ্চিমে বরেন্দ্রী, মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ। বরেন্দ্রীর মাটি লাল, এবং তোহা একান্তই পুরাভূমি। এই পুরাভূমির বিচ্ছিন্ন অসংলগ্ন রেখা চলিয়া গিয়াছে রাজমহলের নিকট গঙ্গা পার হইয়া ধলভূম-মানভূম-সিং ভুম ধরিয়া সমুদ্রতীর পর্যন্ত। উত্তর-রাঢ় ও দক্ষিণ-রাঢ়ের পশ্চিমাংশ এবং মুর্শিদাবাদ এই পুরাভূমির বিস্তৃতাংশ। পূর্ব দক্ষিণ দিকে এই পুরাভূমির গারোপাহাড় (মধুপুরগড় সহ), পার্বত্য ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম হইয়া সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত।
য়ুয়ান চোয়াঙের কজঙ্গল-তাম্রলিপ্তি-কর্ণসুবর্ণবিবরণ পড়িয়া মনে হয়, এই পরিব্রাজক পশ্চিম বঙ্গের সমতল ভূমির ভূখণ্ডের সঙ্গেই পরিচিত হইয়াছিলেন। এই সমতলভূমির পশ্চিমাঞ্চলের উত্তর অংশেই “ভবিষ্যপুরাণ’ কথিত বৈদ্যনাথ-বক্রেশ্বর-বীরভূম-ধূত, উষর ও জাঙ্গলময় যে রাটখণ্ডজঙ্গলভূমি সেই ভূখণ্ডের সঙ্গে তাহার পরিচয় হয় নাই। কিংবা ভবদেব ভট্ট রাঢ় দেশের যে অজলা জঙ্গলময় (=জঙ্গলময় হইতে পারে, আবার জাঙ্গল=জাঙ্গাল=উচ্চ বাধ্যভূমিময়) ভূমির কথা বলিতেছেন তাহার পরিচয়ও তিনি পান নাই। কাজঙ্গল-তাম্রলিপ্তি-কর্ণসুবর্ণ-এই তিনটি রাজ্যেরই যে সমতলভূমি জলীয় এবং ফলমূল-শস্যপ্রসূ যাহার জলবায়ু উষ্ণ অথবা নাতিশীতোষ্ণ, এবং যে ভূমি লোকবহুল সেই ভূমিভাগের সঙ্গেই তাঁহার পরিচয় ঘটিয়াছিল। তিনি আসিয়াছিলেন বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী এবং উৎসুক শিক্ষার্থী হিসাবে; বৌদ্ধধর্মসংঘ ও বিহারগুলির পরিচয়লাভ, পণ্ডিত ও ধর্মগুরুদের অনুষ্ঠান ও প্রতিষ্ঠানগুলির পরিচয়লাভই তাহার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। এইসব বৌদ্ধবিহার বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কেন্দ্ৰ সাধারণত সহজগম্য এবং লোকালয়প্রধান স্থানেই অবস্থিত ছিল। সুপরিচিত, বহুজনপদচিহ্নিত পথ ধরিয়াই তিনি সে-সব স্থানে গিয়াছিলেন। কাজেই উষর, অনুর্বর ও জঙ্গলময়, এবং সেইহেতু গ্রাম ও নগরবিরল, জনবিরল স্থানগুলিতে যাওয়ার কোনও প্রয়োজন তাঁহার হয় নাই।
উত্তরবঙ্গের পুরাভূমি ও নবভূমি, বরিন্দ্-বরেন্দ্রী
পূর্বোক্তি পুরাভূমির একটি রেখা রাজমহলের উত্তরে গঙ্গা পার রাজশাহী-দিনাজপুর-রংপুরের ভিতর দিয়া, ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া ঐ নদীর দুই তীরে বিস্তৃত হইয়া আসামের শৈলশ্রেণী স্পর্শ করিয়াছে। এই পুরাভূমিরেখার মাটি পার্বত্য গৈরিক স্থূল বালিময়। রংপুর-গোয়ালপাড়া-কামরূপেই এই রেখার বিস্তৃতি বেশি; রেনেলের নকশায় তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। উত্তর-বঙ্গের রাঙ্গামাটি প্রসঙ্গ আগেই বলিয়াছি। তাহা ছাড়া বগুড়া-রাজশাহীর উত্তর, দিনাজপুরের পূর্ব, এবং রংপুরের পশ্চিম স্পর্শ করিয়া এই রেখার একটি বিস্তৃত স্ফীতি— উচ্চ গৈরিক ভূমি—দেখিতে পাওয়া যায়; ইহাই মুসলমান ঐতিহাসিকদের বরিন্দ, বরেন্দ্ৰভূমির কেন্দ্ৰবিন্দু। এই বরিন্দের উত্তরে হিমালয়ের তরাই পর্বতসানুর অস্বাস্থ্যকর জলীয় নিম্নভূমিতে জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলা, পূর্ণিয়ার কিয়দংশ। বরেন্দ্রীর কেন্দ্রবিন্দু বরিন্দের গৈরিক ভূমি অনুর্বর, পুরাভূমি; কিন্তু পূর্ব-পশ্চিম-দক্ষিণ ঘিরিয়া তাঙ্গন-আত্রাই, মহানন্দা-কোশী, লম্বা করতোয়ার জল ও পলিমাটি-দ্বারা গঠিত নবভূমি। উপরোক্ত পুরাভূমিরেখাটুকু ছাড়া নবভূমির বাকি সবটাই সমতল-ভূমি, সুশস্যপ্ৰসূ, জলীয় এবং শ্যামল। বরিন্দ জনবিরল, এমনকি মালদহ-রংপুরের পুরাভূমিরেখাও অপেক্ষাকৃত জনবিরল, এবং মাটির রং গৈরিক; ঘন লোকবসতি সাধারণত পদ্মা-আত্রাই-করতোয়ার সমতলভূমিতেই দেখা যায়। প্রাচীন কালেও পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর সমৃদ্ধ জনপদগুলি সমস্তই এই নদনদীপ্লাবিত সমতলভূমিতে।
‘রামচরিতে” বরেন্দ্রভূমির যে শস্যসমৃদ্ধির পরিচয় পাওয়া যায়, যে ঐশ্বর্যবিবরণ পড়া যায় এবং যাহার কথা ধনসম্বল অধ্যায় প্রসঙ্গে এবং অন্যত্র নানা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইয়াছে সেই সমৃদ্ধি সাধারণত এই সমতলভূমির। তাহা হওয়াই স্বাভাবিক। নদনদী বাহিয়াই বাঙলার প্রাচীন সভ্যতা-সংস্কৃতি-সমৃদ্ধির জয়যাত্রা, এবং সমতলভূমিতে নদনদীর তীরেই গ্রাম-নগর-বন্দরের পত্তন, মানুষের ঘনতম বসতি, কৃষি-শিল্প-বাণিজ্যের বিস্তার।
পুণ্ড্রবর্ধন
বরেন্দ্রভূমি প্রাচীন পুণ্ড্র বা পুণ্ড্রবর্ধনেরই এক সুবৃহৎ অংশ, এমনকি কখনও কখনও সমার্থকও। য়ুয়ান-চোয়াঙ ভ্ৰমণ-ব্যাপদেশে পুণ্ড্রবর্ধনেও আসিয়াছিলেন। তখন এই দেশে সমৃদ্ধ, জনবহুল, প্রতি জনপদে দীঘি, আরাম-কানন, পুষ্পেপাদ্যান ইতস্তত বিক্ষিপ্ত; ভূমি সমতল এবং জলীয়, শস্যসম্ভার সুপ্রচুর, জলবায়ু মৃদু। জনসাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবান। আগে বলিয়াছি, উত্তরবঙ্গ এবং ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া ও কামরূপ জেলার ভূ-প্রকৃতি ও জলবায়ু প্রায় একই প্রকার; সেখানেও একই ভূমির বিস্তার। য়ুয়ান-চোয়াঙের কামরূপ-বিবরণ সেই জন্যই পুণ্ড্রবর্ধনের সঙ্গে একেবারে হুবহু মিলিয়া য়ায়। সেখানেও ভূমি সমতল এবং জলীয়, শস্যসম্ভার নিয়মিত এবং জলবায়ু মৃদু। কামরূপের লোকেরা খর্ব ও কৃষ্ণকায়; সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও তাহাদের প্রকৃতি হিংস্র। বিদ্যাথী হিসাবে তাহারা খুব অধ্যবসায়ী এবং তাহাদের ভাষা মধ্যদেশ হইতে পৃথক। এই দেশের দক্ষিণ-পূর্ব বনভূমিতে (গারো ও খাসিয়া-পাহাড়ে?) যুথবদ্ধ হইয়া বন্যহন্তী উৎপাত করিয়া চরিয়া বেড়ায় (এখনও করে); তাহার ফলে এখান হইতে যুদ্ধের প্রয়োজনে হস্তী যথেষ্ট পাওয়া যায়।
রাঢ়-পুণ্ড্রের যোগাযোগ
পশ্চিম-বাঙলার যেমন উত্তরবঙ্গেও তেমনই, য়ুয়ান-চোয়াঙের পরিচয় পুণ্ড্রবর্ধনের সমতল ভূমির সঙ্গে। কেন্দ্ৰভূমি বরিন্দের সঙ্গে বোধহয় তাহার পরিচয় ঘটে নাই। যাহাই হউক, রাঢ় এবং উত্তরবঙ্গের ভূ-প্রকৃতি এবং সঙ্গে সঙ্গে পদ্মা ও ভাগীরথীর ইতিহাস একত্রে স্মরণ ও বিশ্লেষণ বীরভূম-বর্ধমানের ঘনিষ্ঠ যোগ ছিল। ভাগীরথী যখন গৌড়কে ডাইনে রাখিয়া উত্তরহইয়া পরে দক্ষিণবাহী হইত, পদ্মা যখন আরও সোজা পূর্ববাহী ছিল তখন তো পুণ্ড্রবরেন্দ্রীর কিছুটা অংশ (মালদহ জেলা) রাঢ়ভূমির সঙ্গে যুক্তই ছিল। কিন্তু ইহার পরও গঙ্গা বরেন্দ্ৰ-পুণ্ড্র এবং রাঢ়ভূমির মধ্যে কখনও খুব বড় বাধা হইয়া দেখা দেয় নাই। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্বন্ধের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রাচীন বাঙলার এই দুই ভূখণ্ডের মধ্যে বরাবরই ছিল। আজ উত্তর-বাঙলার সঙ্গে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যোগ পূর্ব-বাঙলার বেশি, কিন্তু প্রাচীন কালে তাহা ছিল না বলিলেই চলে। দিনাজপুর-রাজশাহী-মালদহের লোকভাষার প্রকৃতিও রাঢ়ের পূর্বাঞ্চলের লোকভাষা-প্রকৃতির সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ। কিন্তু তাহা আলোচনার স্থান। এখানে নয়। তবে, এ কথা অনস্বীকার্য যে, মোটামুটিভাবে পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী এবং রাঢ়-তাম্রলিপ্তিই বাঙলাদেশের প্রাচীনতর পলিভূমি।
পূর্ববঙ্গের পুরাভূমি ও নবভূমি, মধুপুরগড়, নবভূমির দুই ভাগ
পূর্ব-বাঙলা একান্তই নবভূমি এবং এই নবভূমি পদ্মা-ব্ৰহ্মপুত্র এবং সুরমা-মেঘনার সৃষ্টি। এই নবভূমির উত্তরে, পূর্বে এবং পূর্ব-দক্ষিণে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া–ত্রিপুরা-চট্টগ্রামের শৈলশ্রেণী;; ইহাদের অব্যবহিত সানু ও তলদেশ পার্বত্য না হইলেও কোথাও কোথাও গৈরিক বালুকাময়, কখনও কখনও বালির শক্ত স্তরময়, যেমন চট্টগ্রাম-ত্রিপুরা-শ্ৰীহট্ট-কাছাড় জেলার কোনও কোনও স্থানে। চট্টগ্রামের পার্বত্য-চট্টগ্রাম ও ত্রিপুরার পার্বত্য-ত্রিপুরা অঞ্চল, কাছাড় জেলার উত্তরাংশ ও দক্ষিণাংশে হালিয়াকান্দি অঞ্চল, এবং শ্ৰীহট্ট জেলার পূর্বাঞ্চলকে মোটামুটি পুরাভূমির অন্তর্গতই বলিতে হয়। তাহা ছাড়া, ঢাকা ও মৈমনসিংহ জেলার বিস্তৃত একটি অংশ জুড়িয়া গৈরিক পার্বত্য গজারী-বনময় একখণ্ড পুরাভূমির স্ফীতি দেখিতে পাওয়া যায়-ইহা মধুপুরগড় নামে খ্যাত। ঢাকা জেলার ভাওয়ালের গড়ও তাঁহাই। মধুপুরগড়ের উপরের স্তরের মাটি যেন লাল কাদা-জমানো-মাটি, কিন্তু তাহার নিচের স্তরেই লাল বালি; এই বালি ও অজয়-বরাকর উপত্যকার লাল বালি একই গৈরিক পার্বত্য মাটি। পূর্ব-বাঙলার অন্য সমস্ত ভূমিই জলীয় সমতল ভূমি অর্থাৎ নবগঠিত ভূমি এবং সর্বত্র খালবিল ও সুবিস্তীর্ণ জলাভূমিদ্বারা আচ্ছন্ন। কিন্তু তাহা হইলেও এই নবগঠিত ভূমির দুইটি বিভাগ সুস্পষ্ট। ইহারই মধ্যে মৈমনসিং, ঢাকা, ফরিদপুর, সমতল-ত্রিপুরা ও শ্ৰীহট্টের বহুলাংশের গঠন পুরাতন (old formation), এবং খুলনা, বাখরগঞ্জ, সমতল-নোয়াখালি ও সমতল-চট্টগ্রামের গঠন (new formation)। শ্ৰীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড অঞ্চলে প্রাপ্ত নিধনপুর তাম্রপটোলী (সপ্তম শতক), ভাটোরায় প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের পট্টোলী (একাদশ শতক), বন্দরবাজারে প্রাপ্ত লোকনাথের মূর্তি (দশম-একাদশ শতক), ত্রিপুরা জেলার প্রাপ্ত লোকনাথের পট্টোলী (অষ্টম শতক) এবং তৎপরবর্তী অগণিত লিপি ও মূর্তি, ফরিদপুরে প্রাপ্ত ধর্মাদিত্য-গোপচন্দ্ৰ ইত্যাদির পট্টোলী (ষষ্ঠ-সপ্তম শতক), ঢাকা জেলায় প্রাপ্ত অসংখ্য মূর্তি ও লিপি এইসব ভূখণ্ডে প্রাচীনকাল হইতেই বহুদিন স্থিত সমৃদ্ধ সভ্যতা এবং জনাবাসের দ্যোতক। এইসব ভূখণ্ড পুরাতন গঠন, এবং ইহাদের অবলম্বন করিয়াই প্রাচীন বাঙলার সভ্যতা ও সংস্কৃতি পূর্বাঞ্চলে বিস্তারলাভ করিয়াছিল। এইসব ভূখণ্ডের তুলনায় খুলনা-বাখরগঞ্জ-নোয়াখালি-সমতল চট্টগ্রাম নূতন, এবং লক্ষণীয় এই যে, এইসব ভূখণ্ডে বাঙলার প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির বড় একটি চিহ্ন এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। চট্টগ্রামে বহু মূর্তি এবং কয়েকটি লিপি, নোয়াখালিতে দু-একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হইয়াছে, কিন্তু তাহার একটিও নবগঠিত সমতলাংশে নয়।
মধ্য বা দক্ষিণ বঙ্গের নবভূমি
মধ্য বা দক্ষিণ-বঙ্গে পুরাভূমির অস্তিত্ব কোথাও নাই; এই ভূমি একেবারে পদ্মা-ভাগীরথী-মধুমতীর সৃষ্টি, এবং বাঙলার নবভূমির অন্তর্গত; শতাব্দীর পর শতাব্দীর পলিমাটি জমিয়া জমিয়া এই ভূখণ্ডকে এক ধারে বন্যা ও অন্য ধারে সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার উর্ধের্ব উৎক্ষিপ্ত করিয়া দিয়াছে। খাড়িমণ্ডল-ব্র্যাঘাতটী-সমতট প্রভৃতি নাম লক্ষণীয়। নদীয়া জেলার কিয়দংশ, যশোহর, খুলনা, এবং চব্বিশ-পরগনা এই ভূখণ্ডের অন্তর্গত। সমতট অবশ্যই সমতল-ত্রিপুরা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল—তাহার একাধিক লিপি-প্রমাণ বিদ্যমান-কিন্তু সমতল ত্রিপুরাও তো ফরিদপুরের মতো নবভূমিরই অংশ। তবে ইহাদের মধ্যে নদীয়া-যশোর, এবং বোধহয় চব্বিশ-পরগনা ফরিদপুর-ঢাকা-ত্রিপুরার মতো পুরাতন গঠন, আর, খুলনা-বাখরগঞ্জ সমতল নোয়াখালি বা সমতল-চট্টগ্রামের মতো নূতন গঠন। চব্বিশ-পরগনার গাঙ্গেয় অঞ্চল তো সুপ্রাচীন জনাবাস ও সভ্যতার কেন্দ্ৰই ছিল।
সমতট
য়ুয়ান-চোয়াঙ সমতটেও আসিয়াছিলেন। তিনি বলিতেছেন, এই সমতট সমুদ্র-তীরবর্তী দেশ; ইহার ভূমি জলীয় এবং সমতল। ইহার শস্যসম্ভার বা জনসমৃদ্ধি সম্বন্ধে তিনি কিছুই বলেন নাই। য়ুয়ান-চোয়াঙের সমতট তদানীন্তন যশোর-ফরিদপুর-ঢাকা অঞ্চল বলিয়াই যেন মনে হয়; অন্তত খুলনা-বাখরগঞ্জের ভূখণ্ড যে নয় এ অনুমান বোধহয় করা চলে। তখন বোধহয় এইসব অঞ্চল ভালো করিয়া গড়িয়াই উঠে নাই। আগেই দেখিয়াছি, ষষ্ঠ শতকে ফরিদপুরের কোটালিপাড়া অঞ্চল নূতন সৃষ্ট হইয়াছে মাত্র, তখনও তাহার নাম ‘নব্যারকাশিকা’, এবং সম্ভবত এই জনপদ তখন প্রায় সমুদ্রতীরবর্তী। বাখরগঞ্জের ‘নাব্য’ অঞ্চল তাহার অনেক পরের সৃষ্টি। ঐতিহাসিক কালে নূতন ভাঙাগড়া উলট-পালট বাঙলার এই দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলেই বেশি হইয়াছে।
জলবায়ু, বসন্ত বায়ু, বৰ্ষা ও হেমন্তের বাঙলা
জলবায়ু সম্বন্ধে য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য ভূ-প্রকৃতি প্রসঙ্গে কিছু কিছু জানা গিয়াছে; মোটামুটি একটা ধারণা তাহা হইতেই পাওয়া যায়। বাঙলার জলবায়ু এখনও নাতিশীতোষ্ণ; তবে পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষত বীরভূমে, বর্ধমানের পশ্চিমাংশে এবং কতকটা মেদিনীপুরেও, গ্ৰীষ্মের তাপ প্রখরতার; অন্যত্র গ্ৰীষ্মের বায়ু উষ্ণ জলীয়। য়ুয়ান-চোয়াঙ তাহা লক্ষ্য ও বিবরণীবদ্ধ করিতে ভোলেন নাই। কিন্তু বাঙলাদেশের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য হইতেছে। পূর্ব ও উত্তর-বঙ্গের বারিপাতবাহুল্য। এই বারিপাত ভারত-মহাসাগরবাহিত মৌসুমীবায়ুসঞ্জাত। এই বায়ু হিমালয়, গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়াপাহাড়ে প্রতিহত হইয়া সমগ্ৰ উত্তর ও পূর্ব-বাঙলাকে, বিশেষভাবে, দাৰ্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কোচবিহার, রংপুর, পাবনা, বগুড়া, মৈমনসিং, শ্ৰীহট্ট, ফরিদপুর, বরিশালকে অবিরল বারিপাতে ভাসাইয়া দেয়। আর-একটি বায়ু-প্রবাহ বসন্তের। ফাল্গুন-চৈত্র মাসের দক্ষিণা বাতাসের বৃপকচ্ছলে এই প্রবাহের কিঞ্চিৎ আভাস বোধহয় ধোয়ী কবির ‘পবনদূতে’ পাওয়া যায়। লক্ষণসেন যখন দিগ্বিজয়-উদ্দেশে দক্ষিণ-ভারতে গমন করেন তখন কুবলয়াবতী নামে মলয়পৰ্বতের এক গন্ধৰ্ব্বনারী তাহার প্রতি প্রেমাকৃষ্ট হন; বসন্তাগমে কুবলয়াবতী লক্ষণসেনের বিরহ সহ্য করিতে না পারিয়া বসন্ত পবনকে দূত করিয়া প্রেরণ করেন। এই বসন্ত পবন উত্তর-পূর্ববাহী, এবং যেহেতু ইহা মলয়পৰ্বত স্পর্শ করিয়া আসে সেই হেতু কাব্যসাহিত্যে বসন্তের বাতাসের নাম মলয় পবন। কুবলয়াবতী পবনদূতকে মলয় পর্বত হইতে উত্তর-পূর্ববাহী হইয়া গৌড়ে লক্ষণসেন-সমীপে যাইতে আদেশ করিয়াছিলেন; দূত সে আদেশ পালন করিয়াছিল, তবে পথে হয়তো বিভ্রান্ত হইয়া অনেক বিপথ বিদিক ঘুরিয়া তবে রাজধানী বিজয়পুরে আসিয়া পৌছিয়াছিল। যাহা হউক, এই কাহিনীতে বাঙলার বসন্তকালীন পবন-প্রবাহের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট। সংকলনকর্তা শ্ৰীধরদাসের সদুক্তিকর্ণামৃত-নামক সংকলন-গ্রন্থে বিভিন্ন বাঙালী কবির রচিত বায়ু প্রসঙ্গে প্রাকৃতিক বর্ণনাময় কতকগুলি শ্লোক উদ্ধৃত আছে। দক্ষিণ-বায়ুর বর্ণনা প্রসঙ্গে দক্ষিণাপথের বিভিন্ন দেশের তরুণীদের আশ্রয়ে দুইজন অজ্ঞাতনামা কবি বেশ রোম্যান্টিক কবি-কল্পনার পরিচয় দিয়াছেন। বারিবাহী মৌসুমী বায়ুর কোনও বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক উল্লেখ ও বর্ণনা পাওয়া যাইতেছে না; তবে, রাজেন্দ্রচোলের তিরুমালয় লিপিতে বাঙলাদেশের অবিরল বারিপাতের একটু সংক্ষিপ্ত উল্লেখ আছে। বাঙলাদেশ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, এই দেশে বারিপাতের কখনও বিরাম ছিল না। (Vangaladesa where the rain water never stopped) বর্ষার অবিরল বৃষ্টিপাত তো এখনও পূর্ব ও দক্ষিণ-বঙ্গের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য। একাদশ-দ্বাদশ শতকের বাঙলার বর্ষার একটি বাস্তব সুন্দর ছবি আঁকিয়াছেন কবি যোগেশ্বর (ইনি বাঙালী ছিলেন, এতটুকু সন্দেহ নাই), এবং ছবিটি গ্রাম্য নায়ক তথা কৃষক যুবকের সুখস্বপ্নেরও। উদ্ধার-লোভ সংবরণ করা কঠিন।
ব্রীহিঃ স্তম্বকারিঃ প্রভূত পয়সঃ প্রত্যাগতা ধেনবঃ
প্রত্যুজ্জীবিতমিক্ষুণা ভূশমিতি ধ্যায়ন্ত্রপেতানাধীঃ।
সান্দ্রোশীর কুটুম্বিনী স্তনভর ব্যালুপ্তঘর্মক্লমো।
দেবে নীরমুদারমুজ্ঝতি সুখং শেতে নিশাং গ্রামণীঃ৷ সিদুক্তিকর্ণামৃত, ২/৮৪/৩]
প্রচুর জল পাইয়া ধান চমৎকার গজাইয়া উঠিয়াছে, গোরুগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়াছে; ইক্ষুর সমৃদ্ধিও দেখা যাইতেছে; [কাজেই] অন্য কোনও ভাবনা আর নাই; ঘর্মক্লান্তিমুক্ত স্ত্রীও ঘরে এই অবসরে উশীর প্রসাধন করিতেছে; বাহিরে আকাশ হইতে জল ঝরিতেছে প্রচুর, গ্রাম্য যুবক সুখে শুইয়া আছে।
প্রাচ্যদেশ বাঙলাদেশ যে প্রচুর জল এবং প্রচুর বারিপাতেরই দেশ, তাহা তো পাল-লিপির প্রসিদ্ধ ‘দেশে প্রাচি প্রচুর পয়সি স্বচ্ছমাপীয় তোয়ং’ পদেই প্রমাণ। আর, ‘গুরু-গভীর ঘন বর্ষায়’ মেদুর আকাশকে ‘মেঘৈর্মেদুরমম্বরম’ বলিয়া বাঙালী কবি জয়দেব যে অভিনন্দন জানাইয়াছেন, এবং তার শ্যাম মহিমাকে যে চিত্রে ফুটাইয়া তুলিয়াছেন, তাহা তো বাঙালীর একান্তই সুপরিচিত এবং তাহা বাঙলাদেশ সম্বন্ধেই প্রযোজ্য বলিয়া মনে হয়।
যে ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ কাব্য-সংকলন গ্ৰন্থ হইতে বর্ষার বাঙলার উপরোক্ত চিত্রটি উদ্ধার করা হইয়াছে, সেই গ্রন্থ হইতেই হেমন্তের বাঙলার আর একটি ছবি উদ্ধারের লোভ সংবরণ করা গেল না; এটি একটি অজ্ঞাতনামা (বোধহয় বাঙালী) কবির রচনা, এবং ধান্য ও ইক্ষুসমৃদ্ধ বাঙলার অগ্রহায়ণ-পৌষের অনবদ্য, মধুর বাস্তব চিত্র।
শালিচ্ছেদ-সমৃদ্ধ হালিকগৃহাঃ সংসৃষ্ট-নীলোৎপল
স্নিগ্ধ-শ্যাম-যব-প্ররোহ-নিবিড়ব্যাদীর্ঘ-সীমোদেরাঃ।
মোদন্তে পরিবৃত্ত-ধেন্বনডুহচ্ছাগাঃ পলালৈনবৈঃ
সংসত্তা-ধ্বনিদিষ্ণু যন্ত্রমুখরা গ্ৰাম্য গুড়ামোদিনঃ৷ [সদুক্তিকর্ণামৃত, ২/১৩৬/৫]
কৃষকের বাড়ি কাটা শালিধান্যে সমৃদ্ধ হইয়া উঠিয়াছে। [আঁটি আঁটি কাটা ধান আঙিনায় স্তুপীকৃত হইয়াছে—পৌষ মাসে এখনও যেমন হয়]; গ্রাম সীমান্তের ক্ষেতে যে প্রচুর যব হইয়াছে তাহার শীষ নীলোৎপলের মতো স্নিগ্ধ শ্যাম; গোরু, বলদ ও ছাগগুলি ঘরে ফিরিয়া আসিয়া নূতন খড় পাইয়া আনন্দিত; অবিরত ইক্ষুযন্ত্র ধ্বনিমুখর [আখ মাড়াই কলের শব্দে মুখরিত] গ্রামগুলি [নুতন ইক্ষু] গুড়ের গন্ধে আমোদিত।
লোক-প্রকৃতি
লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত য়ুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য হইতে ইতিপূর্বেই পাওয়া গিয়াছে। কজঙ্গলের লোকেরা স্পষ্টাচারী, গুণবান এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান; পুণ্ড্রবর্ধনের লোকেরাও জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি শ্রদ্ধাবান। কামরূপের লোকেরা সদাচারী হওয়া সত্ত্বেও হিংস্র৷ প্রকৃতির; তাম্রলিপ্তির লোকেরা বুঢ়াচারী কিন্তু তাহারা কর্মঠ ও সাহসী; সমতটের লোকেরা কর্মঠ; কর্ণসুবর্ণের লোকেরা ভদ্র ও সচ্চরিত্র এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের সুপোষক; তাম্রলিপির লোকেরাও জ্ঞানবিজ্ঞানের অনুরাগী। কিন্তু লোক-প্রকৃতির ব্যক্তিগত বিবরণ যথেষ্ট বস্তুগত ও প্রামাণিক সাক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা কঠিন। প্রথমত, এ ব্যাপারে দর্শক বা পর্যবেক্ষকের ব্যক্তিগত লুচি-অরুচির প্রশ্ন অনিবার্য; দ্বিতীয়ত, দুই-একটি বিচ্ছিন্ন, প্রসঙ্গবৰ্জিত উদাহরণ হইতে সাধারণভাবে কয়েকটা মন্তব্যে পৌঁছানও এইসব লেখক ও পর্যবেক্ষকের পক্ষে অসম্ভব কিছু নয়! তৎসত্ত্বেও বিদেশী ও ভিনাপ্রদেশী লােকেরা বিভিন্ন সময়ে বাঙালীর লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কী কী বিভিন্ন ধারণা পোষণ করিতেন তাহার একটু হিসাব লওয়া হয়তো নিরর্থক নয়।
গৌড়-বঙ্গ
‘কামসূত্র’-রচয়িতা বাৎস্যায়ন (তৃতীয়-চতুর্থ শতক) বলিতেছেন, তাহার সময়ে প্রাচ্যদেশের লোকেরা মধ্যদেশের জনসাধারণ অপেক্ষা যৌন ও মিথুন ব্যাপারে অনেক বেশি শিষ্ট ছিল। প্রাচ্যদেশের অন্যান্য অনেক বিভাগের সঙ্গে গৌড় ও বঙ্গ এই দুইটি বিভাগ তিনি জানিতেন; কাজেই তাহার এই মন্তব্য গৌড়-বঙ্গ সম্বন্ধেও নিশ্চয়ই প্রযোজ্য। কদৰ্যতম যৌন অনাচার হইতে তাহারা মুক্ত ছিল; তবে এই দেশেরই রাজান্তঃপুরের–সব দেশে-কালেই যেমন হইয়া থাকে-মহিলারা তাহাদের কামবাসনা চরিতার্থ করিবার জন্য নানারূপ কৌশল অবলম্বন করিতেন। গৌড়বাসীরা সুপুরুষ ছিল, এ সাক্ষ্য বাৎস্যায়ন দিতেছেন, এবং গৌড়-নারীরা যে মৃদুভাষিণী, মৃদু-অঙ্গা এবং অনুরাগবতী ছিলেন তাহাও বলিতেছেন। তাহা ছাড়া তিনি একটি কৌতুহলোদ্দীপক খবরও দিতেছেন; তাহা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যাইতে পারে। গৌড়-পুরুষেরা আঙুলের সৌন্দর্যবৃদ্ধির উদ্দেশ্যে লম্বা লম্বা নখ রাখিতেন এবং মহিলারা নাকি তাহাতে খুব আকৃষ্ট হইতেন। গৌড়দেশের বিভিন্ন নাগরিক এবং বিদগ্ধ নারীদের নানাপ্রকার কাম এবং বিলাস লীলার বিবরণ পড়িলে বাঙলার নগর-সভ্যতা তৃতীয়-চতুর্থ-পঞ্চম শতকে যৌনব্যাপারে খুব যে নীতি ও সংযমপরায়ণ ছিল, অবশ্য বর্তমান আদর্শে, তাহা তো মনে হয় না। কিন্তু এ প্রসঙ্গ গ্রন্থের অন্যত্র আলোচিত হইয়াছে।
গৌড়বাসী সম্বন্ধে আরও খবর পাওয়া যাইতেছে। বাঙালীদের বিদ্যাচর্চায় অনুরাগের সাক্ষ্য য়ুয়ান-চোয়াঙের নিকট হইতে আগেই পাওয়া গিয়াছে। তাহা ছাড়া, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণে, নানা তিব্বতী গ্রন্থে, অসংখ্য ভিনাপ্রদেশের লিপিমালা এবং সাহিত্যগ্রন্থ হইতে অনবরতই দেখা যাইতেছে, এখনকার মতো প্রাচীন কালেও বাঙালী ছাত্র ও শিক্ষকরূপে ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং ভারতবর্ষের বাহিরে যাতায়াত করিত। কবি ক্ষেমেন্দ্র তাহার “দেশোপদেশ’ গ্রন্থে কাশ্মীরে গৌড়দেশের ছাত্রদের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলিতেছেন, এইসব ছাত্রর দেহ এত ক্ষীণ যে, হস্তম্পর্শেই ইহাদের দেহ ভাঙিয়া পড়িবে বলিয়া যেন মনে হয়, কিন্তু কাশ্মীরের জল-হাওয়ায় কিছুদিনের মধ্যেই তাঁহাদের প্রকৃতি উদ্ধত হইয়া উঠে, এবং স্বল্পমাত্র উত্তেজনাতেই একেবারে সহসা মারমুখী হইয়া উঠে। একবার এইরূপ একটু উত্তেজনার ফলে তাহারা এক দোকানদারকে জিনিসের দাম দিতে অস্বীকার করে এবং মুহুর্তমধ্যেই ছুরিকাঘাতে উদ্যত হয়। গৌড়বাসীর এই অচির-ক্ৰোধপরায়ণতা এবং কলহপ্রিয়তা ‘মিতাক্ষরা’-লেখক বিজ্ঞানেশ্বরও বেশ লক্ষ করিয় ছিলেন।
সুহ্ম-রাঢ়
কালিদাসের ‘রঘুবংশ’ কাব্যে (আনুমানিক পঞ্চম শতক) রঘুর দিগ্বিজয় প্রসঙ্গে সুহ্মদের উল্লেখ আছে; কবি বলিতেছেন, বেতসলতা যেমন অবনত হইয়া নদীর স্রোতাবেগ হইতে আত্মরক্ষা করে, সুহ্মদেশীয় লোকেরা অবনত হইয়া উদ্ধত-উচ্ছেদকারী সেই রঘুর হস্ত হইতে আত্মরক্ষা করিয়াছিল। কবির এই উক্তির মধ্যে সুহ্মদেশীয়দের লোক-প্রকৃতি সম্বন্ধে কোনও ইঙ্গিত আছে কিনা বলা শক্ত, কারণ টীকাকার মল্লিনাথ, বৈতসীবৃত্তি সম্বন্ধে এ প্রসঙ্গে কৌটিল্যের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছেন; “বলীয়সাভিযুক্তো দুর্বলঃ সর্বত্ৰানুপ্রাণতো বেতসধৰ্মমাতিষ্ঠেৎ৷”। সুহ্মেরা রঘু সম্বন্ধেই এইরূপ বৈতসীবৃত্তি অবলম্বন করিয়াছিলেন, না দুর্বল বলিয়া এইরূপ বৃত্তিই ছিল জনসাধারণের প্রকৃতি, তাহা বলা কঠিন।
মহাবীর ও তাহার কয়েকজন শিষ্যকে ধর্মপ্রচারোদ্দেশে পথহীন লাঢ়দেশে, বজ্র (ব্ৰহ্ম?) ও সুহ্মভূমিতে, ঘুরিয়া বেড়াইতে হইয়াছিল (আনুমানিক ষষ্ঠ শতক, খ্ৰীষ্টপূর্ব)। এই গল্পটি জৈনদের ধর্মগ্রন্থ ‘আচারাঙ্গসূত্রে’ বর্ণিত আছে। অন্যত্র তাহা সবিস্তারে উল্লেখ করিয়াছি। এই উপলক্ষে, এই কাহিনীটিতে রাঢ়বাসীদের বৃঢ় আচরণের এবং বজ্জভূমিবাসীদের কুখাদ্য ভক্ষণের প্রতি ইঙ্গিত আছে। তাহা ছাড়া, ‘আর্যমঞ্জুশ্ৰীমূলকল্প’ (অষ্টম শতক) গ্রন্থে গৌড় ও পুণ্ড্রের ভাষাকে অসুরভাষা বলা হইয়াছে, সে কথাও আগে অন্য প্রসঙ্গে বলিয়াছি। মহাভারতে সমুদ্রতীরবাসী বঙ্গদের স্লেচ্ছ এবং ভাগবত-পুরাণে সুহ্মদের ‘পাপ’ কোম বলা হইয়াছে। ‘বোধায়ন ধর্মসূত্রে’ বলা হইয়াছে, মধ্যদেশ বা আর্যবর্ত হইতে বঙ্গদেশে গেলে ফিরিয়া আসিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিতে হয়; এই দুই দেশ অশিষ্টভূমির অন্তর্গত এবং লোকেরা ‘সংকীর্ণ-যোনয়ঃ’। কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন, এই সমস্ত উক্তি আর্যভাষাভাষী, আর্য-সংস্কৃতিসম্পন্ন লোকদের; গোঁড়-পুণ্ড্র-বঙ্গের অনার্য বা আর্যপূর্ব লোকদের ভাষা, সংস্কৃতি ও আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে ইহাদের জ্ঞানও ছিল না, শ্রদ্ধা-ভক্তিও ছিল না; তাহারা সেই সুপ্রাচীনকালে ইহাদের অবজ্ঞার চোখেই দেখিতেন। কিন্তু আশ্চর্য এই, রাঢ়দেশবাসী মুকুন্দরামও “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যে রাঢ়দেশবাসীকে একটু বুঢ়া এবং হিংস্র প্রকৃতির লোক বলিয়াছেন। রাঢ়দেশের লোকেরা যে একটু বুঢ়া এবং অশিষ্ট প্রকৃতির লোক ছিলেন, তাহা ঘনরামের ‘ধর্মমঙ্গলে’র একটি পদেও সুস্পষ্ট। মুকুন্দরাম লিখিয়াছেন :
অক্ষটি হিংশক রাড় চৌদিকে পশুর হাড়।
কৃতাঞ্জলি বীর কহে হই গ চোয়াড়।
লোকে না পরস করে সাভে বলে রাড় ॥
ঘনরাম লিখিয়াছেন :
জাতি রাঢ় আমি রে, করমে রাঢ় তু।
দক্ষিণ-রাঢ়ের ব্রাহ্মণেরা যে দাম্ভিক প্রকৃতিক লোক ছিলেন তাহার একটু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায় কৃষ্ণমিশ্রের ‘প্ৰবোধচন্দ্ৰোদয়’ নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কে। কৃষ্ণমিশ্র এই ব্ৰাহ্মণদের একটু ব্যঙ্গই করিয়াছেন। অহংকাররূপী ব্ৰাহ্মণের যে চিত্র তিনি আঁকিয়াছেন তাহা উজ্জ্বল এবং উপভোগ্য। জন্মদেশ, জনপদ এবং নগরের, পিতার এবং নিজের অহংকৃত পরিচয়ের পর ব্ৰাহ্মণ-অহংকার বলিতেছেন,
নাম্মাকং জননী তথোজ্জলকুলা সচ্ছেত্রিয়ানাং পুনর
বুঢ়া কাচন কন্যক খলু ময়া তেনাস্মি ততোধিকঃ।
অস্মচ্ছ্যালকভাগিনেয়দুহিতা মিথ্যাভিশপ্ত যতস
তৎসম্পর্কবাশান্ময়া স্বগৃহিণী প্রেয়স্যপি প্রোজ্ঝিতা ॥
ব্ৰাহ্মণ-অহংকারের আত্মশ্লাঘার প্রতি শ্লেষ সত্যই উপভোগ্য!
কবি ধোয়ীও দক্ষিণ-রাঢ়ের (সুহ্মদেশের) প্রশংসায় উচ্ছ্বসিত হইয়া বলিয়াছেন, “রসময় সুহ্মদেশঃ।”
রাজশেখরের ‘কর্পূরমঞ্জরী’ গ্রন্থে হরিকেল (চন্দ্ৰদ্বীপ-শ্ৰীহট্ট-ত্রিপুরা-মৈমনসিং অঞ্চল, হয়তো চট্টগ্রাম অঞ্চলও) দেশের নারীদের খুব স্তুতিবাদ করা হইয়াছে, এবং রাঢ় ও কামরূপের নারীদের তুলনায় শ্রেষ্ঠতরা বলা হইয়াছে। রাজশেখর গৌড়াঙ্গানাগণের বেশভূষার বর্ণনা করিয়া যে তুতিবাদ করিয়াছেন ‘সদুক্তিকর্ণামৃত’ গ্রন্থে (১২০৬) তাহা উদ্ধৃত হইয়াছে। এই গ্রন্থেই কোনও এক অজ্ঞাত কবির রচিত (পূর্ব) বঙ্গীয় নারীদের সাজ-সজ্জা বর্ণনার একটি শ্লোক উদ্ধার করা হইয়াছে। অন্য আর একজন কবি বাঙলার গ্রাম্য তরুণীর বর্ণনা দিয়া আর একটি শ্লোক বাধিয়াছেন, তাহাও এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। এই সব শ্লোক অন্যত্র উদ্ধার ও আলোচনা করিয়াছি (আহার-বিহার, বসন-ব্যাসন, দৈনন্দিন জীবন প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য)।
প্রাচীন বাঙলার ফলফুল বৃক্ষলতা-শস্যসম্ভারের এবং অন্যান্য উৎপন্ন দ্রব্য ইত্যাদির পরিচয় দেশ-পরিচয়েরই অংশ; ধনসম্বল অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে সবিস্তার উল্লেখ করা হইয়াছে। ধান, যুব, পাট, ইক্ষু, সরিষা, আম, মহুয়া, কাঁটাল, নানাবিধ বস্ত্ৰ-সম্ভার, ধাতুদ্রব্য, খনিজ দ্রব্য, লবণ, পান, গুবাক, নারিকেল, বাঁশ, মাছ, ডালিম, ডুমুর (পর্কটী), খেজুর, পিপ্পল, এলাচ ইত্যাদি শস্য ও দ্রব্যসম্ভার কোথায় কী উৎপাদিত হইত। তাহাও সেই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হইয়াছে। জীবজন্তু সম্বন্ধেও একই কথা। বর্তমান ও পূর্বোক্ত অধ্যায়েই ব্যাঘু, হন্তী, হরিণ, ঘোড়া, বানর, গোরু, ভেড়া, ছাগল, কুকুট, বরাহ, নানা প্রকারের মাছ ইত্যাদির কথাও বলা হইয়াছে।