ব্যবসা-বাণিজ্য
পান, গুবাক ও নারিকেলের ব্যাবসা। লবণের ব্যাবসা
এই নৌশিল্পের কথা হইতেই ধনোৎপাদনের তৃতীয় উপায় ব্যাবসা-বাণিজ্যের কথার মধ্যে আসিয়া পড়া যাইতে পারে। এ-পর্যন্ত ভূমিজাত ও শিল্পজাত যে-সব দ্রব্যাদির কথা বলিয়াছি, তাহাই ছিল ব্যাবসা-বাণিজ্যের উপকরণ। ফলফুল, অর্থাৎ আম, কঁাটাল, মহুয়া ইত্যাদি লইয়া কোনও বিস্তৃত ব্যাবসা সম্ভব ছিল না; মৎস্য সম্বন্ধেও তাহাই। তবু গ্রাম হইতে গ্রামান্তরের হাটে হাটে এইসব জিনিস লইয়া ছোটখাটো ব্যাবসা-বাণিজ্য চলিত বই-কি। হট্ট, হট্টিকা, হট্টিয়গৃহ, হট্টবর, আপণ, মানপ (তীেলদার = দোকানদার = ছোট ব্যবসায়ী) ইত্যাদি শব্দের উল্লেখ প্রায়শ লেখমালাগুলিতে দেখা যায়। অষ্টম শতক-পরবর্তী লিপিগুলিতে তো অনেক স্থলেই হাট-বাজার-ঘাট সমেত (সহট্ট সঘট্ট) জমি দান করা হইয়াছে। হট্টপতি, শৌন্ধিক, তরিক ইত্যাদি রাজকর্মচারীর উল্লেখ হইতেও একটা সমৃদ্ধ অন্তর্বাণিজ্যের কতকটা আভাস পাওয়া যায়; হাটবাজার, বাণিজ্য-শুদ্ধ এবং পারঘাটা-খেয়াঘাটের কর ইত্যাদি আদায়ের দায়িত্ব ছিল ইহাদের উপর। প্রসঙ্গ উল্লেখ হইতে মনে হয়, এইসব উপায় হইতে রাষ্ট্রের যথেষ্ট অর্থাগম হইত। ধর্মদিত্যের পট্টোলী দুইটিতে “ব্যাপার-কারাগুয়া” এবং “ব্যাপোরণ্ড্য” ও গোপচন্দ্রের পট্টোলীতে “ব্যাপারায় বিনিযুক্তক” নামে একপ্রকার রাজপুরুষের উল্লেখ আছে; খুব সম্ভব। ইহারা ব্যাবসা-বাণিজ্য রক্ষণাবেক্ষণের ভারপ্রাপ্ত কর্মচারী ছিলেন এবং ছোটবড় নগরগুলিই এইসব ব্যাবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। নব্যাবকাশিকা এবং কোটীবর্ষ যে বণিক ও ব্যবসায়ীদের খুব সমৃদ্ধ মিলনকেন্দ্র ছিল এ খবর তো কোটালিপাড়া ও দামােদরপুর পট্টোলীতেই পাওয়া যায়। পুণ্ড্রবর্ধনের কোনও এক অনুল্লিখিত স্থানে যে বিচিত্র বিপণিমালা শোভিত এক সমৃদ্ধ, বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল, সে খবর পাওয়া যাইতেছে সোমদেবের কথাসরিৎসাগর গ্রন্থে। কিন্তু শহর ছাড়া গ্রামাঞ্চলের হাটবাজারেও কিছু কিছু ব্যাবসা-বাণিজ্য নিশ্চয়ই চলিত। ইরদা লিপিতে দেখিতেছি হাটসহ একটি গ্রাম দান করা হইতেছে; দামোদর লিপি, ধর্মপালের খালিমপুর লিপি, গোবিন্দকেশবের ভাটেরা লিপি প্রভৃতিতেও হাটবাজার সমেত অনুরূপ ভূমি বা গ্রাম দান-বিক্রয়ের উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এইসব গ্রাম ও গ্রামান্তরের হাটে স্থানীয় উৎপন্ন ও নিত্য-প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি লইয়াই ক্ৰয়-বিক্রয় চলিত। ভূমিজাত অন্যান্য কিছু কিছু দ্রব্য, যেমন পান, সুপারি, নারিকেল ইত্যাদির ব্যাবসা নিশ্চয়ই বিস্তৃততর ছিল সন্দেহ নাই, এবং শুধু বাঙলাদেশের ভিতরেই নয়, দেশের বাহিরেও প্রতিবেশী দেশগুলিতে সুপারি ও নারিকেল এই দুই দ্রব্যই কিছু কিছু রপ্তানি হইত, এরূপ অনুমান করা যায়। পরবর্তী মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যের প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া। বংশীদাসের মনসামঙ্গলে ও কবিকঙ্কণ মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গলকাব্যে পাই, দক্ষিণ-ভারতের সমুদ্রোপকূল বাহিয়া বাঙালী বণিকেরা গুজরাট পর্যন্ত যে বাণিজ্য-সম্ভার লইয়া যাইতেন, তাহার মধ্যে গুয়া(ক) বা গুবাক, পান ও নারিকেল উল্লেখ্য। গুয়ার বদলে লইয়া আসিতেন মাণিক্য, পানের বদলে মরকত এবং নারিকেলের বদলে শঙ্খ। গুয়া বা গুবাক যে সুপারি নাম লইল, তাহার ইতিহাসের মধ্যে বাঙলাদেশের এই দ্রব্যটির বাণিজ্য ইতিহাসও লুকাইয়া আছে। বর্তমান গৌহাটি শহরের নামটি আসিয়াছে গুয়া হইতে; গুবাক৷ ক্রয়-বিক্রয়ের হাট বা হাটি অর্থে গুবাহাটি = গুয়াহাটি = গৌহাটি। যাহা হউক, এই গুবাক৷ প্রাচীন কালেই আরব-পারস্য প্রভৃতি দেশগুলিতে রপ্তানি হইত; ঐ দেশীয় বণিকেরা এই দ্রব্য জাহাজ বোঝাই করিতেন বাঙলাদেশের কোনও সামুদ্রিক বন্দর হইতে নয়, পশ্চিম-ভারতের বন্দর শূর্পারক = সুপ্পারক = সোপারা হইতে, এবং তাহারা এই দ্রব্যকে সোপারার ফল বলিয়াই জানিতেন; এই অর্থে পরবর্তী কালে গুবাক হইল সুপারি এবং সেই নামেই ভারতের সর্বত্র ইহার পরিচয়; কিন্তু বাঙলাদেশের, বিশেষত পূর্ববাঙলার গ্রামে গ্রামে এখনও ইহার নাম গুবা বা গুয়া। গুবকের ব্যাবসা যে খুবই প্রশস্ত ছিল, এবং তাহা হইতে এই দেশের প্রচুর অর্থগমও হইত, তাহার প্রমাণ তো ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমল পর্যন্তও পাওয়া যায়। কোম্পানির আমলে সুপারি বাঙলাদেশের একচেটিয়া ব্যাবসা ছিল। এই সুপারি-নারিকেলের অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের ইতিহাস যদি পরবর্তী মধ্যযুগ বাহিয়া কোম্পানির আমল পর্যন্ত অনুসরণ করা যায়, তবেই বুঝা যাইবে প্রাচীন বাঙলার ভূমিদানি-সম্পর্কিত লিপিগুলিতে বিশেষ করিয়া গুবাক, নারিকেল এবং পানের বরজের বির (অস্ট্রিক) = পান; বরজ = পান যেখানে জন্মায়; পানের বরজ যাহাদের জীবিকা তাহারা বারুজীবী = বারুই] উল্লেখ কেন করা হইয়াছে, এবং অনেক ক্ষেত্রে তাহা হইতে আয়ের পরিমাণও কেন উল্লেখ করা হইয়াছে। লবণ সম্বন্ধেও ঠিক একই কথা বলা চলে। বাঙলাদেশের লবণ সামুদ্রিক লবণ। মধ্যযুগের যে দুইটি কাব্যের নাম কিছু আগে করিয়াছি, তাহাতেই প্রমাণ আছে, লবণও অন্যতম বাণিজ্যসম্ভার ছিল। বাঙালী বণিকেরা সামুদ্রিক লবণের বিনিময়ে পাথুরে লবণ লইয়া আসিতেন। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির আমলেও দেখি, লবণের ব্যাবসা লইয়া কাড়াকড়ি; কোম্পানির সওদাগরেরা অনবরত চেষ্টা করিতেছেন। লবণের ব্যাবসা একচেটিয়া করিতে। এই প্ৰয়াসের ইতিহাস পড়িলে স্বতই মনে হয়, ব্যাবসাটা খুবই লাভবান ছিল। সে-কথাটি না বুঝিলে প্রাচীন লিপিগুলিতে কেন যে ভূমি-দানের সময় বারবারই ‘সলবণ” কথাটি উল্লেখ করা হইতেছে, সে-রহস্যটি ধরা পড়ে না।
পিপ্পলির দাম : বস্ত্ৰ-ব্যাবসা ও বিস্ত্রের মূল্য
Periplus Erythri Mari-গ্রন্থে তেজপাতা ও পিপ্পলের উল্লেখ আমরা দেখিয়াছি। এই দুটি দ্রব্যের ব্যাবসাও খুব লাভজনক ব্যাবসা ছিল সন্দেহ নাই। সব দ্রব্যের বাণিজ্য-মূল্য উপাদানের অভাবে জানিবার উপায় নাই; কিন্তু পিপ্পলির বাণিজ্যমূল্যের খানিকটা আভাস পাইতেছি প্লিনির ইণ্ডিকা নামক গ্ৰন্থ হইতে (খ্ৰী প্রথম শতক)। তিনি বলিতেছেন, রোম সাম্রাজ্যে এক পাউন্ড বা আধ সের পিপ্পলির দাম ছিল তখনকার দিনে ১৫ দিনার, অর্থাৎ পনরাটি স্বর্ণমুদ্রা। ইহা হইতেই বুঝা যাইবে, এইসব বাণিজ্যসম্ভার হইতে দেশে কম। অর্থাগম হইত না। কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্ৰশিল্প সম্বন্ধেও একই কথা বলা চলে। এই শিল্প সম্বন্ধে আগে যে-সমস্ত প্রমাণ উদ্ধৃত করিয়াছি, তাহা হইতেই বুঝা যাইবে, নানাপ্রকার বস্ত্রের ব্যাবসা বাঙলাদেশে খুব সুপ্রাচীন এবং শুধু প্রাচীন বাঙলায়ই নয়, একেবারে অষ্টাদশ শতকের শেষ, উনবিংশ শতকের প্রথম পর্যন্ত সর্বদাই এই বস্ত্রশিল্পের ব্যাবসা দেশের অর্থাগমের একটা মস্ত বড় উপায় ছিল। প্লিনি সেই খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকেই বলিতেছেন, ভারতবর্ষ হইতে যত রেশম ও কার্পাস ইত্যাদি বস্ত্ৰ পশ্চিমের বণিকেরা বহন করিয়া লইয়া যাইত, তাহার বার্ষিক মূল্য ছিল (আনুমানিক) এক লক্ষ (স্বর্ণ?) মুদ্রা। এই অর্থের একটা বৃহৎ অংশ যে বাঙলাদেশে আসিত, তাহাতে সন্দেহ কী?
বাণিজ্যে তাম্রলিপ্তের স্থান
রাষ্ট্র ও সমাজে বণিক ব্যবসায়ীর স্থান
বংশীদাসের জনসামঙ্গল অথবা মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে বাঙালীর অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের যে ছবি পাওয়া যায়, তাহা অতিরঞ্জিত সন্দেহ নাই। গ্রন্থ দুইটি আমাদের যুগের পক্ষে অর্বাচীনও, কিন্তু তৎসত্ত্বেও সাক্ষ্য দুটি যে বাঙালীর প্রাচীন বাণিজ্যস্মৃতি বহন করে, এ কথা সকলেই স্বীকার করেন। ইহার সাক্ষ্য আমাদের বক্ষ্যমান বিষয়ে প্রামাণিক কিছুতেই নয়, তবু এই দেশজাত পান, গুবাক, নারিকেল ইত্যাদির পরিবর্তে বণিকেরা যে-সব মূল্যবান দ্রব্য লইয়া আসিতেন তাহার অংশমাত্রও যদি সত্য হয়, তাহা হইলেও এ কথা অনুমান করা চলে যে, প্রাচীন বাঙলায় অর্থাগমের অন্যতম নয়, প্রথম ও প্রধান উপায়ই ছিল বাণিজ্য। এ কথা যে একেবারে শূন্যকথা নয়, তাহা বস্ত্ৰশিল্প ও পিপ্পল সম্বন্ধে প্লিনির উক্তি হইতেও কতকটা বুঝা যায়। ইক্ষু ও ইক্ষুজাত দ্রব্য, লবণ, নানা প্রকারের হীরা, মুক্তা ও সোনা, তেজপাতা ও অন্যান্য মসলা দ্রব্য ইত্যাদির কথা তো আগেই বলিয়াছি। হাজারিবাগ জেলার দুধপানি পাহাড়ে একটি লিপি উৎকীর্ণ আছে; অক্ষরের রূপ দেখিয়া মনে হয় লিপিটি খ্ৰীষ্টীয় অষ্টম শতকের। এই লিপিতে আছে :
অথ কস্মিংশ্চি [ৎস] ময়ে বাণিজো ভ্রাতরস্ত্ৰয়ঃ।
তাম্রলিপ্তি [ম] যোধ্যায়া যযুঃ পূর্বম্বণিজয়া ৷।
ভূয়ঃ প্রতিনিবৃত্তান্তে সমাবাসং বিয়াসবঃ।
প্রয়োজনেন কেন্যাপি চিরঞ্চকুরিহ স্থিতিং ॥
সুবৰ্ণমণি মাণিক্য মুক্ত প্রভৃতি যৈর্ধ নং।
বিত্তাপম্পৰ্ধয়েবা সোদপর্যন্তমুপার্জিতং ॥
অষ্টম শতকে বলা হইতেছে, ‘কোনো-এক সময়ে’ অর্থাৎ এখানে যে উল্লেখটি আছে, তাহা একটি প্রাচীন দিনের ঘটনার স্মৃতি। কিন্তু, বাণিজ্য উপলক্ষে তিন ভাই অযোধ্যা হইতে তাম্রলিপ্তিতে আসিয়া কিছুকালের মধ্যে প্রচুর ধনরত্ন উপার্জন করিয়া নিজের দেশে ফিরিয়া গিয়াছিলেন, এ কথাটির মধ্যে ঐতিহাসিক সত্য নিহিত আছে, তাহাতে আর সন্দেহ কী? বৌদ্ধ জাতকের অনেক গল্পে বাণিজ্য উপলক্ষে তাম্রলিপ্তির উল্লেখও সুপরিচিত; পুনরুল্লেখ নিম্প্রয়োজন। সোমদেবের কথাসরিৎসাগরে একাধিক জায়গায় উল্লেখ আছে, পাটলীপুত্র হইতে বাণিজ্য উপলক্ষে বণিকদের পুণ্ডে অথবা পুণ্ড্রবর্ধনে আসিবার কথা। ই-ৎসিঙুও এই পথেরই উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন, তাম্রলিপ্তি হইতে পশ্চিমবাহী পথ ধরিয়া যখন তিনি বুদ্ধগয়া যাইতেছিলেন তখন তাহার পথসঙ্গী হইয়াছিল শত শত বণিক। তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যের উল্লেখও বারবার নানা গ্রন্থে দেখা যাইতেছে। বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষায় গুজরাটের সঙ্গে গৌড়ের বাণিজ্য-সম্বন্ধের আভাস পাইতেছি। গঙ্গার মুখে গঙ্গািবন্দরের কথা, তাম্রলিপ্তি ও কর্ণসুবর্ণের বাণিজ্য-সমৃদ্ধির উল্লেখ তো যুয়ান-চোয়াঙও করিয়া গিয়াছেন। য়ুয়ান-চোয়াঙ বলেন, নানা প্রকার মূল্যবান দ্রব্য, মণিরত্ন ইত্যাদির প্রচুর সমাগম হইত। তাম্রলিপ্তিতে; তাম্রলিপ্তির লোকেরা এই হেতুই খুব বিত্তবান ছিলেন। কথাসরিৎসাগরের মতে তাম্রলিপ্তি বিত্তশালী বণিকদের কেন্দ্র ছিল; তাহারা লঙ্কা, সুবর্ণদ্বীপ ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক বাণিজ্যে লিপ্ত ছিলেন। উত্তাল বিক্ষুব্ধ সমুদ্রকে তুষ্ট করিবার উদ্দেশ্যে তাঁহারা মণিরত্ন ও অন্যান্য মূল্যবান দ্রব্যাদি জলে অৰ্পণ করিয়া পূজা করিতেন। এই সুপ্রাচীন রীতির উল্লেখ। মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যেও দেখা যায়। এই সমস্ত সাক্ষ্যই সুপরিচিত। এইসব সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখিলে সহজেই মনে হয়, প্রাচীন বাঙলার সমৃদ্ধি যাহা ছিল, তাহা বহুলাংশে নির্ভর করিত ব্যাবসা-বাণিজ্যেরই উপর। তাহা ছাড়া পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত দেখিতেছি, ভূমি দান-বিক্রয়ের দলিলগুলিতে স্থানীয় অধিকরণে যাঁহাদের আহ্বান করা হইতেছে, সেই পাঁচ জনের মধ্যে দুই জন তো রাজকর্মচারীই-বিষয়পতি স্বয়ং এবং প্রথম-কায়স্থ বা জ্যেষ্ঠ-কায়স্থ। বাকি তিন জনের মধ্যে দুই জন ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রতিনিধি-নগরশ্রেষ্ঠী অর্থাৎ শ্রেষ্ঠীগোষ্ঠীর যিনি প্রধান তিনি এবং প্রথম-সার্থবাহ অর্থাৎ বণিকদের মধ্যে যিনি প্রধান তিনি। অবশিষ্ট যিনি রহিলেন, তিনি প্রথম-কুলিক অর্থাৎ শিল্পীগোষ্ঠীর প্রতিনিধি। তাহা হইলে দেখিতেছি, সমসাময়িককালে রাষ্ট্রেও কতকটা আধিপত্য এই বণিক ও ব্যবসায়ীরাই করিতেছেন। রাষ্ট্রের অন্যান্য ব্যাপারেও ‘প্রধান ব্যাপারিণঃ’ যাহারা তাহাদের সাহায্য লওয়া হইতেছে, মহত্তর অর্থাৎ সমাজের অন্যান্য গণ্যমান্য লোকদের সঙ্গে সঙ্গে। এই সম্বন্ধে পরবর্তী এক অধ্যায়ে আরও বলিবার সুযোগ আসিবে; এইখানে এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট হইবে, ব্যাবসা-বাণিজ্যের ফলে এইসব শ্রেষ্ঠী ও বণিকদের হাতে যে অর্থগম হইত, তাহার ফলেই ইহারা রাষ্ট্রে আধিপত্য লাভ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। আমাদের শাস্ত্ৰে যে আছে, ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মীঃ তদর্ধং কৃষিকৰ্মণি’, ঐ কথা প্রাচীন বাঙলায় যথার্থ সার্থকতা লাভ করিয়াছিল বলিলে ইতিহাসের অমর্যাদা হয় না। প্রাচীন বাঙলার লক্ষ্মী ব্যাবসা-বাণিজ্য-নির্ভরই ছিলেন বেশি, এবং সেই লক্ষ্মী বাস করিতেন বণিক, ব্যাপারী, শ্রেষ্ঠী ইত্যাদির ঘরে-ধর্মাদিত্যের ২ নং এবং গোপচন্দ্রের তাম্রপট্টে যাঁহাদের যথাক্রমে বলা হইয়াছে ব্যাপার-কারগুয়ঃ, ব্যাপারিণঃ, তাহাদের ঘরে। মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যে সওদাগরদের ব্যাবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত কাহিনীগুলিতেও সে কথার প্রমাণ আছে; ধনপতি, হীরামাণিক, দুলালধন, ইত্যাদি নাম যে বণিকদের মধ্যেই পাই, তাহা একেবারে নিরর্থক নয়। বর্তমান হুগলী জেলার ভুরশুট গ্রামে প্রাচীন বাঙলার শ্রেষ্ঠীদের খুব বড় একটা কেন্দ্র ছিল। ভুরশুটের প্রাচীন নাম ভূরিশ্রেষ্ঠিক = ভূরিসৃষ্টি = ভূরিশ্রেষ্ঠীর উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায় ভট্টভবদেবের শিলালিপিতে, শ্ৰীধর আচার্যের ন্যায়কন্দলী-গ্রন্থে। শেষোক্ত গ্রন্থে স্পষ্টই বলা হইয়াছে “ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রাম ভূরিশ্ৰেষ্ঠী-জনাশ্রয়”। গ্রামটিতে বিত্তবান সমৃদ্ধ বণিকসম্প্রদায় ছিল কাজেই সঙ্গে সঙ্গে শ্রেষ্ঠীরাও ছিলেন। অষ্টম শতকপূর্ব লিপিগুলিতে দেখা যায় রাষ্ট্রে ও সমাজের সার্থিবাহদের সঙ্গে শ্রেষ্ঠীদেরও যথেষ্ট আধিপত্য ছিল।
বাণিজ্যপথ
এই সমৃদ্ধ বাণিজ্য স্থলপথ ও জলপথ উভয় পথেই চলিত। বাণিজ্যপথের বিস্তৃততর আলোচনা দেশ-পরিচয় অধ্যায়ে ইতিপূর্বেই করিয়াছি; এখানে ইঙ্গিতামাত্রই যথেষ্ট। এই নদীমাতৃক দেশে নৌশিল্পের প্রচলন যেমন দেখিতে পাই, যত “নাবাত-ক্ষেণী’, ‘নৌবাটি’, ‘নৌদণ্ডক’, ‘নৌবিতান, ইত্যাদির উল্লেখ পাইতেছি, চর্যচর্যবিনিশ্চয়-গ্রন্থ হইতে আরম্ভ করিয়া প্রাকৃত-পৈঙ্গল পর্যন্ত প্রাকৃত ও অপভ্রংশে রচিত অসংখ্য গান ও পদে যত নদ-নদী-নৌকা সংক্রান্ত রূপক ও উপমার দেখা পাইতেছি তাহাতে অনুমান হয়, নৌবাণিজ্যই প্রবলতর ও প্রশস্ততর ছিল। গুজরাট হইতে গৌড়ে, কিংবা বারাণসী হইতে পুণ্ড্রবর্ধনে যে বাণিজ্যের আভাস বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষায় কিংবা সোমদেবের কথাসরিৎসাগরে পাওয়া যায়, জাতকের বহু গল্পে তাম্রলিপ্তিতে বণিকদের যে আনাগোনার খবর পাওয়া যায়, তাহা হয়তো স্থলপথেই বেশি হইত, বৌদ্ধ-যুগের সুপরিচিত বাণিজ্যপথ ধরিয়া। বারাণসী হইতে মগধের ভিতর দিয়া অঙ্গের রাজধানী চম্পা হইয়া পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত সাৰ্থবাহের গোরুর গাড়ির লহর চলাচলের পথও ছিল, এ কথা মনে করিতে সুদূরবিন্সপী কল্পনার আশ্রয় লইবার কোনও প্রয়োজন নাই। চম্পা হইতে গঙ্গা ও ভাগীরথী বাহিয়া গঙ্গাবিন্দর ও তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত নৌকাপথও প্রশস্ত ছিল। মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এই নদীপথের বন্দর ও দেশগুলির বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। বংশীদাসের মনসামঙ্গলে, এবং অন্যান্য মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে এবং বিস্তৃত ভাবে মুকুন্দরামের চণ্ডীকাব্যে, বিভিন্ন চৈতন্যচরিত কাব্যে এই পথের কিয়দংশের বন্দরগুলির উল্লেখ আছে। এই বিবরণের মধ্যে প্রাচীন স্মৃতি কিছু লুকাইয়া নাই, এ কথা কে বলিবে? স্থলপথের আর একটি আভাস য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতে পাওয়া যায়। কজঙ্গল বা উত্তররাঢ় হইতে তিনি গিয়াছিলেন পুণ্ড্রবর্ধনে এবং সেখান হইতে একটি বৃহৎ নদী পার হইয়া কামরূপে। এই পরিব্রাজক নিজে নূতন করিয়া পথ কাটিয়া অগ্রসর হন নাই; যে পথ বহু দিন আগে হইতেই বহুলোক-যাতায়াতে প্রশস্ত হইয়াছে, সেই পথেই তিনি গিয়াছিলেন, এ অনুমানই সংগত। এই পথেই কামরূপের সঙ্গে উত্তরবঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের বাণিজ্য-সম্বন্ধ চলিত। পূর্ব ও নিম্নবঙ্গের সঙ্গে কামরূপের বাণিজ্য-সম্বন্ধ ছিল সেই পথ ধরিয়া যে পথে এই চীন-পরিব্রাজক কামরূপ হইতে সমতট ও তাম্রলিপ্তিতে আসিয়াছিলেন। আর, উড়িষ্যার সঙ্গে বাণিজ্য-সম্বন্ধের স্থলপথ ধরিয়াই যে পরবতী কালে চৈতন্যদেব নীলাচল গিয়াছিলেন, তাহা তো সহজেই অনুমেয়। এইসব পথ বহু প্রাচীন এবং বহুজনের চরণচিহ্নে অঙ্কিত।
গঙ্গাবন্দর ও তাম্রলিপ্তি; বৌদ্ধবণিক বুদ্ধগুপ্ত
সামুদ্রিক বাণিজ্যের প্রধান বন্দর যে ছিল গঙ্গািবন্দর ও তাম্রলিপ্তি, তাহাও সুস্পষ্ট। তাম্রলিপ্তিই জাতকের দামলিপ্তি এবং Ptolemy’র Tamalites, য়ুয়ান-চোয়াঙের তিন-মো-লিহ-তি। সিংহলের সঙ্গে তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যপথের আভাস ফাহিয়ান রাখিয়া গিয়াছেন (চতুর্থ শতক)। তাহারও তিন-চারি শত বৎসর আগে ভারতের দক্ষিণ-সমুদ্রতীর বাহিয়া গঙ্গাবিন্দর ও তাম্রলিপ্তির সঙ্গে সুদূর রোম-সাম্রাজ্যের বাণিজ্য-সম্বন্ধের আভাস তো Periplus ও Ptolemy-র গ্রন্থেই পাওয়া যায়। এ-সমস্ত সাক্ষ্যই অত্যন্ত সুপরিচিত। মিলিন্দ-পঞহ গ্রন্থে বঙ্গ বা পূর্ববঙ্গকেও একটি অন্যতম সামুদ্রিক বাণিজ্য-কেন্দ্ৰ বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে, অন্যান্য অনেক বাণিজ্যকেন্দ্রের সঙ্গে। বলা হইয়াছে, বঙ্গদেশে বাণিজ্যব্যাপদেশে অনেক সমুদ্রগামী জাহাজ একত্র হইত। এই বন্দর কোন বন্দর তাহা অনুমান করিবার উপায় নাই। তবে বুড়ীগঙ্গা (Ptolemy-র Antibole?) বা মেঘনার মুখের কোনও বন্দর হওয়া অসম্ভব নয়, অথবা চট্টগ্রামও হইতে পারে, কিন্তু মধ্যযুগের Bengala বন্দর হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত। বহু পরবর্তী কালেও সপ্তগ্রাম হইতে আরম্ভ করিয়া অন্তত ভৃগুকচ্ছ-সূরাষ্ট্র-পাটন পর্যন্ত এই বাণিজ্য-সম্বন্ধের বিস্তৃততর বিবরণ পাওয়া যাইবে মনসামঙ্গল ও চণ্ডীমঙ্গল কাব্যধারায়। ব্ৰহ্মদেশ ও যবদ্বীপ, সুবর্ণদ্বীপ ও পূর্বদক্ষিণ বৃহত্তর ভারতের দ্বীপগুলির সঙ্গে বাঙলাদেশের বাণিজ্য সম্বন্ধ বিষয়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণ কিছু নাই, তবে অনুমান খুব সহজেই করা যাইতে পারে। উত্তর-ব্রহ্মের সঙ্গে আসাম ও মণিপুরের ভিতর দিয়া স্থলপথে একটা নিকট-সম্বন্ধ তো ছিলই, এ কথা অন্যত্র বলিয়াছি। বর্তমােন ত্রিপুরা জেলার পট্টিকেরার রাজবংশের সঙ্গে যে পাগানের আনাউরহথা ও চ্যািনজিথথার রাজবংশের বৈবাহিক সম্পর্ক ছিল, তাহাও আমি অন্যত্র দেখাইয়াছি। মধ্যযুগে এই পথ দিয়াই একাধিক বার মণিপুরে ব্ৰহ্মদেশের যুদ্ধাভিযান আসিয়াছে। নিম্নব্রহ্মের সঙ্গে সমুদ্রোপকূল বাহিয়া জলপথও ছিল, তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় ব্ৰহ্মদেশীয় প্রাচীন রাজবংশাবলীগুলির ইতিহাসের মধ্যে, কিছু কিছু লিপিমালায়; ব্ৰহ্মদেশে থেরবাদ বৌদ্ধধর্মের ইতিহাস ও আমার অন্য দুটি প্রাসঙ্গিক গ্রন্থে সে কথা প্রমাণ করিতে চেষ্টা করিয়াছি। এখানে উল্লেখ নিম্প্রয়োজন। যবদ্বীপ সুবর্ণদ্বীপের সঙ্গে পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রের দেশ ও দ্বীপগুলির সম্বন্ধের প্রমাণ আছে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের লিপিতে (চতুর্থ-পঞ্চম শতক), মেঘবৰ্মন-সমুদ্র গুপ্ত (চতুর্থ শতক) প্রসঙ্গে, রাজা বালপুত্রদেবের নালন্দা লিপিতে (দশম শতক), ইৎসিঙের (৭ম শতক) ভ্ৰমণ-বৃত্তান্তে, বৌদ্ধ মহাপণ্ডিত ধৰ্মকীর্তির জীবন-ইতিহাসের মধ্যে (একাদশ শতক)। এই-সমস্ত সাক্ষ্যই এত সুপরিচিত যে, ইহাদের উল্লেখ পুনরুক্তি দোষে দুষ্ট হইবে। তাহা ছাড়া, ইতিপূর্বেই দেশ-পরিচয় অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা করা হইয়াছে। সাধারণ ভাবে এইসব পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপ ও দেশগুলিতে বাঙলাদেশের ধর্মসাধনা ও সংস্কৃতির প্রভাব এত সুস্পষ্ট এবং পণ্ডিতমহলে এত বেশি আলোচিত হইয়াছে যে, প্রাচীন বাঙলাদেশের সঙ্গে ইহাদের নিকট-সম্বন্ধের কথা এখন আর কল্পনার বিষয় নয়। সত্য, এইসব সাক্ষ্য-প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত একটিও প্রত্যক্ষভাবে বাণিজ্য-সংক্রান্ত নয়, যদিও এ কথা অনুমান করিতে বাধা নাই যে, বাণিজ্য-সম্বন্ধের উপর নির্ভর করিয়াই ক্ৰমে ক্ৰমে বাঙলাদেশের ও ভারতের অন্যান্য দেশের ধর্মসাধনা ও সংস্কৃতি ক্রমশ এইসব অঞ্চলে ছাড়াইয়া পড়িয়াছিল। অন্য দেশে সংস্কৃতিবিস্তার এইভাবেই হইয়া থাকে, প্রাচীন কালেও হইয়াছিল, বর্তমান কালেও হইয়াছে ও হইতেছে। সর্বাগ্রে বণিক, বণিকের সঙ্গে বণিকের প্রয়োজনেই ধর্ম ও পুরোহিত, তারপরেই ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে আসিয়া পড়ে সামরিক এবং সাংস্কৃতিক প্রভাব। যাহা হউক, প্রত্যক্ষ বাণিজ্য-সম্বন্ধের প্রমাণ প্রাচীন বাঙলায় পাইতেছি না, কিন্তু নানা মনসামঙ্গল কাব্যে সে প্রমাণ ছাড়াইয়া আছে; আরাকান ও ব্রহ্মদেশের সঙ্গে বাণিজ্য-সম্বন্ধের আভাসও এইসব গ্রন্থে পাওয়া যায়। অনুল্লিখিত-নাম যে দেশের বিবরণ সওদাগরদের শুনানো হইতেছে, সেই দেশ যে ব্ৰহ্মদেশ, বিবরণটি একটু মনোযোগ দিয়া পড়িলে এ সম্বন্ধে আর সন্দেহ থাকে না। কিন্তু প্রাচীনকালে এই পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রের দ্বীপ ও দেশগুলির সঙ্গে বাঙলাদেশের বাণিজ্য সম্বন্ধের একটি প্রত্যক্ষ প্রমাণও কি নাই? আমার মনে হয়, আছে। সেই প্রমাণটি উল্লেখ করিয়াই এই ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গ শেষ করিব। মালয় উপদ্বীপের ওয়েলেসলি জেলার একটি প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্য হইতে ১৮৩৪ খ্ৰীষ্টাব্দে একটি স্লেট পাথরে উৎকীর্ণ লিপি আবিষ্কৃত হইয়াছিল। পাথরটির মাঝখানে উৎকীর্ণ বীেদ্ধস্তুপের প্রতিকৃতি; স্তুপটির দুই পাশে লিপি উৎকীর্ণ। লিপিটির পাঠ এইরূপ :
অজ্ঞানাচীয়তে কর্ম জন্মনঃ কর্ম কারণ [ম]
জ্ঞানান্ন চীয়তে [কর্ম কর্মভাবান্ন জায়াতে]
ইহা একটি বৌদ্ধ সূত্র। এর পরেই দক্ষিণতম প্রান্তে লেখা আছে :
মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তস্য রক্তমৃত্তিকা বাস [ত ব্যস্য]
এবং তার পরেই বাম প্রান্তে ও পার্থে আছে :
সর্বেণ প্রকারেণ সবস্মিন সর্বথা স (র) কাব-সিদ্ধ যাত রি] [ঃ] সন্তু।
এই মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত পণ্ডিতমহলে সুপরিচিত; লিপিটি বহু আলোচিত। বুদ্ধগুপ্তের বাড়ি ছিল রক্তমৃত্তিকায়। সিদ্ধযাত্র ও সিদ্ধযাত্ৰা কথাটি লইয়া বহু তর্কবিতর্ক হইয়াছে। বেশির ভাগ তর্ক নিরর্থক। কথাটি এ পর্যন্ত এই দেশ ও দ্বীপগুলির অন্তত সাতটি প্রাচীন লিপিতে পাওয়া গিয়াছে। সিদ্ধযাত্রিক, সিদ্ধযাত্ৰীত্ব, যাত্রাসিদ্ধি কাম ইত্যাদি কথা পঞ্চতন্ত্রে ও জাতকমালায় বার বার পাওয়া যায়। জাতকমালার সুপারগ-জাতকে পূর্ব ভারতের বণিকদের সুবৰ্ণভূমি বা নিমব্ৰহ্মদেশে যাত্রার কথা আছে (সুবৰ্ণভূমি বণিজ্যে যাত্রাসিদ্ধিকমাঃ)- তাহাদের যাত্রা সিদ্ধিলাভ করুক, এই কামনা তাহাদের মনে ছিল সেইজন্য তাহাদের বলা হইয়াছে যাত্রাসিদ্ধিকমাঃ। বুদ্ধগুপ্তের এই লিপিটির শেষ ছত্রটির অর্থেরও অস্পষ্টতা কিছু নাই; সর্বপ্রকারে, সকল বিষয়ে, সৰ্বথা বা সর্ব উপায়ে সকলে সিদ্ধযাত্ৰ হউক, এই প্রকার একটা কামনা বা আশীৰ্বাদ করা হইতেছে। এই কামনা বা আশীৰ্বাদ করা হইয়াছিল যাত্রার পূর্বে, ইহাই তো “সন্তু এই ক্রিয়াপদটির এবং সমস্ত আশীর্বাদটির ইঙ্গিত। কামনা বা আশীর্বাদ করা হইয়াছিল খুব সম্ভব কোনও বৌদ্ধ পুরোহিত বা ধর্মগোষ্ঠীর পক্ষ হইতে; স্তুপের প্রতিকৃতিটি তাহার প্রমাণ, এবং এই আশীর্বাদের একটি লিপি বৌদ্ধসূত্র সহ, ধর্মনিদর্শন সহ খোদাই করিয়া, রক্ষাকধাচের মতো বুদ্ধগুপ্তের সঙ্গে দিয়া দেওয়া হইয়াছিল। এই প্রথা তো এখনও বাঙলার বহু পরিবারে প্রচলিত। এই মহানাবিকের বাস্তব্য অর্থাৎ বাড়ি ছিল রক্তমৃত্তিকায়। এই রক্তমৃত্তিকা কোথায়, ইহাই হইতেছে। প্রশ্ন। অধ্যাপক কার্ন বলিয়াছিলেন, এই রক্তমৃত্তিক চৈনিক উপাদানের Chrih tru, সিয়াম দেশের সমুদ্রোপকূলের একটি স্থানের সঙ্গে অভিন্ন। অক্ষর দেখিয়া লিপিটির তারিখ পণ্ডিতেরা অনুমান করিয়াছেন খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক। লিপিটির ভাষা শুদ্ধ সংস্কৃত; ধর্মপ্রেরণা একান্তভাবেই ভারতীয়; মহানাবিকটির নাম ও ধাম একান্তভাবেই ভারতীয়; বুদ্ধগুপ্ত নামটি যেন বিশেষ করিয়াই ভারতীয়। এই অবস্থায় নাবিকটিকে সিয়ামদেশবাসী বলিয়া মনে করিতে একটু ঐতিহাসিক দ্বিধা বোধ হয় বই-কি! বিশেষত রক্তমৃত্তিকার সন্ধান যদি ভারতবর্ষে কোথাও পাওয়া যায়, তাহা হইলে তো কথাই নাই। য়ুয়ান-চোয়াঙ (সপ্তম শতক) কিন্তু কৰ্ণসুবর্ণের বিবরণ দিতে বসিয়া এক রক্তমৃত্তিকার সন্ধান দিতেছেন; বলিতেছেন, কর্ণসুবর্ণের রাজধানীর একেবারে পাশেই ছিল লো-টো-মো-চিহ্ন (Lo-to-mo-chih) নামে বৃহৎ বৌদ্ধ-বিহার। চীন লো-টো-মো-চিহ্ন পালি অথবা প্রাকৃত লওমছি = রক্তমত্তি = রক্তমৃত্তি বা রক্তমৃত্তিকা, বাঙলা, রাঙামাটি। আমার তো মনে হয়, বুদ্ধগুপ্তের বাড়ি কর্ণসুবর্ণের এই রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটি। তাহা ছাড়া, আর একটি রাঙামাটির খবর আমরা জানি চট্টগ্রামে। প্রাচীন ঐতিহ্য ও ঐতিহাসিক পরিবেশের কথা মনে রাখিলে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত যে বাঙলাদেশের তাম্রলিপ্তি বন্দর হইতে যাত্রা করিয়াছিলেন পূর্ব-দক্ষিণ সমুদ্রতীরের দেশে, এই অনুমানই তো বিজ্ঞানসম্মত সত্য বলিয়া মনে হয়। এবং যদি তাঁহাই হয়, তাহা হইলে এইখানে আমরা প্রাচীন বাঙলার সামুদ্রিক বাণিজ্য-বিস্তারের একটা পাথুরে ও প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইলাম। লক্ষণীয় এই যে, লিপির তারিখ খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক। পরে আমি একাধিক প্রমাণ ও অনুমানের সাহায্যে দেখাইতে চেষ্টা করিব যে, খ্ৰীষ্টপূর্বকাল হইতে আরম্ভ করিয়া আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্তই বাঙলার সামুদ্রিক বাণিজ্যের স্বর্ণযুগ; ইহার পর আদিপর্বে বাঙলার সামুদ্রিক বাণিজ্যের সেই যুগ আর ফিরিয়া আসে নাই।
সামুদ্রিক বাণিজ্যলব্ধ সমৃদ্ধি
এই যে আমরা একটা প্রশস্ত, সমৃদ্ধ ও সুবিস্তৃত অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের পরিচয় পাইলাম, এই বাণিজ্যে বাঙলাদেশে প্রচুর অর্থাগম হইত এবং সে অর্থের অধিকাংশ বণিকদের হাতেই কেন্দ্রীকৃত হইত, এই ইঙ্গিত আগেই করিয়াছি। কিন্তু এই অর্থ কী? ইহা কি মুদ্রায় বিনিময় দ্রব্যাদিতে রূপান্তরিত? প্লিনি যে বলিয়াছেন, আধ সেরা পিপ্পলির দাম হইত ১৫ স্বর্ণ দিনার, এবং ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের বার্ষিক রপ্তানির মূল্য ছিল প্রায় এক লক্ষ মুদ্রা, তাহা হইতে অনুমান হয়, বণিকেরা বাণিজ্য-পসরার বদলে মুদ্ৰাই লইয়া আসিতেন, এবং এই মুদ্রা সবুর্ণমুদ্রা dinarius বা দিনার ও রৌপ্যমুদ্রা drachm বা দ্রাহ্ম। পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত প্রায় সমস্ত পট্টোলীগুলিতে ভূমির মূল্যের উল্লেখ (স্বর্ণ) দিনার অনুযায়ী, কিংবা পরবর্তী পাল ও সেনা-বংশের লিপিগুলিতে মূল্যের উল্লেখ পাই রৌপ্য দ্রহ্মে (ধর্মপালের মহাবোধি লিপির ত্ৰিতয়েন সহস্ৰেণ দ্রাহ্মণাং খানিতা”; বিশ্বরূপ ও কেশবসেনের দুইটি লিপিতেও ভূমির মূল্য বোধহয় দেওয়া হইয়াছে দ্রহ্মে?)। এই দুইটি মুদ্রার নাম হইতে মনে হয়, এক সময়ে এই দুই বিদেশী মুদ্ৰাই বেশ-কিছু পরিমাণে বাঙলাদেশে আসিত, এবং বিনিময়-মুদ্রা হিসাবে স্বীকৃত এবং গৃহীতও হইত; পরে ইহাদের নাম হইতেই স্বর্ণ ও রৌপ্য-মুদ্রা বাঙলাদেশে দিনার ও দ্রাহ্ম নামে পরিচিত হইয়াছিল। ‘দাম এবং ‘দৰ্মা’ (বেতন) এই কথা দুইটি তো ‘দ্রাহ্ম হইতেই আমরা পাইয়াছি। এই দুই মুদ্রাপ্রচলনের মধ্যেও প্রশস্ত বৈদেশিক বাণিজ্য সম্বন্ধের স্মৃতি লুক্কায়িত আছে, সন্দেহ নাই।
কিন্তু বিনিময়-বাণিজ্যও (trade by barter) সঙ্গে সঙ্গে ছিল না, একথাও বলা চলে না। Periplus-গ্রন্থে ভারতীয় বহির্বাণিজ্যের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহাতে তো মনে হয়, এই বাণিজ্য পণ্য-বিনিময়েও মাঝে মাঝে চলিত। বংশীদাস ও মুকুন্দরামের যে সাক্ষ্য আগে একাধিক বার উল্লেখ করিয়াছি তাহা হইতেও প্রমাণ হয় যে, মধ্যযুগেও এই বিনিময় বাণিজ্য বহির্বাণিজ্যের অন্যতম নিয়ম ছিল। টেভারনিয়ারের যে সাক্ষ্য ত্রিপুরাদেশাগত সোনা সম্বন্ধে আগে উল্লেখ করিয়াছি, তাহাতে তো দেখা যায়, অন্তর্বাণিজ্যেও এই ব্যবস্থা কতকটা প্রচলিত ছিল। এই দুটি সাক্ষ্যই মধ্যযুগীয়; তবু মনে হয় প্রাচীন ধারা কিছুটা মধ্যযুগেও অক্ষুঃ ছিল। তবে বিনিময় বাণিজ্যই যে একমাত্র নিয়ম ছিল না। তাহা খ্ৰীষ্টীয় শতকের আগে হইতে সমৃদ্ধ মুদ্রাপ্ৰচলন হইতেই সুপ্রমাণিত হয়।