যাতায়াত ও বাণিজ্যপথ *
(* এই প্রসঙ্গে ধনসম্বল অধ্যায়ে নৌ-শিল্প ও ব্যবসা-বাণিজ্য বিবরণ দ্রষ্টব্য।)
সাধারণভাবে এবং সংক্ষিপ্ত উপায়ে দেশ-পরিচয় লিখিতে বসিয়া গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে বা নগর হইতে নগরান্তরে যাতায়াতের পথের উল্লেখ করিয়া লাভ নাই। যে সব গ্রামের উল্লেখ প্রাচীন বাঙলার লিপিগুলিতে পাওয়া যায় সেগুলি একটু বিশ্লেষণ করিলে প্রায়ই দেখা যায়, গ্রামের প্রান্তসীমায় রাজপথের উল্লেখ; অনেক সময় এই পথগুলিই এক বা একাধিক দিকে গ্রামসীমা অথবা কোনও ভূমিসীমা নির্দেশ করে, এবং সেই হিসাবেই পথগুলির উল্লেখ। অনুমান করিতে বাধা নাই, এই পথগুলিই গ্রাম হইতে গ্রামে ও নগরে বিস্তৃত ছিল। এই রকম দু-একটি পথের উল্লেখ পরবর্তী গ্রাম ও নগর অধ্যায়ে করা হইয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, দামোদর দেবের চট্টগ্রাম লিপিতে কামনপিণ্ডিয়া গ্রামের ডাম্বারডাম পল্লীর একখণ্ড ভূমির পূর্বদিকে এ রাজপথের উল্লেখ আছে। কিছুদিন আগে ধনোরার অদূরে দুইটি বাধান রাজপথের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হইয়াছে। জঙ্গল কাটিয়া অথবা মাটি ভরাট করিয়া নূতন নূতন গ্রাম ও নগর পত্তনের –সঙ্গে সঙ্গে এই ধরনের যাতায়াত পথ ক্রমশ বিস্তৃত হইয়াছে, এই অনুমান করা চলে। এইসব সাধারণ স্থলপথ ছাড়া নদীমাতৃক দেশের অসংখ্য নদনদী, খাটা-খাটিকা, খাল-বিল, যানিকা-স্রোতিকা ইত্যাদি বাহিয়া জলপথে তো ছিলই। উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ বঙ্গে যত লিপি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহার প্রায় প্রত্যেকটিতেই এইসব জলস্রোতের উল্লেখ সুপ্রচুর। ইহাদের প্রেক্ষাপটে যখন সঙ্গে সঙ্গে লিপিগুলিতে দেখা যায়, এবং সমসাময়িক ও প্রাচীনতর। সাহিত্যে পড়া যায় নৌসাধনোদ্যত, সমুদ্রাশ্রয়ী বাঙালীর কথা, তাহাদের অসংখ্য নৌবাটি, নৌবিতান, নৌদণ্ডক, নাবাতক্ষেণী, প্রভৃতির কথা গুঢ় অধ্যাত্ম-সংগীতে (যেমন, চর্যাপদে) নদনদী, নৌকা, নৌকার নানা উপাদান (যথা, দাড়, হাল, মাস্তুল, পাল, লাগি, নোঙরের কাছি) ইত্যাদির উপমা, তখন সহজেই মনের মধ্যে এই ধারণা জন্মায় যে, জলপথে নৌকাযোগে যাতায়োতই ছিল স্থলপথে যাতায়াত অপেক্ষা প্রশস্ততর। লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, এই নৌকা যাতায়াত পূর্ববঙ্গে পুণ্ড্রবর্ধনে এবং সমতটে, অর্থাৎ নদনদীবহুল নিম্নাশায়ী দেশগুলিতেই বেশি ছিল।
এইসব সাধারণ যাতায়াত পথ ছাড়া দেশের প্রান্ত হইতে প্ৰান্ত পর্যন্ত এবং দেশেরও সীমা অতিক্রম করিয়া দেশান্তরে যে সব স্থল ও জলপথ বিস্তৃত ছিল, যে সব পথ বাহিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী অসংখ্য নরনারী তীর্থযাত্রা, দেশভ্রমণ ও বিচিত্রকর্ম উপলক্ষে-সর্বোপরি শ্রেষ্ঠী, বণিক ও সার্থিবাহের দল ব্যাবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে— দেশের বিভিন্ন গ্রামে, নগরে, তীর্থে এবং বাণিজ্যকেন্দ্রে, দেশান্তরের নগরে-বন্দরে যাতায়াত করিত, দেশ-পরিচয় প্রসঙ্গে সেইসব সুদীর্ঘ সুপ্রিশস্ত বহুজনপদলাঞ্ছিত পথগুলির বিবরণই উল্লেখযোগ্য। এইসব পথ দেশের শুধু যাতায়াত পথ নয়, বাণিজ্যপথও বটে এবং এইসব পথ বাহিয়াই বাঙলাদেশে লক্ষ্মীর আনাগোনা। এইসব বহু পথই বর্তমান রেলপথগুলির পূর্ব পর্যন্ত শুধু লক্ষ্মীর নয়, সরস্বতীরও আনাগোনার পথ ছিল; রেলপথগুলি সাধারণত সেইসব সুপ্রাচীন পথ বাহিয়াই প্রতিষ্ঠিত। জীবনধারণের প্রয়োজনে জীবনবিকাশের প্রেবণায় মানুষ সুপ্রাচীন দুৰ্গম বনজঙ্গল কাটিয়া, পাহাড় ভাঙিয়া, নদী ডিঙাইয়া, যে সব পথের প্রতিষ্ঠা করিয়াছে সে সব পথ একদিনে নিশ্চিহ্ন হইয়া যায় না। মানুষের ব্যবহারের মধ্যে, তাহার স্মৃতি ও সংস্কারের মধ্যে, নূতন পথের মধ্যে সেইসব প্রাচীন পথ বাচিয়া থাকে। পৃথিবীতে সর্বত্রই তাহা ঘটিয়াছে, বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। নদ-নদী-প্রবাহ সুপ্রাচীন কালে জলপথ নির্ণয় করিত, এখনও করে; নদীর খাত যখন বদলায় সঙ্গে সঙ্গে পথও বদলায়; খাত মরিয়া গেলে নূতন খাতে জলপ্রবাহ ছুটিয়া চলে, জলপথও তাহার অনুসরণ করে। সমুদ্রস্রোত ও বিভিন্ন ঋতুর বায়ুপ্রবাহ প্রাচীনকালে সমুদ্রপথ নির্ণয় কল্পিত; বাষ্প-জাহাজ-পর্বের পূর্ব পর্যন্ত সমগ্ৰ পৃথিবীতে ইহাই ছিল নিয়ম। বাঙলাদেশেও তাহার ব্যত্যয় ঘটে নাই।
দুঃখের বিষয়, প্রাচীন বাঙলার আন্তবাণিজ্যের স্থলপথের বিবরণ স্বল্প। লিপিগুলিতে, বিদেশী পর্যটকদের বিবরণীতে এবং কিছু সমসাময়িক সাহিত্যে কয়েকটি মাত্র প্রাস্তাতিপ্রান্ত সুদীর্ঘ পথের ঈঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। বিদেশী পর্যটক ও ঐতিহাসিকেরা বৈদেশিক বাণিজ্য সম্বন্ধেই কৌতুহলী ছিলেন এবং সেইসব বাণিজ্যপথের বিবরণই তাহারা যাহা কিছু রাখিয়া গিয়াছেন। তবু, ফাহিয়ান্ বা য়ুয়ান-চোয়াঙের মতো পর্যটক র্যাহারা বাঙলার এক জনপদ হইতে অন্য জনপদ কিছু কিছু ঘোরাঘুরি করিতে বাধ্য হইয়াছেন, তাহারা প্রসঙ্গত অন্তর্দেশের পথের ইঙ্গিতও দিক, রাখিয়া গিয়াছেন। ইৎসিঙের বিবরণে, সোমদেবের কথাসরিৎসাগরের মতো গ্রন্থে, ২/৪টি জগতকের গল্পে, লিপিমালায় ২/১টি আকস্মিক উল্লেখও এই জাতীয় পথের কিছু ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এইসব পথ শুধু অন্তর্বঙ্গপথ নয়; বরং এইসব পথ বাহিয়াই বাঙলাদেশে প্রাচীনকালে সুবিস্তৃত ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সকল প্রকার যোগরক্ষা করিত।
আন্তর্দেশিক স্থলপথ
সোমদেবের ‘কথাসরিৎসাগরে’ পুণ্ড্রবর্ধন হইতে পাটলিপুত্র পর্যন্ত একটি সুবিস্তৃত পথের উল্লেখ আছে। ইৎসিঙ (সপ্তম শতকের তৃতীয় পদের শেষাশেষি)। তাম্রলিপ্তি হইতে বুদ্ধগয়া পর্যন্ত পশ্চিমাভিমুখী একটি পথের ইঙ্গিত দিতেছেন। হাজারিবাগ জেলায় দুধপানিপাহাড়ের আনুমানিক অষ্টম শতকের একটি শিলালিপিতে অযোধ্যা হইতে তাম্রলিপ্তি পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ পথের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। য়ুয়ান-চোয়াঙ (সপ্তম শতকের দ্বিতীয় পাদ) বারাণসী, বৈশালী, পাটলিপুত্র, বুদ্ধগয়া, রাজগৃহ, নালন্দা, অঙ্গ-চম্পা প্রভৃতি পরিভ্রমণ করিয়া আসিয়াছিলেন কজঙ্গলে। আমি এই গ্রন্থেই অন্যত্র দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, কাজঙ্গল দেশ অংশত বর্তমান উত্তর-রাঢ়, বাঁকুড়া-বীরভূমের উত্তর-পশ্চিম প্রাস্তবতী অনুর্বর জাঙ্গলময় প্রদেশ। কজঙ্গল হইতে তিনি গিয়াছেন পুণ্ড্রবর্ধনে (উত্তরবঙ্গ=বগুড়া-রাজশাহী-রংপুর-দিনাজপুর), পুণ্ড্রবর্ধন হইতে পথে এক প্রশস্ত নদী পার হইয়া কামরূপ; কামরূপ হইতে সমতট (ত্রিপুরা, ঢাকা, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল, ২৪ পরগনার নিম্নভূমি); সমতট হইতে তাম্রলিপ্তি (দক্ষিণ পূর্ব মেদিনীপুর); তাম্রলিপ্তি হইতে কর্ণসুবর্ণ (মুর্শিদাবাদ জেলার কানসোনা); এবং কর্ণসুবর্ণ হইতে ওড্র, কঙ্গোব্দ, কলিঙ্গ। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতে তাহা হইলে মোটামুটি আন্তর্দেশিক পথগুলির একটু ইঙ্গিত পাইতেছি। কজঙ্গল বা উত্তর-রাঢ় অঞ্চল হইতে একটি পথ ছিল পুণ্ড্রবর্ধন পর্যন্ত বিস্তৃত। চম্পা (বর্তমান ভাগলপুর জেলা) হইতে তিনি আসিয়াছিলেন কজঙ্গলে। ভাগলপুর হইতে বর্তমানে যে রেলপথ রাজমহলপাহাড়ের ভিতর দিয়া নানা শাখা-প্রশাখায় দক্ষিণমুখী হইয়া চলিয়া গিয়াছে সিউড়ি-রানীগঞ্জ-বাকুড়া-বিষ্ণুপুর-পুরুলিয়ার দিকে এই পথই ছিল য়ুয়ান-চোয়াঙের পথ। কজঙ্গল হইতে উত্তরমুখী হইয়া এই পথ ধরিয়াই য়ুয়ান-চোয়াঙ রাজমহল বা রাজমহলের কিছুটা দক্ষিণে গঙ্গা অতিক্রম করিয়া পরে পূর্বমুখী হইয়া পুণ্ড্রবর্ধনে গিয়াছিলেন। এখন ই-আই-আর পথের বর্ধমান–রানীগঞ্জ–সিউড়ি হইতে রওয়ানা হইয়া লালগোলাঘাটে গঙ্গা পার হইয়া এ বি-আর পথে উত্তরবঙ্গে যাওয়া যায়, এবং সেখান হইতে সোজা রেলপথ ধরিয়া কামরূপ। এই রেলপথও প্রাচীন রাজপথই অনুসরণ করিয়াছে। কিন্তু কামরূপ হইতে সমতটের পথ এখন বর্তমান কালে আর খুব পরিষ্কার ধরিতে পারা যায় না; ধলেশ্বরী–যমুনা-পদ্মা এই পথকে এমনভাবে ভাঙিয়া বঁকাইয়া দিয়াছে যে, তাহার রেখা কল্পনায় আনা হয়তো যায়, কিন্তু সুস্পষ্ট ধরিতে পারা কঠিন। য়ুয়ান-চোয়াঙ বোধহয় স্থলপথে পদব্রজেই আসিয়াছিলেন, বিবরণী পাঠে এই কথাই মনে হয়। বর্তমান ভূমি-নকশা অনুযায়ী অন্তত দুইবার তাহার দুইটি সুপ্রশস্ত নদী, যমুনা ও পদ্মা, অতিক্রম করা উচিত, কিন্তু তাহার উল্লেখ বিবরণীতে কিছু নাই। মনে হয়, যমুনা বা পদ্মার আজিকার কিংবা মধ্যযুগের মতো প্রশস্ত অস্তিত্ব তখন ছিল না। অথচ, এখন এই দুইটি নদীই এ-বি-আর পথের গতি নির্ণয় করিতেছে। গৌহাটিতে ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া এক পথ বগুড়াসান্তাহার-ঈশ্বরদী (পদ্মা) ছুইয়া কলিকাতা পর্যন্ত বিস্তৃত; আর-এক পথ জগন্নাথগঞ্জ (যমুনা) সিরাজগঞ্জ-ঈশ্বরদী (পদ্মা) হইয়া কলিকাতা। দুটি পথই বাকিয়া চুরিয়া নদনদী এড়াইয়া অতিক্রম করিয়া বিস্তৃত। যাহাই হউক, সমতট হইতে ভাগীরথী পার হইয়া তমলুকের পথে তো এখনও বি-এন-আর পথ সোজা চলিয়া গিয়াছে, এবং ভাগীরথীতীর হইতে উত্তরাভিমুখী মুর্শিদাবাদ (কর্ণসুবর্ণ) ছাড়াইয়া ই-আই-আর পথের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখা এখনও বিস্তৃত। মুর্শিদাবাদ হইতে ওড্র বা উড়িশা পর্যন্তও ই-আই-আর ও বি-এন-আর পথে প্রাচীন রাজপথের ইশারা সহজেই পাওয়া যায়। প্রাচীন বাঙলার বিভিন্ন জনপদ যে সব সুদীর্ঘ পথগুলির দ্বারা পরস্পরযুক্ত ছিল সেইসব পথের ইঙ্গিত য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণ হইতে পাওয়া গেল। এইসব পথ তিনি নিজে আবিষ্কার করেন নাই। তাহার বহু আগে হইতেই বহু যানের চক্রপোষণে, বহু পশু ও বহু মানুষের পদতাড়নায় এইসব পথ প্রশস্ত হইয়াছিল; তাহার পরেও বহুকাল পর্যন্ত এইসব পথ ক্রমাগত ব্যবহৃত হইয়া আজিকার রেলপথে বিবর্তিত হইয়াছে। কোথাও রেলপথ প্রাচীন পথকে নিশ্চিহ্ন করিয়া দিয়াছে, কোথাও প্রাচীন পথ রেলপথগুলির পাশাপাশি চলিয়াছে। বস্তুত, ভারতবর্ষের কোনো রেলপথই নূতন সৃষ্ট নবাবিষ্কৃত পথ নয়, প্রত্যেকটিই প্রাচীন পথের নিশানা ধরিয়া চলিয়াছে।
বহির্দেশীয় স্থলপথ
অন্তর্দেশের পথ ছাড়িয়া দেশ হইতে দেশান্তরের পথগুলির ইঙ্গিত এইবার ধরিতে চেষ্টা করা যাইতে পারে। উল্লিখিত বিবরণ হইতে বুঝা যাইবে, বাঙলাদেশ হইতে তিনটি প্রধান পথ পশ্চিম দিকে বিস্তৃত ছিল। একটি পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ হইতে মিথিলা বা উত্তর-বিহার ভেদ করিয়া (বর্তমান বি–এন–ডব্লিউ–আর এই পথ অনুসরণ করিয়াছে) চম্পা (ভাগলপুর) হইয়া পাটলিপুত্রের ভিতর দিয়া বুদ্ধগয়া স্পর্শ করিয়া (অথবা, পাটনা-আরা হইয়া) বারাণসী-অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল; সেখান হইতে একেবারে সিন্ধু–সৌরাষ্ট্র— গুজরাতের বন্দর পর্যন্ত। বিদ্যাপতির পুরুষপরীক্ষায় গৌড় হইতে গুজরাত পর্যন্ত বাণিজ্য-পথের ইঙ্গিত আছে। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী ও ‘কথাসরিৎসাগরের গল্প হইতে এই পথের আভাস পাওয়া যায়। দ্বিতীয় পথটিরও ইঙ্গিত পাওয়া যায় য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতেই। এই পথটি তাম্রলিপ্তি হইতে উত্তরাভিমুখী হইয়া কৰ্ণসুবর্ণের ভিতর দিয়া রাজমহল-চম্পা স্পর্শ করিয়া পাটলিপুত্রের দিকে চলিয়া গিয়াছে। তৃতীয় পথটির আভাস পাওয়া যাইতেছে ইৎসিঙের বিবরণ এবং পূর্বোল্লিখিত হাজারীবাগ জেলার দুধপানিপাহাড়ের আনুমানিক অষ্টম শতকীয় লিপিটিতে। এই পথ তাম্রলিপ্তি হইতে সোজা উত্তর-পশ্চিমাভিমুখী হইয়া বুদ্ধগয়ার ভিতর দিয়া অযোধ্যা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই তিনটি পথ আশ্রয় করিয়াই প্রাচীন বাঙলাদেশ উত্তর ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক, সামরিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষা করিত। বাঙলা ও উত্তর ভারতের যে-কোনও বর্তমান রেলপথের নকশা খুলিলেই দেখা যাইবে এই রেলপথগুলি সেইসব প্রাচীন পথই অনুসরণ করিয়াছে।
উত্তর-পূর্বমুখী পথ
বাঙলার পূর্বদিকে কামরূপ রাজ্য, উত্তরে চীন ও তিব্বত। উত্তরবঙ্গ ও কামরূপের ভিতর দিয়া বাঙলাদেশ এই উত্তরশায়ী দেশদুটির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ রক্ষা করিত। এই পথের বিবরণ পাওয়া যায়। য়ুয়ান-চোয়াঙ এবং কিয়া-তানের ভ্রমণ-বৃত্তান্তে, চীন-রাজদূত, চাঙি-কিয়েনের প্রতিবেদনে, এবং বোধহয় মুহম্মদ ইবন বখতিয়ারের আসাম-তিব্বত অভিযান সংক্রান্ত সুবিখ্যাত শিলালিপিটিতে। ‘তবকাত-ই নাসিরী’ গ্রন্থেও বোধহয় কামরূপের ভিতর দিয়া তিব্বত পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথের উল্লেখ আছে। এই সাক্ষ্যগুলি বিশ্লেষণ করিলে পথটির আভাস স্পষ্ট হইতে পারে। পুণ্ড্রবর্ধন হইতে কামরূপ এবং কামরূপ হইতে সমতট পর্যন্ত দুইটি সুদীর্ঘ পথ যে ছিল, য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণী এ-সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহই রাখে না; ইতিপূর্বেই তাহা বিশ্লেষণ করিয়া দেখানো হইয়াছে। এই দুই পথ দিয়া প্রাচীন কামরূপ এবং সুবর্ণকুড্যকের সমৃদ্ধ ৭। সুচারু বস্ত্ৰশিল্প, অগুরু, চন্দন, হাতি প্রভৃতি বাঙলাদেশে আমদানি হইত, এবং বাঙলার সামূদ্রিক বন্দর ও আন্তর্দেশিক বাণিজ্য কেন্দ্রগুলি হইতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে ও ভারতবর্যের বাহিরে রপ্তানি হইত। কিন্তু কামরূপই পূর্বাভিমুখী এই পথের শেষ সীমা নয়।
উত্তর ব্ৰহ্ম-মণিপুরী কামরূপ আফগানিস্থান পথ
য়ুয়ান-চোয়াঙের অন্তত সাত শত বৎসর আগে চাঙ-কিয়েন (Chang Kien) নামে এক চৈনিক রাজদূতের প্রতিবেদনে দক্ষিণ-চীন হইতে আরম্ভ করিয়া উত্তর-ব্ৰহ্ম ও মণিপুরের ভিতর দিয়া কামরূপ হইয়া আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত এক সুদীর্ঘ প্রান্তাতিপ্রান্ত পথের ইঙ্গিত ধরিতে পারা যায়। চাঙ-কিয়েন (খ্ৰীঃ পূঃ ১২৬) ব্যাকট্রিয়ার বাজারে দক্ষিণ-চীনের যুন্নান এবং সজেচোয়ান প্রদেশেজাত রেশমী বস্ত্র এবং সূক্ষ্ম বাঁশ দেখিতে পাইয়া খোজ লইয়া জানিয়াছিলেন, এই সমস্ত দ্রব্য আসিত চীন হইতে আফগানিস্থান পর্যন্ত বিস্তৃত উত্তর ভারতবর্ষ জুড়িয়া লম্বমান সুদীর্ঘ পথ বাহিয়া, সার্থবাহাদলের পশু ও শকটবাহিনী ভর্তি হইয়া। সজেচেয়ান হইতে কামরূপ পর্যন্ত এই পথের খবর য়ুয়ান-চোয়াঙ সপ্তম শতকেও শুনিয়াছিলেন কামরূপবাসীদের নিকট হইতে; কঠিন পার্বত্য পথ দুই মাসে অতিক্রম করিতে হইত, এ-খবরও য়ুয়ান-চোয়াঙ পাইয়াছিলেন। নবম শতাব্দীর গোড়ায় কিয়া-তান (৭৮৫-৮০৫ খ্ৰী) নামে আর একজন চীনা পরিব্রাজক টঙ্কিন শহর হইতে কামরূপ পর্যন্ত আর-একটি পথের খবর বলিতেছেন। কামরূপে আসিয়া এই পথটি চাঙ-কিয়েন বর্ণিত পথের সঙ্গে মিলিত হইয়া কজঙ্গল এবং সেখান হইতে মগধ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। কাজঙ্গল হইতে পুণ্ড্রবর্ধন হইয়া কামরূপের যে পথের কথা কিয়া-তান বলিতেছেন সেই পথই সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙের পথ ছিল।
চাঙ-কিয়েন বর্ণিত পথটির এবং অন্য আর-একটি পথের আরও ইঙ্গিত অন্য দুইটি সাক্ষ্য হইতে পাওয়া যায় বলিয়া মনে হয়। ‘তবাকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে বর্ণিত আছে, মুহম্মদ ইবন। বখতিয়ার নুদিয়া জয় ও ধ্বংস করিয়া, গৌড় বা লক্ষ্মণাবতীতে নিজ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করিয়া তিব্বত জয়ে অগ্রসর হইয়াছিলেন। পথে তাহাকে একটি সুপ্ৰশস্ত খরস্রোতা নদী (খরতোয়া=করতোয়া?) পার হইতে হয়; সেই নদীর কূল ধরিয়া দশ দিনের পথ চলার পর তিনি ২০টি পাষাণনির্মিত খিলানযুক্ত একটি সেতু পার হন। সেই সেতু পার হইয়া আরও ১৬ দিনের পথের পর একটি প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগর দেখিতে পান এবং সংবাদ পান যে, সেখান হইতে ২৫ ক্রোশ দূরে করবত্তন, করপত্তন বা করমন্বত্তন নামে একটি জায়গায় ৫০,০০০ তুরুস্ক (? ) সৈন্য আছে; সেখানে বহু ব্ৰাহ্মণের বাস, এবং সেখানকার বাজারে প্রতিদিন সকালবেলা ১,৫০০ টাঙ্গন (টাটু) ঘোড়া বিক্রয় হয়। লক্ষ্মণাবতীতে যে সব ঘোড়া দেখিতে পাওয়া যায় সে সমস্তই সেই বাজারে কেনা। ঐ দেশের পথ-ঘাট পার্বত্যদেশ ভেদ করিয়া বিলম্বিত। তিব্বত হইতে কামরূপ পর্যন্ত এই পার্বত্য পথে ৩৫টি গিরিবর্তু আছে এবং সেইসব গিরিবর্ক্সের ভিতর দিয়াই লক্ষ্মণাবতী পর্যন্ত ঘোড়াগুলিকে আনা হয়। এই বিবরণ কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগরটি কোন নগর তাহা নির্ণীত হয় নাই। করবত্তন, করপত্তন বা করমবত্তন কোন স্থান নির্দেশ করে, তাহাও বলা যায় না। কেহ কেহ। বলেন, করমন্বত্তনের ঘোড়ার হাট দিনাজপুর জেলার নেকদমার হাট; সেই হাটে নাকি এখনও বহু ঘোড়া বিক্রয় হয়, এবং সে সব ঘোড়া তিব্বত-ভোটানের টাটু ঘোড়া। কিন্তু করমত্তন হাট দিনাজপুর জেলায় হওয়া একটু কঠিন। গৌড় হইতে দিনাজপুর জেলার যে-কোেনও স্থান ২৬ দিনের পথ হইতে পারে না, দশ সহস্র সৈন্য লইয়া হাঁটিলেও নয়। তাহা ছাড়া, অন্য যুক্তিও আছে; তাহা এখনই বলিতেছি। যাহাই হউক, বখতিয়ার তিব্বত পর্যন্ত অগ্রসর হইতে পারেন। নাই; মধ্যপথেই পর্যুদস্ত হইয়া নানাভাবে লাঞ্ছিত হইয়া তীহাকে ফিরিয়া আসিতে হইয়াছিল। মিনহাজ তাহার বিস্তৃত বিবরণ লিখিয়া গিয়াছেন। মিনহাজের বিবরণ সব বিশ্বাসযোগ্য না হইলেও বখতিয়ার যে কামরূপের ভিতর দিয়া ব্যর্থ একটা উত্তরাভিযান চালাইয়াছিলেন তাহা বর্তমান গৌহাটির নিকটে ব্ৰহ্মপুত্রের তীরে কানাই-বরিশীবোয়া-নামক স্থানে পাষাণাগাত্রে খোদিত একটি শিলালিপিতেই সুপ্ৰমাণ। এই লিপিটির পাঠ এইরূপ :
শাকে ১১২৭ [= ১২০৬, ২৭শে মার্চ, আনুমানিক]
শাকে তুরগ যুগ্মেশে মধুমাস ত্রয়োদশে।
কামরূপং সমাগত্য তুরস্কাঃ ক্ষয়মাযযুঃ।
লিপিটির নিকটেই পাথরের খিলানযুক্ত একটি সেতু আছে। এই সেতুই কি মিনহাজ। কথিত ৩২-খিলান-যুক্ত পাষাণ-সেতু? এই সেতু পার হইয়া আরও ১৬ দিনের পথ হাঁটিয়া বখতিয়ার যেখানে পৌঁছিয়াছিলেন সেখান হইতেও আরও ২৫ ক্রোশ দূরে করমবত্তনের হাট। কাজেই করমবত্তন দিনাজপুর জেলায় হইতেই পারে না। বরং মনে হয়, শিলালিপি ও মিনহাজ। কথিত সেতু, প্রাকারবেষ্টিত দুৰ্গরক্ষিত নগর এবং করমবত্তনের হাট সমস্তই কামরূপসীমা হইতে তিব্বতের সুদুৰ্গম পার্বত্য পথে অবস্থিত ছিল। এই পথে অসংখ্য গিরিবর্তু ছিল, এ খবর মিথ্যা। না-ও হইতে পারে। যাহাই হউক, কামরূপ হইতে তিব্বত পর্যন্ত একটি দুৰ্গম গিরিপথ ছিল এ বিষয়ে সন্দেহের অবসর কম। কামরূপে আসিয়া এই পথ চাঙ-কিয়েন কথিত চীন-ভারত-আফগানিস্তান প্রান্তাতিপ্রান্ত সুদীর্ঘ পথের সঙ্গে মিলিত হইত হইতে পারে, এই পথ দিয়াও বৌদ্ধ পণ্ডিত ও পরিব্রাজকেরা এবং তিব্বতী দূতেরা মগধ ও বঙ্গদেশ হইতে তিব্বতে যাতায়াত করিতেন। গৌহাটি শহরের নিকট ব্ৰহ্মপুত্র পার হইয়া সোজা পঁচিশ মাইল উত্তরে একটি জায়গায় এখনও বৈশাখী পূর্ণিমায় এক বিরাট মেলা বসে; সেই মেলায় বহু তিব্বতী ব্যবসায়ী কম্বল, ভেড়া, ঘোড়া ইত্যাদি বিক্রয়ের জন্য লইয়া আসে।
কিন্তু তিব্বতের সঙ্গে যোগাযোগের আর-একটি পার্বত্য পথ বোধহয় ছিল। এই পথ উত্তরবঙ্গের জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং অঞ্চল হইতে সিকিম, ভোটান পার হইয়া হিমালয় গিরিবর্ক্সের ভিতর দিয়া তিব্বতের ভিতর দিয়া চীনদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পেরিপ্লাস গ্রন্থে (প্রথম শতক) বোধহয় এই পথের একটু ইঙ্গিত আছে। খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকে চীনদেশ হইতে যে রেশম ও রেশমজাত দ্রব্যাদি বঙ্গদেশে আসিত তাহা পূর্বোক্ত কামরূপের পথ বা এই সদ্যোক্ত পথ বাহিয়া আসিত বলিয়াই তো মনে হয়। এখনও কালিমপং বা গ্যাংটকের বাজারে যে সব পার্বত্য টাটু ঘোড়া, কম্বল, কঁচা হলুদ, কঁচা সোনার অলংকার, নানা বর্ণের পাথর ইত্যাদি বিক্রয় হয় তাহা vায় সমস্তই আসে তিব্বত ও ভোটান হইতে; ঐ দেশীয় লোকেরাই তাহা লইয়া আসে।
কামরূপ হইতে তিব্বতের পথে বা জলপাইগুড়ি-দাৰ্জিলিং হইতে তিব্বতের পথ ইহার (কানওটাই এখন আর বহুলব্যবহৃত নয়। পার্বত্য প্রদেশের লোকেরাই শুধু এই পথ ব্যবহার করিয়া থাকে বঙ্গ ও আসামের সমভূমিতে আসিবার প্রয়োজনে। কম্বল, ঘোড়া, সোনা, পাথর ইত্যাদির বিনিময়ে লবণ, বিলাসদ্রব্য ইত্যাদি কিনিবার জন্য। কামরূপ হইতে উত্তর-পূর্ব আসাম ৩। মণিপুরের ভিতর দিয়া, উত্তর ব্রহ্মের ভিতর দিয়া যে-পথ দক্ষিণ-পূর্ব চীনে চলিয়া গিয়াছে, (যা পথের কথা চাঙ-কিয়েন বলিয়াছেন সেই পথে লোক-যাতায়াত বরাবরই কিছু কিছু ছিল; মধ্যযুগেও ছিল, এবং বর্তমান যুগেও আছে। আসামে ও বাঙলায় গোপনে আফিম আমদানী তো এই পথেই হইয়া থাকে। কিন্তু গত ভারত-ব্ৰহ্ম-চীন-জাপান যুদ্ধের তাগাদায় এই পথ পুনরুজ্জীবিত হইয়াছে।
ত্রিপুরা-মণিপুর পথ
ব্রহ্মদেশ হইতে পূর্বাভিমুখী আর-একটি স্থলপথের উল্লেখ করিতেই হয়। এ পথটি পূর্ব বাঙলার ত্রিপুরা জেলার লালমাই-ময়নামতী (প্রাচীন পট্টিকের রাজ্য) অঞ্চল হইতে আরম্ভ করিয়া সুরমা এ কাছাড় উপত্যকার (বর্তমান, শ্ৰীহট্ট-শিলচর) ভিতর দিয়া, লুসাই পাহাড়ের উপর দিয়া, মনিপুরের ভিতর দিয়া, উত্তর ব্ৰহ্মদেশ ভেদ করিয়া, মধ্য ব্ৰহ্মদেশে পাগান পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। পট্টিকেরা রাজ্যের সঙ্গে একাদশ ও দ্বাদশ শতকে ব্ৰহ্মদেশের পাগান রাষ্ট্রের খুব ঘনিষ্ঠ বৈবাহিক ও রাজনৈতিক সম্বন্ধ বিদ্যমান ছিল। এই দুই রাজ্যের সংযোগ ছিল এই সদ্যোক্ত পথে। এই পথের সংবাদও স্থানীয় লোক ছাড়া আর সকলেই ভুলিয়া গিয়াছিল, অথচ মধ্যযুগে মণিপুর-ব্ৰহ্মযুদ্ধের সৈন্যসামন্ত তো এই পথ দিয়াই যাওয়া-আসা করিয়াছে। চোরাই ব্যাবসাও বরাবরই এই পথে চলিত। আজ প্রয়োজনের তাড়নায় সেই পথ আবার বহুজনের পদচারণে প্রশস্ত হইয়াছে।
চট্টগ্রাম-আরাকান পথ
আর একটি পথের প্রতি একান্ত সাম্প্রতিক কালের দৃষ্টি পড়িয়াছে। এই পথ দক্ষিণশায়ী চট্টগ্রাম হইতে আরাকানের ভিতর দিয়া নিম্ন-ব্ৰহ্মের প্রোম বা প্রাচীন শ্ৰীক্ষেত্র পর্যন্ত বিস্তৃত। আনুমানিক নবম-একাদশ শতকে আরাকানে চন্দ্ৰবংশীয় রাজাদের আধিপত্য সুবিদিত। চট্টগ্রামের সঙ্গে ইহাদের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধও সমান সুপরিচিত। মধ্যযুগে আরাকান মুসলমান রাজসভায় বাঙলা সাহিত্যের প্রচুর সমৃদ্ধি দেখা গিয়াছিল; এই সাহিত্যের সঙ্গে চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ। আজ প্রয়োজনের তাড়নায় এই চট্টগ্রাম-আরাকান-প্রোম পথও জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়াছে। অবশ্য এই পথের সমান্তরালবাহী সমুদ্রকুলশায়ী জলপথ তো সঙ্গে সঙ্গে ছিলই।
তাম্রলিপ্তি হইতে দক্ষিণমুখী পথ
আর একটি স্থলপথের উল্লেখ করিলেই স্থলপথ বৃত্তান্ত শেষ হইবে। এই পথটি তাম্রলিপ্তি-তমলুক হইতে, কর্ণসুবর্ণ হইতে, সোজা দক্ষিণবাহী হইয়া বাঙলাদেশকৈ দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যুক্ত করিয়াছে। য়ুয়ান-চোয়াঙ এই পথ ধরিয়াই কর্ণসুবর্ণ হইতে ওড্র, কঙ্গোব্দ, কলিঙ্গ, দক্ষিণ-কৌশল, অন্ধ হইয়া দ্রাবিড়, চোল, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে গিয়াছিলেন। পাল ও সেন রাজারা এই পথেই দক্ষিণ দেশ আক্রমণে অগ্রসর হইয়াছিলেন। পশ্চিম-চালুক্যবংশীয় বিক্ৰমাদিত্য, চোলরাজ, রাজেন্দ্ৰচোল, এবং পূর্ব-গঙ্গােবংশের রাজারা এই পথেই বঙ্গদেশ আক্রমণে সৈন্যচালনা করিয়াছিলেন। এই পথেই চৈতন্যদেব নীলাচল এবং দক্ষিণ-ভারতে গিয়াছিলেন। এই পথেই বর্তমান কালের বি-এন-আর এবং মাদ্রাজ-রেলপথ বিস্তৃত।
আন্তর্দেশীয় নদীপথ
স্থলপথের কথা বলা হইল। এইবার আস্তর্দেশিক নদী ও সামুদ্রিক জলপথের কথা বলা যাইতে পারে। এ সম্বন্ধে সর্বপ্রাচীন সাক্ষ্য কয়েকটি জাতক-কাহিনী হইতে পাওয়া যায়। “শঙ্খজাতক’, ‘সমুন্দবাণিজজাতক’, ‘মহাজনকজাতক’ ইত্যাদি গল্পে দেখা যায়, মধ্যদেশের বণিকরা বারাণসী বা চম্পা হইতে জাহাজে করিয়া গঙ্গা-ভাগীরথীপথে তাম্রলিপ্তি আসিত এবং সেখান হইতে বঙ্গসাগরের কূল ধরিয়া সিংহলে, অথবা উত্তাল সমুদ্র অতিক্রম করিয়া যাইত সুবৰ্ণভূমিতে (নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশ)। সুবৰ্ণভূমির পথে বহুদিন বণিকেরা কুলভূমির চিহ্ন পর্যন্ত দেখিতে পাইত না। মেগাস্থিনিসের বিবরণ হইতে সম্ভবত স্ট্রাবো। এই তথ্য আহরণ করিয়াছিলেন যে, ভাগীরথী-গঙ্গার উজান বাহিয়া সাগরমুখের বন্দর হইতে বাণিজ্যতরীগুলি প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্রের তদানীন্তন রাজধানী পাটলিপুত্র পর্যন্ত যাওয়া-আসা করিত। নদীপথে গঙ্গা-ভাগীরথী বাহিয়াই বঙ্গদেশের সঙ্গে উত্তর-ভারতের যোগাযোগ ছিল। এ পথ প্রাগৈতিহাসিক পথ, এবং রেলপথে দ্রুত বাণিজ্য-সম্ভার যাতায়াতের সূত্রপাতের আগে বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াত এই পথেই ছিল বেশি।
উনবিংশ শতকেও বাঙালী এই নৌকাপথে কাশীধামে যাওয়া-আসা করিত, এই স্মৃতি এখনও বিলুপ্ত হয় নাই। প্রাচীন বাঙলার অন্য দুইটি প্রধানতম নদনদী করতোয়া এবং ব্ৰহ্মপুত্র বা লৌহিত্যপথে বাণিজ্যলক্ষ্মীর যাতায়াতের সাক্ষ্য বড় একটা পাওয়া যায় না। তবে, কামরূপ হইতে কর্ণসুবর্ণ এক জলপথের ইঙ্গিত বোধহয় পাওয়া যায়। য়ুয়ান-চোয়াঙের বিবরণীতে হর্ষবর্ধন-ভাস্করবর্ম সংবাদ প্রসঙ্গে। কিন্তু, এই জলপথ কি ব্ৰহ্মপুত্ৰ-ভাটি এবং গঙ্গা-উজান বাহিয়া, না কামরূপ হইতে স্থলপথে উত্তরবঙ্গের ভিতর দিয়া, তাহার পর কোশী বা মহানন্দার ভাটি বাহিয়া গঙ্গাতীরস্থ কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত, তাহা নিঃসংশয়ে বলা কঠিন। যাহা হউক, এ কথা অনুমান করিতে কিছুমাত্র কল্পনার আশ্রয় লইতে হয় না যে, উত্তর-আসামের রেশমজাতীয় বস্ত্রসম্ভার, বাঁশ, কাঠ, চন্দনকাঠ, পান, গুবক বা সুপারি, তেজপাতা ইত্যাদি ব্ৰহ্মপুত্র-সুরমা-মেঘনা বাহিয়াই বাঙলাদেশে আসিত। বাঁশ, কাঠ, ঘর ছাইবার খড় ইত্যাদি তো এখনও ভাটির স্রোতে ভেলায় ভাসাইয়া বাঙলাদেশে আনা হয়। পাট এবং ধান-চাল তো আজও নৌকাপথেই আমদানি-রপ্তানি হয় বেশি, বিশেষত পূর্ব-বাঙলার বিভিন্ন স্থানে এবং আসামের ও সুরমা উপত্যকা অঞ্চলে। করতোয়া যে এক সময় খুবই প্রশস্ত ও খরস্রোতা নদী ছিল এবং সোজা গিয়া সমুদ্রে পড়িত এ কথা তো আগেই বলিয়াছি। উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গে যোগাযোগ এই নদীপথেই ছিল, সন্দেহ করিবার কারণ নাই। এ কথাও আগে বলিয়াছি যে, এই নদীমাতৃক দেশে স্থলপথ অপেক্ষা নদীপথেই যাতায়াত ও বাণিজ্য প্রশস্ততর ছিল। লিপি এবং সমসাময়িক সাহিত্যেই যে শুধু সে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহাই নয়; মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্যে এবং উনবিংশ শতাব্দীর শেষাশেষি পর্যন্ত লোকের অভ্যাস ও সংস্কারের মধ্যেও তাহার আভাস ও ইঙ্গিত সুস্পষ্ট।
বহির্দেশীয় সমুদ্রপথ : বঙ্গ-সিংহল পথ
নদীপথে আন্তর্দেশিক বাণিজ্য অপেক্ষা প্রাচীন বাঙলার সামুদ্রিক বাণিজ্য এবং বাণিজ্য-পথের সাক্ষ্য-প্রমাণ অনেক বেশি পাওয়া যায়। জাতকের গল্পে তাম্রলিপ্তি হইতে সিংহল ও সুবর্ণদ্বীপ যাত্রার কথা বলিয়াছি। দক্ষিণ-ভারত ও সিংহলের পথের কথাই আগে বলা যাক। সিংহলী ইতিগ্ৰন্থ ‘দীপবংশ’ ও ‘মহাবংশে’ উল্লিখিত লাঢ়দেশী রাজপুত্র বিজয়সিংহ কর্তৃক সমুদ্রপথে সিংহেলগমন এবং দ্বীপটি অধিকার ইত্যাদির গাল্পৈতিহ্য বাঙালী কবি সত্যেন্দ্রনাথের কল্যাণে সুপরিচিত। কিন্তু এই লাঢ়দেশ কি প্রাচীন বাঙলার রাঢ় জনপদ, না প্রাচীন গুজরাত বা লাটদেশ, এই লইয়া পণ্ডিতমহলে মতভেদ আছে, এবং এই সম্পৰ্কীয় আলোচনা নানা ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক এবং শব্দতাত্ত্বিক বিতর্কে কণ্টকিত। কিন্তু এ সাক্ষ্য ছাড়াও এই সম্বন্ধে অন্য প্রাচীন সাক্ষা বিদ্যমান। পেরিপ্লাসের সাক্ষ্য আগে উল্লেখ করিয়াছি। এই গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, লগদেশের সঙ্গে দক্ষিণ ভারত ও সিংহলের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্য-সম্বন্ধ ছিল। সমুদ্রমুখে গঙ্গাবন্দর হইতে বাণিজ্যসম্ভার কোলণ্ডিয়া (Colandia) নামক এক প্রকার জাহাজ বোঝাই হইত এবং সেই জাহাজগুলি দক্ষিণ ভারতে ও সিংহলে যাতায়াত করিত। প্লিনিও এই সামুদ্রিক বাণিজ্যপথের উল্লেখ করিয়া বলিতেছেন, আগে প্রাচ্যদেশ হইতে সিংহলে যাইতে ২০ দিন লাগিত, পরে (অর্থাৎ, প্লিনির সময়ে এবং কিছু আগে) লাগিত মাত্ৰ সাতদিন (‘a seven days’ sail according to the rate of speed of ourships’)। চতুর্থ শতকে ফাহিয়ান যখন তাম্রলিপ্তি হইতে এক বাণিজ্য-জাহাজ চড়িয়া সিংহলে যান। তখন লাগিয়াছিল চৌদ্দ দিন ও রাত্রি। সিংহল তো খ্রীষ্টপূর্বকাল হইতেই বৌদ্ধধর্মের এক বিশিষ্ট কেন্দ্ৰ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল, এবং কালক্রমে এই হিসাবে এই দ্বীপটির খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা বাড়িয়াই চলিয়াছিল। ফাহিয়ানের পর হইতেই বহু চীনা বৌদ্ধ পরিব্রাজক সিংহলে-বাঙলাদেশে আসা-যাওয়া করিতেন এবং তাহা সদ্যোক্ত সমুদ্রপথেই। সপ্তম শতকে ইৎসিঙের বিবরণী পাঠে জানা যায়, ঐ সময় অসংখ্য চীনদেশীয় বৌদ্ধশ্রমণ সিংহল হইতে বাঙলায় এবং বাঙলা হইতে সিংহলে ঐ পথে যাতায়াত করিয়াছিলেন। বোধহয়, ঐ সূত্র ধরিয়াই মহাযান বৌদ্ধধর্ম এবং কিছু কিছু নাগরী লিপির বৌদ্ধধর্মগ্রন্থও সিংহলে প্রসারলাভ করিযাছিল। অষ্টম শতকের পর বৈদেশিক বাণিজ্যে বাঙলাদেশের প্রতিষ্ঠা ক্ষুঃ হওয়ার পরে বহুদিন এই পথের কথা আর শোনা যায় না; তবে মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্য পাঠ করিলে মনে হয়, তখন এই পথ ধরিয়া অর্থাৎ সমুদ্রোপকূল বাহিয়া সিংহল গুজরাত পর্যন্ত সমুদ্রপথ পুনরুজজীবিত হইয়াছিল, অথবা এইসব পথের সুপ্রাচীন স্মৃতি প্রচলিত গল্প কাহিনীর মধ্যে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল, যেমন ‘মনসামঙ্গল কাব্যগুলিতে। সিংহল হইতে মালয়, নিম্ন-ব্ৰহ্ম, সুবর্ণদ্বীপ, যবদ্বীপ, চম্পা, কম্বোজের সমুদ্রপথ তো ছিলই, এবং তাহার প্রমাণও সুপ্রচুর।
তাম্রলিপ্তি-আরাকান-ব্ৰহ্ম-মালয়-যবদ্বীপ-সুবর্ণদ্বীপ পথ
তাম্রলিপ্তি হইতে নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশ বা সুবৰ্ণভূমির দ্বিতীয় সমুদ্রপথের ইঙ্গিত যে “মহাজনকজাতকের গল্পে পাওয়া যাইতেছে, সে কথা ইতিপূর্বে বলিয়াছি। এই পথ সম্ভবত ছিল চট্টগ্রাম-আরাকানের সমুদ্রোপকূল বাহিয়া। একাদশ শতকে এবং পরে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের সঙ্গে আরাকানের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধের আনাগোনা যে এই পথেই অনেকটা হইত। তাহা কতকটা অনুমান করা চলে। মধ্যযুগীয় বাঙলা সাহিত্যেও বাঙলার সঙ্গে নিম্ন-ব্রহ্মের সামুদ্রিক বাণিজ্যের এবং এই বাণিজ্যপথের সুদূর স্মৃতি ধরিতে পারা কঠিন নয়। ‘সুপারগ জাতক’ নামে আর-একটি জাতকের গল্পেও পূর্ব ভারতের বণিকদের সুবৰ্ণভূমিতে যাত্রার কথা আছে। মধ্যযুগে চীন বণিক ও পরিব্রাজকেরা (যেমন, মা-হুয়ান), আরব বণিকেরা এবং পরে পর্তুগীজ বণিকেরা সপ্তগ্রাম ও চেহাটি-গান বা চট্টগ্রাম হইতে এই সমুদ্রোপকূল বাহিয়াই আরাকান ও নিম্ন-ব্ৰহ্মদেশে যাওয়া-আসা করিতেন, এমন প্রমাণ একেবারেই দুর্লভ নয়। ইৎসিঙ সপ্তম শতকেই বলিতেছেন, হিউয়েন-ত নামে একজন চীন পরিব্রাজক মালয় উপদ্বীপের সমুদ্রকুলবর্তী কেন্ডা (Keddah) হইতে সোজা তাম্রলিপ্তি গিয়াছিলেন। এই পথটির আভাস বোধহয় খ্ৰীষ্টীয় চতুর্থ-পঞ্চম শতক হইতে পাইতেছি। মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের যে লিপিটি মালয় উপদ্বীপে পাওয়া গিয়াছে সেই লিপিটিতে দেখিতেছি, বুদ্ধগুপ্ত রক্তমৃত্তিকা হইতে সমুদ্রপথে গিয়াছিলেন মালয়ে, বাণিজ্যব্যাপদেশে। এই রক্তমৃত্তিকা মুর্শিদাবাদ জেলার রাঙ্গামাটি (য়ুয়ান-চোয়াঙের লো-টো-মো-চিহ) বা চট্টগ্রাম জেলার রাঙ্গামাটিও হইতে পারে; শেষেরটি হওয়াই অধিকতর সম্ভব। নবম শতকের মাঝামাঝি দেবপালের নালন্দা লিপিতেও বঙ্গসাগর বাহিয়া এক সমুদ্রপথের ইঙ্গিত পাওয়া যাইতেছে। তখন তাম্রলিপ্তি বন্দর অবলুপ্ত; বাঙলার আর কোনও সামুদ্রিক বন্দরের উল্লেখও পাইতেছি। না। কাজেই, এই পথ সমুদ্রতীর বাহিয়া, না কোনাকুনি বঙ্গোপসাগর বাহিয়া, ওড়িশার কোনো বন্দর হইয়া, তাহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতেছে না।
তাম্রলিপ্তি-পলৌরা-মালয়-সুবর্ণভূমি পথ
তৃতীয় আর-একটি পথের কথাও বলিতে হয়। এই পথের সর্বপ্রাচীন সংবাদ দিতেছেন ভৌগোলিক ও জ্যোতির্বেত্তা টলেমি। তাম্রলিপ্তি হইতে যাত্ৰা করিয়া জাহাজগুলি সোজা আসিত ওড়িশা দেশের পলৌরা (Paloura) বন্দরে, এবং সেখান হইতে কোনাকুনি বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়া যাইত মালয়, যবদ্বীপ, সুমাত্রা প্রভৃতি দ্বীপ-উপদ্বীপগুলিতে।