ভূমির প্রকারভেদ
অষ্টমশতকপূর্ববতী লিপিগুলিতে আমরা প্রধানত তিন প্রকার ভূমির উল্লেখ পাইতেছি; বাস্তু, ক্ষেত্র ও খিলক্ষেত্র। যে ভূমিতে লোকে ঘরবাড়ি তৈরি করিয়া বাস করিত অথবা বাসযোগ্য যে ভূমি, তাহা বাস্তুভূমি। কোনও কোনও ক্ষেত্রে, যেমন বৈগ্রাম-পট্টোলীতে, বাস্তুভূমিকে স্থলবাস্তুভূমিও বলা হইয়াছে। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতকের কোনও কোনও লিপিতে “ব্যাভূ” বলিয়া বাস্তুভূমি নির্দেশ করা হইয়াছে, যথা, দামোদর দেবের অপ্রকাশিত চট্টগ্রাম-লিপিতে, বিশ্বরূপ সেনের সাহিত্য-পরিষৎ লিপিতে। “ব্যাভূ” “চতুঃসীমাবচ্ছিন্ন বাস্তুভূমি”, অর্থাৎ সীমানির্দিষ্ট বসবাস করিবার ভূমি।
যে ভূমি কর্ষণযোগ্য ও কর্ষণাধীন, সে ভূমি ক্ষেত্রভূমি। যেখানে দান-বিক্রয় হইতেছে, এ কথা সহজেই অনুমেয় যে, সেখানে ভূমি পূর্বেই অন্য লোকের দ্বারা কর্ষিত ও ব্যবহৃত হইয়াছে, তাহা রাজার পক্ষ হইতেই হউক বা অন্য কোনও ব্যক্তি দ্বারা বা ব্যক্তির পক্ষ হইতেই হউক। ক্ষেত্রভূমি দান-বিক্রয় যেখানে হইতেছে, সেখানে ভূমি হস্তান্তরিতও হইতেছে। দ্বাদশ ও ত্ৰয়োদশ শতকের কোনও কোনও লিপিতে কর্ষণযোগ্য ক্ষেত্রভূমি বুঝাইতে “নালভূ” বা “নাভূ”কথাটির ব্যবহার করা হইয়াছে, যেমন পূর্বোক্ত দামোদর দেবের অপ্রকাশিত চট্টগ্রাম-লিপিতে। নালজমি কথা তো এই অর্থে এখনো প্রচলিত।
ভূমি কর্ষণযোগ্য ও কর্ষণাধীন যেমন হইতে পারে, তেমনই কর্ষণযোগ্য কিন্তু অকৰ্ষিতও হইতে পারে। এ কথা বলিতে বুঝিতেছি, কোনও নির্দিষ্ট ভূমি চাষের উপযুক্ত, কিন্তু যে কারণেই হোক, যখন সে ভূমি দান-বিক্রয় হইতেছে, তখন কেহ সে ভূমি চাষ করিতেছে না। এমন যে ক্ষেত্র বা ভূমি, তাহা খিলক্ষেত্র চাষ করিয়া করিয়া যে ভূমির উর্বরতা নষ্ট হইয়া যায়, সে ভূমি অনেক সময় দু’চার বৎসর ফেলিয়া রাখা হয়, তাহাতে ভূমির উর্বরতা বাড়ে, এবং পরে তাহা আবার চাষযোগ্য হয়। খিলক্ষেত্র বলিতে খুব সম্ভব, এই ধরনের ভূমির দিকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে। আর, যে ভূমি শুধু খিল বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে, তাহাকর্ষণের অযোগ্য ভূমি। অষ্টমশতকোত্তর কোনও কোনও লিপিতে নালভূমির সঙ্গে খিলভূমির উল্লেখ হইতেও (সখিলনালা, সবাৰ্ত্তনালখিলা) এই অনুমানই সত্য বলিয়া মনে হয়। এখনও পূর্ববাঙলা ও শ্ৰীহট্টে কোনও কোনও স্থান খিলজমি বলিতে অনুর্বর, কর্ষণের অযোগ্য জলাভূমিকেই বুঝায়। ইহার একটু পরোক্ষ ঐতিহাসিক প্রমাণও আছে বৈন্যগুপ্তের গুণাইঘর-লিপিতে। এই ক্ষেত্রে বিশেষ একখণ্ড খিলভূমি উল্লিখিত হইতেছে হজিক খিলভূমি’ বলিয়া (water-logged waste land) হজিক =হাজা, শুখা বা শুকনার বিপরীত, অর্থ জলাভূমি। তবে, এমনও হইতে পারে, খিল ও খিলক্ষেত্র বলিতে একই প্রকারের ভূমি নির্দেশ করা হইতেছে। দুই ভিন্ন অর্থে কথা দুইটি ব্যবহৃত হইতেছে কি না, লিপিগুলির সাক্ষ্য হইতে তাহা বুঝিবার উপায় নাই। কোনও কোনও লিপিতে, যেমন ১ নং দামোদরপুর-লিপিতে, খিল-ভূমিকেই আবার বিশেষিত করা হইতেছে “অপ্ৰহত অর্থাৎ আকৃষ্ট বলিয়া। আমরকোষের মতে খিল ও অপ্ৰহত একার্থিক (২।১০।।৫) এবং হলায়ুধ খিল অর্থে বুঝিয়াছেন পতিত জমি। যাদবপ্রকাশ তাহার বৈজয়ন্তী গ্রন্থে (একাদশ শতক) এই প্রসঙ্গে বলিতেছেন, “খিলমপ্ৰহতং স্থানমুষবস্তৃত্যুষরেরিণীে” (পৃ: ১২৪)। তিনিও তাহা হইলে খিল ও অপ্ৰহত সমর্থক বলিয়াই ধরিয়া লইয়াছেন এবং খিলভূমি বলিতে কর্ষণযোগ্য অথচ অকৃষ্ট ভূমির প্রতিই যেন ইঙ্গিত করিতেছেন। নারদ-স্মৃতির মতে যে ভূমি এক বছর চাষ করা হয় নাই, তাহা অর্ধখিল, যাহা তিন বছর চাষ করা হয় নাই, তাহা খিল (১১/২৬)। ক্ষেত্র ও খিলভূমির পূর্বোক্ত পার্থক্য পরবর্তীকালেও দেখা যায়। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থে ভূমির প্রকারভেদ প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে: ১. যে ভূমি কর্ষণাধীন, তাহা ‘পোলাজ’ ভূমি; ইহাই প্রাচীন বাঙলার ক্ষেত্রভূমি; ২৭ যে ভূমি কর্ষণযোগ্য, কিন্তু এক বা দুই বৎসরের জন্য কর্ষণ করা হইতেছে না, উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, সেই ভূমি “পরেীতি ভূমি; ৩- এই ভাবে যে ভূমি তিন বা চার বৎসর ফেলিয়া রাখা হইয়াছে, তাহা ‘চিচর ভূমি; ৪ এবং যাহা পাঁচ বা ততোধিক বৎসর ফেলিয়া রাখা হইয়াছে, তাহা ‘বঞ্জর’ ভূমি। আকবরের কালের ২, ৩ ও ৪নং ভূমিই খুব সম্ভব প্রাচীন বাঙলার খিলভূমি।
এই প্রধান তিন-চার প্রকার ভূমি ছাড়া অন্যান্য প্রকারের ভূমির উল্লেখও লিপিগুলিতে দেখা যায়। একে একে সেগুলির উল্লেখ করা যাইতে পারে।
তল, বাটক, উদ্দেশ, আলি। বৈগ্রাম-পট্টোলীতে ‘তালবাটক’ কথা একসঙ্গেই ব্যবহৃত হইয়াছে। যিনি ভূমি ক্রয় করিতেছেন, তিনি বাস্তুভূমিই ক্রয় করিতেছেন; উদ্দেশ্য, ঘরবাড়ি তৈরি করা, এবং ঘরবাড়ি করিয়া বাস করিতে হইলেই পায়ে চলিবার পথ এবং জল চলাচলের পথও তৈরি করা প্রয়োজন। খালিমপুর-লিপির ‘তলপাটক নিঃসন্দেহে ‘তালবাটক’ এবং বৈগ্রাম-লিপিতে কথাটি যে অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে, এখানেও ঠিক তাহাই। এখনও বাঙলাদেশের অনেক জায়গায় পথ অর্থে বাট কথাটির ব্যবহার প্রচলিত আছে; বাঙলার বাহিরেও আছে। এই পথের অর্থাৎ বাটকের সঙ্গে তল কথার উল্লেখ যেখানেই আছে, সেখানে তলের অর্থ নালা বা প্ৰণুল্লী এক কথায় নর্দমা বা জল নিঃসরণের পথ। নালা এবং প্ৰণুল্লী, এই দুইটি শব্দের উল্লেখ অষ্টমশতকোত্তর লিপিতেও আছে। সাধারণত পথের ধারে ধারেই থাকিত জল নিঃসরণের পথ। তাহা ছাড়া কথা দুইটি বিপরীতাৰ্থক্যব্যঞ্জক; সেইজন্যই তল এবং বাটক প্রায় সর্বত্রই একত্র উল্লিখিত হইয়াছে। অষ্টম শতকোত্তর লিপিগুলিতে অনেক স্থলে তলের সঙ্গে উদ্দেশ কথাটিরও ব্যবহার দেখিতে পাওয়া যায় (সতলঃ সোদেশঃ)। সে-ক্ষেত্রেও তল অর্থে পয়ঃপ্রণালী বুঝাইতে কোনও আপত্তি নাই; কারণ, উদ্দেশ বা উৎ + দেশ অর্থে উচ্চ ভূমি, অর্থাৎ বাধ, চিপি, জমির আলি (আইল, ধৰ্মপালের খালিমপুর-লিপি। দ্রষ্টব্য; বান্ধাইল বরেন্দ্রভূমিতে এখনও প্রচলিত) ইত্যাদি বুঝায় এবং বাধ বা জমির আলির পাশে পাশেই তো এখনও দেখা যায় ক্ষেতের জল নিঃসরণের বা জলসেচনের প্রণালী, কেহ কেহ তল বলিতে সাধারণভাবে গ্রামের নিন্ন জলাভূমি বুঝিয়াছেন; আমার কাছে এই অর্থ সমীচীন মনে হয় না। কারণ বাটক বা উদ্দেশ উভয়ের সঙ্গেই পয়ঃপ্ৰণালী অর্থে তল কথাটির ব্যবহার সার্থকতর, তাহাতে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই।
জোলা, জোলক, জোটিকা, খাট, খােটা, খাটিকা, খাড়ি, খাড়িকা, যানিকা, স্রোতিকা, গঙ্গিনিকা, হজিক, খাল, বিল ইত্যাদি। এই প্রত্যেকটি শব্দই প্রাচীন বাঙলা লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। দত্ত অথবা বিক্ৰীত ভূমির সীমানির্দেশ উপলক্ষেই এইসব কথা ব্যবহারের প্রয়োজন হইয়াছে। জেলা কথাটি তো এখনও উত্তর ও পূর্ববাঙলায় বহুল ব্যবহৃত; যে অনতিপ্রসার খালের পথ দিয়া বিল, পুষ্করিণী, গ্রাম ইত্যাদির জল চলাচল করে, তাহারই নাম জেলা। জোলক, জোটিকা প্রভৃতি শব্দ জেলা শব্দেরই সমার্থক। খাট, খাটা, খাটিকা, খাড়ি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে খাল অর্থে; যে জনপদ। খাল বহুল, তাহাই খাড়িমণ্ডল, আর চব্বিশ পরগনার দক্ষিণাংশ যে খালবহুল তাহা তো সকলেই জানেন। আর, খাদা বা খাটার পারে পারে যে জনপদ, তাহাই খাদা (? ) পার বা খােটাপার বিষয় (ধনাইদহ-লিপি)। যানিকা, স্রোতিকা, গঙ্গিনিকাও খাড়ি-খাটিকা কথার সমার্থক বলিয়াই মনে হয়। মরা নদীর খাদ অর্থে গঙ্গিনিকাও শব্দ উত্তরবঙ্গে এখনও ব্যবহৃত হয় বলিয়া অক্ষয়কুমার মৈত্ৰেয় মহাশয় বলিয়াছেন; কিন্তু গঙ্গিনিকার অপভ্ৰংশ গাঙ্গিনা উত্তর ও পূর্ববাঙলায় এখনও যে-কোেনও মরা পুরাতন খালকেই বুঝায়। হজ্জিকা যে নিম্ন জলাভূমি, তাহার ইঙ্গিত তো আগেই করিয়াছি। ঠিক এই অর্থে জলা বা জল্লা কথা মৈমনসিংহ, শ্ৰীহট্ট, কুমিল্লা প্রভৃতি জেলায় আজও প্রচলিত। খাল, খােটা, খাটিকা, খাড়িকা ইত্যাদি শব্দ সমার্থক। বিল কথার উল্লেখ দামোদর দেবের অপ্রকাশিত একটি লিপিতে আছে।
হট্ট, হট্টিকা, ঘট্ট, তর। হট্ট, হট্টিকা সহজবোধ্য এবং আমাদের হাট, বাজার অর্থেই সর্বত্র ইহার ব্যবহার। ঘট্ট=ঘাট, এবং তর= পারঘাট বা খেয়াপারাপারের ঘাট।
গর্ত, উষর (সগর্তোষর)—গর্ত তো সহজবোধ্য। বদ্ধ ডোবা, অনতিগভীর অনতিপ্রসার কর্ষণ-অযোগ্য ভূমি অর্থেই এই শব্দটির ব্যবহার লিপিতে আছে।
ঊষর অর্থে অনুর্বর কর্ষণ-অযোগ্য উচ্চভূমি। প্রতি গ্রামেই এই ধরনের গর্ত ও উষর ভূমি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত আজও দেখিতে পাওয়া যায়। গর্ত এবং উষরভূমিসহ যেমন ভূখণ্ড দান বিক্রয় করা হইয়াছে, তেমনই জলস্থলসহও হইয়াছে। একই লিপিতে একই ভূখণ্ড “সগর্তোষর” এবং “সজলস্থল” দানের উল্লেখ লিপিগুলিতে অপ্রতুল নয়। কাজেই জল অর্থে এ-ক্ষেত্রে গর্ত বুঝাইতে পারে না; খুব সম্ভবত জলাশয়, পুষ্করিণী, কুম্ভ, ব্যাপী ইত্যাদি বুঝায়, এবং ইহাদের উল্লেখও কোথাও কোথাও আছে।
গোমার্গ, গোবাট, গোপথ, গোচর ইত্যাদি। গোচর সোজাসুজি গোচারণভূমি, যে ভূমিতে গরু মহিষ চরিয়া বেড়ায়। গোচরীভূমি সুপ্রাচীন কাল হইতেই গ্রামবাসীদের সাধারণ সম্পত্তি, এবং সাধারণত গ্রামের বহিঃসীমায়ই তাহার অবস্থিতি। এ সম্বন্ধে কৌটিল্য এবং ধর্মশাস্ত্ৰ-রচয়িতাদের সাক্ষ্য উল্লেখযোগ্য। কৌটিল্যের মতে গ্রামের চারিদিকে ১০০ ধনু (৪০০ হাত) অন্তর অন্তর বেড়া দেওয়া গোচরীভূমি থাকা প্রয়োজন; মনু এবং যাজ্ঞবল্ক্যের বিধানও অনুরূপ। ইহা কিছু আশ্চর্য নয় যে, লিপিগুলির ইঙ্গিতও তাঁহাই “যে পথে গ্রামের ভিতর হইতে গোরু, মহিষ প্রভৃতি গোচরভূমিতে যাতায়াত করে, সেই পথই গোমার্গ, গোবট অথবা গোপথ। গোবাট-(পূর্ববাঙলায় কোথাও কোথাও এখনও গোপাট), গোপথ প্রভৃতি শব্দ এই অর্থে এখনও বাঙলাদেশের অনেক জায়গায় প্রচলিত।
যে গোচরের কথা এইমাত্র বলিলাম, অনেকগুলি লিপিতে, বিশেষত অষ্টমশতকোত্তর লিপিগুলিতে, তাহার সঙ্গেই উল্লেখ আছে তৃণযুতি অথবা তৃণপুতি কথাটির। সীমা নির্দেশ উপলক্ষেই কথাটির ব্যবহার; যে-ভূমি দান করা হইতেছে, তাহার সীমা অনেক ক্ষেত্রেই “স্বসীমা (বচ্ছিন্না) তৃণযুতি (অথবা তৃণপুতি) গোচর পর্যন্ত।” এ কথা সহজেই বুঝা যাইতেছে যে, গোচরের মতো তৃণযুতির বা তৃণপূতির অবস্থানও গ্রামসীমায় বা দত্তভূমির একান্ত সীমায়। তৃণযুতি এবং তৃণপূতি ও তাঁহাদের অর্থ লইয়া পণ্ডিতমহলে অনেক তর্ক-বিতর্ক হইয়া গিয়াছে। প্রাচীনতর লিপিতে, যেমন সমুদ্রসেনের নিরমানন্দ তাম্রপটে কথাটি হইতেছে তৃণ-যুতি। কিন্তু সেখানে তৃণ ও যুতির মধ্যে আরও দুটি শব্দ আছে, কাজেই তৃণযুতি একটি কথা নয়। চাম্বা প্রদেশের লিপিতে একই প্রসঙ্গে গোযুতির উল্লেখ আছে; এবং গরু যেখানে বাধা হয়। সেই স্থানকেই বুঝাইতেছে। পাল আমলের লিপিগুলিতে কিন্তু তৃণ এবং যুতি কথা দুইটি একসঙ্গে এক কথা বলিয়াই পাইতেছি। সেন আমলের লিপিগুলির তৃণপুতি কথাটি কি তৃণযুতি কথাটির অশুদ্ধ রূপ? সমসাময়িক নাগর লিপিতে “য” ও “পা” বর্ণে পার্থক্য খুব বেশি নয়। যদি তাহা হয়, তাহা হইলে গোচরের সঙ্গেই তৃণযুতির উল্লেখ খুব অসাৰ্থক নয়। গ্রামসীমায় যে তৃণান্তীর্ণ ভূমিতে গোরু মহিষ বধিয়া রাখা এবং ঘাস খাওয়ানো হইত। তাঁহাই তৃণযুতি এবং তাঁহারই পাশে গোরু মহিষ চরিয়া বেড়াইবার গোচারণ ভূমি। আর, যদি তৃণপূতি কথাটি শুদ্ধ অবিকৃতরূপে আমরা পাইয়া থাকি, তাহা হইলে, কথাটিকে গোচরের বিশেষণরূপে ধরিয়া লওয়া যায় কি? কোষকারদের মতে পূতি এক ধরনের ঘাস, কাজেই তৃণ ও পূতি প্রায় সমার্থক। তৃণ পূতিপূর্ণ যে গোচরীভূমি, তাহাই তৃণপূতিগোচর এবং তাহা যে গ্রামসীমায় বা ক্ষেত্র ও খিলভূমির সীমায় অবস্থিত থাকিবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি?
বন, অরণ্য ইত্যাদি। বন, অরণ্য সকল ক্ষেত্রেই গ্রামের বাহিরে। একাধিক লিপিতে বনভূমি, অরণ্যভূমি দানের উল্লেখ আছে। অরণ্যভূমি পরিষ্কার করিয়া কী করিয়া গ্রামের পত্তন করা হইত, তাহার পরিচয় অন্তত একটি লিপিতে আছে। লোকনাথের ত্রিপুরা-পট্টোলীতে দেখিতেছি সুকবুঙ্গ বিষয়ে রাজা লোকনাথ সৰ্প-মহিষ ব্যাঘ্র-বরাহাধুষিত আটাবী ভূখণ্ডে চতুর্বেদবিদ্যবিশারদ দুই শত এগার জন ব্রাহ্মণ বসাইবার জন্য প্রচুর ভূমি দান করিয়াছিলেন; দানের প্রার্থনা জানাইয়াছিলেন ব্ৰাহ্মণ প্রদোষশৰ্মা। কৌটিল্যের বিধানে বন, অরণ্য ইত্যাদি ছিল রাষ্ট্রসম্পত্তি; ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে অরণ্যভূমি ব্ৰাহ্মণকে দান করা যাইতে পারে, কৌটিল্য এই বিধানও দিয়াছেন। অরণ্যভূমি পরিষ্কার করিয়া কী করিয়া নূতন জনপদের পত্তন করিতে হয়, কৌটিল্য তাহারও ইঙ্গিত রাখিয়া গিয়াছেন। লোকনাথের লিপিটি কৌটিল্যের বিধানের অন্যতম ঐতিহাসিক প্রমাণ।
মাৰ্গ, বাট দুইই জনপদের লোক ও যানবাহন চলাচলের পথ। ইরদা তাম্রপট্টের আবষ্করস্থান তো আঁস্তাকুঁড় এবং সেই হেতু ঊষর ভূমির সঙ্গেই তাহার উল্লেখ।