প্রথমেই সংবাদ পাওয়া যাইতেছে অগণিত ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ্য প্রতিষ্ঠানের। ১ নং দামোদরপুর লিপিতে (খ্ৰীষ্টাব্দ ৪৪৩-৪৪) জনৈক কর্পটিকনামীয় ব্রাহ্মণ অগ্নিহোত্র যজ্ঞকাৰ্য সম্পাদনের জন্য ভূমিক্রয় প্রার্থন করিতেছেন; ২ নং পট্টোলি দ্বা্রা (৪৪৮-৪৯) পঞ্চ মহাযজ্ঞেব জন্য আর এক ব্রাহ্মণকে ভূমি দেওয়া হইতেছে; ধনাইদহ পট্টোলির (৪৩২-৩৩) বলে কটকনিবাসী এক ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ কিছু ভূমি লাভ করিতেছেন; ৩ নং দামোদরপুর পট্টোলিতে (৪৮২-৮৩) পাইতেছি নাভক নামে এক ব্যক্তি কয়েকজন প্রসিদ্ধ ব্রাহ্মণ বসাইবার জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৪ নং দামোদরপুর লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, নগরশ্রেষ্ঠ রিভূপাল হিমালয়ের পাদদেশে ডোঙ্গাগ্রামে কোকামুখস্বামী, শ্বেতবরাহস্বামী এবং নামলিঙ্গের পূজা ও সেবার জন্য ভূমিক্রয় করিতেছেন; বৈগ্রাম পট্টোলির (৪৪৭-৪৮) সংবাদ, ভোয়িল এবং ভাস্কর নামে দুই ভাই গোবিন্দস্বামীর নিত্য পূজার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন; ৫ নং দামোদর পট্টোলিতে (৫৪৩-৪৪) দেখিতেছি শ্বেতবরাহস্বামীর মন্দির সংস্কারের জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন অযোধ্যাবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব। এ সমস্ত লিপিই পুণ্ড্র বর্ধনভূক্তির অন্তর্গত ভূমি সম্বন্ধীয়। এই অনুমান নিঃসংশয় যে পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে ব্রাহ্মণ্যধর্ম স্বীকৃতি লাভ করিয়াছে, এই ধর্মের দেবদেবীরা পূজিত হইতেছেন, ব্রাহ্মণদের বসবাস বিস্তত হইতেছে, অব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণদের ভূমিদান করিতেছেন, আনিয়া বসবাস করাইতেছেন, এবং অযোধ্যাবাসী ভিন-প্রদেশী আসিয়াও এইদেশে মন্দির সংস্কার করাইবার জন্য ভূমি ক্রয় করিতেছেন। যে সব ব্রাহ্মণেরা অসিতেছেন তাহাদের মধ্যে বেদবিদ ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণও আছেন। উত্তরবঙ্গের সংবাদ বোধ হয় আরও পাওয়া যায় কামরূপরাজ ভাস্করবর্মণের নিধনপুর লিপিতে। লিপিটি সপ্তম শতকের, পট্টোলি কর্ণসুবর্ণ জয়স্কান্ধাবার হইতে নির্গত; দত্তভূমি চন্দ্রপুরি বিষয়ের ময়ূরশান্মলাগ্রহার ক্ষেত্র, এবং এই ভূমিদানকার্য ভাস্করের চারি পুরুষ পূর্বে বুদ্ধপ্রপিতামহ ভূতিবর্মণদ্বারা (আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের প্রথম পাদ) প্রথম সম্পাদিত হইয়াছিল। চন্দ্রপুরি বিষয় বা ময়ূরশাল্মল অগ্রহার কোথায় তাহা আজও নিঃসংশয়ে নির্ণীত হয় নাই; তবে উত্তরবঙ্গের পূর্বতন সীমায় (রংপুর জেলায়) কিংবা একেবারে শ্রীহট্ট জেলার পঞ্চখণ্ড (লিপির আবিষ্কার স্থান) অঞ্চল, এ দুয়ের এক জায়গায় হওয়াই সম্ভব, যদিও রংপুর অঞ্চল হওয়াই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বলিয়া মনে হয়। যাহাই হউক, এই লিপিতে দেখা যাইতেছে ময়ূরশাল্মল অগ্রহারে ভূতিবর্মণ ভিন্ন ভিন্ন বেদের ৫৬টি বিভিন্ন গোত্রীয় অন্তত ২০৫ জন ‘বৈদিক’ বা ‘সাম্প্রদায়িক ব্রাহ্মণের বসতি করাইয়াছিলেন। ব্রাহ্মণের সকলেই বাজসনেয়ী, ছান্দোগ্য, বাহ্বৃচ্য, চারক্য এবং তৈত্তিরীয়, এই পাঁচটি বেদ-পরিচয়ের অন্তর্গত, তবে যজুর্বেদীয় বাজসনেয়ী-পরিচয়ের সংখ্যাই অধিক। চারক্য এবং তৈত্তিরীয়েরাও যজুর্বেদীয়; বাহ্বৃচ্য ঋগ্বেদীয়; ছান্দোগ্য সামবেদীয়। ইঁহাদের অধিকাংশের পদবী স্বামী। স্পষ্টই দেখা যাইতেছে, ষষ্ঠ শতকের গোড়াতেই উত্তরপূর্ব-বাংলায় (ভিন্ন মতে, শ্ৰীহট্ট অঞ্চলে) পুরাদস্তুর ব্রাহ্মণ-সমাজ গড়িয়া উঠিয়াছে। পূর্বোক্ত অন্যান্য লিপির সাক্ষ্যও তাহাই। ভূমি দান-বিক্রয় যে সব গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে নিম্পন্ন হইতেছে তাহদের মধ্যে অনেক ব্রাহ্মণের দর্শন মিলিতেছে; ইঁহাদের নামপদবী শর্মণ এবং স্বামী দুইই পাওয়া যাইতেছে।
পশ্চিমবঙ্গের খবর পাওয়া যাইতেছে বিজয়সেনের মল্লসারুল লিপি (ষষ্ঠ শতক) এবং জয়নাগের বপ্যঘোষবাট লিপিতে (সপ্তম শতক)। শেষোক্ত লিপিটিদ্বারা মহাপ্রতীহার সূৰ্যসেন বপ্যঘোষবাটনামক একটি গ্রাম ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী নামে এক ব্ৰাক্ষণকে দান করিতেছেন, এই লিপিতেই খবর পাওয়া যাইতেছে কুককুট গ্রামের ব্রাহ্মণদেব ভট্ট উন্মীলন স্বামী এবং প্রবলি স্বামী নামে আরও দুইটি ব্রাহ্মণের দেখা এখানেও মিলিতেছে। এক্ষেত্রেও নাম-পদবী স্বামী। মল্লাসারুল লিপিতে সংবাদ পাওয়া যাইতেছে, দৈনিক পঞ্চ মহাযজ্ঞ নিম্পন্নের জন্য মহারাজ বিজয়সেন বৎসস্বামীনামক জনৈক ঋগ্বেদীয় ব্রাহ্মণকে কিছু ভূমি দান করিতেছেন। স্পষ্টই বুঝা যাইতেছে রাঢ় রাষ্ট্রেও ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা যষ্ঠ-সপ্তম শতকেই স্বীকৃত ও প্রসারিত হইয়াছে। এই তথ্যের প্রমাণ আর ও পাওয়া যায় সদ্য আবিষ্কৃত শশাঙ্কের মেদিনীপুর লিপি দুইটীতে। মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে দণ্ডভূক্তিদেশে ও যে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম ও বর্ণব্যবস্থা স্বীকৃত হইয়াছিল তাহা সিদ্ধান্ত করা যায় ইহাদের সাক্ষ্যে।
মধ্য ও পূর্ব বঙ্গেও এই যুগে অনুরূপ সংবাদ পাওয়া যাইতেছে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীত হইতেছেন লৌহিত্য তীরবাসী জনৈক কান্বগোত্রীয় ব্রাহ্মণ, ভট্টগোমীদত্ত স্বামী। যে-মণ্ডলে (বারকমণ্ডলে; ফরিদপুর জেলায়) দত্ত ভূমির অবস্থিতি তাহার শাসনকর্তাও ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ, তাঁহার নাম বৎসপাল স্বামী। এই বংশের আর এক রাজা ধর্মাদিত্যের একটি পট্টোলিদত্ত ভূমির দানগ্রহীতা হইতেছেন ব্রাহ্মণ চন্দ্রস্বামী, আর একটির জনৈক বসুদেব স্বামী। শেষোক্ত পট্টোলিতে গর্গস্বামী নামে আর এক ব্রাহ্মণের ভূমিরও খবর পাওয়া যাইতেছে। তখনও বারকমণ্ডলের শাসনকতা একজন ব্ৰাহ্মণ, নাম গোপালস্বামী। ধর্মাদিত্যের প্রথম পট্টোলিটিতে গ্রামবাসিদের মধ্যেও দুইজন ব্রাহ্মণের উল্লেখ আছে বলিয়া মনে হয় একজনের নাম বৃহচ্চট, আর একজনের কুলস্বামী। মহারাজ সমাচার দেবের ঘুগ্রাহাটি লিপির দত্তভূমির দানগ্রহীতা ও একজন ব্রাহ্মণ, নাম সুপ্রতীক স্বামী এবং দান-গ্রহণের উদ্দেশ্য বলিচরুসত্ৰ প্রবতন। যষ্ঠ শতকের ফরিদপুর ছাড়িয়া সপ্তম শতকের ত্রিপুরার লোকনাথ লিপির সাক্ষ্য ও একই প্রকার; এখানে ও দেখিতেছি জনৈক ব্রাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশর্মণ অনন্তনারায়ণ মন্দির প্রতিষ্ঠা এবং ২১১ জন চাতুবির্দ্য ব্রাহ্মণের বসতি করাইবার জন্য পশুসংকুল বনপ্রদেশে ভূমিদান গ্রহণ করিতেছেন। গ্রামকুটম্বি অর্থাং গৃহস্থদের মধ্যে শর্মা ও স্বামী পদবীযুক্ত অনেক নাম পাইতেছি, যথা মঘশর্মা, হরিশর্মা, রুষ্টশর্মা, অহিশর্মা, গুপ্তশর্মা, ক্রমশর্মা, শুক্রশর্মা, কৈবর্তশর্মা, হিমশর্মা, লক্ষ্মণশর্মা, নাথশর্মা, অলাতস্বামী, ব্রহ্মস্বামী, মহাসেনভট্টস্বামী, বামনস্বামী, ধনস্বামী, জীবস্বামী, ইত্যাদি।
শুধু যে ব্রাহ্মণেরাই ভূমিদান লাভ করিতেছেন তাহাই নয়; জৈন ও বৌদ্ধ আচার্যরা এবং তাঁহাদের প্রতিষ্ঠানগুলিও অনুরূপ ভূমিদান লাভ করিয়াছেন। পঞ্চম শতকে উত্তরবঙ্গে পাহাড়পুর অঞ্চলে প্রাপ্ত একটি লিপিতে দেখিতেছি (৪৭৮-৭৯ খ্ৰী) জনৈক ব্রাহ্মণ নাথশর্মা এবং তাহার স্ত্রী রামী এক জৈন আচার্য গুহনন্দির বিহারে দানের জন্য কিছু ভূমি ক্রয় করিতেছেন। ষষ্ঠ শতকে (গুনাইঘর লিপি, ৫০৭-৮ খ্রী) ত্রিপুরা জেলায় জনৈক মহাযানাচার্য শান্তিদেব প্রতিষ্ঠিত আর্য অবলোকিতেশ্বরের আশ্রম বিহারের মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘের জন্য মহারাজ রুদ্রদত্ত কিছু ভূমি দান করিতেছেন। এই লিপিটিতেও একজন ব্রাহ্মণ কুমারামাত্য বেরজ্জ স্বামীর সংবাদ পাইতেছি। সপ্তম-অষ্টম শতকে ঢাকা জেলার আস্রফপুর অঞ্চলে দেখিতেছি জনৈক বৌদ্ধ আচার্য বন্দ্য সংঘমিত্র তাঁহার বিহার ইত্যাদির জন্য স্বয়ং রাজার নিকট হইতে প্রচু্র ভূমিদান লাভ করিতেছেন।
ব্রাহ্মণদের পদবী ও গাঞি (?) পরিচয়
উপরোক্ত তথ্য বিশ্লেষণ হইতে দেখা যাইতেছে শর্মণ ও স্বামী পদবী ছাড়া ব্রাহ্মণদের বোধ হয় অন্য পদবী-পরিচয়ও ছিল। যেমন, বৃহচ্চট নামে চট্ট, ভট্ট গোমিদত্ত স্বামী, ভট্ট ব্রহ্মবীর স্বামী, ভট্ট উন্মীলন স্বামী, ভট্ট বামন স্বামী, মহাসেন ভট্ট স্বামী, এবং শ্রীনেত্ৰ ভট (ভট্ট) প্রভৃতি নামে ভট্ট, এবং বন্দ্য জ্ঞানমতি ও বন্দ্য সংঘমিত্র নামে বন্দ্য। বৃহচ্চট্টের চট্ট নামের অংশমাত্র বলিয়া মনে হইতেছে না। ব্রহ্মবীর, উন্মীলন, বামন এবং মহাসেন যে ব্রাহ্মণ তাহা তাহাদের স্বামী পদবীতেই পরিশগকার; কিন্তু তাহার পরেও যখন তাঁহাদের নামের পূর্বে অথবা মধ্যে ভট্ট ব্যবহৃত হইতেছে তখন ভট্ট যেন তাঁহাদের “গাঞি” পরিচয় বলিয়াই মনে হইতেছে। পরবর্তী কালের ভাট অর্থ এই ক্ষেত্রে গ্রহণেযাগ্য বলিয়া মনে হয় না। শ্রীনেত্র ভট স্পষ্টই শ্রীনেত্র ভট্ট এবং এক্ষেত্রে ভট্ট ব্যবহৃত হইয়াছে নামের পরে। বন্দ্য পূজনীয় অর্থে ব্যবহৃত হইয়া থাকিতে পারে, অন্ততঃ আচার্য বন্দ্য সংঘ মিত্রের ক্ষেত্রে; কিন্তু বন্দ্য জ্ঞানমতির ক্ষেত্রেও কি তাহাই? এক্ষেত্রেও বন্দ্য “গাঞি” পরিচয় হওয়া অসম্ভব নয়। চট্ট, ভট্ট এবং বন্দ্য, এই কটিই যে রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণদের অসংখ্য “গাঞি” পরিচয়ের মধ্যে তিনটি, এ-তথ্য পববর্তী স্মৃতি ও কুলজী গ্রন্থে জানা যায়। ষষ্ঠ-সপ্তম শতকেই এই “গাঞ্চি” পরিচয়ের রীতি প্রচলিত হইয়াছিল, ইহা অসম্ভব এবং অনৈতিহাসিক নাও হইতে পারে।
ব্রাহ্মণদের শর্মণ-শর্মা পদবী-পরিচয় বাংলাদেশে আজও সুপ্রচলিত। কিন্তু স্বামী পদবী-পরিচয় মধ্যযুগের সূচনা হইতেই অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছে। নিধনপুর লিপি্র সাক্ষ্য ও শ্ৰীহট্ট অঞ্চলের লোকস্মৃতি হইতে মনে হয়, ঐ লিপির দুই শতাধিক স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা বৈদিক (পরবর্তী কালে, সাম্প্রদায়িক) ব্রাহ্মণ বলিয়া পরিচিত ছিলেন। অনুমান হয়, ইঁহারা সকলেই বাংলাদেশের বাহির হইতে—পশ্চিম বা দক্ষিণ হইতে—আসিয়াছিলেন। ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তো এখনও ব্রাহ্মণোদের স্বামী পদবী সুপ্রচলিত। প্রাচীন কালেও তাহাই ছিল। উত্তর-ভারতেও যে তাহা ছিল তাহার প্রমাণ গুপ্তযুগের শিলামালায়ই পাওয়া য্যা। পরবর্তী কালের কুলজী-গ্রন্থে বৈদিক ব্রাহ্মণদের দুটি শাখার পরিচয় পাওয়া যায় : পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য। এই সব স্বামী পদবীযুক্ত ব্রাহ্মণেরা পাশ্চাত্য ও দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণ হওয়া অসম্ভব নয়। ধনাইদহ পট্টোলির দানগ্রহীতা বরাহস্বামী ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ, এবং তিনি আসিয়াছিলেন উড়িষ্যান্তর্গত কটক অঞ্চল হইতে। গোপচন্দ্রের একটি পট্টোলির দানগ্রহীতা ব্রাহ্মণটির নাম গোমিদত্ত স্বামী। তিনি কান্বগোত্রীয় এবং লৌহিত্য-তীরবাসী। লৌহিত্য-তীরবর্তী কামরূপের ব্রাহ্মণেরা তো আজও নিজেদের পাশ্চাত্য বৈদিক বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। অবশ্য, স্বামী পদবীর উপর নির্ভর করিয়া এসম্বন্ধে নিঃসংশয় সিদ্ধান্ত কিছু করা চলে না। বাহির হইতে ব্রাহ্মণেরা যে বাংলাদেশে আসিতেছেন তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ অযোধ্যবাসী কুলপুত্ৰক অমৃতদেব স্বয়ং।
এই সব ব্রাহ্মণদের ছাড়া পঞ্চম হইতে অষ্টম শতক পর্যন্ত লিপিগুলিতে রাজকর্মকারচী, গ্রামবাসী গৃহস্থ, প্রধান প্রধান লোক, নগরবাসী, শ্ৰেষ্ঠী, সার্থবাহ এবং অন্যান্য লোকের নাম-পরিচয়ও পাওয়া যাইতেছে। কয়েকটি নামের উল্লেখ করা যাইতে পারে; যথা, চিরাতদত্ত, বেত্রবর্মণ, ধৃতিপাল, বন্ধুমিত্র, ধৃতিমিত্র, শাম্বপাল, রিশিদত্ত (লক্ষণীয় এই যে, নামটির বানান ঋষিদত্ত উচিত ছিল; সংস্কৃত রীতিপদ্ধতি তখনও অভ্যস্ত হয় নাই বলিয়া মনে করা চলে), জয়নন্দি, বিভুদত্ত, গুহনন্দি, দিবাকরনন্দি, ধৃতিবিষ্ণু, বিবোচন, রামদাস, হরিদাস, শশিনন্দী, দেবকীর্তি, ক্ষেমদত্ত, গোষ্ঠক, বর্গপাল, পিঙ্গল, সুংকুক, বিষ্ণুভদ্র, খাসক, রামক, গোপাল, শ্ৰীভদ্র, সোমপাল, রাম, পত্রদাস, স্থায়ণপাল, কপিল, জয়দত্ত, শণ্ডক, রিভূপাল, কুলবৃদ্ধি, ভোয়িল, ভাস্কর, নবনন্দী, জয়নন্দী, ভটনন্দী, শিবনন্দী, দুর্গাদত্ত, হিমদত্ত, অর্কদাস, রুদ্রদত্ত, ভীম, ভামহ, বৎসভোজিক, নরদত্ত, বরদত্ত, বস্পিয়ক, আদিত্যবন্ধু, জোলারি, নগিজোদক, বুদুক, কলক, সূর্য, মহীপাল, খন্দবিদুর্গ, গবিক, মণিভদ্র, যজ্ঞপাত, নাদভদক, গণেশ্বর, জিতসেন, রিভূপাল, স্থাণুদত্ত, মতিদন্ত, বিপ্ৰপাল, স্কন্দপাল, জীবদত্ত, পবিক্রক, দামুক, বংসকুণ্ড, শুচিপালিত, বিহিতঘোষ, শূরদত্ত, প্রিয়দত্ত, জনার্দন, কুণ্ড, কবণিক, নবনাগ, কেশব, ইটিত, কুলচন্দ্র, গরুড়, আলূক, অনাচার, ভাশৈত্য, শুভদেব, ঘোষচন্দ্র, অনমিত্র, গুণচন্দ্র, কলসখ, দুর্লভ, সত্যচন্দ্র, প্রভূচন্দ্র, রুদ্রদাস, অর্জুন-বপ্প (সোজাসুজি অর্জুনের বাপের সংস্কৃত রূপ, এই ধরনের ডাক-নাম আজও বাংলার পাড়াগাঁয়ে প্রচলিত), কুণ্ডলিপ্ত, নাগদেব, নয়সেন, সোমঘোষ, জন্মভূতি, সূর্যসেন, লক্ষ্মীনাথ, শ্রীমিত্রাবলি, বর্ণটিয়োক, শর্বান্তর, শিখর, পুরদাস, শক্ৰক, উপাসক, স্বস্তিমোক, সুলদ্ধ, রাজদাস, দুর্গগট ইত্যাদি। এই নামগুলি বিশ্লেষণ করিলে কয়েকটি তথ্য লক্ষ্যগোচর হয়। প্রথমত, অধিকাংশ নামের রূপ সংস্কৃত; কতকগুলি নামের দেশজ রূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন বস্পিযক, খন্দবিদুৰ্গ গরিক, অর্জুন-বপ্প, বর্ণটিয়োক, দুর্গ্ গট ইত্যাদি; আর কতকগুলির নামরূপ দেশজই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, জোলারি, নগিজোদক, কলক, নাদভদক, দামুক, আলূক, কলসখ, ইটিত, সুং’কুক, খাসক ইত্যাদি। ‘অক্’ বা ‘ওক্’ প্রত্যয় জুড়িয়া দিয়া দেশজ বা ভাষা শব্দের নামকে সংস্কৃত ক-কারান্ত পদ রূপে দেখাইবার যে রীতি আমরা পরবর্তী কালে বাংলা দেশে প্রচলিত দেখিতে পাই (যেমন “সদুক্তিকর্ণামৃত” গ্রন্থে গৌড় বঙ্গের কবিদের নাম-পরিচয়ে, এবং অন্যত্র) তাহাও এই যুগেই প্রতিষ্ঠিত হইয়া গিয়াছে, যথা, খাসক, রামক, বম্পিযক, বর্ণটিযোক, নগিজোদক, নাদভদক, স্বস্তিয়োক ইত্যাদি। দ্বিতীযত, ব্যক্তিগত নামে জনসাধারণ সাধারণত কোন ও পদবী ব্যবহার করিত না, শুধু পূর্ব নামেই (forename) পরিচিত হইত (তেমন নামে সংখ্যাই অধিক), যেমন, পিঙ্গল, গোপাল, শ্রীভদ্র, রাম, কপিল, বিরোচন, দেবকীৰ্তি, গোষ্ঠক, শণ্ডক, ভোয়িল, ভাস্কর, ভামহ, বুদ্ধক, সূর্য, পরিক্রক, করণিক, কেশব, গরুড়, অনাচার, ভাশৈত্য, দুর্লভ, শবান্তর, শিখর, শক্রুক, উপাসক, সুলব্ধ, গরুড় ইত্যাদি। তৃতীয়ত, এই নামগুলির মধ্যে কতকগুলি অন্ত্যনামের (৪urname) পবিচয় পাওয়া যাইতেছে যেগুলি এখনও বাংলাদেশে নাম-পদবী হিসাবে ব্যবহৃত হয়, যেমন, দত্ত, পাল, মিত্র, নন্দি-নন্দী, বর্মণ, দাস, ভদ্র, সেন, দেব, ঘোষ, কুণ্ডু, পালিত, নাগ, চন্দ্র, এমন কি দাম (দা), ভূতি, বিষ্ণ, যশ, শিব, রুদ্র ইত্যাদি। অধিংকাংশ ক্ষেত্রেই যে এগুলি অন্ত্যনাম এসম্বন্ধে সন্দেহ করা চলে না, তবে কোন কোন ক্ষেত্রে নামেরই অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হইয়াছে, এই অনুমানও হয়তো করা চলে। চতুর্থত, এই সব অন্ত্যনাম আজকাল যেমন বর্ণজ্ঞাপক, পঞ্চম-অষ্টম শতকে তেমন ছিল না, তবে ব্রাহ্মণেতর বর্ণের লোকেরাই এই অন্ত্যনামগুলি ব্যবহার করিতেন; ব্রাহ্মণের শুধু শর্মণ বা স্বামী পদবী এবং ভট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি “গাঞি” পরিচয় গ্রহণ করিতেন, এইরূপ অনুমান বোধ হয় করা যায়। বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য তথাকথিত ‘ভদ্র’ জাতের মধ্যে (বৃহদ্বর্ম পুরাণোক্ত উত্তম সংকর ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণোক্ত সৎশূদ্র জাতের মধ্যে) চন্দ্র, গুপ্ত, নাগ, দাস, আদিত্য, নন্দী, মিত্র, শীল, ধর, কর, দত্ত, রক্ষিত, ভদ্র, দেব, পালিত প্রভৃতি নামাংশ বা পদবীর ব্যবহার এই সময় হইতে আরম্ভ হইয়া হিন্দু আমলের শেষেও যে চলিতেছিল তাহার প্রমাণ পাওয়া যায় “সদুক্তিকর্ণামৃত”-গ্রন্থের গৌড়বঙ্গীয় কবিদের নামের মধ্যে।(১) একথা সত্য বাংলার বাহিরে, বিশেষভাবে গুজরাত-কাথিয়াবাড় অঞ্চলে প্রাচীন কালে এক শ্রেণীর ব্রাহ্মণদের মধ্যে দত্ত, নাগ, মিত্র, ঘোষ, এবং বর্মণ ইত্যাদি অন্তনামের ব্যবহার দেখা যায়। কিন্তু বাংলায় এই লিপিগুলিতে এই সব অন্ত্যনাম যে-সব ক্ষেত্রে ব্যবহার হইতেছে, তাহাদের একজনকেও ব্রাহ্মণ বলিয়া মনে হইতেছে না, ব্রাহ্মণেরা যেন সর্বত্রই শর্মণ বা স্বামী এই অন্ত্যনামে পরিচিত হইতেছেন, অথবা ভট্ট, চট্ট, বন্দ্য প্রভৃতি উপ বা অন্ত্য নামে।
লিপিগুলিতে অনেক ব্যক্তিনামের উল্লেখ যেমন আছে, তেমনই আছে অনেক স্থান নামের উল্লেখ। এই নাম গুলি বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যায়, কতকগুলি নামের রূপ পুরাপুরি সংস্কৃত, যেমন, পুণ্ড্রবর্ধন, কোটীবস, পঞ্চনগরী, নব্যাবকাশিকা, সূবর্ণবীথি, ঔদম্বুরিক (বিষয়), চণ্ডগ্রাম, কর্মান্তবাসক, শিলাকুণ্ড, পলাশবৃন্দক, স্বচ্ছন্দ পাটক ইত্যাদি। কতকগুলি নামের দেশজরূপ হইতে সংস্কৃতীকরণ হইয়াছে, যেমন, বারিগ্রাম, পৃষ্ঠম-পোট্টক, গোষাটপুঞ্জক, খাড়(টা)পার, ত্রিবৃতা, ত্রিঘট্টিক, বোল্লবায়িকা ইত্যাদি। আবার, কতকগুলির নাম এখনও দেশজ রূপেই থাকিয়া গিয়াছে, যেমন, কুট্কুট্, নাগিরট্ট, ডোঙ্গা (গ্রাম), কণমোটিকা ইত্যাদি। মনে হয়, ব্যক্তি-নামের ক্ষেত্রে যেমন স্থাননামের ক্ষেত্রেও তেমনই, আর্যীকরণ দ্রুত অগ্রসর হইতেছে।
——————–
(১) সদুক্তিকর্ণামৃত, সংকলয়িতা, শ্রীধরদাস (১২০৬) Ed by Ramavatara Sarma and Haradatta Sarma. Lahore. 1936. শ্রীসুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, “সদুক্তিকর্ণামৃত” বিশ্বভারতী পত্রিকা, কার্তিক-পৌষ, ১৩৫০।
কায়স্থ-করণ
উপরোক্ত অন্ত্যনামগুলি যাঁহাদের ব্যক্তিনামের সঙ্গে ব্যবহৃত হইতেছে তাঁহারা কোন বর্ণ বা উপরর্ণের স্থির করিবার কোনও উপায় নাই, এ কথা আগেই বলিয়াছি। এই যুগের লিপিগুলিতে কায়স্থ নামে পরিচিত এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়, যেমন, প্রথম কায়স্থ শাম্বপাল, স্কন্দপাল, বিপ্রপাল, করণ-কায়স্থ নবদত্ত, কায়স্থ প্রভুচন্দ্র, রুদ্রদাস, দেবদত্ত, কৃষ্ণদাস, জ্যেষ্ঠকায়স্থ নয়সেন, ইত্যাদি। ইঁহারা যে রাজকর্মচারী এসম্বন্ধে সন্দেহ করিবার অবকাশ নাই। কায়স্থ বলিতে মূলত কোনও বর্ণ বা উপবর্ণ বুঝাইত না, কোষাকার বৈজয়ন্তী (একদশ শতক) কায়স্থ অর্থে বলিতেছেন লেখক, এবং কায়স্থ ও করণ সমর্থক ইহাও বলিতেছেন।(১) ক্ষীরস্বামী কৃত অমরকোমের টীকায়ও(২) করণ বলিতে কায়স্থদের মতই একশ্রেণীর রাজকর্মচারীকে বুঝান হইয়াছে। গাহডবালরাজ গোবিন্দচন্দ্রের দুইটি পট্টোলিক লেখক জলহণ একটিতে নিজের পরিচয় দিতেছেন কায়স্থ বলিয়া, আর একটিতে তিনি “করণিকোদ্গতো”।(৩) চান্দেল্লরাজ ভোজবর্মণের অজয়গড় লিপিতেও করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিয়া ধরা হইয়াছে।(৪) কায়স্থরা যে রাজকর্মচারী তাহা প্রাচীন বিষ্ণু ও যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিদ্বারাও সমর্থিত।(৫) বিষ্ণুস্মৃতিমতে তাহারা রাজকীয় দলিল-পত্রাদির লেখক ছিলেন; যাজ্ঞবল্ক্যস্মৃতির টীকাকার বলেন কায়স্থরা ছিলেন লেখক ও হিসাবরক্ষক। এখনও তো বিহার অঞ্চলে হিসাব রাখার লিখনপদ্ধতির যে বিশিষ্ট ধরণ তাহাকে বলা হয় “কাইথী” লিপি। করণ শব্দও লেখক ও হিসাবরক্ষক অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে; সমস্ত পববর্তী সাক্ষ্যের ইঙ্গিতই এইরূপ, দু’এক ক্ষেত্রে মাত্র করণ ও কায়স্থ দুইটি শব্দ পৃথক পৃথক ভাবে ব্যবহৃত হইয়াছে, যেমন ৮৭০ খ্রীস্টাব্দের গুরম্হ তাম্র পট্টোলিতে।(৬) বৃহদ্ধর্মপুরাণে কিন্তু করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলা হইয়াছে।(৭) উত্তর বিহারে করণ সম্প্রদায় এখনও কায়স্থদেরই একটি শাখা বলিয়া পরিগণিত, উত্তর রাঢ়ীয় কায়স্থরা আজও নিজেদের করণ বলিয়া পরিচয় দিয়া থাকেন। মেদিনীপুর, উড়িষ্যা ও মধ্যপ্রদেশের করণরা চিত্রগুপ্তকেই তাহাদের আদিপুরুষ বলিয়া মনে করেন, বাঙালী কায়স্থরাও তো তাহাই করেন। প্রাচীন কালে যাহাই হউক, পরবর্তী কালে অর্থাং খ্রীস্টীয় নবম-দশম শতক নাগাদ বাংলাদেশে করণ ও কায়স্থ সমার্থক বলিনাই বিবেচিত হইত; ভারতের অন্যত্র ও হইত। বাংলাদেশে করণেরা ক্রমে কায়স্থ নামের মধ্যেই বিলীন হইয়া গিয়াছিল। যাহাই হউক, আমরা যে-যুগের আলোচনা করিতেছি সেই যুগে বাংলার লিপিগুলিতে কায়স্থ শব্দের ব্যবহার যেমন পাইতেছি, তেমনই পাইতেছি করণ শব্দের ও প্রাচীন গ্রীক ও পারসিক দলিলপত্রে কাইথিঅয়, ক্ষযতিয় নামে এক শ্রেণীর রাজকর্মচারীর সংবাদ পাওয়া যায়; তাহারা ও লেখক ও হিসাবরক্ষক। এই কাইথিঅয় –ক্ষয়তিয়-র সঙ্গে আমাদের কায়স্থ শব্দের একটা যোগাযোগ থাকা কিছু অসম্ভব নয়। এ তথ্য নিঃসংশয় বলিয়া মনে করা যাইতে পাবে যে এই যুগের লিপিগুলিতে কায়স্থ কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণজ্ঞাপক শব্দ নয় —জীবনবৃত্তিবাচক শব্দ, অর্থাং কায়স্থর এই যুগে এখনও বর্ণ বা উপবর্ণ বলিয়া গড়িয়া উঠে নাই। এই যুগের অন্তত দুইটি লিপিতে করণদের উল্লেখ পাইতেছি। গুণাইঘর পট্টোলির লেখক সন্ধিবিগ্ৰহাপিক মানদত্ত ছিলেন করণ-কায়স্থ, এবং ত্রিপুরার লোকনাথ পট্টোলির মহারাজ লোকনাথও নিজের পরিচয় দিতেছেন করণ বলিয়া। কারণ-কায়স্থ বলিয়া নবদত্তের আত্মপরিচয় লক্ষ্যণীয়, করণ এবং কায়স্থ একেবাবে সমার্থক একথা স্পষ্ট না হইলে ও উভয়েব মধ্যে যে একটা ঘনিষ্ঠ যোগ বিদ্যমান তাহা এই ধরণের উল্লেখের মধ্যে যেন সুস্পষ্ট। লোকনাথের করণ-পরিচয় ও অন্য দিক দিয়া উল্লেখযোগ্য। তাঁহার মাতামহ কেশবকে বলা হইয়াছে, ‘পারশর’; পিতামহ ‘দ্বিজবর’, প্রপিতামহ ‘দ্বিজসত্তমা’, এবং বুদ্ধপ্রপিতামহ মুনি ভরদ্বাজের বংশধর। ‘পরাশর কেশব’ কথার অর্থ তো এই যে কেশবের ব্রাহ্মণ পিতা একজন শূদ্রাণীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। অথচ, কেশব ছিলেন রাজার সৈন্যাধ্যক্ষ, এবং সমসাময়িক রাষ্ট্রে ও সমাজে তিনি যথেষ্ট মান্যও ছিলেন। ব্রাহ্মণ বর ও শূদ্র কন্যার বিবাহ বোধ হয় তথন ও সমাজে নিন্দনীয় ছিল না, পরবর্তী কালেও নিন্দনীয় না হউক অপ্রচলিত যে ছিল না তাহা তো স্মৃতিকার ভবদেব ভট্ট এবং জীমূতবাহনের রচনা হইতেই জানা যায়। লোকনাথের নিজের করণ-পরিচয়েব কারণ বলা বড় কঠিন। বুঝা যাইতেছে, লোকনাথের পিতা একজন পারশর-দুহিতাকে বিবাহ করিয়াছিলেন; এই জন্যই কি লোকনাথ বর্ণসমাজে নীচে নামিয়া গিয়াছিলেন, অথবা, তাঁহার পিতাও ছিলেন করণ? এক্ষেত্রে করণ বর্ণ না বৃত্তিবাচক শব্দ তাহাও কিছুই নিশ্চয় করিয়া বলা যাইতেছে না। যাহা হউক, এইটকু বুঝা গেল, করণ বা কায়স্থ এখন ও নিঃসন্দেহে বর্ণ বা উপবর্ণ হিসাবে বিবেচিত হইতেছে না, এই দুই শব্দেরই ব্যবহার মোটামুটি বৃত্তিবাচক, তবে বৃত্তি ক্রমশ বর্ণে বিধিবদ্ধ হইবার দিকে ঝুঁকিতেছে।
————————
(১) “কায়স্থঃস্যার্ল্লিপিকয়ঃ করণোক্ষর জীবনঃ লেখকোক্ষর চূঞ্চুশ্চ”।
(২) অমরকোষ।
(৩) Ep. Ind IV, p. 14o, VIII, p. I53
(৪) Ep. Ind. I, p. 330
(৫) Kane, History of Dharmasasta.
(৬) Bhandan kar, List of Inscriptions….no. 34.
(৭) পরে দ্রষ্টব্য।
ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য
উপরে আলোচিত ও বিশ্লেষিত নামগুলির মধ্যে আর কোন কোন বর্ণ বা উপবর্ণ আত্মগোপন করিয়া আছে তাহা বলিবার উপায় নাই; অন্তত বিশেষ ভাবে কোন ও বর্ণ বা উপবর্ণ উল্লিখিত হইতেছে না। বর্মণ অন্ত্যনাম কোন ও কোন ও ক্ষেত্রে পাওয়া যাইতেছে, যেমন বেত্রবর্মণ সিংহবৰ্মণ, চন্দ্রবর্মণ ইত্যাদি। এই যুগে বর্মণান্ত নাম উত্তর-ভারতের অন্যত্র ক্ষত্রিয়ত্ব জ্ঞাপক; কিন্তু বেত্রবর্মণ, চন্দ্রবর্মণ ক্ষত্রিয় কিনা বলা কঠিন, অন্তত তেমন দাবি কেহ করিতেছেন না। রাজ-রাজন্যরা ত সাধারণত ক্ষত্রিয়ত্বের দাবি করিয়া থাকেন, কিন্তু সমসাময়িক বাংলার রাজরাজন্যদের পক্ষ হইতে ও তেমন দাবি কেহই জানায় নাই। পরবর্তী পাল রাজাদের ক্ষত্রিয়ত্বের দাবিও নিঃসংশয় নয়, কেবল বিদেশাগত কোনও কোন ও বাজবংশ এই দাবি করিয়াছেন। বস্তুত বাংলার স্মৃতি-পুরাণে ঐতিহ্যে ক্ষত্রিয় বর্ণের সবিশেষ দাবি কাহারও যেন নাই! নগরশ্রেষ্ঠ, সার্থবাহ, ব্যাপারী-ব্যবসায়ীর উল্লেখ এযুগে প্রচুর; কিন্তু তাহাদের পক্ষ হইতেও বৈশ্যত্বের দাবি কেহ করিতেছেন—সমসাময়িক কালে তো নয়ই, পরবর্তী কালেও নয়। বাংলার স্মৃতি-পুরাণ-ঐতিহ্যে বিশিষ্ট পৃথক বর্ণ হিসাবে বৈশ্যবর্ণের স্বীকৃতি নাই। বল্লালচরিতে বণিক-সুবর্ণবণিকদের বৈশ্যত্বের দাবি করা হইয়াছে; কিন্তু এ সাক্ষ্য কতটুকু বিশ্বাসযোগ্য বলা কঠিন। অন্যত্র কোথাও কাহারও সে দাবি নাই, স্মৃতি গ্রন্থাদিতে নাই, বৃহদ্বর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে পর্যন্ত নাই। বস্তুত বাংলাদেশে কোনও কালেই ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য সুনির্দিষ্ট বর্ণহিসাবে গঠিত ও স্বীকৃত হইয়াছিল বলিয়াই মনে হয় না; অন্তত তাহার সপক্ষে বিশ্বাসযোগ্য ঐতিহাসিক কোনও প্রমাণ নাই। ইহার কারণ কি বলা কঠিন। বহুদিন আগে রামপ্রসাদ চন্দ মহাশয় বলিয়ছিলেন, (১) বাংলার আর্যীকরণ ঋগ্বেদীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী হয় নাই, সেই জন্য ব্রাহ্মণ-ক্ষত্ৰিয় বৈশ্য-শূদ্র লইয়া যে চাতুবৰ্ণ-সমাজ, বাংলাদেশে তাহার প্রচলন নাই। বাংলার বর্ণসমাজ অ্যাল্পীয় আর্য সমাজব্যবস্থানুযায়ী গঠিত, এবং অ্যালপীয় আর্য ভাষীরা ঋগ্বেদীয় আর্যভাষী হইতে পৃথক। চন্দ মহাশয়ের এই মত যদি সত্য হয় তাহা হইলে ইহার মধ্যে বাংলার ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য বর্ণের প্রায়ানুপস্থিতির কারণ নিহিত থাকা অসম্ভব নয়। বাংলার বর্ণবিন্যাস ব্রাহ্মণ এবং শূদ্রবর্ণ ও অন্তজ-ম্লেচ্ছদের লইয়া গঠিত; করণ-কায়স্থ, অম্বষ্ঠ-বৈদ্য এবং অন্যান্য সংকর বর্ণ সমস্তই শূদ্র-পর্যায়ে; সর্বনিম্নে অন্ত্যজ বর্ণের লোকেরা। দ্বাদশ ত্রয়োদশ শতকের এই বর্ণবিন্যাস পঞ্চম-অষ্টম শতকে খুব সুস্পষ্টভাবে দেখা না দিলেও তাহার মোটামুটি কাঠামো এই যুগেই গড়িয়া উঠিয়াছিল, এই অনুমান করা চলে। কারণ, এই যুগের লিপিগুলিতে তিনটি দ্বিজবর্ণের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণদেরই সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ধরা পড়িতেছে; আর যাঁহারা, তাঁহারা এবং অন্যান্যে বিচিত্র জীবন-বৃত্তি অবলম্বন করিয়া শূদ্রান্তর্গত বিভিন্ন উপবর্ণ গড়িয়া উঠিতেছে মাত্র; ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যবর্ণের কোন ইঙ্গিত-আভাস কিছুই নাই।
—————–
(১) Chanda, Indo-Aryan Races