প্রাচীন বাঙালীর গ্রামকেন্দ্ৰিক জীবন ও গ্রামীণ সংস্কৃতি
বাঙলায় ইতিহাসের আদিপর্বে— এবং শুধু আদিপর্বেই নয়, সমস্ত মধ্যযুগ ব্যাপিয়া এবং বহুলাংশে এখনও– বাঙালী জীবন প্রধানত গ্রামকেন্দ্রিক, এবং বাঙালীর সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রামীণ! গ্রামকে কেন্দ্ৰ করিয়াই সাধারণ বাঙালীর দৈনন্দিন জীবন এবং তাহার সমস্ত ভাবনা-কল্পনা আবর্তিত হইত। কিছুদিন আগে পর্যন্তও ইহাই ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে বড় কথা। ইহার কারণ বুঝিতে পারা কঠিন নয়।
প্রথম কারণ আমাদের কোমবদ্ধ আদিম জীবনধারা, যে জীবনে প্রধান জীবনোপায় শিকার ও কৃষি এবং খুব ছোট ছোট গৃহশিল্প, এবং যাহার সমাজ-গঠনের প্রধান আশ্রয় গোষ্ঠী ও পরিবার। স্বভাবতই এই ধরনের জীবন শস্য ফলাইবার মাঠ, নদনদী, খালবিলের জলাশয় এবং অরণ্যকে আশ্রয় করিয়াই গড়িয়া ওঠে, এবং এইভাবে গ্রামের পত্তন হয়। কৌমজীবনে পরিবার ও গোষ্ঠীবন্ধন স্বভাবতই প্রবল; এবং যেহেতু আমাদের মধ্যে কৌমচেতনা আজও সক্রিয়ভাবে বহমান, সেই হেতু বৃহত্তর জনসমাজ গঠিত হওয়ার পরও আমাদের গ্রামকেন্দ্রিক ভাবনা-কল্পনা এবং সমাজবন্ধন কখনও ঘুচে নাই। কারণ, কৌমচেতনার আশ্ৰয়ই হইতেছে গ্রাম; এক একটি গ্রামকে আশ্রয় করিয়াই তো একটি প্রাচীন গাঞাঁ, গোষ্ঠী, এবং গাঞী ও গোষ্ঠীবদ্ধ বিভিন্ন পরিবার।
কিন্তু এই গ্রামকেন্দ্রিকতার প্রধান কারণ আমাদের সামাজিক ধনোৎপাদন পদ্ধতি। নানা অধ্যায়ে বলিয়াছি, আমাদের প্রধান জীবনোপায়ই ছিল কৃষি এবং ছোট ছোট গৃহশিল্প। কৃষি একান্তই ভূমি নির্ভর। ছোট ছোট গৃহশিল্পে যাঁহারা নিযুক্ত থাকিতেন তাহারাও প্রধানত না হউন অংশত কৃষকই, এবং তাহারাও সেইজন্যই একান্ত ভূমিসংলগ্ন জীবনেই অভ্যস্ত ছিলেন।
কৃষিভূমি তো সমস্তই গ্রামে; বস্তুত কৃষিভূমিকে আশ্রয় করিয়াই তো গ্রামগুলি গড়িয়া উঠিত। এই ভূমিই আবার গোষ্ঠী ও পরিবার-বন্ধনের আশ্রয়, অথবা একেবারে উলটাইয়া বলা চলে, এক এক ভূম্যাংশ আশ্রয় করিয়াই এক একটি গোষ্ঠী ও পরিবার; এবং যেহেতু সেই ভূমি অনড়, আচল এবং সেই ভূমিই সকলের জীবিকাশ্ৰয়, সেই হেতু গোষ্ঠী এবং পরিবারও স্থির এবং গোষ্ঠী পরিবারবন্ধনও দৃঢ়। তীৰ্থ পর্যটন, শিক্ষাদীক্ষা আহরণ, ধর্মপ্রচার এবং ব্যাবসা-বাণিজ্য ছাড়া গ্রাম ছাড়িয়া বাহিরে যাইবার কোনও প্রয়োজন কাহারও হইত না; জীবিকা সংগ্ৰহ হইত গ্রামেই, এবং গ্রামগুলি সাধারণত ছিল স্বনির্ভর, স্বয়ংসম্পূর্ণ। এই ধরনের উৎপাদন ও বণ্টন পদ্ধতিতে জীবন গ্রামকেন্দ্ৰিক হইবে ইহা কিছু বিচিত্র নয়, এবং যেহেতু জীবন গ্রামকেন্দ্ৰিক সেই হেতু আমাদের সংস্কৃতিও গ্রামীণ।
একাধিক অধ্যায়ে আমি দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, খ্রীষ্টোত্তর প্রথম-দ্বিতীয় শতক হইতে আরম্ভ করিয়া অন্তত ষষ্ঠ-সপ্তম শতক পর্যন্ত, বিশেষভাবে চতুর্থ হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত এই সুদীর্ঘ কয়েক শতাব্দী বাঙলাদেশ উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের অন্যান্য প্রান্তের সুবিস্তৃত অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের অন্যতম প্রধান অংশীদার হইয়াছিল এবং তাহার ফলে তাহার ঐকাস্তিক কৃষি ও ভূমি নির্ভরতায় কিছুটা বোধহয় ভাটা পড়িয়াছিল। বৃহত্তর ব্যাবসা-বাণিজ্যের প্রয়োজনে গ্রাম ছাড়িয়া অন্তত কিছু কিছু লোককে কমবেশি সময়ের জন্য বিদেশে যাপন করিতে হইত; তাহার ফলে তাহাদের গ্রামকেন্দ্ৰিক গোষ্ঠী ও পরিবারবন্ধনও কিছুটা শিথিল হইয়া পড়িত, সন্দেহ নাই। যুদ্ধবিগ্রহ এবং হয়তো রাজকীয় কাজকর্মের প্রয়োজনেও কিছু কিছু লোককে স্বল্পকালের জন্য। হইলেও দেশের বাহিরে যাপন করিতে হইত। তাহার ফলেও কর্ম ভাবনা-কল্পনার পরিধি কিছুটা বিস্তৃত হইয়াছিল, এবং ধীর-মস্থর গ্রাম্য জীবনস্রোতে বাহির হইতে কিছু তরঙ্গাভিঘাত লাগিয়াছিল। ব্যাবসা-বাণিজ্যের জন্য গ্রাম্য গৃহশিল্পও নিশ্চয়ই কিছু কিছু বিস্তৃত হইয়া থাকিবে, এবং বৃহত্তর যৌথশিল্পগুলি নগরগুলিতে স্থানান্তরিত হইয়াছিল। প্রধানত এই সব প্রয়োজনেই, এবং কিছুটা রাষ্ট্রীয় ও সামরিক প্রয়োজনে প্রাচীন বাঙলায় কিছু কিছু নগরের পত্তন হইয়াছিল। কিন্তু সাধারণভাবে, বাঙালীর কৃষিনির্ভরতা কখনও একেবারে ঘুচে নাই; বণিক-ব্যবসায়ীবাও দেশ বিদেশ ঘুরিয়া গ্রামেই ফিরিয়া আসিতেন এবং অর্জিত ও সংগৃহীত ধন গ্রামেই ব্যয়িত ও বণ্টিত হইত, পরিবার ও গোষ্ঠীকে আশ্রয় করিয়া। নগরের যৌথশিল্পগুলিরও যোগান ফাইত গ্রাম হইতেই এবং সে অর্থের অন্তত একটি বৃহৎ অংশ গ্রামেই ফিরিয়া আসিত। এইসব কারণে বাঙলায় যে সব নগর গড়িয়া উঠিয়াছিল সেগুলিকেও আকৃতি-প্রকৃতিতে বৃহত্তর ও সমৃদ্ধতির গ্রাম ছাড়া আর কিছু বলা চলে। কিনা সন্দেহ। কিন্তু অষ্টম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া বাঙলায় এবং উত্তর-ভারতের প্রায় সর্বত্রই বৃহত্তর ব্যাবসা-বাণিজ্যস্রোতে ভাটা পড়িয়া যায়, এবং বাঙালী জীবন! আবার একান্তভাবে কৃষিনির্ভর হইয়া পড়িতে বাধ্য হয়। তাহার ফলে জীবনে ঐকান্তিক গ্রামকেন্দ্রিকতাও বাড়িয়া যায়, এবং আদিপর্বের শেষের দিকে ও মধ্যযুগে তাহা ক্রমবর্ধমান। বৃহত্তর, সংগ্ৰামমুখর, উল্লাস-উতরোল জীবনের স্পর্শও সেইজন্যই বাঙালীর গ্রামীণ সংস্কৃতির স্রোতে কোনও বৃহৎ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে নাই, তাহার তটরেখাকে প্রসারিত বা প্রবাহকে গভীর গভীর করিতে পারে নাই। বৃহতের, গভীরতার এবং ভাব ও মননসমৃদ্ধির যেটুকু পরিচয় প্রাচীন বাঙালীর সংস্কৃতিতে দৃষ্টিগোচর তাহা সর্বভারতীয় সংস্কৃতি এবং বৃহত্তর শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যগত জীবনোপায়ের দান।