০৩. আঃ খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০-৩০০

আঃ খ্রীস্টপূর্ব ৩৫০-৩০০

প্রাচীন গ্ৰীক ও লাতিন লেখকদের কৃপায় খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকের তৃতীয় পাদে বাঙলার রাজবৃত্ত-কথা অনেকটা স্পষ্ট। এই গ্ৰীক ও লাতিন লেখকেরা আলেকজান্দারের ভারত-অভিযান সম্পর্কে এক সুবিস্তৃত সাহিত্য রচনা করিয়া গিয়াছেন; সে-সাহিত্য বর্তমান ঐতিহাসিকদের নিকট সুবিদিত, সুআলোচিত। কাজেই তাহার বিস্তৃত উল্লেখের প্রয়োজন নাই। এই প্রসঙ্গেই প্রথম শোনা যাইতেছে যে, বিপাশা নদীর পূর্বতীরে দুইটি পরাক্রান্ত রাষ্ট্র বিস্তৃত ছিল, একটি Prasioi বা প্রাচ্য এবং আর একটি Gangarida (পাঠান্তরে Gandaridal) বা গঙ্গারাষ্ট্র (?)। প্রাচ্য রাষ্ট্রের রাজধানী ছিল Paliborthra বা পাটলীপুত্র, এবং গঙ্গারাষ্ট্রের Gange বা গঙ্গা (-নগর)। পেরিপ্লাস-গ্রন্থ ও টলেমীর বিবরণ হইতে জানা যায়, গঙ্গ-নগর সামুদ্রিক বাণিজ্যের বৃহৎ বন্দর ছিল; টলেমি আরও বলিতেছেন, এই গঙ্গা বন্দরের অবস্থিতি ছিল গাঙ্গেয় Kamberikhon-নদীর মোহনায়। Kamberikhon এবং কুমার নদী যে অভিন্ন তাহা আগেই এক অধ্যায়ের নদনদী-প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে! Gangarida-রা যে গাঙ্গেয় প্রদেশের লোক এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই, কারণ গ্ৰীক ও লাতিন লেখকরা এ সম্বন্ধে এক মত। দিয়োদোরািস-কাটিয়াস-প্লতার্ক-সলিন্যাস -প্লিনি-টলেমি-স্ট্র্যাবো প্রভৃতি লেখকদের প্রাসঙ্গিক মতামতের তুলনামূলক বিস্তৃত আলোচনা করিয়া হেমচন্দ্র রায়চৌধুরী মহাশয় দেখাইয়াছেন যে, Gangaridai বা গঙ্গারাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্বতীরে অবস্থিত ও বিস্তৃত ছিল এবং প্রাচ্যরাষ্ট্র গঙ্গা-ভাগীরথী হইতে আরম্ভ করিয়া পশ্চিমদিকে সমস্ত গাঙ্গেয় উপত্যকায় বিস্তৃত ছিল। তাম্রলিপ্তি যে প্রাচ্য রাষ্ট্রের অন্তর্গত ছিল, ইহাও তাঁহারই অনুমান। রায়চৌধুরী মহাশয়ের এই অনুমান যুক্তিসম্মত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত বলিয়া মনে করা যাইতে পারে। যাহা হউক, এই দুই রাষ্ট্রে পারস্পরিক সম্বন্ধ প্রসঙ্গে পূর্বোক্ত বিদেশী লেখকরা কী বলিতেছেন তাহা সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাইতে পারে। কাটিয়াসের বিবরণী পড়িলে মনে হয়, প্রাচ্য ও গঙ্গারাষ্ট্র দুই স্বতন্ত্র রাজ্য, কিন্তু খ্ৰীষ্টর জন্মের চতুর্থ শতকের তৃতীয় পাদে একই রাজার অধীন এবং একই রাষ্ট্রে সংবদ্ধ। দিয়োদোরসও বলিতেছেন, প্রাচ্য ও গঙ্গা একই রাষ্ট্র, একই রাজার অধীন। প্লুতার্ক এক জায়গায় বলিতেছেন, “the kings of the Gangaridai and the Prasioi”; অথচ আর এক জায়গার ইঙ্গিত যেন একটি রাজা এবং একটি রাষ্ট্রের দিকে। যাহাই হউক, এই সব উক্তি হইতে যেlঅনুমান সহজেই বুদ্ধিতে স্বীকৃতি লাভ করে তাহা এই যে, প্রাচ্য ও গঙ্গা দুইটি স্বতন্ত্র জনপদ-রাষ্ট্র হিসাবেই বিদ্যমান ছিল; দুই স্বতন্ত্র নামই তাহার প্রমাণ। কিন্তু চতুর্থ শতকের তৃতীয় পাদে কিংবা তাহার আগে কোনও সময় দুই জনপদ-রাষ্ট্র এক রাজার অধীনস্থ হয় এবং একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠিত হয়, যদিও তাহার পরে খুব সম্ভব দুই জনপদের সৈন্যসামন্ত প্রভৃতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ছিল। একদিকে কাটিয়াস-দিয়োদোরস এবং অন্যদিকে প্লুতার্কের সাক্ষ্য তুলনা করিয়া দেখিলে এ-অনুমান একেবারে অসঙ্গত বলিয়া মনে হয় না।

নন্দ বংশাধিকার

এই যুক্তরাষ্ট্রের রাজা ছিলেন Agrammes বা Xandrammes =ঔগ্রসৈনা=উগ্রসেনের পুত্র। পুরাণে যাহাকে বলা হইয়াছে মহাপদ্মনন্দ তাহাকেই বোধ হয় মহাবোধিবংশ-গ্রন্থে উগ্ৰসেন বলা হইয়াছে। Agrammes নীচকুলোদ্ভব” নাপিতের পুত্র ছিলেন, এ-সাক্ষ্য পূর্বোক্ত লেখকেরাই দিতেছেন; হেমচন্দ্রের পরিশিষ্টপর্ব নামক জৈন গ্রন্থেও মহাপদ্মানন্দকে বলা হইয়াছে নাপিত-কুমার। পুরাণে কিন্তু মহাপদ্মনন্দকে, শূদ্রোগর্ভোদ্ভব বলা হইয়াছে। মহাপদ্মকে আরও বলা হইয়াছে, “সর্বক্ষত্রাস্তুক নৃপঃ” এবং “একরাট্‌”। যিনি কাশী, মিথিলা, বীতিহোত্ৰ, ইক্ষবাকু, কুরু, পঞ্চাল, হৈহয় ও কলিঙ্গদের পরাভূত করিয়াছিলেন তাহার পক্ষে গঙ্গারাষ্ট্র স্বীয় প্রাচ্য রাজ্যের অন্তর্গত করা কিছু অসম্ভব নয়। যাহাই হউক, আজ এ-তথ্য সুবিদিত যে, ঔগ্রসৈন্যের সমবেত প্রাচ্য-গঙ্গারাষ্ট্রের সুবৃহৎ সৈন্য এবং তঁহার প্রভূত ধনরত্ন পরিপূর্ণ রাজকোষের সংবাদ আলেকজান্দারের শিবিরে পৌছিয়ছিল এবং তিনি যে বিপাশা পার হইয়া পূর্বদিকে আর অগ্রসর না হইয়া ব্যাবিলনে ফিরিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত করিলেন, তাহার মূলে অন্যান্য কারণের সঙ্গে এই সংবাদগত কারণটিও অগ্রাহ্য করিবার মতন নয়।

মৌর্যাধিকার

মৌর্য-সম্রাট চন্দ্ৰগুপ্ত নন্দবংশ ধ্বংস করিয়া সুবিস্তৃত নন্দ-সাম্রাজ্য, নন্দ-সৈন্যসামন্ত এবং প্রভূত ধনরত্নপূর্ণ নন্দ-রাজকোষের উত্তরাধিকারী হইয়াছিলেন। মহাপদ্মনন্দ ও তাহার পুত্রদের গঙ্গারাষ্ট্রও মৌর্য সাম্রাজ্যের করতলগত হইয়াছিল, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ কম। প্রাচীন জৈন এবং বৌদ্ধগ্রন্থ, মহাস্থানে প্রাপ্ত শিলাখণ্ডলিপি এবং যুয়ান-চোয়াঙের সাক্ষ্য প্রামাণিক বলিয়া মানিলে স্বীকার করিতে হয়, পুণ্ড্রবর্ধন বা উত্তরবঙ্গ নিঃসন্দেহে মৌর্য-সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। য়ুয়ান-চোয়াঙ তো পুণ্ড্রবর্ধন ছাড়া প্রাচীন বাঙলার অন্যান্য জনপদেও (যথা কর্ণসুবর্ণ, তাম্রলিপ্তি, সমতট) মৌর্য-সম্রাট অশোক-নির্মিত বৌদ্ধস্তুপ ও বিহার দেখিয়াছিলেন বা তাহাদের বিবরণ শুনিয়াছিলেন বলিয়া বলিতেছেন। যদি তাহাই হয় তবে প্রাচীন বাঙলায় মৌর্য-রাষ্ট্রব্যবস্থাও প্রচলিত ছিল বলিয়া স্বীকার করিতে হয়। মহাস্থানের ব্রাহ্মী-লিপিতে দেখিতেছি, রাজধানী পুন্দনগলে (পুঞ্জনগরে) একজন মহামাত্র নিযুক্ত ছিলেন এবং স্থানীয় রাজকোষ ও রাষ্ট্রশস্যভাণ্ডার গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রায় এবং ধান্যশস্যে পরিপূর্ণ ছিল। দুর্ভিক্ষের সময় প্রজাদের বীজ এবং খাদ্যদানের নির্দেশ কৌটিল্য দিতেছেন; তাহার পরিবর্তে প্রজাদের দুর্গ অথবা সেতু নিৰ্মাণ কার্যে নিযুক্ত করা হইত, অথবা রাজা ইচ্ছা করিলে কোনও শ্রম গ্ৰহণ না করিয়াও দান করিতে পারিতেন (দুর্ভিক্ষে রাজা বীজ-ভক্তোপগ্ৰহম কৃত্বানুগ্রহম কুৰ্য্যাৎ। দুর্গসেতুকর্ম বা ভক্তগনুগ্ৰহেণ ভকতসংবিভাগং বা ৷ অৰ্থশাস্ত্ৰ, ৪।৩৭৮)। মহাস্থান-লিপিতেও দেখিতেছি, কোনও এক অত্যায়িত কালে রাজা পুন্দনগলের মাহামাত্রকে নির্দেশ দিতেছেন, প্রজাদের ধান্য এবং গণ্ডক ও কাকনিক মুদ্রা দিয়া সাহায্য করিবার জন্য, কিন্তু সুদিন ফিরিয়া আসিলে ধান্য ও মুদ্রা উভয়ই রাজভাণ্ডারে প্রত্যাৰ্পণ করিতে হইবে, তাহাও বলিয়া দিতেছেন। বিনা শ্রমবিনিময়ে দান বা দুর্গ অথবা সেতু নির্মাণে শ্রম কোনও কিছুরই উল্লেখ এক্ষেত্রে করা হইতেছে না। লিপি-কথিত অত্যায়িক যে কী জাতীয় তাহাও বলা হয় নাই।

শুঙ্গ রাজাদের আমলেও বোধ হয় বাঙলাদেশ পাটলিপুত্ৰ-রাজ্যের অন্তর্গত ছিল, কিন্তু এ-সম্বন্ধে কোনও নিঃসন্দিগ্ধ প্রমাণ নাই। তবে শুঙ্গ শিল্পশৈলী এবং সংস্কৃতি বাঙলাদেশে প্রচলিত হইয়াছিল, এমন প্রমাণ কিছু কিছু পাওয়া গিয়াছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় শতকে গঙ্গাবন্দর

বাঙলাদেশে কিছু কিছু নানা চিহ্নাঙ্কিত (punch-marked) মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে; এই সব মুদ্রা মৌর্য ও শুঙ্গ আমলের হইলেও হইতে পারে; নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই। তবে, খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকে পেরিপ্লাস-গ্রন্থে নিম্নগাঙ্গেয় ভূমিতে “ক্যালটিস” নামক এক প্রকার সুবর্ণমুদ্রা প্রচলনের খবর পাওয়া যাইতেছে। প্রথম ও দ্বিতীয় শতকের বাঙলাদেশ সম্বন্ধে পেরিপ্লাস-গ্রন্থ ও টলেমির বিবরণে আরও কিছু খবর পাওয়া যাইতেছে। যে-গঙ্গারাষ্ট্রের কথা গ্ৰীক ও লাতিন লেখকদের রচনায় পাওয়া গিয়াছে, সেই গঙ্গারাষ্ট্র একই রূপে ও শাসন-প্রকৃতিতে এই যুগেই ছিল কিনা বলা যায় না; তবে, গঙ্গারাষ্ট্রের রাজধানী গঙ্গাবিন্দর নগর তখনও বিদ্যমান। এই গঙ্গাবিন্দরে অতি সূক্ষ্ম কার্পােস বস্ত্ৰ উৎপন্ন হইত এবং ইহার সন্নিকটেই কোথাও সোনার খনি ছিল। গঙ্গা-বন্দরের অবস্থিতি যে কুমার-নদীর মোহনায়, অর্থাৎ প্রাচীন কুমারতালিক-মণ্ডলে, এই ইঙ্গিত আগেই করা হইয়াছে। ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়া অঞ্চলে প্রাপ্ত ষষ্ঠ শতকের একটি লিপিতে সুবর্ণবীথীর উল্লেখ্য, ঢাকা জেলার নারায়ণগঞ্জ মহকুমায় সুবর্ণগ্রাম, মুন্সীগঞ্জ মহকুমার সোনারঙ্গ, সোনাকান্দি, বর্তমান বাঙলার পশ্চিম প্রান্তে সুবর্ণরেখা নদী, ইত্যাদি সমস্তই সুবৰ্ণ-স্মৃতিবহ। টলেমি নিম্ন-মধ্যবঙ্গে যে সোনার খনির কথা বলিতেছেন তাহা একান্ত কাল্পনিক না-ও হইতে পারে।

কুষাণ মুদ্রা, মুরাণ্ড

কুষাণ-আমলের কিছু কিছু সুবর্ণ ও অন্য ধাতব মুদ্রা বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। মহাস্থানের ধ্বংসস্তুপেও কনিষ্কের (?) মূর্তি-চিহ্নিত একটি সুবর্ণমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে। বাঙলাদেশের কুষাণাধিপত্যের কোনও অকাট্য প্রমাণ নাই; এই সব মুদ্রা হয়তো বাণিজ্যসূত্রে এখানে আসিয়া থাকিবে। তবে, টলেমি গঙ্গার পূর্বদিকে (India Extra-Gangem-Si) কোনও স্থানে Murandooi নামে এক কৌমজনপদের উল্লেখ করিয়াছেন। এই মুরগুরা পঞ্জাব অঞ্চলের সুপরিচিত মুরুগুদের সঙ্গে সম্পূক্ত হইলেও হইতে পারেন। সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদািস্তম্ভলিপিতে কুষাণ রাজবংশ এবং শাক-মুরুগুদের উল্লেখ আছে। শাক-মুরুগু বলিতে কেহ বুঝেন, “শক-প্রধান’, কেহ-প্ৰা মনে করেন। শাক এবং মুরগু দুইটি পৃথক কাম। টলেমির উল্লেখ হইতে মনে হয়, মুরগু বা মুরুগু এক স্বতন্তু কোম। ইহারা যদি কখনো বাঙলাদেশের অধিবাসী হইয়া থাকেন, তাহা হইলে শক এবং কুষাণ জনগোষ্ঠী সম্পূক্ত মুরুদণ্ডরা হয়তো প্রথম বা দ্বিতীয় শতকে কখনো বাঙলাদেশে আধিপত্য বিস্তার করিয়া থাকিবেন এবং কুষাণ মুদ্রার প্রচলন তাহারাই করিয়া থাকিবেন। তবে, এ সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছুই বলিবার উপায় নাই।

সামাজিক ইঙ্গিত, আর্থিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধি

বস্তুত, গ্ৰীক-লাতিন লেখকবৰ্গ-কথিত গঙ্গারাষ্ট্র এবং মৌর্য-আমলের পর হইতে আরম্ভ করিয়া খ্ৰীষ্টোত্তর চতুর্থ শতকের প্রারম্ভে গুপ্তরাজবংশ প্রতিষ্ঠা পর্যন্ত প্রাচীন বাঙলার রাজবৃত্তকাহিনী সম্বন্ধে স্বল্প তথ্যই আমরা জানি। দুই চারিটি বিচ্ছিন্ন সংবাদ ছাড়া রাজা, রাজবংশ বা রাষ্ট্র সম্বন্ধে কিছুই নিশ্চয় করিয়া বলিবার উপায় নাই। অথচ, পেরিপ্লাস ও টলেমির বিবরণ, মিলিন্দপঞহ, জাতকের গল্প, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র প্রভৃতি গ্রন্থে দেখিতেছি, এই সময়ে বাঙলাদেশে সমৃদ্ধ ও বিস্তৃত ব্যাবসা-বাণিজ্যের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত; বাণিজ্যসূত্রে ভারতবর্ষের অন্যান্য দেশ এবং ভারতের বাহিরে বিদেশের সঙ্গে—একদিকে মিশর ও রোম সাম্রাজ্য, অন্যদিকে পূর্ব-দক্ষিণ এশিয়ার দেশ ও দ্বীপপুঞ্জ এবং চীন-তাহার যোগাযোেগ। বৌদ্ধধর্ম প্রচার সূত্রে সিংহল ও পূর্ব-দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে যোগাযোগেরও কিছু কিছু পরিচয় পাওয়া যাইতেছে। রাষ্ট্র ও সমাজগত শাসন শৃঙ্খলা বর্তমান না থাকিলে এই ধরনের বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, বিশেষভাবে সুসমৃদ্ধ, সুদূরপ্রসারী অন্তঃ ও বহির্বাণিজ্য কিছুতেই সম্ভব হইতে না। সুবর্ণমুদ্রার প্রচলনও এই অনুমানের অন্যতম ইঙ্গিত। এই যুগের বিভিন্ন বাণিজ্যিক দ্রব্বাসম্ভারের কথা পেরিপ্লাস ও টলেমির বিবরণে সবিশেষ উল্লিখিত আছে; ধনসম্বল ও ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে তাহা আলোচনাও করিয়াছি। সোনা, মনি-মুক্তা, বিচিত্ৰ সূক্ষ্ম রেশম ও কার্পাস বস্ত্ৰ, নানাপ্রকার মসলা ও গন্ধদ্রব্য ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে দেশ-বিদেশে রপ্তানী হইত এবং তাহার ফলে দেশে প্রচুর অর্থাগম হইত। তাহা ছাড়া, যুদ্ধের ও যানবাহনের একটি মস্ত বড় উপকরণ-হস্তী-প্রাচীন বাঙলা ও কামরূপ হইতে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশে যাইত, তাহার প্রমাণ তো বারবার পাওয়া যায়। দিয়োদোরস ও পুতার্ক ঔগ্রসৈন্যের সৈন্যবাহিনীর যে বিবরণ দিতেছেন তাহার তুলনামূলক আলোচনা হইতে মনে হয়, প্রাচ্য বাহিনীতে যেমন গঙ্গারাষ্ট্র বাহিনীতেও তেমনই যথেষ্ট সংখ্যক হস্তী ছিল। মহাভারত ও অর্থশাস্ত্রের সাক্ষ্য পুনরুল্লেখ করিয়া লাভ নাই। যাহাঁই হউক, এই আমলে বাঙলাদেশ নানা ধনরত্নে ও উৎপন্ন দ্রব্যাদিতে খুবই সমৃদ্ধ ছিল, সন্দেহ নাই; এবং এই সমৃদ্ধির আকর্ষণেই মহাপদ্মনন্দ হইতে আরম্ভ করিয়া গুপ্তদের আমল পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন রাজবংশ একের পর এক বাঙলাদেশে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করিয়াছেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সফলকামও হইয়াছেন। আর, বাণিজ্য-বিস্তারের চেষ্টা তো মিশর দেশ হইতে আরম্ভ করিয়া চীন পর্যন্ত সকলেই করিয়াছে। মহাবোধিবংশ-গ্রন্থে মহাপদ্মনদের কনিষ্ঠতম পুত্রের নাম পাইতেছি। ধন (নন্দ); এই ধননন্দ সম্বন্ধে সিংহলী মহাবংশ-গ্রন্থে বলা হইয়াছে, এই রাজা প্রভূত ধন সংগ্ৰহ করিয়াছিলেন নানা ন্যায় ও অন্যায় উপায়ে; ধনের পরিমাণ দেওয়া হইয়াছে আশি কোটি; বোধ হয়। সুবর্ণমুদ্রাই হইবে; এই ধন তিনি গঙ্গার নীচে এক সুড়ঙ্গের ভিতর লুকাইয়া রাখিতেন। য়ুয়ান-চোয়াঙও এ-বিষয়ে সাক্ষ্য দিতেছেন। কথাসরিৎসাগরের এক গল্পেও আছে যে, নন্দরাজের ধনের পরিমাণ ছিল নিরানব্বই কোটি সুবর্ণখণ্ড (মুদ্রা?)। নন্দদের এই বিপুল অর্থ ও সম্পদের কতকটা অংশ যে গঙ্গারাষ্ট্র হইতে সংগৃহীত হইত এ-সম্বন্ধে তো কোনও সন্দেহ থাকিতে পারে না। মৌর্যরাও নিশ্চয়ই এই বিপুল ধনের অধিকারী হইয়াছিলেন; বিশেষত কৌটিল্য অর্থনৈতিক শাসনব্যবস্থার যে-ইঙ্গিত দিতেছেন তাহাতে তো রাজকোষে প্রচুর অর্থগম হওয়ার কথা। এ-বিষয়ে কিছু পরোক্ষ প্রমাণও মহাস্থান শিলাখণ্ডলিপিতে সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন ইত্যাদি সাক্ষ্যে পাওয়া যাইতেছে।

আর্যীকরণ ও পরাভাবের হেতু

মধ্য ও উত্তর-ভারত হইতে যে-সব রাজবংশ, যে-সব বণিক ও ব্যবসায়ী যুদ্ধ, রাষ্ট্রকর্ম ও ব্যাবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে বাঙলাদেশে আসিয়াছেন, তাহারাই সঙ্গে সঙ্গে মধ্য ও উত্তর-ভারতের আর্য-ভাষা, আর্য-ধর্ম এবং আর্য-সংস্কৃতিও বহন করিয়া আনিয়াছেন। তাহারাই পথ ও ক্ষেত্র রচনা করিয়াছেন এবং সেই পথ বাহিয়া সেই সব ক্ষেত্রে আসিয়া আর্য অনুষ্ঠান-প্রতিষ্ঠান গড়িয়া তুলিয়াছেন আর্য-ধর্ম ও শিক্ষার প্রচারকেরা। প্রথমে জৈন-ধর্ম ও সংস্কৃতি, পরে বৌদ্ধ-ধর্ম ও সংস্কৃতি এবং আরও পরে, বিশেষ ভাবে গুপ্ত আমলে পৌরাণিক ব্রাহ্মণ্য-ধর্ম ও সংস্কৃতি ক্রমশ বাঙলাদেশে বিস্তার লাভ করিয়াছে। যে-আমলের কথা বলিতেছি, সেই আমলে বিশেষভাবে অগ্নি জৈন ও বৌদ্ধধর্মের প্রভাব, এবং দুই ধর্মকে আশ্ৰয় করিয়া আৰ্য ভাষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি।

বাধা ও বিরোধ গড়িয়া তোলা সত্ত্বেও সমসাময়িক বাঙলার প্রাচীন কোমগুলি এই প্রভাব ঠেকাইতে পারে নাই। রাষ্ট্ৰক্ষেত্রে পরাভব স্বীকারের প্রধান সামাজিক কারণ, এই সব প্রাচীন কোমগুলি তাহদের কৌম-সামাজিক মন পরিত্যাগ করিয়া কোমসীমা অতিক্রম করিয়া রাজতন্ত্রের বৃহত্তর সামাজিক ও রাষ্ট্ৰীয় পরিধির মধ্যে স্থায়ীভাবে ঐক্যবদ্ধ হইতে পারে নাই; নিজ নিজ কৌম স্বাৰ্থ বুদ্ধিই বোধ হয় এই পরাভাবের কারণ। রাষ্ট্র ও অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাহিরের বিজেতা রাষ্ট্রগুলির উন্নততর উৎপাদন ব্যবস্থা এবং উন্নততর শস্ত্র ও যুদ্ধপ্রণালী নিঃসন্দেহে যেমন পরাভাবের অন্যতম কারণ, তেমনই উহাদের উন্নততর সামাজিক ব্যবস্থাও ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পরাভাবের হেতু, এ-সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ স্বল্প। আর, অর্থ ও রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে পরাভব ঘটিলে ধর্ম ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও অল্পবিস্তুর পরাভব ঘটা যে অনিবার্য তাহা তো আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে বারবারই দেখা গিয়াছে, এমন কি সুপ্রাচীন সংস্কৃতি-সম্পন্ন চীন ও ভারতবর্ষের মতন দেশেও।