ধর্মপূজা সম্বন্ধে যাহা সত্য নীল বা চড়কপূজা সম্বন্ধেও তাহাই। এই চড়কপূজা এখন শিবের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে জড়িত। জলভরা একটি পাত্রে প্রতিষ্ঠিত যে-প্রতীকটি এই পূজার কেন্দ্র সেই প্রতীক শিবলিঙ্গ এবং ইহাই পূজারীর নিকট ‘বুড়া শিব’ নামে আখ্যাত। এই পূজার পুরোহিত সাধারণত আচার্য-ব্রাহ্মণ বা গ্রহবিপ্র এবং গ্রহবিপ্রেরা যে ব্রাহ্মণ্যস্মৃতি অনুযায়ী পতিত-ব্রাহ্মণ, এ-তথ্য সর্বজনবিদিত।
কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের উপর ছোলা কাঁটা ও ছুরির উপর ঝম্প, বাণফোঁড়া, শিবের বিবাহ ও অগ্নিনৃত্য, চড়কগাছ হইতে দোলা এবং দানো (ভূত) বারাণো বা হাজরা পূজা চড়কপূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ। এই শেষোক্ত ‘দানো বারাণো’ বা ‘হাজরা পূজা’র স্থান সাধারণত শ্মশানে এবং এই অনুষ্ঠানটির সঙ্গেই পোড়া শোল মাছ এবং তাহার পুনর্জন্মের কাহিনী (মহাভারতের শ্রীবৎসরাজার উপাখ্যান তুলনীয়), চড়কের সং (কলিতাকার জেলেপাড়ার সং তুলনীয়) প্রভৃতি জড়িত। চড়ক-পূজার পূজারীরা আজও আমাদের সমাজে সাধারণত জল অনাচরণীয় স্তরের।
সামাজিক জনতত্বের দৃষ্টিতে ধর্ম ও চড়ক-পূজা দুইই আদিম কোম সমাজের ভূতবাদ ও পুনর্জন্মবাদ বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত; প্রত্যেক কোমের মৃত ব্যক্তিদের পুনর্জন্মের কামনাতেই এই দুই পূজার বাৎসরিক অনুষ্ঠান। তাহা ছাড়া বাণফোঁড়া এবং দৈহিক যন্ত্রণা-গ্রহণ বা রক্তপাত উদ্দেশ্যে যে-সব অনুষ্ঠান চড়ক-পূজার সঙ্গে জড়িত তাহার মূলে সুপ্রাচীন কোম সমাজের নরবলি প্রথার স্মৃতি বিদ্যমান, এ-সম্বন্ধেও সন্দেহের অবকাশ কম। ধর্মপূজার মূলেও তাহাই; এ ক্ষেত্রেও যে অজশিশুটিকে ধর্মের উদ্দেশ্যে বলিপ্রদান করা হয়, সে-টি প্রাচীন নরবলিরই আর্য-ব্রাহ্মণ্য রূপান্তর।
রামাই পণ্ডিতের শূন্যপুরাণ-গ্রন্থের সাক্ষ্য প্রামাণিক হইলে স্বীকার করিতে হয়, ধর্মপূজার প্রচলন সেন-আমলে, তুর্কী-বিজয়ের আগেই দেখা দিয়াছিল।