ধর্মঠাকুর
কিছুদিন পূর্ব পর্যন্তও আমরা ধর্মঠাকুরকে বৌদ্ধমতের ‘ধর্ম’ বলিয়া মনে করিতাম এবং এই পূজার মধ্যে বৌদ্ধধর্মের অবশেষ খুঁজিয়া বেড়াইতাম। কিন্তু সম্প্রতি নানা গবেষণার ফলে আমরা জানিয়াছি, ধর্মঠাকুর মূলত ছিলেন প্রাক-আর্য আদিবাসী কোমের দেবতা; পরে বৈদিক ও পৌরাণিক, দেশী ও বিদেশী নানা দেবতা তাহার সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া ধর্মঠাকুরের উদ্ভব হইয়াছে। ধর্মঠাকুরের আসল প্রতীক পাদুকাচিহ্ন এবং ধর্ম-পূজার পুরোহিতেরা তাঁহাদের গলায় ঝুলাইয়া রাখেন এক খণ্ড পাদুকা বা পাদুকার মালা। আজও ধর্মপূজার প্রধান অধিকারী ডোমেরা, যদিও এখন কৈবর্ত, শুঁড়ি, বাগদী, ধোপা প্রভৃতির ভিতরও ধর্মপণ্ডিত বা ধর্মপূজার পুরোহিত বিরল নয়। রাঢ়দেশেই ধর্মপূজার প্রচলন ছিল বেশি, এখনও তাঁহাই; তবে এখন কোথাও কোথাও ধর্মঠাকুর শিব বা বিষ্ণুতে রূপান্তরিত হইয়া গিয়াছেন, সেখানে তিনি ব্ৰাহ্মণ-পুরোহিত ছাড়া অন্য কাহারও পূজা গ্ৰহণ করেন না। স্তুপীকৃত পিষ্টক আর প্রচুর মদ্য দিয়া (“মদ্যের পুঙ্কর্ণী দিব পিষ্টের জাঙ্গাল”) ধর্মঠাকুরের পূজা হইত। মৃতদেহ ও নরমুণ্ড লইয়া ছিল ধর্মের গাজনের নাচ। শূন্যপুরাণে বলা হইয়াছে, ধর্মঠাকুর ছিলেন শূন্যমূর্তি, তিনি ‘নিরঞ্জন’, ‘শূন্যদেহ’, তাঁহার বাহন শাদা পেঁচক বা শাদা কাক। যে-প্রতীকের পূজা করা হইত। তাহা কুৰ্মকৃতি পাষাণখণ্ড বা পাষাণ-নির্মিত কুর্মবিগ্রহ; তাহার উপর আঁকা থাকিত পাদুকাচিহ্ন। আদিতে যে তিনি প্রাক-আর্য বা অনার্য দেবতা, এ-সম্বন্ধে তাহা হইলে সন্দেহ করিবার কোনও কারণ নাই। পরে তিনি একে একে বৈদিক, বরুণ, অশ্বরথ বাহিত সূর্য, উদীচ্যবেশী অর্থাৎ বুটপরা ঘোড়াচড়া মিহির বা সূৰ্য, পৌরাণিক কৃর্মাবতার ও কন্ধি অবতার প্রভৃতির সঙ্গে মিলিয়া মিশিয়া এক হইয়া বর্তমান ধরে রূপান্তরিত হইয়া প্রধানত রাঢ় অঞ্চলেই পূজালাভ করিতেছেন। বৃন্দাবন দাসের “মদ্য মাংস দিয়া কেহ যক্ষ পূজা করে” বোধ হয় এই ধর্মঠাকুরেরই পূজা। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় তো মনে করেন, “ধর্ম” শব্দটিই বোধ হয় প্রাচীন কোনও অস্ট্রিক শব্দের সংস্কৃত রূপান্তর এবং বৌদ্ধ এয়ীর মধ্যম শব্দ অর্থাৎ “ধৰ্ম” এবং তাহার পূজা মূলত আদিবাসী কোমের ধর্মপূজা হইতেই গৃহীত। রাজা হরিশচন্দ্র এবং ‘ধৰ্ম’রাজ যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে ধর্মের সম্বন্ধও একই উৎস হইতে উদ্ভূত বলিয়া মনে হয়। মহিষবাহন ধৰ্মরাজ যমও এই প্রসঙ্গে স্মর্তব্য।