০২. সীমানির্দেশ – দেশ-পরিচয়

সীমানির্দেশ – দেশ-পরিচয়

কোনও স্থান বা দেশের রাষ্ট্ৰীয় সীমা এবং উহার ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সীমা সর্বত্র সকল সময় এক না-ও হইতে পারে রাষ্ট্ৰীয় সীমা পরিবর্তনশীল; রাষ্ট্ৰীয় ক্ষমতার প্রসার ও সংকোচনের সঙ্গে সঙ্গে, কিংবা অন্য কোনও কারণে রাষ্ট্রসীমা প্রসারিত ও সংকুচিত হইতে পারে, প্রায়শ হইয়াও থাকে , প্রাচীনকালে হইতো, এখনও হয়। প্রাকৃতিক সীমা, যেমন নদনদী, পাহাড়পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদি কখনও কখনও রাষ্ট্ৰসীমা নির্ধারণ করে সন্দেহ নাই; প্রাচীন ইতিহাসে তাঁহাই ছিল সাধারণ নিয়ম। কিন্তু, বর্তমান কালে রাষ্ট্রসীমা অনেক সময়ই প্রাকৃতিক সীমাকে অবজ্ঞা করিয়া চলে; বর্তমান যন্ত্র-বিজ্ঞান রাষ্ট্রকে সেই অবজ্ঞার শক্তি দিয়াছে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, বর্তমান বাঙলাদেশের পশ্চিম ও পশ্চিম-দক্ষিণ সীমা কোনও প্রাকৃতিক সীমাদ্বারা নির্দিষ্ট হয় নাই। কোথায় যে বাঙলাদেশের শেষ, কোথায় যে বিহারের আরম্ভ, কোথায় যে মেদিনীপুর শেষ হইয়া ওডিশার আরম্ভ, কোথায় যে ত্রিপুরা, মৈমনসিং জেলা শেষ হইয়া শ্ৰীহট্ট জেলার আরম্ভ, বলা কঠিন। ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক সীমা প্রধানত নির্নীত হয়। ভূ-প্রকৃতিগত সীমাদ্বারা, এবং তাহা সাধারণত অপরিবর্তনীয়। দ্বিতীয়ত এক-জনত্বদ্বারা, এবং তৃতীয়ত ভাষার একত্ব দ্বারা। সাধারণত দেখা যায়, বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সীমার আবেষ্টনীর মধ্যেই জাতি ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য গড়িয়া উঠে। অন্তত, প্রাচীন বাঙলায় তাহাই হইয়াছিল। জন ও ভাষার ওই একত্ব-বৈশিষ্ট্য বাঙলাদেশে নিঃসন্দেহে একদিনে গড়িয়া উঠে নাই। প্রাগৈতিহাসিক কাল হইতে আরম্ভ করিয়া এই একত্ব দানা বাঁধিতে বাঁধিতে একেবারে প্রাচীনযুগের শেষাশেষি আসিয়া পৌঁছিয়াছে; বস্তুত, মধ্যযুগের আগে তাহার পূর্ণ প্রকাশ দেখা যায় নাই। বাঙলার বিভিন্ন জনপদরাষ্ট্র তাহাদের প্রাচীন পুণ্ড্র-গৌড়-সুহ্ম-রাঢ়-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল ইত্যাদির ভৌগোলিক ও রাষ্ট্ৰীয় স্বাতন্ত্র্য বিলুপ্ত করিয়া এক অখণ্ড ভৌগোলিক ও রাষ্ট্ৰীয় ঐক্য-সম্বন্ধে যখন আবদ্ধ হইল, যখন বিভিন্ন স্বতন্ত্র নাম পরিহার করিয়া এক বঙ্গ বা বাঙলা নামে অভিহিত হইতে আরম্ভ করিল, তখন বাঙলার ইতিহাসের প্রথম পর্ব অতিক্রান্ত হইয়া গিয়াছে। প্রাচ্যদেশীয় প্রাকৃত ও মাগধী প্রাকৃত হইতে স্বাতন্ত্র্য লাভ করিয়া, অপভ্রংশ পর্যায় হইতে মুক্তিলাভ করিয়া বাঙলা ভাষা যখন তাহার যথার্থ আদিম রূপ প্রকাশ করিল, তখন আদিপর্বশেষ না হইলেও প্রায় শেষ হইতে চলিয়াছে। এই জন ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য লইয়াই বর্তমান বাঙলাদেশ, এবং সেই দেশ চতুর্দিকে বিশিষ্ট ভৌগোলিক বা প্রাকৃতিক সীমাদ্বারা বেষ্টিত। বর্তমান রাষ্ট্রসীমা এই প্রাকৃতিক ইঙ্গিত অনুসরণ করে নাই সত্য, কিন্তু ঐতিহাসিককে সেই ইঙ্গিতই মানিয়া চলিতে হয়, তাহাই ইতিহাসের নির্দেশ।

 

উত্তর সীমা

বিশিষ্ট প্রাকৃতিক সীমায় সীমিত, জাতি ও ভাষার একত্ব-বৈশিষ্ট্য লইয়া আজিকার যে বাঙলাদেশ এই দেশের উত্তর-সীমায় সিকিম এবং হিমালয়-কিরীটি কাঞ্চনজঙ্ঘার শুভ্ৰ-তুষারময় শিখর; তাহারই নিম্ন উপত্যকায় বাঙলার উত্তরতম দাৰ্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা। এই দুই জেলার পশ্চিমে নেপাল, পূর্বে ভোটান রাজ্যসীমা। গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্তের আমলেই দেখিতেছি, নেপাল তাঁহার রাজ্যের পূর্বতম অংশের উত্তরতম প্রত্যন্ত দেশ। দাৰ্জিলিং-জলপাইগুড়ি-কোচবিহার এই তিনটি জেলাই প্রধানত পার্বত্য কোম্যদ্বারা আধুষিত; কোচ, রাজবংশী, ভোটিয়া–ইহারা সকলেই ভোট-ব্ৰহ্ম জনের বিভিন্ন শাখা-উপশাখা। কিন্তু, উত্তর-পূর্ব দিকে রংপুর-কোচবিহারের বর্তমান রাষ্ট্রসীমা কিছু প্রাকৃতিক সীমা নয়, সে-সীমা একেবারে ব্ৰহ্মপুত্ৰনদ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই নদই প্রাচীনকালে পুণ্ড্রবর্ধন ও কামরূপ রাজ্যের যথাক্রমে পূর্ব ও পশ্চিম সীমা নির্দেশ করিত। সত্য, কামরূপের রাষ্ট্ৰসীমা কখনও কখনও করতোয়া অতিক্রম করিয়া বাঙলার উত্তরতম জেলাগুলি—রংপুর-কোচবিহার-জলপাইগুড়ি–অতিক্ৰম করিয়া উত্তর বিহারের প্রাচীন কোশনদী স্পর্শও হয়তো করিত; তৎসত্ত্বেও ব্ৰহ্মপুত্ৰই (এবং কখনও কখনও হয়তো করতোয়া) যে ছিল মোটামুটি কামরূপ রাজ্যসীমা, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। ঐতিহাসিক কালের অধিকাংশ পর্বেই ব্ৰহ্মপুত্রের উত্তর ও দক্ষিণ উপত্যকাভূমিতে কামরূপের রাষ্ট্ৰীয় ও সামাজিক প্রভুত্ব বিস্তৃত ছিল। এই হিসাবে বর্তমান গোয়ালপাড়া জেলার অধিকাংশই পুণ্ড্রবর্ধনের সীমাভুক্ত ছিল এই অনুমান অসংগত নয়; মধ্যযুগে তো উত্তর ব্ৰহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমতম প্রান্ত বাঙলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভুত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিলই।

 

পূর্ব সীমা

বাঙলার পূর্ব সীমায় উত্তরে ব্ৰহ্মপুত্র নদ, মধ্যে গারো, খাসিয়া ও জৈন্তিয়াপাহাড়; দক্ষিণে লুসাই, চট্টগ্রাম ও আরাকান শৈলমালা। গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়াশৈলশ্রেণীর বিন্যাস দেখিলে স্পষ্টতই বুঝা যায়, বাঙলার সীমা এই পার্বত্যদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত। গোয়ালপাড়া জেলার মতো শ্ৰীহট্ট এবং কাছাড় জেলার কিয়দংশের লোকও বাঙলা ভাষাভাষী, এবং সামাজিক স্মৃতিশাসন, আচার-ব্যবহার, রীতিনীতিও বাঙলা-ভাষাভাষীর; জন এবং জাতও বাঙালীর এবং বাঙলার! তাহা ছাড়া, বরাক ও সুরমানদীর উপত্যকা তো মেঘনা-উপত্যকারই (মৈমনসিং-ত্রিপুরা-ঢাকা) উত্তরাংশ মাত্র। এই দুই উপত্যকার মধ্যে প্রাকৃতিক সীমা কিছু নাই বলিলেই চলে, এবং এই কারণেই প্রাচীন ও মধ্যযুগে পূর্ব বাঙলার এই কয়টি জেলার–বিশেষভাবে ত্রিপুরা ও পূর্ব মৈমনসিং জেলার-সংস্কার ও সংস্কৃতি এত সহজে শ্ৰীহট্ট-কাছাড়ে বিস্তারলাভ করিতে পারিয়াছিল। এখনও শ্ৰীহট্ট-কাছাড়ের হিন্দু-মুসলমানের সমাজ ও সংস্কৃতি বাঙলার পূর্বতম জেলাগুলির সঙ্গে একসূত্রে গাঁথা। শুধু তাঁহাই নয়, লৌকিক ও অর্থনৈতিক বন্ধনও বাঙলার এই জেলাগুলির সঙ্গে। সিলেট-সরকার আকবরের আমলে সুবা বাঙলার অন্তর্গত ছিল : ১৮৭৪ খ্ৰীষ্টাব্দে এই দুই জেলা ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত ছিল। শ্ৰীহট্টের দক্ষিণে ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী এই দুই জেলা হইতে শ্ৰীহট্টকে পৃথক করিয়াছে। ত্রিপুরার উত্তরে ও পূর্বে ত্রিপুরা-শৈলমালা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ত্রিপুরা হইতে পৃথক করিয়াছে; দক্ষিণ ত্রিপুরার সঙ্গে নোয়াখালি এবং সমতল চট্টগ্রামের যোগাযোগ। যাহা হউক, ত্রিপুরা ও চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাঙলাদেশকে যে লুসাই জেলা এবং ব্ৰহ্মদেশ হইতে পৃথক করিয়াছে, তাহা সুস্পষ্ট। এইসব কারণেই এই দুটি শৈলশ্রেণী বাঙলার পূর্ব-দক্ষিণ সীমা-নির্দেশক।

 

পশ্চিম সীমা

বাঙলার বর্তমান পশ্চিম-সীমা পূর্ব-সীমাপেক্ষাও অধিক খবীকৃত হইয়াছে। উত্তর প্রান্তে মালদহ ও দিনাজপুর জেলার উত্তর ও পশ্চিম সীমাই আধুনিক বাঙলার সীমা নির্দেশ করিতেছে। অথচ প্রাচীন ও মধ্যযুগে এই সীমা দক্ষিণে গঙ্গার তট বাহিয়া একেবারে বর্তমান দ্বারভাঙ্গা জেলার পশ্চিম সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। দ্বারভাঙ্গা তো দ্বার:বঙ্গ (বা বঙ্গের দ্বার) শব্দেরই আধুনিক বিকৃত রূপ। পূর্ণিয়া সরকার তো আকবরের আমলেও বাঙলা সুবার অন্তর্গত ছিল। তাহা ছাড়া, কি ভূমি-প্রকৃতিতে কি প্রাচীন ভাষায় উত্তর-বিহার ও মিথিলার সঙ্গে উত্তর বঙ্গ বা গৌর-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রীর পার্থক্য অল্পই ছিল। পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে মিথিলাই তো ছিল অন্যতম বিদ্যা ও সংস্কৃতির কেন্দ্ৰ যাহাকে বাঙলার পণ্ডিতেরা পরমতীৰ্থ বলিয়া মনে করিতেন। মৈথিল কবি বিদ্যাপতি বাঙালীরও পরমপ্রিয় কবি। উত্তর-বঙ্গের এবং শ্ৰীহট্টের কোথাও কোথাও বহুদিন পর্যন্ত মৈথিল স্মৃতির প্রচলন ছিল, এখনও আছে; বাচস্পতি মিশ্রের স্মৃতি এখনও শ্ৰীহট্টের কোনও কোনও টোলে পঠিত হইয়া থাকে, প্রচুর প্রাচীন পাণ্ডুলিপিও পাওয়া যায়। শ্ৰীহট্ট সাহিত্য-পরিষদ-গ্ৰন্থাগারে বাচস্পতি মিশ্রের স্মৃতিগ্রন্থের অনেকগুলি পাণ্ডুলিপি রক্ষিত আছে। এই দুই ভূমির, অর্থাৎ উত্তর-বঙ্গ ও উত্তর-বিহারের মধ্যে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যবধান রচিত হইয়াছে মধ্যযুগে। প্রাচীনকালে এই ব্যবধান ছিল না; এই দুই ভূমি একই ভূমি বলিয়া গণ্য হইত, এমন মনে করিবার ঐতিহাসিক কারণ বিদ্যমান। এই দুই ভূমির মধ্যে প্রাকৃতিক ব্যবধানও কিছু নাই, ভূ-প্রকৃতিরও কিছু বিভিন্নতা নাই! উত্তর-বিহারের দক্ষিণ সীমা ধরিয়া, রাজমহল পাহাড়ের ভিতর দিয়া, মালদহের পশ্চিম ও দক্ষিণ সীমা ঘেষিয়া গঙ্গা বাঙলাদেশে আসিয়া ঢুকিয়ছে। লাজমহল ও গঙ্গার দক্ষিণে বর্তমান সাঁওতাল পরগণা প্রাচীন উত্তর-রাঢ়ের উত্তর-পশ্চিমতম অংশ; ভবিষ্যপুরাণে এই ভূমিকে বলা হইয়াছে অজলা, ঊষর, জঙ্গলময় ভূমি, যেখানে কিছু কিছু লৌহ-আকর আছে, যেখানে তিনভাগ জঙ্গল, একভাগ গ্রাম, স্বল্পভূমি মাত্র উর্বর। ভবদেব ভট্টর একাদশ শতকীয় লিপিতেও এই ভূমিকে বলা হইয়াছে ঊষর ও জঙ্গলময়। ইহাই য়ুয়ান-চোয়াঙ বর্ণিত কজঙ্গল। সপ্তম শতকে রাজা জয়নাগের (রাজধানী কর্ণসুবর্ণ?) বপ্লঘোষবাট পট্টোলীতে ঔদুম্বরিক বিষয় নামে একটি ক্ষুদ্র জনপদের উল্লেখ আছে। আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’ মুরশিদাবাদ-বীরভূম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। রাজমহল (তদানীন্তন আকমহল) এই ঔদম্বর সরকারের অন্তর্গত ছিল। বস্তুত, রাজমহল ও সাঁওতাল পরগনার কিয়দংশ যে বাঙলার অন্তৰ্গত ছিল, এ সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিতে পারে না। বাঁকুড়ার পশ্চিম-সীমায় মানভূম জেলা বর্তমান বিহারের অন্তৰ্গত; অথচ, এই মানভূম প্রাচীন মল্লভূমি-মালভূমেরই অন্তর্গত। বাঁকুড়া ও মানভূমের ভিতর কোনও প্রাকৃতিক সীমা নাই; সেই সীমা মানভূম অতিক্রম করিয়া একেবারে ছোটনাগপুরের শৈলশ্রেণী পর্যন্ত বিস্তৃত এবং এই শৈলশ্রেণীই এই দিকে প্রাচীন বাঙলার সীমা। ভাষায়, ভূ-প্রকৃতিতে, সমাজ ও কৌমবিন্যাসে সঁওতাল পরগনার সঙ্গে যেমন উত্তর বীরভূমের, তেমনই মানভূমের সঙ্গে বাঁকুড়ার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ। দক্ষিণে মেদিনীপুরের পশ্চিম-দক্ষিণ সীমায় বালেশ্বর জেলা ওড়িশার অন্তর্গত, এবং সিংহভূম বিহারের। এই দুইটি জেলারই কতকাংশ মেদিনীপুর জেলার যথাক্রমে কঁাথি, সদর ও ঝাড়গ্রাম মহকুমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধে যুক্ত-ভাষায়, ভূ-প্রকৃতিতে, সামাজিক সংস্কৃতিতে এবং কৌমবিন্যাসে। সম্প্রতি মেদিনীপুর সাহিত্য-পরিষদে রক্ষিত মহারাজ শশাঙ্কের যে তাম্রশাসনের পাঠোদ্ধার হইয়াছে তাহাতে দেখা যাইতেছে, উৎকলদেশও সপ্তম শতকে দণ্ডভুক্তির (বর্তমান দাতনের) অন্তর্গত ছিল। যে কোনও প্রাকৃতিক ভূমি-নকশা বিশ্লেষণ করিলেই দেখা যাইবে রাজমহল হইতে এক অনুচ্চ শৈলশ্রেণী এবং গৈরিক পার্বত্যভূমি দক্ষিণে সোজা প্রসারিত হইয়া একেবারে ময়ূরভঞ্জ-কেওঞ্জর-বালেশ্বর স্পর্শ করিয়া সমুদ্র পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছে। এই শৈলমালা এবং গৈরিক মালভূমিই সঁওতাল পরগনা, ছোটনাগপুর, মানভূম, সিং ভুম এবং ময়ূরভঞ্জ-বালেশ্বর-কেওজরশৈলমালার অরণ্যময় গৈরিক উচ্চভূমি এবং বাঙলার স্বাভাবিক প্রাকৃতিক পশ্চিম সীমা। বাঙলার ভাষা, সমাজবিন্যাস, জন ও কেমবিন্যাস এবং উত্তর-রাঢ় ও পশ্চিম-দক্ষিণ মেদিনীপুরের ভূ-প্রকৃতি এই সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত।

 

দক্ষিণ সীমা

বাঙলার দক্ষিণ-সীমায় বঙ্গোপসাগর এবং তাহারই তট ঘিরিয়া মেদিনীপুর-চব্বিশ পরগণা-খুলনাবরিশাল-ফরিদপুর-ঢাকা-ত্রিপুরার দক্ষিণতম প্রান্ত (অর্থাৎ চাঁদপুর) নোয়াখালি-চট্টগ্রামের সমতটভূমির সবুজ বনময় অথবা শস্যশ্যামল আস্তরণ। এই আস্তরণ অসংখ্য ক্ষুদ্রবৃহৎ নদনদী-খাটিখাড়ি-খালনালা-বিল, জলা-হাওর (হায়র-সায়র=সাগর) ইত্যাদিতে সমাচ্ছন্ন। এই জেলাগুলির অধিকাংশ নিম্নভূমি ক্রমশ গড়িয়া উঠিয়াছে অসংখ্য নদনদীবাহিত পলিমাটি এবং সাগরগর্ভতাড়িত বালুকারাশির সমন্বয়ে, প্রাগৈতিহাসিক কালে,–এবং বোধহয় কতকটা ঐতিহাসিক কালেও।

সূত্ৰ-সংক্ষিপ্ততায় এখন এইভাবে বোধহয় বাঙলার সীমা-নির্দেশ করা চলে : উত্তরে হিমালয় এবং হিমালয়ধুত নেপাল, সিকিম ও ভোটান রাজ্য; উত্তর-পূর্বদিকে ব্ৰহ্মপুত্র নদ ও উপত্যকা; উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারবঙ্গ পর্যন্ত ভাগীরথীর উত্তর সমান্তরালবতী সমভূমি; পূর্বদিকে গারো-খাসিয়া-জৈন্তিয়া-ত্রিপুরা-চট্টগ্রাম শৈলশ্রেণী বাহিয়া দক্ষিণ সমুদ্র পর্যন্ত; পশ্চিমে রাজমহল-সাঁওতাল পরগনা-ছোটনাগপুর-মানভূম-ধলভূম-কেওঞ্জের-ময়ূরভঞ্জের শৈলময় অরণ্যময় মালভূমি; দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই প্রাকৃতিক সীমা বিধৃত ভূমিখণ্ডের মধ্যেই প্রাচীন বাঙলার গৌড়-পুণ্ড্র-বরেন্দ্রী-রাঢ়-সুহ্ম-তাম্রলিপ্তি-সমতট-বঙ্গ-বঙ্গাল-হরিকেল প্রভৃতি জনপদ, ভাগীরথী–করতোয়া-ব্ৰহ্মপুত্র-পদ্মা-মেঘনা এবং আরও অসংখ্য নদনদীবিধৌত বাঙলার গ্রাম, প্রান্তর, পাহাড়, কান্তার। এই ভূখণ্ডই ঐতিহাসিক কালের বাঙালীর কর্মকৃতির উৎস এবং ধর্ম-কর্ম-নিৰ্মভূমি। একদিকে সু-উচ্চ পর্বত, দুইদিকে কঠিন শৈলভূমি, আর একদিকে বিস্তীর্ণ সমুদ্র; মাঝখানে সমভূমির সাম্য—ইহাই বাঙালীর ভৌগোলিক ভাগ্য। আজ হিমালয় আমাদের নামমাত্রই; সমুদ্রও বুঝি নামমাত্র; তাম্রলিপ্তি সত্যই সকরুণ স্মৃতি। সাম্প্রতিক বাঙলার উত্তরে তরাই বনভূমি, দক্ষিণে সুন্দরবন ও তৃণান্তীর্ণ জলাভূমি। এই দুইয়ে মিলিয়া যেন বাঙলাদেশকে। উষ্ণ জলীয়তার ক্লান্ত অবসাদে ঘিরিয়া ধরিয়াছে। বিংশ শতাব্দীর এক বাঙালী কবির লেখনীতে এই ভৌগোলিক ভাগ্য সুন্দর কাব্যময় রূপ গ্রহণ করিয়াছে। কবিতাটি সমগ্ৰ উদ্ধৃতির দাবি রাখে :

হিমালয় নাম মাত্র,
আমাদের সমুদ্র কোথায়?
টিমটিম করে শুধু খেলো দুটি বন্দরের বাতি।
সমুদ্রের দুঃসাহসী জাহাজ ভেড়ে না সেথা;
—তাম্রলিপ্তি সকরুণ স্মৃতি।

দিগন্ত-বিস্তৃত স্বপ্ন আছে বটে সমতল সবুজ খেতের,
কত উগ্ৰ নদী সেই স্বপনেতে গেল মাজে হেজে;
একা পদ্মা মরে মাথা কুটে।

উত্তরে উত্তুঙ্গ গিরি
দক্ষিণেতে দুরন্ত সাগর
যে দারুণ দেবতার বর,
মাঠভরা ধান দিয়ে শুধু
গান দিয়ে নিরাপদ খেয়া-তরণীর
পরিতৃপ্ত জীবনের ধন্যবাদ দিয়ে
তারে কভু তুষ্ট করা যায়!
ছবির মতন গ্রাম
স্বপনের মতন শহর
যতো পারো গড়ো,
অৰ্চনার চূড়া তুলে ধরো
তারাদের পানে;
তবু জেনো আরো এক মৃত্যুদীপ্ত মানে
ছিলো এই ভূখণ্ডের,
—ছিলো সেই সাগরের পাহাড়ের দেবতার মনে।
সেই অর্থ লাঞ্ছিত যে, তাই,
আমাদের সীমা হল
দক্ষিণে সুন্দরবন
উত্তরে টেরাই!

[‘ভৌগোলিক’]—প্রেমেন্দ্ৰ মিত্র