গ্রাম ও গ্রামের সংস্থান
বাঙলার লিপিগুলিতে রাজসরকার হইতে বিক্ৰীত বা দত্ত ভূমিগুলির বিবরণ ও তৎসংলগ্ন গ্রামগুলির বিবরণ যে-ভাবে পাইতেছি তাহা হইতে বাঙলার গ্রামের সংস্থান ও সংগঠন সম্বন্ধে কতকগুলি সুস্পষ্ট ধারণা করিতে পারা যায়। মহাস্থান লিপি (খৃষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতক, আনুমানিক) এবং চন্দ্ৰবৰ্মার শুশুনিয়া লিপির (খ্ৰীষ্টাত্তর চতুর্থ শতক) কথা ছাড়িয়া দিয়া পঞ্চম শতক হইতেই আলোচনা আরম্ভ করা যাইতে পারে। এই শতকের সাত-আটখানা লিপির প্রত্যেকটিতেই দেখিতেছি, বাস্তুভূমির চেয়ে খিলভূমির চাহিদা অনেক বেশি, এবং খিলভূমি যে চাষের জন্যই দান-বিক্রয় হইতেছে। এ-সম্বন্ধেও সন্দেহ নাই; পরবর্তী লিপিগুলিরও সাক্ষ্যও তাহাই।। বস্তুত, আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত সমস্ত সাক্ষ্যেই দেখিতেছি, কৃষিযোগ্য এবং কৃষিভূমির উপরই গ্রাম্য সমাজের নির্ভর এবং তাহার চাহিদাই উত্তরোত্তর বাড়িয়া চলিয়াছে। এমন-কি। খ্ৰীষ্টপূর্ব তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকের মহাস্থান-লিপিতে যে-ধান্যকে দেখিতেছি লোকের প্রাণধারণের প্রধান উপায় সেই ধান্যও তো স্থানীয় অর্থাৎ এই দেশেরই কৃষিক্ষেত্ৰলব্ধ সম্পদ বলিয়া মনে না। করিবার কোনও কারণ নাই। লিপিগুলির বিশ্লেষণে স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, এই সব খণ্ড খণ্ড কৃষিক্ষেত্র সমস্তই একে অন্যের সঙ্গে সংলগ্ন, এক খিলক্ষেত্রের সীমা আর-এক ক্ষেত্রের সীমার একেবারে গাত্রলগ্ন; বিচ্ছিন্ন ক্ষেত্রভূমি প্রায় নাই বললেই চলে। অনেক দৃষ্টান্ত এমনও আহরণ করা যায়, যেখানে একই ব্যক্তি যো-পরিমাণ ক্ষেত্রভূমি চাহিতেছেন তাহা এক গ্রামে পাওয়া যাইতেছে না, বিভিন্ন গ্রাম হইতে সংগ্ৰহ করিতে হইতেছে। আবার নূতন গ্রামের পত্তন যেখানে হইতেছে। সেখানে সমস্ত বাস্তু ও ক্ষেত্রভূমি একত্র নেওয়া হইতেছে, বিচ্ছিন্নভাবে নয়।
কয়েকটি দৃষ্টান্ত আহরণ করা যাইতে পারে। পঞ্চম শতকের পাহাড়পুর পট্টোলীতে দেখিতেছি, এক ব্রাহ্মণদম্পতি ১ কুল্যবাপ ২ ১/২ (আড়াই), দ্রোণবাপ ক্ষেত্ৰভূমি ক্রয় করিতেছেন তিনটি বিভিন্ন গ্রাম হইতে। এই শতকেই বৈগ্রাম লিপিতে দেখা যাইতেছে, ভোয়িল নামে জনৈক গৃহস্থ বায়িগ্রামের ত্ৰিবৃত নামক পাড়ায় (?); ৩ কুল্যবাপ খিলক্ষেত্র এবং এক দ্রোণবাপ বাস্তুভূমি কিনিয়াছিলেন শ্ৰীগোহালী পাড়ায় (?); ভোয়িলের সহোদর ভ্রাতা ভাস্করও একই সঙ্গে কিছু বাস্তুভূমি কিনিয়াছিলেন শেষোক্ত গ্রামে। স্পষ্টতই বোঝা যাইতেছে শ্রীগোহালীতে খিলভূমি সহজলভ্য আর ছিল না। ত্ৰিবৃত-পাড়ায় যে ভূমিখণ্ড কিনিয়াছিলেন তাহার সম্বন্ধে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ঐ ভূমি হইতে রাজার কোনও আয় এ-যাবৎ হইতেছিল না, অর্থাৎ ভূমিখণ্ডটি পতিত পড়িয়াছিল। ষষ্ঠ শতকের গুণাইঘর পট্টোলীতে একসঙ্গে অনেকগুলি খবর পাওয়া যাইতেছে। মহারাজ রুদ্রদত্তের অনুরোধে শ্ৰীমহারাজ বৈন্যগুপ্ত উত্তরমণ্ডলের অন্তর্গত কন্তেড়দক গ্রামে মহাযানিক অবৈবর্তিক ভিক্ষুসংঘকে পাচটি পৃথক ভূখণ্ডে ১১ পাটক কর্ষণযোগ্য অথচ অকৃষ্ট ভূমিদান করিয়াছিলেন। প্রথম ভূখণ্ডের সীমার পূর্বদিকে গুণিকাগ্রহার গ্রাম এবং বিষ্ণুবৰ্ধকর (?) ক্ষেত্র, দক্ষিণে মৃদুবিলাল (?) নামক জনৈক গৃহস্থের ক্ষেত্র এবং রাজবিহারের ক্ষেত্র, পশ্চিমে সূরীনশীর-পূৰ্গকের ক্ষেত্র; উত্তরে দোষীভোগ পুষ্করিণী— এবং বম্পিয়ক ও আদিত্যবন্ধুর ক্ষেত্ৰসীমা। দ্বিতীয় ভূখণ্ডের সীমায় পূর্বদিকে গুণিকাগ্রহার গ্রাম, দক্ষিণে পঙ্কবিললের ক্ষেত্র, পশ্চিমে রাজবিহার, উত্তরে বৈদ্যনাম গৃহস্থের ক্ষেত্র। তৃতীয় ভূখণ্ডের সীমায় পূর্বদিকে জনৈক গৃহস্থের ক্ষেত্রভূমি, দক্ষিণে আর একজন গৃহস্থের ক্ষেত্ৰসীমা,; পশ্চিমে জোলারির ক্ষেত্ৰসীমা; উত্তরে নগিজোদকের ক্ষেত্ৰসীমা। চতুর্থ ভূমিখণ্ডের সীমায়, পূর্বে বুদুকের ক্ষেত্ৰসীমা, দক্ষিণে কলকের ক্ষেত্ৰসীমা; পশ্চিমে সূর্যের ক্ষেত্ৰসীমা, উত্তরে মহীপালের ক্ষেত্ৰসীমা। পঞ্চম ভূমিখণ্ডের পূর্বসীমায় খন্দবিন্দুগগুরিকের ক্ষেত্র, দক্ষিণে মণিভদ্রের ক্ষেত্র, পশ্চিমে যজ্ঞরাতের ক্ষেত্র, উত্তরে নাদভদক গ্রাম। সপ্তম শতকে জয়নাগের বপ্যঘোষবাট পট্টোলী দ্বারা বপ্যঘোষবাট গ্রামখানা ব্ৰাহ্মণ ভট্ট বীরস্বামীকে দান করা হইয়াছিল। এই গ্রামের পশ্চিম সীমায় কুকুট গ্রামের ব্ৰাহ্মণদিগকে প্রদত্ত ক্ষেত্ৰভূমির সীমা; উত্তরে নদীর খাত; পূর্বে একই নদীর খাত্ এবং এই খাত হইতে আরম্ভ করিয়া আমলপস্তিক গ্রামের পশ্চিম সীমা স্পর্শ করিয়া যে সর্ষপযানিক একেবারে চলিয়া গিয়াছে ভট্ট উন্মীলনস্বামীর ক্ষেত্ৰভূমি পর্যন্ত; সেইখান হইতে আরম্ভ করিয়া দক্ষিণে সোজা ভরাণিস্বামীর ক্ষেত্র পর্যন্ত এবং সেখান হইতে সোজা লম্ববান হইয়া ভট্ট উন্মীলনস্বামীর ক্ষেত্ৰসীমায় অবস্থিত বখটস্মালিকার পুষ্করিণী ভেদ করিয়া কুকুট গ্রামের ব্ৰাহ্মণদিগকে প্রদত্ত ভূমিসীমা পর্যন্ত বিলম্বিত। এই শতকেরই ত্রিপুরার লোকনাথ পট্টোলীতে দেখিতেছি, জনৈক ব্ৰাহ্মণ মহাসামন্ত প্রদোষশৰ্মা দুই শতাধিক ব্ৰাহ্মণের বসবাসের জন্য সুব্ববুঙ্গ বিষয়ের অরণ্যময় প্রদেশে বাস্তু ও ক্ষেত্রভূমি রাজার নিকট হইতে দানস্বরূপ গ্রহণ করিতেছেন। এক্ষেত্রে স্পষ্টতই বনভূমি পরিষ্কার করিয়া নূতন গ্রামের পত্তন হইতেছে, এ-সম্বন্ধে সন্দেহ থাকিতে পারে না। অষ্টম হইতে ত্ৰয়োদশ শতকের শেষাশেষি পর্যন্ত লিপি প্রমাণ অপর্যাপ্ত এবং সমগ্র বাঙলাদেশ জুড়িয়া, শ্ৰীহট্ট হইতে মেদিনীপুর, এবং বরেন্দ্ৰ হইতে খাড়ীমণ্ডল এই সব লিপির ব্যাপ্তি। যে সব ক্ষেত্রভূমি, বাস্তুভূমি এবং গ্রামের বর্ণনা এই লিপিগুলিতে পাওয়া যায় তাহাতে দেখা যাইতেছে, ক্ষেত্রভূমি ক্ষেত্রভূমির সঙ্গে, এবং বাস্তুভূমি বাস্তুভূমির সঙ্গে একেবারে সংলগ্ন, এবং কোথাও কোথাও গ্রামও গ্রামের সংলগ্ন।
কিন্তু দৃষ্টান্ত উল্লেখের আর প্রয়োজন নাই। উদ্ধৃত দৃষ্টান্ত হইতে দুইটি তথ্য পরিষ্কার। প্রথম, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাস্তু ও কৃষিক্ষেত্র বিস্তৃত হইয়াছে, সর্বপ্রকার ভূমির চাহিদা বাড়িয়াছে, বন-অরণ্যভূমি পরিষ্কার করিয়া নূতন গ্রামের পত্তন হইয়াছে, পতিত অথচ কর্ষণযোগ্য ভূমি কর্ষণাধীন করা হইয়াছে। দ্বিতীয়ত, বাস্তু ও ক্ষেত্রভূমি লইয়া প্রত্যেকটি গ্রাম পৃথক অথচ ঘনসন্নিবিষ্ট, দৃঢ়সংবদ্ধ অর্থাৎ গ্রামান্তর্গত গৃহস্থবাড়িগুলি এবং কৃষিক্ষেত্রখণ্ডগুলি ইতস্তত বিক্ষিপ্ত নয়। তাহা না হইবার কারণও আছে। যে ভূমি-নির্ভর সমাজের জীবিকা প্রধানত শুধু পশুপালন এবং পশুচারণ, সেখানে চারণভূমি যেমন দেখা যায় দূরে দূরে বিক্ষিপ্ত তেমনই বাস্তুও থাকে পরস্পর বিচ্ছিন্ন। কিন্তু একান্তভাবে কৃষিনির্ভর গ্রামে তাহা হইতে পারে না, বরং প্রবণতা দেখা যায় ঠিক তাহার বিপরীত দিকে। তাহা ছাড়া, কৃষিজীবী সমাজে নূতন গ্রামের যখন পত্তন হয়, তখন প্রথমেই বৃহৎ বসতি ও ক্ষেত্রভূমির বিস্তার দেখা যায় না। কয়েকটি গৃহস্থ বাড়ি ও তাহাদের প্রয়োজন মতো ক্ষেত্রভূমি লইয়া গ্রামের পত্তন হয়; তাহার পর গ্রামের লোকবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সেই কয়েকটি বাড়ি ও ক্ষেত্রভূমিকে কেন্দ্ৰ করিয়া দুয়েরই ক্রমবিস্তার ঘটিতে থাকে। লিপিসংবদ্ধ সংবাদ একটু সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করিলে প্রাচীন বাঙলার গ্রামগুলির এই গঠন-প্রকৃতি ধরিতে পারা কঠিন নয়। তাহা ছাড়া, গ্রামগুলি ঘনসন্নিবিষ্ট ও দৃঢ়সংবদ্ধ হইবার অন্য কারণও আছে। ভয়-ভীতি, নানাপ্রকারের বিপদ-উৎপাত প্রভৃতি হইতে আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যেও গ্রামবাসীরা ঘনসন্নিবিষ্ট হইয়া বাস করিত এবং সাধারণত এক এক বৃত্তি আশ্রয় করিয়া সমশ্রেণীর লোকেদের লইয়া এক-একটি পাড়া গড়িয়া উঠিত। এই ধরনের পাড়া ও গ্রামের গঠন প্রাচীন কৌমসমাজেরই দান।
প্রাচীন লিপিমালায় অসংখ্য গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যাইতেছে। সব গ্রামের আয়তন ও লোকসংখ্যা সমান ছিল না, ইহা তো সহজেই অনুমেয়; প্রকৃতিও একপ্রকার ছিল না, এরূপ অনুমানেও বাধা নাই। ছোট ছোট গ্রাম বা গ্রামাংশের নাম ছিল পাটক (বা পাড়া)। বৈগ্রাম পট্টোলীতে তো স্পষ্টই দেখিতেছি, বায়িগ্রামের অন্তত দুইটি ভাগ ছিল, ত্রিবৃতা ও শ্ৰীগোহলী, যদিও ইহাদের পাটক বলা হইতেছে না। কিন্তু ষষ্ঠ শতকের ৫ নং দামোদরপুর পট্টোলীতে পরিষ্কার স্বচ্ছন্দ পাটক এবং পুরাণ-বৃন্দিকহরি অন্তর্গত। আর-একটি পাটকের উল্লেখ দেখিতেছি। মল্লসরুল লিপিতে বাটক নামে একটি জনপদ বিভাগের নাম পাওয়া যাইতেছে, যেমন নিৰ্ব্বত-বািটক, কপিস্থ-বািটক, শাল্মলী-বািটক, মধু-বাটক ইত্যাদি। এই বাটক ও পাটক সমার্থক, এবং একই শব্দ বলিয়া মনে হইতেছে। এই লিপিরই খণ্ডজ্যোটিকা বোধ হয় কোনও জোটিকা বা খাড়ীকা-তীরবর্তী গ্ৰাম। যাহা হউক, এই সময় হইতে আরম্ভ করিয়া আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত এই পাটক বিভাগ বিদ্যমান। যে-সব গ্রামের অবস্থিতি প্রশস্ত জল ও স্থলপথের উপর, বাস্তুক্ষেত্র ও কৃষিক্ষেত্র যেখানে সুলভ ও সুপ্রচুর, যে-সব গ্রামে শিল্প-বাণিজ্যের সুযোগ ও প্রচলন বেশি কিংবা যে-সব গ্রামে শাসনকার্য পরিচালনার কোনও কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত থাকিত, শিক্ষা, সংস্কৃতি বা ধর্মকর্মের কেন্দ্ৰ বলিয়া পরিগণিত হইত, সেই সব গ্রাম সদ্যোক্ত এক বা একাধিক কারণে আয়তনে, লোকসংখ্যায় এবং মর্যাদায় অন্যান্য গ্রামাপেক্ষা অধিকতর গুরুত্বলাভ করিত, সন্দেহ নাই। এই রকম দুই-চারিটি বৃহৎ এবং মর্যাদাসম্পন্ন গ্রামের খবর লিপিমালা ও সমসাময়িক সাহিত্যে পাওয়া যায়; পরে তাহাদের কথা বলিতেছি। আকৃতি ও প্রকৃতির এই পার্থক্য সত্ত্বেও প্রত্যেক গ্রামই কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্যে একপ্রকার; যেমন, প্রত্যেক গ্রামই কয়েকটি সুনির্দিষ্ট অঙ্গপ্রত্যঙ্গে বিভক্ত। বাস্তুভূমি ও ক্ষেত্রভূমি দুই প্রধান অঙ্গ; ইহা ছাড়া প্রায় প্রত্যেক গ্রামেই উষরভূমি, মালভূমি, গর্তভূমি, তলভূমি, গোচরীভূমি, বাটক-বাট, গোপথ-গোবাট-গোমার্গভূমি ইত্যাদির উল্লেখ পাইতেছি, একেবারে পঞ্চম হইতে আরম্ভ করিয়া ত্ৰয়োদশ শতক পর্যন্ত। তাহা ছাড়া, খাল, বিল, খাটিকা, খাটা, পুষ্করিণী, নদী, নদীর খাত, গঙ্গিনিকা ইত্যাদির উল্লেখ তো আছেই। গোচর বা গোচারণভূমি সর্বদাই গ্রামের ক্ষেত্রভূমির প্রান্তসীমানায় অথবা একেবারে এক পাশে এবং সেইখান হইতে গ্রামের সীমা ঘেষিয়া গ্রামের ভিতর পর্যন্ত গোবাট-গোমার্গ-গোপথ। কোনও কোনও গ্রামে হট্ট, হট্টীয় গৃহ, আপণ ইত্যাদির উল্লেখ পাইতেছি; নানা দেবতার মন্দির, দেবকুল, জৈন ও বৌদ্ধ বিহার ইত্যাদির উল্লেখও আছে। সব গ্রামে হাট, বাজার, মন্দির ইত্যাদি থাকিত না; লিপিতেও তেমন উল্লেখ নাই; যে-সব গ্রামে ছিল সে-সব ক্ষেত্রেই উল্লেখ পাইতেছি মাত্র। কোনও কোনও গ্রামে বনজঙ্গল, ঝাড়, বড় বড় গাছ ইত্যাদিও ছিল (সবন, সব্বােটবিটপ ইত্যাদি); লিপিতে তাহাও উল্লিখিত হইয়াছে। এই সব বনজঙ্গল হইতে লোক জ্বালানি কাঠ, ঘর-বাড়ি প্রস্তুত করিবার জন্য বাঁশ, খুঁটি ইত্যাদি সংগ্ৰহ করিত। বিক্ৰীত ও দত্তভূমির শ্রেণীবিভাগের যে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ লিপিগুলিতে পাওয়া যায় তাহাতে এ-তথ্য সুস্পষ্ট যে, পঞ্চম শতকের আগেই বাঙলার গ্রাম কৃষিনির্ভর সমাজ সুশৃঙ্খল সুবিন্যস্ত ভাবে সমস্ত অধিগম্য ও প্রয়োজনীয় ভূমিকে সামাজিক স্বার্থসাধনের বিষয়ীভূত করিয়াছিল।
গ্রামগুলির আপেক্ষিক আয়তন সম্বন্ধে কিছু ইঙ্গিত সেন-আমলের লিপিগুলিতে পাওয়া যায়। বল্লালসেনের নৈহাটি লিপিতে দেখি, বাল্লহিটুঠ গ্রামের আয়তন ৭ ভূপাটক ৭ দ্রাণ ১ আঢ়ক ৩৪ উন্মান এবং ৩। কাক (বাস্তু, ক্ষেত্র, পতিত ভূমি এবং খাল সহ), এবং বার্ষিক উৎপত্তিক ৫০০ কপর্দক পুরাণ। এই গ্রাম ছিল বর্ধমানভুক্তির উত্তররাঢ় মণ্ডলের স্বল্পদক্ষিণবীথীর অন্তর্গত। লক্ষ্মণসেনের গোবিন্দপুর লিপিতে দেখিতেছি, একই বর্ধমানভুক্তির পশ্চিম খাটিকার অন্তর্ভুক্ত বেতডডচতুরকের অন্তর্গত বিডডােরশাসন গ্রামের আয়তন (অরণ্য, জল, স্থল, গর্তভূমি, উষরভূমি, ইত্যাদি সহ) ৬০ ভূদ্রোণ ১৭ উন্মান; দ্রোণ প্রতি ১৫ পুরাণ হিসাবে বার্ষিক উৎপত্তিক ৯০০ পুরাণ। এই রাজারই তৰ্পণদীঘি লিপিতে দেখিতেছি, বিক্রমপুরের অন্তর্গত বেলহিষ্ঠী গ্রামের আয়তন মাত্র ১২০ আঢ়াবাপ (আঢক) ৫ উন্মান; বার্ষিক উৎপতি মাত্র ১৫০ কপর্দক পুরাণ। স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে, তিনটি ভিন্ন ভিন্ন গ্রাম তিন বিভিন্ন আয়তনের , পাল ও সেন আমলের, এমন-কি আগেকার পর্বের লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিলেও দেখা যাইবে, অধিকাংশ গ্রামই কোনও নদনদী, খাল, বিল, খাটিকা, খাড়ীক প্রভৃতির তীরে অবস্থিত। অধিকাংশ গ্রামে ঘাট (সঘট্ট), পুষ্করিণী ইত্যাদিও দেখা যায়। কোটালিপাড়ার একটি পট্টোলীতে গ্রামের প্রান্তে বলদের গাড়ির রাস্তাও একটি ভূমির সীমারূপে উল্লিখিত হইয়াছে। গ্রাম্যসমাজ যে কৃষিপ্রধান সমাজ তাহা তো বারবারই বলিয়াছি। কিন্তু ইহার অর্থ এই নয় যে, গ্রামে শিল্পীদের বাস ছিল না। বাঁশ ও বেতের শিল্প, কাষ্ঠশিল্প, মৃৎশিল্প, কার্পাস ও অন্যান্য বস্ত্ৰশিল্প, লৌহশিল্প ইত্যাদির কেন্দ্ৰ তো গ্রামেই ছিল, এরূপ অনুমান সহজেই করা যায়। কৃষিকর্মের প্রয়োজনীয় বাঁশ ও বেতের নানাপ্রকার পাত্র ও ভাণ্ড, ঘরবাড়ি ও নৌকা, মাটির হাঁড়িভাণ্ড প্রভৃতি দা’-কুড়াল-কোদাল, লাঙ্গলের ফলা, খন্ত ইত্যাদি নিত্য ব্যবহার্য কৃষি যন্ত্রাদি ইত্যাদির প্রয়োজন তো গ্রামেই ছিল বেশি। কার্পাস ফুল ও বীচি, তাত, তুলা, তুলাধূনা ইত্যাদির সঙ্গে পরিচয় যে গ্রামের লোকদেরই বেশি তাহার ইঙ্গিত পাইতেছি বিজয়সেনের দেওপাড়া লিপিতে, চর্যাগীতিগুলিতে এবং সদুক্তিকর্ণামৃত গ্রন্থের দু-একটি শ্লোকে। শেষোক্ত গ্রন্থের একটি শ্লোকে কবি শুভাঙ্ক বলিতেছেন, নির্ধন শ্রোত্রিয়গণের ঝটিকাবাহিত কুটীর প্রাঙ্গণ কার্পাস বীজ দ্বারা আকীর্ণ থাকিত। সূতাকটা দরিদ্র ব্রাহ্মণ-গৃহস্থবাড়ির মেয়েদেরও দৈনন্দিন কর্ম ছিল; কাপড় বুনিতেন তন্তুবায়-কুবিন্দকেরা, যুঙ্গি বা যুগীরা। কিন্তু এই সব শিল্প ছাড়া কোনও কোনও গ্রামে দুই-একটি সমৃদ্ধতির শিল্পও প্রচলিত ছিল। শ্ৰীহট্ট জেলার ভাটেরা গ্রামে প্রাপ্ত গোবিন্দকেশবের লিপিতে দেখিতেছি, এক কাংসকার (বা কঁসারী) গোবিন্দ, এক নাবিক দ্যোজে এবং এক দন্তকার (হাতির দাতের শিল্পী) রাজবিগ নিজ নিজ গ্রামে বসিয়াই তাঁহাদের স্বীয় বৃত্তি অভ্যাস করিতেন • কাংসকার গোবিন্দ বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ ছিলেন বলিয়া মনে হয়; তাহার বাড়িতে পাঁচখানা ঘর ছিল। নাবিক দ্যোজেরও ছিল দুইখানা ঘর। অথচ অন্যান্য সকলেরই প্রায় দেখিতেছি এক একখানা ঘর। দুই চারিজন ছোটখাট ব্যবসায়ী যে গ্রামে বাস করিতেন না তাহা নয়; পাল-সম্রাট মহারাজাধিরাজ মহীপালের রাজত্বের তৃতীয়-চতুর্থ বৎসরে যে দুই বণিক যথাক্রমে একটি নারায়ণ ও একটি গণেশ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, সেই দুইজনই ছিলেন ত্রিপুরা জেলার বিলকীন্দক গ্রামবাসী। ষষ্ঠ শতকের কোটালিপাড়ার দুইটি পট্টোলীতে উল্লিখিত ভূমিসীমা প্রসঙ্গে যে “নৌদণ্ডক”, “ঘাট” এবং “নাবাতাক্ষেণী”র উল্লেখ পাইতেছি তাহাতে মনে হয়, কোনও কোনও গ্রাম সমৃদ্ধ নৌবাণিজ্যের কেন্দ্রও ছিল।
গ্রামে কাহারা প্রধানত বাস করিতেন তাহাও অনুমান করা কঠিন নয়; লিপিগুলিতে তাহার ইঙ্গিতও পাওয়া যায়, একেবারে পঞ্চম শতক হইতে আরম্ভ করিয়া ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত। তাহা ছাড়া, বৃহদ্ধর্ম ও ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণেও তাহার কিছু কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। গ্রামবাসী ছিলেন সাধারণত ব্ৰাহ্মণেরা, ভূমিবান মহামহত্তর, মহত্তর, কুটুম্বারা; ক্ষেত্ৰকরেরা, বারজীবীরা, ভূমিহীন কৃষি-শ্রমিকেরা; তন্তুবায়-কুবিন্দক, কর্মকার, কুম্ভকার, কংসকার, মালাকার, চিত্রকার, তৈলকার, সূত্ৰধার প্রভৃতি শিল্পীরা; তীেলিক, মোদক, তাম্বুলী, শৌণ্ডিক, ধীবর-জালিক প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা; গোপ, নাপিত, রাজক, আভীর, নট-নৰ্তক প্রভৃতি সমাজ-সেবকরা; বরুড় (বাউড়ী), চর্মকার, ঘট্টজীবী (পাটনী), ডোলবাহী (ডুলে, ডুলিয়া), ব্যাধ, হাড়ডি (হাড়ি), ডোম, জোলা, বাগাতীত (বাগদী?), বেদিয়া (বেদে), মাংসচ্ছেদ, চর্মকার, চণ্ডাল, কোল, ভীল্ল, শবর, পুলিন্দ, মেদ, পৌণ্ডক (পোদ ঃ) প্রভৃতি অন্ত্যজ ও আদিবাসী পর্যায়ের লোকেরা। শেষোক্ত পর্যায়ের লোকেরা সাধারণত বাস করিতেন গ্রামের এক প্রান্তে, আজও যেমন করিয়া থাকেন। ভাটেরা গ্রামের পূর্বোক্ত লিপিটিতে গ্রামবাসীদের মধ্যে পাইতেছি। কয়েকজন গোপ, অন্তত একজন রাজক এবং একজন নাপিতকে। কোনো কোনো গ্রামে সমৃদ্ধ শ্রেষ্ঠীরাও বাস করিতেন বলিয়া মনে হইতেছে, যেমন দক্ষিণরাঢ় দেশের ভূরিসৃষ্টি বা বর্তমান ভুরসুন্টু গ্রামে। এই গ্রামটি ব্ৰাহ্মণদের একটি বড় কেন্দ্ৰস্থল তো ছিলই, তাহা ছাড়া বহু সংখ্যক শ্রেষ্ঠীজনের আশ্রয়ও ছিল। শ্ৰীধরাচার্যের ন্যায়কন্দলী গ্রন্থে (৯৯১-৯২) আছে,
আসীদ্দক্ষিণরাঢ়ায়াং দ্বিজানাং ভুরিকর্মণাম।
ভূরিসৃষ্টিরিতি গ্রামো ভূরিশ্রেষ্ঠিজনাশ্রয়ঃ ॥
লিপিগুলিতে অসংখ্য গ্রামের উল্লেখ পাইতেছি, একথা আগেই বলা হইয়াছে। ইহাদের মধ্যে আয়তনে ও মর্যাদায় গুরুত্বসম্পন্ন কয়েকটি গ্রামের লিপি-প্রদত্ত বিবরণ উল্লেখ করিলে প্রাচীন বাঙলার গ্রামগুলি সংস্থান ও বিন্যাস সম্বন্ধে ধারণা একটু পরিষ্কার হইতে পারে।