০১. যুক্তি – শ্ৰেণী-বিন্যাস

যুক্তি – শ্ৰেণী-বিন্যাস

প্রাচীন বাঙলার সমাজ যেমন বিভিন্ন বর্ণে তেমনই বিভিন্ন অর্থনৈতিক শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল। সামাজিক ধনের উৎপাদন ও বণ্টনানুযায়ী সমাজে অর্থনৈতিক শ্রেণীর উদ্ভব ও স্তরভেদ দেখা দেয়। যে-সমাজের উৎপাদিত ধনের উপর সকলের সমান অধিকার, ব্যক্তিগত ধনাধিকার যে-সমাজে স্বীকৃত নয়, সেই সমাজে শ্রেণী-বিন্যাসের প্রশ্ন অবান্তর। কিন্তু, প্রাচীন বাঙলার সমাজে ব্যক্তিগত ধনাধিকার যেমন আজিকার মতোই স্বীকৃত হইত— সমগ্ৰ ভারতবর্ষেই হইত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও হইত— তেমনই অস্বীকৃত হইত উৎপাদিত ধনের উপর সকলের সমান অধিকার। বস্তুত, বহু প্রাচীন কাল হইতেই ভারতবর্ষের অধ্যাত্মচিন্তায় অন্নের উপর সকলের সমানাধিকার, অর্থাৎ সকলেরই খাইয়া বাঁচিবার অধিকার স্বীকৃত হইলেও(১), বাস্তব দৈনন্দিন জীবনের ক্ষেত্রে সামাজিক ধনের উপর সকলের সমানাধিকার কখনও স্বীকৃত হয় নাই। বিংশ শতকের আগে মঠ-মন্দির- বিহার-সংঘারাম ছাড়া পৃথিবীর আর কোথাও এই স্বীকৃতি ছিল না। কৌম সমাজের ধনসাম্য-ব্যবস্থার কথা বাদ দিলে, ঐতিহাসিক পর্বে ব্যক্তিগত ধনাধিকারবাদ স্বীকৃতির উপরই ছিল প্রাচীন সমাজের প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ধন উৎপাদন যাঁহারা করিতেন তাহারাই যে উৎপাদিত ধন ভোগ করিতে পারিতেন তাহা নয়। সামাজিক ধন কাহারা বেশি ভোগ করিতেন, কাহারা কম করিতেন, কাহারা কায়ক্লেশে জীবনধারণ করিতেন, কিংবা উৎপাদিত ধন একেবারেই ভোগ করিবার সুযোগ পাইতেন না, তাহা নির্ভর করিত উৎপাদিত ধনের বণ্টন ব্যবস্থার উপর। এই বণ্টন কাহারা করিতেন? প্রাচীন বাঙলায় ধনোৎপাদনের ছিল তিন উপায়— কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্য। কৃষি ও ব্যাবসা-বাণিজ্যই এই তিন উপায়ের মধ্যে ধনাগমের প্রধান দুই উপায় ছিল বলিয়া মনে হয়। কৃষি ভূমিনির্ভর; ভূমির ব্যক্তিগত অধিকার এবং ব্যক্তিগত অধিকারের উপর রাষ্ট্রের অধিকার প্রাচীন বাঙলায় স্বীকৃত ছিল, এ-তথ্য পূর্ববতী এক অধ্যায়ে জানা গিয়াছে। কাজেই, কৃষিদ্রব্য ক্ষেত্রকর বা কার্যকরা উৎপাদনা করিলেও বণ্টন ব্যবস্থাটা ছিল ভূম্যধিকারী এবং রাষ্ট্রের হাতে। ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল বণিকদের হাতে, শিল্প ছিল শিল্পীদের হাতে; এই দুই উপায়ে উৎপাদিত অর্থের বণ্টন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ইহাদের হাতে না থাকিলেও— খানিকটা তো রাষ্ট্রের হাতে ছিলাই- অধিকাংশ ইহাদেরই করায়ত্ত ছিল। ধনোৎপাদনের তিন উপায় অবলম্বন করিয়া স্বভাবতই বাঙলায় তিনটি শ্রেণী গড়িয়া উঠিবে, ইহা কিছু আশ্চর্য নয়; এবং উৎপাদিত ও বণ্টিত ধনের তারতম্যানুযায়ী প্রত্যেক শ্রেণীতে নানা স্তর থাকিবে তাহাও আশ্চর্য নয়।

কিন্তু, সমাজে এমন বহু লোক বাস করেন যাঁহারা ধন উৎপাদন করেন না, বণ্টনের অধিকারও যাহাদের নাই। ধন উৎপাদন ও বণ্টন ছাড়াও সমাজের অনেক কর্তব্য আছে যাহা সমাজের পক্ষে একান্ত প্রয়োজনীয় এবং কল্যাণকর। এই সব কর্তব্যের তালিকা সুদীর্ঘ; ইহাদের একপ্রান্তে যেমন মিলিবে জ্ঞান-বিজ্ঞান, ধর্মকর্ম, শিল্পকলা, ভাষা-সাহিত্য, এক কথায় সমাজের মানস-জীবনের নায়কদের, শিক্ষা ও ধর্মজীবীদের, তেমনই অন্যপ্রান্তে পাওয়া যাইবে সমাজের অঙ্গ-নিৰ্গত আবর্জনা-পরিষ্কারক রাজক-চণ্ডাল-বাউড়ী-পোদ-বাগদী ইত্যাদিদের। এইখানেই আসিয়া পড়ে সমাজের বর্ণ-বিন্যাসের কথা, এবং শ্রেণী-বিন্যাসের সঙ্গে তাহা জড়াইয়া যায়। বস্তুত, ভারতীয় সমাজে বর্ণ ও শ্রেণী অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, একটিকে আর একটি হইতে পৃথক করিয়া দেখিবার উপায় নাই; বাঙলাদেশেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে দেখা গিয়াছে, বৃত্তি বা জীবিকা বর্ণনির্ভর, এবং বর্ণ জন্মনির্ভর। বিশেষ বর্ণের কেহ নির্ধারিত বৃত্তির সীমা অতিক্রম করিতেন না। এমন নয়, কিন্তু তাহা সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম; অধিকাংশ লোক নিজ নিজ বৃত্তিসীমা রক্ষা করিয়াই চলিতেন। ব্রাহ্মণ হইতে আরম্ভ করিয়া অস্ত্যজ চণ্ডাল পর্যন্ত অগণিত স্তরের অগণিত বৃত্তি এবং বৃত্তি অনুযায়ী যেমন বর্ণের সামাজিক মর্যাদা, তেমনই বর্ণনুযায়ী বৃত্তির নির্দেশ। বৃত্তি বা জীবিকা যেখানে বর্ণ অনুযায়ী সেখানে বর্ণ ও শ্রেণী একে অন্যের সঙ্গে জড়াইয়া থাকিবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়, এবং শ্রেণীর মর্যাদাও সেই সমাজে বর্ণ ও বৃত্তি অনুযায়ী হইবে তাহাও বিচিত্র নয়। উৎপাদিত ধন উৎপাদক ও বণ্টকেরা তো ভোগ করিতেনই, বিশেষভাবে করিতেন উৎপাদন ও বণ্টন যাঁহারা নিয়ন্ত্ৰণ করিতেন তাহারা, যাঁহারা তাঁহাদের সহায়ক ও সমর্থক ছিলেন তাঁহারা, এবং সমাজের অন্যান্য বিচিত্র কর্তব্যে যাঁহারা নিয়োজিত ছিলেন তাঁহারাও। সমানাধিকারবাদের স্বীকৃতি যখন ছিল না, তখন সকলে সমভাবে সামাজিক ধন ভোগ করিতে পাইতেন না, তাহাও স্বাভাবিক। তাহার উপর এই বণ্টন আবার নিয়মিত হইত বর্ণ ও বৃত্তির মর্যাদানুযায়ী; কাজেই, ধনোৎপাদনের প্রধান তিন উপায়ানুযায়ী তিনটি শ্রেণী ছাড়া আরও অনেক অর্থনৈতিক শ্রেণী থাকিবে ইহা অস্বাভাবিক নয়।

সব শ্রেণী-উপশ্রেণী একসঙ্গে গড়িয়া উঠিয়াছিল এমন মনে করিবার কারণ নাই; সমাজের গঠন-বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে, সমাজকর্মের জটিলতা ও কর্মবিভাগ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শ্রেণী-উপশ্রেণীর সংখ্যা বাড়িয়াছে, ইহাই যুক্তিসঙ্গত অনুমান। তবে, এই অনুমান অনেকটা নিঃসংশয়ে করা চলে যে, খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকগুলিতেই ধনাগমের পূর্বোক্ত তিন প্রধান উপায় অবলম্বন করিয়া তিনটি প্রধান শ্রেণী প্রাচীন বাঙলায় গড়িয়া উঠিয়াছিল। সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট প্রমাণ নাই, কিন্তু ষষ্ঠ-পঞ্চম-চতুর্থ খ্ৰীষ্টপূর্ব শতকগুলিতে প্রতিবেশী অঙ্গ-মগধের সাক্ষ্য যদি আংশিকতও পুণ্ড্র-রাঢ়-সুহ্ম-বঙ্গ সম্বন্ধে প্রযোজ্য হয়, এবং এই সব জনপদের কৃষি-শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি সম্বন্ধে যদি সমসাময়িক সাক্ষ্য প্রমাণিক হয়, তাহা হইলে এই অনুমান অস্বীকার করা যায় না। তবে খ্ৰীষ্টীয় পঞ্চম শতক হইতেই এ-বিষয়ে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়; তাহার আগে সবটাই অনুমান। পঞ্চম শতক-পরবর্তী বাঙলার লিপিমালা পূর্বোক্ত অনুমান সমর্থন করে এবং সদ্যকথিত তিনটি ও অন্যান্য শ্রেণীগুলি যে তাহার আগেই তাহাড়ের বিশেষ বিশেষ বৃত্তি লইয়া কোথাও অস্পষ্ট, কোথাও সুস্পষ্ট সীমারেখায় বিভক্ত হইয়া গিয়াছিল, ইহার কিছু কিছু ইঙ্গিতও পাওয়া যায়। কিন্তু সে-কথা বলিবার আগে শ্রেণী-বিন্যাস সংক্রান্ত উপকরণগুলি সম্বন্ধে দু’একটি কথা বলিয়া লওয়া প্রয়োজন।

————————

(১) আন্নাদ্যাদেঃ সংবিভাগে ভূতেভ্যশ্চ যথার্যতঃ। ভাগবত, ৭, ১১,১০
সৰ্ব্বভুতে যথাযোগ্যভাবে অন্নাদির সম্যক বিভাগও ধর্ম। এই ভাগবতেই অন্যত্র (৭,১৪,১৮) পাইতেছি :
যাবৰ্দভিয়েত জঠরৎ তাবৎ সত্ত্বং হি দেহিনাম।
অধিকং যোহভিমন্যেত স স্তেনো দণ্ডমৰ্হতি ৷।
ক্ষুধার ও প্রয়োজনের অনুরূপ অন্ন পাওয়া দেহী মাত্রেরই অধিকার; তাহার বেশি যে অধিকার করে সে দণ্ডার্হ।