০১. যুক্তি – শিল্পকলা

যুক্তি – শিল্পকলা

ভাষা-সাহিত্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-দীক্ষায় যে সংস্কৃতি প্রতিফলিত তাহার পশ্চাতে সচেতন বুদ্ধির ক্রিয়া প্রত্যক্ষ। কিন্তু সংস্কৃতির এমন প্রকাশও আছে যেখানে বুদ্ধির লীলা সক্রিয় থাকিলেও তাহা প্রত্যক্ষ ভাবে দেখা যায় না, কিংবা বুদ্ধিই সেখানে একমাত্র নিয়ামক নয়। সংস্কৃতির সেই প্রকাশ ধরা পড়ে চারুকলায় ও সংগীতে এবং এ-দুয়েরই প্রধান উৎস ও আবেদন মানুষের বোধ, বুদ্ধি ও বোধির ক্ষেত্রে। এ-বিষয়ে ভাষা-সাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানাপেক্ষা চারুকলা ও সংগীতের আবেদন একদিকে যেমন সূক্ষ্মতর, অন্যদিকে তেমনই প্রত্যক্ষতার এবং পরিধি হিসাবে বিস্তৃততর, বোধ হয়, গভীরতরও বটে।

উপাদান

কিন্তু আদিম লোকায়ত বাঙালীর চারুকলা বা সংগীত সম্বন্ধে উপাদান’ অভাবে কিছু বুলিবার উপায় নাই। সাংস্কৃতিক নরতত্ত্বের গবেষণার কাজও এমন কিছু অগ্রসর হয় নাই যে, সেদিক হইতে কিছু সাহায্য পাওয়া যাইতে পারে। চারুকলার কিছু কিছু উপাদান যদিও-বা পাওয়া যায়, একেবারে শেষ পর্বের আগে সংগীত সম্বন্ধে কোনও কথাই বলা যায় না। অথচ গুহাবাসী অরণ্যচারী মানুষেরও প্রাথমিক সাংস্কৃতিক প্রকাশ তো গানেই। এই গানের ভিতর দিয়াই তো সে তাহার সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা বাক্ত করে। আদিম কৌম বাঙালীও– রাঢ়-পুণ্ডু-বঙ্গ-সুহ্ম। প্রভৃতি জনপদবাসীরাও তাহাই করিত, সন্দেহ নাই। কিন্তু সেই গানের কী ছিল রাগ-রাগিণী, কী ছিল সুর, তাল, লয়, মোন কিছুই আমরা জানি না, কেহ তোহা লিখিয়াও রাখে নাই। পরবর্তী কালে, একেবারে দশম-দ্বাদশ শতকে যে সব রাগ-রাগিণী, তাল-লিয়ের পরিচয় পাইতেছি, তাহা তো একান্তই সভা, সংস্কৃতিপুত চিণ্ডের প্রকাশ, প্রধানত আৰ্যমানসের প্রকাশ, যে আর্যমানসে অন্তত কিছুটা পরিমাণে বহির্ভারতীয় সংস্কৃতির স্পর্শও লাগিয়াছে। কিন্তু, তাহাতে ক্টোম বাঙালীর লোকায়াত সংগীতের প্রভাবও পড়ে নাই, এ কথাও বলা যায় না, বরং তাহার সুস্পষ্ট প্রমাণও আছে। সে সব কথা পরে বলিতেছি। আজিকার দিনেও বাঙালীর বাউল, ভাটিয়াল, ঝুমুর গানে যে সংস্কৃতির প্রকাশ এবং যাহা আজও বিশুদ্ধ মাৰ্গ-সংগীতের পর্যায়ে স্থান লাভ করে নাই, সেই সব গানে কৌম বাঙালীর লোকায়াত সংগীতের ধারাই তো বহমান, এ কথা কোনও তথ্যগত প্রমাণের অপেক্ষা রাখে না, এবং এই লোকায়ত সংগীতকেই রবীন্দ্রনাথ তাঁহার অসংখ্য গানে উচ্চস্তরে সাংগীতিক মর্যাদা দান করিয়াছেন।

লোকায়ত সংগীত ও নৃত্য

আজিকার সাঁওতাল, কোল, হো, মুণ্ড, শবর, গারো খাসিয়া, কোচ প্রভৃতিদের মধ্যে যে সব সুর ও তালের গান শোনা যায়, নাচ দেখা যায়, সেই সব সুর ও তাল, নাচের ভঙ্গী প্রভৃতির মধ্যেও সুপ্রাচীন কৌম বাঙালীর নৃত্যগীতের ধারা বহমান, সে-সম্বন্ধেও সন্দেহের অবকাশ কম। গ্রামে নিম্নস্তরের মেয়েদের মধ্যে যে সব গীত ও নৃত্য প্রচলিত, বীরভূমে রায়বেঁশেদের মধ্যে, অন্যান্য জেলার লাঠিয়ালদের মধ্যে যে ধরনের নৃত্য আজও অভ্যস্ত তাহা সমস্তই সেই আদিম ধারার খাতে প্রবাহিত। লোকায়ত সেই সব নাচ ও গান উচ্চস্তরের কৌলীন্য মর্যাদা লাভ করে নাই বলিয়া তাহাদের কথা কোথাও কীর্তিতও হয় নাই। তবু, সকল উপেক্ষা সহ্য করিয়া, উচ্চকোটি-সংস্কৃতির চাপ সহ্য করিয়া ইহারা আজও বঁচিয়া আছে এবং কালে কালে ইহাদের অনেক রূপ ও ভঙ্গী মাৰ্গস্তরে স্বীকৃত এবং গৃহীতও হইয়াছে।

লোকায়ত শিল্প

চারুকলার ক্ষেত্রেও এই লোকায়ত সংস্কৃতির ধারা আজও বহমান এবং একই অবস্থার ভিতর দিয়া। আমাদের ব্রত ও অন্যান্য মঙ্গলানুষ্ঠানের আলপনায়, কাচা বা পোড়ামাটির তৈরি পুতুল ও খেলনায়, মনসা বা গাজীর পটচিত্রে, মাটিলেপা বেড়ার উপর, অথবা সারা ও ঘটের উপর নানা রঙিন চিত্র ও নকশায়, কঁথার উপর বিচিত্ৰ সূচীকার্যে, ঝুলানো শিকার পরিকল্পনায়, খুঁটি ও খড়ের তৈরি ধনুকাকৃতি দোচালা, চৌচালা বা আটচালা ঘরে, নানা বাঁশ ও বেতের শিল্পে এবং আরও নানা প্রকারের গৃহকলায় সেই প্রাচীন লোকায়ত শিল্পের ধারাই বহমান। এ-সব বিষয়ে কিছু দিন যাবৎ আমাদের শিক্ষিত সমাজের মনোযোগ আকৃষ্ট হইয়াছে বটে, কিন্তু বিজ্ঞান-সম্মত আলোচনা-গবেষণা আজও বিশেষ আরম্ভ হয় নাই। তবু, স্বীকার করিতে বাধা নাই, এই সব বিচিত্র প্রকাশের ভিতর দিয়াই বহু শতাব্দী ধরিয়া আমাদের কৌম গ্রামীণ লোকায়ত মানস নিজেকে ব্যক্ত করিয়াছে। কিন্তু আদিপর্বের লোকায়াত বাঙালীর এই সব রচনার বিশেষ কোনও নিদর্শন আমাদের হাতে আসিয়া পৌঁছায় নাই।

ঘরবাড়ির উপাদান

ইহার অন্যতম কারণ সহজভঙ্গুর উপাদানের ব্যবহার। সাধারণ লোকেরা বসবাসের জন্য ঘরবাড়ি যাহা নির্মাণ করিত তাহা সাধারণত বাঁশ, কাঠ, নল-খাগড়া, খড়, পাতা প্রভৃতির সাহায্যে। কাল জয় করিবার মতন শক্তি ইহাদের ছিল না। ব্রাঞ্জ প্রাসাদগুলিও সাধারণত এই মাল-মসলা দিয়া তৈরি হইত। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ইটের ব্যবহারও ছিল না। এমন নয়; কিন্তু ইটও কালজয়ী নয়, বিশেষ বাঙলার উষ্ণ জলীয় আবহাওয়ায়। ছোটখাট মন্দিরগুলিও বাঁশ-কাঠ-খড়ের চালাঘর ছাড়া কিছু ছিল না; তবে রাজ-রাজড়া এবং সমাজের সমৃদ্ধ শ্রেণীর লোকের যে-সব দেবমন্দির, বিহার ইত্যাদি নির্মাণ করাইতেন সেগুলিতে প্ৰধানত ইট এবং খুব স্বল্প পরিমাণে পাথর- যেমন, দরজায়, জানালায়, খিলানে, সিঁড়িতে, কোণে কোণে- ব্যবহৃত হইত। বাঙলাদেশ পাথরের দেশ নয়; কাজেই বহুল পরিমাণে পাথর ব্যবহারের সুযোগই ছিল না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইটের তৈরি মন্দির-বিহার ইত্যাদি ধ্বংস হইয়া মাটির ধুলায় মিশিয়া গিয়াছে; কতগুলি ভাঙা পাথরের টুকরা, অসংখ্য ভাঙা ইট ইতস্তুত বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িয়া আছে মাত্র। দু’একটি ক্ষেত্রে মাত্ৰ ইটের তৈরি বিহার, মন্দির অর্ধভগ্ন অবস্থায় কোনও রকমে দাঁড়াইয়া আছে, যেমন, পাহাড়পুরের মন্দির-বিহার, দক্ষিণবঙ্গের জটার-দেউল, বরাকারের মন্দির, সাত-দেউলিয়ার মন্দির, বহুলাড়ার মন্দির প্রভৃতিতে। তবু যে প্রাচীন বাঙলার ছোটবড় মন্দিরগুলির আকৃতি-প্রকৃতির কতকটা ধারণা আমরা করিতে পারি। তাহা বিশেষভাবে সম্ভব হইয়াছে পাথরের তৈরি সমসাময়িক দেবমূর্তির ফলকগুলির এবং রঙে-রেখায় আঁকা কয়েকটি পাণ্ডুলিপি-চিত্রের সহায়তায়। এই ফলক এবং চিত্রগুলিতে সমসাময়িক মন্দিরাদির কিছু কিছু নকশা সহজেই ধরিতে পারা যায় এবং ইহাদের সাহাযে৷ অর্ধভগ্ন মন্দিরগুলির মৌলিক চেহারাটাও ধরা পড়ে!

তক্ষণশিল্পে পাথর, কাঠ ও মাটি কালাতীত মৃৎশিল্প

মূর্তি-শিল্পে পাথরের তৈরি অর্থাৎ পাথরে খোদাই মূর্তি ইত্যাদি যাহা নির্মিত হইয়াছে তাঁহারই কিছু কিছু নমুনা আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিয়াছে নানা খনন ও অনুসন্ধানের ফলে। কিন্তু রাজমহল পাহাড় অথবা ছোটনাগপুরের পাহাড় হইতে পাথর আনাইয়া ভাস্করকে তাহার পারিশ্রমিক দিয়া মূর্তি নির্মাণ করাইবার মতো সামর্থ্য খুব বেশি লোকের ছিল না; সম্পন্ন সমৃদ্ধ লোকেরাই তাহা করিতেন এবং তাহাও বিশেষভাবে মন্দিরসজা এবং প্রতিমা-প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই। সেই জন্যই প্রস্তরভাস্কর্য-নিদর্শন যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহার প্রায় সমস্তই জৈন, বৌদ্ধ, এবং ব্রাহ্মণ্য দেব-দেবীর মূর্তি অথবা বিহার-মন্দির সম্পৃক্ত অলংকরণ-ফলক, স্থাপত্যাংশ বা ধর্মগত পুরাণ কাহিনীর প্রস্তরীকৃত প্রতিকৃতি এবং সেই হেতু অল্পবিস্তর প্রতিমা-লক্ষণ শাস্ত্র বা ধ্যান-সাধনের সূত্রদ্বারা নিয়মিত। দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব। গতিভঙ্গির এবং লোকায়ত প্ৰাণ-প্রবাহের পরিচয় সেই হেতু ইহাদের মধ্য ধরা পড়িবার সুযোগ কম; ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের বা আনন্দ-বেদনার প্রকাশও সেখানে সহসা ধরা পড়ে না। প্রাচীন বাঙলার প্রস্তর-ভাস্কর্যে বাঙালী মনের যে-পরিচয় পাওয়া যায় তাহা তাহার সংস্কৃতিপূত চিত্তের সমষ্টিগত গভীরতর ধ্যান-কল্পনার এবং সূক্ষ্মতর দৃষ্টির, যে দৃষ্টি ও ধ্যান কল্পনার যোগ সর্বভারতীয় দৃষ্টি ও ধ্যান-কল্পনার সঙ্গে। কাঠেও প্রচুর তক্ষণ ও মণ্ডণ কার্য হইত, সন্দেহ নাই, পাথরের চেয়ে বোধ হয় বেশিই হইত, কিন্তু আমাদের হাতে যে কয়েকটি নিদর্শন আসিয়া পৌঁছিয়াছে তাহদের ভিতরও একই ভাস্কর্য-লক্ষণ সুপরিস্ফুট। কাজেই, না প্রস্তরশিল্পে না কাষ্ঠশিল্পে সমসাময়িক লোকায়ত মানসের পরিচয় বিশেষ পাওয়া যায় না। সেই পরিচয় স্বভাবতই ধরা পড়িবার কথা মৃৎশিল্পে, বিশেষত গঙ্গা-মেঘনা-ব্ৰহ্মপুত্রের পলিবিস্তৃত বাঙলাদেশে। নদীর ধারে, পুকুর পড়ে, মাঠের মধ্যে বসিয়া কাদা লইয়া খেলা, আঁটালো মাটির নরম ঢেলা লইয়া বিচিত্র রূপ গড়া ও ভাঙা, ভাঙা ও গড়া, দৈনন্দিন জীবনের চলতি মুহূর্তের ক্ষণস্থায়ী কামনা-বাসনার, আনন্দ-বেদনার, বিচিত্র গতি ও স্থিতির নানারূপ— এই মুহূর্তে আছে। পরের মুহুর্তে নাই, এমন সব রূপের বাতি জ্বালানো এবং নেভানো, মাটির নরম তাল লইয়া খেলার ইহাই তো প্রকৃতি। কিন্তু, এই সব বিচিত্র রূপের লীলা প্রত্যক্ষ করিবার কোনও উপাদানই আজ আর আমাদের হাতে নাই। মাটিতেই যাহার সৃষ্টি মাটির ধুলায়ই কবে তাহা গিয়াছে মিশিয়া! তবু, এই সব রূপ কালজয়ী, কালাতীত; কালপ্রবাহকে অতিক্রম করিয়া তাহারা আজও আমাদের মধ্যেই বাচিয়া আছে; বাচিয়া আছে আমাদের ব্ৰতানুষ্ঠানের মাটির গড়া নানা মূর্তিতে, গ্রামের কুমোরের তৈরি নানা মাটির পুতুল ও খেলনায়। সেই প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু সভ্যতার আমলে সিন্ধুনদীর তীরে বসিয়া সমসাময়িক লোকেরা যে পুতুল তৈরি করিত, বাঙলার গ্রামে নদীর ধারে পুকুর পাড়ে বটের ছায়ে বসিয়া বাঙালী কুমোর, বাঙালী ব্ৰতধর্মী নারী আজও তাঁহাই করে।

কালধর্মী মৃৎশিল্প

কিন্তু আর এক ধরনের মাটির শিল্পরূপও লোকেরা গড়িত, গড়া শেষ হইয়া গেলে প্রয়োজন ফুরাইয়া গেলেই ভাঙিয়া ফেলিবার জন্য নয়, বা নেহাৎই খেয়াল-খুশীর খেলনার জন্যও নয়। সেগুলি লোকে ব্যবহার করিত ঘরের কুলুঙ্গি, মঞ্চ, দেয়াল প্রভৃতির সাজাইবার জন্য, আমরা যেমন ছবি দিয়া ঘর সাজাই; আবার সেগুলির সাহায্যে, সুযোগ পাইলেও প্রয়োজন হইলে, বড় বড় মন্দির, বিহার প্রভৃতির বহিরঙ্গ সজ্জাও হইত। বড় বড় মন্দির-বিহারে সুবিস্তৃত বহির্গাত্র শিল্পীরূপে ঢাকিয়া দিবার মতো পাথরের প্রাচুর্য বাঙলাদেশে ছিল না; কাজেই তখন ডাক পড়িত গ্রামের কুমোর শিল্পীদের। তাহারা তখন আসিয়া স্বল্প সময়ের মধ্যে ছাচের সাহায্যে অথবা হাতের আঙুলে টিপিয়া টিপিয়া অপেক্ষাকৃত স্বল্প আয়াসে ক্ষুদ্র বৃহৎ মাটির ফলক গড়িয়া চারিদিক ঢাকিয়া দিত জীবনের শোভাযাত্রায়। এই ধরনের অন্তত কিছুটা স্থায়িত্বের প্রশ্ন যেখানে ছিল সেখানে মাটির গড়া এই সব শিল্প-ফলক, ছোটই হউক আর বড়ই হউক, আগুনে পোড়ানো হইত। এই ধরনের পোড়ামাটির ছোটবড় শিল্প-ফলক বাঙলার নানা প্রত্নস্থান হইতে কিছু কিছু পাওয়া গিয়াছে’- খ্ৰীষ্টীয় শতকের প্রারম্ভ হইতে একেবারে অষ্টম-নবম শতক পর্যন্ত। সুপ্রচুর সংখ্যায় পাওয়া গিয়াছে পাহাড়পুর ও ময়নামতীর ধ্বংসাবশেষ হইতে। এই সব পোড়ামাটির ফলকগুলি ঠিক পূর্বোক্ত কালাতীত বা কালজয়ী প্রকৃতির নয়; বরং ইহাদের উপর কালের ছাপ সুস্পষ্ট এবং সমসাময়িক পাথরের তক্ষণ শিল্পের শিল্পরূপ ও ধারার প্রভাবও ইহারা একেবারে এড়াইতে পারে নাই। কিন্তু বিষয়বস্তু এবং লোকায়াত জীবনের প্রাণ-প্রবাহের দিক হইতে ইহাদের মধ্যে পার্থক্যও প্রচুর। পোড়ামাটির শিল্প সাধারণত দেবদেবীর মূর্তি নয়, কাজেই কোনও শাস্ত্ৰ বা নিয়ম-বন্ধন দ্বারা নিয়মিতও নয়! ইহাদের বিষয়বস্তু দৈনন্দিন জীবনের চলমান প্রবাহের লোকায়ত কথা ও কাহিনীর, ক্ষণস্থায়ী জীবন-রূপের; কোনও গভীর ভাব-রহস্যের, কোনও গভীর তত্ত্বের বা আদর্শের দৃষ্টিগ্রাহ্য রূপেরও নয়। বস্তুত, প্রাচীন বাঙালীর লোকায়ত শিল্পের প্রধান অভিজ্ঞান এই মাটির ফলকগুলিই।

প্রাচীন বাঙলার লোকায়ত চিত্রশিল্পের কোনও নিদর্শনই আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছায় নাই; অথচ তাহা যে ছিল না, এমন নয়। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকীয় বাঙলা পটচিত্রের ধারা প্রাচীন কৌম লোকায়ত খাতেই বহিয়া আসিয়াছে এবং তাহার কিছু কিছু প্রাচীন আভাসও সাম্প্রতিক গবেষণায় ধরা পড়িয়াছে। ধর্মানুশাসিত উচ্চকোটি-স্তরের যে চিত্ৰ-নিদর্শনের কথা আমরা কিছু কিছু জানি তাহা সমস্তই পুঁথিচিত্র; পুঁথিসজ্জা, পুঁথিবর্ণিত দেবদেবীর মূর্তি-পরিচয়ের জন্যই তাহাদের সৃষ্টি।