যুক্তি ও উপাদান – রাষ্ট্র-বিন্যাস
প্রাচীন বাঙলার সমাজ-বিন্যাসের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেখিতে হইলে রাষ্ট্র-বিন্যাসের চেহারাটাও একবার দেখিয়া লওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যক্তিবিশেষের খেয়াল মাত্র নয়, অর্থশাস্ত্ৰ-দণ্ডশাস্ত্র অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় ব্যাকরণের উদাহরণ মাত্র নয়; সমসাময়িক সমাজেরই রূপ কমবেশি রাষ্ট্রে প্রতিফলিত হয়, সেই সমাজের প্রয়োজনেই রাষ্ট্র গড়িয়া উঠে, অর্থশাস্ত্ৰ-দণ্ডশাস্ত্র রচিত হয়। কোনও শাস্ত্রের রীতিপদ্ধতি অচল ও সনাতন নয়; যখন সমাজের রূপ যেমন সামাজিক আদর্শ যেমন, সেই অনুযায়ী রাষ্ট্র গঠিত হয়, শাস্ত্র রচিত হয়; সেই রূপ ও আদর্শ যখন বদলায়, রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রীয় শাস্ত্রও বদলায়। কৌটল্যের অর্থশাস্ত্র বা শুক্রাচার্যের শুক্রনীতিসার সর্বদেশ সর্বকালে প্রযোজ্য নয়; সমসাময়িক কাল ও তদোক্ত দেশের রাষ্ট্রবিন্যাস-ব্যাখ্যায়ই তাহারা সহায়ক। কিন্তু সহায়ক মাত্ৰই, তাহার বেশি নয়।
প্রাচীন বাঙলার রাষ্ট্রবিন্যাস-ব্যাখ্যায়। এই ধরনের কোনও শাস্ত্ৰ-সহায় আমাদের সম্মুখে উপস্থিত নাই। যাহা আছে তাহা রাষ্ট্রযন্ত্রের বাস্তব ক্রিয়াকর্মের এবং বিভিন্ন শাখা-উপশাখার, বিভাগ-উপবিভাগের পরিচয়জ্ঞাপক কতকগুলি রাজকীয় দলিল-ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টি বা পটা ৷ ইহা স্বাভাবিক ও সহজবোধ্য যে, এই ধরনের পট্রে রাষ্ট্র-বিন্যাস সংক্রান্ত সকল সংবাদ পাওয়া সম্ভব নয়; ভূমি দান-বিক্রয়ের জন্য রাষ্ট্রযন্ত্রের যে-অংশের পরিচয় দেওয়া প্রয়োজন হইয়াছে সেইটুকুই শুধু আমরা পাইতেছি এবং পরোক্ষভাবে আরও কিছু কিছু সংবাদের ইঙ্গিত পাইতেছি। এই সব সংবাদ ও সংবাদের ইঙ্গিত কিছু কিছু প্রাচীনতর অর্থশাস্ত্ৰ-দণ্ডশাস্ত্রের ব্যাখ্যার সাহায্যে স্ফুটন্তর হয়, সন্দেহ নাই; কিন্তু এমন সংবাদও আছে যাহা এই সব শাস্ত্ৰে নাই, যাহা বিশেষ স্থান ও বিশেষ কালেরই সংবাদ। একাদশ-দ্বাদশ শতকের সমসাময়িক সাহিত্যগ্রন্ত হইতেও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত দুই একটি টুকরা-টাকরা খবর জানা যায়।
পূর্বাপর-সংলগ্ন তথ্য-সম্বলিত উপাদান পঞ্চম শতকের আগে পাওয়া যায় না। কিন্তু তাহার বহু আগে হইতেই উত্তর-ভারতে, বিশেষভাবে মগধ রাষ্ট্রকে কেন্দ্ৰ করিয়া, সুবিস্তৃত রাষ্ট্ৰীয় আদর্শ ও মতবাদ, জটিল অথচ সুসংবদ্ধ, বিভাগ-উপবিভাগবহুল, কর্মচারীবহুল, রাষ্ট্রযন্ত্র গড়িয়া উঠিয়াছিল; মৌর্যাধিকার কালে ভারতবর্ষে তাহার সুস্পষ্ট সুনির্দিষ্ট একটা রূপ আমরা দেখিয়াছি। মৌর্য রাষ্ট্রযন্ত্রই শক-কুষাণ আমলের রাষ্ট্রীয় মতবাদ ও আদর্শ এবং রাষ্ট্র-বিন্যাসের প্রভাবে গুপ্ত-রাষ্ট্রযন্ত্রে ও রাষ্ট্রীয়-বিন্যাসে বিবর্তিত হয়। মহাস্থান শিলাখণ্ড লিপির সাক্ষ্যে অনুমিত হয়, বাঙলাদেশের অন্তত কিয়দংশ মৌর্যরাষ্ট্রের করুকবলিত হইয়াছিল; তখন মৌর্য রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রাদেশিক রূপও এদেশে প্রবর্তিত হইয়াছিল, এরূপ মনে করিবার কারণ আছে। মৌর্য রাষ্ট্র-বিন্যাস উত্তর-ভারতীয় আর্য সমাজ-বিন্যাসেরই আংশিক রূপ; কাজেই এই অনুমান করা চলে যে, আর্য সংস্কার, সংস্কৃতি ও সমাজ-বিন্যাস বাঙলাদেশে বিস্তৃত হইবার সঙ্গে সঙ্গে আর্য রাষ্ট্র-বিন্যাসের আদর্শ এবং অভ্যাসও ক্রমশ ধীরে ধীরে প্রবর্তিত হইতেছিল। কিন্তু গুপ্তাধিকারের আগে আর্য সমাজ-বিন্যাস যেমন বাঙলায় যথেষ্ট কার্যকরী হইতে পারে নাই, মনে হয়, উত্তর-ভারতীয় রাষ্ট্রদর্শ এবং বিন্যাসও তেমনই পূর্ণাঙ্গ প্রবর্তন লাভ করে নাই। গুপ্তাধিকারের সঙ্গে সঙ্গে তাহা ঘটিল; ধর্মে, সংস্কারে, সংস্কৃতিতে, সমাজ-বিন্যাসে, যেমন, রাষ্ট্র-বিন্যাস ক্ষেত্রেও তেমনই বাঙলাদেশ এই সর্বপ্রথম উত্তর-ভারতীয় জীবন-নাট্যমঞ্চে প্রবেশ করিল। কাজেই, ঐতিহাসিক কালে বাঙলার রাষ্ট্র-বিন্যাসের যে-চেহারা আমরা দেখি তাহা গুপ্ত-আমলের উত্তর-ভারতীয় রাষ্ট্র-বিন্যাসেরই প্রাদেশিক ও স্থানীয় বিবর্তনের রূপ।