নন্দলাল শৰ্মা সংকলিত
রাধারমণ গীতিমালা থেকে গৃহীত কতিপয় গীতি
১
জানিয়া পার কর
দয়াল গুরুজী–
মোরে কাঙ্গাল জানিয়া পার করো।
দয়াল গুরুজী–
বানাইয়া রংমহল ঘর
অঙ্গে অঙ্গে জুড়া
নব কুঠার জ্বলছে বাত্তি
ষোল জন তার পারা।
দয়াল গুরুজী–
লাভ করিতে আইলাম ভবে
লাইয়া সাধের ধন
পড়িয়া কামিনীর ফেরে
হারাইলাম রতন।
দয়াল গুরুজী–
কত কত সাধু জনা
গাঙ্গে বাইয়া যায়
রঙ্গের নিশান পাল টাঙ্গাইয়া
প্রেমের বৈঠা বায়।
দয়াল গুরুজী–
সৰ্প হইয়া দংশো বা গুরু
উঝা হইয়া ঝারো
মরিলে জিয়াইতে পারো
যদি দয়া ধরো–
দয়াল গুরুজী–
কহে হীন রাধারমণ
অঙ্গ ঝর ঝর
ভবাৰ্ণবে তরী বাইতে
কিঞ্চিত দয়া ধরো।
২
প্ৰভু তোমায় ডাকি আমি হরিবল বলে
দয়া করি নেও আমায়ে তোমার নায়ে ভুলে।
দীন জনে পার করা গুরু ঠেকেছি ভবের জঞ্জালে
ভবের মায়ায় কাল কটাইলাম নেও দিয়ার ছলে।
ভবের ঘাটে দিছ খেওয়া দয়াগুণে আনা নেওয়া
পার কর দয়াল শুরু দীনহীন কাঙ্গালে।
মনমাঝি হয়ে বেভূল নাশ কইলো বিভব অতুল
এখন আর দেখিনা কুল তাই ডাকি দয়াল বলে।।
দয়া করি নেও মোরে ঠেকিয়াছি ভব সায়রে
শ্রীরাধারমণের আশা ঐ চরণ তলে।।
৩
আমার একী বিপদ ঘটলো গো
গুরুর নামটি নিবার আমার সময় নাই
আমি পড়িয়াছি ঘোর বিপদে
তরাইয়া লও আমায়।
ভাই বল বন্ধু বল সময় দেখে পলাইল গো
স্ত্রী বল পুত্র বল সঙ্গের সাখী কেই নাই।
ভাইবে রাধারমগ বলে ঠেকলাম ভবের মায়াজালে
আমি চাইয়া দেখি সব বিদেশী
আপন দেশের কেহই নাই।।
৪
হরির নাম লও রে মন লও কৃষ্ণ নাম ।
এই নাম জপিলে পূর্ণ হবে মনষ্কাম।।
হরির নাম বল রে বদনে বল হরির নাম
হরির নামের পার হব জগৎ, যাব নিত্যধাম।।
অনিত্য সংসারে আমার ডুবে আছে মন
হরির নামে চালাও বৈঠা চল বৃন্দাবন।
ভাইবে রাধারমণ বলে মানব জন্ম যায় বিফলে
আমি অন্তিমকালে লইতে যেন পারি হরির নাম।।
৫
দেহতত্ত্ব
অতি সাধের ঘর ভাঙ্গিয়া নিল এক দিনের তুফানে
এগো ভক্তিভাবে লাগোও পালা যে কোন সন্ধানে।।
ছয় ইন্দুরায় ভিটার মাটি কুড়ে রাত্র দিনে
এগো মাড়ইশ পালা যাহা ছিল সবেই খাইল ঘুণে।।
ছুটিল লাহুতের নদী কমতি হইল বল
বত্ৰিশ বালেদার ঘরখানি এক দিনে খসিবে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মানব জনম যায় বিফলে
আমার হবে না মানব জনম ভাঙলে মাথা পাষাণে।
৬
এই যে দেহতরী কে করিল সুগঠন
মেস্তরিরে চিনিলায় নারে মন।।
ঐ যে নাওয়ের আছে জোড়া জোড়ায় জোড়ায়
গিলটি মারা
কে করিল গঠন।।
লোহা ছাড়া তক্তা মারা, কিবা শোভা পাটাতন।।
এই যে নাওয়ের ষোল্লতালা
খুল্লায় নারে ও মন ভোলা ঘুমে অচেতন।।
তালা খুলবে যখন দেখবে তখন
মোহর মারা আছে ধন।।
একবার খুলে দেখা রে নয়ন।
রাধারমণ বলে দিল কালা তোর
জন্ম হইল অকারণ।
৭
বসে ভাবছ কীরে মন ভোমরা
ছয় চোরায় ডুবাইল তোমারে।
দিন গেল বেপথ বেসেবে, বুঝি আমার কর্মদোষে
আমার সাধন সিদ্ধি কিছুই হইল না রে।।
একটি গাছের ভাল পাতা নাই তার কোনো কাল
বেটু ছাড়া ধরছে ফুলের কলি রে মন ভোমরা।
ডাল আছে পাতা নাই এ ফুল ফুটিয়াছে সই
পদ্ম যেন ভাসে গঙ্গার জলে রে ভোমরা
ভাইবে রাধারমণ বলে ঢেউ উঠিল আপন মনে
যে গান ভাবিক ছাড়া বুঝবে না পণ্ডিতেরে।
৮
সজনী গো গুরু ধন ধন চিনলাম না।
অমূল্য ধন শুরুর চরণ ভজন হইল না।।
বেচিলাম জিনিস নগদ বাকী, লইয়া গেল দিয়া ফাঁকি
আর কতদিন বসে থাকি আসল উসল হৈল না।।
আমার মনেতে মন পাগল, বনে পাগল ময়না
হৃদয় পিঞ্জিরার পাখি সিয়ালে বেড়ায় না।
কামনদীতে তিন ধারা চিনতে পারলাম না
সেই নদী চিনতে পারলে তন্ত্ৰমন্ত্র লাগে না।
শ্রীরাধারমণ বলে আমার ঘাটে যাওয়া হইল না
বেভুলেতে দিন গায়াইলাম গুরুর চরণ ভজালাম না।
৯
ওরে পাষান মন রে জনমে হরির নাম ভোইল না।
ঐ হরির নাম লইলেরে শমনের ভয় আর রবে না।।
যখন ছিলে মা-র উদরে মহামায়ায় দামোদরে
মহামায়ার মায়ায় পড়ে শুরু কী ধন চিনলায় না।।
মহামায়ায় ছলে কোন রে মন ভুইলে রলে।
এ দেহা প্ৰাণান্ত হলে ঘৃণায় কেগ ছবে না।।
ধন যত সব রবে পড়ি সিন্দুকে সব রবে পড়ি
মইলে নিবে কড়ার কড়ি আম্রকাষ্ঠ দুইচার খানা।।
তীক্ষ্ণ আনন দিবে জ্বাইলে তার মাঝে পালাইয়ে
যতসব মায়া চাইলে সম্পর্কে কিছুই রবে না।।
যে নামে কারুল শঙ্কা যাবে তারে কোন ভেইলাছ রে
মিছে পরবাসে করতে আছ কালযাপনা।।
কালগত যবে হবে দারাসুত কোথায় রবে
ভাইবে রাধারমণ বলে সঙ্গের সঙ্গী কেও হবে না।।
১০
কৃষ্ণনাম লও রে মন দুরাচার
কৃষ্ণ বিনে সকলি অসার।।
পানি উঠে ভাঙ্গা নাওয়ে কার ভরসায় বৈঠা বাও রে
নৌকা আস্তে আস্তে তল অইলো রে।।
যখন নৌকা অইল অতুল অখন করো কার বল রে
ভাই বন্ধু সবই রইলা চাইয়া রে।।
সঙ্গে নিলাম মাঝে বেটা সে ফালাইয়া গেল বৈঠা
শুধু নৌকা ফিরে ঘাটে ঘাটে রে।
ভাইরে রাধারমণ বলে মানব জনম যায় বিফলে
জীবন সহিতে অইবায় পার।
১১
তুমি চিনিয়া মানুষের সঙ্গ লইও
পাষাণ মন রে বুঝাইও
যদি হয় রে সুজন, তার কাছে না যাইও মনরে
তুমি নিদাগেতে দাগ লাগাইবার চাইও।
ভাইবে রাধারমণ কয়, শুন মন মহাশয়রে
তুমি রসিক পাইলে রসের কতা কইও।।
১২
দেহের মাঝে আছে রে মন গোলোক বৃন্দাবন
দেহের বাতি জ্বালাইয়ে দেখরে যুগল মিলন।।
মন রে
এ দেহ করিয়া শুচি বৈষ্ণব হৈল রুহিদাস মুচি
পেয়ে কৃষ্ণধন
পঞ্চপাণ্ডব এক হইয়া রুহিদাসকে করায় ভোজন।।
মন রে
দাতাকৰ্ণ পদ্মাবতী গুরুপদে কইরে মতি
তারা দুইজন,
তারা আপন পুত্রের মুণ্ড কেটে
ব্রাহ্মণে করায় ভোজন।।
১৩
পাষাণ মন রে জীবনে হরির নাম ভুল না
হরির নাম নিলে রে মন যাবে রে ভবের যন্ত্ৰণা।।
মন রে, যখন ছিলে মারি উদরে ভজব বইলে দামোদরে
মিছা মায়াতে পড়ে সে কথা তোর মনে নাই
গনার দিন ফুয়াই গেলে সেদিন আর আসবে না।
মন রে যখন তোমার কফ অসিরে, ক্রমে ঊর্ধ্বশ্বাস বহিবে
ঘরের বাহির কইরা দেবে আরতি ঘরে রাখবেনা।
মনরে ভাইবন্ধু প্ৰতিবেশী শিয়রেতে কাঁদবে বসি
তখন তোমার প্রাণপ্রিয়সী চউখ ভুলে চাইবে না।।
মন রে মরলে নিবে শ্মশানঘাটা রইবে দালানকোঠা
বিষয় বিত্ত কোন কিছু সঙ্গে যাবে না।।
মন রে যত সব টাকাকড়ি সিন্দুকেতে রবে পড়ি
সঙ্গে নিবে পাঁচ কড়ি আম্র কাষ্ঠ দুচার-খানা।
১৪
যার মুখে হরিকথা নাই, মন তার কাছে তুমি যাইও না।
মন রে, একাই এসেছে ভুবন মাঝারে
অবিলম্বে কর যাহা করিবারে
দুদিনের খেলা দুদিনে ফুরাবে অনন্ত সাগর মাঝে।
মনরে হরিনাম গাও, হরিনাম লও
হরি নামে সদা সুখে রও হও
হরি নামে গীত গাও অন্য গীত গাইও না।।
১৫
রে মন কী রসে ভুলিয়াছে
অসার সংসারে আশা
ভরসা করিয়াছো।।
দেহকে আপন জেনে
যতন করিয়াছো
তুমি নি তোমার মন রে
আপন জানিয়াছো।
যাইবার বেলা সঙ্গে সাথী
কেবা করিয়াছো
ভাই বন্ধু সুতদারা
আপনা জানিয়াছো।।
ভাইবে রাধারমণ বলে
মনেতে ভাবিয়া
ব্রহ্মানন্দের দেহতরী
শুকনায় ভাসাইয়া।।
১৬
সহজ সাধন রে মন গুরু ভজনা রইল না।
শুরু কৃষ্ণ রূপে রে মন শাস্ত্ৰে ঠিকানা।
মন জন্ম গুরু কল্পতরু, দীক্ষা শিক্ষা গুরু
গুরু কল্পতরু রে মন, তার কি নাম না।
গুরু নিঃশ্বাসেতে মুক্ত রে মন ভাব বন্দনা।
মন শ্ৰীরাধারমণের গাথা, শুনিয়ে ভগবদগীতা
সাধু সঙ্গে কৃষ্ণ রে মন ভক্তি-সাধনা।
১৭
সোনার ময়না ঘরে থইয়া বাইরে তালা লাগাইছে
কোন রসিকে পিঞ্জিরা বানাইছে।।
মন রে দীক্ষা লইলাম গুরুর কাছে, শিক্ষা লইতোম কার কাছে
গুরুর হাতের চাবি নিয়ে দেখ না তালা খুলে।
মনরে একটি নদীর দুইটি ধারা উজান ভাটি হইতেছে
সেই নদীতে স্নান করে কত সাধু সন্ত তারিয়া গেছে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে, মানবজনম যায় বিফলে
আর হবে না মানবজনম ভাঙলে মাথা পাষাণে।।
১৮
হরি বল রে মনরসনা শুনরে কৃষ্ণ নাম
ও তোর পূর্ণ হবে মনোবাঞ্ছা লিও হরিনাম।
হরি বল রে বদনে, হরির নাম তিন প্রভুর মর্ম
এক মনে ভাবনা করে ছয় গোস্বামীর ধর্ম।।
নামের তুল্য ধন কী আছে গৌর নাচে নিতাই নাচে
কাষ্ঠতরী হইল সোনা পাইয়া কৃষ্ণনাম
বদন বলে হরিবল নাম জপ রে অবিরাম
শ্ৰী রাধারমণে বলে জপ হারে কৃষ্ণ রাম।।
১৯
আমার প্রাণ কান্দে গো প্ৰাণসখী
গৌর বিনে সদায় দুঃখী
চরণ পাব পাব বলে আশাতে প্রাণ কয়দিন রাখি।
যদি গৌরার কলাগাল পাইতাম, হৃদয়ে ছাপাইয়া রাখতাম
শ্ৰীচরণে দাসী গো হাইতাম।।
চরণ কেশ দিয়া মুছাহতাম। অগুরু চন্দন মাখি
ভাব কল্পতরু মূলে সুরধনী নদীর কুলে
দুই রঙে ফুটিয়াছে একটি ফুল
প্ৰেম গাছে ফুল ফটেছে নিত্য নতুন স্বর্ণমুখী
ফুলের গন্ধে জগৎজোড়া পেয়েছে রসিক যারা
প্ৰেমানন্দে উঠছে এক লহরী
ভাইবে রাধারমণ কয়, গৌরচরণ পেলাম কই
আর পাব কি?
২০
সুরধুনীর তীরে গো সোনার গৌর উদয় হইয়াছে
দেখবে যদি আয় গো তোরা, কী শোভা ধরেছে গো।।
অঙ্গে শোভে নামাবলী আনন্দে দুই বাহু তুলি
হরি বলা হরি বল বলি প্ৰেমানন্দে নাচে গো।
যতই দেখি সাধ মিটে না, এ জগতে নাই তুলনা গো
আমায় মনে জলয় তার সঙ্গে যাইতাম
আমার কপালে যা আছে গো
ভাইবে রাধারমণ বলে আমি গৌর পদে সপিব গো।
২১
রাধারানীর প্রেমের আশ্রয়
রসিক নাগর শ্যামারসময়
কলির জীবের ভাগ্যে গৌরা
নদীয়াতে হলেন উদয়।।
ব্ৰজলীলা করে সাঙ্গ
রাধাপ্রেমে হয় উদাসী
চূড়াবাঁশি ত্যাগ করিয়া
হলেন নবীন সন্ন্যাসী।।
গৌরাচান্দে ধরিয়াছেন
নবীন কৌপীন করঙ্গ
যেই জনের কর্মভার
লয় আসি এই সাধুসঙ্গ।।
প্ৰেমবাজারে বিকিকিনি
হাটের রাজা রাধারানী
রঘুনাথ প্ৰেমধনে ধনী
রাধারমণের নাই আশ্রয়।
২২
অয় গো সখী অন্যে জানে কেমনে
গৌরপ্রেমের ঢেউ উঠিয়াছে যার মনে।।
সে তো অধর চান গৌরা তারে ধরতে গেলে না দেয় ধরা
অয় গো সখী ধরা দেয় রে আপনে।।
সে তো তোর কৌপীনধারী পিরিাতের ভিখারী
গোপীর মন করল চুরি–
সেজে রাধা রাধা রাধা বইলে ধারা বয় দুই নয়ানে
গৌরপদে মজাও রে মন কয় শ্ৰীরাধারমণে।
২৩
গৌরচান তোমায় পাব আর কতদিন বাকি
তুমি একবার না দিলায় দেখা জন্মভরা ডাকাডাকি।
যখন ছিলাম যার উদরে গৌরচান কতই না বলেছ আমারে
এ জনামে হবে দেখাদেখি।
আমারে পাঠাইয়া ভাবে ও গৌরচান তুমি কোথায় দিলায় লুকি
এখন জন্ম নিলাম ভূমণ্ডলে মনুষ্য উত্তম কুলে
তোমার ভুলে আর কতদিন থাকি
ভাইবে রাধারমণ কয় যদি গৌরার দয়া হয়
চরণ তলে আশ্রয় দেও দেখি।।
২৪
গৌরচান দয়া করে দেখি
তুমি পতিত পাবন তোমার নামে উদ্ধারিবে নাকি।।
আমি না জানি সাধনভজন কোন গুণে তোমায় ডাকি।
আমি বনে বনে কান্দি বেড়াই মন হইতেছে চাতক পাখি।।
পুষ্পচন্দন হৈতরে গৌর অঙ্গে মাখিয়া রাখি
আমার মনে লয় শুধু গৌর নয় রাইর প্ৰেমে মাখামাখি।।
ভাইবে রাধারমণ বলে, ঝুরে দুটি আঁখি
তুমি পতিত পাবন গৌর দয়াময় পতিতাকে উদ্ধারো নাকি।
২৫
গৌরচান পরার অধীন বানাইলা আমারে
সুরধনীর তোরে তীরে গৌরচান নৃত্য করে
গৌরা আঁখি টেরে ভুলাইলা আমারে।।
গৌরা যারে কৃপা করে অনায়াসে তরাইতে পারে
তুমি ভবযন্ত্রণা দিও না আমারে।
ভাইবে রাধারমণ বলে রেখো গৌর চরণ তলে
তুমি চরণ ছাড়া কইরা না আমারে।।
২৬
গৌরচান্দ রাইকিশোরীর ভাবসাধিকে
প্ৰেমরসে ভাসাইল রে অবনী।
প্রেমরসের গুরু কল্পতরু
অনন্ত প্ৰেমধনের ধনী।।
কলির জীবের ভাগ্যে হইয়ে সদয়
ব্রহ হইতে শ্যামরায় নদীয়ায় উদয়
উদয় শচীর গর্ভসিন্ধু মাঝে
পতিত পাবন নামটি শুনি।।
পতিত পাষণ্ডী যে ছিল
পাপী তাপী তারিয়ে গেল
কলির জীবের কারণ নাম ধরিয়াছে
পতিত পাবন কৰ্ণে শুনি।।
রাধারমণ মরলে তবে
নামেতে কলঙ্ক রবে এ ভবে
আমি নরাধমকে তরাইলে
পতিত পাবন নামের গুণ বাখানি।।
২৭
গৌরনামে চলছে গাড়ি যাবে বৃন্দাবন
দয়া করে তুলে নেও মই অতি অভাজন।
নিষ্ঠাকাষ্ঠে যোগান বারি, ভক্তির অনল প্ৰেমবারি
কাজে কয়লা হয়না দাহন
দিবারাত্র বিরাম নাই কলের কোঠায় রূপাসনাতন
দমকালেতে চাপি দিয়া চালায় তারে মহাজন
দোকানদার চতুষষ্ঠী কেনাবেচায় রসিকজন
পলকে পলকে চলে গাড়ি বসে দেখে রাধারমণ।।
২৮
জয় গৌরার নামে বাদাম তুলি দেও ডঙ্কায় বাড়ি
বিপদকালে নাম জপ শ্ৰীগৌর হরি।।
গৌরা তোর কপিন ধারণ করি হরিনাম বিলাইছে
দয়া করি সঙ্গে নিবায় পারে যাইবার কালে
ও মাঝি রে অকুলে ধইরাছ পাড়ি তুফান উঠ্যাছে
এই নিবেদন রক্ষা করা পারে। যাইবার কালে।
ভাইবে রাধারমণ বলে, স্টেীয় তোমার চরণে পড়ি
অন্তিম কালে চরণ ধূলি দিও দয়া করি।
২৯
গউর রূপের ফান্দে ঠেকাইল আমায় গো, ও নাগরী।।
য়গো রূপে দাসী কইরে সঙ্গে লিতে চায় গো।।
আমি গিয়াছিলাম সুরধুনী আমি হেরলাম গৌরচান্দ গুণমণি
এমন রিসের খনি না দেখি জগতে গো।
জুড়-ভুরু দুটি আখি গৌরায় বাকা আখি রাখে গো
গউরার আখির ঠারে কারে না ভুলায়।।
ভাইবে রাধারমণ বলে তাহারে পাইতাম যদি কোন কলে গো
আমার প্রাণ জুড়াইতাম রাখিয়া হিয়ায়।
৩০
নাম নিয়ে ভাই নইদে আইল নিতাই গুণমণি
সেই অবধি হরির নাম নবদ্বীপে শুনি।
এমন দয়াল দেখি না ভাই দয়ার শিরোমণি
ওরে আনিয়া গোলোকের প্ৰেমধন বিলাইল আপনি।
পাপীতাপী যত ছিল তারা হইল ধনী
আপনার কর্মদোষে বঞ্চিত হইলাম আমি।
শ্ৰীরাধারমণ বলে আইল গৌরমণি
পথিককে করুণা করি মাইরা খাইল আপনি।
৩১
দেইখে আইলাম শ্যামকালা গো সজনী
জলের ঘাটে কদমতলে মধুর রূপ খানি।।
শ্যামের মাথায় মোহন চূড়া গলায় বনমালা
মোহন বাঁশি হস্তে লইয়া দাঁড়ায় কদমতলা।।
শ্যামের পরণে শোভিয়াছে নীলাম্বরী শাড়ি
শ্যামের পদেতে শোভিয়াছে পঞ্চ কাঠিখাড়ি।।
ঝুনুর ঝুনুর বাজে খাড়ি মধুর ধ্বনি শুনি
গোসাই রমণচান্দে বলে জলে যাও গো ধনি।।
৩২
শুন গো সাঁই ঐ বাজে গো বাঁশি।।
মনপ্ৰাণ সহিতে টানে লাগাইয়া বরিশি।
অমিয় বরষন করে গো নিরলেতে বসি।।
যে নাগারে বাজায় বাঁশি হইতোম চাই তার দাসী।।
কি মন্ত্র মোহিনী জানো গো বাঁশি কুলবিনাশী
বারি বিনে চাতবিচনী হইয়াছে পিপাসী।
মোহন মধুর স্বরে গো হইয়াছে উদাসী
শ্ৰীরাধারমণে বলে কৃষ্ণ অভিলাষী।
৩৩
সজনী জলে গিয়াছিলাম একেলা
রাখছে না গো শ্যাম কালা
একাকিনী পাইয়া বন্ধে গো
করিয়াছে রসের খেলা।।
জল ভরিতে গিয়েছিলাম আমি এক অবলা
এগো পরাণে বন্ধু রক্তে রসে গো
বন্ধু মনচোরে করে উতলা
রেখেছে নাগো শ্যাম কালা।।
ভাইবে রাধারমণ বলে শোন গো অবলা
এগোতোরে নিষেধ করি ও নাগরী
যাইছ না জলে একেলা।।
৩৪
অনুরাগ
আমি পাগলিনী হইলাম যার লাগিয়া গো রূপ দেখিয়া
এগো সে জনারে একেবারে এনে দেখাও না আনিয়া।।
নয়নে দেখিলাম চাইয়া জলের ঘাটে শ্যাম কালিয়া
সে যে স্থিরে বসি বাজায় বাঁশি হাসিয়া হাসিয়া
হেন কালে শ্যামনগরে বাঁশি থইয়া আমার ধারে গো
এগো কলসীখানি ভেসে গেল প্রেমের ঢেউ লাগিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনের আশা রইল মনে গো
রূপ দেখিয়া প্রেমের লাগি কাঁদে আমার হিয়া।
৩৫
আমার বন্ধু দয়াময়, তোমারে দেখিবার মনে লয়
আরে তোমারে না দেখলে রাধার জীবন কেমনে রয়।।
কদম ডালে বইসারে বন্ধু রঙ্গে ঢঙ্গে আগা
শিশুকালে প্ৰেম শিখাইয়া যৌবন কালে দাগা।।
তমাল ডালে বইসারে বন্ধু বাজাও রঙ্গের বাঁশি।।
সুরা শুনিয়া রাধার মন হইল উদাসী
ভাইবে রাধারমণ বলে মনের কথা কয়
কৃষ্ণ প্রেমে রাধার মন প্ৰেমানলে দয়।।
৩৬
আমার মন মজিল গো সই কাল চরণে
আর নীলাম্বরী পীত ধড়া হাতে বাঁশি মাথে চূড়া
এগো চূড়ার উপর ময়ূর পাখা ঝলকে।।
আমি থাকি রূপবাণে সে থাকে তার অন্য ভানে
ও নিষেধ মানে না মানে গো আমার পরাণে
ভাইবে রাধারমণ বলে শুনগো রাধা বিনোদিনী
এগো আসবে কালা দিবে জ্বালা আমায় এখনি।
৩৭
কী হেরিলাম প্ৰাণসখী শ্যামরুদপে ধিকিধিকি
রূপের কথা বলব কত বিজুলি চটকের মতো
দাঁড়াইয়াছে কদম্ব তলায়।
কাজল বরণ কালা গলে শোভে বনমালা
মোহন বাঁশি আছে কার কপালে।
মেঘেতে বিজুলির ন্যায় রূপকে কেমন দেখা যায়
রূপের ছটায় যুবতীর মন ভুলে।
ভাইবে রাধারমণ বলে স্থান দিওনা কৰ্ণমূলে
সবে মিলে করুক কানাকানি।
৩৮
কে তোরে শিখাইল রাধার নামটিরে শ্যামের বাঁশি
রাধা রাধা বলে মন করলায় উদাসীরে।।
যখন শ্যামে বাজায় বাঁশি বযমুনাতে কাকে কলসী রে
জল ভরা তো হইল না মোর ভেসে যায় কলসী রে।।
তার বাঁশিতে মধু ভরা মন প্ৰাণ করিল সারারে
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম ঘরের বাহির হইয়ারে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে রে
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম চিরদাসী হইয়ারে।।
৩৯
জলে যাইও না গো রাই
আইজ রাধার জলে যাওয়ার জাতের বিচার নাই
মায়ে পিন্দইন যেমন তেমন ভইনে পিন্দইন শাড়ি
শ্ৰীমতী রাধিকায় পিন্দইন কৃষ্ণানীলাম্বরী।
ভাইবে রাধারমণ বলে শোন গো ধনী রাই
কালার লাগি হইছইন পাগল, কমলিনী রাই।।
৪০
জলের ঘাটে চলে গো সখী জলের ঘাটে চল
কালার রূপ হেরিব নয়ন ভরি, চল গো সখি চল।
আমি নয়ন ভরি হেরব সেরূপ দাঁড়াইয়া জলে
বনফুলে মালা গাঁথি দেব বন্ধের গলে।।
ঐ বাজে মোহন বাঁশি শুন গো শ্রবণে
প্ৰাণ হরিয়া নিল কালা ঐ বাঁশির টানে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে, করি জলের ছল
কাল রূপ দেখিতে জলের ঘাটে চলে গো সখী চল।
৪১
প্ৰাণবন্ধু দাসীরে ফিরিয়া চাইও
অবলা রাধারে বন্ধু মনেতে ভাবিও।
নিতি নিতি চুপে আইস যাওয়া কোন রূপেরে
ওগো ননদীর ডরে বন্ধু আমায় না ছাড়িও।
মুই যাইমু যমুনার জলে, ও বন্ধু তুমি যাইও কোন ছলেরে
এগো কদমডালে বসিয়া বন্ধু বাঁশিটি বাজাইও।
তুমি আমার প্রাণপ্ৰিয় আমায় শান্ত ক্র দেখা দিয়া রে
আমার বিষাদ সংকটের কালে যুগল চরণ দিয়ো গো।
দীনহীন কাঙ্গাল আমি ঠেকিয়া রইমু মায়াজালে রে
ওগো শ্ৰী রাধারমণে বলে দুঃখ দিলে দুঃখ সইও।
৪২
বাজায় বাঁশি ঘনাইয়া ওগো
নিগূঢ় কদম্বতলে বাঁশি বাজায় রাত্ৰিদিনে গো
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম নাচিয়া নাচিয়া গো
পাইতাম যদি রাখতাম বাঁশি কাড়িয়া কাড়িয়া গো
ভাইবে রাধারমণ বলে, দণ্ডবৎ পিরিাতের পদে
এগো মনে লয় তারে যৌবন দিতাম
যাচিয়া যাচিয়া গো।
৪৩
যাব না আর জলে সই গো আর যাব না জলে
জলের ঘাটে শ্যাম নটাবর দেখছি কদম তলে।।
কদমতলে বসি শ্যামে বাজায় যখন বাঁশি।
ধুমার ছলে কানতে থাকি যখন রানতে বসি।।
সব সখি লৈয়া সঙ্গে জল ভরিতে গেলাম রঙ্গে
কালার রূপ দেখিয়া ভুলে রৈলাম কালা কদম তলে।
ভাইরে রাধারমণ বলে কালা আছে রাইয়ের ছলে
কদম তলে বাজায় বাঁশি রাধা রাধা বলে।
৪৪
শুন এগো প্রাণ লতিকা কি বলব বাঁশির কথা
ধ্বনি শুইনো গৃহে থাকা দায়।
শুনিয়া বাঁশির ধ্বনি, মন হৈয়াছে পাগলিনী
তারে না হেরিলে প্ৰাণ যায়।
যত নারী আছে ব্ৰজে সবাই থাকে গৃহকাজে
আমি গৃহে রহিতে না পারি।
ঘরে গুরুজনের জ্বালা তার উপরে বাঁশির জ্বালা
এত জ্বালা সহিব কেমনে
ধরি সখি তোদের পায় কোথা শ্যামে বাঁশি বাজায়
রাধারমণ বলে চলে যাই সেথা যাই চলে
যেথায় শ্যামে বাঁশিটি বাজায়।।
৪৫
দেবর আসিয়া কইনা দেওগো দিদি জাঠা
কি অইতে কি হুনিয়া আনিয়া দিলাম পাটা।
আরি বাড়ির প’রি আইলা দিতাম। করি সাদা
ধুতুরা পাতা দিতে কইন বাউলা কেনে দাদা।
ভাবিয়া রাধারমণ বলে বাঁশি জ্বালায় এই
এমন কেউ কয় না। আমি বান্ধব আনিয়া দেই।
৪৬
নাগরি জিজ্ঞাসি তোমারে
কহ তোমার মানের কথা ভালবাসো করে।
মনে বড় বাঞ্ছা হয় তাহা শুনিবারে
না জানি কী ধন দিয়া ভুলইয়া তোমারে।
প্ৰাণপ্ৰেয়সী রাখি তুমি আইলায় কেমন করে।
তোমারে না দেখিয়া যদি সেই রমণী মরে।
ধর্মের দোহাই দিয়া তোমায় বলি বারে বারে
আমার মত প্ৰেমানলে পুড়িও না তারে।।
সারা নিশি গত করি আসিয়াছ ভোরে
রমণ বলে নিভইল আগুন জ্বালাই ও নারে।
৪৭
শ্যামচাদ আমার মন নিল কাড়িয়া
জলের ঘাটে গিয়েছিলাম জলের লাগিয়া।
শ্যামে নষ্ট করল জাতিকুল, তার জন্য মন বেয়াকুল
শ্যামের জালায় মারি সই গো কান্দিয়া কান্দিয়া।।
প্ৰাণটা বান্ধা শ্যামের কাছে, শ্যাম যায় চলিয়া
আমি পাগলিনী হইয়া বেড়াই ঘুরিয়া ঘুরিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে কি কাজ আর জাতিকুলে
দাসী হয়ে সঙ্গে যাব বুকুলমান ত্যেজিয়া।
দৌত্য
৪৮
চন্দ্রার কুঞ্জে বৃন্দাদুতী শ্যামচাঁদ তাল্লাসে যায়
বইলা দেগো চন্দ্রাবলী রাধার বন্ধু পাই কোথায়।
দেইখা চন্দ্ৰা করি গো বৃন্দা শ্যাম আমার কুঞ্জে যায়
প্ৰেমময়ী শয্যা আজি সাজাইয়াছেন রাধিকায়।
ভাইবে রাধারমণ বলে চন্দ্রাই তো ভালা নায়
শিখাই বুঝাই পরার বন্ধু আর কতদিন রাখিবায়।
৪৯
আইল না শ্যাম প্ৰাণবন্ধু কালিয়া
বৃথা গেল জীবন আমার নিকুঞ্জ সাজাইয়া।।
আসবে বলে বংশীধারী আশান্বিত হইয়া
রাখিলাম চুয়া চন্দন কটরায় ভরিয়া।।
শোন গো তোরা সব সখী এখন উপায় করি কী
কার কুঞ্জে রইল বন্ধু আমায় পাশরিয়া।।
লবঙ্গ মালতীর মালা সাজাইলাম গো শ্যাম কালা
এগো দেও নি মালা জলেতে ভাসাইয়া।।
শ্ৰীরাধার নয়ন জলে বসন যায়। ভাসিয়া।।
সই গো তোমরা উপায় বল, সুখের নিশি গত হইল
রাধার বন্ধু রৈল পাশরিয়া।
ভাইবে রাধারমণ বলে দুক্ষেতে আস্তর জ্বলে
আনও নিবাও গো সখী প্ৰাণবন্ধু আনিয়া।
৫০
কার কুঞ্জে নিশি ভোর রে, রসরাজ রাধার মনচোর
সারা নিশি জাগরণে আঁখি হইল ঘোর।
হাসিয়া ঢলিয়া পড়ে যেমন নিশা ঘোর
কোন কামিনী দিল তোমার কপালের সিন্দুর।
নিশি ভোরে আসিয়াছ নিদয়া নিষ্ঠুর
পথ হারা হইয়া নাকি আইলায় এত দুর।
মিটি চও বন্ধু রাধার মনচোর
রমণ বলে রাধার হাতে বিচার হবে তোর।।
৫১
না আসিয়া মনচোরা নিশি হইল ভোর
পুরুষ ভ্ৰমর জাতি নিদয়া নিষ্ঠুর।।
কোকিলার রব শুনিতে মধুর
কুহু কুহু রব করি ডাকিল ময়ূর।
বাসি হইল ফুলের মালা তামুল কাপূর
আসা পথে চাইয়া থাকি দুইটি আঁখি ঘোর।।
মনের আশা মনে রইল হিয়া জ্বলে ঘোর
রাধারমণ বলে সে তা হয় না ঘটের ঠিাকুর।।
৫২
বন্ধু, যদি যাও রে ছাড়ি’–
গলে দিমু কাটালি ছুরি।
ওয়রে তোমার লাগি–
ত্যজিতাম পরান রে।।
আর চুয়াচন্দন থইছি আমি
কটরায়—কটরায় ভরি
ওরে, দেখলে চন্দন উঠে কান্দন–
কার অঙ্গে ছিটাই রে।।
আর কেওয়া পুষ্প, ফুল মালতী–
আমি বিনা সুতায় মালা গাঁথি।
ওয়রে দেখলে মালা উঠে জ্বালা
কার গলে পরাই রে।।
আর অভাবে রাধারমণ বলে,
প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে
ও তার নয়ন জলে বক্ষ যায়—ভাসিয়া রে।।
৫৩
কুঞ্জ সাজাও গিয়া, আসবে শ্যাম কালিয়া
মনোরঙ্গে সাজাও কুঞ্জ সব সখি মিলিয়া।
জবাকুসুম সন্ধ্যামালী আনি রে তুলিয়া
মনোসুখে গাঁথা মালা কৃষ্ণ নাম লৈয়া।।
সব সখি সাজাই কুঞ্জ থাক রে বসিয়া
সুখের নিশি গত হয় আসে না বিনোদিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে সখি না কান্দ বসিয়া
নিশিভোরে আসবে শ্যাম বাঁশরি বাজাইয়া।।
৫৪
বন্ধু আইলায় না আইলায় না আইলায় না রে
দারুণ কোকিলার রবে বুক ভাসিয়া যায় রে।
এক প্রহর রাত্র বন্ধু আউলাইল মাথার কেশ
বন্ধু আসিলে বলি ধরি নানান বেশ।।
দুই প্ৰহর রাত্ৰ বন্ধু বাটা সাজাইল পান
বন্ধু আসিবে বলে পাইলাম অপমান।
তিন প্রহর রাত্ৰ বন্ধু গাছে ফুটিল ফুল
নিশ্চয় জানিও বন্ধু গন্ধে ব্যাকুল।।
চাইর প্রহর রাত্র বন্ধু সাজাই ফুলের শয্যা
বন্ধু আসিবে বলি পাইলাম বড় লজ্জা।
পঞ্চপ্রহর রাত্র বন্ধু শীতল বাতাস বয়
নিশ্চয় জানিও বন্ধু তুমি আমার নয়।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া।
অভাগিনী চাইয়া রইছি পন্থ নিরখিয়া।।
৫৫
যাও রে ভ্রমর পুষ্পবনে পুষ্প আন গিয়া
আজ রাতে আসবে কুঞ্জে বন্ধুশ্যাম কালিয়া।।
অপরাজিতা টগরমালী, গোলাইব ফুল তুলিয়া
ওগো সাজাইতাম বাসকসজ্জা সব সখী লইয়া।।
গাঁথিতাম ফুলের মালা প্ৰাণবন্ধুর লাগিয়া
সন্ধ্যামালী ফুলের মালা বাসি হইয়া গেলা
কোন পথে গেলা ভ্ৰমর পথ ছাড়াইয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আসিবা তোমার বন্ধু বাঁশরী বাজাইয়া।
৫৬
ওরে আজ কেন রে প্রাণের সুবল রাই এলো না। যমুনাতে
আমি রাই অপেক্ষায় বসে আছি হাতে নিয়ে মোহন বাঁশি রাই এলো না।।
সুবলেরে বল বল সুবল সখা কত দিনে হবে দেখা, রাধার কথা বল রে গোপনে
আমি রাই আসিলে জিজ্ঞাসিবো না আসিলে সময় মত।
সুবলরে না জানি রাই কি কারণে বিচ্ছেদ ভাবিয়া মনে
মান কইরাছে বিনা অপরাধে আমি রাই সুখেতে প্ৰাণ ত্যজিব
পারলাম না রাইর মান ভাঙ্গাতে।।
সুবলরে মনের দুঃখ মনে রইল সকল দুঃখ বরণ বর
সকল দুঃখ রইল রে অন্তরে।
রাধারমণে কয় ওরে সুবল কাজ নাই আমার এ পিরিতের।।
৫৭
নিশি শেষে কেনে এসে দেও রে কালা যন্ত্রণা
তুমি যে শ্যাম চন্দ্রার বন্ধু ডাকি আমি জানি না।
মুখে বল রাধার বন্ধু অন্তর তোমার ভাল না
জানতাম যদি রাই রঙ্গিনী তোমায় প্ৰাণ সঁপতাম না।
মান করে রাই কমলিনী কালরূপ আর হেরব না
এবার বন্ধু পড়লে মোরে কাদলে মান আর ভাঙবো না।
ভাইবে রাধারমণ বলে কেন করা ভাবনা
কাজ তোমার আছে রাইরা পায়ে কোন ধর না।।
৫৮
বিশখা গো সখা আমার কুঞ্জে আইল না
আমি কার লাগি বিছাইলাম ফুলের বিছানা।।
আইলাম গো কাল শশী গাথামালা হইল বাসি
বাসি মালা পালাও যমুনা
এগো কেনে আইলাম অরণ্যেতে
মন মানুষের মন পাইলাম না।।
হাতের পুলা চুয়া চন্দন, এসব দেখে আসে কান্দন
আমার বিলাস কুঞ্জে বিলাস হইল না।
৫৯
মান ভাঙো রাই কমলিনী চাও গো নয়ন তুলিয়া
কিঞ্চিৎ দোষের দোষী আমি চন্দ্রার কুঞ্জে গিয়া।।
এক দিবসে রঙ্গে ঢঙ্গে গেছলাম চন্দ্রার কুঞ্জে
সেই কথাটি হাসি হাসি কইলাম তোমার কাছে।।
আরেক দিবস গিয়া খাইলাম চিড়া পানের বিড়া
আর যদি চাই চন্দ্রার কুঞ্জে দেও গো মাথার কিরা।
হস্তবুলি মাথে গো দিলাম তবু যদি না মান
আর কত দিন গেছি গো রাধে সাক্ষী প্রমাণ আন।।
নিক্তি আন ওজন কর দন্দলে বসাইয়া
অল্প বয়সর বন্ধু তুমি মাতি না। ডরাইয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আইজ অবধি কৃষ্ণ নাম দিলাম গো ছাড়িয়া।
৬০
শ্যাম কালা পাশা খেলবি আজ নিশি।
আমি যদি হারিখেলা শুনছে চিকন কালা
শ্ৰীচরণে হইয়া থাকব দাসী।।
তুমি যদি হারো খেলা, গলে দিব বনমালা
চিরতরে রাখবে প্ৰেমে বাঁধি।
খেলাও আরম্ভ হইল, হাতের গুটি হতে রৈল
জিনিল কিনিল রাই রূপসী।।
শ্রীরাধারমণ কয়, ভাবছ কী রে রসময়
আজি কাড়িয়া রাখিব মোহনবাঁশি।
৬১
আমায় পাগল করল শ্যাম কালিয়া রুপে আমায়
কুক্ষণে জল ভারতে গেলাম, বিজলী চটকে শ্যাম নয়নে হেরলাম
আমার অঙ্গুলো হিলাইয়া শ্যামে কি বলিল গো।
হায় বিধি যদি পাখা গো দিত; উইড্রা গিয়া দেখতাম শ্যাম জীবনের মত
আমার শ্যামের সঙ্গে দেখা যদি না হইল গো।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মানব জন্ম যায় বিফলে
এবার আমার মনের ব্যথা মনে রইল না।।
৬২
আমার নিত্যি জলে যাইতে হয়
জল ভরা তো সহজ ব্যাপার নয়
জল ভরা যেমন তেমন যন্ত্রণাটি সইতে হয়।।
যখন আমি যাই গো জলে, সে থাকে তো আড়ে আড়ে
সে যে আড়াল থেকে তীর মারিল গো সই
ও আমার কলসীখানা ছিদ্র হয়।।
যখন জল লইয়া আসি ননদীয়ে কয়
তুমি কী করিয়া কলসী ভাঙলায়
হাতে ছিল থালাবাটি ঠেস লাগিয়া ছিদ্র হয়।।
ভাইবে রাধারমণ কয় কৃষ্ণপ্ৰেমে অঙ্গ দয়
কৃষ্ণ দরশনে রাধার জলে যাইতে হয়।।
৬৩
আমার মন করে আকুল
আমার প্রাণ করে আকুল
রূপে আমার লি জাতিকুল।
আমি গৃহে যাইতে আর পারি না মাথে ধরে তুল।।
আঁখি ঠারে কয় গো কথা মন করে আকুল
আমি ত্ৰিজগতে আর দেখি না বন্ধের সমতুল।
আমার প্রাণবন্ধুর মুখের হাসি যেমন গোলাপ ফুল
ভাইবে রাধারমণ বলে আমার হইল ভুল
আমি অন্ধের হাতে মানিক অইয়া
পাইলাম না তার কুল।
৬৪
আমার শ্যাম জানি কই রইলো গো শ্যামরূপে মন প্ৰাণ নিল
আমার মন নিল প্ৰাণ নিল বন্দে নিল কোন সন্ধানে
রূপ পানে চাইতে চাইতে রূপ নেহারিল
এগো রূপ সাগরের মধ্যে বন্দে আমায় ডুবাই মারাল।
শ্ৰীকৃষ্ণ বিচ্ছেদের অনল জ্বলিয়া উঠিল
এগো শ্যাম জল আইনা নিভাও অনল
আমার প্রাণ গেল প্রাণ গেল না।
ভাইবে রাধারমণ বলে; কি হইল কি হইল
বিজলি চটকের মত ঐ রূপ নয়নে লাগিল।
৬৫
আমায় উপায় বলো এগো সই প্ৰেম করে। প্ৰাণ গেল
এগো আমি ভাবি রাত্ৰিদিনে বন্ধু কোথায় রইলো।।
দেহ হতে রসরাজ সিং কেটে প্ৰাণ নিলো–
জনম ভরা পদ সাধিলাম বন্ধে সঙ্গে নাই নিলো।
আমার মত কত দাসী বন্ধের দাসী হইল
সুখের নৌকায় তুলিয়া বন্ধে সায়রেতে ভাসাইল।
জিয়ান হইতে মরণ ভালো মরণ মঙ্গলো–
জনমভরা কলঙ্ক রাধার জগতে রহিলো–।
রাধারমণ চান্দে বলে প্ৰেম করা কি ভালো
এ জনামের মত বন্ধে আমায় ছাড়িয়া গেলো।
৬৬
আমি প্ৰাণ বন্ধুরে পাইলাম না গো বিরহে জ্বলিয়া
দুক্ষিনীর জনম নি যাবে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
পুরুষ কঠিন জাতি নিরারুণ হিয়া
না জানে নারীর বেদন নিদারুণ নিদিয়া।।
বন্ধের হাতে প্ৰাণ সপিলাম আপনা জানিয়া
এখন মোরে ছাড়িয়া গেল। কুলটা বানাইয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
আসবে তোমার কালাচান্দ শাস্ত করা হিয়া।।
৬৭
আমি রব না। রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্ৰাণ বাঁচে না
বন্ধু আমার চিকন কালানয়নে লাইগাছে ভালা
বিষম কালা ধাইলে ছাড়ে না।
বন্ধু বিনে নাইযে গতি কিবা দিবা কিবা রাতি
জ্বলছে আগুন আর তো নিভে না।
এমন সুন্দর পাখি হৃদয়ে হৃদয়ে রাখি
ছুটলে পাখি ধরা দেবে না।
হাতে আছে স্বরমধু গৃহে আছে কুলবধূ
কী মধু খাওয়াইল জানি না।
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে
জ্বলছে আগুন আর তো নিভে না।।
৬৮
আমি রাধা ছাড়া কেমনে থাকি একা রে সুবল সখা
ব্ৰজেশ্বরী রাইকিশোরী একবার এনে দেখা।।
রাখার কথা মনে পড়লে বুক ভেসে যায় নয়ন জলে
রাধা ছাড়া গোচারণে কেমনে থাকি একা
রাধা আমার প্রেমের শুরু মনবাঞ্ছা কল্পতরু
রাধা আমার হস্তের বাঁশি বলে রাধা রাধা।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মানব জনম যায় বিফলে
রাধা ছাড়া গোচারণে ঘুরি একা একা।।
৬৯
ঐ যমুনায় ঢেউ দিলে বিন্দু উঠে একই সাথে
বিন্দুর সাথে শ্ৰীনন্দের নন্দন সখী রে
ঢেউ বড় হইয়াছে কাল হারাইলাম নন্দলাল
এখন আমি করি কি উপায় সখী রে
বাজায় বাঁশি বইলে শ্যামরায় সখী রে
ভাইবে রাধারমণ বলে ঢেউ দিও না জলে
কসলী ভাসাইল রাধিকায়।।
৭০
ঐ শুনা যায় শ্যামের বাঁশির ধ্বনি গো
এই বাঁশির সুরে আমার প্রাণ করল। উদাসী গো।।
কদম ভালে বসি শ্যামে বাজায় মোহন বাঁশি
শ্যাম যে আমার চিকন কালা, শ্যাম গলার মালা
তারে দেখতে গেলে জলের ঘাটে বাড়ে দ্বিগুণ জ্বালা।
ভাইবে রাধারমণ বলে পড়ি শ্যামের চরণ তলে
বাঁশির জালায় ঘরে থাকা দায় গো প্ৰাণসজনী।।
৭১
ঐ শোনা যায় মোহন বাঁশির ধ্বনি গো প্ৰাণ সজনী
ঐ শোনা যায় মোহন বাঁশির ধ্বনি।
গকুল নগরের মাঝে আর কয় জন সখী আছে গো
কাল জলে পাব নি তার দেখা গো প্ৰাণ সজনী,
ঐ শোনা যায় মোহন বাঁশির ধ্বনি।।
ভাইবে রাধারমণ বলে শ্যামের বাঁশি কি মহিমা জানে
কুলমান লইয়া করে টানাটানি গো প্ৰাণ সজনী।।
৭২
ও প্ৰাণ বিশাখে ললিতে গো কহ গো মরে।।
মোহন বাঁশি কে বাজায় ওগো সখী কালিন্দীর তীরে।।
কেমনে চিনিল বাঁশি অভাগিনীরে।
রাধা বইলে বাজায় বাঁশি গো সুমধুর স্বরে।।১।।
পঞ্জর ঝরঝর গো মর রহিতে নারি ঘরে।
মন হইয়াছে চাতকিনী গো সখী উড়তে সাধ করে।।২।।
কোন জাতি কেমন যুবতী, কথায় বাস করে
রাধারমণ বলে বাশের বাঁশি গো সখী পুর নব জলধরে।।
৭৩
ও আমার প্রাণকৃষ্ণ কাঁই গো বল গো আমারে
ও আমি কৃষ্ণ সেবায় দেহ দিতাম করে।।
মনে হয় যোগিনী হাইতাম কৰ্ণেতে কুণ্ডল বসাইতাম
ও আমার বিধি যদি দিতে পাখা যাই দেশ দেশান্তরী।।
শোন গো চম্পকা দিদি পাইয়াছিলাম গুণনিধি গো
ও গুণনিধি পেয়ে হইল আজ বাদী গো।।
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে গো
ও আমি অভাগিনী কর্মদোষে আমার বিধি হৈল বাদী গো।
৭৪
ও বিশখা গো
আমার মত জনম দুক্ষী নাহি গো সংসারে
রসিকচান্দে প্ৰেমডোরে বান্ধিয়াছে মোরে।।
বন্ধে আশা দিয়া রাধিকারে ভাসাইল সাগরে
এখন বন্ধু আইল না গো রৈল চন্দ্রার বাসরে।।
আমি নিদ্রার ছলে শুইয়া থাকি
স্বপনে বন্ধু রে দেখি গো
এগো জাগিয়া না পাই চিকন কালারে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে ঠেকিয়াছি বরির কলে
বন্ধু অভাগিনী জানি মোরে দরশন দেওরে।।
৭৫
ও শ্যামে বিচ্ছেদ লাগাইল
এগো একা কুঞ্জে রাধা থইয়া মধুপুরে গেল।।
মধুপুরে গিয়া শ্যামে কী না মধু পাইল
অবলা পাইয়া শ্যামে অনাথ করিল।।
এসো কংসের দাসী কুন্তুজারে বামেতে পাইল
জটা হইল মাথার কেশ মলিন রাধার বেশ
হায় কৃষ্ণ হায় কৃষ্ণ বলে পাঞ্জর হইল শেষ।।
৭৬
কারে দেখাব মনের দুঃখ গো আমি বুক চিরিয়া
অন্তরে তুষেরই অনল জ্বলে গইয়া।।
কার ফলন্ত গাছ উগারিলাম, পুত্ৰশোকে গালি দিলাম গো
না জানি কোন অভিশাপে এমন গেল হইয়া।।
ঘর বাঁধলাম প্ৰাণ বন্ধের সনে কত কথা ছিল মনে গো
ভাঙ্গিল আদরের জোড়া কোন্ জন বাদী হইয়া
কথা ছিল সঙ্গে নিবো সঙ্গে আমায় নাহি নিলো গো
রাধারমণ ভবে রইল জিতে মারা হইয়া।।
৭৭
কালায় প্ৰাণটি নিল বাঁশিটি বাজাইয়া
আমারে যে থৈয়া গেল উদাসী বানাইয়া।।
কে বাজাইয়া যাও রে বাঁশি রাজপথ দিয়া
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম কুলমান ছেদিয়া।।
অষ্ট আঙ্গুল বাঁশের বাঁশি মধ্যে মধ্যে ছেদা
নাম ধরিয়া ডাকে বাঁশি কলঙ্কিনী রাধা।।
বাঁশিটি বাজাইয়া বন্ধে থৈল কদমতলে
লিলুয়া বাতাসে বাঁশি রাধা রাধা বলে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
নিভিয়াছিল মনের আগুন কে দিল জ্বালাইয়া।
৭৮
কী দিয়া শোধিতাম প্ৰেমঋণ গো
রাই আমার সোধন নাই।
রাধা অনুরাগে আমল জ্বলছে হিয়ার মাঝে
জল দিলে ও নিবে না রে অনল জ্বলে দ্বিগুণ তেজে।।
রাধারমণ বলেগো ধনী আমি তার ঋণী
ঠেকিয়াছি বিষম দায়।
দাসখতে নামটি লিখি আর কী ধন আছে বাকি
আমি প্ৰাণ দিয়ে ঋণমুক্তি চাই।
৭৯
কারে দিতাম মালা গো সখী করে দিতাম মালা
সখী গো যার লাগি আয়োজন পাইলাম তার দরশন
নরম হলে মরণ গো ভাঙ্গলা গো সখী।।
সখী গো বাসি পুস্পপ গোলাপে জলে ভাসি কীরূপে
হইল না শ্ৰীরূপের মেলা সখী গো
সখী গো মন রাধারমণ বলে, তাপিত অঙ্গ জ্বলে
স্থান যেন পাই অন্তিম কালে।।
৮০
কুলনাশা বাঁশির স্বরে কুলমান মজায়
শীঘ্ৰ চল শ্যাম দর্শনে সময় গাইয়া যায়
বাঁশির সুরে মুগ্ধ হয়ে কলসী ভাসাই জলে
কালার রূপে মুগ্ধ আমি কার কলসী কেবা আনে।
পাইয়া তারে পাইলাম না গো আপন কর্মদোষে
এমন দরদী নাই আমারে জিজ্ঞাসে।।
জলের ঘাটে যাওগো রাধে রাধারমণ কয়
জলে গেলে হবে দেখা বাঁশি হাতে শ্যামরায়।।
৮১
কে যাবে শ্ৰীবৃন্দাবন যার লাগাল পাই
দুক্ষিনী রাইরে দুঃখ বন্ধুরে জানাই।।
আঙ্গুলি কাটিয়া কলম গো সখি নয়ন জলে কালি
হৃৎপত্র কাগজের মাঝে বন্ধের নামটি লেখি।।
লেখ লেখা এগো বৃন্দে লেখ মন দিয়া
অবশ্য আইবা বন্ধু লেখন পাইয়া।।
বনফুল হাইতাম যদি থাকতাম বন্ধের গলে
করিয়া বরিয়া পড়তাম ও রাঙ্গা চরণে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
প্ৰাণবন্ধু ভুলিয়া রইছে রাসমতী পাইয়া।।
৮২
কোথা গেলে কৃষ্ণ আমি পাই গো রাই
আপনা জানি প্ৰাণ বন্ধুরে হৃদে দিলাম ঠাঁই।।
এগো ছিল আশা দিল দাগা, আর প্রেমে কাজ নাই
হিঙ্গল মন্দির মাঝে শুইয়া নিদ্ৰা যাই।।
শুইলে স্বপন দেখি শ্যামকে লইয়া বেড়াই
কৃষ্ণ কোথা পাই গো আমি কৃষ্ণ কোথা পাই
ভাইবে রাধারমণ বলে শুনগো ধনি রাই
পাইলে বন্ধে ধরব গলে ছাড়াছড়ি নাই।
৮৩
কোকিলা মানা করি তোরে
হৈছি আমি বন্ধুহারা আর ডাকিও না শোক স্বরে।
যেই পন্থে আসরে সেই পন্থে যাও
অভাগিনীর কর্মদোষে ফিরিয়া না চাও।
কাক কালা কোকিল কালা কালা প্রাণের হরি
খঞ্জনের বুক কালা এই সে দুঃখে মরি।
আমি ধরে কুপাকুপা তেঁতুল ধরে বেকা
দেশের বন্ধু বিদেশ গেলে আর নি হবে দেখা।।
৮৪
খুলি নেও গলার হার গো ললিতে
ললিতায় নেও গলার মালা বিশখায় নেও হাতের বালা
সুপ্রিয়া নেও কনের সোনা নাই আশা।।
আমি মৈলে ঐ করিও না পুড়িও না গাড়িও
আমারে বান্ধিয়া থুইও মগডালে।
নিষ্ঠুর আইলে জিজ্ঞাসিবে রাই মরিল কি জন্য
তোমরা বলিও মরিছে প্ৰেম জ্বালায়।
৮৫
জলের ঘাটে পাইলাম দেখা বন্ধু শ্যামরায়
এমন নিষ্ঠুর বন্ধু রাধাকে জ্বালায়।।
হৃদয়েতে ছেল বসাইয়া জ্বালায় প্রেমের বাতি
আমার মনপ্ৰাণ হরি নিল করিলা কলঙ্কী।
সাজাইয়া ফুলের মালা রইলাম। আশা পন্থে
আসবে নিশো প্ৰাণবন্ধু অবলার প্রাণ থাকতে।।
একে তো বসন্তের জ্বালা, জ্বালায় শ্যামরায়
বাঁশি বাজল কোন বনে সইগো জাইনে আয়।।
ভাইবে রাধারমণ বলে শুন গো ধনি রাই
বন্ধের সঙ্গে দেখা হবে কদম্বের তলায়।।
৮৬
ডাকিও না রে শ্যামের বাঁশি জয় রাধা বলিয়া
অয়রে শ্যামচন্দের বাঁশি কই বিনয় করিয়া।।
পুরুষ ভ্ৰমরা জাতি কঠিন তারও হিয়া
নারী তো সরল গো জাতি উঠে রইয়া রইয়া।
একঘেরে শুইয়া থাকি নিশি গত হইয়া
শুইলে স্বপন গো দেখি হৃদয় বন্ধুয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
গোপনে করছিলাম পিরিত দিলায় প্ৰকাশিয়া।
৮৭
ধরিয়া দে গো প্রাণসজনী ঐ যায় মনচোরা
এগো সুতলি কাঁইটা গেল পাখি পিঞ্জিরা ভাঙ্গিয়া।।
কোন বা দেশে গেল বা পাখি না আসল ফিরিয়া
রাধারানীর পোষা পাখি মৰ্ম্মকুরাতে খাইল ধরা।।
আর দেবো না পিরিতি করে জগৎ জুড়িয়া
ও পিরিত করছে যেজন মরছে। সেজন পিরিত না করছে জন।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
মনে লয় তার সঙ্গে যাইতাম কুলমান ত্যজিয়া।।
৮৮
পিরিতি বিষম জ্বালা সয় না আমার গায়
কুল নিল গো শ্যামের বাঁশি প্ৰাণ নিল কালায়।।
ঘরে বাইরে থাকে বন্ধু ঐ পিরিাতের দায়
কালা তো সামান্য নয়। রাধার মন ভুলায়
ভাইবে রাধারমণ বলে শুনগো ললিতায়
কুল নিলগো শ্যামের বাঁশি প্ৰাণ নিল কালায়।।
৮৯
পিরিতে মজাইল মোরে বন্ধু শ্যামরায়
বন্ধের বাঁশির ডাকে আমার ঘরে রওয়া দায়।।
বন্ধু আমার হংস রূপে জালেতে ভাসিয়া যায়
আলগা থাকি কাল নাগে ছুব মারিল রাঙা পায়।।
সর্পের বিষ বারিতে লামে প্রেমের বিষে উজান ব্যায়
উজা বৈদ্যের নাইরে সাধ্য কারিয়া সে বিষ লামায়।।
এক উঝায় লাড়েচাড়ে আর উঝায় চায়
ঝারিতে না লামে বিষ ফিরিয়া উজান বায়।।
ভাইবে রাধারমণ বলে এখন আমার কি উপায়
বিষে অঙ্গ ঝরকার প্রাণ রাখা হইল দায়।।
৯০
প্রথম যৌবন কালে কে বা না পিরিতি গো করে
সেই পিরিতি নিত্যি গঙ্গার জল গো প্ৰাণ সই।
যখন আমি ডাকি বন্ধু বন্ধু পার কইরা দাও ভবাসিন্ধু
বন্ধের মনে ডুবাইবার বাসনা।।
এখন কলসী বান্দিয়া গলে বাপ দিব যমুনার জলে
কলসী ভাসাইয়া নিব স্রোতে।
যদি বন্ধু আপনি হইত স্রোতের কলসী আনিয়া দিত
পরান বন্ধে বইসা রঙ্গ চায়।।
৯১
প্ৰাণ নিল গো প্ৰাণসজনী মুরলী বাজাইয়া মধুর স্বরে
বাঁশির সনে মনপ্ৰাণ নিল উদাসীন কইরে
তথায় বিপিন বিহারী বিপিনে বিহারে
ত্বরাই কএ কর বেশ শীঘ্র যাই কল ভরিবারে
ভাইবে রাধারমণ বলে শীঘ্ৰ যাই গো জলে
কইমু গো মরমী কথা বিধি যদি মিলায় তারে।।
৯২
প্ৰেম করি ভুবিলাম গো সই মনে বিষম জ্বালা
দেখা দেয় না প্রাণনাথ শ্যামচাঁদ কালা।।
তার নয়নে অঞ্জন অর্মকা রূপ লাগিয়াছে স্বপনে
চূড়ার উপর ময়ূর পাখা হেলাইছে পবনে।।
ভুবন মোহন শ্যাম নটাবর রূপ লাগিয়াছে নয়নে
বিবাণী করেছে আমায় সেই প্রেমের মহাজনে।
বন্ধু আমার সোনাচান তার লাগি হারাইলাম মান
রাধারমণ কয় মনের আশা পাই যে নরে শ্যামকাল।।
৯৩
প্ৰেম করি মাইলাম গো সই বিচ্ছেদের জ্বালায়
সর্ব ঘটে রাজে কালা বাদী কেবল আমার দায়।।
বুঝিতে না পারি তার রীতি নীতি ধারা
প্ৰেমফাসি গলায় দিয়া আলগা থাকি মারিলায়।
আমি তো অবলা নারী কত জ্বালা সইতে পারি
প্ৰেম জ্বালায় জ্বলিয়া মারি অন্তর কালো তার দায়।
কত আর জ্বালাইবে মোরে ভস্ম হইলাম জ্বলে পুড়ে
কি লাভ মোরে ভস্ময় করে নামেতে কলঙ্ক লাগায়।
সবে জানে। দয়াল তুমি কী দোষ করিলাম আমি
তবে কেন সোনা বন্ধু অভাগীরে জ্বালারায়।
চিরজীবী তুমি কালা গলে পারছি তোর প্ৰেমমালা
জ্বালা সইয়া জীবন গেলো। আর কতকাল জ্বালাইবায়।
জীবনে মরণে তুমি পিছা না ছাড়িমু আমি
দেখি তোমায় পাই নি নামী আমি কালিয়া বন্ধু শ্যামরায়।
ভাবিয়া রাধারমণ বলে জীবন গেল প্ৰেম জ্বালায়
জিতে না পাইছি যদি মইলে পাইমু শ্যামরায়।।
৯৪
বন্ধু আমার হৃদয় রতন
করছি আশা অন্তিম কালে করিও পূরণ।
সুধা ভাবি গরল আমি
করিছি ভক্ষণ
সে জালায় অন্তর আমার
জ্বলিয়া ছাই সৰ্ব্বক্ষণ।
কানু কলঙ্কিনী নাম
দয়াল জুড়ি প্রচারণ
শ্বশুড়ী ননদী গঞ্জে
মুই কি করি এখন।
গঞ্জনার ভয় রাখি না
নাম লইলে ভয় নিবারণ
যোগীঋষি পায়না যারে
কেমনে পাই সে মহাজন?
গুরু মুখে শুনিয়াছি নাম
পতিত পাবেন
পদাশ্রয়ের আশ রাখে
বাউল রাধারমণ।
৯৫
বন্ধু রে অবলার বন্ধু যাইও না রে থইয়া
ঝাড়ের বাঁশ কাটিয়া রে বন্ধু নদীতে দিলাম বানা
তুই বন্ধুর পিন্ধিরতের লাগি মাথুর করলাম মানা।।
আগে যদি জানতাম রে বন্ধু যাইবায় রে ছাড়িয়া
দুই চরণ বান্ধিয়া রাখতাম মাথার কেশ দিয়া
গোসাঁই রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
মনে লয় মরিয়া যাইতাম গলে ছুরি দিয়া।
৯৬
বিদায় হইলাম গো রাই কমলিনী তোমার চরণে
আমি শুইলে স্বপনে দেখি গো রাধে
দেখি না তুমি বিনে।।
রাধে গো
গোষ্ঠ আচরণে যাই, রাই বইলে বাঁশরী বাজাই
বাঁশির স্বরে ডাকিগো তোমারে
বাইর হও বাইর হও রাধে দেখি তোমায় পরান ভরে।
রাধে গো
ছাড়িয়া যাই জনমের মত দিয়া যাই দানপত্ৰ গো
চূড়া বাঁশি দিয়া যাই তোমারে রাধে
ঐ রাঙ্গা চরণে।
৯৭
বাঁশি বাজায় গো শ্ৰীকান্তে
রাধা রাধা রাধা ধ্বনি পাইলাম শুনতে।।
একদিন গিয়েছিলাম যমুনায় জল আনতে
রূপ দেখিয়ে অইলাম পাগল
আইলাম কানতে কানতে
গাঁথিয়া ফুলের মালা চাইয়া রৈলাম পন্থে
আসবে নি শ্যাম কালা এ দেহে প্ৰাণ থাকতে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মৈলাম কালার পিরিতে
একজলা শ্যামবিচ্ছেদ আর জ্বালা বদন্তে।।
৯৮
বিশাখে গো শোন শ্রবণে
ও নিশাতে বন্ধুয়ার বাঁশিয়ে আমায় ডাকে কেনে।
প্রতি অঙ্গ জরজর মুরলীর টানে
শুনিয়া মুরলীর ধ্বনি মন টানে যাই বলে
ঘরে বাইরে হইলাম দোষী বাঁশির কারণে।।
কুপিত সাপিনী যেমন গরুড় উৎকারে
রাধারমণ বলে ধনি কী ভাব হইল মনে
শীঘ্ৰ চল ও বিশাখে প্ৰাণবন্ধু দর্শনে।
৯৯
ভুবনমোহন রূপের দিকে রৈলাম সখি চাইয়া
কালিন্দীর স্রোতে আমার কলসী প্রেছল ভাইয়া।।
কদমতলে বাঁশি বাজায় শ্যাম নাগর কালিয়া
বিধুমুখে মধুর হাসি, আমার প্রাণ নিল হরিয়া।।
সখীরে কুলমান সবই নিল নয়ন পানে চাইয়া
আমার অন্তরে তুষের অনল জ্বলে গইয়া গইয়া।।
প্রেমের জালায় সখি মারি গো জ্বলিয়া
কোন বিধি গড়ে দিল কতই রূপ দিয়া।।
সইগো আমার প্রাণ কন্দে শ্যামরূপ হেরিয়া
আমার প্রাণমন কাইছড়া নিল রসের বিনোদিয়া।
ভাইবে রাধারমণ বলে শ্যামের দিকে চাইয়া
প্রেমের ফাঁসি লাগলে গলে আগুন জলে গইয়া।।
১০০
মদন শ্রীকান্ত বিনে আমার পরানে যায়
গিয়াছিলাম জলের ঘাটে দেইখে আইলাম শ্যামরায়।।
মেঘবরণ চিকণকালা বিনাসুতে গাঁথি মালা
ত্ৰিভঙ্গ হইয়া শ্যাম মুরলী বাজায়।
জীবন থাকতে মরি আমি শ্যামের বাঁশির জ্বালায়
কদমতলে থানা বসাই বাঁশি বাজায় শ্যামরায়।।
ভাইবে রাধারমণ বলে আর এক যাইও না জলে
জলের ঘাটে যৌবন লুটে একলা পেয়ে শ্যামরায়।।
১০১
মানা করি রাই বঙ্গিনী আর যমুনায় যাইওনা–
কালো রূপ লাগিয়ে অঙ্গে হেমাঙ্গী রবে না।।
হেরিবারে সদায় যারে করা গো রাই ভাবনা–
সে যে তোমার কুলের কালি তারে কি রাই জানো না।
ঘরে বাদী ননদিনী বারে পরিজনা–
ছাড়ো ধ্বনি রাই কমিনী কালার প্ৰেমে বাসনা।
ভাইবে রাধারমণ বলে–ছাড়া বিষম যন্ত্রণা
প্রেমের আঠা বিষম লেঠা ছাড়াইলে তো ছাড় না।
১০২
মনের দুঃখে পরান যায় ফাটিয়া
প্ৰাণবন্ধু আইল না গো কী দোষ পাইয়া।।
সখী গো বন্ধের হাতে প্ৰাণ সপিলাম আপনি জানিয়া
এখন মোরে ছাড়িয়া গেল। কুলটা বানাইয়া।।
রসিকচান্দে প্ৰেমে ডোরে বন্ধন কৈরাছে মোরে
বন্ধে সাগরে ভাসাইয়া মাইল আমায় আশা দিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে ঠেকিয়াছি বরির কালে গো
দরশন দেওরে বন্ধু অভাগী জানিয়া।।
১০৩
রাধার নামে কে বাজাইল বাঁশি রে
বাঁশির ধ্বনি শুইনে আমি হইলাম। উদাসী রে।।
শুনিয়া তোমার বাঁশির ধ্বনি জল ভরিতে আসি আমি
ঘরে আছে কাল ননদী আমায় বানায় দোষী রে।।
মনে লয় শ্ৰীচরণে হৈ তাম তোমার দাসীরে।
কাল ননদীর ভয়ে মোর প্রাণটি কাঁপে থরে থরে
বলে ছলে জল ঢালিয়া কাঙ্কে লই কলসী রে।।
ভাইবে রাধারমণ বলে তুমি কি আর জান নারে
ওরে তুমি বিনে প্ৰাণ বাঁচেনা তুমিই বিশ্বাসীরে।।
১০৪
শ্যাম কালা কোথায় পাই গো, বল গো সখী
কোন বা দেশে যাই।
কালা থাকে কালার ভাবে
আমি পুইড়ে হইলাম ছাই গো।
বল গো সখি কোন বা দেশে যাই
আপ্ত মাইনে প্ৰাণ বন্ধুরে হৃদে দিলাম ঠাঁই।।
ছিল আশা দিল দাগা আর প্রেমের কাজ নাই।।
ফুলেরই পালঙ্কে আমি শুয়ে নিদ্ৰায় যাই
মুজলে নয়ন দেখা স্বপন শ্যাম লইয়া বেড়াই গো।
ভাইবে রাধারমণ বলে শুনগো ধনী রাই
পাইলে বন্ধের খবর গলে ছাড়াছড়ি নাই।।
১০৫
শান্তি না পাই মনে গো নিদ্রা নয়নে গো
সদায় কন্দে মন গো বন্ধুয়ার লাগিয়া।
সখী গো একা কুঞ্জে বসে আমি পথ পানে চাইয়া
নড়িলে গাছের পাতা উঠি চমকিয়া।
শুইলে স্বপনে দেখি প্ৰাণবন্ধু আসিয়া
শিয়রে বসিয়া ডাকে কেশে হাত দিয়া।
জাগিয়া না দেখি তারে চারিদিকে চাইয়া
নয়নের জলে আমার বক্ষ যায় ভাসিয়া।
আশায় আশায় জনম গেল পন্থপানে চাইয়া
রাধারমণ কয় প্ৰাণ না ত্যেজ গরল খাইয়া।।
১০৬
শ্যাম তোমারে করি মানা মোহন বাঁশি বাজাইও না
সন্ধ্যাকালে বাজিয়ে বাঁশি নারীর মন করলায় উদাসী
তুমি পুরুষ কুলে জন্ম নিয়া নারীর বেদন বুঝ না।।
রাত্ৰ নিশি দিবাকালে বাঁশি বাজায় রাধা বইলে
আমি ঘুমের ঘোরে। চমকি উঠি কান্দি ভিজাই ফুল বিছানা।
ভাইবে রাধারমণ বলে রাধা বলে বাঁশি বাজে
আমি পুরুষ হয়ে যেতে পারি নারী হয়ে দেয় যন্ত্রণা।
১০৭
শ্যামরূপ হেরিলাম তরুমুলে
যমুনার কাল জলে সৌদামিনী জ্বলে।
কী সুন্দর মাধুরিয়া কেমন সুন্দর বদন চন্দ্ৰিমা
শ্যামরূপের নাই কোন তুলনা জগৎ মণ্ডলে।
শ্যামরূপে জ্বলে অর্মাখি বাইরে হুল পরান পাখি
তবু না ধরিতে পারি সময় যায় নানা ছলে।
ভাইবে রাধারমণ বলে না জানি কি আছে ভালে
লেখছে বিধি রই মনে যে আগুনে হিয়া জ্বলে।
১০৮
শ্যামারূপ হেরিলাম গো কদম্বের তলে
তুষের অনলের মত অঙ্গ মোর জ্বলে।
মজিয়ে বাঁশির সুরে বইসে থাকি সারাদিনে
যার বাঁশি তারে ডাকে রাধারাধা বলে।।
ইচ্ছে হয় প্ৰাণ বন্ধুয়ারে হৃদয়ের মাঝে রাখি
তৈলের অভাণ্ডে ঘৃত আনি সাজাইয়া রাখি।।
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে
বন্ধের হাতের বাঁশির জ্বালা যাবে আমি মৈলে।
১০৯
শ্যামের বাঁশি মন মজাইল
মন নিল শ্যাম নটবরে আমার প্রাণ নিল।।
শ্যামের বাঁশির মোহর সুর মনেতে বাজিল
ভুলিতে না পারি তারে একী জ্বালা হইল।।
কর্ণ নিল বাঁশির টানে নয়ন নিল রূপবানে
শ্যামরূপ ভুজঙ্গ হইয়া দংশিল হৃদয় কোণে।।
সে বিষের এমন জ্বালা অবশ্য হইলাম অবলা
বিষম জ্বালায় প্ৰাণ আমার অবশ্য হইল।।
ভাইবে রাধারমণ বলে কে করিবে ভাল
শ্যামারূপ হেরিয়া রাধার পরান জুড়াইল।
১১০
শ্যামরূপে নয়ন আমার নিল গো
তারে আমি ভুলিতে না পারি।
আমার কী জ্বালা হইল গো।।
যাইতে যমুনার জলে বাঁশি বাজায় কদম তলে
আড়ে আড়ে শ্যাম নাগারে আমার পানে চাইল গো
শ্যামনগর ভুজঙ্গ হয়ে দংশিল আমার অঙ্গে
আমার জীবন সংশয় হইল বিষে অঙ্গ ছাইল গো
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গা জ্বলে
মনের মানুষ বিনে অনল কে নিভাইতে পারে।।
১১১
শ্যাম বরণ বংশীবদন হেরলে নয়ন ফিরে না, ও গৃহে রব না
একদিন দেইখাছি যারে সুরধুনীর কিনারে
তারে দেখছি অন্যে লাগছে মনে
পাশরিতে পারি না, গৃহে রব না
কদম্ব ডালেতে বসি বাজায় শ্যাম দিবানিশি
বাঁশিয়ে বলে জয়রাধা
ভাইবে রাধারমণ বলে কথা রাইখো এচরণে
আমি শ্রীচরণের হব দাসী মনে ছিল কামনা
ও গৃহে রব না।।
১১২
শ্যামের নাগাল পাইলে বন্ধন করি ভাসব যমুনায়
ললিতা বিশাখা সখী আয় গো তোরা আয়
যমুনার ঘাটে গিয়া হাতের কলসী ভুসে থৈয়া
নিরাখিব শ্যামরূপে তার দিকে তাকাইয়া
বাঁশির সুরে প্রাণ বিন্দরে রাইতে নারি ঘরে
কুলবধূর কুল মজাইল শ্যামের বাঁশির টানে
যারে দংশে শ্যামের বাঁশি নাহি বাঁচে জন
ভাইবে রাধারমণ বলে আয় গো সখী আয়
ধরতে গেলে পাইনা নাগাল সে কোন দেশে যায়।
১১৩
শ্যামের মোহন রূপ গো সই ভুলিতে পারি না
মোহন বাঁশির জ্বালায় আমার প্রাণ বাঁচে না।।
না জানি কোন কারিগর গড়িয়াছে এরূপ
দেখলে মনে আগুন জ্বলে সইতে পারি না।
এই পিরিাতের এই রীতি এই দশা ঘটিল রে
পিরিত করিয়া ছাড়িয়া গেল এমন পিরিত কইরা না।।
সই গো জলের ঘাটে গিয়েছিলাম কলসী কাখে লৈয়া
কালাচান্দে বাজায় বাঁশি রাধার নাম লৈয়া।।
পিারিতের এই দশা প্ৰাণে তো আর সহে না
রাধারমণ বলে এমন পিরিত আর হইল না।।
১১৪
শ্যামের সঙ্কেত মুরলী বাজিল গো সই
ঐ শুনি বাজিল গো নিকুঞ্জ কানন বনে।।
শ্যামের মোহন রূপ আমার লাগিল নয়ানে
বাঁশির জ্বালায় অন্তর পুড়িল আগুনে।।
আমি রৈলাম বন্ধের আগে বন্ধু রৈল কই
মনে থাকে মনের কথা কটাইল দুকাখ কই।।
শ্যামে গহীন বনে চরায় ধেনু তমাল ডালে বাজায় বেণু
ভাইবে রাধারমণ বলে আশায় থাকি পাব বলে
চরণ দেখা পাব বলে আশায় পন্থ চাইয়া রই।।
১১৫
সই আমি বসে রৈলাম করা আশায়
কালার সনে পিরিত করি ঠেকালাম বিষম দায়।।
ছাই দিয়েছি কুলেরে মানিক গৃহে থাকা দায়
কথা দিয়েও কুঞ্জে আমার আয় না। শ্যামরায়।।
আসিব আসিব আসব বইলা নিশি গাইয়া যায়
সুখের নিশি গত হইল বন্ধু স্নইল কোথায়।।
কুহু কুহু কুহু রবে ডাকে কোকিলায়
কী দোষে প্ৰাণ বন্ধুর দয়া হইল না আমায়।
ভাইবে রাধারমণ বলে ব্ৰজে আমি যাইতাম চলে
দেহমান সপিয়া দিতাম কালার রাঙ্গা পায়।।
১১৬
সখী বল বল গো উপায়।।
এ বাজে কুলনাশীর বাঁশি গৃহে থাকা হইল দায়।
বাঁশি কি অমিয়া নিধি সুজিল কি বিধাতায়
মন প্ৰাণ হরিয়া নিকল কুল রাখা হইল দায়।।
ঘরের বাহির হইতে নারি থাকি গুরু গঞ্জনায়
বাঁশির জ্বালা সইতে নারি প্রাণি কণ্ঠাগত প্ৰায়।।
কেন গো সে কালাচান্দে নাম ধরে বাঁশি বায়
শ্ৰীরাধারমণ ভনে তার তো সরম ভরম নাই।
১১৭
কী আনন্দে কুঞ্জ সাজায়
সখী
যাতি যুতি লং মালতী
রঙ্গন গাঁথি মধু মালতী দিয়া
আমি নাম জানি না।
কী হইল ফুলের মহিমায়।।
সখী গো
রজত কাঞ্চন অঙ্গেরই ভূষণ
মণিমুকুতার বালা
ফুলের মশারী বালিশ ফুলে
রত্ন সিংহাসন তায়।।
সখী গো
কুঞ্জ হেরিতে আইল
প্যারী প্রেমে মন মজিল
আসিল মোর প্রাণনাথ
জয় প্রভু রঘুনাথ
গন্ধে বেভুল গোপিকায়।।
১১৮
পুর্ব দিকে চেয়ে দেখ আর তো নিশি নাই
জয় রাধিকা জাগো শ্যামের মনমোহিনী
বিনোদিনী রাই।
রাই জাগো গো জাগো শ্যামের
মনমোহিনী বিনোদিনী রাই।।
বাসি ফুল দাও ভাসিয়ে আবার আনো ফুল তুলিয়ে
মন সাধে যুগল সাজাই।।
শ্যাম অঙ্গ অঙ্গ দিয়ে কী সুখে আছে ঘুমিয়ে
লোক নিন্দার ভয় কি তোমার নাই।।
ভাইবে রাধারমণ বলে যুগলে যুগল মিশিয়ে
যুগল বিনা অন্য গতি নাই।।
১১৯
জল ধামাইল
আমি বিনয় করি বলি রে শুক পাখিয়া
সোনা বন্ধের খবর আনি শীঘ্র দেও আনিয়া
শুক পাখিয়া বিনয় করি জলে যাব জল খেলাব
সব সখী মিলিয়া
হিয়ার মাঝে জ্বলছে অনল প্ৰাণ বন্ধের লাগিয়া।।
পুরুষ তো ভ্রমরা জাতি নিষ্ঠুর নিদয়া
জানে না নারীর বেদন কঠিন তার হিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে মনেতে ভাবিয়া
পিরিত কইয়া ছাইড়া গোল কী দোষ জানিয়া।
১২০
জল ধামাইল
কে যেন জল ভারতে যায় তোরা দেইখে আয়
কাঙ্খেতে সোনার কলসী মুখে যেন মুচকি হাসি
আমার পরাণ যে লইয়া কারিয়া।।
নদীর জল দেখতে ভাল স্নান করিতে লাগে ভাল
আমার সোনার অঙ্গ মলিন হইয়া যায়।।
কে যেন জল ভারতে যায়, পায়ে সোনার নূপুর বাজে সদায়
আমার নীলাম্বরী বাতাসে উড়ায়।।
ভাইবে রাধারমণ বলে যাইও না তোমরা সকলে
ঘরে থাক জাত কুলমান লইয়া।।
১২১
নদীয়া নগরে আজি মঙ্গল জুকার
ভিক্ষার কারণে গেলা জননীর নিকট।
ভিক্ষা দেহি ভিক্ষাং দেহি বসিতে লাগিলা
ফল তন্তুল দিয়া ভিক্ষা জননীয়ে দিলা।
রজত কাঞ্চন দিলা ঝুলিতে ঢালিয়া
ভিক্ষা লইয়া চলিয়া গেলা গুরুত্বরও সদনে।
গুরুকে দক্ষিণা দিলা ধরিয়া চরণে
পুর্নবার যাও বাছা ভিক্ষার কারণে।
ভিক্ষাহেতু চলিয়া গেলা গৃহেরও দারে
স্বর্ণখাল ভরিয়া ভিক্ষা জননীয়ে দিলা।
ফলমূল দিয়া মায়ে ডালারে ভরিয়া
ভগিনীয়ে দিলা ভিক্ষা যতন করিয়া।
তারপরে দিলা ভিক্ষা ব্ৰজবাসিগণ
ভিক্ষা লইয়া ব্ৰহ্মচারী আশ্রয়েতে গেলা।
ভাইবে রাধারমণ বলে বামনের চরণে
অন্তকালে তারাইও প্ৰভু নারায়ণে।।
১২২
অধিবাসের গান
রানী ডাক রে ব্রজের মাইয়া
শ্যাম সুন্দরের অধিবাসের সুন্দা বাট যাইয়া।।
শীতল ও পাথরখানি মধ্যে করি লইয়া
সারি সারি সব রমণী এক বিছানায় বইয়া।।
সুন্দা বাটিয়া সব যুবতী খুশিবাসি হইয়া
স্বর্ণ র্কাবুল পুর্ণ করি থইছে নিয়ে ভরি
রমণ বলে অধিবাসের বিছানা করা যাইয়া।।
১২৩
গউর এ যে প্ৰেম করিল যে রসে কেউ ডুবে না।
শ্রীরূপাদি ছয় গোস্বামী চণ্ডীদাস আর রজাকিনী।
পাঁচ রসিকের জানা।।
নামেতে প্ৰেম অনুপাম দিয়ারে গউর রাধাভাবে মগনা।।
স্বরূপ রামানন্দ চিনেছে প্ৰভুর মর্ম কেও তো বুঝে না।।
গৌরপদ পঙ্কজে মজোরে রাধারমণের এই কামনা।।
১২৪
তোমার মনে কী বাসনা রে অবলারে কান্দাইয়া
তোমার প্রেমের বাণে আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া।।
চাও না কেনে নয়ন তুলি কার প্ৰেমে রৈলে তুমি
আমি দুঃখের কথা বলি গো খুলিয়া।।
প্ৰথমে পিরিতির কালে কত আশা ছিল মনে
কী লেইখাছে দারুণ বিধি আমার লাগিয়া।।
ভাইবে রাধারমণ বলে প্ৰেমানলে অঙ্গ জ্বলে
মনের ব্যথায় জ্বলি গো মরিয়া।।
কীভাবে আমি *রাধারমন গীতি সংগ্রহ*একপিস বই পাবো? দয়া করে জানাবেন।মোবাইল ঃঃ01626433013.