পরের দিন বেলা দ্বিপ্রহরে মীর-সাহেব ঠিক এসে হাজির। গোলাপি নেশার মতো একটু ঘুম এসেছিল, কিন্তু মীর-সাহেবের তাড়ার চোটে ‘তশরিফ্’ ওঠাতেই হল। বাইরে গিয়ে দেখি মীর-সাহেবের গাড়ির খোল-নলচে দুই-ই বদলানো হয়েছে।
সেই ছোট্ট পাটাতনটুকুর চারপাশে চারটি রঙিন দণ্ড লাগানো হয়েছে, তার ওপরে সাদা ধবধবে ছত্রী। মেয়ে-সওয়ারির জন্য তিন দিকে তিনটি পর্দাও ঝুলছে।
সব থেকে মজা লাগল, সেই বাহাদুর ঘোড়ার দুই চোখের মধ্যিখান থেকে প্রায় নাসারন্ধ্র অবধি লম্বিত একটি শোলার কদমফুল দেখে। বেশ বোঝা গেল অনেকদিন পর নতুন অলংকার পেয়ে ঘোড়াটিও গর্বিত বোধ করছে। গতকাল আমার এখান থেকে বিদায় নিয়ে বোধহয় আহার-নিদ্রা পরিত্যাগ করে মীর-সাহেব আমার আরামের জন্য তাঁর সেই গাড়ির সংস্কারসাধন করেছেন।
মীর-সাহেব সৈয়দ সাহেবের মতন অবস্থাপন্ন লোক নন, সে-কথা বেশ বুঝতে পারা যেত; কিন্তু সেই অবস্থার মধ্যে পয়সা খরচ করে তিনি আমার জন্য যে গাড়ির এই সংস্কারসাধন করলেন–এতে তাঁর জন্য আমার দুঃখ হতে লাগল। কিন্তু দুঃখ হলেও, কি জানি তাঁকে আমার পরম বন্ধু বলে মনে হল। আমি সারাজীবন ধরে এইভাবে স্বল্পপরিচিত নর-নারীর কাছ থেকে কত যে সাহায্য পেয়েছি তার আর অন্ত নেই। মীর-সাহেবকে ভালো করে না চিনলেও, তাঁর ভাষা ভালো বুঝতে না পারলেও আমার অন্তর তাঁকে বন্ধু বলেই স্বীকার করে নিল।
যাই হোক, গাড়িতে চেপে বসে বেশ একটা ডাণ্ডা বাগিয়ে ধরলুম আর মীর-সাহেবের নির্দেশে কোচোয়ান গাড়ি চালাতে লাগল।
এ-গলি সে-গলি, এ-পথ, ও-পথ দিয়ে আমরা প্রায় সারাদিনই কখনও হেঁটে কখনও গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ালুম। মীর-সাহেব দেখাতে লাগলেন–এই পথ দিয়ে বন্দি দারাকে নিয়ে আসা হয়েছিল, এইসব রাস্তা দিয়ে তাঁর মুণ্ডহীন দেহ হাতিতে করে ঘুরিয়ে বেড়ানো হয়েছিল–এইরকম কত কথা। এইখানে অমুক ‘রইস’-এর বাড়ি ছিল, এটায় ওমুক ওমরাহের তমুক অনুগৃহীতা থাকতেন–ইত্যাদি কত লোকের সম্বন্ধে কত অদ্ভুত কাহিনি তিনি গড়গড় করে বলে যেতে লাগলেন। সে-সব শুনতে শুনতে এমন সব ছবি প্রত্যক্ষবৎ আমার সামনে ভেসে উঠতে লাগল যে, তার সত্যাসত্য নির্ধারণ করবার ইচ্ছাও আমার মনে উদয় হল না। তিনি যা বলতে লাগলেন তাই সত্য বলে বিশ্বাস করলুম। এমনি করে ঘুরতে ঘুরতে প্রায় সন্ধ্যাবেলা বাসায় ফিরে এলুম।
পরের দিন থেকেই প্রতিদিনই আমরা বেরুতে লাগলুম। এইরকম-ভাবে ঐতিহাসিক নগরীতে ঘুরতে ঘুরতে আমারও কেমন একটা নেশা চড়ে গেল। সমস্ত দিনটা একটা স্বপ্নের ঘোরে কেটে যেতে লাগল।
একদিন আমরা একটা নির্জন স্থানে এসে পৌঁছলুম। সেখানে বাড়ি-ঘর-দোর সব ভাঙা-ভাঙা পড়ে রয়েছে। লোকজন আর সেখানে বাস করে না। স্থানটা বোধহয় কেল্লার পেছনদিকে। মীর-সাহেব বললেন–এই জায়গায় গালিবের বাড়ি ছিল। গালিবসাহেবের নাম শুনেছেন তো? বললাম–তাঁর নাম হিন্দুস্থানেরকে না জানে? তিনি সুবিখ্যাত উর্দু-কবি। ফারসি কবিতা তিনি অনেক লিখেছিলেন।
গালিব-সাহেব মহম্মদ শা-র দরবার থেকে মাসোহারা পেতেন, কিন্তু তাতেও তাঁর খরচে কুলোত না। তাঁকে ঘিরে কত যে গল্প তৈরি হয়েছে তার ঠিকঠিকানা নেই এবং সে-সব কাহিনি দিল্লিবাসীর মুখে মুখে এখনও ফিরছে। তাঁর লেখার মধ্য থেকেই জানা যায় যে, তিনি ছিলেন অত্যন্ত গরিব। তাঁর সম্বন্ধে গল্প শুনতে শুনতে যে-লোকটির ছবি চোখের সামনে ফুটে ওঠে তাঁকে ভালো না বেসে আর থাকা যায় না। এমন একটি লোক দিল্লিতে সারাজীবন বাস করলেন এবং এইখানেই মারা গেলেন, অথচ দিল্লিবাসীরা তাঁর বাড়ির ঠিকানা রাখলে না–এটা অত্যন্ত দুঃখের কথা সন্দেহ নেই।
দিন-কয়েক রাস্তায় ঘোরাঘুরির পর মীর সাহেব একদিন বললেন–কাল আমরা ইন্দ্রপ্রস্থে যাব। সেই কুতুবমিনার থেকে আরম্ভ করব। তার পরে একটু একটু করে এগোনো যাবে।
জিজ্ঞাসা করলুম–ঘোড়া অতদূর এগোতে পারবে?
তিনি বললেন–দরকার হলে এ-ঘোড়া আপনাকে আগ্রায় পৌঁছে দিয়ে আসতে পারে। আজকাল রোজ ওকে এক সের করে চানা দেওয়া হয়।
সে-সময় দিল্লি শহরে একপয়সা কি দেড়পয়সা দিলে এক সের ছোলা পাওয়া যেত। আমি বললুম–আরও কিছু বেশি দানা ওর জন্যে বরাদ্দ করুন।
মীর-সাহেব তাচ্ছিল্যের সহিত বললেন–ওর চেয়ে বেশি ও হজম করতে পারবে না।
বাস্তবিকপক্ষে মীর-সাহেব, তাঁর গাড়ি-ঘোড়া ও তার চালক–এই তিনের দুর্লভ সমাবেশকে আমার অদ্ভুত বলে মনে হত। ঘোড়া ইঙ্গিতে চলে, চালকের মুখ থেকে এতদিনেও ‘হাঁ’ কিংবা ‘না’ কিংবা অন্য কোনো কথা একটাও শুনতে পাইনি। আর মীর-সাহেবের অনর্গল বক্তৃতার তো শেষই নেই।
যাই হোক–পরের দিন থেকে আমাদের পুরাতন দিল্লির ধ্বংসস্তূপ পরিক্রমা আরম্ভ হল। সেই পুরাতন ইতিবৃত্ত মীর-সাহেবের কথায় নতুন রূপ ধরতে লাগল। কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে মীর-সাহেব হুমায়ুনের সমাধিতে করলেন ভর। বেলা দুটো-আড়াইটার সময় আমরা হুমায়ুনের সমাধিতে এসে বসতুম।
বেশ উঁচু প্রশস্ত চাতাল, তার উপরে সমাধি-মন্দির। মন্দিরও বেশ প্রশস্ত। সেইখানে ঠান্ডায় বসে মীর-সাহেবের কথা শুনতুম। শুনতে শুনতে দিল্লির ওই নিদারুণ দ্বিপ্রহরের রৌদ্রেও সান্ধ্য নেশা জমে উঠত।
একদিন মীর-সাহেব সমাধি-মন্দিরের কোণে একটা ঘর দেখিয়ে বললেন–এটা কি জানেন?
-আজ্ঞে, না।
মীর-সাহেব বলতে শুরু করলেন–দিল্লির সেই দুর্দিনে দিল্লির সম্রাট বাহাদুর শা আত্মরক্ষার জন্য সপরিবারে পালিয়ে এসে এই ঘরে লুকিয়ে বসেছিলেন। গুপ্তচরেরা গিয়ে ইংরেজদের খবর দিলে, আর তক্ষুনি তারা সদলবলে এসে তাঁদের গ্রেফতার করে হিঁচড়োতে হিঁচড়োতে টেনে নিয়ে গেল।
বলতে বলতে মীর-সাহেব ক্ষিপ্তপ্রায় হয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বলতে লাগলেন-একবার কল্পনা করুন সেই দৃশ্য। হুমায়ুন বাদশার আগে যিনিই ভারতের সিংহাসনে বসুন না কেন, সত্যি, করে বলতে গেলে হুমায়ুন বাদশাই মোগল সাম্রাজ্য দেশে কায়েম করে গিয়েছিলেন। ওই কোণে তাঁর বেগম হামিদাবানুর সমাধি রয়েছে–ওই দেখুন! এঁদের সামনে দিয়ে এঁদেরই শেষ বংশধরদের ইংরেজ হিঁচড়ে টেনে নিয়ে চলে গেল। দিল্লি তখন আগুনে ফুটছে! একদিকে ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচার, অন্যদিকে সিপাহীদের গোলমাল। তার ওপরে দস্যু-তস্করেরা প্রকাশ্য দিবালোকে লোকের বাড়িতে ঢুকে লুঠ-তরাজ করছে। হডসন বলে একজন সেনানী এঁদের ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা জনতার চিৎকার শুনে সেইখানেই তৎক্ষণাৎ হাতির পিঠ থেকে তিন রাজপুত্রকে টেনে রাস্তায় নামিয়ে দমাদ্দম গুলি করে মেরে ফেললে। রাজপুত্রেরা এই রাস্তার ওপরেই হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে হাত জোড় করে অনুনয় করেছিল–আগে দয়া করে অনুসন্ধান করুন–আমরা নির্দোষ কি না! কিন্তু সে-কথা কে শোনে!
বলতে বলতে মীর-সাহেব দৌড়ে গিয়ে হুমায়ুনের সমাধির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বিড়বিড় করে কি-সব বলতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে প্রবলবেগে সমাধিতে মাথাও ঠুকতে লাগলেন।
মীর-সাহেবকে যতই দেখতে লাগলুম, ততই অভিনব বলে মনে হতে লাগল।
নিত্য নতুন রূপ!
তাঁর সঙ্গ আমার শেষপর্যন্ত নেশায় দাঁড়িয়ে গেল।
একদিন হুমায়ুনের সমাধিতে আমরা বসে আছি এমন সময় বৃষ্টি নামল।
বেশ লাগছিল।
চারদিকের সেই তপ্ত পাথরের মধ্যে ঝমঝম বৃষ্টি আমার মনের মধ্যে কাব্যসৃজন করছিল। মীর-সাহেবের বগলে একটা করে দপ্তর থাকতই। সেদিন এই দপ্তর থেকে একটি চটি লম্বা মতন বই বার করে তিনি চেঁচিয়ে পড়তে আরম্ভ করলেন। পড়তে পড়তে তাঁর কণ্ঠস্বরে অশ্রুর আমেজ এসে লাগল। তারপরে এল একটু সুর। তারপর তিনি দস্তুরমতো গান ধরলেন।
করুণ সে কবিতা। তার ধ্বনি-মাধুর্যেই ধরা যায় যে, সে-কবিতায় করুণার প্রস্রবণ ছুটেছে। মীর-সাহেবকে জিজ্ঞাসা করলুম–কার লেখা?
তিনি বললেন–এ-কেতাবের নাম দেওয়ান-এ-জাফর-শা। সে-কেতাব ভারতের শেষ বাদশা বাহাদুর শাহের লেখা।
এই বলে তিনি কবিতার খানিকটা আমাকে বুঝিয়ে দিয়ে গান ধরলেন।
গাইতে গাইতে কিছুক্ষণের মধ্যে তাঁর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল।
অশ্রু জিনিসটা অত্যন্ত সংক্রামক। তাঁর চোখে অশ্রু দেখে আমার চোখেও অশ্রু উদ্গত হল।
বাইরে ঝমঝম করে বৃষ্টি ঝরছে, আমরা দু’টিতে সেই সমাধি-মন্দিরের মধ্যে বসে আছি। মনের মধ্যে হাহাকার করে বেড়াচ্ছে–’দেওয়ান-এ-জাফর-শা’-এর বয়েৎ–’হায় জাফর, তামাম হিন্দুস্থানের সম্রাট ছিলে তুমি–কিন্তু আজ তোমার সমাধির জন্য সাড়ে তিন হাত জমিও জুটল না!’
আজ অতীতের সেই দিনগুলি টুকরো টুকরো হয়ে মানসসাগরের উপরে ভেসে উঠছে দুর্দিনের সুখস্বপ্নের মতো। মনে হচ্ছে, সেদিনের সেই অভিজ্ঞতাগুলো আমার জীবনে কোন্ কাজে লেগেছে!
.
মীর-সাহেবের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি কি করে হল, সেই কথাটা বলে এই প্রসঙ্গ শেষ করি। আগেই বলেছি, মীর-সাহেবের সঙ্গ আমার একটা নেশার মতো দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ঠিক দ্বিপ্রহর হবার সঙ্গে-সঙ্গেই আমি অনুভব করতুম সেই দূরের ধ্বংসস্তূপ যেন আমাকে আকর্ষণ করছে। মীর-সাহেবের আসতে একটু দেরি হলে তাই আমি অত্যন্ত অস্বস্তি বোধ করতুম।
একদিন দ্বিপ্রহরে আমি ও মীর-সাহেব শের-মণ্ডল পরিক্রমণ করছি। ছাতের ওপর উঠে চারদিক দেখে নামবার উপক্রম করছি, এমন সময়ে মীর-সাহেব চিৎকার করে বললেন—-এইখান দিয়ে নামতে গিয়ে হুমায়ুন বাদশা পড়ে গিয়েছিলেন। তিনি আর সংজ্ঞা ফিরে পাননি। সেই অবস্থাতেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
সত্যি বলতে কি, সেই জায়গাটি এমন সঙ্গীন যে, সাধারণ লোকেরও ওঠানামা করতে ভয় হয়। বাদশা তো কোন্ ছার! যাই হোক, আমরা তো নামছি,–মীর-সাহেব আগে আর আমি পেছনে। এমন সময় হঠাৎ মীর-সাহেব একটা পা শূন্যে তুলে টাল খেয়ে নীচে পড়ে যাবার উপক্রম করলেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে মুণ্ডটা টেনে ধরে উপরে ছাতে তুলে আনলুম তারপর তাড়াতাড়ি নীচে নেমে, একরকম দৌড়ে রাস্তায় এসে গাড়িতে পড়লুম।
বেশ খানিকক্ষণ পরে মীর-সাহেব হাঁপাতে হাঁপাতে এসে উপস্থিত হলেন। আমাকে একরকম ধমকের সুরে বললেন–বেশ তো আপনি! আমি পড়ে গিয়ে দেখছিলুম, বাদশার মতো অজ্ঞান হয়ে পড়ি কি না, আর আপনি কিনা আমায় ধরে সব নষ্ট করে দিলেন।
আমি আর এ-কথার কি জবাব দেব! আমার বুকের মধ্যে তখনও ধড়ফড় করছিল। গাড়ি ঘুরে অভ্যাসমতো হুমায়ুন বাদশার কবরের দিকে চলতে লাগল, কিন্তু আমি মীর-সাহেবকে বললুম–আমার শরীর ভালো লাগছে না–বাড়ি ফিরে চলুন।
শরীর ভালো লাগছে না শুনে তিনি অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বলতে লাগলেন–নিশ্চয়ই আপনার সর্দিগর্মি হয়েছে।
মীর-সাহেব গাড়োয়ানকে হুকুম দিলেন–বাড়ির দিকে চল।
এদিকে সর্দিগর্মি হয়েছে শুনে আমার তো বুকের মধ্যে ধড়ফড়ানি আরও বেড়ে গেল।
বাড়িতে পৌঁছিয়েই বিছানায় লেটিয়ে পড়লুম। মীর-সাহেব কানের কাছে কি-সব বকর-বকর করতে লাগলেন–সেদিকে মন দিলুম না।
–কাল আবার যথাসময়ে আসব–এই বলে মীর-সাহেব বাসায় চলে গেলেন।
শুয়ে শুয়ে কেবল মনে হতে লাগল–আজ হাতে দড়ি পড়েছিল আর কি! মনের মধ্যে কে যেন বলতে লাগল–’দিব্যি আছ যাদু, পরের বাড়িতে থাকছ, দুবেলা পলান্ন পরম পরিতোষের সঙ্গে আহার করছ আর দ্বিপ্রহরে একটা পাগলার সঙ্গে নেচে নেচে দিন কাটাচ্ছ। বেশ চুটিয়ে চাকরি হচ্ছে!’
এতদিন বৃথাই কাটিয়েছি বলে সত্যিই আফশোস হতে লাগল। সংকল্প করলুম, কালই এখান থেকে লম্বা দিতে হবে।
পরের দিন সৈয়দ-সাহেব আসামাত্র জানালুম–আজ এক্ষুনি আমি দিল্লি ত্যাগ করছি। আপনি যা উপকার করেছেন, তা আমার চিরদিন মনে থাকবে।
আমি চলে যাচ্ছি শুনে সৈয়দ সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন–আমাদের দিক থেকে মেমান-নেওয়াজী’র কোনো ‘খিলাফ’ হয়েছে কি?
আমি বললুম–কিছুমাত্র না। কিন্তু আরও দশটা শহরে আমাকে যেতে হবে তো।
সৈয়দ-সাহেব বললেন–আবার দিল্লিতে এলে আমার এখানে এসেই উঠবেন। এই ঘর সর্বদা আপনার জন্য খোলা থাকবে।
এখানে বলে রাখি, বছর দু’ তিনেকের মধ্যেই একবার দিল্লিতে গিয়েছিলুম। কিন্তু ‘আফ্তাব’ তখন অস্তমিত এবং সৈয়দ-সাহেব যে কোথায় ডুব মেরেছেন তার সন্ধান পাওয়া গেল না।
যাই হোক, সৈয়দ-সাহেবকে বলে তো তখুনি ইস্টিশনে চলে এলুম। আগে থাকতেই ঠিক হয়েছিল আমি পাঞ্জাবের দিকে খানিকটা অগ্রসর হয়ে আগে চলে আসব, কিন্তু কেন জানি না আমার আর ওপরের দিকে উঠতে ইচ্ছে হল না। বেলা চারটের সময় জি. আই. পি.-র গাড়িতে চড়ে আমি বোম্বাই-এর দিকে যাত্রা করলুম।
.
ভোরবেলা গাড়ি এসে থামল ঝাঁসী স্টেশনে। এর আগেও বার-দুয়েক এই রাস্তায় আসা-যাওয়া করেছি। ঝাঁসী স্টেশন থেকে পাহাড়ের ওপরের ছোট দুর্গটি আমাকে বরাবরই আকর্ষণ করেছে। এবারে স্টেশনে গাড়ি থামা মাত্র বাক্স-বিছানা নিয়ে আমি নেমে পড়লুম। টাঙ্গাওয়ালা একটা সরাইখানায় নিয়ে গিয়ে পৌঁছল।
সেই মামুলি সরাই। একটি ঘরে একটি দরজা!
যাই হোক, জিনিসপত্র রেখে, আমি আমার ব্যাগে ব্যবসার পক্ষে জরুরি জিনিস নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। কয়েকদিন দিল্লিতে বৃথা কাটিয়ে মনের মধ্যে অনুশোচনা হচ্ছিল, তাই সকাল থেকেই কাজে লেগে গেলুম।
তখনও লোকজন ওঠেনি। আমি খুঁজে খুঁজে একটা চায়ের দোকান বার করে সেখানে চা-খাওয়ার নামে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে গ্রাহক পাকড়াবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লুম।
রাস্তায় ঘুরে ঘুরে এ-বাড়ি সে-বাড়ি দরজা ঠেলে সেদিন বেলা বারোটার মধ্যে জন-পাঁচেক লোককে গেঁথে ফেলা গেল। একদিনের পক্ষে অনেক কাজ হয়েছে মনে করে এক ময়রার দোকান থেকে বেশ করে কচুরি-আলুরদম ঠেসে, সরাইয়ে ফিরে, টেনে একটি ঘুম দেওয়া গেল।
ঝাঁসীতে আশাতীতভাবে আমার কাজ হতে লাগল। দিল্লিতে যে-কদিন বৃথাই কাটিয়েছিলুম, ঝাঁসীতে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে তার চেয়ে বেশি কাজ পেয়ে গেলুম।
আগেই বলেছি বিকেলে কাজেই বেরুতাম না, কিন্তু একদিন কি খেয়াল হল বিকেলবেলাতেই আমার জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। কিন্তু কাজ করতে মন লাগছিল না। তাই কেল্লার পাহাড়েই উঠে পড়া গেল।
পাহাড় মানে পাথরের খানিকটা উঁচু ঢিপি। আমার জিনিসপত্র একটা কালো পাতলা কাঠের বাক্সের মধ্যে থাকত। সেইটে বয়ে নিয়ে বেড়ানো ছিল সুবিধাজনক। পাহাড়ে উঠে আমি কেল্লার এদিক-ওদিক দেখছি এমন সময় একটা নোটিশের দিকে নজর পড়ল। তাতে লেখা রয়েছে–এই কেল্লার কোনো জায়গার ফোটো যদি কেউ নেয় তা হলে সে আইন-অনুসারে দণ্ডনীয় হবে।
ছোট্ট কেল্লা।
বাইরে থেকে দেখবার বিশেষ কিছু নেই।
আমি সেদিক থেকে সরে এসে সূর্যাস্ত চেয়ে দেখছি, এমন সময় আমার পাশ থেকে একটি ভদ্রলোক ইংরেজিতে বললেন–এখানে ফোটো-নেওয়া বারণ।
আমি বললুম–এটা ক্যামেরা নয়, এতে অন্য জিনিস আছে।
লোকটির বয়স বেশি নয়, ছাব্বিশ-সাতাশ বছর হবে, সুন্দর চেহারা। আমায় হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন–আপনার বাড়ি কোথায়?
আমি বললাম–কলকাতায়।
তিনি সবিস্ময়ে পরিষ্কার বাংলায় বললেন–আমরা বহুকাল কলকাতায় বাস করেছি। বাঁশতলা গলিতে আমরা থাকতুম। আমি এনট্রান্স পাস করবার পর আমার বাবা রিটায়ার করে আমার লেখাপড়ার জন্য আগ্রায় বাস করছিলেন। আগ্রা থেকেই আমি বি. এল. পাস করি
আমি বললাম–তাহলে তো আপনি বাংলা বলতে পারেন।
তিনি ইংরেজিতেই বললেন–আমি ভালো বলতে পারি না, কিন্তু আমার বোন, সে বাংলা ইস্কুলে পড়ত, সে আপনাদের মতই বাংলা বলতে পারে।
কথাবার্তা এগোতে লাগল। কথাবার্তা শুনে মনে হল তিনি বেশ অমায়িক লোক। একবার কথা বলতে বলতে আমার কাঁধের কাছে তাঁর মুখটা এনে গলা খাটো করে জিজ্ঞাসা করলেন–এখানে খাওয়া-দাওয়ার কি ব্যবস্থা হচ্ছে? আপনাদের খাদ্য তো এখানে সহজে মেলে না।
আমি হেসে বললুম–তাই আপনাদের খাদ্য খেতে হচ্ছে!
ভদ্রলোক বললেন–এখানকার কাজ শেষ করে আপনি আমাদের ওখানে চলে আসুন, আমি কথা দিচ্ছি–সেখানেও আপনার অনেক কাজ হবে। তা ছাড়া আমার বোন খুব ভালো মাংস রাঁধতে পারে। আপনাদের ‘লোচি’-ও সে ভালো করে তৈরি করতে পারে। তা আপনি মেহমান–আপনার জন্য এসব তৈরি হলে রোজ সন্ধ্যাবেলা আমারও কিছু জুটবে। কতদিন যে ‘মাংস’ খাইনি!
বলতে বলতে ভদ্রলোক জিহ্বা ও তালুতে চটাং করে একটা আওয়াজ করলেন।
তাঁর বাড়ির সংবাদ নিলুম। এই শহর থেকে দূরে অন্য মহকুমার একটা শহরে তিনি বাস করেন। তিনি সেখানকার উকিল এবং কথাবার্তায় বুঝলুম পসারও ভালো আছে। ভদ্রলোক আমার নাম জেনে নিলেন এবং বললেন–আমার নাম দেওকীনন্দন ভার্গব।
কথা.বলতে বলতে আমরা পাহাড়ের নীচে নেমে এলুম। তাঁকে টেনে একটা চায়ের দোকানে নিয়ে গেলুম। চা খেতে খেতে আলাপ রীতিমতো জমে গেল। তিনি বললেন–এই রবিবারেই আসুন। সেখানে কিছুদিন থেকে আবার না-হয় আসবেন।
ভদ্রলোককে কথা দিলুম–নিশ্চয়ই যাব।
তিনি বললেন–চলুন, আপনার বাসা দেখে আসি।
সরাইখানায় আমার বাসা দেখে তিনি অনুতাপ করে বললেন–ছি ছি, এরকম বাসায় থাকলে আপনি অসুখে পড়ে যাবেন।
মনে মনে হাসলুম।
সরাইয়ের বাইরে বেরিয়ে এসে তিনি তাঁর গন্তব্যস্থানে চলে গেলেন–আমিও সান্ধ্যকালীন আহার্যের ব্যবস্থায় মন দিলুম।
কচুরি আর রাবড়ি। তবে তখনকার দিনে খাঁটি ঘি আর খাঁটি দুধের অভাব ছিল না। এখনকার মতো সাপের চর্বি আর পচা গুঁড়ো-দুধের কারবার যদি তখন থাকত তাহলে যেখানে-সেখানে ওইসব খাবার খেয়ে এই জাতক লিখতে বসবার সুযোগ ঘটত না।
.
কয়েকদিন যেতে-না-যেতে একদিন সকালবেলায় দেখি দেওকীনন্দন এসে হাজির। উনি আমাকে একেবারে তুমি সম্বোধন করে বললেন–চল বন্ধু, তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি। কাল একটা কাজে এখানে এসেছিলুম–মনে করলুম রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে তোমায় নিয়ে যাব।
এই বলে সে আমার বিছানাপত্তর বাঁধতে আরম্ভ করে দিলে। তার এই আগ্রহ-ভরা আহ্বান উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। বাইরে টাঙ্গা দাঁড়িয়ে ছিল–সরাইওলাকে তার প্রাপ্য চুকিয়ে দিয়ে সওয়ার হওয়া গেল।
ঝাঁসী থেকে ঘণ্টাদেড়েক ট্রেনযোগ গিয়ে সেখানে পৌঁছলুম। স্টেশন থেকে বেশ খানিকটা দূরে তাদের বাড়ি। সেখানে গিয়ে যখন পৌঁছলুম, তখন বেলা এগারোটা বেজে গেছে। বাড়ির মধ্যে ঢুকে একটু গিয়েই দেওকীনন্দনের বাবার ঘর। সে আমায় নিয়ে সেই ঘরে ঢুকে বললে–এইটি আমার অফিস।
ঘরখানি সাজানো-গোছানো। চকচকে আলমারিতে আইনের বইগুলি ঝকঝক করছে। মফস্সলের উকিলের ঘরে সাধারণত এ-দৃশ্য দেখা যায় না। ঘরের খানিকটা জায়গা আলমারি সাজিয়ে পার্টিশন করা হয়েছে। ঘরের মধ্যে ঘর হলেও এ জায়গাটিতে বেশ আলো-বাতাস, সেখানে একখানি তক্তপোশ পাতা রয়েছে।
দেওকীনন্দন আমায় বললে–এইখানে থাকতে তোমার কোনো অসুবিধা হবে কি? না হলে ওপরেও ঘর আছে–সেখানেও থাকবার ব্যবস্থা হতে পারে।
আমি বললুম–না, না–এ তো চমৎকার জায়গা। আমি কিরকম ঘরে থাকতুম, দেখেছ তো।
সে নিজেই তক্তপোশের ওপর আমার বিছানা পেতে পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করে দিলে। ভাঙা টিনের বাক্সটা খাটের তলায় ঢুকিয়ে দিয়ে বাড়ির ভেতর দিকে তাকিয়ে ডাক দিলে–গোরি!
ভেতর থেকে ক্ষীণ নারীকণ্ঠের জবাব এল–আয়ি।
একটু পরেই হাত মুছতে মুছতে যিনি ঢুকলেন–কি বলে তাঁর বর্ণনা করব ঠিক বুঝতে পারছি না। ‘গোরী’ তো তিনি বটেই, একেবারে যাকে বলে ‘গোরোচনা গোরী’। সোনা-রঙের মধ্যে লালের আভা, তার ওপরে দীর্ঘাঙ্গী। পরিপূর্ণ নিটোল যৌবন। কিন্তু পরিপূর্ণ নিটোল যৌবন বললেও তার সবখানি বলা হয় না। এমন সৌষ্ঠব ও সুষমাময়ী নারী এত কাছে এর আগে কখনও দেখিনি।
অঙ্গে তাঁর একখানি ‘মোটা আধময়লা থান, বাড়িতে কেচে কেচে সেখানা প্রায় লাল হয়ে এসেছে। গায়ে সেইরকমই সাদা একটি জামা।
দেওকীনন্দন আমাকে সম্বোধন করে বললে–এই আমার বোন–নাম সুভগা। আমরা গোরি বলে ডাকি।
বোনকে সম্বোধন করে সে বললে–বাবুজীকে ধরে এনেছি, ইনি এখন এখানে কয়েকদিন থাকবেন। এঁকে রোজ মাংস রেঁধে খাওয়াতে হবে।
মুখখানা আমার দিকে ফিরিয়ে স্মিতহাস্যে দু’খানি নিরাভরণ হাত তুলে আমাকে নমস্কার করে পরিষ্কার বাংলায় বললেন–নমস্কার! আমার ভাই আপনার কথা আমায় বলেছেন। আপনার দেশে আমি জন্মেছি। বাঙালিদের ইস্কুলে অনেকদিন পড়েওছিলুম।
আমি বললুম–আপনি তো বেশ পরিষ্কার বাংলা বলেন।
গোরি বললে–পরিষ্কার বাংলা বলতুম, কিন্তু এখন আদৎ ছুটে গেছে।
দেওকীনন্দন বললে-বাবুজীকে যত্ন-আত্তি করবার ভার তোমার ওপরে রইল। আমি সারাদিন কাজের চাপেই থাকি।
সুভগা আমায় জিজ্ঞাসা করলে–এবেলা ভাত খাবেন না রুটি খাবেন? আমি তো একবেলা ভাত আর একবেলা রুটি খেতুম।
বললুম–ভাতই খাব। অনেকদিন ভাত খাইনি।
সুভাগা আবার জিজ্ঞাসা করলে–চা-টা খাবেন?
চায়ের কথা শুনে দেওকীনন্দন লাফিয়ে উঠলো–হ্যাঁ, হ্যাঁ–দুকাপ চা-ই পাঠিয়ে দাও।
সুভাগার চেহারার মধ্যে পুরুষকে আকর্ষণ করবার শক্তি ছিল প্রবল। এই শক্তি শুধু চেহারার ‘খুব-সুরুতি’র উপর সব সময় নির্ভর করে না। এ এক অন্য বস্তু। অন্তত আমাকে তার সে-চেহারা এমনভাবে আকর্ষণ করলে যা ইতিপূর্বে কোনো নারী করেনি।
তারপর চা এল; চা খেতে খেতে দেওকীনন্দন তার সংসারের কথা কিছু কিছু আমায় শোনালে। সুভগার বিয়ে হয়েছিল–তার স্বামী বিলেতে পড়তে গিয়েছিল এবং সেইখানেই সে মারা যায়।
চা খাওয়া হল।
কিছুক্ষণের বিশ্রামের পর স্নান সেরে আহারাদি সারা হল, কিন্তু আমার মনের মধ্যে সারাক্ষণই সুভগার চিন্তা ও তার চেহারা ঘুরতে লাগল।
আহারাদির পর দেওকীনন্দন বললে–এখন কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর।
বিছানা পেতে শুয়ে পড়লুম। ঘুমোবার চেষ্টা করতে লাগলুম কিন্তু ঘুম কোথায়! মন ঘুরতে লাগল সেই সুভগার আশেপাশে। মাঝে মাঝে তার চিন্তা মন থেকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলুম কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য। বিকেলবেলা দেওকীনন্দনের কাছে তার দু’একজন বন্ধু এল। আমি দেশটাকে দেখবার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লুম। বেরোবার সময় সে বলে দিলে–সন্ধ্যাবেলায় চা খাওয়ার আগে ফিরে এসো।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। থেকে-থেকেই সুভগার চেহারা আমার মনের মধ্যে ঘুঘু করতে লাগল। যতই তার চিন্তা থেকে মনকে ছাড়িয়ে নিতে চাই–একটু পরেই দ্বিগুণ বেগে ততই আমার মন তারই চিত্তার দিকে ছুটে যায়। সে যেন আরব্য-উপন্যাস-বর্ণিত সেই বিরাট চুম্বকের পাহাড় আর আমি সিন্ধবাদ নাবিকের জাহাজের পেরেকের মতো ছুটে গিয়ে তারই অঙ্গে লেগেছি।
.
যাই হোক, রাত্রিবেলা মাংস-রুটি খেয়ে শুয়ে পড়া গেল। মনে হল, সকালবেলা মন শান্ত হয়ে যাবে।
কিন্তু পরদিন ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে তার চিন্তা শুরু হল। আমি আমার জিনিসপত্তর নিয়ে কাজে বেরিয়ে পড়লুম–ভাবলুম কাজে ব্যাপৃত থাকলে মন হয়তো অন্যত্র সরে যাবে। কিন্তু কোথায় কি! দু’একটা খদ্দেরের সঙ্গে কথাবার্তাও হল। কিন্তু মনের আর-একদিকে তার চিন্তা পাক খেতে লাগল। মনে মনে ভাবলুম–এই কি ভালোবাসা–এই কি প্রেম?
প্রেম একদিন এসেছিল আমার জীবনে কৈশোরের প্রারম্ভে অত্যন্ত আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত ভাবে। প্রকৃতির সমস্ত বাধাবিঘ্ন উপচে সে তার সমারোহ এনে ঢেলে দিয়েছিল আমার জীবনে। অস্বাভাবিক হলেও সে তার মর্ম-নিঙড়ানো মধুপাত্র এনে ধরেছিল আমার মুখের কাছে। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই তাকে আবার ফিরে যেতে হয়েছিল আমার জীবনযজ্ঞকে পণ্ড করে দিয়ে। এই কারণেই নারী এবং নারীর সঙ্গকে আমি সর্বদাই এড়িয়ে চলতুম। কিন্তু সমস্ত বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করেই মন আমার অনিবার্যরূপে সুভগার দিকে ঝুঁকে পড়ল।
ক্রমেই গোরিকে কাছে পাবার, তার সঙ্গে কথা কইবার–মোট কথা, তার সঙ্গলাভ করবার প্রবল ইচ্ছা মনের মধ্যে তাড়া দিতে লাগল। সকালবেলা কাজকর্ম সেরে যখন বাড়ি ফিরতুম, তখন দেওকীনন্দন বাড়ি থাকত না। আমি বাড়ির ভেতর ঢুকে গুর্গুর্ করে এটা ওটা সেটা–নানান কথা গোরিকে জিজ্ঞাসা করতুম। সে নিশ্চয়ই আমার মতলব বুঝতে পেরেছিল এবং মেয়েদের চারিদিকে যে রক্ষাকবচের আবরণী তাদের সমস্ত বিপদ থেকে আড়াল করে রাখে, তা ক্রমেই শিথিল হয়ে পড়েছিল, অর্থাৎ আমাকে সে প্রশ্রয়ই দিচ্ছিল।
একদিন নীচে তাকে দেখতে না পেয়ে ঝিকে জিজ্ঞাসা করল–সে কোথায় আছে?
ঝি খানিকক্ষণ বাদে আমায় এসে বললে–আপনাকে ওপরে ডাকছেন।
আর বেশি কথা বলতে হল না, তড়াক করে তিন লাফে দোতলায় উঠে গেলুম।
উঠে দেখি গোরি তক্তপোশে পা ছড়িয়ে বসে কি-যেন সেলাই করছে।
চেয়ার-টেবিল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো ঘর।
সে বললে–এটি আমার ঘর আর ওই পাশে আমার বড়-ভাইয়ের ঘর।
সেদিন বিশেষ কিছু কথা হল না। কিন্তু দিনের পর দিন ক্রমেই আমরা পরস্পর পরস্পরের নিকটবর্তী হতে লাগলুম।
ঝাঁসী থেকে হঠাৎ চলে আসার দরুন কতকগুলো জরুরি কাজ ফেলে আসতে হয়েছিল। সেখান থেকে তাগাদা আসায় ইতিমধ্যে আমাকে একবার ঝাঁসীতে ফিরে যেতে হল।
দেওকীনন্দন তো কিছুতেই ছাড়বে না, কারণ এখানেও অর্ডার বেশ ভালোই পাওয়া যাচ্ছিল। শেষকালে–পাঁচ-ছ’দিনের মধ্যে ফিরে আসব–এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাকে ঝাঁসীতে ফিরে যেতে হল। কিন্তু গোরির প্রবল আকর্ষণে সেখানে টেকাও আমার পক্ষে দুষ্কর হয়ে দাঁড়াল। দিন-দুয়েক কোনোরকমে কাটিয়ে আবার ফিরে এলুম।
একদিন দুপুরবেলা গোরিকে ইঙ্গিতে জানিয়ে দিলুম যে, আমি কিছু কিছু হাত দেখতে পারি। কথাটা শোনামাত্র সে তার কনকচম্পকবর্ণ দক্ষিণ-হস্তটি আমার সামনে প্রসারিত করে বললে–এটা দেখো তো!
আমি দু’হাতে তার হাতখানা একরকম জড়িয়েই ধরলুম।
সেই স্পর্শের অনুভূতি বর্ণনা করা আজ আমার পক্ষে দুঃসাধ্য।
গোরির জীবন-বৃত্তান্ত প্রায় সমস্তই আমি দেওকীনন্দনের কাছে শুনেছিলুম। তারই এক-একটি টিপে টিপে ছাড়তে লাগলুম। আর সে-ও অবাক হবার ভান করতে লাগল।
কিন্তু এসব ‘এহ বাহ্য’ কথার পর আসল কথাটি ছাড়লুম সবার শেষে। বললুম–কোনো লোক তোমাকে ভালোবাসে এবং সে তোমার জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে।
কথাটা শুনে সে মৃদুভাবে একবার হাতটা নিজের দিকে টেনেই আত্মসমর্পণ করলে। তারপরে তার বাঁ-হাতখানাও নিজের হাতে নিয়ে দেখতে লাগলুম এবং কে যে তাকে ভালবাসে–কিছুক্ষণ বাদেই তা প্রকাশ করে ফেললুম।
গোরি মোটেই আশ্চর্য হল না, কারণ সে আমার হাল-চাল দেখে আগে থাকতেই সব অনুমান করে নিয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্য হলুম যখন শুনলুম–সে-ও আমার প্রতি বিরূপ নয়। গোরি বলতে লাগল–আমি অতি হতভাগিনী, বিয়ের পরই বিধবা হয়েছি। বাপ-মা নিরন্তর মনে করতেন, বাড়িতে কালসাপ পোষা হয়েছে। আজ তাঁরা চলে গিয়েছেন কিন্তু নতুন করে আবার আজ তোমার দুঃখের কারণ হলুম।
আমি বললুম–দুঃখের কারণ কেন? তুমি আমার জীবনে অতি সুখের কারণ।
সে সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করল–কি করে? আমাদের মিলন কি করে সম্ভব হতে পারে? আমি বললুম–তুমি আমার সঙ্গে কলকাতায় যাবে, সেখানে আমি তোমায় বিয়ে করব। তারপর আমাদের সংসার একরকম চলেই যাবে।
–আবার বিয়ে! ছিঃ! ছিঃ! ছিঃ!–এই বলে সে আমার কাছ থেকে এমনভাবে একটু দূরে সরে গেল যে, আমি একেবারে দমে গেলুম। তার দুই চোখ দু’ফলা ছুরির মতো ঝকঝকিয়ে উঠল।
কয়েক দিন গোরি আর আমার সামনে এলো না। খাবার-দাবার সে দিত বটে, কিন্তু মুখের দিকে চাইত না। আমি মনে-মনে তাতে শেলাঘাত অনুভব করলেও মুখে কিছু প্রকাশ করলুম না।
এদিকে দেওকীনন্দন আমার সঙ্গে যেন আরও হৃদ্য ব্যবহার করতে লাগল। আমার বিমর্ষ মুখ দেখে সে বার বার জিজ্ঞাসা করতে লাগল যে, এ-বাড়িতে আমার কোনো অসুবিধে হচ্ছে কি না। তার সরল মনের আন্তরিকতা ও ব্যগ্রতা দেখে আমার মনে লজ্জা এলো-এ আমি করছি কি! যে বন্ধু তার পরিবারের মধ্যে অবাধে মেলামেশার সুযোগ দিলে, প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করলে, আমি তার কি প্রতিদান দিতে উদ্যত হয়েছি! মনে করলুম–আর এখানে থাকা নয়।
পরদিন দেওকীনন্দনকে বললুম–এবার ভাবছি পুণেতে যাব। সেখানেও কিছু অর্ডার হয়তো পেতে পারি। এখানে তো অনেকটা কাজই হল। কিন্তু আমাকে দশটা শহর ঘুরতে হবে তো?
দেওকীনন্দন জিজ্ঞাসা করলে যে, আমি আবার ফিরে আসছি কি না। কিন্তু আমি বললুম–অনেকদিন দেশ-ছাড়া আছি, ইচ্ছে আছে একবার কলকাতা ঘুরে আসব।
দেওকীনন্দন আর কিছু বললে না। আমি জিনিসপত্তর গোছগাছ করছি, দেওকীনন্দন তার কাজে বেরিয়ে গেছে–এমন সময় ছায়ামূর্তির মতো ধীর পদসঞ্চারে গোরি আমার কাছে এসে দাঁড়াল। দেখলুম তার চোখ-দু’টি ছলছলে। ধীরে ধীরে সে বললে–আমায় নিয়ে যেতে চেয়েছিলে–নিয়ে যাবে?
আমার সামনে সারা দুনিয়া তার কথা শুনে চক্কর খেতে শুরু করলে। জীবনে যত সুন্দর মুখ স্মৃতিপটে আঁকা ছিল সব যেন গোরির রূপ ধরে বলতে শুরু করলে–আমায় নিয়ে যাবে? আমায় নিয়ে যাবে?
আমার সারা অন্তরাত্মা চিৎকার করে উঠল–না–না। মুখে কিছু বললুম না–মাথা নামিয়ে বিছানা বাঁধতে লাগলুম।
একটু পরে গোরি ঘর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেল।
তার সঙ্গে আর আমার দেখা হয়নি।
এর কিছুদিন পরের কথা।
বোধহয় উনিশ-শ’-আট সাল কি ওইরকম কোনো একটা সময়। ক্ষুদিরামের ফাঁসির পর্ব শেষ হয়ে গেছে, বাংলার তখন তুঙ্গী অবস্থা। বাঙালির ছেলে বাংলার বাইরে যেখানে যায় সেখানকার জনসাধারণ তাকে সম্ভ্রমের চোখে দেখে, খাতির করে। আর তেমনি অত্যাচার করে পুলিশের লোকে।
আমি তখন ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে পড়েছি পুণে শহরে। মাথা গোঁজবার স্থান নেই; মুখে খাতির করলেও কেউ ভয়ে স্থান দেয় না। দিনকয়েক পুলিশের থানায় থানায় কাটিয়ে শেষকালে তাদের হাত থেকে ছাড়া পেলুম। পথে পথে ঘুরি। পেশা চশমা-ফিরি-করা। ঝাঁসী সফরের ফলে ট্যাকে যে অর্থ ছিল তা খরচ হয়ে গিয়েছে। ট্যাক-খালির সঙ্গে পেটও খালি যাচ্ছে।
পকেটে যখন কিছু পয়সা ছিল তখন এক পাঞ্জাবি দোকান থেকে চা খেতুম। তারাই এখন ও দুবেলা দু’কাপ চা দেয়; বলে–পয়সা হলে দাম দিয়ে দিও। মধ্যে মধ্যে যেদিন তারা লুকিয়ে মাংস রাঁধে সেদিন সন্ধেবেলা আমার ভুরিভোজন হয়। একসঙ্গে তিন-চারদিনের খাদ্য পেটে পুরে দিই। এই অবস্থায় পরমানন্দে দিন কাটছিল।
এই সময়ে একদিন সেই পাঞ্জাবি ভদ্রলোক আমায় বললেন–এখানে একজন বাঙালি থাকেন। তাঁকে তুমি চেনো?
আমি বললুম–না। কোথায় থাকেন তিনি?
সে বললে–কোথায় থাকেন তা তো জানি না, তবে পুণেতে সব লোকই তাঁকে চেনে। মস্ত যাদুকর তিনি। আচ্ছা, আমি তাঁর বাড়িটা খোঁজ করে তোমায় দেখিয়ে দেব।
কয়েকদিন বাদে আমার সেই পাঞ্জাবি বন্ধু পরতাব বললে–চল, বাড়ির খোঁজ পেয়েছি। খানিকটা দূরে একটা ছোট্ট-দরজাওয়ালা বাড়ি। বাড়ির একতলা ইঁটের তৈরি, দোতলায় খড়ের চাল। তার দরজা দেখিয়ে পরতাব বললে, এই বাড়ি।
তখন দরজার তালা ঝুলছিল দেখে চলে গেলুম। তারপরে সারাদিন রাত্রি ন’টা অবধি খোঁজ করেছি কিন্তু তালা তখনও খোলেনি। পরের দিন বেলা এগারোটা নাগাদ সেই বাড়িতে গিয়ে দেখলুম দরজা খোলা–হ্যাট খোলা।
আমি কড়া নাড়তেই উপর থেকে জানলা দিয়ে একখানি হাসিভরা মুখ বাড়িয়ে একটি ভদ্রলোক হিন্দিতে বললে–এই দরজা দিয়ে উপরে চলে আসুন।
সামনেই সিঁড়ি। উঠে ঢুকলুম একখানি ছোট ঘরে। ঘরটি বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। আমি ভদ্রলোককে নমস্কার করে বললুম—আমি শুনলুম আপনি বাঙালি, তাই দেখা করতে এসেছি।
ঘরের মেঝেতে একখানি চাটাই-এর উপরে একখানি ঘোড়ার-কম্বল পাতা। আমাকে তিনি হিন্দিতে বললেন–এইখানে বসুন।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম–আপনার বাড়ি কোথায়?
তিনি বললেন–আমার বাড়ি চিতোরগড়ে।
এতক্ষণে ভদ্রলোককে বেশ ভালো করে দেখলুম। শ্যামবর্ণ, সুন্দর মুখশ্রী, চওড়া বুক, সরু কোমর; আর চোখ-দুটি তাঁর অপূর্ব এক জ্যোতিতে যেন জ্বলজ্বল করছে। জিজ্ঞাসা করলুম–আপনার চিতোরগড়ে বাড়ি তো এখানকার লোকেরা আপনাকে বাঙালি বলে কেন?
ভদ্রলোক হাত জোড় করে বললেন–না, না, আমি বাঙালি নই; আমি যা কিছু করি সবই যৌগিক ক্রিয়ায়। আমি বাংলাদেশে যাইনি পর্যন্ত।
এই কথা শুনে আমার মনে পড়ল যে, যাদুকরকে বাংলাদেশের বাইরে অনেকে বাঙালি বলে অভিহিত করে। হঠাৎ চোখে পড়ল, ঘরের একটা কোণে তিনটে ইটের উপরে একটা মাটির হাঁড়ি, নীচে কাঠের আগুন ধিকিধিকি করে জ্বলছে। কম্বলের একদিকে একটা কেরোসিন-কাঠের বাক্স, তার উপরে খানকয়েক কাগজ ও দোয়াত-কলম। ঘরের আলোর দিকে দেয়ালের মধ্যে দুটো-তিনটে তাকে কতকগুলো খবরের কাগজ ও আর কি কি সব রয়েছে।
ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কোথায় থাক?
আমি বললুম–থাকবার কোথাও জায়গা নেই। একটা দোকানে আমার একটা বাক্স, একটা শতরঞ্চি ও একটা বালিশ আছে।
তিনি বললেন–আমার এখানে যদি অসুবিধা না হয়, এসে থাকতে পার। বললুম–তা হলে তো বেঁচে যাই।
তিনি বললেন–সেগুলো কতদূরে আছে?
পরতাবের দোকান কাছেই ছিল। বললুম–কাছেই আছে। নিয়ে আসব? ভদ্রলোক বললেন–যাও, নিয়ে এস।
তখনই পরতাবের দোকানের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লুম।
জিনিসপত্র নিয়ে এসে নিয়ে এসে দেখি, তিনি ভাতের ফ্যান গড়াচ্ছেন। আমায় জিজ্ঞাসা করলেন–তোমার নাম কি?
নামামৃত উচ্চারণ করে আমি জিজ্ঞাসা করলুম–আপনার নাম কি?
তিনি বললেন–আমার নাম ব্রিজশরণ। সঙ্গে সঙ্গে বললেন–আমাকে ভাইয়া বলে ডেকো, আমিও তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকব।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে, যাকে এর আগে কখনও দেখিনি, যার নাম কখনও শুনিনি-সে হয়ে গেল আমার ভাই। এইরকম পথে পথে আরও দু’একটি ভাই পেয়ে হারিয়েছি। যাক সে-কথা।
তাক থেকে খানকয়েক কাগজ নামিয়ে নিয়ে এসে ব্রিজশরণ কম্বলের উপর পাতলে। তারপর হাঁড়ি উলটে সেই কাগজের উপর সমস্ত ভাত ঢেলে ফেললে। পাশেই একটা ঠোঙায় চিনি ছিল, ভাতের উপর সেই চিনি সবটা ঢাললে। চিনিতে ভাতেতে বেশ করে মাখা হয়ে যাবার পর আর-একটুকরো কাগজ নিয়ে আধাআধি ভাত তাতে রেখে আমায় বললে–খাও।
আমিও বিনা-বাক্যব্যয়ে খেতে আরম্ভ করলুম। সেও খেতে লাগল। খাওয়া হয়ে গেলে কাগজগুলো জানলা দিয়ে রাস্তায় ফেলে দেওয়া হল। তারপর দু’জনে নীচে গিয়ে কল খুলে মুখ ধুয়ে, জল খেয়ে উপরে চলে এলুম।
সেদিন থেকে ব্রিজশরণের বাড়িতেই আশ্রয় নিলুম। সকালবেলা খাই। সন্ধেবেলার পরতাব যদি একবার চা দেয় তো কোনোদিন খাই, কোনোদিন তা-ও জোটে না। নিজের কাজকারবার একরকম বন্ধই রইল।
আমার এই নতুন আশ্রয়দাতাকে যতই দেখতে লাগলুম ততই অদ্ভুত বলে মনে হতে লাগল। উনুনে ফুঁ দিতে দিতে কখনও সে হাসতে-হাসতে গড়িয়ে পড়ে, কখনও-বা দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে কাকে ধমক-ধামক দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মনে হতে লাগল–শেষকালে কি এক পাগলার পাল্লায় এসে পড়লুম!
একদিন জনকতক লোক এসে ব্রিজশরণকে সন্ধেবেলা নেমন্তন্ন করলে। সেদিন সন্ধেবেলা ব্রিজশরণ আমাকে বললে–চল ভেইয়া, নেমন্তন্ন খেয়ে আসি।
দ্বিতীয়বার আর বলতে হল না, আমি তার সঙ্গ নিলুম। সেখানে গিয়ে দেখি অনেক লোক জড়ো হয়েছে, তার মধ্যে নারীর সংখ্যাও কম নয়। ব্রিজশরণ এসে দাঁড়ানো মাত্র সকলে তাকে দড়াদ্দড় প্রণাম করতে লাগল। ব্রিজশরণ কিছুতেই পায়ে হাত দিতে দেবে না। অবশেষে উপায়ান্তর না দেখে সে পা-দুটো পিছনে করে ধরাসনে বসে পড়ল।
যা হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাবার পর একটি হাত-দেড়েক বেশ মোটা ইস্পাতের ডাণ্ডা কোথা থেকে বার করে এনে তারা ব্রিজশরণের হাতে দিলে। সে ডাণ্ডাটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ এ-কথা সে-কথা বলে সেটার দিকে চেয়ে রইল। দর্শক-দর্শিকারা নীরবে অনিমেষ দৃষ্টিতে তার হাতের দিকে চেয়ে আছে। আমি তো ব্যাপার দেখে অবাক। নেমন্তন্ন খেতে এসে এ কী কাণ্ড! ব্রিজশরণের দৃষ্টি ক্রমেই সতেজ হয়ে উঠতে লাগল। প্রায় পনেরো-বিশ মিনিট সেই ডাণ্ডার দিকে সতেজে চেয়ে সে সেটাকে দুই হাতে ধরে তিন-চার-পাঁচটা পাক দিয়ে দিলে। অর্থাৎ দেড়-ইঞ্চি দু’ ইঞ্চি মোটা একটা ইস্পাতের লৌহদণ্ডকে প্রায় ইস্কুপ বানিয়ে ছেড়ে দিলে।
এর পর খাওয়া-দাওয়ার পালা। কিন্তু মহারাষ্ট্রীয়দের আহার্যের তালিকা দেওয়া নিষ্প্রয়োজন আর-একদিনের কথা। ব্রিজশরণ প্রতিদিন একখানি ভজন গান গাইত। তারপরে পদ্মাসন হয়ে বসে আধঘণ্টা পৌনে-একঘণ্টা স্থির হয়ে থাকত। এই ভজনগানটি আমার বড় ভালো লাগত। সে-গানটির কথাও ছিল যেমন সুন্দর, সুরও ছিল তেমনি মধুর। ব্রিজশরণের ভাঙা গলাতেও মোটেই তা শ্রুতিকটু বলে মনে হত না।
একদিন সন্ধেবেলায় ভজনগান ও স্থির হয়ে বসার পরে আমি তাকে বললুম–ভাইয়া গানটি আমায় লিখে দেবে?
আমার কথা শুনে সে বললে–তাতে কি হয়েছে! আমি এক্ষুনি লিখে দিচ্ছি।
কথাটা বলেই সে তাকের কাছে উঠে গেল। তাকের দিকটা অন্ধকার। ব্রিজশরণ বললে–ভাইয়া, ডিবেটা নিয়ে এসো তো।
ডিবেটা পেড়ে তার হাতে দিলুম। সেটা হাতে নিয়ে সে একবার সেটার মধ্যে, তারপর তাকটার দিকে তাকিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে–এই দেখ আমি এইখানে দোয়াত-কলম রেখেছিলুম–কে এইরকম করে নিয়ে যায়? নিয়ে যায় তো ঠিকমতো রেখে যায় না কেন?–ইত্যাদি বলে মহা তম্বি শুরু করে দিল। আমি কেরোসিনের ডিবেটা যথাস্থানে রেখে এসে বসতে-না-বসতেই সে বললে–আচ্ছা, আর একবার নিয়ে এসো তো।
এইবার দেখা গেল তাকের ওপর দোয়াত-কলম ও কতকগুলো কাগজ রয়েছে। ব্রিজশরণ খান-দুই কাগজ ও দোয়াত-কলম নামিয়ে তাকের দিকে তাক্বিয়ে বললে–ঠিক সময়ে দিয়ে যেতে মনে থাকে না বুঝি!
তার ছাপার অক্ষরের মতো সুন্দর দেবনাগরী হরফে সেই প্রায় এক পাতা ধরে ভজনটা লিখেই আমাকে বললে–নাও।
কাগজখানা মুড়ে পকেটে রাখছি, সে বললে–চল, এইবার শুয়ে পড়া যাক।
আলোটা নিবিয়ে শুয়ে তো পড়লুম। কিন্তু ব্যাপারটা আমার মোটেই সুবিধার বলে মনে হল না। ভাবতে লাগলুম–এর চেয়েও যে বাবা রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলুম সেও ছিল ভালো।
এমন সময় বাইরের রাস্তায় একটি শব-বাহকের দল কি-সব কথা বলতে-বলতে চলে গেল। ব্রিজশরণ বললে–ভেইয়া, শহরে খুব পেলেগ লেগেছে, একটু সাবধানে থেকো।
ভাবতে লাগলুম–একে এই ভূতগত ব্যাপার, তার উপরে আবার পেলেগ! আর-একদিন সন্ধেবেলায় ভজন গেয়ে ব্রিজশরণ তার ধ্যানে বসেছে, আমি একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছি। অদূরে কেরোসিনের ট্যামটেমিটা টিমটিম করছে। হঠাৎ যেন আমার মনে হল–সমস্ত ঘরখানা একটা ক্ষীণ সবুজ আলোয় ভরে উঠেছে, যেন খুব কম-শক্তির নিওন-লাইটের আলো। তারপরে দেখলুম খুব অস্পষ্ট সবুজ আলোর শিখা ব্রিজশরণের মাথার কাছে দপদপ করে কাঁপছে। আমি ভয় পেয়ে উঠে গিয়ে ব্রিজশরণকে ধাক্কা মেরে ডাকলুম–ভেইয়া, ভেইয়া–
ব্রিজশরণ কোনো কথা না বলে কম্বলের উপর ঢলে পড়ল এবং সেই মুহূর্তেই সেই ক্ষীণ আলো অন্তর্হিত হয়ে গেল। ব্রিজশরণ অনেকক্ষণ সেইরকম ভাবে পড়ে থেকে একবার উঠে বসে আবার তখুনি শুয়ে আমায় বললে–শুয়ে পড়ো।
আমি বাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লুম।
.
পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ব্রিজশরণ আমাকে বললে-ভেইয়া, আমি দিনকয়েকের জন্যে আমার একটু দরকারে বাইরে যাচ্ছি। চল–তোমার একটা ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
আমি বাক্স ইত্যাদি গুছিয়ে নিয়ে তার সঙ্গে চললুম। সে চলে যাবে শুনে মনের মধ্যে একটা ব্যথা অনুভব করছিলুম, কিন্তু উপায় কি?
প্রায় মাইল-খানেক পথ চলে আমরা একটা বাড়িতে এলুম। রাস্তা থেকে একেবারে সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা অবধি। উঠেই একটা বড় ঘর। আমি তার পিছু পিছু সেই ঘরে ঢুকে গেলুম। ঘরের একদিকে একটি বৃদ্ধ ভদ্রলোক বসে কি করছিলেন–ব্রিজশরণকে দেখে খুব খুশি হয়ে চিৎকার করে তার সংবর্ধনা করতে লাগলেন। তারপর আমার দিকে চোখ পড়তেই তাকে জিজ্ঞাসা করলেন –এ কে?
ব্রিজশরণ বললে-উনি একজন চশমার ট্র্যাভেলিং এজেন্ট। এ-দেশে এসে বিপদে পড়ে গেছেন। পয়সাকড়ি ফুরিয়ে গেছে, হেড-কোয়ার্টারে চিঠি লিখে-লিখে কোনো জবাব পাচ্ছেন না। আপনার এখানে একটু মাথা গোঁজবার স্থান ও আহারাদির ব্যবস্থা করে দেন তো বেচারির বড় উপকার হয়।।
ভদ্রলোক ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে আমাকে বললেন–তা আপনি এখানে থাকতে পারেন, যদ্দিন ইচ্ছা থাকতে পারেন। তবে ট্র্যাভেলিং এজেন্সিতে কিছু নেই। এ-দেশে চাকরি-বাকরি করুন, বিয়ে-থা করুন, বিয়ে-থা করে এ-দেশের লোক হয়ে যান।
ব্রিজশরণ লোকটির সঙ্গে আর কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে আমাকে রেখে চলে গেল। আমার বাক্স ও ব্যাগ ইত্যাদি রাখার জন্য একটা কোণ দেখিয়ে দিয়ে ভদ্রলোক বললেন –এখানে বোসো।
বাড়ির ভিতরের দিকে চেয়ে দেখলুম, অনেকগুলি মেয়ে সেখানে ঘোরাঘুরি করছে। আমার আশ্রয়দাতা তাদের মধ্যে একজনকে ডেকে মারাঠী ভাষায় কিসব বুঝিয়ে দিলে। আমি বসে আছি, মাঝে মাঝে এক-আধটা কথা আমাদের মধ্যে হচ্ছে, এমন সময় সেই মেয়েটি এসে আমাকে মারাঠী ভাষায় কি সব বললে, তার একবর্ণও আমি বুঝতে পারলুম না। লোকটি তক্ষুনি আমাকে বললেন–তুমি যদি চান করতে চাও, এর সঙ্গে যাও।
কতদিন যে চান করিনি তার ঠিকানা নেই। তাড়াতাড়ি একটা গামছা ও ধুতি বার করে মেয়েটির অনুগমন করলুম।
চান করবার পর খাওয়ার পালা। একপাল মেয়ে খাবার পরিবেশন ও খাওয়া পরিদর্শন করতে লাগল। বয়স তাদের পনেরো থেকে কুড়ির মধ্যে। অতগুলি স্বাস্থ্যবতী মেয়ে বাঙালির ঘরে একসঙ্গে দেখা যায় না। আহার্য অতি মামুলি হাতে-গড়া রুটি, তার সঙ্গে ঢ্যাঁড়স-ভাজা, তাও আবার বাদামের তেলে। তারপরেই একহাতা ভাত, একটুখানি ঘন ডাল, তারপর এক চামচ জোলো দুধ। এর চেয়েও ব্রিজশরণের কাছে চিনি দিয়ে মাখা ভাত খেয়ে ঢের বেশি তৃপ্তি হত।
এখানে থাকতে থাকতে জানতে পারলুম যে এটি একটি অনাথ-আশ্রম। একে মারাঠী খাদ্য, তায় অনাথ-আশ্রম। দুবেলা এক খাবার কলের মতো খেয়ে যেতে লাগলুম। এইসব মেয়েরা সকলেই অনাথিনী, এদের সংগ্রহ করা হয়েছে প্লেগ-হাসপাতাল থেকে অথবা কেউ ব্যবস্থা করে দিয়ে গিয়েছে। সেই বৃদ্ধ ভদ্রলোক এই অনাথ-আশ্রম চালাবার জন্য সরকার থেকে টাকা পান। তা ছাড়া মিউনিসিপ্যালিটি ও অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান এদের সাহায্য করে থাকে। বাড়িতে পুরুষমানুষ দেখতেই পেতুম না, কেবল আমার খাওয়ার সময় জনকয়েক লোক এসে আমারই সঙ্গে পিঁড়িতে বসে ওই খাদ্য খেত। বেশ গুণ্ডা চেহারা তাদের, মেয়েদেরও বেশ গোলগাল চেহারা। মনে হয়, ওই খাদ্য মুখরোচক না হলেও যে পুষ্টিকর সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই।
তেতলার ঘরখানা গোটা দোতলার উপরে। সেই ঘরে দিনের বেলা দলে দলে কম্পোজিটার এসে কি-সব কম্পোজ করে আবার বিকেলবেলা চলে যায়। এই কম্পোজিটারদের দুটো র্যাকের মাঝখানে একটুখানি জায়গায় আমার স্থান নির্দিষ্ট হয়েছিল। অন্ধকার রাত্রে দেশলাই জ্বালিয়ে সেইখানে আমার বিছানাটুকু করে শুয়ে শুয়ে বিড়ি ফুঁকতাম। রাজ্যের চিন্তা এসে আমার মগজে ভিড় করতে থাকত। এইসব চিন্তাকে চমকে দিয়ে নীচে রাস্তায় শবযাত্রীর দল চিৎকার করতে করতে চলে যেত। রোজই শুনতুম, প্লেগ দিনে দিনে ছড়িয়ে পড়েছে। কখন কাকে চেপে ধরে, পালাবার পথ নেই। আমি উপায়বিহীন, নিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকতুম।
একদিন আশ্রমের মালিক আমায় বললেন–তুমি নাকি পুলিশের গুপ্তচর?
আমি বললুম–পুলিশ-কমিশনারের চাকরি পেলেও আমি করব না–গুপ্তচর-বৃত্তি তো দূরের কথা।
আশ্রমের কর্তা বললেন–গুপ্তচর হতে পার কিন্তু তাতে আমার কিছুই করতে পারবে না। আমিও পুলিশের লোক। তবে তুমি তো কাজকর্ম কিছুই কর না বাপু। তাই সন্দেহ হয়।
আমি চুপ করে আছি দেখে তিনি বললেন–তুমি এখানে একটি চাকরি করো। বলো তো আমি চাকরি দেখে দিতে পারি। এইখানকার একটি মেয়ে, তা সে তোমার পছন্দমতো যে-কোনো মেয়েই হোক, বিয়ে করে এইখানেই ঘর-সংসার করো।
তাকে বললুম–আচ্ছা, ভেবে দেখব।
আশ্রমে একটি ভদ্রমহিলা সপ্তাহে দু’ তিনবার করে আসতেন। তাঁর বয়স প্রায় পঞ্চাশ হবে। হাসি-হাসি মুখ, খুব কথা বলেন। আশ্রমবাসী সকলেই তাঁকে লছমীমায়ী না লছমীবাঈ কি বলত, আমি বুঝতে পারতুম না। তিনি মধ্যে মধ্যে মেয়েদের মিষ্টি খাওয়ার জন্যে পয়সা দিতেন। সকলকেই তিনি ভালোবাসতেন; আর তারাও সকলে তাঁকে ভালোবাসত। আমার খাবার সময়ে মাঝে মাঝে তিনি কাছে এসে বসতেন এবং এটা খাও, ওটা খাও ইত্যাদি বলে তদারক করতেন। ভদ্রমহিলা বেশ গড়গড় করে হিন্দি বলতে পারতেন। আশ্রমের কর্তা যেদিন আমাকে চাকরি ও বিয়ের কথা বললেন তারই দিন-দুই পরে লছমীমায়ী এসেছিলেন। সেদিন বাড়ি যাবার সময় তিনি আমায় ইশারায় ডেকে রাস্তায় নামিয়ে নিয়ে এলেন।
নামিয়ে নিয়ে এসে বললেন–তোমাকে কিছুদিন থেকে এখানে দেখছি। তোমার বাড়ি কোথায়?
বললুম–আমার বাড়ি কলকাতায়। কার্যব্যপদেশে এখানে এসে বিপদে পড়ে গেছি। তিনি বললেন–তুমি বিদেশি লোক। অল্প বয়স তোমার। এ-সময়ে এখানে থাকা তো ঠিক নয়। চারিদিকে প্লেগ হচ্ছে। কখন যে কাকে ধরে তার ঠিক নেই।
বললুম–কি করব! আমার হাত-পা বাঁধা। হয়তো এইখানেই মরতে হবে।
ভদ্রমহিলা বললেন–তুমি জান এই বাড়িতে প্রতিবছর একজন-না-একজন আক্রান্ত হয়। শুধু এ-বাড়িই কেন–কোন্ বাড়ি না? গেলবছর তোমারই মতন আমার একটি ছেলে ধড়ফড় করে মারা গেল ওই রোগে।
কথাটা শুনে আমার বুকের ভিতর গুর্গুর্ করে উঠল। ভদ্রমহিলা আমার মাথার চুলগুলোর মধ্যে আঙুল চালাতে চালাতে বললেন–তোমারই মতন তার চুল ছিল কোঁকড়া। তোমারই বয়সি হবে।
বলতে বলতে তাঁর চক্ষু সজল হয়ে উঠল। তাঁর সেই চোখ দেখে আমার মা’র অশ্রুসজল মুখখানির কথা মনে পড়ল। অমনি সঙ্গে সঙ্গে এ-কথাও মনে হল যে, দেশে-দেশান্তরে ছড়িয়ে আছে আমার মায়ের দল। ভরসায় বুক ভরে উঠল। বললুম–আমার কাছে একটি পয়সা নেই। এখান থেকে যে চলে যাব তারও কোনো উপায় নেই।
ভদ্রমহিলা একেবারে ‘তুমি’ ছেড়ে “তুই’ সম্বোধন করলেন। বললেন–আচ্ছা, আমি যদি তোকে ভাড়ার টাকা দিই তুই যাবি তো?
বললুম–নিশ্চয়ই।
ভদ্রমহিলা চলতে আরম্ভ করলেন। আমিও সঙ্গে সঙ্গে চললুম। তিনি বললেন–না, না তোর হাতে আমি নগদ টাকা দেব না। তোর মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুই বড় দুষ্টু ছেলে। তা কলকাতা যাবার ভাড়া কত? আমি তোকে টিকিট কিনে দেব।
আমি বললুম–আপাতত আমার আগ্রা যেতেই হবে। আপনি আমার আগ্রা পর্যন্ত টিকিট কেটে দিন, তা হলেই হবে।