প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

মরমী কথাশিল্পী – দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়

মরমী কথাশিল্পী – দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় 

“যখন গল্প লিখলুম, লোকে বললে, এসব আমার নিজের কথা। আর যখন আত্মজীবনী লিখলুম, সবাই বললে গল্প লিখেছি।” সাহিত্যশিল্পী প্রেমাঙ্কুর আতর্থী বললেন ঈষৎ মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে। নিজের সাহিত্যকর্মের বিচারে পাঠকদের বিবেচনা-শক্তিকে যেন বিশ্লেষণ করতেন–পাঠকবর্গের এ কেমন সিদ্ধান্ত? গল্পের কল্পনাকে তাঁরা লেখকের নিজের কথা অর্থাৎ বাস্তব এবং জীবনস্মৃতিকে অলীক কাহিনি সাব্যস্ত করেছেন! 

আতর্থী-মহাশয়ের রচিত সাহিত্য পাঠ করে অনেকে কল্পনাকে বাস্তব এবং বাস্তবকে কল্পনা মনে করায় তিনি যেন কিছু হতাশা বোধ করেন। তাঁর হয়তো ধারণা হয়েছিল, তাঁর সাহিত্যের আবেদন সেই পাঠকদের মনে যথোচিত সাড়া জাগাতে পারেনি। তাই সে নিবিড় দুঃখ-সুখের বিচিত্র জীবন-লীলা, বাস্তবের নানা অঘটন ঘটালোকের কাছে অ-যথার্থ বোধ হয়েছে এবং কল্পিত মানসবিলাসের কলা-কৌশল প্রতিভাত হয়েছে সত্যের রূপে। 

লেখক হয়তো চিন্তা করে দেখেননি, তাঁর সাহিত্যশিল্প সার্থক হওয়ার জন্যেই পাঠকদের এই চিত্তবিভ্রম ঘটে। পাঠকের মন এমন করে হরণ করে যে সাহিত্য তা শিল্পকর্মরূপে অনিন্দ্য সাফল্যেরই নিদর্শন। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সাহিত্যকৃতি এই শ্রেণীর! তাঁর রচনায় অলীক ও সত্য, ভাব ও বস্তু অঙ্গাঙ্গি মিশে গিয়ে ঘটনা ও মানস একান্ত অন্তরঙ্গ হয়ে পাঠকের চিত্তে এক গভীর অনুভব সৃষ্টি করে। আন্তরিক হৃদয়াবেগে উদ্বেল তাঁর সাহিত্য দেখা দেয় পরম উপভোগ্য বস্তু হয়ে। পাঠকের মন এক অপরূপ আনন্দ-বেদনার রসে আপ্লুত হয়। দরদী লেখকের অসামান্য বর্ণনাশক্তির গুণে বর্ণিত ঘটনাবলীর মধ্যে সত্য ও মিথ্যা কতখানি আছে, ও প্রশ্ন তখন অবান্তর। জীবনের সত্য সাহিত্যের সত্য হয়ে কখন পাঠকের চেতনায় একাকারে মিশে যায়। 

এমন জীবন্ত, এমন আন্তরিকতার রস-সমুজ্জ্বল আতর্থী-মহাশয়ের সাহিত্য-রচনা! মানুষের রূপলোক ও অন্তরলোকের এমন শিল্পসুন্দর উদ্ঘাটন, এমন সজীব নিসর্গ-চিত্র, এমন মর্মস্পর্শী প্রকাশরীতি ও বর্ণনাশৈলী যাঁর, তিনি যে পাঠকদের মন অধিকার করবেন, তাতে আর আশ্চর্যের কি আছে! মরমী কথাশিল্পী প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন জাত-সাহিত্যিক। প্রাণের প্রতপ্ত আবেগ, যথার্থ শিল্পীমানস এবং বিপুল অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ জীবনকে তিনি সাহিত্যায়নের কাজে নিয়োজিত করেছিলেন। 

তিনি বলতেন–”Feel করলেই লেখা যায়।” এটি তাঁর বিনয়ের কথা। অর্থাৎ তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন বলেই যেন লিখতে সক্ষম হন। লেখা এমন কিছু কঠিন ব্যাপার নয়। 

কথাটা কিন্তু সঠিক বলে মেনে নেওয়া যায় না। অনুভব তো মানুষ মাত্রেই করে থাকে। কিন্তু তার প্রকাশ-ক্ষমতা আছে ক’জনের? শিল্পী ভিন্ন তা সম্ভব নয়। আর যেমন-তেমন প্রকাশ হলেও চলে না। শিল্পসৃষ্টির মাধ্যমে সেই ভাব সঞ্চারিত করা চাই অপরের মনে। তিনি নিজেও এ-কথা অন্যরকমভাবে একবার লিখেছিলেন। “মানুষমাত্রেই, সে নারী হোক বা পুরুষই হোক, ভালোবাসার শক্তি তার সহজাত; কিন্তু ভালোবাসা প্রকাশ করবার শক্তি যে দেবদুর্লভ। ঠিক রসিক ও কবিতে যে পার্থক্য।” (“মহাস্থবির জাতক’, দ্বিতীয় পর্ব)। 

তিনি ছিলেন দুর্লভ শক্তির অধিকারী, স্বভাবশিল্পী। তাই তাঁর মর্মোৎসারিত রচনা পাঠকের প্রাণে প্রত্যক্ষ সাড়া জাগায়। তাঁর সৃষ্ট সব চরিত্র যেন জীবন থেকে উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। লিপি-নৈপুণ্যে তাদের চোখের সামনে দেখা যায়, এমন সজীব। পাঠকের ধারণা হয় যে গল্পের পাত্রপাত্রীরা বাস্তব জগতেরই মানুষ, বর্ণিত কাহিনি একদিন সত্যই ঘটেছিল। 

আরো একটি কারণে তাঁর গল্পগুলি তাঁর ‘নিজের কথা’ অর্থাৎ সত্য মনে হয় অনেক পাঠকের। তা হল–তাঁর উৎকৃষ্ট অনেক গল্পের মূল চরিত্র ও আখ্যান বাস্তব-জীবন থেকে নেওয়া। দৃষ্ট ও শ্রুত জগৎকেই তিনি আপন অনুভবের রঙে রঞ্জিত করে তাঁর সাহিত্যের উপাদানস্বরূপ ব্যবহার করেছেন রীতিমতো দক্ষতার সঙ্গে। 

এ-বিষয়ে কয়েকটি দৃষ্টান্ত এখানে দেওয়া যায়। তাঁর গল্পগুলির মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘মোতিলাল’, বাস্তবের ভিত্তিতে রচিত। বাস্তব-জগতের মোতিলাল প্রেমাঙ্কুরের সুপরিচিত ছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর চরিত্র সমগ্রভাবে গল্পটির আকারে প্রকট হয়নি। গল্পের প্রয়োজনে শিল্পী প্রেমাঙ্কুর তাঁর জীবন-কাহিনি সুসমঞ্জসভাবে পরিবর্তিত ও অনুরঞ্জিত করে দেন। তাঁর অপর একটি গল্প ‘বড়দা’ সম্পর্কেও এ-কথা প্রযোজ্য। ‘পাগলিনী’র আখ্যানভাগ সম্পূর্ণ সত্য। উত্তর-কলকাতার সুকিয়া স্ট্রিট অঞ্চলে একসময় এই ভিখারিনীকে সকলে জানত। পাগলিনীর সঙ্গে কয়েকদিন কথা বলেন প্রেমাঙ্কুর। এই গল্পের তাঁর নিজস্ব সংযোজন হল, শেষাংশের শ্যাম (কৃষ্ণ) সম্পর্কে বিবৃতিটি। তাঁর দেখা পাগলিনীর জীবনে এই মহৎ উপসংহার ছিল না। এই অংশটুকু যুক্ত করে দিয়ে গল্পটিতে তিনি যে অভাবনীয় উচ্চাঙ্গের ব্যঞ্জনা দেন, তা তাঁর শিল্পকর্ম–শিল্পী-মানসের এক উজ্জ্বল স্বাক্ষর। ‘শেফালী’ গল্পের মূলেও সত্য আছে, তবে পরিবেশ রচনার জন্য অনুকূল কাল্পনিক আবহ সৃষ্ট করেন। পশ্চিমাঞ্চলের সেই কুষ্ঠরোগীর ছোটগল্পটি সম্পূর্ণ বাস্তব উপকরণ নিয়ে হুবহু লেখা। ‘হিন্দু-মুসলমান ফ্যাক্ট’ গল্পে যে ওস্তাদজীর বর্ণনা আছে তা সাক্ষাৎভাবে বিখ্যাত সরোদী করামউল্লার চরিত্র অবলম্বনে গঠিত। ওস্তাদ করামউল্লার কথা প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গীত-শিক্ষা-প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হবে। এই গল্পে করামউল্লার চরিত্র, ধ্যান-ধারণা ও কথাবার্তার ধরন-ধারণ সঠিকভাবে বর্ণনা করে লেখক দেখিয়েছেন যে হিন্দু-মুসলমান মিলনের জন্য pact যতই হোক, মুসলমান ধর্মান্ধতা এবং ধর্মাহঙ্কারের জন্য আসল fact অন্যরকম। ১৯৪৬ সালে কলকাতার দাঙ্গার অব্যবহিত পরে তিনি এই গল্পটি লেখেন। তাঁর ‘ত-এ-তাউস’ শিশিরকুমার ভাদুড়ীর পরিচালনায় ও প্রধান ভূমিকায় শ্রীরঙ্গম্ মঞ্চে অভিনীত হবার পরে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকথা নিয়ে লেখা একটি হালকা সরস রচনা হল তাঁর ‘নাট্যকার’ নামক গল্পটি। 

এমনিভাবে দেখা যায়, তাঁর বেশিরভাগ গল্পে তিনি সম্পূর্ণ বাস্তব উপাদানে তাঁর গল্পগুলি গঠন করেছেন। এ-বিষয়ে অধিক উল্লেখের প্রয়োজন নেই। নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে যেমন বেশি যাননি, তেমনি কল্পনার আশ্রয়ও বেশি নেননি সাহিত্যসৃষ্টির ক্ষেত্রে। তাঁর অনেক সাৰ্থক গল্প এই পর্যায়ের। 

অবশ্য কিছু গল্প তাঁর আছে যা নিজের অভিজ্ঞতা-প্রসূত নয়। কিন্তু সেখানেও কল্পিত কাহিনি তেমন স্থান পায়নি। এসব ক্ষেত্রে তিনি অন্যের জানাশোনা বাস্তব ঘটনা বা বিবৃতি নিয়ে কাজ করেছেন গল্পের উপকরণ হিসাবে। তাই থেকে আখ্যানভাগ পুনর্গঠিত করেছেন। তাঁর একটি অনবদ্য সৃষ্টি ‘দুই রাত্রি’ এই শ্রেণীর রচনা। এই মর্মস্পর্শী কাহিনিকে ছোট উপন্যাস না বলে বড় গল্প বলাই সমীচীন। এমন আন্তরিকতার রসে ‘দুই রাত্রি’ গল্পটি নিষিক্ত, বর্ণনাশক্তির গুণে এর মূল চরিত্র দুটি, বিশেষ নায়িকার, এমন জীবন্ত এবং ঘটনা-বৈচিত্র্য এমন আকর্ষক যে পাঠকের স্বভাবতই মনে হবে যে, এ গল্প-লেখকের নিজের কথা। অন্তত তাঁর স্বচক্ষে দেখা। কিন্তু তা নয়। এর মূল আখ্যান অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত এবং সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনার বিবরণ মাত্র। শিল্পাচার্য অবনীন্দ্রনাথ খবরের কাগজের এই অংশটি প্রেমাঙ্কুরকে গল্প-রচনার জন্য দিয়েছিলেন। জামাতা, সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের অন্তরঙ্গ সুহৃদ প্রেমাঙ্কুরকে বিশেষ, স্নেহ করতেন অবনীন্দ্রনাথ। যে হোক, সংবাদপত্রের সেই সামান্য বিবৃতিটুকুকে তিনি এক অসামান্য সাহিত্যশিল্পে পরিণত করেন–গল্পের ভূমিকা, পরিবেশ, বিস্তারিত আখ্যান এবং নায়ক-চরিত্র পরিকল্পনা করে এই নায়ক মূল গল্পে ছিল না। তাকে গল্পের ঘাত-প্রতিঘাতের সঙ্গে সুদক্ষভাবে যুক্ত করে দিয়ে যেভাবে পরিণতির পথে নিয়ে গেছেন তা তাঁর বিশিষ্ট প্রতিভার দ্যোতক। গল্পের অনেক স্থানে এমন প্রগাঢ় জীবনবোধের প্রকাশ ঘটেছে যে পাঠকদের অভিভূত হতে হয়। যথা : “জীবনযাত্রা শুরু করবার আগে রানি খুব চড়া পর্দায়ে সুর বেঁধেছিল। কিন্তু সংসার তাকে বুঝিয়ে দিলে, যে-পর্দায় সুর বেঁধেছিল সে-পর্দায় সুর বাঁধাই চলে, বাজানো চলে না। জীবন-যন্ত্রের সমস্ত তারগুলি আলগা করে দিয়ে আবার সে নতুন পর্দায় সুর বাঁধলে।” 

তাঁর ‘বৌঠান’ গল্পের আখ্যান বস্তুত ‘দুই রাত্রি’র মতন সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ঘটনা। এটিও অবনীন্দ্রনাথ তাঁকে খবরের কাগজের অংশ থেকে দেন। 

তাঁর আর একটি গল্প আছে, তার রর্ণিত ঘটনাস্থল হল পশ্চিমের এক দেহাতী অঞ্চল। ‘আমি’র জবানীতে বিবৃত এ গল্পে সেখানকার এক নারীর নিরুদ্দিষ্ট স্বামিভ্রমে নির্যাতিত হবার কৌতুক-করুণ বর্ণনা এমন নিখুঁতভাবে করা হয়েছে যে, তা স্বয়ং লেখকের এক প্রাণান্তকর অভিজ্ঞতা। আসলে এটি সেসিল বি ডি. মিলি-র একটি বইয়ের এক ঘটনার পরিবর্তিত রূপ। 

এমনিভাবে তাঁর হৃদয়গ্রাহী রচনাশক্তির গুণে চরিত্রগুলি জীবন্ত হয়ে পাঠকের মনশ্চক্ষুতে দেখা দেয়, তা সে-কাহিনি তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা কিংবা অন্যের কাছে পাওয়া গল্প, যাই হোক। এমন বেশ কয়েকটি ছোটগল্প তাঁর আছে যা ভুলে যাবার নয়। 

তাঁর সাহিত্যসৃষ্টির একটি গূঢ় কথা এই যে মানুষকে তিনি অন্তস্তল পর্যন্ত গভীরভাবে দেখেছেন এবং তাকে স্বরূপে উদ্‌ঘাটিত করেছেন যথার্থ শিল্পীর হাতে। তাঁর অতিশয় সংবেদনশীল ও স্পর্শকাতর মনে বিশেষ ধরনের (টাইপ) চরিত্র আকর্ষণ জাগাত বেশি এবং মানুষটিকে তিনি ছাঁকা তুলে নিতেন মনের পটে। সেই বিশিষ্ট মানুষটিকে, তার সংসার বা পরিবার এসবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করে নয়। তারপর অন্তরের গাঢ় হৃদয়ানুভূতিতে তাকে সঞ্জীবিত করে প্রকাশ করতেন। বাস্তব চরিত্র বা ঘটনা বা কাহিনি সংগ্রহ করবার সঙ্গে তিনি তাদের স্বাভাবিক পটভূমিও যথাসম্ভব উপস্থাপিত করেন রচনায়, গল্পের প্রয়োজনে ঘটনাসংস্থানের অদলবদল করে নিয়ে। 

তাঁর সাহিত্য-রচনার মূল অনুসন্ধানের প্রশ্নে বর্তমান লেখককে তিনি ওইভাবে নিজের সাহিত্যমানসের ব্যাখ্যা করেছিলেন। 

তাঁর লেখার এক প্রধান আকর্ষণ হল বর্ণনাশক্তির সৌকর্য। তাঁর বর্ণনা একাধারে ত্রুটিহীন বাস্তব এবং কবিত্বময়। চিত্রধর্মী এবং অতিমনোগ্রাহী তার বর্ণনার গুণে জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রত্যেক বিষয়। বহিরঙ্গ জীবনযাত্রার নানা প্রসঙ্গ থেকে আরম্ভ করে প্রাণের গোপন কথা, মানুষের নন্দন-কান্তি কিংবা চির বৈচিত্র্যময় নিসর্গ-চিত্র, রস-রসিকতা কিংবা মর্মন্তুদ বেদনা অন্তস্তলের সূক্ষ্মতম অনুভূতি কিংবা স্থূল ইন্দ্রিয়গ্রামের বৃত্তান্ত, স্মৃতির বিভিন্ন রহস্যস্বাদ কিংবা বর্তমানের চেতনা-অনুভবের সচকিত উদ্ঘাটন, ভোগবিলাস ও দেহাত্মবাদ কিংবা অদৃষ্টবাদ ও অধ্যাত্ম-জিজ্ঞাসা ইত্যাদির চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গ পাওয়া যায় তাঁর বর্ণচ্ছটাময় বর্ণনায়। 

ভাষা এবং প্রকাশশৈলী দুই-ই তাঁর নিজস্ব সম্পদ, তা কারুর অনুকৃতি নয়। আত্মবিকিরণের আকৃতিতে স্বভাবসুন্দর ভাষণ। সংস্কৃত ও প্রাকৃত, মার্জিত ও কথ্য রূপের অপরূপ সম্মিলনে ঐশ্বর্যময় তাঁর ভাষা। সেই সঙ্গে বিচিত্র জীবন-রসের জন্য তাঁর সাহিত্যের এক স্বতন্ত্র আস্বাদ। এবং পাঠকের মনে তা অনুরূপ অনুরণন জাগায়। 

তাঁর রচনার কিছু কিছু নিদর্শন এখানে উদ্ধৃত করে দেওয়া হল : 

“আকাশ থেকে একটা পৃথিবী-জোড়া অন্ধকার নীচের দিকে নেমে আসতে-আসতে হঠাৎ মাঝপথে থমকে দাঁড়িয়ে গেল। আমার বহুদিন বিস্মৃত ছেলেবেলার কথাগুলো একে একে মনে পড়তে লাগল।” (বাজীকর) 

“জ্ঞান ফিরে আসবার পর দেখতে পেলুম দূরে স্মৃতিসাগরের ওপারে আমার অতীত জীবনটা এই সুখদুঃখমাখা সংসারের মধ্যে ফিরে আসবার জন্যে দু’হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। উপরে চেয়ে দেখলুম সন্ধ্যাকুমারী অস্তরবির সোনালী পাড়ওয়ালা নীলাম্বরী পরে পৃথিবীর সামনে এসে মোহন বেশে দাঁড়িয়েছে। চারদিকে পরিপূর্ণ সৌন্দর্যের মাঝখানে আমার এ-জীবনটা নিষ্ফলে কেটে গেছে।” (বাজীকর) 

“সামনে চেয়ে দেখলুম, দিনান্তের নিভন্ত চিতার শেষরশ্মিটি তখনও কুতুবমিনারের চূড়ার ওপরে ধ্বকধ্বক করে জ্বলছে। পূর্বদিক থেকে একটা বিরাট অন্ধকার পাখা মেলে সেই আলোটুকুকে গ্রাস করবার জন্যে ছুটে আসছে।” (বাজীকর) 

“মাথার ওপর তো চাদর টেনে দিয়ে শুয়ে পড়া গেল। কিন্তু মনের ওপর যেই চাদর মুড়ে দেবার চেষ্টা করি, অমনি সেই নূপুরের আওয়াজ যেন চাদরের একটা খুঁট তুলে ধরে বলতে থাকে–কোথায়? দেখি দেখি, এত লজ্জা কিসের?” (নিশির ডাক) 

“বাঁশীর সুর গুমরে-গুমরে আমার রুদ্ধ দুয়ারে এসে আঘাত করতে লাগল। সে কি করুণ অনুনয়–যানে! ওরে যাসনে! আমাকে ফেলে যাসনে? (চাষার মেয়ে) 

“দারিদ্র্য কাকে বলে এতদিন তা আমার জানা ছিল না, কুকুরের মতো সে আমার শ্বশুরের সংসারের পেছনে ঘুরতে থাকত…।” (চাষার মেয়ে) 

“পরের দিনের সকালটা যেন দিনের বুকে অসাড় হয়ে পড়ে রইল। কিছুতেই আর সে যেতে চায় না।” (চাষার মেয়ে) 

“সুখের আনাচে-কানাচে দুঃখ ঘুরে বেড়াচ্ছে, জীবনের পায়ে-পায়ে মৃত্যু ঘুরে বেড়ায় এ আমরা দেখেও দেখি না।” (চাষার মেয়ে) 

“সন্ধ্যার অন্ধকারে আমরা দৈন্যের লজ্জা ঢেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লুম।” (চাষার মেয়ে) “মানুষের হৃদয় বিচিত্র উপাদানে তৈরি। অপরে তো দূরের কথা, মানুষ নিজের হৃদয়কেই চিনতে পারে না। মানুষ সুখে দুঃখে হাসে কাঁদে, বাঁচে মরে, কিন্তু তার নিজের মধ্যে যে রহস্যময় জগৎ রয়েছে, তার কোন্ কোঠায় কি সঞ্চিত আছে তা সে জানেও না।” (চাষার মেয়ে) 

“কে যেন স্মৃতিসাগর থেকে এক আঁচলা জল তুলে নিয়ে আমার চোখে ঝাঁপটা মারলে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল।” 

“দীনবন্ধু ন্যায়রত্ন জন্মেছিলেন বটে এ-যুগে, তাঁর মনটা বাঁধা ছিল সে-যুগের খোঁটায়। আধুনিক ঝড়ঝাঁপটা যতবারই তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করেছে, ততবারই তিনি দ্বিগুণ বেগে সে-যুগের খোঁটার মূলে ফিরে এসেছেন।” (কল্পনাদেবী) 

“কিন্তু বিয়ে জিনিসটা তো আর ভালোবাসার টিকে নয়।” (কল্পনাদেবী) 

“বয়সে সে বৃদ্ধা কিন্তু যৌবন যে তার ঝড়ের মধ্যে দিয়ে কেটেছে এ-বয়সেও তার চিহ্ন বর্তমান।” (কল্পনাদেবী) 

“আকাশে তখনো মেঘের ছুটোছুটি থামেনি। সেদিন প্রতিপদের চাঁদখানা মেঘের ওড়নায় মুখ ঢেকে কার অভিসারে ছুটে চলেছিল, কিন্তু চঞ্চল বাতাস বার বার তার মুখের বসন খসিয়ে দিয়ে তাকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলছিল। নীচে ছায়ানটের গম্ভীর করুণ তানে ঘাটের ওপর বার বার আছড়ে কি কথা জানাচ্ছিল কে জানে।” (অচল পথের যাত্রী) 

“উমার চোখ দুটো ছিল আশ্চর্য উপাদানে তৈরি। আমার মনে হত সে-দুটো যেন সর্বদা জ্বলছে। সেই আগুনের পশ্চাতে যে অশ্রুসাগর লুকানো আছে, ঘুণাক্ষরে সে-কথা জানতে পারা যেত না।” (অচল পথের যাত্রী) 

“সমুদ্রতীর। আমার সামনে দিগন্তহীন নীলজল থৈ থৈ করছে। সমুদ্রে একটুও ঢেউ নেই। মধ্যে মধ্যে আমার বুকের দীর্ঘশ্বাসের মতো সমুদ্রের বুকখানা একটু ফুলে উঠছে মাত্র। তারপর দিগন্তব্যাপী একটা শব্দ–হ্যাঁ হা হা।” (অচল পথের যাত্রী) 

“শীত কেটে গেল। নিশান্তে সুন্দরীর জাগরণের মতো প্রকৃতি সবেমাত্র তার চোখ খুলেছে। চোখের জড়তা ও আলস্য তখনো কাটেনি। ধরণীর এই যৌবন-সৌন্দর্য দেখবার জন্য আকাশ তার চোখ থেকে কুয়াশা মুছে ফেলেছে। এইরকম একটা সময়ে একদিন দুপুরবেলা চিররহস্যময় চিরমৌন হিমালয়ের প্রতিচ্ছবি আকাশে ফুটে উঠল। আমি ভাবলুম, এবার আমার যাবার সময় হয়েছে।” (অচল পথের যাত্রী). 

“যে-চোখ শরৎপ্রভাতের সৌরকরোজ্জ্বল শিশিরবিন্দুর মতো ঝলমল করত সে-চোখ যেন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছে, যেন ঊর্মিমুখর সাগর একটা প্রাকৃতিক বিপ্লবে শান্ত হয়ে গিয়েছে।” (মহাস্থবির জাতক, দ্বিতীয় পর্ব) 

“আমার মূর্ছিত অতীত চমকে উঠে বিস্মিত বর্তমানের দিকে চেয়ে রইল।” (মহাস্থবির জাতক, দ্বিতীয় পর্ব) 

এই ধরনের ভাষা ও ভঙ্গিতে তাঁর রচনা দীপ্তিময় হয়ে আছে। আরও উদ্ধৃত করবার অবকাশ থাকলে দেখানো যেত, জীবন-সত্যের কত দুর্লভ চকিত প্রকাশে তাঁর নানা গল্প, উপন্যাস ও আত্মজীবন সমৃদ্ধ। 

তাঁর আত্মস্মৃতি-কথন ‘মহাস্থবির জাতক’ তাঁর শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকর্ম। চার খণ্ডের এই জাতক-গ্রন্থাবলী বাংলা-সাহিত্যে তাঁর নামকে স্মরণীয় করে রাখবে। তাঁর এই পরিণত বয়সের এবং শেষ সৃষ্টিকে শ্রীমণ্ডিত করেছে তাঁর রচনার সমস্ত মনোহারী বৈশিষ্ট্য। আত্মজীবনীর উপকরণে গঠিত তাঁর জাতক বিষয়বস্তু ও দৃষ্টিভঙ্গির অভিনবত্বে বাংলা-সাহিত্যে এক অনাস্বাদিতপূর্ব রসের সন্ধান দিয়েছে, শরৎচন্দ্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘শ্রীকান্ত’ প্রথম পর্বের সগোত্র হয়েও প্রেমাঙ্কুরের ‘মহাস্থবির জাতক’ আপন বিশিষ্ট ঐশ্বর্যে ভাস্বর। 

বিংশ শতকের এই জাতকের ঘটনাবলী রচয়িতার নিজ উক্তি অনুসারে–”শতকরা ৯০ ভাগ সত্যি”। অপরপক্ষে শরৎচন্দ্রের উক্ত সৃষ্টিতে বাস্তব ও কল্পনার অনুপাত প্রায় বিপরীত হতে পারে। কিন্তু দুই গ্রন্থের মধ্যে বিষয় ও গুণগত সাদৃশ্য হল-অনন্য, বিচিত্র চরিত্রাবলী ও নাটকীয় ঘটনা-পরম্পরায় বিধৃত সুগভীর জীবন-জিজ্ঞাসা এবং স্বকীয় শিল্পদৃষ্টির আলোকপাতে প্রাণরহস্যের উদ্ভাসন। 

এই দু’টি গ্রন্থের জীবনবোধের কোনো তুলনাত্মক আলোচনা এখানে লক্ষ্য নয়, তাদের সাজাত্য উল্লেখ করাই উদ্দেশ্য। 

‘মহাস্থবির জাতক’-এর লেখক অল্পবয়স থেকেই বিদ্যালয়ের বাইরে জীবনের বৃহত্তর পাঠশালায় যে পাঠ সাক্ষাৎভাবে পেয়েছিলেন, তাঁর আপন-বিশিষ্ট সত্তা অন্তরের প্রেরণায় যেমন বিকাশলাভ করেছিল, যে অন্তর্দৃষ্টিতে জীবন, জগৎ ও মানুষকে তন্নিষ্ঠ হয়ে দেখেছিলেন, জীবনে পঙ্কে-পঙ্কজে যে অমৃতের সন্ধান করে বেড়িয়েছিলেন আকুল আবেগে–জাতকের ছত্রে ছত্রে সেই পিয়াসী মনের, সেই ভূয়োদর্শনের, সেই স্বেচ্ছা-যাযাবরের বৃত্তান্ত দীপ্যমান হয়ে আছে। লেখকের মহৎ আত্মজিজ্ঞাসা এবং আত্মপ্রকাশের এক সুন্দর স্বাক্ষর ‘মহাস্থবির জাতক’। 

“আমার চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, মন ও বুদ্ধির অগোচরে যে আরো একটা রহস্যলোক আছে সেখানকার ইঙ্গিত এই প্রথম এলো আমার জীবনে। তারপর সারাজীবন ধরে আভাসে ইঙ্গিতে সেখানকার কত বার্তাই আমার কাছে এসে পৌঁছল কিন্তু সে-লোকে প্রবেশ করবার হদিশ আজও পেলুম না। জীবনের এই অভিজ্ঞতা প্রকাশ করবার জন্যেই এই জাতকের অবতারণা; এই অভিজ্ঞতার জন্যই আমি মহাস্থবির।” 

(‘মহাস্থবির জাতক’, দ্বিতীয় পর্ব) 

“আমি খুঁজব তাঁকে যিনি আমার ভাগ্যলিপি লিখেছেন। জিজ্ঞাসা করব তাঁকে, কেন তিনি দিলেন আমার মধ্যে আবেগ ও আকুলতা, অথচ সংসারের প্রতিটি জিনিসকে লেলিয়ে দিলেন আমার বিরুদ্ধে যেন কোনো কাজেই আমি সাফল্যলাভ না করতে পারি।’ 

(‘মহস্থবির জাতক’, তৃতীয় পর্ব) 

“কবি বলেছেন সুখদুঃখ দু’টি ভাই? মায়ের পেটের ভাই কি চোরে চোরে মাসতুত ভাই–সে-বিষয়ে তিনি নীরব, তাই সুখ ও দুঃখ সম্বন্ধে এইখানে তেড়ে একটি ভাষণ ঝাড়বার প্রলোভন হচ্ছে।” 

(‘মহাস্থবির জাতক’, তৃতীয় পর্ব) 

“আমার মনে হতে লাগল, আমি যেন এই রহস্যের গভীরতম গভীরে প্রবেশ করছি, নিজের ইচ্ছায় নয়, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে। তার কাজ শুধু টেনে নিয়ে যাওয়া আর আমার কাজ শুধু বিস্মিত হওয়া। বিস্ময়রসই জগতের একমাত্র রস। সমস্ত রসেরই অন্তরতম প্রদেশে আছে বিস্ময়। যে বিস্মিত হয় না, সেই শুধু অন্য রসে মজতে পারে।” 

(মহাস্থবির জাতক, দ্বিতীয় পর্ব) 

এই একধরনের তত্ত্বদর্শী মন্তব্য জাতকে মাঝে মাঝে দেখা যায় তার দু-একটি নিদর্শন এখানে দেওয়া হল। নিয়মশৃঙ্খলা ও বিধি-নিষেধের গণ্ডী ভেদ করে তিনি বেরিয়েছিলেন বৃহত্তর জীবনের পথে-বিপথে। স্বচক্ষে জগৎটাকে দেখতে গিয়ে দুঃখসুখের ও সুদুর্লভের বিপুল অভিজ্ঞতায় তাঁর জীবনের পাত্র প্রায় পূর্ণ হয়েছিল। ভূয়োদর্শী লেখকের সেইসব লব্ধ জ্ঞানের নানা পরিচয় ইতস্তত ছড়িয়ে আছে জাতকের নানা স্থানে। যথা : 

“মানুষের মধ্যে যত প্রকার শ্রেণী আছে–অর্থাৎ জ্ঞানী, অজ্ঞানী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বিবেচক, অবিবেচক, ধূর্ত, নির্বোধ, সুবোধ, দুর্বোধ–এদের কারুকেই স্রেফ দেখেই বোঝা যায় না কোন শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ যারা পরশমণির ছোঁয়া পেয়েছে–তাদের দেখলেই চেনা যায়। অন্তত এই শ্রেণীর যত লোকের সাহচর্যে আমি এসেছি তাদের দেখেই চিনতে পেরেছি।” 

(মহাস্থবির জাতক, তৃতীয় পর্ব) 

“দুষ্ট লোক পরের সুখে হিংসা করে ও পরের দুঃখে আনন্দিত হয়। সাধারণ লোক পরের সুখে হিংসা করে ও পরের দুঃখ সম্বন্ধে উদাসীন থাকে। অসাধারণ লোক পরের দুঃখে দুঃখী হয় এবং পরের সুখ সম্বন্ধে উদাসীন থাকে। ভালো লোক পরের দুঃখে দুঃখী এবং পরের সুখে সুখী হয় কিন্তু পরের সুখদুঃখকে এমনভাবে ভোগ কর’ যে সম্ভব হতে পারে তা এখানেই প্রথম দেখলুম।” 

(মহাস্থবির জাতক, দ্বিতীয় পর্ব) 

এবার তাঁর পারিবারিক কথা সংক্ষেপে কিছু বলব। তাঁর পিতা মহেশচন্দ্র আতর্থীর পূর্বনিবাস ছিল ঢাকা-বিক্রমপুরের শিমুলিয়া গ্রামে। মানিকগঞ্জের বিপিনবিহারী রায়চৌধুরীর জমিদারিতে নায়েব ছিলেন। সেই সময়ে কর্মোপলক্ষে কোনো সময়ে ফরিদপুরে অবস্থানকালে দ্বিতীয় পুত্র (তৃতীয় সন্তান) প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দের পয়লা জানুয়ারি তারিখে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর একমাস বয়সে মহেশচন্দ্র আতর্থী স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করতে থাকেন, যদিও সতেরো বছর বয়সেই তিনি কলকাতায় এসেছিলেন। মহেশচন্দ্র আতর্থী সমাজসেবা ও সমাজ সংস্কারের প্রবল প্রেরণায় ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে। তিনি বিবাহ করেছিলেন জনাই-এর মুখুজ্জে-পরিবারে। তাঁদের দশটি সন্তান হয়েছিল–পাঁচ পুত্র ও পাঁচকন্যা। 

‘একটি বিচিত্র জীবন’ শীর্ষকে শ্রীপ্রভাতকুমার গঙ্গোপাধ্যায় মহেশ আতর্থী সম্বন্ধে লিখেছেন (‘রবিবাসরীয় যুগান্তর সাময়িকী’ ৫ জুলাই ১৯৬৪) 

মহেশচন্দ্রের চরিত্রে একটি দিক এমন ছিল, যার প্রতিক্রিয়ায় সম্ভবত প্রেমাঙ্কুরের জীবনের গতিপ্রকৃতি স্বতন্ত্র ধারায় বিবর্তিত হয়। 

ধর্মীয় আচার-ব্যবহার সংস্কারাদিতে নিষ্ঠার আতিশয্য গোঁড়ামির প্রচণ্ড পর্যায়ে পৌঁছেছিল মহেশচন্দ্রের জীবনে। উপরন্তু তিনি অত্যন্ত ক্রোধী ছিলেন। পুত্রদের শিক্ষাদান ইত্যাদি বিষয়ে সদা-শাসন নিতান্ত কঠোরতায় পর্যবসিত হয়েছিল। বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে প্রেমাঙ্কুর স্বভাবতই বীতরাগ ও অমনোযোগী ছিলেন, পিতার নিষ্ঠুর তাড়নার ফলে পাঠ্যপুস্তক ও গৃহজীবন দুই-ই বিভীষিকাময় হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। পিতা-পুত্রের সম্পর্কিত এইসব অধ্যায় যথাযথভাবে ‘মহাস্থবির জাতকে’ চিত্রিত আছে। 

বাল্যকাল থেকেই দুরন্ত-স্বভাব প্রেমাঙ্কুর পিতার প্রবল পীড়নেও বশ্যতা স্বীকার করলেন না। বিদ্যাচর্চাতেও উন্নতি হল না আদৌ। আধ-ডজন স্কুল অদল-বদল করেও কোনোক্রমে সেকেন্ড ক্লাস পর্যন্ত পৌঁছতে পেরেছিলেন। ব্রাহ্ম গাল্স স্কুল, ব্রাহ্ম বয়েজ স্কুল, ডফ্ স্কুল, কেশব অ্যাকাডেমি ইত্যাদিতে তিনি যাতায়াত করেন ওই পর্যন্ত। গৃহ এবং পিতার কবল থেকে পলায়ন করতে আরম্ভ করেন বারো-তেরো বছর বয়স থেকেই। প্রথমদিকে বেশিদূর যেতে পারতেন না। গ্রেপ্তার হয়ে পুনরায় গৃহ ও স্কুল, কারায় আবদ্ধ হতে হত যথারীতি। পনেরো বছর বয়স থেকে দূরযাত্রায় পশ্চিমাঞ্চলে পাড়ি দিতে লাগলেন। এসব প্রসঙ্গে নাটকীয়ভাবে অনেকাংশেই বর্ণনা করা আছে ‘জাতকে’। 

পিতার চরিত্রও সমস্ত মহত্ত্ব, সরলতা, ত্যাগ, সেবাধর্ম, আদর্শবাদ, এবং কঠোরতা-সমেত প্রেমাঙ্কুর আশ্চর্য দক্ষতায় ‘মহাদেব’ নামে জাতকে অঙ্কন করেছেন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা নরেশচন্দ্রকে বর্ণনা করেছেন ‘স্থির’ বলে। পিতার শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে নরেশচন্দ্র ভাগ্যান্বেষণে বিদেশ চলে যান, প্রথমে লন্ডনে ও পরে আমেরিকায়। সেখানে চিকিৎসাবিদ্যায় এম্. ডি. ডিগ্রি লাভ করে Plastic Surgeon রূপে সুপ্রতিষ্ঠিত হন; স্বদেশে আর প্রত্যাবর্তন করেননি। তৃতীয় ভ্রাতা জ্ঞানাঙ্কুরকে জাতকে ‘অস্থির’ নামে বর্ণনা করা হয়েছে এবং নায়ক নিজের ডাকনাম ‘বুড়োকে স্মরণ করেই বোধহয় ‘স্থবির’ নামটি গ্রহণ করেছেন। লেখকরূপে সেই নাম থেকে হয়েছেন মহত্তর তাৎপর্যময় ‘মহাস্থবির’। 

পাঠ্যপুস্তক-নির্ভর বিদ্যাচর্চার ব্যর্থতার অন্তরালে কিন্তু প্রেমাঙ্কুরের জীবনে এক মহৎ সার্থকতার প্রস্তুতি আরম্ভ হয়েছিল। অদম্য আগ্রহে এবং গোপনে তিনি নানা সাহিত্য-গ্রন্থ পাঠ করতেন বাল্যবন্ধু প্রভাতচন্দ্রের সহযোগে। উত্তরজীবনে খ্যাতনামা দেশব্রত-সংবাদপত্রসেবী প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন প্রেমাঙ্কুরের নিকটতম প্রতিবেশী এবং ব্রাহ্ম গার্লস্ স্কুলে (এখানকার নিম্নশ্রেণীতে বালকরাও যোগ দিতে পারত) তাঁর সহপাঠী। সে-যুগের অন্যতম ব্রাহ্মনেতা, ‘অবলা বান্ধব’-পত্রিকার সম্পাদক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের পুত্র প্রভাতচন্দ্ৰ বাল্যজীবনে ১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে (‘সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দির’-এর বিপরীত বা পূর্বদিকে)বাস করতেন। সেই বাড়ির দক্ষিণে সংলগ্ন বাড়িটিতে থাকতেন সপরিবারে মহেশচন্দ্র আতর্থী। যে ১৩-সংখ্যক গৃহের উত্তরাংশে দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায় ও তাঁর জ্যেষ্ঠ জামাতা– বহুমুখী প্রতিভাধর উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাস ছিল তারই দক্ষিণ অংশে ছিল ব্রাহ্ম গার্লস্ স্কুল। এবং সেই বাড়িতে প্রভাতচন্দ্রের মাতুলরা এক পারিবারিক লাইব্রেরি গড়ে তুলেছিলেন। সেই লাইব্রেরির গ্রন্থসংগ্রহের মধ্যে অনেকসময় সাহিত্য-পাঠে নিমগ্ন থাকতেন প্রভাতচন্দ্র ও প্রেমাঙ্কুর। স্কুল-পাঠ্য- বহির্ভূত এইসব পাঠ্যের বিষয়ে দুই বন্ধুতে প্রচুর আলোচনা হত। 

তার কিছুকাল পরে দুজনের সঙ্গেই আলাপ হল প্রসাদ রায়ের সঙ্গে, প্রেমাঙ্কুরের তখন চোদ্দোবছর বয়স। প্রসাদ তাঁর চেয়ে বছর দুয়েকের জ্যেষ্ঠ এবং তখনই যে-ছদ্মনামে বাংলা পত্র-পত্রিকায় রচনা আরম্ভ করেছিলেন পরবর্তীকালে সেই হেমেন্দ্রকুমার রায় নামেই সাহিত্য-ক্ষেত্রে সুপরিচিত হন। সেই কিশোর বয়সে সাহিত্যের সঙ্গী হলেন তিনজনে। 

সাহিত্য ও শিল্পাদি ক্ষেত্রে আকুল পিপাসা তৃপ্ত করতে তিন বন্ধু পরে যাতায়াত আরম্ভ করেন তখনকার ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরিতে, স্ট্রান্ড রোডের মেট্‌কাফ হল্-এ। সেখানেই তাঁদের সঙ্গে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয় ও বন্ধুত্ব হয়, সত্যেন্দ্রনাথ যদিও প্রেমাঙ্কুরের চেয়ে আটবছরের বয়োজ্যেষ্ঠ। এ প্রসঙ্গ উল্লেখ করা যায় যে, প্রেমাঙ্কুরের শেষ রচনায় প্রকাশিত হয়েছিল সত্যেন্দ্রনাথেরই স্মৃতিকথা; সত্যেন্দ্রনাথের পর প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে সাহিত্যিক মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের আলাপ-পরিচয় ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিল। মণিলালের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি “হৃদ্যতা ছিল অবশ্য হেমেন্দ্রকুমারের। প্রেমাঙ্কুর সাহিত্য-রচনায় প্রথমজীবনে হেমেন্দ্রকুমার এবং মণিলাল দুজনেরই কাছেই উপকৃত ছিলেন, একথা তিনি বৃদ্ধবয়সেও বলে গেছেন। 

প্রেমাঙ্কুরের সাহিত্যকর্ম ষোলো-সতেরো বছরের মধ্যেই আরম্ভ হয় বটে, কিন্তু তা কখনও অব্যাহতভাবে অগ্রসর হয়নি। কারণ, আগেও বলা হয়েছে, পলাতক-জীবন তাঁর আরম্ভ হয়েছিল কিশোর-বয়স থেকেই। বারবার বাড়ি থেকে পলায়ন করেছেন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে, বহু বিচিত্র মানুষের সম্বন্ধে অভিজ্ঞ হয়েছেন। বেদনা-আনন্দে বিজড়িত বৃহত্তর জীবন তাঁকে নিরন্তর আহ্বান জানিয়েছে আর সে ডাকে সাড়া দিতে গতানুগতিক ধারায় ইস্তফা দিয়ে তিনি বারংবার গৃহছাড়া হয়েছেন। তাঁর পাঠ এইভাবেই সম্পন্ন হয়েছে বিদ্যালয়ের বাইরে। আপাতরিক্ততার মধ্যেও অন্তর তাঁর জীবনদেবতার অজস্র দাক্ষিণ্য পূর্ণ হয়। জীবনের পথে কিছুই যায় না ফেলা। চিত্তের সেই সঞ্চিত অমৃত ক্ষরিত হয় সাহিত্য-সৃষ্টিতে। জীবনে যত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে দিয়েই তাঁকে যেতে হোক, শিল্পী-সাহিত্যিকের মন ও দৃষ্টি তাঁর চিরদিন অক্ষুণ্ণ ছিল। সংসার-যাত্রার জন্যে যতপ্রকার জীবিকাই অবলম্বন করুন, মনে-প্রাণে তিনি ছিলেন সাহিত্যিক। সাহিত্যকর্মে জীবনের নানা বাঁকে ছেদ পড়লেও জাত সাহিত্যিক তিনি থাকেন ঠিকই। 

‘জাহ্নবী” মাসিক পত্রিকায় প্রেমাঙ্কুরের সতেরো বছর বয়সে প্রথম গল্প প্রকাশিত হয়। সে গল্পটি তাঁর কোনো গল্পপুস্তকে পরে অন্তর্ভুক্ত করেননি তিনি। তখন ‘জাহ্নবী’র সম্পাদক ছিলেন সুধাকৃষ্ণ বাগচী নামে একজন অর্বাচীন, কিন্তু পত্রিকাটি আসলে কবি গিরীন্দ্রমোহিনীর ছিল। নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের পরিচালনায় কিছুকাল থাকার পর এটি আসে ওই ব্যক্তির হাতে। সুধাকৃষ্ণের অযোগ্যতার ফলে পত্রিকা বানচাল হবার উপক্রম করলে, তিন বন্ধু হেমেন্দ্রকুমার, প্রেমাঙ্কুর ও প্রভাতচন্দ্র এর সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেন এবং কয়েক বছর সংশ্লিষ্ট থাকেন। 

তার কয়েক বছর পরে প্রেমাঙ্কুর বিখ্যাত ‘ভারত’ মাসিকপত্রিকায় গল্প প্রকাশ করেন এবং ক্রমে সুপরিচিত হন ‘ভারতী’ গোষ্ঠীর অন্যতম শক্তিশালী লেখক রূপে। ‘ভারতী’র কর্ণধার তখন মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁকে লেখকরূপেও প্রেমাঙ্কুর অতিশয় শ্রদ্ধা করতেন। হেমেন্দ্রকুমার ভিন্ন সাহিত্য রচনার বিষয়ে বিশেষ ঋণী ছিলেন তিনি মণিলালের কাছে। “মণিলাল আমার লেখা দেখে-শুনে দিতেন, এটা এইরকম হলে ভালো হয় ইত্যাদি জানাতেন।”– প্রথম সাহিত্য-জীবনের প্রসঙ্গে বলতেন প্রেমাঙ্কুর। 

কিন্তু সাহিত্যিক-রূপে সে অগ্রগতির আগে ও পরে তাঁর জীবনে অন্য নানা কর্মপ্রচেষ্টাও ছিল। প্রথম যৌবন থেকে আরম্ভ করে বিভিন্ন সময়ে জীবন-সংগ্রামের বহু পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাঁকে। জীবিকা-অর্জনের জন্যে অনেকরকমের কাজই তিনি করেছিলেন। অল্পবয়সের পলাতক জীবনে বিদেশে নানা উঞ্ছবৃত্তি গ্রহণ করতে বাধ্য হন তিনি–পথে কায়িক শ্রম থেকে আরম্ভ করে গৃহস্থের পরিচারক ও পাঁচকের কাজ পর্যন্ত কিছুই তাঁর বাকি ছিল না। 

কলকাতাতেও নানা রকমের সামান্য কাজ করেন। এসপ্ল্যানেড অঞ্চলে কার এন্ড মহলানবীশ-এর ক্রীড়া সরঞ্জামের দোকানে সাধারণ বিক্রেতার কর্মে অতিবাহিত হয় ছবছর–১৯১১ থেকে ১৯১৭ খ্রিঃ। এই দোকানে কাজ করবার সময়েও সাহিত্য-চর্চায় তাঁর বিরতি ছিল না। “ফুটবলে পাম্প করতে হত, লেখাও চলত”–নিজ উক্তি। 

ঠনঠনে অঞ্চলে পশ্চিমের এক চশমা ব্যবসায়ীর কারবারে চশমার কাজও বেশ কিছুদিন করেছিলেন। 

নিজে কয়েক রকমের ব্যবসাও করেন নানা সময়ে। প্রত্যেকটিতে ব্যর্থ হন। বেনেপুকুর অঞ্চলে জুতোর ব্যবসা। দুধ-ঘিয়ের ব্যবসা। বোম্বাইয়ে সিগারেটের ব্যবসা। সবেতেই কিছু-না-কিছু লোকসান দিয়ে বন্ধ করতে হয়। 

সিনেমা জগতেও তিনি যোগ দিয়ে দীর্ঘকাল অবস্থান করেছিলেন। তাঁর জীবনে ছায়াচিত্রের স্থান ছিল সাহিত্যের নীচেই। সে প্রসঙ্গ কিছু বিস্তারিত, পরে তার পরিচয় দেওয়া হবে। 

সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছেন একাধিকবার। শখ করে নয়, পেশা হিসাবেই। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রতিষ্ঠিত সান্ধ্য দৈনিকপত্র ‘বৈকালীতে প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ও হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সহযোগে লেখনী চালনা করেছেন। এই বৈকালী’ সংবাদপত্রের সম্পাদকরূপে নির্মলচন্দ্র চন্দ্রের নাম মুদ্রিত থাকলেও, সম্পাদনার প্রায় যাবতীয় দায়িত্বই পালন করতেন তাঁরা তিন বন্ধুতে। সম্পাদকীয় প্রবন্ধও তাঁরা লিখতেন। 

‘বৈকালী’ ভিন্ন আরো একটি দৈনিক পত্রিকায় প্রেমাঙ্কুর সাংবাদিক, লেখকরূপে যোগ দিয়েছিলেন। সেই সংবাদপত্রটির নাম ‘হিন্দুস্থান’। 

দু’জায়গাতেই কাজ তাঁর দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। পরে আর একটি বিশেষ ধরনের পাক্ষিক পত্রিকা তিনি সম্পাদনা করেছিলেন–’বেতার-জগৎ’। তিনিই ‘বেতার জগৎ’-এর প্রথম সম্পাদক। সে পরিচয় তাঁর কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের অবস্থানের প্রসঙ্গে দেওয়া হবে। কিন্তু সৃজনী সাহিত্যের পথে যে পরিক্রমা আরম্ভ করেছিলেন, নানা বাধা-বিঘ্নে তার গতি সাময়িকভাবে রুদ্ধ হলেও, স্তব্ধ হতে পারেনি কোনোদিন। ‘যমুনা’ ও পরে ‘ভারতী’ মাসিক-পত্রিকায় তাঁর গল্প মাঝে মাঝে প্রকাশিত হয়ে স্বকীয় উৎকর্ষের জন্যে গুণীজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে যুগের ‘যমুনা’ ও ‘ভারতীতে তাঁর প্রত্যেক গল্প শরৎচন্দ্র পড়তেন এবং তাঁর সম্পর্কে বিশেষ আশা পোষণ করতেন, এ-কথা শরৎচন্দ্র প্রেমাঙ্কুরকে জানিয়েছিলেন। 

প্রেমাঙ্কুরের সেইসব সাহিত্যকর্ম সার্থক সৃষ্টি হলেও অর্থকরী ছিল না। তখনকার কালের প্রথা অনুসারে তিনি মাসিকপত্র থেকে কিছুই পেতেন না গল্প লিখে। বই প্রকাশিত হলে যা পেতেন, তাও সামান্য। এ-কথা উল্লেখ করবার উদ্দেশ্য এই যে, তিনি সাহিত্যসেবা করতেন সে যুগের অনেকেরই মতন অন্তরের প্রেরণায়। সাহিত্যচর্চা তাঁর শিল্পীসত্তার আত্মপ্রকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম ছিল। 

তাঁর প্রথম গল্পপুস্তক ‘বাজীকর’ আট-আনা সংস্করণের বই (প্রকাশক : গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স)। ‘বাজীকর’ প্রকাশের সময় তাঁর বয়স তিরিশ পার হয়েছে। 

এই গল্পের বইয়ের আগে অন্য একটি গ্রন্থ তিনি সম্পাদনা ও পরিকল্পনা করেছিলেন, তাঁর অন্যতম বন্ধু-চিত্রশিল্পী চারুচন্দ্র রায়ের সহযোগিতায়। সেটি ছোটদের জন্যে গল্প, কবিতা, রঙিন ছবি ইত্যাদির সংকলন-গ্রন্থ। নাম ‘রং-মশাল’। সে-যুগের ছেলেমেয়েদের জন্যে এমন উচ্চমানের সচিত্র সংকলন-পুস্তক বাংলা-সাহিত্যের এই বিভাগের পথিকৃতের কাজ করেছিল। তাঁর সম্পাদিত এই গ্রন্থের লেখক ও শিল্পীদের তালিকা থেকে বোঝা যায় কত উচ্চ শ্রেণীর হয়েছিল সংকলনটি। অবনীন্দ্রনাথ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, সুকুমার রায়, হেমেন্দ্রকুমার রায়, জলধর সেন, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, নরেন্দ্র দেব প্রভৃতির লেখা এবং গগনেন্দ্ৰনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, নন্দলাল, যতীন্দ্রকুমার সেন, সুরেন্দ্রনাথ কর প্রভৃতির অঙ্কিত পূর্ণপৃষ্ঠার ছবি। তাছাড়া, চারুচন্দ্র রায়ের আঁকা তেত্রিশটি খুচরো ছবি। বইখানির আর একটি লক্ষণীয় বিষয় হল–মুখপাতে প্রত্যেক লেখকের কবিতায় পরিচয়-রচনা। দেখা যায়, তখনই (১৯২০ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল) অবনীন্দ্রনাথ ‘ছবির রাজা অবীন ঠাকুর’ আখ্যাত হয়েছেন। যথা : 

“ছবির রাজা অবীন ঠাকুর রংয়ের নেশায় আছেন ভুলি,
পেয়েছি তাঁর চিত্র, লেখা বিচিত্র সে ভাবের তুলি।” 

লেখক-পরিচিতির শেষ দু’ছত্র হল : 

“ভুল চুক সব মাপ কোরো ভাই, এটাই প্রথম চেষ্টা যখন 
শ্রীচারু রায় প্রেমাঙ্কুরের যুক্ত করে এই নিবেদন।” 

কবিতাটি প্রেমাঙ্কুরের রচনা। এখানে বলে রাখা যায় যে, কবিতা-লেখাতেও তাঁর হাত ছিল। শেষজীবনে প্রকাশিত তাঁর সর্বশেষ; গল্পের বই ‘শেফালীর [য ] উৎসর্গপত্রে একটি হৃদয়গ্রাহী কবিতা রচনা করেন তাঁর অন্যতম বাল্যবন্ধু অমল হোমের উদ্দেশে। ছোটদের জন্যে প্রেমাঙ্কুরের প্রথম উচ্চশ্রেণীর সংকলন-গ্রন্থ ‘রং-মশাল’-এর প্রসঙ্গে এ-কথাও উল্লেখযোগ্য যে, তাঁর সাহিত্য-জীবনে বরাবরই শিশুসাহিত্য একটি স্থান অধিকার করে ছিল। ছোটদের জন্য তিনি নানা সময়ে নানা ধরনের মনোজ্ঞ রচনা প্রকাশ করেন–গল্প, ঐতিহাসিক কাহিনি, পুরাণকথা ইত্যাদি। সে-সবের মধ্যে কিছু কিছু বিভিন্ন পত্রিকায় রয়ে গেছে। পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ‘আনারকলি’, ‘ডানপিটে’, ‘ছোটদের ভাল ভাল গল্প’।. 

‘রং-মশাল’-এর পর প্রথম গল্পের বই ‘বাজীকর’ প্রকাশিত হয়; তাঁর প্রথম উপন্যাস ঝড়ের পাখী’। তার প্রায় তিন বছর পরে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছিল ‘চাষার মেয়ে’। সে যুগের নির্বাক-ছায়াচিত্রে এটি রূপায়িত হয়েছিল বীরেন্দ্রনাথ সরকারের The International Film Craft [ ৪.১.৩১ তারিখে মুক্তি পায় ] থেকে এবং পরিচালনা করেছিলেন চারু রায়। ‘চাষার মেয়ে’র পরের বছর বেরোয় আনারকলি’। তার প্রায় দু’বছর পরে ‘দুই রাত্রি’ আত্মপ্রকাশ করে। তারপর ‘অচল পথের যাত্রী’ ইত্যাদি আরো কয়েকটি উপন্যাস প্রকাশিত হয়ে তিনি ক্রমে সাহিত্য-ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। 

তা ছাড়াও তাঁর আরো কয়েকখানি পুস্তক–তাঁর অত্যুৎকৃষ্ট রচনা প্রকাশিত হয়েছিল, সেসব পরে উল্লেখ করা হবে। আপাতত তাঁর সাহিত্য জীবনের পরিণতির আলোচনায় আর অগ্রসর না হয়ে, তাঁর প্রথম ও মধ্য জীবনের অন্যান্য কয়েকটি প্রসঙ্গের অবতারণার প্রয়োজন কারণ আরো একাধিক সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে তাঁর বিচিত্র প্রতিভা পুষ্পিত হয়েছিল। 

প্রথমত তাঁর সঙ্গীতচর্চার কথা। 

প্রেমাঙ্কুরের শিল্পীমন সহজাত ছিল। অনেক প্রতিভাবান সাহিত্যিক বা শিল্পীর জীবনে যেমন দেখা যায় ললিতকলার অন্য কোনো কোনো বিভাগেও তাঁদের অন্তরের গভীর যোগ এবং খানিক পরিমাণে নৈপুণ্য আছে, প্রেমাঙ্কুরের ক্ষেত্রেও তা লক্ষণীয়। তাঁর জীবনে সঙ্গীত ও অভিনয়কলার স্থান ছিল। তার মধ্যে প্রথমটির চর্চা তিনি রীতিমতো করেছিলেন বেশ কিছুকাল ধরে। 

সঙ্গীতের আকর্ষণ যে বাল্যকাল থেকে তাঁর মনে নিবিড়ভাবে অনুভূত হত, তার অন্তরঙ্গ পরিচয় তিনি ‘মহাস্থবির জাতক’-এর প্রথম পর্বে যথার্থ শিল্পীর মতই প্রকাশ করেছেন। নৌকার ওপর সেই পশ্চিমা বাঈজীর মর্মস্পর্শী ঠুংরি বালকের চেতনায় যে অপূর্ব অনুভব সৃষ্টি করেছিল তা প্রেমাঙ্কুরের নিজেরই অভিজ্ঞতা। তাঁর ‘চাষার মেয়ে’ উপন্যাসে, মনের ওপর বাঁশির সুরের আচ্ছন্ন-করা প্রভাবের কথা একাধিক আছে। তাঁর ‘অচল পথের যাত্রী’ এবং ‘দুই রাত্রি’র মধ্যেও পাওয়া যায় মাদকতাময় সঙ্গীত-অনুষ্ঠানের বিবরণ। ‘বাজীকর’ পুস্তকের অন্তর্ভুক্ত ‘মল্লারের সুর’, ‘স্বর্গের মাটি’র অন্তর্গত ‘মরু-মরীচিকা’ ইত্যাদি গল্পও তাঁর রাগ-সঙ্গীতপ্রীতির এক একটি নিদর্শন। রচনাবলীর আরো নানা স্থানে প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গীতজ্ঞতার পরিচয় বিধৃত আছে। 

তিনি যে সঙ্গীতচর্চা করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে, তা অবশ্য কণ্ঠসঙ্গীত নয়, যন্ত্রসঙ্গীত–সেতার। রাগ-সঙ্গীতের সুর-বৈচিত্র্যে আকৃষ্ট হয়ে যৌবনে তিনি সেতার-শিক্ষা আরম্ভ করে ছিলেন এবং কয়েকজন ওস্তাদের কাছে শিক্ষার্থী হয়ে যেতেন। তাঁদের মধ্যে ওস্তাদ করামউল্লা খাঁর সঙ্গ করেছিলেন সবচেয়ে বেশি। খাঁ-সাহেবের আগে তাঁরই কনিষ্ঠ কৌকভ খাঁ’র কাছে কিছুদিন শিখেছিলেন। [শ্রীবিমলাকান্ত রায়চৌধুরীর ‘ভারতীয় সঙ্গীতকোষ’ গ্রন্থে পাওয়া তথ্য হচ্ছে সরোদি নিয়ামতুল্লার তিন ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে কেরামতুল্লা (১৮৬২-১৯৩২) এবং মেজ আসাদুল্লা বা কৌকভ খাঁ (১৮৬৫-১৯১৫)। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীকে এই কোষগ্রন্থে কৌকভ খাঁ’র শিষ্য বলা হয়েছে। প্রকাশক ] মেটিয়াবুরুজের নবাব ওয়াজিদ আলি শা’র দরবারে আগত সরোদী নিয়ামউল্লা খাঁ’র এই পুত্রদ্বয় পিতার শিক্ষাধীনে সবিশেষ কৃতী হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে তাঁদের সঙ্গীত-জীবনের এক উল্লেখযোগ্য অংশ কলকাতায় অতিবাহিত করে, কয়েকজন গুণী বাঙালিকে সঙ্গীতশিক্ষা দিয়েছিলেন। দুই ভ্রাতার মধ্যে প্রথমে কলকাতায় আসেন ওস্তাদ কৌকভ খাঁ, মহারাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের উদ্‌যাগে এবং প্রায় আটবছর কলকাতায় সগৌরবে অবস্থানের পর ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যু হয়। তিনি স্যার আশুতোষ চৌধুরী ও প্রতিভা দেবী প্রতিষ্ঠিত, বিখ্যাত ‘সঙ্গীত সঙ্ঘ’র প্রধান যন্ত্রসঙ্গীত-শিক্ষক থাকায় তাঁর মৃত্যুতে তাঁর অভাব পূরণের জন্যে সঙ্ঘের কর্তৃপক্ষ এলাহাবাদ থেকে ওস্তাদ করামউল্লাকে আনিয়েছিলেন। করামউল্লা কলকাতায় দশ বছরেরও অধিক কাল কলকাতার একজন সর্ববিখ্যাত ওস্তাদরূপে বসবাস করেন। খাঁ ভ্রাতৃদ্বয়ের কাছে ধীরেন্দ্রনাথ বসু, হরেন্দ্রকৃষ্ণ শীল, কালিদাস পাল, কৃষ্ণচন্দ্র দে, নাটোররাজ যোগীন্দ্রনাথ রায়, নৃপেন্দ্রনাথ বসু, ননী মতিলাল, যতীন্দ্রচরণ গুহ (গোবরবাবু) প্রমুখ সঙ্গীতশিক্ষা করেন এবং তাঁদের মধ্যে একমাত্র (অন্ধগায়ক) কৃষ্ণচন্দ্র দে কণ্ঠসঙ্গীতে খেয়ালের তালিম পান, অবশিষ্ট সকলেই ছিলেন যন্ত্রসঙ্গীতের শিষ্য প্রেমাঙ্কুর দুই ভ্রাতার কাছেই, বিশেষত ওস্তাদ করামউল্লার কাছে সেতার শিক্ষা করেন। তা ছাড়া তিনি এনায়েৎ খাঁ’র পিতা সেতার-সুরবাহার-বাদক ইমদাদ খাঁ’র কাছেও কিছুদিন শিখেছিলেন। আধুনিককালে ঠুংরিগানের নেতৃস্থানীয় কলাবত গণপৎ রাও (ভাইয়া-সাহেব)-এর শিষ্য শ্যামলাল ক্ষেত্রীর কাছেও যাতায়াত করতেন প্রেমাঙ্কুর। সেখানে কণ্ঠসঙ্গীতের চর্চা না করলেও সঙ্গীত-বিষয়ে কিছু উপকৃত হয়েছিলেন। 

তাঁর জীবনের নানামুখী গতি, প্রধান শিল্পকর্ম সাহিত্য-সেবায় আত্মনিয়োগ, ইত্যাদি কারণে তাঁর সেতার শিক্ষা সম্পূর্ণতার পথে অগ্রসর হতে পারেনি–রাগসঙ্গীতের সাধনায় একান্তভাবে নিমগ্ন না হলে তা সম্ভবও হয় না কারুর পক্ষে। 

প্রেমাঙ্কুরের জীবনে আর একটি উল্লেখ্য অধ্যায় হল–কলকাতা বেতার কেন্দ্রে তাঁর কার্যকাল। কলকাতা-বেতারের আদিযুগে, প্রতিষ্ঠানটি যখন বেসরকারি ছিল, তিনি সেখানে যোগ দেন এবং প্রায় সাত বছর একাদিক্রমে নিযুক্ত থেকে শুধু নিজের একাধিক গুণের পরিচয় দেননি, বেতারের উন্নতি ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্যেও কিছু অবদান রেখেছিলেন। 

বেতার কেন্দ্রে তাঁর প্রধান পরিচয় ছিল বক্তা এবং ‘বেতার-জগৎ’ পত্রিকার সম্পাদকরূপে। তা ছাড়া, স্বরচিত অনেক গল্পও এখানে তিনি পাঠ করেন, প্রথমযুগে এবং নিয়মিত কার্যকাল শেষ হবার বহু পরে পর্যন্তও। তবে এখানে প্রথমযুগে তাঁর কাজের কথাই বিশেষ করে উল্লেখ্য। 

বক্তারূপে বেতারে তাঁর একটি ছদ্মনাম ছিল–সোমদত্ত। এই নামে তিনি নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে ভাষণ দিতেন। সে-যুগের বেতার-কেন্দ্রের যে ক’টি বিভাগ বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্যতম বিশিষ্ট ছিল–”মহিলা মজলিস্, শ্রোত্রীদের জন্যে বিশেষ আসর। ‘মহিলা মজলিস্’-এর পরিচালক ছিলেন বিষ্ণুশর্মা ছদ্মনামে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, যিনি ‘বেতার নাটুকে দল’ (সেকালের বেতারের নাট্যগোষ্ঠী)-এর প্রধান অভিনেতা ও প্রযোজকরূপে এবং হাস্যরসিক বক্তা হিসাবেও বিখ্যাত হয়েছিলেন। বিষ্ণুশর্মা-পরিচালিত সেই মহিলা মজলিসের আসরে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী সোমদত্ত-ছদ্মনামে নিয়মিত ভাষণ দিতেন বিভিন্ন জ্ঞাতব্য বিষয়ে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ প্রাঞ্জল আলোচনার জন্যে ‘সোমদত্ত’ সে-কালের বেতার-শ্রোতৃবৃন্দের কাছে অতি সুপরিচিত ছিলেন। 

কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের মুখপত্ররূপে ‘বেতার-জগৎ’ পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা যাঁরা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে প্রেমাঙ্কুরের নাম বিশেষ স্মরণীয়। ‘বেতার-জগৎ’-এর তিনি শুধু অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নন, প্রথম সম্পাদকও। ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে তার প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার সময় থেকে প্রায় ছ’বছর তিনি এর সম্পাদনার দায়িত্ব বহন করেছিলেন। ‘বেতার-জগৎ’ শুধু বেতারের অনুষ্ঠানলিপি ছিল না, পাঠ্যযোগ্য বিষয়াদির সমাবেশে তা জনপ্রিয় হয়েছিল তাঁর সম্পাদন- নৈপুণ্যে। 

কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের আর একটি বিশেষ ও বিখ্যাত অনুষ্ঠানের জন্যেও প্রেমাঙ্কুরের নাম স্মরণযোগ্য; তা হল–প্রতিবছর মহালয়া-তিথির ব্রাহ্ম-মুহূর্তে অনুষ্ঠিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। বেতারের সেই বেসরকারি এবং প্রথম-যুগে প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে এক অন্তরঙ্গ পরিবেশ ছিল এবং যে ক’জন বাঙালি তার সঙ্গে কর্মসূত্রে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, তাঁরা শুধু নিয়মতান্ত্রিকভাবে শুষ্ক কর্তব্য পালন করে দায়িত্ব শেষ করতেন না। রেডিওর উত্তরোত্তর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্যে নানাপ্রকার জল্পনা-কল্পনা করতেন নতুন নতুন বিভাগ ও অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করে। একদিন অভাবিত সময়ে বেশিক্ষণ ধরে এমন একটি বিশেষ ধরনের অনুষ্ঠান পত্তন করলে হয়, যাতে শ্রোতাদের মধ্যে একটা আলোড়ন সৃষ্টি হয়, বেতার সম্পর্কে লোকে নতুন করে সচেতন হয়ে ওঠে–এমন একটি ‘আইডিয়া’ প্রেমাঙ্কুরের মাথায় আসে এবং অন্যান্য কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার ফলে মহালয়ার ভোররাত্রির এই অনুষ্ঠানটি পরিকল্পিত হয়। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের শ্রীশ্রীচণ্ডী থেকে সুরেলা আবৃত্তি, পঙ্কজকুমার মল্লিকের সুরসংযোজনা, ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ কলকাতা-বেতারকে অগণিত শ্রোতাদের ঘরে ঘরে আপন করে নিতে অনেকখানি সাহায্য করে। 

এইভাবে কলকাতা বেতার-কেন্দ্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট থাকবার সময়ে প্রেমাঙ্কুরের যোগাযোগ ঘটে ফিল্ম-জগতে স্বনাম-প্রসিদ্ধ নিউ থিয়েটার্সের সঙ্গে। তাঁর জীবনের আর একটি প্রখ্যাত পরিচ্ছেদের সূচনা হয়। অর্থাৎ তাঁর সিনেমা-জীবন। 

সিনেমা-জগতের সঙ্গে এবার তিনি ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন, যদিও আরো কয়েক বছর আগে এ যোগাযোগের সূত্রপাত হয়েছিল। এবং তা ঘটে তাঁর অন্যতম অন্তরঙ্গ সুহৃদ, উত্তরকালে স্বনামধন্য নট ও নাট্যাচার্য শিশিরকুমার ভাদুড়ীর উদ্‌যোগে। নাট্যাচার্য হবার আগে, নির্বাক্-চলচ্চিত্রের যুগে শিশিরকুমার এক ফিল্মসংস্থার পত্তন করেছিলেন–তাজমহল ফিল্ম কোং। প্রেমাঙ্কুরকে তিনি চিত্রনাট্য রচনা করবার জন্যে আহ্বান করলেন। প্রেমাঙ্কুরও সোৎসাহে যোগ দেন শিশিরকুমারের সঙ্গে। কিন্তু সে-চলচ্চিত্রের কাজ শিশিরকুমারের বেশিদিন চলেনি, সুতরাং প্রেমাঙ্কুরেরও সে-জীবনে তখনকার মতন ছেদ পড়ে। 

কিন্তু শিশিরকুমারের সেই সিনেমা-প্রচেষ্টার সংস্পর্শে আসবার পর থেকে প্রেমাঙ্কুর ফিল্মের জগতে আকৃষ্ট হয়েছিলেন এবং তারপর মাঝে মাঝে সিনেমার কাজ করেন নানা ধরনের। নানা জায়গায় সাময়িক কাজ। সেও এক রকমের বোহেমিয়ান জীবন। কিছুকাল লাহোরের এক ফিল্ম-প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। তাঁদের ‘আনারকলি’ ছবির কন্টিনিউইটি-ম্যান হন প্রেমাঙ্কুর। তাদের কার্যালয় লাহোরে, কিন্তু কর্মক্ষেত্র অর্থাৎ ‘শুটিং’ চলত দিল্লিতে। সে-সব দিনের স্মৃতি তাঁর কোনো কোনো গল্পে (‘শেফালী’ পুস্তকের অন্তর্গত) দেখা যায়। 

সে-কাজ করবারও আগে প্রেমাঙ্কুর কিছুদিন নির্বাক যুগের বিখ্যাত অভিনেত্রী সীতা দেবীর প্রচার-সচিব ছিলেন। সীতা দেবী নামে সুপরিচিতা হলেও তিনি ছিলেন ঈঙ্গ-ভারতীয় (অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান); এবং ম্যাডান কোম্পানির বহু সফল ছবির নায়িকা (ভ্রমর, সরলা, আয়েষা প্রভৃতি) রূপে সেকালের সিনেমা জগতে একজন শীর্ষস্থানীয়া ছিলেন। 

তারপর প্রেমাঙ্কুর আবার কিছুদিন প্রচার সচিবের কাজ করেন এক ভ্রাম্যমাণ প্রতিষ্ঠানে। ভারতীয় সিনেমা-ক্ষেত্রের অন্যতম আদি পরিচালক নিরঞ্জন পাল একটি থিয়েটারের দল গঠন করে একসময় ভারতের নানা স্থানে অভিনয় প্রদর্শন করতেন। প্রেমাঙ্কুর ছিলেন সেই দলের প্রচার ও বিজ্ঞাপনের ভারপ্রাপ্ত ব্যক্তি। 

সিনেমা-সংশ্লিষ্ট জগতে এমনি নানা বিচিত্র কাজ তিনি আগেই করেছিলেন। তা ছাড়া, তাঁর নিজের প্রথম উপন্যাস ‘চাষার মেয়ে’ নির্বাক চলচ্চিত্রে রূপায়িত হয় প্রথমযুগের অন্যতম চিত্র-পরিচালক প্রফুল্ল রায়ের পরিচালনায়।

এইসব পর্বের পর প্রেমাঙ্কুর কলকাতা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিয়েছিলেন এবং সেখানে অবস্থান করবার সময়ে আবার নতুন করে তাঁর সিনেমা-জগতে প্রবেশ ঘটে। এবার আরো প্রত্যক্ষ অংশ নিয়ে এবং প্রথমে গল্প-লেখক ও চিত্র-নাট্যকার রূপে। 

এ-যাত্রায় বিখ্যাত চলচ্চিত্র-প্রতিষ্ঠান ‘নিউ থিয়েটার্স’-এর স্বত্বাধিকারী বীরেন্দ্রনাথ সরকার মহাশয়ের সঙ্গে প্রেমাঙ্কুরের প্রথম থেকেই যোগাযোগ হয়। তখন নির্বাক ছবির শেষ পর্যায় চলেছে এবং বীরেন্দ্রনাথের ছবির জন্যে প্রেমাঙ্কুর রচনা করলেন কাহিনি ও চিত্রনাট্য। চলচ্চিত্রটি নির্মাণের সমস্ত প্রস্তুতি শেষ হল। এমন সময় বাধা পড়ল অকল্পিতভাবে, যেমন বাধা দেখা গেছে প্রেমাঙ্কুরের সারাজীবনে অসংখ্যবার। 

হঠাৎ সবাক্-ছবির যুগ আরম্ভ হয়ে গেল। ম্যাডান প্রতিষ্ঠান থেকে বেরুল প্রথম সবাক্-চিত্র। সরকার-মহাশয় নির্বাক ছবির পথে আর অগ্রসর হলেন না, সবাক্-চিত্র-নির্মাণের বিষয় চিন্তা করতে লাগলেন। প্রেমাঙ্কুরের সেই গল্প ও চিত্রনাট্য সবই নষ্ট হল। তবে বীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে যে-কর্মসূত্রে পরিচিত হয়েছিলেন, তার সুফল লাভ করলেন কিছুদিনের মধ্যেই। 

এবার নিউ-থিয়েটার্সের সবাক্-চিত্র-প্রস্তুতির অন্যতম পরিচালক নিযুক্ত হলেন প্রেমাঙ্কুর। নিউ-থিয়েটার্সে তাঁর পরিচালনায় শরৎচন্দ্রের ‘দেনা পাওনা’ [১৯৩১-এর ৩ আগস্ট ম্যাডান কোম্পানির ‘ঋষির প্রেম’ মুক্তি পায়। আর ওই বছরেরই ২৪ ডিসেম্বর ‘দেনাপাওনা’ মুক্তি পেয়েছিল ] সবাক্-ছবি রূপালী পর্দায় আত্মপ্রকাশ করে। সিনেমা-পরিচালক রূপে প্রেমাঙ্কুরের জীবন কয়েক বছর ধরে এগিয়ে চলল। এতদিন পরে এই প্রথম তিনি আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করলেন বটে, কিন্তু সাহিত্য-জীবন হল রাহুগ্রস্থ। দশবছরেরও বেশি সাহিত্যের সঙ্গে প্রায় সম্পর্ক-রহিত হয়ে গেল। নিউ থিয়েটার্সে তাঁর পরিচালনায় পর পর সবাক্-ছবি মুক্তিলাভ করতে লাগল–’কপালকুণ্ডলা’, ‘ইহুদী-কী লেড়কী’ (হিন্দী), ‘পুনর্জন্ম’, ‘দিকশূল’, ‘সুধার প্রেম’ ইত্যাদি। [‘চিরকুমার সভা’ তাঁর পরিচালনায় ১৯৩২-এর ২৮ মে তারিখে মুক্তিলাভ করেছিল। প্রকাশক ] 

শুধু পরিচালনা নয়, এখানে তাঁর আরো একটি কৃতিত্বের প্রকাশ দেখা যায়। তা তাঁর অভিনয় নৈপুণ্য। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘পুনর্জন্ম’ নাটকের সবাক্-চিত্রে প্রেমাঙ্কুর প্রধান ভূমিকা যাদবের অংশ অভিনয় করেন। চমৎকার হয় তাঁর যাদবের অভিনয়। ‘কপালকুণ্ডলা’ চিত্রেও তিনি একটি ছোট অংশে অভিনয় করেছিলেন এবং ‘ইহুদী-কী-লেড়কী’-তেও একটি ক্ষুদ্র ভূমিকা তিনি নেন। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, অভিনয়-শক্তি তাঁর ছিল, কিন্তু তার অভ্যাস তিনি কোনো করেননি। তাঁর কথাবার্তার ধরনই ছিল নাটকীয়। অত্যন্ত সরস ও আকর্ষক কথার ভঙ্গিতে তিনি যে কোনো বিষয়কে বর্ণনা করতে পারতেন রীতিমতো জীবন্ত করে–(তাঁর লেখারও যা বিশেষত্ব)–এবং বর্ণনার সময়ে তাঁর মুখে-চোখে যে ভাবের অভিব্যক্তি প্রকাশ পেত, তা নিপুণ অভিনেতার। হাবভাব যথোচিত প্রকট করে শ্রোতাদের মনে বিষয়ের ছবি এঁকে দেবার জন্যে তিনি কথাবার্তার মধ্যে দাঁড়িয়ে উঠে হস্তাদি, অঙ্গ সঞ্চালন করতেন। ফলে তাঁর বর্ণিত বিষয়ই শুধু প্রাণবন্ত হত না, সে-আসর হয়ে উঠত সজীব মজলিস। এও তাঁর অভিনেতা-সত্তার এক লক্ষণ। সে যাই হোক, নিউ-থিয়েটার্সের পর সিনেমা-জীবনে তিনি ‘ভারতলক্ষ্মী পিকাঁচার্স’-এও কিছুকাল ছিলেন। তারপর চলে যান বোম্বাইয়ের চলচ্চিত্র জগতে। 

বোম্বাই অঞ্চলে প্রায় দশবছর থেকে যান। সেখানে তাঁর পরিচালনায় ‘সরলা’, ‘ভারত-কী বেটী’ এবং অন্যান্য হিন্দি-উর্দু কয়েকটি চিত্র গৃহীত হয়। সেখানে তাঁকে হিন্দী-উর্দু ছবিতেই কাজ করতে হয়েছিল। সেজন্যে ভাষা-দু’টিও বেশ খানিক শিখতে হয়েছিল,–উর্দুতে অভিনয় শিক্ষাও দিতে হত তাঁকে। 

বোম্বাইতে বাসের মধ্যে কোলাপুরে কয়েকমাস চাকরি-সূত্রে কাটিয়ে আসেন। এইভাবে প্রায় দশবছর পরে বোম্বাইয়ের পালা শেষ করে প্রত্যাবর্তন করেন বাংলাদেশে। এই দীর্ঘকাল সাহিত্য-সৃষ্টি স্তব্ধ ছিল বলা যায়। তবে প্রবাস-জীবনের এসব ঘটনাবলীর কিছু কিছু তাঁর সাহিত্যের বিষয়বস্তু রূপে রূপান্তরিত হয়েছে উত্তরকালে। 

কলকাতায় ফিরে আসবার পরে আবার তাঁর সাহিত্যচর্চার কিছু ফসল ফলে। ‘স্বর্গের চাবি’ নামে স্মরণীয় গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয় তাঁর পরিণত প্রতিভার স্বাক্ষর নিয়ে। তাঁর সাহিত্য-প্রতিভার শ্রেষ্ঠ ফলন অবশ্য ‘মহাস্থবির জাতক’, যার তিনটি পর্ব তাঁর জীবনের অপরাহ্ণে দশবছরের মধ্যে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হয়। জাতক তাঁর শেষ সৃষ্টিও। তৃতীয় পর্ব জাতক প্রকাশের পর তিনি আরো দশবছর বর্তমান ছিলেন এবং তাঁর সৃষ্টিক্ষমতা অব্যাহত ছিল। সে প্রসঙ্গ উল্লেখ করবার আগে তাঁর বাল্য-জীবন ও সাহিত্য জীবনেরও কিছু তথ্য জানাবার আছে। 

সাহিত্য-জীবনের মধ্যে তাঁর নাটকের প্রসঙ্গ। দু’খানি নাটক তিনি লিখেছিলেন, তার মধ্যে একখানির নাম বাংলার নাট্যামোদীদের সুপরিচিত। ‘ত-এ তাউস’ অর্থাৎ ময়ূর-সিংহাসন। মোগল বাদশাহীর পতন যুগে আওরঙ্গজেবের পৌত্র জাহান্দার শা’র একবছরের বাদশাগিরি ও পরে নিজের ভ্রাতুষ্পুত্র ফরুখ্ শিয়ারের দ্বারা নিহত হওয়ার বৃত্তান্ত অবলম্বনে রচিত এই নাটকটি নাট্যাচার্য শিশিরকুমারের পরিচালনায় ১৯৫০ খ্রিঃ ১০ মে থেকে শ্রীরঙ্গম্ রঙ্গমঞ্চে মহা সমারোহে অভিনীত হয়। যে মুষ্টিমেয় কয়েকটি নতুন নাটক ভাদুড়ী মহাশয়ের শেষজীবনে তাঁর প্রতিভার যোগ্য বাহন হয়েছিল, প্রেমাঙ্কুরের এই শক্তিশালী নাটকটি তার অন্যতম বিশিষ্ট। ‘তত-এ তাউস’-এর নায়ক জাহান্দর শা’র চরিত্রে অভিনয় করে শিশিরকুমার নিজের অভিনীত ‘দিগ্বিজয়ী’ যুগের প্রতিভার পরিচয় আবার নতুন করে দিয়েছিলেন–নাট্যকার প্রেমাঙ্কুরের পক্ষে তা কম গৌরবের কথা নয়। নাটকটি স্বাতন্ত্র্যপূর্ণ ঐতিহাসিকত্বে। প্রত্যেকটি চরিত্র ও ঘটনা এমন নিষ্ঠার সঙ্গে ইতিহাস থেকে নাট্যকার গ্রহণ করেছেন যে, কোনো কাল্পনিক ব্যক্তির বা ঘটনা সংস্থানের স্থান নাটকে দেননি। অথচ আদ্যোপান্ত নাটকীয় উপাদান ও আবেদনে অনবদ্য চিত্তাকর্ষক। এই দিক থেকে প্রেমাঙ্কুরের এই নাটক বাংলায় অনন্য। 

নাটকটি তিনি লেখেন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে,–অর্থাৎ ছাব্বিশ বছর পরে তা মঞ্চস্থ হয়। কারণ শিশিরকুমার এটি হারিয়ে ফেলেছিলেন সে-সময়। প্রেমাঙ্কুর রচিত আর একখানি নাটকও শিশিরকুমারের কাছে ছিল এবং সেটিও হারিয়েছিলেন; আর পাওয়া যায়নি। সেটিও শিশিরকুমারের অত্যন্ত পছন্দ হয়েছিল এবং অভিনয় করবেন বলে রেখেছিলেন-প্রেমাঙ্কুরের ভাষায়–”এমন যত্ন করে শিশির রাখলে যে খুঁজে পাওয়া গেল না”। 

সেই লুপ্ত নাটকখানির নাম ‘মাটির ঘর’। রুশি লেখক ম্যাকসিম গোর্কীর Lower Depth নাটকের ছায়া অবলম্বনে প্রেমাঙ্কুর রচনা করেন ‘মাটির ঘর’। তবে তিনি বলতেন–”এরকম স্তরের জীবন আমি নিজে বিস্তর দেখেছি, আমার এ-বিষয়ে খুব অভিজ্ঞতা আছে!” গোর্কীর Lower Depths-এর ভাব-অনুসরণে এবং এদেশে তাঁর নিজের দেখা ওই শ্রেণীর মানুষের জীবনযাত্রা ও চরিত্র নিয়ে নাট্যসূত্র গ্রথিত করে প্রেমাঙ্কুর লিখেছেন ‘মাটির ঘর’। শিশিরকুমার যখন সেটি আগ্রহ করে নিয়েছিলেন নিজে মঞ্চস্থ করবার জন্যে, তখন ‘মাটির ঘর’ যে একটি সার্থক নাটক-রচনা হয়েছিল তা অনুমান করা যায়। সেইসঙ্গে, তত্-এ তাউস-এর সাফল্য স্মরণ করলে মনে হয় যে, আরো নাটক রচনা করলে তিনি এ-বিভাগেও স্মরণীয় অবদান রেখে যেতেন। 

আরো কিছু লেখা তাঁর ছিল, যা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। ‘দক্ষিণে’ শিরোনামায় তাঁর দক্ষিণ-ভারতের একটি এমন বৃত্তান্ত ‘ভারতবর্ষ’ মাসিক পত্রিকায় চার সংখ্যায় ধারাবাহিকভাবে বেরিয়েছিল। একটি ঐতিহাসিক বিষয়ে তাঁর অনুবাদ রচনা আর-একটি মাসিক-পত্রিকায় কয়েক মাস ধরে প্রকাশিত হয়, কিন্তু তাও সম্পূর্ণ করতে পারেননি গুরুতর শারীরিক পীড়ার জন্যে। সে-লেখাটি ছিল দিল্লির মোঘলদের বিষয়ে ইতালীয় গ্রন্থাকার Manucci-এর পুস্তকের অনুবাদ। তা ছাড়াও ছোটদের জন্যে লেখা কয়েকটি গল্পাদি, সাধারণ সাহিত্যের আসরে ‘নব্য-ভারত’-সম্পাদক দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরীর স্মৃতিকথা প্রভৃতি আরো কিছু রচনা তাঁর সাময়িক পত্র-পত্রিকায় বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। 

‘মহাস্থবির জাতক’ তাঁর শেষ গ্রন্থ। 

তাঁর শিল্পী-মানসের যথার্থ সৃষ্টিক্ষেত্র সাহিত্যের আসরে গৌরবোজ্জ্বল পুনরাবির্ভাব ঘটে যে ‘মহাস্থবির জাতক’ নিয়ে তার রচনা আরম্ভ করেন কিন্তু এক বাহ্যিক উপলক্ষের ফলে। স্বয়ং শরৎচন্দ্র এই উপলক্ষ্য হয়েছিলেন, এবং অমল হোমের উৎসাহে তিনি তাঁর জীবন কথা নিয়ে ‘মহাস্থবির’ রচনা শুরু করেন। প্রেমাঙ্কুরের স্বকীয় ‘প্রত্যেকটি লেখা যিনি সেই অতীতের ‘ভারত’-’যমুনা’র যুগে পাঠ করতেন, তাঁর সাহিত্যিক ভবিষ্যৎ অত্যুজ্জ্বল বলে যাঁর দৃঢ় ধারণা ছিল, তাঁকে যিনি সাহিত্যকর্মের জন্যে অতি স্নেহের চক্ষে দেখতেন, সেই শরৎচন্দ্র একদিন তাঁকে তীব্র ভাষায় যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন সিনেমায় মেতে উঠে সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় চুকিয়ে দেবার জন্যে। তাঁর প্রতিভার যোগ্য ক্ষেত্র সাহিত্য-রচনা বন্ধ করে তিনি নিজের চূড়ান্ত ক্ষতি করেছেন, এই ধরনের মর্মান্তিক ভর্ৎসনা করলেন অনেকের সমক্ষেই। 

শরৎচন্দ্রের এই সুতীক্ষ্ণ অনুযোগের ফলে প্রকারান্তরে সাহিত্যে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা প্রেমাঙ্কুর মনের মধ্যে লাভ করলেন। লেখা অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই আরম্ভ হল না। বেশ কিছুদিন পরে, নিজেরই বর্ণচ্ছটাময় অতীতের বিষামৃত মন্থন করে সমগ্র জীবনের নির্যাসে সুরভিত করে লিখতে লাগলেন ‘মহাস্থবির জাতক’। অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে লিখতে লাগলেন, জীবন-পাত্র থেকে কলমে কালি ভরে নিয়ে। 

প্রথম পর্বটি সম্পূর্ণ করতেই দু’বছর লাগল। লিখেছেন, সংশোধন করেছেন, আবার নতুন করে লিখেছেন। শিল্পকর্ম-হিসেবে যতদিন না মনের মতন হয়েছে, প্রকাশ করেননি। “শতকরা নব্বুই-ভাগ সত্য” এই রচনা। দু’বছর ধরে লেখা প্রথম পর্ব শেষ হবার পর, শনিবারের চিঠি’ মাসিকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়। বই আকারে দেখা দেয় তারও পরে। বাংলা-সাহিত্যে ‘মহাস্থবির জাতক’ রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে। প্রেমাঙ্কুরের স্থান সুনির্দিষ্ট হয়ে যায় বহুকালের জন্যে। 

শরৎচন্দ্র অবশ্য প্রেমাঙ্কুরের এই সার্থকতম সাহিত্যপ্রয়াস দেখে যেতে পারেননি। কিন্তু প্রেমাঙ্কুর শেষবয়সেও শরৎচন্দ্রের সেই সস্নেহ তিরস্কার এবং তার ফলে এক মহৎ প্রেরণা পাবার কথা উল্লেখ করতেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ আন্তরিকতার সঙ্গে। তাঁর স্বভাবের এই এক বৈশিষ্ট্য ছিল যে, নিজের সাহিত্যকৃতি নিয়ে কখনও অহমিকা প্রকাশ করতেন না। তাঁর লেখা পাঠ করে বিশেষ তৃপ্তি পাওয়া যায় এ-কথা বললে তাঁর মুখ প্রসন্নতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠত, এই পর্যন্ত। একদিকে অহঙ্কারের অভাব, অন্যদিকে নিজের সমস্ত দোষত্রুটি দুর্বলতা স্বীকারের মধ্য দিয়ে তাঁর চরিত্রে দুর্লভ সরলতা প্রকাশ পেত। নিজের কোনো গুণের কথা ফলাও করে গৌরব নেবার চেষ্টা করতেন না, সহজাত-বিনয়-বশত। তাঁর সাহিত্য যেমন, ব্যক্তিচরিত্রেও অন্তরঙ্গ আন্তরিকতার গভীরে এক আশ্চর্য নিরাসক্ত মন প্রচ্ছন্ন ছিল। এই নিরাসক্তি নিয়ে কিন্তু তিনি জীবন ও জগৎকে দেখেছিলেন প্রাণ ভরে। তাই অতি স্থূল বাস্তবের মধ্যে তিনি জীবনে বহুবার অবগাহন করলেও পঙ্ক তাঁর অন্তরকে আবিল করতে পারেনি। পঙ্কজের মতন তিনি শুভ্র সুন্দরকে প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর অমৃতসাহিত্যে। 

.

বোম্বাই থেকে ফিরে আসবার পরে তিনি, ২নং রঘুনাথ চ্যাটার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে, বারোবছর বাস করেন এবং এখানে তাঁর পত্নী ও প্রিয় কনিষ্ঠ জ্ঞানাঙ্কুরের মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত এ-বাড়িতে বাসের সময়ে ১৯৪৩ সালে তাঁর পত্নী পরলোকগতা হন এবং ১৯৫১ সালে প্রেমাঙ্কুর গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন অ্যাজ্‌জ্মা-টাইপের ব্রঙ্কাইটিসে। পরে ‘হাই ব্লাডপ্রেসার’ দেখা দেয়। 

১৯৫৩ সালে সেই নিঃসঙ্গ বাড়ি ছেড়ে চলে আসেন বিবেকানন্দ রোডের পাশে ৭-এ চালতাবাগান লেনে, তাঁর দুই কন্যার মধ্যে কনিষ্ঠার গৃহে। এখানেই তাঁর শেষের প্রায় এগারো বছর অতিবাহিত হয়েছিল। 

কৈশোর থেকে চির-অশান্ত প্রেমাঙ্কুর শেষপর্বে বাহ্যত শান্ত হয়ে পড়লেন। তখন প্রায় ন’-দশ বছর সেই অশ্রান্ত যাযাবরের যেন বন্দি-জীবন। ‘রক্তচাপের আধিক্য’ রোগ তারও আগে থেকেই দেখা দেয়, কিন্তু অন্তিমের বছরগুলি তাঁকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ক্রমে বাড়ির বাইরে বেরুনো বন্ধ, তারপর ঘর থেকেও। চার দেয়ালের মধ্যে এতকালের মুক্ত-বিহঙ্গের গতি রুদ্ধ হয়ে গেল।… 

এখন অখণ্ড অবসর,–অতীতে যা ছিল অভাবিত। সেই সঙ্গে শিল্পী-মন সাহিত্যিকের অতিশয় সংবেদনশীলতা সবই অবিকৃত আছে। সমগ্র বিগত-জীবনের স্মৃতি মনের মুকুরে জাজ্বল্যমান হয়ে পরম আকুলতা জাগায়। এখনো যে অনেক কথা রয়ে গেছে লেখবার অপেক্ষায়। অপরিসীম বৈচিত্র্যে ভরা প্রাণের পাত্র–তার সব স্বাদ তো এখনো প্রকাশ করা হয়নি। চিন্তার পটে এখনো কত স্মৃতি-রঙ্গ! কত অপরূপ আনন্দ-বেদনার অভিজ্ঞতা! ভূয়োদর্শনের সঙ্গে নিজের জীবন-দর্শন মিলিত হয়ে অন্তর থেকে প্রেরণা আসে কলম নিয়ে বসতে। আরম্ভ করেন ‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ পর্ব-রচনা। কিন্তু দেহপট এখন অপটু। ইচ্ছামতন কাজ এগোয় না। এক-একদিন ব্লাড-প্রেসারের ঊর্ধ্বগতিতে অসুস্থ হয়ে পড়েন আকস্মিকভাবে। 

শেষ পরিচ্ছেদের দশবছর শয্যাশায়ী হয়ে পড়লেন। নিজের হাতে কিছু লিখতে পারতেন না, হাত কাঁপত। 

তাঁর সাহিত্য-জীবনের এই শেষ পর্যায়ে রচনার প্রসঙ্গ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে কবি উমা দেবীর উল্লেখ না করলে। আলোচ্য কালের ক’বছর আগে ‘জাতক’-এর তৃতীয় পর্ব যখন শনিবারের চিঠিতে প্রকাশিত হতে আরম্ভ করে তখনই আতর্থী মহাশয় অসুস্থ হয়ে পড়েন। সে-সময় শনিবারের চিঠিতে ‘জাতক’-এর ধারাবাহিক প্রকাশ সম্ভব হত না যদি উমা দেবী লেখকের খাতা থেকে নিয়মিত প্রেস-কপি প্রস্তুত করে না দিতেন, একথা গ্রন্থকার স্বয়ং জানিয়েছেন তৃতীয়-পর্ব পুস্তকের ভূমিকায়। 

প্রেমাঙ্কুরবাবুর স্নেহের পাত্রী উমা দেবীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় তারও বহু বছর আগে। উমা দেবী তখন নিতান্ত বালিকা এবং ভাগলপুর-নিবাসিনী। 

শেষের বছরগুলিতে আতর্থী মহাশয়ের শারীরিক অসুস্থতার জন্য লেখা বন্ধ হয়ে যায় দেখে উমা দেবী এ-বিষয়ে সাহায্য করেন। যেদিন প্রেমাঙ্কুর অপেক্ষাকৃত সুস্থ থাকেন, তিনি মুখে মুখে বলে যান এবং লিখে নেন উমা দেবী। এইভাবে ‘জাতক’ চতুর্থ-পর্বের বাকি তিন-চতুর্থাংশ লেখা সম্পূর্ণ হয়। লেখকের জীবদ্দশায় তার বিচ্ছিন্ন একাধিক অধ্যায় কোনো কোনো পত্রিকায় প্রকাশ পেলেও পরিপূর্ণ আকারে দেখা দেয়নি। তাঁর মৃত্যুর তিন বছর পরে উমা দেবীর উদ্‌যোগে এবং তাঁরই দ্বারা প্রস্তুত প্রেস কপি থেকে প্রথমে এক সাপ্তাহিকে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়ে ‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ-পর্ব প্রকাশ পায় গ্রন্থাকারে (১৯৬৯ খ্রিঃ)। 

আতর্থী মহাশয়ের জীবনের সেই শেষপর্বে প্রকাশিত এবং তাঁর শেষ গল্পের বই ‘শিউলী’ও অনেকাংশেই লেখকের মুখে বলা এবং উমা দেবীর লিখে-নেওয়া থেকে মুদ্রিত। ‘শিউলী’র উৎসর্গপত্রে প্রকাশিত, লেখকের বাল্যবন্ধু অমল হোমের উদ্দেশে রচিত কবিতাটিও প্রেমাঙ্কুর-বর্ণিত ভাব অনুসারে লিখিত। জীবনের এই সমাপ্তি-পর্যায়ে বিভিন্ন সাময়িক পত্রাদিতে প্রকাশিত প্রেমাঙ্কুরবাবুর লেখা রাজশেখর বসু, দেবীপ্রসন্ন রায়চৌধুরী (‘নব্য-ভারত’ মাসিকের সম্পাদক), সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পর্কে স্মৃতিকথাগুলিও এইভাবে রচিত। 

শেষপর্যন্ত, অসুস্থতা সত্ত্বেও, প্রেমাঙ্কুর ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, পরিহাস-রসিক, বেশে বর্ণে ভাষণে উজ্জ্বল এবং চিত্তাকর্ষক সদালাপী। অবশেষে ১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসের তেরো তারিখে সপ্তমীপূজার সকালে তাঁর যাযাবর জীবনের শান্ত পরিসমাপ্তি ঘটে। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *