যাঁদের দেখছি – হেমেন্দ্রকুমার রায়
পুরাতন বন্ধু। কিছু কম পাঁচ যুগ আগে প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে হয় আমার প্রথম পরিচয়। পৃথিবীর নাট্যশালায় আজও আমার যে দুই-চারজন সত্যকার মরমী বন্ধু বিদ্যমান আছে, তাঁদের মধ্যে একজন হচ্ছেন প্রেমাঙ্কুর। আমার কাছে তিনি শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক বা প্রখ্যাত চিত্র-পরিচালক নন, আমার কাছে তিনি বন্ধু–কেবল বন্ধুই। এই বিষাক্ত দুনিয়ায় অকপট বন্ধুলাভ যে কতটা দুৰ্ঘট, দুনিয়াদারিতে ভুক্তভোগীর কাছে তা অবিদিত থাকবার কথা নয়।
প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে যখন আমার প্রথম পরিচয় হয়, তখন তিনি সাহিত্যিক ছিলেন না, ছিলেন কেবল সাহিত্যরসিক। কিন্তু লেখক হবার জন্যে তখনই যে গোপনে হাতমক্স শুরু করেছেন, সে প্রমাণ পেয়েছিলুম অল্পদিন পরেই।
সুধাকৃষ্ণ বাগচী এক তৃতীয় শ্রেণীর যুবক, তার মূলমন্ত্র ছিল–’ভুলিয়াও সত্য কথা কহিবে না।’ নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের ‘জাহ্নবী’ নামে মাসিক কাগজ উঠে যাবার কয়েক বৎসর পরে সে ওই নামেই আর একখানি পত্রিকা প্রকাশ করে। নামে সেই-ই ছিল সম্পাদক। কিন্তু তার রচনাশক্তি বা সম্পাদকের উপযোগী বিদ্যাবুদ্ধি ছিল না। পত্রিকা পরিচালনার ভার নিয়ে যে কয়েকজন তরুণ যুবক তখন ‘জাহ্নবী’ কার্যালয়ে ওঠা-বসা করতেন, তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই আজ বিভিন্ন বিভাগে হয়েছেন দেশের ও দশের কাছে সুপরিচিত। তাঁরা হচ্ছেন শ্রীপ্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় (পরে অধুনালুপ্ত দৈনিক ‘ভারতে’র সম্পাদক), শ্রীঅমল হোম (পরে ‘মিউনিসিপ্যাল গেজেটের সম্পাদক এবং এখন সরকারের প্রচার-সচিব), শ্রীসুধীরচন্দ্র সরকার (পরে ‘মৌচাক’ সম্পাদক ও বিখ্যাত পুস্তক প্রকাশক), শ্রীচারুচন্দ্র রায় (চিত্রকর ও চিত্র-পরিচালকরূপে নাম কেনেন) এবং শ্রীপ্রেমাঙ্কুর আতর্থী (পরে ঔপন্যাসিক ও চিত্র-পরিচালক)। এই দলে আর একজনও ছিলেন, পরে ভেস্তে গিয়েছেন কেবল তিনিই। তাঁর নাম শ্রীনরেশচন্দ্র দত্ত। কার্যক্ষেত্রে আরম্ভ করেছিলেন তিনি আশাপ্রদ জীবন। কাজ করতেন সুরেন্দ্রনাথের বিখ্যাত দৈনিক ‘বেঙ্গলী’র সম্পাদকীয় বিভাগে। তারপর প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ‘বেঙ্গলীকে ছেড়ে অবলম্বন করলেন মসীর বদলে অসি–অর্থাৎ সৈনিক-বৃত্তি। দেশে ফিরে হলেন সাবডেপুটি। ওই পর্যন্ত।
প্রসঙ্গক্রমে আর একটা কথা মনে হচ্ছে। প্রেমাঙ্কুর আর আমারও জীবন হয়তো বদলে যেত। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে ইংরেজ গভর্নমেন্ট সেনাদলে ভর্তি হবার জন্যে বাঙালি যুবকদের আহ্বান করেন। প্রেমাঙ্কুর ও আমি পরামর্শের পর স্থির করলুম আমরাও ধারণ করব মসীর বদলে অসি। বিপুল উৎসাহে আমি একদিন যথাস্থানে গিয়ে সেনাদলে নাম লিখিয়ে এলুম। প্রেমাঙ্কুর তো তখন থেকেই সেকালকার গোরা সৈনিকদের মতো খাঁটো করে চুল ছাঁটতে শুরু করে দিলেন। দুজনে মিলে দেখতে লাগলুম যুদ্ধক্ষেত্রের রক্তাক্ত স্বপ্ন। সে যাত্রা সৈনিক হবে বলে নাম লিখিয়েছিল প্রায় ছয় শত জন বাঙালি যুবক। কিন্তু হঠাৎ গভর্নমেন্টের মত গেল বদলে। বললেন, না, আপাতত আর বাঙালি ফৌজের দরকার নেই। প্রথম ছয় শত জনের নাম খারিজ করে দেওয়া হল। কিছুদিন পরে আবার এল সরকারি আহ্বান–বাঙালি ফৌজ চাই। নতুন করে সবাই নাম লেখাও। আমাদের ভিতর থেকে সে আহ্বানে সাড়া দিলেন কেবল নরেশচন্দ্র। প্রেমাঙ্কুরের ও আমার সে প্রবৃত্তি আর হল না। প্রথম বারেই প্রত্যাখ্যাত হয়ে জুড়িয়ে গিয়েছিল আমাদের প্রতপ্ত উৎসাহ। ভুল করেছি বলে মনে হচ্ছে না। কারণ আজ জেনেছি অসির চেয়ে মসীর শক্তিই বেশি। সারা পৃথিবীতে এখন এই যে “কোল্ড ওয়ার” বা “ঠান্ডা যুদ্ধ” চলছে, তার প্রধান অস্ত্রই তো হচ্ছে কালি ও কলম।
যাক্। ‘জাহ্নবী’ কার্যালয়ের কথা হচ্ছিল। ওখানে আমিও প্রত্যহ যেতুম বটে, কিন্তু পত্রিকা পরিচালনার সঙ্গে আমার কোন সংস্রব ছিল না। আমি ছিলুম ‘জাহ্নবী’র নিয়মিত লেখক। যে তরুণদের দলটি নিয়ে ‘জাহ্নবীর বৈঠকটি গঠিত হয়, তাঁদের মধ্যে সাহিত্যক্ষেত্রে আমিই ছিলুম তখন সবচেয়ে অগ্রসর, কারণ সে সময়ে ‘ভারতী’, ‘প্রবাসী’, ‘সাহিত্য’, ‘নব্যভারত’, ‘মানসী’, ‘অৰ্চ্চনা’, ও ‘জন্মভূমি’, এবং অন্যান্য বহু পত্রিকায় আমার অনেক প্রবন্ধ, গল্প ও কবিতা প্রকাশিত হত।
মনে ছিল তখন ভবিষ্যতের কত সম্ভাবনার ইঙ্গিত, সাহিত্যের রূপকথাই ছিল আমাদের আনন্দের একমাত্র সম্বল। সাহিত্যের মাদকতা আমাদের মত্ত করে তুলেছিল এবং সে নেশার ঘোর আজও কাটেনি। তখনও পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের উপরে বঙ্কিমচন্দ্রের যথেষ্ট প্রভাব বিদ্যমান ছিল, যদিও তখনকার অধিকাংশ উদীয়মান সাহিত্যিকের গুরু স্থানীয় ছিলেন রবীন্দ্রনাথই। নাট্যসাহিত্যে চলেছে তখন দ্বিজেন্দ্রলালের যুগ। ‘বিন্দুর ছেলে’ ও ‘রামের সুমতি’ প্রভৃতি গল্প বোধ হয় তখন বেরোয়নি কিংবা সবে বেরিয়েছে, কিন্তু সুপরিচিত লেখক হিসাবে জনসাধারণের বা আমাদের মনে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কোন স্থানই ছিল না।
বয়সে ছিলুম সকলেই তরুণ, বয়সের ধর্মকে অস্বীকার করতেও পারতুম না। ঝোঁকের মাথায় প্রায়ই তুমুল তর্কাতর্কির ঝড়ের ভিতরে গিয়ে পড়তুম। এখন সেই বালকতার কথা মনে করলেও হাসি পায়, কিন্তু তখনই সেই তর্কের হার-জিতের উপর নির্ভর করত যেন আমাদের সমস্ত মানসম্ভ্রম। দুই পক্ষের একমাত্র লক্ষ্য থাকত, সুযুক্তি বা কুযুক্তির সাহায্যে যেমন করেই হোক প্রতিপক্ষের মুখ বন্ধ করা। কিন্তু মুখ তো বন্ধ হতই না, বরং আরো বেশি করে খুলে যেত।
একবার তর্ক বাধল বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথকে অবলম্বন করে। একপক্ষে ছিলাম প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে আমি এবং অন্য পক্ষে প্রভাতচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। অন্যেরা থাকতেন মধ্যস্থের মতো। বাকবিতণ্ডা চরমে উঠলে উত্তেজিত হয়ে তারস্বরে চিৎকার করতুম আমরা তিনজনেই। তর্ক শুরু হত সন্ধ্যার আগে ‘জাহ্নবী’ কার্যালয়ে। সন্ধ্যার পর আসত রাত্রি। কার্যালয় বন্ধ হয়ে যেত। তবু বন্ধ হত না আমাদের বাক্প্রপঞ্চ। কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের জনবহুল ফুটপাথের উপরে আমাদের তর্ক চলত অশ্রান্তভাবে। ওদিকে হেদুয়া আর এদিকে শ্রীমানী মার্কেট। ওদিক থেকে এদিকে আসি, আবার এদিক থেকে যাই ওদিকে এবং চলতে চলতে ফোঁটাই অনবরত কথার খই। মাঝে মাঝে হঠাৎ এত জোরে ছুঁড়ি বাক্য-বন্দুক যে, রাজপথের চলমান পথিকরা চমকে ও থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে অবাক হয়ে তাকায় আমাদের মুখের দিকে। ক্রমে রাত বাড়ে, পথ জনবিরল হয়ে পড়ে, কিন্তু তর্ক থামে না। প্রেমাঙ্কুর ও প্রভাত থাকেন এই পাড়ায়, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরের আশেপাশে এবং আমি তখন থাকতুম পাথুরিয়াঘাটায় আমাদের পৈতৃক বাড়িতে। আমি যদি হই বাড়িমুখো, অন্য কেউ আমার সঙ্গ ছাড়তে নারাজ। বিডন স্ট্রিট ধরে চিৎপুরের মোড়। তর্ক তখনও প্রবল। তাকে আধা খ্যাঁচড়া রেখে কারুরই বাড়ি যেতে মন সরে না। সবাই ঢুকি বিডন গার্ডেনে। আবার বসে তর্কসভা। মধ্যরাত্রি। বাধ্য হয়ে সবাই উঠে দাঁড়াই। প্রেমাঙ্কুর ও প্রভাত প্রভৃতি নিজেদের পাড়ার দিকে পদচালনা করেন। হঠাৎ আমার মনে হয়, তূণের কতিপয় চোখা চোখা বাক্যবাণ এখনো ছোঁড়া হয়নি। আমিও সেইগুলি ব্যবহার করতে করতে আবার চলি তাঁদের সঙ্গে সঙ্গে। বিডন স্ট্রিটের আধখানা পার হয়ে আবার কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটে। তবু তর্ক থেকে যায় অমীমাংসিত। সেদিন অতৃপ্ত মনে সবাই বাড়ি ফিরলুম বটে, কিন্তু তর্কের খেই ধরা হল আবার পরদিন। এমনি চলল দিনের পর দিন। প্রত্যেকেই নাছোড়বান্দা।
পাড়ার লোকেরা দস্তুরমতো অতিষ্ঠ। প্রেমাঙ্কুরের পিতৃদেবের কাছে গিয়ে তাঁরা নালিশ করলেন, “মশাই, আপনার ছেলে আর তার বন্ধুদের উপদ্রবে এ পাড়া থেকে ঘুমের পাট উঠে যেতে বসেছে। রোজ দুপুর রাত্রে তারা ‘বঙ্কিমচন্দ্র’ আর ‘রবীন্দ্রনাথ’ বলে এমন ভয়ানক জোরে বীভৎস তর্জনগর্জন করে যে, ঘুমোতে ঘুমোতে আমাদের আঁৎকে জেগে উঠতে হয়। এ ভয়াবহ কাণ্ড বন্ধ না করলে আমাদের প্রাণ আর বাঁচে না।”
চিৎকারে আমাদের মধ্যে প্রভাতই ছিলেন অগ্রগণ্য। তাঁর একার কণ্ঠে ছিল চারজনের সম্মিলিত কণ্ঠের চিৎকার করবার শক্তি।
তর্কাতর্কি একেবারে ব্যর্থ হত না। তার মধ্য থেকে পেয়েছি আমার কয়েকটি নতুন রচনার উপাদান। (প্রেমাঙ্কুরও রবীন্দ্রনাথের “রাজা ও রাণী’কে বিশ্লেষণ করে প্রকাণ্ড একখানি পাণ্ডুলিপি প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন।)
প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে স্থাপিত হল আমার অচ্ছেদ্য সম্পর্ক। প্রতিদিনই কেউ কারুকে না দেখে থাকতে পারি না। পরে পরে ‘যমুনা’, ‘মর্ম্মবাণী’, ‘সঙ্কল্প’ ও ‘ভারতী’ প্রভৃতি পত্রিকার আসরে, বিভিন্ন বন্ধুবাড়ির বৈঠকে, থিয়েটারে, সিনেমায়, গান-বাজনার মজলিসে–এমনকি কুস্তির আখড়ায় ও খেলাধুলোর মাঠেও আমাদের দু’জনের আবির্ভাব হত এক সঙ্গে মানিকজোড়ের মতো। এই ভাবে কেটে গিয়েছে বৎসরের পর বৎসর, বহু বৎসর। শহরের ভিতরে এবং বাহিরে কত দিন রাত কাটিয়েছি এক শয্যায়।
কিন্তু জীবনসংগ্রাম একান্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও বিক্ষিপ্ত করে ইতস্তত তাদের টেনে নিয়ে যায় পরস্পরের চোখের আড়ালে। আমি শিকার গেড়ে মোতায়েন আছি সাহিত্য ক্ষেত্রেই, কিন্তু প্রেমাঙ্কুর যেদিন থেকে প্রবেশ করেছেন সিনেমা জগতে সেই দিন থেকেই তাঁর সঙ্গেই আমার দেখা হয় ন’ মাসে ছ’মাসে। তবে আমাদের মনের সম্পর্ক যে আজও একটুও শিথিল হয়নি, মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে দেখা হলে সেটুকু বুঝতে বিলম্ব হয় না।
গোড়ার দিকে তিনি আর একবার বেশ কিছুকালের জন্য সাহিত্যের সঙ্গে সম্পর্ক তুলে দিয়ে চাকরিতে নিযুক্ত হয়েছিলেন। কিছুকাল পরে আবার হন বেকার। কিন্তু তাঁর মতন একজন মনীষী ব্যক্তির অলস হয়ে বসে থাকাটা আমার ভালো লাগেনি। সেই সময়ে স্বর্গীয় ললিতমোহন গুপ্ত ‘হিন্দুস্থান’ নামে একখানি ভালো দৈনিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং আমি ছিলুম তার একজন নিয়মিত লেখক। প্রেমাঙ্কুরকেও আমি ‘হিন্দুস্থানে’র সম্পাদকীয় বিভাগে ভিড়িয়ে দি (পত্রিকাখানি ছয় বৎসর ধরে চলেছিল)। তারপর থেকে তার লেখনী হয়ে ওঠে রীতিমত সচল। পরে পরে তিনি রচনা করেন অনেকগুলি জনপ্রিয় গল্প ও কয়েকখানি উপন্যাস। ক্রমে ক্রমে বেড়ে ওঠে তার হাতযশ। পরিচিত হন তিনি ‘ভারতী’ গোষ্ঠীভুক্ত অন্যতম বিখ্যাত লেখকরূপে। তাঁর সাহিত্য-সাধনার সম্যক পরিচয় দেবার স্থান এখানে নেই। তবে এটুকু উল্লেখ করা চলে যে, জীবনের পর্বার্ধে তিনি লোকপ্রিয় সুলেখক বলে সুনাম কিনেছিলেন বটে, কিন্তু ‘মহাস্থবির জাতক’ রচনা করে সমধিক খ্যাতি অর্জন করেছেন প্রাচীন বয়সেই। প্রায় দুই যুগ আগে একখানি নাটক রচনা করেছিলেন– ‘তখৎ-এ-তাউস।’ সম্প্রতি তা মঞ্চস্থ হয়েছে শিশিরকুমারের ‘শ্রীরঙ্গমে’।
বাল্যকাল থেকেই তাঁর ঝোঁক ছিল নাট্যকলার দিকে। তরুণ বয়সেই তিনি শৌখিন অভিনয়ে যোগ দিতেন এবং পরিণত বয়সে এই নাট্যানুরাগের জন্যেই আকৃষ্ট হন চলচ্চিত্রের দিকে। কেবল পরিচালনায় নয়, চিত্রাভিনয়েও তাঁর দক্ষতা আছে। কয়েক বৎসর পূর্বে নিউ থিয়েটারের “পুনর্জন্ম” কথাচিত্রে তিনি অভিনয় করেছিলেন প্রধান ভূমিকায়। [ ৯৩২-এর ২রা এপ্রিল তারিখে চিত্রা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছিল। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী শুধু অভিনয় করেননি–তিনি পরিচালকও ছিলেন। প্রকাশক। ]
বন্ধুরা সকলেই তাঁর সঙ্গ প্রার্থনা করে। তাঁর উপস্থিতিতে সরস ও সজীব হয়ে ওঠে যে কোন শ্রেণীর বৈঠক। মিশতে পারেন তিনি শিল্পীদের সঙ্গে শিল্পীর মতো, আবার রাম-শ্যামের সঙ্গে রাম-শ্যামের মতো। তাঁর মুখে হাসির বুলি ও হাসির গল্প জমে ওঠে অপূর্বভাবে, এমন গল্পিয়া মানুষ আধুনিক সাহিত্যিকদের মধ্যে আমি আর দেখিনি। অতি সাধারণ কথা তাঁর ভাষণ-ভঙ্গিতে হয়ে ওঠে অতি অসাধারণ। আজ তিনি রোগজর্জর, জরাকাতর, কিন্তু এখনো মন তাঁর হয়ে আছে চিরহরিৎ, কথায় কথায় সেখান থেকে উচ্ছলিত হয়ে ওঠে হাসিরাঙা রসের ফোয়ারা।
সেদিন বৈকালে বাড়ির ত্রিতলে রচনাকার্যে নিযুক্ত হয়ে আছি, হঠাৎ রাস্তা থেকে ডাক শুনলুম, “হেমেন্দ্ৰ।”
জানলার কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “কে?”
–”আমি প্রেমাঙ্কুর।”
বহু–বহুকাল অদর্শনের পর আচম্বিতে প্রেমাঙ্কুরের এই অভাবিত আবির্ভাব কেন? নীচে গিয়ে শুধলুম, “ব্যাপার কি?”
প্রেমাঙ্কুর অভিভূত কণ্ঠে বললেন, “বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হল, দুনিয়ায় আমি একা। তুমি ছাড়া আমার আর কোন বন্ধু নেই। তাই ছুটতে ছুটতে তোমার কাছেই চলে এসেছি।”
অজিতকুমার চক্রবর্তী, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় ও সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতির সঙ্গে আমরা ‘ভারতী’র আসরে বাস করতুম একটি সুখী পরিবারের মতো। সে আসর ভেঙে গেছে, প্রায় সব দীপ নিভে গেছে। দু-তিনটি জীবনদীপ এখনো টিম্ টিম্ করে জ্বলছে বটে, কিন্তু তারও তেল ফুরোতে দেরি নেই।
[ যাঁদের দেখছি ]