প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

৩.৮ ভাগ্য-পরিবর্তনের কথা

পরের দিন সকালবেলা উঠে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়া গেল। আমাদের হঠাৎ এই ভাগ্য-পরিবর্তনের কথা তাদের না জানানো পর্যন্ত মনটা খুঁতখুঁত করছিল। গিয়ে দেখলুম, আমাদের জন্যে কোনো মাথা-ব্যথাই তাদের নেই। আমরা শিগিরই বোম্বাই শহরের মিলে কাজ শিখতে যাব শুনে তারা হাঁ-না কিছুই বললে না। শুনলুম, জনার্দন তার বাড়িতে টাকার জন্যে চিঠি লিখেছে। টাকা নিশ্চয়ই আসবে, টাকা এলে তারা খুব ফলাও করে ব্যবসা শুরু করবে। দেখলুম, আমরা তাদের দল থেকে খসে পড়ায় তারা বেশ আনন্দেই আছে।

তবুও জনার্দনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা চলে এলুম। ফিরে এসে দেখি, পণ্ডিতজী আপিসে বেরিয়ে গিয়েছেন। শুনলুম, তিনি রাত থাকতে ঘুম থেকে উঠে স্নান করে পূজা-অৰ্চনা শুরু করেন, শেষ হয় সেই বেলা আটটা আন্দাজ। তার পরে একেবারে আপিসের পোশাক পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চা-জলখাবার খেয়ে বেরিয়ে যান। দুপুরে বাড়ি ফিরে আহারাদি করে নিজের ঘরে শুতে যান। তার পরে কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে বেলা পাঁচটা নাগাদ আবার পুজোয় বসেন-–সাতটা, সাড়ে সাতটার আগে উঠে আসেন না। শুনলুম পণ্ডিতজী যখন ঘুমোন তখন তাঁর ঘরের বিশেষ কয়েকটি জানলা খোলা হয় বা বন্ধ হয়। এই দরজা-জানলা খোলা ও বন্ধ দেখে তাঁর ছেলেমেয়েরা ও চাকরবাকর বুঝতে পারে, তিনি কি করছেন। কারণ তিনি যখন পুজোয় বসেন তখন তাঁকে ডাকা বারণ।

পণ্ডিতজী একটা বড় ঘরে থাকতেন। ঘরের মধ্যে খানিকটা জায়গা পুজোয় বসবার জন্য নির্দিষ্ট ছিল। জায়গাটিতে একটি বাঘের ছাল পাতা থাকত। কোনো বিশেষ দেবতার ছবি কিংবা মূর্তি সেখানে দেখিনি। সামনে আশেপাশে কয়েকটি পুরুষ ও নারীর ব্রোমাইড ছবি টাঙানো ছিল, সেগুলির অধিকাংশই ইউরোপীয়ানদের, দু’-একজন মাত্র ভারতবর্ষীয় লোক ছিলেন। পণ্ডিতজীর কাছেই শুনেছিলুম, তাঁরা সকলেই নাকি উঁচুদরের সাধক–এঁদের মধ্যে কেউ কেউ দেহ-রক্ষা করেছেন, কেউ-বা এখনও বেঁচে আছেন। এঁদের সবার নামও বলেছিলেন, কিন্তু সারা জীবন ধরে নিজের নাম মনে রাখতে রাখতে তাঁদের নাম ভুলে গিয়েছি। পণ্ডিতজীর ঘরের সামনেই ঠিক পুবমুখো একটু ছোট-গোছের বারান্দা ছিল। তাঁর ঘরের একপাশে ছোট একটা ঘরে আমাদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, আর একপাশে বড় একটা ঘরে শঙ্কর ও দেবী রাত্রে শুত।

একদিন সকালবেলা উঠে অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখলুম। আমরা চা-পান করবার জন্যে খাবার ঘরে যাচ্ছি, এমন সময় বারান্দার দিকে চেয়ে দেখি, পণ্ডিতজী স্থির হয়ে হাতজোড় করে উদীয়মান সূর্যের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর পরনে একখানা রেশমের হালকা গোলাপি রঙের ধুতি, অঙ্গেও সেই রঙেরই একখানা চাদর পৈতের মতন করে পেঁচানো রয়েছে। রক্তাভ গৌর তাঁর দেহ, তার ওপরে এসে পড়েছে উদীয়মান সূর্যের অরুণালোক-অরুণ-মেঘচ্ছায়া যেন প্রতিবিম্বিত হয়েছে স্বচ্ছ স্রোতে। আমার মনে হতে লাগল, যেন পুরাকালের কোনো এক বৈদিক ঊষার বন্দনাসূক্তের একটি ঋক্ হঠাৎ বিভ্রান্ত হয়ে এসে পড়েছে সুরাটের মতন এই আধুনিক শহরে। আমাদের চিত্তলোকে যে অদৈহিক আকৃতি ও অরূপের কান্না কাঁদছে, তারই যেন প্রত্যক্ষ রূপ ওই দীপ্ত ব্ৰহ্মণ্যশ্রী।

সেই দৃশ্য দেখে আমরা আর নড়তে পারলুম না। কি যেন একটা আকর্ষণী শক্তি আমাদের টেনে সেইখানেই বেঁধে রেখে দিলে। পণ্ডিতজীর হাত-দুটি যুক্ত, চোখ-দুটি খোলা রয়েছে বটে–কিন্তু স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ রয়েছে সেই প্রদীপ্ত সূর্যের পানে। আমি যদি চিত্রকর হতুম তো চিত্রিত করে রেখে দিতুম সেই রূপ। আগ্রায় সত্যদার কাছে শুনেছিলুম বটে যে, তিনি প্রতিদিন সকালবেলা উঠে সূর্যের দিকে চেয়ে থাকেন। সত্যদার সে কথা শুনে মনে হয়েছিল, কোথাও কিছু নেই, খামকা লোকে সূর্যের দিকে চেয়ে থাকতে যাবে কেন? আজ এই ব্রাহ্মণকে দেখে আমাদের ভুল ভাঙল। পণ্ডিতজীর দিক থেকে চোখ আর ফেরাতে পারি না। যত দেখি তত মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। চোখের পলক নেই, হাত-পা বা দেহের কোনো জায়গা একটু নড়ছে না, নিশ্বাস পড়ছে কি পড়ছে না–তা বোঝার উপায় নেই। ধীর স্থির নিস্পন্দ সেই দেহযষ্টি নিষ্কম্প উজ্জ্বল দীপশিখার মতন।

আমরা প্রায় আধ ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়ে সে-দৃশ্য দেখে নিঃশব্দে সেখান থেকে সরে এলুম। পরে শঙ্কর ও দেবীর কাছে শুনেছিলুম, তিনি প্রতিদিন প্রায় দু’-ঘণ্টা ওইরকম সূর্যের দিকে চেয়ে থেকে জপ করেন।

পণ্ডিতজীর বাড়িতে আমাদের দিনগুলি সুখেই কাটতে লাগল। শান্তির অভাবও সেখানে ছিল না, তবে আমাদের অনির্দিষ্ট ভবিষ্যতের চিন্তা মধ্যে মধ্যে মনকে নাড়া দিত। আমাদের সম্বন্ধে ইঞ্জিনীয়ার-সাহেবের কাছে কোনো চিঠি এল কি না সে-কথা মাঝে মাঝে পণ্ডিতজীকে জিজ্ঞাসা করতুম। কিন্তু তার উত্তরে তিনি তাঁর স্বভাব-সুলভ উচ্চহাসি হেসে বলতেন, ভাবনা কি! চিঠি এলে ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব নিজেই আমাকে বলবেন–আমাকে আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না।

তারপরেই তিনি একটু থেমে আবার বলতেন, এখানে তোমাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না তো? তোমাদের জামা কাপড় জুতো আছে তো?

অদ্ভুত মানুষ ছিলেন এই পণ্ডিতজী। গৃহস্থের মধ্যেও এমন লোক থাকতে পারে তা এর আগে আমার ধারণা ছিল না। সেখানে থাকতে থাকতে কিছু তাঁর মুখে, কিছু তাঁর ছেলে-মেয়ের কাছে তাঁর পুণ্যজীবন কথা শুনেছিলুম। জীবনও তাঁর ছিল অদ্ভুত।

অনেকদিন আগে পণ্ডিতজীর পূর্বপুরুষের কোনো লোক তীর্থ করতে এসে এই দেশেই থেকে গিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন গৌড়-সারস্বত ব্রাহ্মণ। তখন মারাঠারা সবেমাত্র একটু একটু করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। গৌড়-সারস্বত ব্রাহ্মণেরা তখন ভারতবর্ষময় নিজেদের তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার জন্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। আমাদের পণ্ডিতজীর পূর্বপুরুষ মারাঠাদের রাজসরকারে সামান্য কাজে ঢুকে বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার বলে অসামান্য হয়ে উঠেছিলেন। ক্রমে তাঁদের বংশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। কেউ কেউ আর্যাবর্তে এসে নিজের জাতে বিবাহ করতেন, কেউ বা মহারাষ্ট্রীয়দের ঘরে বিবাহ করতেন। কারুর বা একাধিক স্ত্রী থাকত–তাঁদের মধ্যে কেউ-বা গৌড়-সারস্বত ব্রাহ্মণের মেয়ে, কেউ-বা মহারাষ্ট্রীয় ব্রাহ্মণের মেয়ে। এমনও হয়েছে যে, কেউ-বা সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু ব্রাহ্মণের মেয়ে নয়। এমনি করে চলছিল। ইংরেজরা এ-দেশ অধিকার করার পর এদেরই এক পরিবার ইংরেজি লেখাপড়ার দিকে ঝুঁকে পড়ল। এই পরিবারের বংশধর হচ্ছেন আমাদের পণ্ডিতজী। তাঁর পিতা ইংরেজ সরকারে কাজ করতেন এবং কিছু পয়সাকড়িও তিনি করে গিয়েছিলেন। পণ্ডিতজী ইংলন্ড থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাস করে ফ্রান্সে চাকরি গ্রহণ করেন। ফ্রান্সে চাকরির সময়ে তিনি সেখানকার একদল স্ত্রী-পুরুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন–যাঁরা গোপনে ভারতীয় যোগসাধনা অভ্যাস করতেন। ফরাসি দেশে বসে বিদেশীদের সঙ্গে মিলে যখন তিনি যোগসাধনায় মগ্ন, ঠিক সেইসময় দেশ থেকে খবর গেল যে, তাঁর বৃদ্ধ পিতা-মাতা অত্যন্ত অসুস্থ এবং অবিলম্বে এখানে না এলে তাঁদের সঙ্গে বোধহয় আর দেখা হবে না। যোগ করলেও পিতা-মাতার প্রতি মমত্ব ও সাংসারিক কর্তব্যবোধ তাঁর একেবারে রহিত হয়ে যায়নি–তাই পত্র-পাঠ তিনি বৃদ্ধ পিতা-মাতার কাছে ফিরে এলেন।

পণ্ডিতজী স্থির করেছিলেন, পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তিনি আবার ফ্রান্সে ফিরে যাবেন এবং সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করবেন; কিন্তু প্রজাপতির ব্যবস্থা ছিল অন্যরকম। তিনি যে জাহাজে করে ভারতবর্ষে ফিরছিলেন সেই জাহাজেই একটি পাঞ্জাবী ভদ্রলোক তাঁর একমাত্র রূপসি দুহিতাকে নিয়ে ইউরোপ সফর করে দেশে ফিরছিলেন। ফলে উভয়ের সাক্ষাৎ, আলাপ-পরিচয়, প্রেম এবং ভারতবর্ষে পৌঁছতে-না-পৌঁছতেই বিবাহ। পণ্ডিতজীর বাবা-মা ইউরোপের গ্রাস থেকে ছেলেকে ফিরে পেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পেয়ে গেলেন একেবারে ছেলে-বউ। পুত্রবধূ অন্য জাতের হওয়ায় মন খুঁতখুঁত প্রকাশ করবার আগেই তাঁরা ইহলোক থেকে বিদায় নিলেন। পিতা-মাতার মৃত্যুর পর জায়গা-জমি বেচে দিয়ে তিনি আবার ইউরোপ যাত্রা করবার ব্যবস্থা করেছিলেন, কিন্তু স্ত্রী বাধা দেওয়ায় এখানেই তাঁকে চাকরি নিয়ে বসে যেতে হল। স্ত্রীর ইচ্ছানুসারে পণ্ডিতজী ঠিক করেছিলেন ভারতবর্ষেই শেষজীবন যাপন করবেন; কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দু’টি সন্তান রেখে স্ত্রী মারা যেতে তিনি আবার প্ল্যান বদলে ফেললেন। এবারে তিনি ঠিক করলেন, চাকরি শেষ হয়ে গেলে ছেলে ও মেয়েকে নিয়ে ফ্রান্সে ফিরে যাবেন এবং শেষজীবনটা সেখানেই বসবাস করবেন।

প্রায় প্রতিদিনই সন্ধ্যার কিছু পরে পূজা প্রার্থনা ইত্যাদি সেরে তিনি তাঁর ছেলে-মেয়ে ও আমাদের নিয়ে গল্প করতে বসতেন। রাত্রে খাওয়ার পরেও প্রায় দেড়ঘণ্টা কি দু’ঘণ্টা ধরে আমাদের সেই আসর চলতে থাকত।

পণ্ডিতজী অনেক বিভূতির অধিকারী হয়েছিলেন। তিনি একটু চেষ্টা করলেই লোকের মনের কথা জানতে পারতেন। হাত কিংবা কোষ্ঠী দেখে চোখ বুজে মানুষের ভূত-ভবিষ্যৎ প্রায় নির্ভুল বলে দিতে পারতেন। আমার ভবিষ্যতে কি হবে সে-কথা যতবার জিজ্ঞাসা করেছি, তিনি হেসে পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়েছেন। সুকান্তও অনেকবার তার নিজের ভবিষ্যতের কথা জানতে চেয়েছিল, কিন্তু তিনি সেইরকম মধুর হাসি হেসে তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেন।

একদিন পণ্ডিতজী আমাদের একটা অদ্ভুত কাণ্ড দেখিয়েছিলেন। সেদিন সন্ধ্যার অনেক আগেই তাঁর পূজা হয়ে যাওয়ায় আমাদের নিয়ে বাগানের দিকের একটা বারান্দায় বসে গল্প করছিলেন। ভারতবর্ষে কিছুদিন পূর্বেও অর্থাৎ দু’-তিনশো বছর আগে পর্যন্ত কত বড় বড় সব যোগী ছিলেন–তারই কথা হচ্ছিল। তাঁদের সম্বন্ধে অনেক অলৌকিক কাহিনির কথা বলতে বলতে তিনি বললেন, মানুষ জানে না যে প্রকৃতিকে সম্পূর্ণরূপে জয় করবার শক্তি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। সাধনা দ্বারা সেই শক্তির বিকাশ হয়। মানুষ শূন্যের মধ্যে দিয়ে উড়ে চলে যেতে পারে, অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এক দেশ থেকে অন্য দেশে চলে যাওয়া তার পক্ষে কিছুই নয়। জঙ্গলের মধ্যে হিংস্র প্রাণীদের বশ করা তো তার পক্ষে কিছুই নয়। পণ্ডিতজী বলতেন, আমার বিশ্বাস- মানুষ একদিন সর্ব-শক্তিমান হবে।

সুকান্ত ফট করে বলে ফেললে–আচ্ছা পণ্ডিতজী, আপনি যে এতদিন ধরে সাধনা করেছেন–আপনি কোনো বিভূতি পাননি? হিংস্র জানোয়ার বশ করতে পারেন?

পণ্ডিতজী তাঁর স্বভাবসুলভ হো-হো করে হেসে বললেন, আমি? না না। আমার কোনো শক্তি নেই। আমি তো সামান্য একজন সাধক মাত্র, আমার এখনও ঢের দেরি–এ জন্মে বিশেষ কিছু হবে বলে তো মনে হয় না।

একটুক্ষণ চুপ করে থেকে পণ্ডিতজী বললেন, আচ্ছা, তুমি যখন বললে তখন একটু পরীক্ষা করে দেখা যাক্, কি বল?

দেবী ও শঙ্কর দু’জনেই বলে উঠল, হাঁ হাঁ, বাবুজী–দেখাও দেখাও।

পণ্ডিতজী বললেন, আচ্ছা, তবে স্থির হয়ে ব’স।

পণ্ডিতজী স্থির হয়ে বসে চোখ বুজে ডানহাতের অঙ্গুষ্ঠ দিয়ে ডান চোখ, মধ্যমা আর অনামিকা দিয়ে বাঁ-চোখ আর তর্জনী দিয়ে দুই ভ্রূর মাঝখানটা টিপে কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে রইলেন। মুখ তুলতেই দেখলুম, তাঁর চোখ-দুটি লাল আর অস্বাভাবিক রকমের উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। এদিক ওদিক চেয়ে আমাদের বললেন, ওই যে দূরে দুটো পায়রা দেখছ, ওদের প্রতি লক্ষ্য রাখ।

দেখা গেল, দূরে কোনো এক পুরাতন প্রাসাদ না কি–চারদিকে খুব উঁচু পাথরের প্রাচীর–তারই ওপরে দুটো বুনো পায়রা খেলা করছে। একটা চুপ করে বসে আছে, আর একটা তাকে ঘিরে নেচে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ পায়রা-দুটোই চঞ্চল হয়ে উঠল অর্থাৎ মনে হল কে যেন তাদের এই খেলায় বাধা দিলে। যে পায়রাটা পায়ে-পায়ে তালে-তালে ঘুরছিল, সে থেমে গিয়ে চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। যেটা পা মুড়ে বসে ছিল, সে তার ডানা ঝেড়ে উঠে পড়ল। তারপরে দুটোই উড়ে পণ্ডিতজীর বাড়ির হুদ্দোর মধ্যেই একটা বড় গাছের ডালে এসে বসল। একটু এদিক ওদিক করে একটা পায়রা আমরা যে ছাতে বসে ছিলুম সেই ছাতের পাঁচিলের ওপর এসে বসল। পণ্ডিতজীকে দেখলুম–সেই থেকে স্থির ও সতেজ দৃষ্টিতে পায়রাটার দিকে চেয়ে রয়েছেন। কয়েক সেকেন্ড পরেই পায়রাটা ছাতের পাঁচিল থেকে নেমে গুড়গুড় করে হেঁটে একেবারে পণ্ডিতজীর হাতের কাছে এসে উপস্থিত হল। পণ্ডিতজী সেটাকে তুলে কিছুক্ষণ আদর করে নামিয়ে রাখলেন। দু’-এক সেকেন্ড পরে–শিশু যেমন হঠাৎ বিপদ সম্বন্ধে চেতনা লাভ করে বিপদের কারণের কাছ থেকে দূরে পালিয়ে যায়, তেমনি কথা না বললেও পায়রাটা যেন–”ওরে বাবা রে!’ ভাব দেখিয়ে পোঁ-পোঁ করে উড়ে একেবারে আমাদের দৃষ্টির বাইরে চলে গেল।

তার উড়ে যাওয়ার ভঙ্গি দেখে আমরা সবাই হেসে উঠলুম।

আগেই বলেছি–আমরা যাওয়ার পর থেকে পণ্ডিতজীর ছেলে শঙ্কর দু’-একদিনের মধ্যেই আমাদের সঙ্গে অবাধে মেলামেশা করতে শুরু করেছিল। পণ্ডিতজীর মেয়ে দেবী কিন্তু প্রথম থেকেই নিজেকে বেশ দূরে রেখেছিল। ক্রমে দূরত্বের মাত্রা কমে গেলেও নিজের চারদিকে সে একটা কঠিন আবরণ টেনে রেখেছিল–তা মে সুন্দরী মেয়ে বলেই হোক, বড়লোকের মেয়ে বলেই হোক কিংবা বিলিতি ইস্কুলে পড়া বিদ্যার গর্বেই হোক।

আমরা ছিলুম তাদের বাড়ির আশ্রিত ব্যক্তি। কাজেই সেখানে থাকতে খেতে পেয়েই সন্তুষ্ট ছিলুম, পণ্ডিতজী ও তাঁর ছেলে-মেয়েদের সদয় ব্যবহারে ছিলুম কৃতজ্ঞ–এর চেয়ে বেশি কিছু আমাদের কাম্যও ছিল না। দেবীকে তার বাবা ও ছোটভাই শঙ্কর খাতির করে দেবীজী বলে ডাকত। আমরা তাকে বহেনজী বলে ডাকতে আরম্ভ করে দিলুম।

শঙ্কর একদিন বললে, কেন, তোমরাও দেবীজী বলে ডাক না?

দেবী তাতে আপত্তি করে বললে, না না, বহেনজী বলেই ডেকো–বেশ লাগে আমার।

দেবী আমাদের সঙ্গে পারতপক্ষে কথাবার্তাই বলত না। তবে খাবার-টেবিলে সে আমাদের মায়ের মতন তদারক করত–শর্মা-ভাই, তোমাকে আর একখানা রুটি দিক, খাও। কাহ্-ভাই, তুমি কিছু খাচ্ছ না, ইত্যাদি। কিন্তু সে ওই পর্যন্ত। খাবার-টেবিল ছাড়লেই সে একেবারে অন্য লোক হয়ে পড়ত।

কিন্তু দেবীর এই গাম্ভীর্য ও আলাদা-আলাদা ভাব বেশিদিন চলল না। একদিনের একটা সামান্য কারণে আমার সঙ্গে তার এমন ভাব হয়ে গেল যে, মুখের কথা তো দূরের কথা–সে আমাকে তার মনের কথা পর্যন্ত বলতে আরম্ভ করে দিলে।

আগেই বলেছি যে, বিকেলবেলাটা পণ্ডিতজীর বাড়ি অত্যন্ত নির্জন হয়ে পড়ত। পণ্ডিতজী থাকতেন তাঁর ঘরে, সে-সময় তিনি পূজা-অর্চনা করতেন, ভূমিকম্প হলেও বেরুতেন না। সারা দুপুর পড়াশোনা করে শঙ্কর ও দেবী তখন চলে যেত নীচের বাগানে। চাকরেরা যে যার পড়ে ঘুম লাগাত। সেই নিস্তব্ধ বাড়ি হয়ে পড়ত অধিকতর নিস্তব্ধ।

বাগানের এক কোণে কতকগুলো খোলার ঘর ছিল। এইসব ঘরের মধ্যে অনেক জিনিসপত্র থাকত। এরই মধ্যে একখানা বড় ঘরের একটা দিক খালি ছিল। এই খালি জায়গাটাতে দেবী ও শঙ্কর ঠাকুর-ঘর করেছিল। রোজ বিকেলবেলায় তারা ভাই-বোনে এখানে পুজো করতে ঢুকত। একদিন শঙ্কর আমাকে নিয়ে গেল তাদের পুজোর ঘর দেখাতে। ঘরের মধ্যে ছেঁড়া বস্তায় তুলো, পাট, কাঠের কুচি; ঘরময় নোংরা–তারই একটা কোণে দিব্যি পরিষ্কার জায়গায় তারা পুজোর দুটো বেদী তৈরি করেছে দেখলুম। দুটো পাথরের নুড়ি দিয়ে দু’জনের শিব হয়েছে। দিব্যি টাটকা লতা-পাতা দিয়ে শিবের বেদী সাজানো হয়েছে। তার মধ্যে আবার ছোট ছোট দু’টি প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। জায়গাটি সত্যি আমার বড় ভালো লাগল। ফিরিঙ্গি ইস্কুলে পড়ে ফিরিঙ্গিভাবে চালিত ও শিক্ষিত হয়েও যে তারা শিবপুজো করছে–দেখে খুশি হয়ে আরও ডাল-লতা-পাতা এনে আরও ভালো করে তাদের বেদী সাজিয়ে দিলুম।

ঠাকুর—ঘরের প্রশংসা করায় ও আমার শিবভক্তি দেখে দেবী আমার প্রতি খুব প্রসন্ন হয়ে দু’-একটা করে কথা বলতে লাগল। আমার একটা শিবস্তোত্র মুখস্থ ছিল, আমি দেবীর শিবের সামনে বসে হাত জোড় করে চোখ বুজে দিব্যি সুর করে স্তোত্র আওড়াতে শুরু করে দিলুম। স্তোত্রটা শেষ হতে-না-হতে দেবী একেবারে উছলে পড়ল, এ যে স্যানসক্রিট–না শর্মা-ভাই, এ নিশ্চয়ই স্যানসক্রিট! কি আশ্চর্য! শর্মা-ভাই, তুমি স্যানসক্রিট জান?

দেবী একেবারে আমার পাশে বসে একরকম গলা জড়িয়ে ধরে বললে, শর্মা-ভাই, এই মন্ত্রটা আমায় শিখিয়ে দেবে?

–নিশ্চয় দেব।

দেবী বলতে লাগল, ওঃ, হাউ ওয়ান্ডারফুল–তুমি স্যানসক্রিট জান!

ইংরেজি, ভাঙা-হিন্দি ও মারাঠী–এই ত্রিবেণীধারায় প্রশংসা বর্ষিত হতে লাগল আমার ওপর। দেবী বলতে লাগল, আচ্ছা, আর একটু স্যানসক্রিট বল তো!

–শুনবে?–

বিদ্বত্বং চ নৃপত্বং চ’নৈব তুল্যং কদাচন।
স্বদেশে পূজ্যতে রাজা বিদ্বান্ সর্বত্র পূজ্যতে।।

-আরও?

-আচ্ছা।–

উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে।
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্ঠতি স বান্ধবঃ।।

–ওঃ, হাউ ওয়ান্ডারফুল! আমি ফাদারকে বলে তোমায় টিচার রাখব। শর্মা-ভাই, আমাকে স্যানসক্রিট শেখাবে?

–এতে আর কি হয়েছে, তোমায় দু’দিনেই শিখিয়ে দেব।

দেবী বললে, আমার স্কুল খুলতে এখনও মাস-দেড়েক দেরি আছে–এর মধ্যে শিখে নিতে পারব না?

–খুব, খুব। অন্তত আমি যতটুকু জানি ততটুকু শেখাতে ওর চেয়ে বেশিদিন লাগবে না। তাতে তুমি কথাবার্তা চালিয়ে নিতে পারবে।

দেবী বললে, ফাদারকে বলব, এজন্যে তোমায় মাইনে দিতে হবে।

পণ্ডিতজী বেশ ভালো সংস্কৃত জানতেন। আমার জ্ঞানের মাত্রা জানতে পারলে একটা হাস্যকর পরিস্থিতির উদ্ভব হবে বুঝতে পেরে দেবীকে বুঝিয়ে বলুম, বহেনজী, ফাদারকে জানিয়ে আর কাজ নেই। তুমি আমার বহেন হও, তোমায় শিখিয়ে টাকা নিলে আমার পাপ হবে। তোমার কোনো ভাবনা নেই, আমি তোমাকে ঠিক শিখিয়ে দেব।

সেদিন থেকে দেবী আমার অনুগত বন্ধুতে পরিণত হল। আমি তাকে সুর করে মোহমুদ্গর আবৃত্তি করতে শেখাতে লাগলুম। মোহমুদ্গারের মধ্যে কি আছে জানি না। শ্লোকগুলো মুখস্থ হবার পর তার শিবভক্তি যেন বেড়ে গেল। এতদিন সে বিকেলে পুজো করত, এখন থেকে দুবেলায় পুজোর ঘরে যেতে আরম্ভ করে দিলে। সুরাটের আর একটা স্মৃতি আমার মনের মধ্যে বিশেষ করে উজ্জ্বল হয়ে আছে, সে-স্মৃতি কোনো লোকের কথা নয়–একটি জায়গার কথা।

বিকেলবেলা জলখাবারের পর দেবী ও শঙ্কর নীচে নেমে যেত বাগানে–তাদের ঠাকুর ঘরে। ঠাকুর-ঘর ঝাঁট দিয়ে বাসি ফুল-পাতা ফেলে দিয়ে তারা সত্য হোক–মিথ্যা হোক–গভীর ভক্তির সঙ্গে পুজো করত। পুজো শেষ হতে প্রায় সন্ধে হয়ে যেত। এই সময়টা আমি আর সুকান্ত বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়তুম ঘুরে বেড়াবার জন্যে।

দু’-একদিন জনার্দনের ওখানেও গিয়েছিলুম, কিন্তু বুঝতে পারলুম আমরা গেলেই তারা বিব্রত হয়ে পড়ে। মনে করে, এই বুঝি এরা আবার ফিরে এল! শেষকালে আমরা এদিক ওদিক ঘুরে বেড়িয়ে সময়টা কাটিয়ে দিতে লাগলুম।

একদিন এইভাবে নদীর ধারে বেড়াতে বেড়াতে শহর থেকে একটু দূরে একটা জায়গায় এসে পৌঁছানো গেল। সেখানে নদী থেকে খাঁড়ির মতন একটা চওড়া জলধারা জমির মধ্যে এসে প্রবেশ করেছে–নদীর প্রধান প্রবাহ থেকে প্রায় দুশো গজ পর্যন্ত ভেতরদিকে! জায়গাটা দেখেই আমার মনে হল, এ যেন চেনা জায়গা। কোথায় দেখেছি, কবে দেখেছি ইত্যাদি নিয়ে মনের মধ্যে কিছুক্ষণ আন্দোলন চালিয়েও কিছুই মনে করে উঠতে পারলুম না। অথচ সুরাটে আমি এর আগে কখনও আসিনি ও এবার এসেও এখানে কখনও আসিনি।

যাই হোক, জায়গাটা এত নিৰ্জন ও এত আকর্ষণীয় যে, সেখানটা ছেড়ে নড়তে ইচ্ছে হল না। আমি জলের প্রায় কাছাকাছি গিয়ে বসে পড়লুম। সঙ্গে সুকান্তও ছিল, সেও কোনো কথা না বলে একটু দূরে জলের ধারে গিয়ে বসল। সেখানে বসতে-না-বসতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মনের মধ্যে একটা অনুভূত শান্তি এসে জমা হতে লাগল। মনে হতে লাগল যেন মনের মধ্যে গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টিধারার মতন শান্তিবারি বর্ষিত হচ্ছে। সেই অনাস্বাদিতপূর্ব অনুভূতির বর্ণনা আমি কোনো ভাষায় প্রকাশ করব! গৃহ, পরিবার, পরিবেশ, অবস্থা–সবই ভুলে গেলুম। মনে হতে লাগল, সবই সুন্দর–মনোরম –মধুময়।

জলের প্রায় কিনারায় বসেছিলুম। জায়গাটা এত নিরালা যে কিনারায় এসে যে জলের ঢেউ মধ্যে মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে লাগছিল, আমি যেন তার মধ্যেও অস্পষ্ট বাণীর আকুল আকৃতি শুনতে লাগলুম। ছল-ছল কল-কল শব্দ তুলে নদী-মাতা আমায় যেন সম্ভাষণ করতে আরম্ভ করে দিলে।

মনে হতে লাগল, হয়তো কোনো পূর্বজন্মে বালক আমি এই জলের ধারে খেলা করতুম। বহু জন্মজন্মান্তর বাদে সেই পরিচিত বালকটিকে দেখতে পেয়ে নদীমাতা যেন আকুল ভাষায় আমায় স্নেহের সম্ভাষণ জানাচ্ছে। বাল্যকাল থেকেই আমি একটু কল্পনা-বিলাসী–এখানে বসে আমার কল্পনার উৎস যেন খুলে গেল।

দেখলুম, দূরে একজোড়া লম্বা ঠ্যাঙওয়ালা সারস পাখি আস্তে আস্তে চলে-ফিরে বেড়াচ্ছে, ভারি ভালো লাগল তাদের চলন-ফেরন। কিছুক্ষণ পরেই মাথার ওপর দিয়ে একঝাঁক বলাকা গোল হয়ে উড়ে চলে গেল–তারপরে আর একঝাঁক,–আর একঝাঁক,–আর একঝাঁক। হাওয়ার বিপরীত দিকে চলল তারা, অথচ কি দ্রুত ও কি নিশ্চিত তাদের গতি! তাদের পক্ষ-তাড়নায় যে শব্দ উত্থিত হল তাতে সেই নির্জনতাকে যেন আরও গম্ভীর করে তুলল। ক্রমে আমার চারদিক ঘিরে অন্ধকার নেমে আসতে লাগল। সেই স্বচ্ছ অন্ধকারে দেখলুম, দূরে একটি মেয়ে দু’টি কলসি নিয়ে এসে নদীর ধারে দাঁড়াল। তারপরে কলসি ধুয়ে একে একে দু’কলসি জল তুলে নিয়ে নদীর ধারে রাখলে। তারপর একটার ওপর আর-একটা কর্লসি মাথায় তুলে নিয়ে চলে গেল অন্ধকারের গভীরে, যেন কালো বর্ণের পটে তুলি দিয়ে তার চেহারাখানা মুছে দেওয়া হল। সন্ধে হয়ে যাবার অনেক পরে আমরা সে-জায়গাটা ছেড়ে উঠে পড়লুম।

কিছুক্ষণ নীরবে পথ চলার পর সুকান্ত বললে, জায়গাটা এত ভালো লাগছিল যে উঠতে ইচ্ছে করছিল না।

যাই হোক, পরের দিন বিকেল হতে-না-হতে সেই জায়গাটা আবার আমাদের আকর্ষণ করতে লাগল। চা খাবার একটু পরেই আমরা ছুটলুম সেই নদীর ধারে। সেখানে গিয়ে আগের দিন আমি ও সুকান্ত–যে যেখানে বসেছিলুম, সেখানে গিয়ে বসে পড়লুম। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, সেদিন ও বসতে-না-বসতে মনের মধ্যে সেই শান্তির অবতরণ বুঝতে পারলুম। বরঞ্চ কালকের চেয়ে আজকের অবতরণ যেন আরও গভীর, পরিবেশ যেন মধুরতর হয়ে উঠল।

নদীর ধারে সেই বক চরছে। লম্বা-ঠ্যাঙওয়ালা সারস পাখি দুটো সেইরকম সন্তর্পণে পা ফেলে ফেলে চলা-ফেরা করছে। নির্দিষ্ট সময়ে মাথার ওপর দিয়ে সেই বকের পাঁতি শন-শন্ করতে করতে উড়ে গেল–এক সার-দু’-সার–তিন সার। অন্ধকারে আপনাকে লুকিয়ে একটি মেয়ে এল নদীর ধারে–বোধহয় কাল যাকে দেখেছিলুম সে-ই হবে

এমনি করে প্রতিদিন বৈকালে নদী আমাদের আকর্ষণ করে নিয়ে যায় তার তীরে। সকাল থেকে বিকেলে অবধি দেবী ও শঙ্করের সঙ্গে কাটে, তারাই আমাদের ভাই-বোন হয়ে উঠেছে। বোম্বাই গিয়ে মিল-এ কাজ শেখবার কথা একরকম ভুলেই গিয়েছি। দিনের বেলা বাড়ির কথা, কাজকর্মের কথা, জীবনে উন্নতি করার কথা কখন-সখন মনে হয় বটে, কিন্তু সে-চিন্তার তীব্রতা চলে গিয়েছে। তারপর বিকেলবেলা নদীর তীরে গেলে সব চিন্তার ওপরে শান্তির প্রলেপ পড়ে যায়, সমস্ত উদ্বেগ চলে যায়, মনের হয় এমনি করেই জীবন কেটে যাবে।

ঠিক এইরকম শান্তির অভিজ্ঞতা আমার জীবনে আর একবার হয়েছিল, সে-বৃত্তান্তও এই জাতকে লেখা থাকা দরকার। সুরাটের এই সময়ের প্রায় বিশ বৎসর পরে একবার শীতের সময় মাস-তিনেক জয়পুর শহরে বাস করতে হয়েছিল। শহর থেকে অনেক দূরে একটা নির্জন স্থানে ছিল আমার বাড়ি। বাড়ির সামনে-পেছনে আশেপাশে ইঁটের তৈরি কোনো বাড়ি নেই–দূরে মাঝে মাঝে দু’-চারটে খোলার চালের বস্তি, তারপরে আবার সব ফাঁকা। বাড়ির সামনে দিয়ে চওড়া রাস্তা চলে গিয়েছে, কোথায় কোন্ দূরের অন্য এক রাজ্যের রাজধানী পর্যন্ত। আমি শীতকাতুরে লোক, দুপুরবেলা ঘরে থাকতে কষ্ট হত বলে রোদে রোদে ঘুরে বেড়াতুম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই নির্জন পথ বেয়ে চলতে থাকতুম যতক্ষণ পর্যন্ত না রোদের ঝাঁজ কমে যায়। চারিদিকে জনশূন্য–নিস্তব্ধ প্রকৃতি। থেকে থেকে পাগলা হাওয়ায় কখনও-বা খানিকটা ধুলো উড়িয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটে চলল, কখনও-বা চষা মাঠের মাঝখানে খানিকটা ধুলো লাটুর মতন ঘুরতে ঘুরতে ওপরে উঠে ছড়িয়ে পড়ল। কোথাও-বা একপাল হরিণ চরে বেড়াচ্ছে–কোথাও বা ময়ূর। এরই মাঝে মাঝে কোনো ধনী লোকের এক-একটি বাড়ি বা বাগান-বাড়ি আছে, কিন্তু সেও অত্যন্ত নির্জন।

বড় ভালো লাগত আমার এই দুপুরের নিরুদ্দেশ অভিযান।

একদিন দ্বিপ্রহরে এইরকম চলেছি। চলতে চলতে পথশ্রমেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক একজায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিক দেখছিলুম–দেখলুম, রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা সমাধি রয়েছে। রাজপুতানায় মৃত ব্যক্তির স্মরণে মঠের মতো ইট কিংবা পাথরের সমাধি করার রেওয়াজ আছে। এইরকম সব বড় বড় শ্বেতপাথরের সমাধি উদয়পুরেও আছে, কিন্তু উদয়পুরের তুলনায় জয়পুরের সমাধি-মঠগুলি কিছুই নয়। এই সমাধির মধ্যে কোথাও একজোড়া পায়ের চিহ্ন দেখেছি, কোথাও তাও নেই। যাই হোক, যে সমাধিটার কথা বলছি সেটার অবস্থা খারাপ, অযত্নে ছাত প্রায় ভেঙে পড়েছে। সমাধির চারদিকে অনেকখানি জায়গা ঘিরে একসময় কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু তারের চিহ্নও এখন নেই–মাঝে মাঝে এক-একটা খুঁটি দাঁড়িয়ে রয়েছে মাত্র।

সমাধিটা দেখা মাত্রই আমি নিজের মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা আকর্ষণ অনুভব করলুম। মনে হতে লাগল যার স্মৃতিকে স্থায়ী করার জন্য ওই সমাধি তৈরি হয়েছিল সে যেন আজও ওই ভগ্নস্তূপের মধ্যে বন্দী হয়ে আছে, আমি পদার্পণ করলেই ওই ভগ্নমন্দির ধূলিসাৎ হয়ে যাবে, আর যে বন্দী হয়ে আছে সেও মুক্তি-লাভ করবে।

আমি ধীরে ধীরে ইট-পাটকেল সামলে সেই সমাধির ওপরে গিয়ে বসতেই কোথা থেকে এক শান্তির নির্ঝর যেন আমার ওপর বর্ষিত হতে লাগল। মনে হল, মধু বাতা ঋতায়তে, মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ–বাতাসে মধু–মধু নদীর জলে। ভূত-ভবিষ্যতের চিন্তা কোথায় মুহূর্তে অন্তর্হিত হয়ে গেল।

প্রায় সন্ধ্যা অবধি সেখানে বসে থেকে আমি উঠে এলুম। পরদিন দ্বিপ্রহরে আবার গিয়ে সেখানে বসলুম।

বসার কিছু পরেই আবার সেই শান্তির নির্ঝর ঝরতে লাগল। সেই থেকে আমি প্রায় দু’মাস সেখানে ছিলুম এবং কাজকর্ম না থাকলে প্রতিদিনই দুপুরবেলা সেখানে গিয়ে বসতুম। বোধহয় দু’-তিনদিন ছাড়া প্রতিবারেই আমি সেই শান্তি অনুভব করেছি। আমার এই অভিজ্ঞতার কথা সে-সময় আমি আমার বন্ধু কবি নরেন্দ্র দেবকে লিখেছিলুম। আমার সেই চিঠির উত্তরে নরেন আমাকে সুন্দর একটি চিঠি লিখেছিল। নরেনের চিঠিখানা এইখানে দিতে পারলে এই জাতক অলঙ্কৃত হত সন্দেহ নেই; কিন্তু যে লক্ষ্মীছাড়া কোনো সঞ্চয়ই জীবনে করতে পারেনি, চিঠিপত্র জমা করা তার দ্বারা আর কি করে সম্ভব হবে?

আগেই বলেছি দেবীর সঙ্গে আমার খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। একদিন দুপুরবেলা খাওয়া-দাওয়ার আগে আমরা গল্প করছি, এমন সময়ে আমাকে ও সুকান্তকে দেবী বললে, ভাইয়া তোমরা আমাদের বাড়িতেই থাক। তোমাদের দু’জনকেই আমার খুব ভালো লাগে। কলকাতা বা বোম্বাই গিয়ে কি আর হবে ফাদারকে বলি, তিনি তোমাদের এখানেই এক-একটা কাজে লাগিয়ে দেবেন।

দেবীকে বললুম, তুমি তো দু’দিন বাদেই ইস্কুলে চলে যাবে।

সে বললে, তাতে কি হয়েছে! ইস্কুল খুললেই তো আমার পরীক্ষা। পাস যদি করতে পারি তো ইস্কুলে আর পড়ব না। বাড়িতে পড়ে বোম্বে ইউনিভার্সিটিতে পরীক্ষা দেব। তাছাড়া আমি আর ক’দিন আছি!

–কদিন আছ মানে!

দেবীর মুখখানা আমার প্রশ্নে মলিন হয়ে গেল। সে বললে, জান ভাই, আমি বেশিদিন বাঁচব না। কুড়ি বছরের বেশি আমার পরমায়ু নেই। এখনি আমার সতের বছর চলছে–আর বড়-জোর তিন বছর। বাবা বলেছেন, এর মধ্যে যে-কোনো সময়ে মরে যেতে পারি।

দেবীর উল্লাসে পরিপূর্ণ, স্বাস্থ্যে নিটোল সেই উজ্জ্বল মুখখানা দেখতে দেখতে মলিন হয়ে গেল। একটু চুপ করে থেকে সে বললে, জান ভাই, বাবা যা বলেন তা কখনও মিথ্যা হয় না!

দেবীর কথাগুলি শুনে বুকের মধ্যে হা-হা করে উঠল। মনে হল, এমন ফুল অকালে শুকিয়ে যাবে! তাই বুঝি নিয়তি তাকে সংহারের দেবতা মহেশ্বরের পায়ের কাছে টেনে নিয়ে গিয়েছে–তাই বুঝি সে শিবপূজায় অনুরাগিণী, নিত্য শিবপূজা করে। মনে হতে লাগল, মৃত্যুর কৃষ্ণযবনিকার ওপরে এই যে ফুল ফুটে উঠছে কি এর উদ্দেশ্য? কেন এই অকারণ আবরণ রূপ–সৃষ্টি, যদি অরূপেই তা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়? কেন এই তারুণ্যের উন্মুখ পিপাসা, যদি মৃত্যুর মরুবালুকাই থাকে পথের শেষে? মানুষের মনের কোন্ আর্তবিদ্রোহ সংহারের দেবতাকে নটরাজরূপে কল্পনা করল–কঠিন ধাতবে গেঁথে দিল তার কোমল আশা? এইসব ভাবধারার অতল গহনে ডুবে গেছি, এমন সময় দেবীর কণ্ঠস্বরে আবার চেতনার স্রোতে ভেসে উঠলুম।

দেবী বলতে লাগল, মরতে আমার একটুও ইচ্ছে নেই। বল ভাইয়া, কে মরতে চায়! তবু মনকে আমি শক্ত করবার চেষ্টা করি। বাবা আমাকে মন ঠিক করবার মন্ত্র দিয়েছেন–সব সময় সেই মন্ত্ৰ জপ করি। সত্যি ভাইয়া, মন্ত্র জপ করতে করতে মরবার ভয় আমার একটুও নেই। কিন্তু তবু, মরতে আমি চাই না, মরবার ইচ্ছেও আমার নেই। হায়! তবু আমায় মরতে হবে।

দেবীর কথা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল এসে গেল। ফিরে দেখলুম, সুকান্তের চোখ উপচে জল পড়ছে-শঙ্কর-ভাই নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। দেবী তাকে জড়িয়েধরে আদর করতে শুরু করে দিলে।

এই বেদনার মধ্যে আমাদের বন্ধন দৃঢ়তর হয়ে উঠলেও আমাদের চারিদিকে ঘিরে মরণের করুণ সুর বাজতে লাগল। সেইদিনই দুপুরে খাবার সময় পণ্ডিতজীকে বললুম, বহেনজী বলছিল যে, কুড়ি বছরের বেশি ওর পরমায়ু নেই, এর মধ্যে যে-কোনোদিন তার মৃত্যু হতে পারে–এ কি সত্যি কথা!

আমার কথা শুনে পণ্ডিতজী তাঁর স্বভাবসুলভ উচ্চহাসি হেসে উঠলেন। হাসি থামলে বললেন, দেবী বলছিল নাকি? হ্যাঁ হ্যাঁ ওর আয়ু বড় কম। তা আমি তো ওকে মন্ত্র দিয়েছি–

কথাটা বলতে-বলতেই পণ্ডিতজী আবার সেইরকম হেসে খাওয়ার দিকে মন দিলেন।

সত্যিকথা বলতে কি, পণ্ডিতজীকে আমরা এত শ্রদ্ধা করতুম ও এমন ভালবাসতুম যে বলবার নয়। তবুও একমাত্র কন্যাসন্তানের মৃত্যুর কথা এমন অবহেলা ও হাসির সঙ্গে উড়িয়ে দেওয়াটা বড় নিষ্ঠুর বলে মনে হতে লাগল।

সন্তানের শুভাশুভ সম্বন্ধে এর চেয়েও বেশি ঔদাসীন্য তাঁর মধ্যে আর একদিন দেখেছিলুম। তখন অবশ্য বুঝতে পারিনি যে, বিশ্বনিয়ন্তার ওপর কতখানি নির্ভরশীল হলে এবং কতখানি আত্মসমর্পণ করতে পারলে মানুষ এতটা উদাসীন হতে পারে। সেই কাহিনি বর্ণনা করেই এবারের পর্ব শেষ করি।

একদিন বিকেলে চায়ের পর্ব শেষ হয়ে যাবার পর তখনও কট্‌কটে রোদ্দুর আছে দেখে আমরা না বেরিয়ে ঘণ্টাখানেক গড়িয়ে নিচ্ছি। এমন সময় দেবীর খাস ঝি’র তীব্র আর্তনাদ শুনে নিজেদের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দেখি যে, সে পণ্ডিতজীর ঘরের দরজার একটু দূরে দাঁড়িয়ে মারাঠী ভাষায় চিৎকার করে কি-সব বলছে। এই স্ত্রীলোকটি ছিল দেবীর খাস ঝি–হিন্দি কথা একেবারেই বুঝতে পারত না বা বলতেও পারত না। দেখলুম, সে হাত ছুঁড়ে ছুঁড়ে তারস্বরে চিৎকার করে কি বলছে।

আমরা বেরিয়ে আসতেই সে পণ্ডিতজীর ঘরের ভেজানো দরজার দিকে আঙুল দিয়ে কি–দেখাতে লাগল। আমরা তার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না দেখে সে আরও চেঁচিয়ে হাত ছুঁড়ে কি-সব বলতে লাগল। কিন্তু আমরা তখনও কিছু বুঝতে পারছি না দেখে সে একরকম ছুটে গিয়ে পণ্ডিতজীর ঘরের ভেজানো দরজাটা দড়াম করে খুলে ফেলেই হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।

আমরা দেখলুম, পণ্ডিতজী পদ্মাসনে বসে আছেন। শরীরটা সোজা, চক্ষু-মুদ্রিত–দেখলেই বুঝতে পারা যায় যে তিনি সমাধিস্থ। এদিকে সেই স্ত্রীলোকটি একটু চুপ করে থেকেই আবার চেল্লাতে শুরু করলে। কিন্তু পণ্ডিতজী নির্বিকার, নিস্পন্দ। শেষকালে আমরা তাকে চুপ করতে বলে দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে তাকে সরিয়ে নিয়ে এলুম। অনেক জেরা করবার পর কোনোরকমে বোঝা গেল যে, বাগানের দিকে দেবী ও শঙ্করের কি হয়েছে–এক্ষুনি সেখানে যাওয়া দরকার।

কালবিলম্ব না করে বাগানের দিকে ছুটলুম। পেছনে দেবীর ঝি চেঁচাতে চেঁচাতে আমাদের অনুসরণ করতে লাগল। বাগানে গিয়ে দেখি, সেখানে সাংঘাতিক কাণ্ড শুরু হয়েছে। দেবী ও শঙ্করের ঠাকুর-ঘরে লেগেছে আগুন–আগুন চালা অবধি উঠে গেছে। কুণ্ডলী করে ধোঁয়া উঠছে ওপরে, তার মধ্যে মাঝে মাঝে লাল আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে। ঘরের একটা ছোট্ট জানলা খোলা, তার মধ্যে দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরুচ্ছে, ঘরের চওড়া দরজা দিয়ে ভেতরের খানিকটা দেখা যাচ্ছে, কুণ্ডলীকৃত অগ্নিগর্ভ ধোঁয়া মেঝেতে পাক খাচ্ছে–ঘরের মধ্যে দেবী ও শঙ্কর রয়েছে, তাদের কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। একদল চাকর বাইরে দাঁড়িয়ে চেঁচামেচি করছে। ছোঁড়া চাকরটা বাড়ির মধ্যে থেকে দু’হাতে দু’বালতি করে জল এনে চালায় ছুঁড়ে দিচ্ছে। প্রতিবার জল আনতে প্রায় পাঁচ মিনিট করে সময় যাচ্ছে।

চাকরদের বললুম, তোমরা দাঁড়িয়ে কি মজা দেখছ! যাও, ভেতরে ঢুকে ওদের বের করে নিয়ে এস।

আমাদের কথায় কেউ সাড়া দিলে না। কয়েক সেকেন্ড পরে বৃদ্ধ বাবুর্চি বললে, ওর মধ্যে কে যাবে সাহেব, ও নিশ্চিত মৃত্যুর মধ্যে কে যাবে!

আমার মনের মধ্যে তখন আকুলতার ঝড় চলেছে। দেবীর সেই ফুলের মতন মুখখানার ছবি মনের মধ্যে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হতে লাগল, জ্ঞান হওয়া থেকে আরম্ভ করে আজ পর্যন্ত আমি তো বিশ্বের নিন্দিত। পিতা-মাতা আমার জন্যে নিশিদিন চিন্তিত, শঙ্কিত ও মর্মাহত–লোকের কাছে তাঁরা মুখ দেখাতে পারেন না। খারাপ ছেলের দৃষ্টান্ত দিতে হলে আত্মীয়-স্বজনেরা আমার দিকে আঙুল তুলে দেখায়। আমার সঙ্গে মিশতে দেখলে অভিভাবকেরা তাঁদের ছেলেদের শাসন করেন। আজ ভগবান আমাকে একটা সৎকাজ করবার সুযোগ জুটিয়ে দিয়েছেন। যদি মরি তো সংসারের একটা আবর্জনা সরে যাবে।

ফিরে সুকান্তকে বললুম, কি রে সুকান্ত, যাবি নাকি? আয় না–আর দেরি করলে যাওয়া না-যাওয়া সমান–কি রে সুকান্ত–

সুকান্ত কোনো জবাব দিলে না, তবে তার মুখ দেখে মনে হল যে, সে যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত। আর কিছু না বলে, আর কিছু না ভেবে সেই ধোঁয়ার অন্ধকারে ঢুকে পড়া গেল।

ঘরের মধ্যে দৌড়ে ঢুকে খেলুম এক আছাড়। মাটির মেঝে–তার ওপর কয়েক বালতি জল পড়ে খুব পিছল হয়েছে। সামলে দাঁড়ালুম বটে, কিন্তু সেই জমাট-বাঁধা ধোঁয়ার মধ্যে আগুনের হল্কা লুকিয়ে রয়েছে–মাঝে মাঝে ফুঁসে উঠছে।

নিশ্বাস বন্ধ করে পা ঘেঁষটে ও হাত দিয়ে খুঁজতে লাগলুম শঙ্কর ও দেবীকে। কিন্তু কতক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থাকা যায়! নিশ্বাস নিতেই বুকটা যেন জ্বলে গেল। বেশ বুঝতে পারলুম, বুকের মধ্যে খানিকটা গরম ধোঁয়া ঢুকে পড়ল। দেহের সেই নিদারুণ কষ্টকে চেপে পা ঘেঁষটে চলেছি, পায়ে নরম একটা কি লাগতেই বুঝতে পারলুম, দেবী পড়ে আছে। চিৎকার করে ডাকলুম, বহেনজী!

কিন্তু খানিকটা আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই বেরুল না বরঞ্চ সঙ্গে সঙ্গে আর এক হল্কা ধোঁয়া ঢুকল বুকে। সেই অবস্থায় বসে পড়ে দেবীকে তোলবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু আমার সাধ্য কি সেই লাশ ওঠাই! শেষকালে তার হাত-দুটো ধরে টানতেই যেন কিসে আটকে গেল। বুঝতে পারলুম, তার চোদ্দো-হাত শাড়ির আঁচল কিছুতে আটকে পড়ে গিয়ে সে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। জোর করে টেনে তার দেহটাকে দরজার কাছে নিয়ে এলুম–শাড়ির খানিকটা ছিঁড়ে সেখানে আটকেই রইল। কিন্তু শাড়ি দেখবার তখন আর সময় নেই। আর যেটুকু দম অবশিষ্ট ছিল, তারই জোরে দেবীর দেহখানা হিঁচড়ে কিছুদূর টেনে নিয়ে গিয়ে ঘুরে পড়ে গেলুম।

মাটিতে পড়েই বাঁ-হাতে একটা চোট লাগায় চেতনাটা একবার চনমনিয়ে উঠল–তারই মধ্যে ছায়ার মতন চোখে পড়ল, সুকান্ত শঙ্করের দেহখানা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পড়ে গেল। ব্যস্–তার পরে আর কিছু মনে নেই।

জ্ঞান হয়ে দেখলুম, রাত্রি হয়ে গিয়েছে আমাকে তুলে এনে ঘরের মধ্যে শোয়ানো হয়েছে। ঘরে আলো জ্বলছে। অদূরে আর একজন কে শুয়ে রয়েছে। তার শিয়রে একজন বাঁধা পাগড়ি-পরা লোক বসে রয়েছে, পণ্ডিতজী পাশে দাঁড়িয়ে।

হাতখানা বেদনায় কনকন করতে লাগল, বুকের ভেতর একটা জ্বালা। যন্ত্রণার একটু আওয়াজ মুখ দিয়ে বেরুতেই পণ্ডিতজী এসে আমার মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কেমন আছ?

তারপরে পাগড়ি-বাঁধা লোকটিকে ডেকে বললেন, ডাক্তার, এইদিকে, এই যে চেতনা হয়েছে–

ডাক্তার উঠে আমার কাছে আসতেই দেখলুম, অদূরে যে শুয়ে রয়েছে সে সুকান্ত-সুকান্ত তখনও অচৈতন্য।

সেই রাত্রে আমি ও সুকান্ত দু’জনেই খুব অসুস্থ হয়ে পড়লুম। বুকে অসহ্য বেদনা, তার ওপর মুহূর্মুহূ বমি! বুকে সরষের পটি ও মালিশ চলতে লাগল। দিন-তিনেক বাদে তবে পথ্য পেলুম। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, দেবী ও শঙ্কর পরের দিনই বেশ সুস্থ হয়ে উঠল।

আমরা পথ্য পেলুম বটে, কিন্তু ডাক্তার বলে গেলেন, দিন–রাত্রি যেন বিছানায় শুয়ে থাকি। তিনি সকালে ও সন্ধ্যায় এসে আমাদের বুক পেট সব পরীক্ষা করে যেতে লাগলেন। দেবী ও শঙ্কর সর্বদাই আমাদের কাছে থাকতে লাগল। উদ্ধারকর্তারা কাত হলেন, অথচ উদ্ধৃতেরা দিব্যি ঘোরাফেরা করতে লাগলেন। এই নিয়ে আমাদের হাসাহাসি হত।

সন্ধ্যার পর থেকে পণ্ডিতজী আমাদের কাছে এসে বসতেন। সময়টা হাসি-ঠাট্টা আমোদ ও নানারকম কথাবার্তায় আনন্দে আহ্লাদে কাটতে লাগল। প্রায় দিন-পনেরো বিছানায় কাটিয়ে আমরা সুস্থ হয়ে উঠলুম।

ওদিকে দেবী ও শঙ্করের ইস্কুলে ফিরে যাবার দিন এগিয়ে আসতে লাগল। দুই ভাই-বোনের কিছু কাপড়-চোপড় দরকার–কিন্তু সুরাটে কিছুই পাওয়া যায় না। ঠিক হয়েছে হপ্তাখানেকের জন্যে দেবী ও শঙ্করকে নিয়ে পণ্ডিতজী কাপড়-চোপড় কিনতে বোম্বাই যাবেন।

কথাবার্তা চলছে, আলাপ-আলোচনা হচ্ছে–এইরকম একটা সময়ে একদিন দ্বিপ্রহরে খেতে বসে দেখলুম যে, দেবীর বাঁ-চোখের কোণটা লাল হয়ে উঠেছে। জিজ্ঞাসা করলুম, বহেনজী তোমার চোখটা লাল হয়ে উঠেছে যে?

দেবী বললে, হ্যাঁ ভাইয়া, কাল রাত থেকে মাঝে মাঝে চোখটা দপদপ্ করে উঠছে–বোধ হয় ঠান্ডা লেগেছে।

পণ্ডিতজী দেখে বললেন, খেয়ে উঠে চোখটায় গরম জলের সেঁক দিও।

সেদিন রাত্রে নদীর ধার থেকে ফিরে এসে দেখি, দেবীর সমস্ত চোখটাই রাঙা হয়ে উঠেছে–একটু ফুলেছে বলেও যেন মনে হল।

দেবী বললে, দেখ তো ভাইয়া, আমার জ্বর এসেছে কি না?

কপালে হাত দিয়ে দেখলুম, তার বেশ জ্বর হয়েছে।

পণ্ডিতজী দেখে-শুনে ডাক্তার ডাকলেন। ডাক্তারটি ওখানকার শ্রেষ্ঠ ডাক্তার। তিনি এসে দেখে ওষুধ দিয়ে গেলেন। রাতে দেবীর চোখের যন্ত্রণা অসম্ভব রকম বেড়ে গেল, সেই সঙ্গে সঙ্গে জ্বরও।

চিকিৎসা চলতে লাগল। চোখের ফোলাটা কমে গেল বটে, কিন্তু দেবী বলতে লাগল, চোখটার দৃষ্টি কমে আসছে। জ্বর একটু একটু রয়েই গেল। তার ওপরে দ্যাখ দ্যাখ করতে করতে সে রোগা হয়ে যেতে লাগল। ডাক্তারেরা পণ্ডিতজীকে উপদেশ দিলেন বোম্বাইয়ে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে–সেখানে চোখের বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের নামও করে দিলেন।

পরের দিনই পণ্ডিজী ছুটির জন্যে দরখাস্ত করে দেবীকে নিয়ে বোম্বাই চলে গেলেন। শঙ্কর আমাদের কাছে রইল।

বোম্বাই যাবার সময় আমি ও সুকান্ত স্টেশনে গিয়েছিলুম। গাড়ি ছাড়বার একটু আগে পণ্ডিতজী আমাদের দু’জনকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোমরা আমার সন্তানদের বাঁচাবার জন্যে নিজেদের জীবন তুচ্ছ করেছিলে–তোমাদের কি বলে কৃতজ্ঞতা জানাব জানি না। আমার অনুরোধ, তোমরা আরও কিছুদিন এখানে থাক–দেবীরও ইচ্ছে তাই।

কিছুক্ষণ পরে গাড়ি ছেড়ে ছিল। অত্যন্ত ভারী মন নিয়ে স্টেশন থেকে ফিরে এলুম।

প্রায় পনেরো দিন পরে পণ্ডিতজী দেবীকে নিয়ে বোম্বাই থেকে ফিরে এলেন। আমরা স্টেশনে তো তাকে প্রথমে চিনতেই পারিনি। সেই প্রফুল্ল শতদলের মতন নিটোল স্বাস্থ্য তার এই ক’দিনেই যেন ভেঙে পড়েছে। তার সেই মাখন-সিঁদুরে লালচে-সোনা রঙের ওপর কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে! দেখলুম, তার বাঁ-চোখের পর্দাটা ঝুলে পড়েছে। ভালো করে হাঁটতে পারে না–কিরকম ধুঁকতে ধুঁকতে কথা বলে। তার অবস্থা দেখে চোখে জল এসে গেল।

বাড়িতে এনে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমরা তার পাশে গিয়ে বসলুম। এরই মধ্যে থেকে থেকে সে বোম্বাইয়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে লাগল। কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলে সে একবার বললে, ভাইয়া, এই চোখটায় আর কিছুই দেখতে পাই না। জ্বর দিনরাত্রি লেগেই আছে।

পণ্ডিতজীকে কিন্তু দেখলুম সেই সদাপ্রসন্ন অবস্থাতেই আছেন। বাড়িতে এসে স্নান করে তিনি কাজে বেরিয়ে গেলেন। সেদিন দুপুরবেলা খাবার-টেবিলে পণ্ডিতজীকে বললুম, কলকাতায় সন্ডার্স-সাহেব আছেন–চক্ষুচিকিৎসায় তাঁর জোড়া নেই। তাঁকে একবার দেখালে হয় না?

পণ্ডিতজী বললেন, আচ্ছা, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি–কি করা যেতে পারে।

পরের দিন রাত্রিবেলা আমরা যখন দেবীকে ঘিরে বসে গল্প করছি, এমন সময় পণ্ডিতজী এসে ঘোষণা করলেন যে, তিনি ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব, আমাদের ইঞ্জিনীয়ার-সাহেব ও তাঁর আপিসের আরও অনেককে সন্ডার্স-সাহেবের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন। তাঁরা সকলেই বলেছেন যে, চক্ষু চিকিৎসায় তাঁর জোড়া আর কেউ নেই। সকলেই পরামর্শ দিলেন, দেবীকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে সন্ডার্সকে দেখাতে।

পণ্ডিতজী আরও বললেন, তাঁর আপিসের এক বন্ধু কলকাতায় তার করে দিয়েছেন–তাঁদের জন্য একটা বাড়ি ঠিক করতে। বাড়ি ঠিক হয়ে গেলেই কলকাতা যাওয়া হবে।

দেবী সেই ম্লান মুখেও একটু হেসে বললে, যাক, এই ব্যারামের দৌলতে আবার কলকাতা দেখা হয়ে যাবে।

সেদিন রাত্রিবেলা খাওয়া-দাওয়ার পরে নিজেদের ঘরে এসে সুকান্তকে বললুম, আর কি বন্ধু। এবার ডেরা-ডাণ্ডা তোলো–এখানকার দেনা-পাওনা চুকে গেল বলেই তো মনে হচ্ছে। সুকান্ত বললে, ম্যাজিস্ট্রেট-সাহেব যে কুড়িটা টাকা দিয়েছিল, সেটা কার কাছে আছে? সেটা তো আমাদের টাকা।

বললুম, কার কাছে আছে জানি না। তবে পরহস্তগত ধন–সে থাকা না-থাকা সমান। তবুও পণ্ডিতজীকে একবার জিজ্ঞাসা করা যাবে।

কাছে একটা কপর্দকও নেই–এমন অবস্থা এর আগে হয়নি। কিছুক্ষণ সেই চিন্তায় মনটা বিগড়ে রইল, তারপরে ঘুমিয়ে পড়লুম।

পণ্ডিতজী আপিসে ছুটির দরখাস্ত করে দিলেন। এবার দীর্ঘদিনের ছুটি চাই, কারণ দেবী কতকাল ভুগবে এবং তাকে নিয়ে কতকাল ভুগতে হবে তা জানা নেই। ঠিক হল, শঙ্করও সঙ্গে যাবে, দেবীর পরিচর্যার জন্যে সেই মারাঠী পরিচারিকাও যাবে।

দিন দুই রাদে আপিসের সেই বন্ধুর কাছে তার এল যে, তাদের জন্যে বাড়ি ঠিক হয়ে গেছে। হগ-মার্কেটের খুব কাছে ফিরিঙ্গি-পাড়ায় সস্তায় একখানা ফ্ল্যাট ভাড়া পাওয়া গিয়েছে। এদিককার সব বন্দোবস্ত তখন সম্পূর্ণ হয়ে গিয়েছে, শুধু পণ্ডিতজীর ছুটির দরখাস্তের কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। পণ্ডিতজী বললেন, ছুটি না দিলে আমি চাকরিতে জবাব দেব।

দু-তিনদিন কেটে গেল, তবুও পণ্ডিতজীর দরখাস্তের কোনো জবাব এল না দেখে তিনি ঠিক করলেন, অমনিই চলে যাবেন–তারপরে যা হবার তাই হবে–আর বসে থাকা চলে না। সেদিন দুপুরবেলা খাবার-টেবিলে পণ্ডিতজীকে বলেই ফেললুম, আমরা কি তবে বোম্বাই চলে যাব?

পণ্ডিতজী বললেন, এইসব হাঙ্গামায় তোমাদের কথা একদম ভুলেই গেছি। তোমরা কি বোম্বাই যাবে, না, এখানে থাকবে?

–আপনি যা বলেন তাই হবে।

পণ্ডিতজী একটু ভেবে বললেন, দেখ, আমরা কলকাতা থেকে ফিরে আসি, তারপরে তোমাদের কথা চিন্তা করা যাবে। আমি বলি, ততদিন তোমরা এইখানেই থাক। শুধু চাকর-বাকরদের হাতে এতবড় বাড়ি আর এত জিনিসপত্র ফেলে রেখে যাওয়া সমীচীন নয়। কি বল?

বললুম, তাই হবে।

পণ্ডিতজী আশ্বাসের সুরে আবার বললেন, খুব সম্ভব এখানকার চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমাকে বোম্বাই যেতে হবে। তা যদি হয় তো কথাই নেই।

পণ্ডিতজীর কথায় কতকটা নিশ্চিন্ত হলেও, কি জানি কেন, মনে শান্তি পাচ্ছিলুম না। কি জানি, আবার ভাগ্যে কি আছে–এইরকম চিন্তা আমাকে আঁকড়ে রইল।

সেদিন রাত্রে আহারাদির পরে আমরা সবাই দেবীর ঘরে বসে গল্প করছি। কি জানি, কি কথার ওপর সুকান্ত বললে, কাল এতক্ষণ তোমরা ট্রেনে চড়ে চলেছ।

তার উত্তরে দেবী বললে, ভাইয়া, তোমরাও আমাদের সঙ্গে চল না।

আমরা চুপ করে রইলুম। ভাবতে লাগলুম, আবার কলকাতা!!!

দেবী আমার একখানা হাত ধরে অনুনয় করতে লাগল, চল না ভাইয়া, এখানে একলা তোমাদের ভালো লাগবে?

দেবীর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠল দেখে পণ্ডিতজী বললেন, বেশ তো, চল না। কলকাতা তোমাদের দেশ–আমি সেখানকার কিছুই জানি না। তোমাদের মতন আপনার লোক কাছে থাকলে কত সুবিধা হবে, কত ভরসা পাব।

বাপের কথা শুনে দেবী উল্লসিত হয়ে বললে, তাই চল ভাইয়া। কেমন, যাবে তো? দেবীর সে-অনুরোধে ‘না’ করতে পারলুম না। কচি মেয়ের মতন আবদারের সুরে–হ্যাঁ ভাইয়া, হ্যাঁ ভাইয়া–করতে করতে বিছানায় উঠে বসতে লাগল। আমাদের কাছ থেকে প্ৰতিশ্ৰুতি নিয়ে তবে সে শুলো।

পরের দিন সন্ধ্যার সময় সকলে মিলে কলকাতায় রওনা হওয়া গেল। পথে পাছে দেবীর অসুবিধা হয়ে সেজন্যে পণ্ডিতজী একটি পুরো দ্বিতীয় শ্রেণীর কামরা রিজার্ভ করায় আমরা বেশ আরামেই এসে পৌঁছুলুম। স্টেশনে পণ্ডিতজীর জন্যে তাঁর আপিসের বন্ধুর সেই বন্ধু উপস্থিত ছিলেন। তাঁর সঙ্গে তাঁদের নতুন আবাসে গিয়ে বাজার ইত্যাদির ব্যবস্থা করে দিয়ে আমরা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলুম।

বাড়িতে কিরকম সংবর্ধনা হল, সে-কথা এখন থাক্। তবে সেদিন আর দেবীকে দেখতে যাওয়া হল না।

সে-সময় বড়বাজারে বগলার মাড়োয়ারী হাসপাতালে সন্ডার্স-সাহেব সপ্তাহে একদিন না দু’দিন করে আসতেন। শোনা গেল, তিনি চন্দনগরে থাকেন–হ্যাঁসপাতাল ছাড়া বাইরের কোনো লোককে চিকিৎসা করেন না। ইতিমধ্যে মেডিক্যাল কলেজের তদানীন্তন প্রিন্সিপ্যাল লিউঁকিস-সাহেবকে ডেকে দেবীকে দেখানো হল। তাঁর অনুরোধে সন্ডার্স এসে তার চোখ পরীক্ষা করলেন। দুই মহারথী মিলে দেবীর চিকিৎসা শুরু করে দিল–টাকা উড়তে লাগল ঝাঁক-ঝাঁক।

ওষুধের গুণেই হোক বা নতুন আবহাওয়ার গুণেই হোক–দিন-দশেকের মধ্যেই দেবীর স্বাস্থ্যের আশ্চর্য উন্নতি হতে লাগল। যে রুগি পাশ ফিরতে পারত না, এক চক্ষু একেবারে দৃষ্টিহীন, অন্য চক্ষুও প্রায় সেইরকম হয়ে পড়েছিল–সে উঠে হেঁটে বেড়াতে লাগল।

লিউকিস্-সাহেব বললেন, রক্তহীনতা রোগ–কেবল বিশ্রাম ও পথ্যের ওপর রোগীর স্বাস্থ্য নির্ভর করছে।

প্রায় মাস-দুয়েক এখানে কাটিয়ে বেশ সুস্থ হয়ে আলিপুরের চিড়িয়াখানা, শিবপুরের বাগান মন্দির প্রভৃতি দেখে খুশি হয়ে হাসিমুখে একদিন সন্ধ্যাবেলা তারা কলকাতা থেকে সুরাটের দিকে রওনা হল।

সে-সময়ে সুকান্ত কলকাতায় ছিল না। এখানে তার থাকবার জায়গা নেই, কাজেই বাধ্য হয়ে তাকে দেশে ফিরে যেতে হয়েছিল। দেবী ও শঙ্কর দু’জনেই তাদের সঙ্গে আমাকেও যাবার . জন্যে পীড়াপীড়ি আরম্ভ করেছিল, কিন্তু এতদিন বাদে ঘরে ফিরে এসে আবার বেরিয়ে পড়া সে-সময় সম্ভব হল না। তাদের কথা দিলুম, আমি ও সুকান্ত মাসখানেকের মধ্যেই ওখানে গিয়ে জুটব। পণ্ডিতজীও আমার প্রস্তাব অনুমোদন করে বললেন, এ-সময়ে বাড়ি ছেড়ে যাওয়া ঠিক হবে না।

তার পরে একটু চুপ করে থেকে আবার বললেন, আমি তোমাদের জন্যে বোম্বাইতে হোক কিংবা সুরাটেই হোক–একটা কিছু ব্যবস্থা করে চিঠি লিখলে তোমরা রওনা হয়ো।

দুইপক্ষই হাসিমুখে বিদায় নিলুম।

মাস-দুয়েক কেটে গেল। প্রায়দিনই পণ্ডিতজীর কাছ থেকে চিঠি ও ভালো খবর পাবার আশায় বসে থাকি, কিন্তু নিত্যই নিরাশ হই। আমি যে এখানে থাকব না এবং শিগগির বোম্বাইয়ে চাকরি নিয়ে চলে যাব–এ কথা অন্তরঙ্গদের কাছে গোপনে প্রকাশও করে ফেলেছি। কোনো কোনো বন্ধুকে প্রতিশ্রুতিও দিয়ে ফেলেছি যে, বোম্বাই শহরে গিয়ে বসবার পর তাদেরও একটা যা হোক কিছু জুটিয়ে দেব। সুকান্তর সঙ্গেও দস্তরমতন চিঠি-চালাচলি হচ্ছে গোপনে। ঠিক হয়ে আছে পণ্ডিতজীর চিঠি পেলেই তাকে জানাব। সুকান্ত কিছু টাকাকড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছে। এইরকম উদ্বেগ, আশা ও উৎকণ্ঠায় আমাদের দিন কাটছে, এমন সময় প্রায় মাস ছয়েক বাদে আমাদের বহুপ্রত্যাশিত পণ্ডিতজীর চিঠি এসে হাজির হল।

বোম্বাইয়ের তাজমহল হোটেলের কাগজে লেখা চিঠি–

প্রিয় স্থবির ও সুকান্ত,

কলকাতা থেকে এসেই তোমাদের চিঠি দেবার কথা ছিল, কিন্তু কার্যগতিকে তা সম্ভব হয়নি। আপিসের নানা গোলযোগের মধ্যে দিন কাটছিল–ভেবেছিলুম, সেসব মিটে গেলে শান্তিতে বসে তোমাদের চিঠি লিখব–তা আর হয়ে উঠেনি।

ওখান থেকে যখন আসি, তখন দেবীর স্বাস্থ্য সম্বন্ধে ডাক্তারেরা আমায় খুব সাবধান হতে বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু শত সাবধানতা সত্ত্বেও মাসখানেকের মধ্যেই সে অসুস্থ হয়ে পড়ল। প্রায় মাস-দুই কঠিন রোগযন্ত্রণা ভোগ করে সে চলে গিয়েছে।

আর আমার এ-দেশে থাকবার প্রয়োজন নেই। এখানে আমার পূর্বপুরুষদের সঞ্চিত যেসব বিষয়সম্পত্তির মালিক আমি হয়েছিলুম, তা বিক্রি করে শঙ্করকে নিয়ে আমি ফিরে চললুম ফ্রান্সে–ভবিষ্যৎ ঈশ্বরের হাতে।

কাল বেলা একটার সময় আমরা জাহাজে চড়ব। তোমরা দু’জনে আমার সন্তানদের রক্ষা করতে নিজেদের প্রাণ বিপন্ন করেছিলেন–সে-কথা কখনও ভুলব না। সেজন্যে যতদিন বাঁচব ততদিন কৃতজ্ঞতার সঙ্গে তোমাদের স্মরণ করব। ঈশ্বর তোমাদের মঙ্গল করুন!

সেই থেকে পণ্ডিতজী বা শঙ্করদের দেখা পাওয়া তো দূরের কথা, তাদের কোনো খোঁজই পাইনি। কিন্তু দেবী আমাকে ভোলেনি। মাঝে মাঝে স্মৃতির সরণী বেয়ে এসে সে আমাকে চমকে দিয়ে চলে যায়।

।। তৃতীয় পর্ব সমাপ্ত।।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *