ভারতবর্ষ স্বাধীন হবার অনেক অনেক আগেকার কথা বলছি। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে বলতে হয় যে, স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখবার আগেকার কথা–এখন তাদের কি ব্যবস্থা হয়েছে জানি না, সে-সময় জয়পুর রাজ্যে খোদ মহারাজার অধীনে বড় বড় জমিদার থাকতেন। এই জমিদারদের সর্দার বলা হত। তাঁদের নিজ নিজ জমিদারির মধ্যে তাঁরা,একরকম স্বাধীনই ছিলেন এঁদের মধ্যে অনেকের আবার কেল্লাও ছিল এবং সেখানে তাঁদের নিজেদের সৈন্য-সামন্ত থাকত। খোদ মহারাজের সঙ্গে এঁদের কি সম্বন্ধ ছিল তা ঠিক বলতে পারি না, তবে সর্দারেরা নানা শ্রেণীতে বিভক্ত ছিলেন। শুনেছি, প্রথম শ্রেণীর সর্দারেরা বাঁ-পায়ে সোনার মল পরে দরবারে উপস্থিত হতেন এবং মহারাজা নাকি সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের নমস্কার করতেন। এইরকম দ্বিতীয়-তৃতীয় শ্রেণীর সব সর্দার ছিলেন। এই সর্দারেরা–তা তিনি প্রথম শ্রেণীর হোন অথবা তৃতীয় শ্রেণীর হোন–নিজেদের রাজ্যে অর্থাৎ জমিদারির মধ্যে দোর্দণ্ড প্রতাপশালী হতেন। এই সর্দারদের মধ্যে একজন কিশোর-বয়সে এক সন্ন্যাসীর শিষ্য হয়েছিলেন। তিনি সেই বয়সেই রাজ্যসম্পদ ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন। কিছুকাল সাধন-ভজন করবার পর গুরু তাঁকে আবার গৃহে ফিরে পাঠান। গৃহে ফিরে এলেও সেখানে স্থায়িভাবে তিনি কখনও থাকেন না। কখনও দীর্ঘকাল গুরুর আশ্রমে, কখনও বা তীর্থে তীর্থে ঘুরে কাটান। বাড়িতে এলেও সেখানকার ঐশ্বর্য ও সম্ভোগ থেকে তিনি দূরে থাকেন। সেখানে তো বটেই, এমনকি জয়পুর শহরের লোক পর্যন্ত সম্ভ্রমের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ করে থাকে এবং গদিতে না বসলেও এঁকেও সকলে সেখানকার সর্দার বলে মানে। আমি যখনকার কথা বলছি তখন এঁর বয়স ছিল নব্বুইয়ের বেশি। এঁর ঠাকুরদা যখন গদি পেয়েছিলেন অর্থাৎ যখন তাঁর একুশ বছর বয়েস, তখন তিনি এই সাধু-মহারাজের শিষ্য হয়েছিলেন। ওখানে গুজব ছিল যে, এই সাধু-মহারাজও এই সর্দার-পরিবারেরই ছেলে–ছেলেবেলায় সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলেন।
যাই হোক, আমরা শুনলুম যে, সাধু-মহারাজ কয়েকজন শিষ্য নিয়ে প্রায় দেড় মাস হল এইখানে এসে উঠেছেন এবং মাত্র কয়েকদিন সেখানে থাকবেন। এও শোনা গেল যে, সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা করায় কোনো বাধা নেই। শুধু তাই নয়, গুরুদেব আসার উপলক্ষে সর্দারজী তাঁর প্রাসাদে সদাব্রত খুলে দিয়েছেন–গুরুদেব যতদিন আছেন ততদিন যে-কেউ ইচ্ছা করলে .সেখানে থাকতে খেতে পারে–এটা নাকি সাধু-মহারাজার আদেশ।
আমরা শুনলুম, সর্দারজীর রাজধানী জয়পুর শহর থেকে প্রায় বিশ মাইল পথ। স্থির করা গেল হেঁটেই এই দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা যাবে, কারণ উট ভাড়া করে এইসময় অর্থ নষ্ট করা কোনো কাজের কথা নয়। সেই লোকগুলিকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল যে, এখন যাত্রা করলে মাঝ-রাত্রি নাগাদ আমরা সেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারব–রাস্তাও ভালো, পাকা সড়ক, জয়পুর থেকে একেবারে সোজা গিয়েছে সেখানে পর্যন্ত।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বেলা প্রায় আটটা নাগাদ আমরা সাধু-মহারাজের উদ্দেশে রওনা হলুম।
প্রায় পঞ্চাশ বছর আগেকার কথা, জায়গাটার নাম একদম ভুলে গিয়েছি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা শহরের হুদ্দো ছাড়িয়ে গেলুম। ফাল্গুনের মাঝামাঝি সময়, তখনও সে-দেশে গরম পড়েনি, আমরা আরামেই চলতে লাগলুম। ক্রমে লোকালয় পেরিয়ে গেলুম, দু-পাশে শস্যক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পাকা চওড়া রাস্তা চলে গিয়েছে সোজা–এরই মধ্যে কখনও বা রাস্তার ধারে সুন্দর এক-একটা বাড়ি ও বাগান দেখতে পাওয়া যায়। পথ চলতে চলতে কখনও দেখি, রাস্তায় ও মাঠের মধ্যে দলে দলে ময়ূর ঘুরে বেড়াচ্ছে–মেয়ে-ময়ূরগুলো পুরুষ-ময়ূরদের চেয়ে কত বিশ্রী দেখতে! তারই আলোচনায় খানিকক্ষণ কেটে যায়। কখনও বা হরিণের পাল দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যাই। আমাদের চোখে এসব দৃশ্য নতুন।
পথ চওড়া হলেও মাঝে মাঝে ধুলো উড়ে একেবারে দম বন্ধ হবার উপক্রম হয়। কোনো কোনো জায়গায় দু-পাশের শস্যক্ষেত থেকে ফসল কেটে নেওয়া হয়েছে–দমকা হাওয়া সেখানেও ধুলো উড়িয়ে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে কেউ-বা ঘোড়ায় চড়ে সামনের দিক থেকে এসে আমাদের পার হয়ে হয়ে চলে যায়। ঘোড়া ও সওয়ারের সর্বাঙ্গ ধুলায় সাদা হয়ে গিয়েছে–আমরা অবাক হয়ে তাকে দেখি, সেও অবাক হয়ে আমাদের দেখে। কখনও বা দেখতে পাই উটের পিঠে চড়ে কয়েকজন লোক চলেছে–বাংলাদেশের লোক আমরা, উট-দেখা অভ্যেস নেই। বিস্ময়চকিত দৃষ্টিতে আমরা সেই দৃশ্য দেখতে থাকি–লম্বা লম্বা পা ফেলে বিচিত্র ভঙ্গিতে চলতে চলতে উট আমাদের দৃষ্টির সীমা পার হয়ে চলে যায়। কখনও বা সেই নির্জন রাস্তায় চিৎকারের দমকা ঝড় তুলে একদল পুরুষ ও স্ত্রীলোক কলরব করতে করতে চলে যায়–গ্রাম্যলোক তারা, আস্তে কথা বলতে জানে না–তাদের জিজ্ঞাসা করি, আমরা ঠিক পথে চলেছি কি না। কখনও বা ক্লান্ত ধূলি-ধূসরিত দেহ নিয়ে কোনো পথিক আসে অপর দিক থেকে, তাকে জিজ্ঞাসা করি–সে ঝাড়শাহী ভাষায় কি উত্তর দেয় আমরা বুঝতে পারি না। সেও আমাদের শহুরে হিন্দি বুঝতে পারে না, কয়েক মুহূর্তে অবাক হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে আবার নিজের পথ ধরে।
চলতে চলতে একজায়গায় পথের ধারে কয়েকটা ধূলিমাখা খোলার ঘর দেখে দাঁড়িয়ে গেলুম। অনেকক্ষণ ধরে জল-তেষ্টা পেয়েছিল, কিন্তু তৃষ্ণানিবারণের কিছুই পাইনি। মাঝে মাঝে পথের ধারে বড় বড় ইঁদারা দেখেছি বটে, কিন্তু ইঁদারা দেখলে তো তৃষ্ণা-নিবারণ হয় না। এইখানে জল পাওয়া যেতে পারে মনে করে সেদিকে এগিয়ে গিয়ে খোঁজাখুঁজি করে একটা চানা-ভাজার দোকানে গিয়ে বললুম, আমরা বড় তৃষ্ণার্ত, একটু জল খাওয়াতে পার।
কথা শুনে লোকটা কথা না বলে ইতস্তত করতে লাগল। দোকানদারের মনস্তত্ত্ব সর্বদেশেই প্রায় সমান। তার হালচাল দেখে বললুম, তোমার দোকান থেকে ভুজা খেয়ে আবার জল খেতে যাব কোথায়?
দোকানদার এবার সোজা জিজ্ঞাসা করলে, কত ভুজা চাই?
দু-পয়সার চালভাজা ও একপয়সার ছোলাভাজা কিনে দোকানে বসেই আমরা চিৰোতে আরম্ভ করে দিলুম। হিসাব করে দেখা গেল যে, সেই রাশীকৃত চাল-ছোলা-ভাজা গলাধঃকরণ করতে দিব। অবসান হয়ে যাবে। অতএব বুদ্ধিমানের মতন সেগুলি কাপড়ের খুঁটে বেঁধে ভরপেট জল পান করে সেখান থেকে রওনা হলুম। এবার কিন্তু কিছুক্ষণ চলতে-না-চলতে পেটে জল পড়ার জন্যেই হোক অথবা অন্য কোনো কারণেই হোক, শ্রান্তিতে শরীর ভারী হয়ে আসতে লাগল। শেষকালে বেগতিক দেখে পথের ধারে এক বিরাট গাছের তলায় গিয়ে আশ্রয় নিলুম। আমি ও জনার্দন আর বৃথা কালবিলম্ব না করে সেইখানেই গা ঢেলে দিলুম— কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতেই ঘুম। সুকান্ত যখন আমাদের ঠেলে তুলে দিলে তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে। তখনও হা-হা করে হাওয়া বইছে বটে, কিন্তু দুপুরের হাওয়ার চাইতে তা অনেক ঠান্ডা। ভাগ্যে আমরা বুদ্ধি করে গায়ের কাপড় নিয়ে এসেছিলুম!
উঠে আবার যাত্রা শুরু করা গেল। একদল লোক সামনের দিক থেকে আসছিল, তাদের জিজ্ঞাসা করে জানতে পারা গেল যে, আমরা প্রায় মাইল-দশেক এসেছি। আমাদের লক্ষ্যস্থল আর কত দূরে জিজ্ঞাসা করায় তারা বললে, আরও তিন-চার ঘণ্টার পথ। যদি পা চালিয়ে চলতে পারি তো সন্ধে-রাত্রির মধ্যে সেখানে পৌঁছতে পারব।
তারা আরও একটি সংবাদ দিলে, যা শুনে প্রাণ জুড়িয়ে গেল। তারা বললে যে, আজকাল প্রথম রাত্রে এদিকটায় বাঘের উপদ্রব বেড়েছে। সন্ধে হবার ঘণ্টাদুয়েকের মধ্যে ঠিকানায় যদি না পৌঁছতে পার তা হলে কোনো জায়গায় আশ্রয় নিও।
আমার জিজ্ঞাসা করলুম, দু-পাশে এইতো ধু-ধু করছে মরুভূমির মতো মাঠ আর চর জমি –এর মধ্যে বাঘ থাকে কোথায়?
তারা দূরের পাহাড়গুলো দেখিয়ে বললে, ওইখান থেকে সব বাঘ, বন্যবরাহ, হুঁড়ার প্রভৃতি নামে। আর দিন-পনেরো বাদে অর্থাৎ গরম পড়ে গেলে তারা আর জমিতে নামবে না। কিন্তু শীতের এই শেষটায় তাদের অত্যাচার বাড়ে।
তারা আশ্বাস দিয়ে বললে, নির্ভয়ে চলে যাও। একটু পরেই গ্রামের পর গ্রাম দেখতে পাবে। একজনের বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে দিও, কোনো ভয় নেই।
এই কথা শোনার পর ঢিমে-তেতালায় চলা চলে না–একেবারে দৌড়ে-হাঁটা আরম্ভ করে দিলুম। কিন্তু হাজার হলেও শরীর ছিল ক্লান্ত, কতক্ষণ আর সেরকম চলা যায়! কিছুক্ষণ দৌড়েই গতি আমাদের মন্থর হয়ে গেল। দু-একটা খোলার বাড়ি পথের ধারে দেখতে পেলুম বটে, কিন্তু আমরা ঠিক করলুম যে রাত্রির প্রথম প্রহর অতীত না হলে বিশ্রাম নেব না।
চলতে চলতে বেলা পড়ে এল। সমস্ত দিন পথশ্রম। সকালে কিছু খেয়ে বেরিয়েছিলুম–কিছু খাদ্য সঙ্গে নেওয়া উচিত ছিল, কিন্তু পরেশদার সঙ্গে দেখা করার উৎসাহে সে-কথা মনেই হয়নি। পথে যে চাল-ছোলা কিনেছিলুম তা একেবারে অখাদ্য। দিবাবসানের সঙ্গে সঙ্গে জঠরে ক্ষুধার অগ্নি জ্বলতে শুরু হল দাউ দাউ করে। এদিকে চরণও আর চলতে চায় না, এমন অবস্থা। রাত্রির প্রথম প্রহর অতীত না হলে বিশ্রামের চেষ্টা করব না বলে যে-সংকল্প করা গিয়েছিল তা আর রাখা চলল না।
তখনও একেবারে অন্ধকার হয়নি, আমরা একটা গাঁয়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, চওড়া রাস্তা, দু-পাশে নীচু খোলার বাড়ি। গ্রামখানা অস্বাভাবিক রকমের নিস্তব্ধ বলে মনে হতে লাগল। গ্রামে পৌঁছলেই সেখানকার কুকুরগুলো আমাদের অপরিচিত দেখে চেঁচাতে আরম্ভ করে দেয়। এখানটায় কোনো কুকুর না দেখে আশ্চর্য বোধ হল। ছোট ছোট ছেলেকেও রাস্তার ধারে খেলা করতে দেখা যায়–এখানে তাও দেখা গেল না। কোনো ঘরে আলো দেখতে পেলুম না। জনার্দন বললে, এটা নিশ্চয় ভূতের গ্রাম।
যাঁহাতক ভূতের নাম শোনা, অমনি লাগালুম ছুট। যে-চরণ এতক্ষণ চলতে চাইছিল না, ভূতের নামে তার গতি চতুর্গুণ বেড়ে গেল।
কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতে আর একটা গ্রাম এসে গেল। তখন অন্ধকার বেশ গাঢ় হয়ে এসেছে, বটে, তবুও গ্রামখানাকে অপেক্ষাকৃত সজীব বলে বোধ হল। কুকুরও আছে দু-চারটে, কয়েকটি ছোট ছেলেপিলে দেখা গেল। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেলুম, এক বাড়ির দরজায় একজন স্ত্রীলোক মুড়িসুড়ি দিয়ে রাস্তার দিকে মুখ করে উবু হয়ে বসে রয়েছে। তারই একটু দূরে একটা মাটির বড় ডেলার ওপরে একটা প্রদীপ বসানো রয়েছে। রাতের মতন সেখানে আশ্রয় পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করবার জন্যে আমরা তিনজনেই সেদিকে এগিয়ে গেলুম। দূর থেকে দেখে তাকে খুব বুড়ি বলে মনে হয়েছিল, কিন্তু কাছে গিয়ে সেই অল্প আলোতেও বুঝতে পারা গেল সে বুড়ি নয়–বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হবে। যা হোক জনার্দন তার ঢাকাই হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলে, মাসি, আজকে রাত্রির মতন আমাদের এই তিনজনকে আশ্রয় দেবে?
এতক্ষণ স্ত্রীলোকটি পথের দিকেই চেয়ে ছিল। জনার্দনের আওয়াজ পেয়ে মুখ তুলে কটমট করে আমাদের আপাদমস্তক দেখতে লাগল। জনার্দন আমাদের চেয়ে একটু এগিয়ে ছিল। স্ত্রীলোকটির ওইরকম কটমটে চাউনি দেখে ব্যাপার বিশেষ সুবিধের নয় বুঝে আমি তাকে ডেকে বললুম, জনা, চলে আয়, ব্যাপারটা যেন কিরকম ঠেকছে!
কিন্তু জনার্দন আমার কথা গ্রাহ্য না করে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলতে লাগল, হ্যাঁ মাসি, তোমার বোনপোরা শেষকালে কি বাঘের পেটে যাবে–একটুখানি এইখানে পড়ে থাকব, রাতটা কাবার হলেই চলে যাব।
এবারে স্ত্রীলোকটি ধীরে-সুস্থে সেখান থেকে উঠে বাড়ির ভেতরে চলে গেল। জনা চেঁচিয়ে আমাদের ডেকে বললে, মাসির দয়া হয়েছে–আজ রাত্রিটুকুর জন্যে বোধ হয় আশ্রয় পাওয়া গেল।
জিজ্ঞাসা করলুম, কি বললে, মাসি?
জনার্দন বললে, মুখে কিছু বলেনি, মনে হচ্ছে বালিশ-টালিশ আনতে গেল।
আমরা এইরকম কথাবার্তা বলছি, এমন সময় সেই স্ত্রীলোকটি একটা লম্বা লাঠি হাতে করে তীরবেগে দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে একমুহূর্তের মধ্যে জনার্দনকে ধড়াক ধড়াক করে ঘা-কয়েক জমিয়ে দিলে।
স্ত্রীলোকটি বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাবার পর জনার্দন এক-পা দু-পা করতে-করতে দাওয়ায় উঠে গিয়েছিল। হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে আঘাত পেয়ে সে “ওরে বাবা রে, গেছি রে” বলে একলাফে নীচে পড়েই একেবারে রাস্তায়।
বলা বাহুল্য, আমরা আগেই রাস্তায় এসে পড়েছিলুম। স্ত্রীলোকটি কিন্তু সেইখানেই থামল না। সে লাঠি-হাতে সেইভাবে তাড়া করে অনেক দূর পর্যন্ত আমাদের পেছু পেছু দৌড়িয়ে এল–আমরা একরকম দৌড়ে গ্রামটুকু পেরিয়ে গেলুম। পেছনে কুকুরগুলো চেঁচাতে লাগল।
অন্ধকারের ভেতর দিয়ে চলেছি–সামনে, পেছনে, দক্ষিণে, বামে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। চন্দ্রহীন আকাশে তারা ফুটেছে, কিন্তু আমাদের অনভ্যস্ত চক্ষু তারার আলো দেখতে পায় না। পেছনে-ফেলে-আসা গ্রামপ্রান্তে গৃহস্থঘরের ক্ষীণ দীপরশ্মি কখন মিলিয়ে গিয়েছে–আশ্চর্য সে অন্ধকার- রূপ! সে যেমন নিবিড় তেমনই নিস্তব্ধ ও ভয়াবহ–গভীর, অনন্ত অন্ধকারের মধ্য দিয়ে চলেছি। সেই সুগভীর স্তব্ধতার মধ্যে আমাদের সমস্ত প্রগল্ভতা একেবারে চুপসে গিয়েছে–মাঝে মাঝে বুকের ধকধকানি পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছি। এই অন্ধকারে নিঃশব্দ পদসঞ্চারে হয়তো বাঘ আসছে আমাদের অনুসরণ করে–হয়তো বা অন্য কোনো সাংঘাতিক জানোয়ার কিংবা কোনো সরীসৃপ! প্রাকৃতিক নিয়মে সে আমাদের দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু আমরা অন্ধ। ভয়ে আমরা হাত ধরাধরি করে চলেছি। আমি মাঝখানে, একপাশে সুকান্ত, অন্যপাশে জনার্দন। মাঝখানে থাকায় মনে করছি, অন্যদের চাইতে আমি অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। অন্ধকারে যতদূর সম্ভব সোজা চলতে চেষ্টা করছি, কিন্তু তবুও মাঝে মাঝে পথের ধারের গাছের ওপর গিয়ে পড়ি-চলেছি তো চলেছি, পলকে প্রলয় মনে হচ্ছে। অনেকক্ষণ এইভাবে চলবার পর দূরে ক্ষীণ আলো দেখা গেল। বুঝলুম কোনো গ্রামপ্রান্তে এসে পড়েছি।
আরও কিছুক্ষণ চলে আমরা আর-একটা গ্রামে এসে পড়লুম। দু-ধারে বাড়ি কিন্তু অধিকাংশ বাড়ির দরজা বন্ধ। আশ্রয়ের জন্যে কোথায় বলা যায় তাই ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চলেছি, এমন সময় দেখতে পেলুম এক বাড়ির দাওয়ার ওপরে চাটাই পেতে একজন লোক একখানা ছোট জলচৌকির ওপর একখানা বই রেখে সুর করে কি পড়ছে। বইখানা আকৃতি দেখেই মনে হল তুলসীদাসী রামায়ণ–এগিয়ে গিয়ে অতি বিনীতভাবে লোকটিকে নমস্কার করে বলা গেল, বাবা, আমরা অমুক স্থানে যাচ্ছি সন্ন্যাসীদর্শনে, কিন্তু রাত্রি হয়ে গিয়েছে, তার ওপর সারাদিন পথ চলে অত্যন্ত শ্রান্ত হয়েছি। আজ রাত্রিটুকু যদি আপনার এই দাওয়ায় আশ্রয় দেন তবে প্রাণ বাঁচে।
লোকটি আমাদের কথা শুনে বললে, উঠে এসে বস।
আমরা উঠে দাওয়ায় বসার পর সে বললে, সন্ন্যাসীর কথা তোমরা কোথায় শুনলে?
–জয়পুরে। তা ছাড়া সন্ন্যাসীর এক চেলা আমাদের ভাই হয়।
লোকটি জিজ্ঞাসা করলে, তোমাদের বাড়ি কোথায়?
-বাংলাদেশ।
লোকটি আর কোনো কথা না বলে ফট্ করে উঠে বাড়ির মধ্যে চলে গেল। কোনো কথা না বলে ওইরকম হঠাৎ বাড়ির মধ্যে ঢুকে যাওয়ায় আমরা একটু ভড়কে গেলুম। জনার্দন বললে, কি বাবা, মেসো আবার কি আনতে গেল!
সরে পড়ব কি না ভাবছি, এমন সময় লোকটি অন্য একজন বয়স্ক লোক সঙ্গে নিয়ে এল। এই লোকটি এসেই বেশ হাসিমুখে পরিষ্কার বাংলাভাষায় বললে, আপনারা বাংলাদেশ থেকে আসছেন বুঝি?
আমরা তো একেবারে অবাক! রাজপুতানার এই গ্রামের মধ্যে বাংলা কথা! বললুম, হ্যাঁ। লোকটি অন্যজনকে আমাদের বসবার জায়গা করে দিতে বললে। আমরা বসলে পর জিজ্ঞাসা করলে, আপনারা সাধুদর্শন করতে চলেছেন?
বললুম, হ্যাঁ, সাধুদর্শন করতে যাচ্ছি। পথে কয়েকজন লোক বললে–এইসময়ে এই দিকটায় বড় বাঘের উৎপাত হয়। সেজন্য রাত্রির মতন যদি আমাদের একটু আশ্রয় দেন, আমরা কাল ভোরে উঠেই চলে যাব।
লোকটি বললে, বেশ বেশ, তার জন্যে আর কি! আপনাদের যতদিন ইচ্ছা থাকুন–এ আপনাদেরই বাড়ি।
লোকটির কথাবার্তা অতি ভদ্র ও মিষ্টি। তিনি আমাদের বাড়ির মধ্যে নিয়ে গেলেন। বাড়ির অবস্থা দেখে মনে মনে হল, তাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন লোক। একটা ছোট ঘরের মধ্যে গিয়ে আমরা বসলুম, দু-তিনটি ছোট ছেলেপিলেও দেখলুম। লোকটির সঙ্গে আলাপ হল–কলকাতার কোনো ব্যাঙ্কে দেউড়িরক্ষকের কাজ করেন। তিন ভাই একজায়গায় কাজ করেন। দুজন কর্মস্থানে থাকেন
আর একজন করে দেশে আসেন। দেশে একজন না থাকলে চলে না, কারণ এখানে ক্ষেতখামার বিরাট, তা ছাড়া টাকা খাটাবার কারবারও খুব ফলাও আছে। জয়পুরে গদি আছে, এক ভাইপো সেখানে থাকে। কলকাতাতেও টাকা ধার দেওয়ার কারবার আছে। নিজেদের আপিসের বাঙালি বাবুরাই টাকা নেন, এতে টাকা মারা যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই। এঁদের বাবা এই কাজে ঢুকে আস্তে আস্তে তিন ছেলেকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন। ছেলেবেলা থেকে বাঙালিদের সঙ্গে মেলামেশা করতে করতে তাঁরা বাংলাভাষা বলতে, লিখতে ও পড়তে শিখে গেছেন। ইংরিজি একটু-একটু জানেন, তবে ভাইপোরা ইংরিজি শিখছে, ইত্যাদি-
জিজ্ঞাসা করলুম, আপনারা কি ব্রাহ্মণ?
ভদ্রলোক বললেন, ঠিক ব্রাহ্মণ নই, তবে আমাদের পৈতে আছে। আমরা আসলে হচ্ছি রাজপুত। আমাদের আদি বাড়ি ছিল যোধপুর-মাড়ওয়ারে–পূর্বপুরুষেরা এখানে এসে বাস করেছিলেন। ব্রাহ্মণের কাজও আমরা করে থাকি, গ্রামের অনেক পরিবারই আমাদের যজমান।
আমরা জিজ্ঞাসা করলুম, অমুক জায়গায় যে একজন সাধু এসেছেন শোনেননি?
তিনি বললেন, শুনেছি বইকি। আজ একমাস হল এই রাস্তা দিয়ে মেলার মতন লোক চলেছে সাধুদর্শন করতে–এই চার-পাঁচদিন লোক-চলা কমেছে, তা না হলে দিনে রাতে সমানে লোক যাচ্ছিল সাধু দেখতে।
লোকটি আমাদের নাম জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁর নাম বললেন, রণবীর সিং।
একটু পরে তিনি একজন লোক দিয়ে আমাদের কুয়োতলায় পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে গিয়ে বেশ করে হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে এসে আমরা চৌকিতে লম্বা হয়ে পড়লুম। ঘরের মধ্যে অন্য কোনো আসবাব নেই, প্রায় ঘরজোড়া চৌকি ছাড়া। মাত্র একটা ময়লা তাকিয়া একদিকে পড়ে ছিল, সেইটেই কোনোরকমে তিনজনে মাথায় ঠেকিয়ে শোয়া গেল। ঘুমোবার চেষ্টা করতে হল না, শরীর তৈরিই ছিল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছিলুম জানি না, রণবীর সিং আমাদের ডেকে তুলে বললেন, চলুন বাবু, গরিবদের বাড়িতে কিছু আহার করবেন।
সত্যি কথা বলতে কি, আমরা এতটা আশা করিনি, আশ্রয় পেয়েই বর্তে গিয়েছিলুম। খাবার জায়গায় যাওয়া গেল। একটা দাওয়ার মতন জায়গায় আমাদের আসন করা হয়েছে, আসনের সামনে শালপাতার মতো বড় বড় পাতা–আমরা বসতেই একটি বৃদ্ধা এসে পরিবেশন আরম্ভ করলেন। গরম রুটি, তাতে ঘি মাখানো আর অড়রের ডাল, একটা কিসের তরকারি আর দু-তিন রকমের আচার। সিংজী বলতে লাগলেন, আপনারা যা খান তা আমরা কোথায় পাব, তবু ভাবলুম অতিথি না খেয়ে থাকবেন–তাই এই কষ্ট দেওয়া।
আমরা বললুম, বিদেশে রাস্তায় কোথায় বাঘের মুখে যাচ্ছিলুম, আপনি আশ্রয় দেওয়ায় প্রাণে বেঁচে গেলুম। সারাদিন অনাহারের পর এই খাদ্য আমাদের অমৃতের মতন লাগছে, ঈশ্বর
আপনার মঙ্গল করবেন।
ভদ্রলোক বললেন, এই যে-খাবার আপনাদের দেওয়া হয়েছে এর সবই আমাদের ঘরের তৈরি–গম, ডাল, ঘি–সব।
আহারের পর কিছু দুধও খেতে দিলেন তাঁরা। খাবার পর রণবীর আমাদের ঘরে এসে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে যাবার সময় বললেন, কাল খুব ভোরে তুলে দেব আপনাদের, সকালবেলাতেই সেখানে গিয়ে পৌঁছতে পারবেন।
পরদিন রাত থাকতে রণবীর সিংজী এসে আমাদের তুলে জিজ্ঞাসা করলেন, চা-টা খাওয়ার অভ্যেস আছে?
বললুম পেলে তো বেঁচে যাই।
আমাদের জন্যে চায়ের হুকুম দিয়ে সিংজী বললেন, কলকাতায় থেকে ওইটুকু বদ-অভ্যেস হয়ে গেছে। তারপর এ-কথা সে-কথার পর বললেন, চলুন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই, সাধুদর্শন করে আসি।
–বেশ তো, চলুন না।
সিংজী বললেন, আপনারা সেখানে পুরো একটা দিন-রাত থেকে বিশ্রাম করে ফিরবেন, আমি দর্শন করেই ফিরে আসব। ফেরবার সময় আবার আমাদের এখানে একরাত্রি কাটিয়ে যাবেন।
দু-গেলাস গরম-গরম চা মেরে আমরা বেরিয়ে পড়লুম। আগের দিন রাত্রে বেশ ভালো আহার ও সারারাত্রি নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে শরীর ও মন বেশ ঝরঝরে হওয়ায় আমরা খুব দ্রুত হাঁটতে লাগলুম। রণবীর সিংজী তাঁদের দেশের গল্প করতে থাকায় পথশ্রম অনেক কমে গেল। সূর্যোদয়ের কিছু পরেই আমরা লক্ষ্যস্থলে গিয়ে উপস্থিত হলুম।
আমরা সেখানে পৌঁছেই বুঝতে পারলুম যে, মেলা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। দূর-দূরান্তর থেকে লোক-আসা কমে গিয়েছে, কাছাকাছির লোকেরা, যারা প্রায়ই আসে তারাই আসছে যাচ্ছে। সদাব্রতের ধুমধাম আর নেই, লোকজনের উৎসাহ যেন কমে এসেছে।
জমিদারের প্রকাণ্ড বাড়ি। কত যে ঘোড়া তার আর ঠিক নেই, উটও দেখলুম অনেক রয়েছে, একটা হাতিও বাঁধা রয়েছে। একদিকের উঠোনে অসংখ্য গোলাপায়রা–তখন তাদের খেতে দেওয়া হচ্ছিল। এসব ছাড়িয়ে প্রকাণ্ড বাগান, এই বাগানের একদিকে একখানা ছোট-মতন সুদৃশ্য বাড়ির একতলায় সাধু-মহারাজ থাকেন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখলুম, ধবধবে সাদা চাদর পাতা একটা ছোট গদিতে সাধু-মহারাজ বসে আছেন। সাধুর মাথায় প্রকাণ্ড জটা, এক-মুখ দাড়ি ও গোঁফ সাদা থেকে লাল হয়ে গিয়েছে। তাঁর পাশে গদির নীচেই একটি লোক বসে আছেন, তাঁকে দেখলে মনে হয় সত্তর পার হয়ে গিয়েছে, তাঁরও সাদা ধবধবে দাড়ি-গোঁফ। এই লোকটিকে দূর থেকে দেখলেও বিশিষ্ট লোক বলে মনে হয়, চোখ বুজে স্থির হয়ে সাধুর পাশে বসে আছেন। শুনলুম যে ইনিই সরকার অর্থাৎ রাজা, যাঁর বাড়িতে সাধু-মহারাজ বাস করছেন। ইনি বাল্যকালেই সাধুর শিষ্য হয়ে তাঁর সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন হিমালয় পাহাড়ে। সেখান থেকে দশবছর পরে দেশে ফিরে আসেন। তারপর সারাজীবন ধরে নানা তীর্থে ঘুরে বেড়িয়েছেন, কখনও বা গুরুর কাছে কাটিয়েছেন। বিবাহাদি করেননি, বিষয়-আশয় তাঁর ভাইপোর বংশধরেরা ভোগ করে, বর্তমান রাজা তাঁর ভাইয়ের নাতি হলেও জয়পুরের রাজসরকার এখনও এঁকেই রাজা বলে মানেন। বর্তমান রাজা এঁর প্রতিনিধি মাত্ৰ।
সাধুর সামনে আরও কয়েকজন লোক বসে আছেন। সাধু-মহারাজ মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে দু-একটা কথা-বলছেন। আমরা প্রথমে একেবারে সাধুর কাছে না গিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়ে রইলুম–অনেকক্ষণ সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। সেইখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে সাধু-মহারাজকে যতটুকু দেখতে পেলুম তাতে মনে হল, যে-সাধু এসে পরেশদাকে নিয়ে গিয়েছিল এ যেন সে-সাধু নয়। অবিশ্যি পরেশদার গুরুকে আমরা দূর থেকে কয়েক সেকেন্ড, বড়-জোর এক কি দেড়মিনিট দেখেছিলুম, তাতে মনে হয়েছিল তাঁর যেন এক বিরাট চেহারা। এই সাধুর মূর্তি বড় হলেও ঠিক যেন তাঁর মতন নয়। আমি এদিক-ওদিক দেখতে লাগলুম যদি জ্বর দেখা পাওয়া যায়! কিন্তু তাকে দেখতে পেলুম না। ইতিমধ্যে সাধুর সামনে যারা বসে ছিল তারা একে একে উঠে যেতেই প্রথমে রণবীর সিং, তারপরে আমরা গিয়ে তাঁকে প্রণাম করলুম।
সাধু-মহারাজ আমাদের প্রত্যেকের দিকে চাইতে লাগলেন–হাসি-হাসি মুখ, চোখ-দুটোও যেন হাসতে লাগল। মনে হতে লাগল, যেন কত আপনার লোক তিনি–অনেকদিন বাদে আমাদের দেখা পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন। আমরা দাঁড়িয়ে আছি দেখে ইঙ্গিতে ডেকে আমায় বললেন, আও, বয়ঠো।
আমরা তাঁর সামনেই বসে পড়লুম। সিংজী কিন্তু দাঁড়িয়েই রইলেন। সাধু মহারাজের আশেপাশে আরও কয়েকজন লোক বসে ছিলেন–তাঁদের দেখে মনে হল, হয় তাঁরা সেই বাড়িরই লোক, নয়তো সর্বদাই তাঁর কাছাকাছি থাকেন। এঁদের উদ্দেশ করে সন্ন্যাসী বললেন, এই ছেলেরা খুবই ভক্তিমান, অনেকদূর থেকে সাধুদর্শন করতে এসেছেন।
এই অবধি বলে সন্ন্যাসী পাশে উপবিষ্ট সরকার-বাহাদুরকে ডাক দিলেন, বড়ে! সরকার-বাহাদুর চোখ চাইতে তিনি বললেন, দেখো ঝড়ে, এই ছেলেরা বাংলাদেশ থেকে এসেছে।
সরকার-বাহাদুর হাসিমুখে আমাদের দিকে চাইতে আমরা তাঁকে নমস্কার করলুম। সাধু মহারাজ বললেন, এখানে আসতে পথে কোনো কষ্ট হয়নি?
বললুম, মহারাজ, আপনার আশীর্বাদে আমাদের কোনো কষ্টই হয়নি। ঠান্ডা দিন ছিল, শান্তি বোধ করলেই গাছের ছায়ায় বিশ্রাম করেছি–রাত্রে এই সিংজীর আশ্রয়ে আনন্দে কাটিয়েছি।
সাধু এতক্ষণে মুখ তুলে রণবীর সিংকে দেখে বললেন, ব’সো।
সাধু আমাদের বললেন, আমার একটি ছেলে আছে, যার বাড়ি তোমাদের দেশে। দেখা করবে তার সঙ্গে?
বললুম, নিশ্চয়। কোথায় তিনি?
সাধু বললেন, কে আছ, আনন্দকে ডেকে দাও তো?
দু-তিনজন লোক চেঁচামেচি করতে লাগল, এ আনন্দ-মহারাজ—সদানন্দবাবা–সদানন্দজী–
আশা হতে লাগল, এ আমাদের পরেশদা না হয়ে যায় না। বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ করতে লাগল, মনের মধ্যে কল্পনার ভিড় ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, কিন্তু হায়, বিধির ইচ্ছা ছিল অন্যপ্রকার!
অনেক ডাকাডাকি ও হাঁকাহাঁকির পর সদানন্দজী তো এসে হাজির হলেন, কিন্তু পরেশদার সঙ্গে তাঁর কোনো সাদৃশ্যই নেই।
সদানন্দ-মহারাজকে দেখে মনে হল, তাঁর বয়স চল্লিশের কিছু বেশি। দীর্ঘ দেহ, মাথায় কুণ্ডলী-পাকানো জটা, মুখ দাড়ি-গোঁফ ভরা, তাতে একটু পাক ধরেছে। দেহের বাঁধুনি ব্যায়ামবীরের মতন। তিনি ছুটতে-ছুটতে এসে সাধুর সামনে দাঁড়াতেই অতি মধুর স্বরে তিনি বললেন, বেটা তোমার জন্মভূমি যেখানে, এঁরা সেই দেশের লোক।
আমরা সদানন্দজীকে নমস্কার করতেই তিনি হাত-দুটো জোড়া করে নিজের বুকে ঠেকিয়ে সেইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলেন। সাধু আবার বললেন, আনন্দ, এই ছেলেরা বড় ভক্তিমান। এঁরা দূরান্তর থেকে পদব্রজে সাধুদর্শন করতে এসেছেন। এঁদের ক্লান্তি দূর করবার ব্যবস্থা কর, এঁদের বিশ্রাম ও আহারের যেন কোনো ত্রুটি না হয়।
গুরুর কথা শুনেই সদানন্দ-মহারাজ আমাদের বললেন, চলুন।
কিন্তু তখুনি সেখান থেকে ওঠবার ইচ্ছা আমাদের মোটেই হচ্ছিল না। উঠতে তা-না-না-না করছি দেখে–যেমন করে ছেলে ভোলায় তেমনি মিষ্টিসুরে সাধু-মহারাজ আমাদের বললেন, যাও বেটা, তোমরা ক্লান্ত, এখন বিশ্রাম কর গিয়ে। সন্ধ্যার সময় এখানে.ভজন কীর্তন হবে তখন এসো।
এর পর আর সেখানে বসে থাকা চলে না, উঠতেই হল। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে রণবীর সিংজীও সাধুঁকে প্রণাম করে বেরিয়ে এলেন। বললেন, ভাগ্যে আপনারা আমার বাড়িতে এসেছিলেন, তাই তো মহাপুরুষ-দর্শন হয়ে গেল, এইজন্যেই লোকে সৎসঙ্গের কামনা করে ইত্যাদি।
রণবীর সিং বললেন, আপনারা যদি দু-চারদিনের মধ্যে ফেরেন, তবে আমার ওখান হয়ে যাবেন। আমি শিগগিরিই কলকাতায় ফিরব। তার আগে জয়পুরের গদিতে কিছু কাজ সারতে হবে, আপনাদের সঙ্গেই জয়পুরে ফেরা যাবে।
ফেরবার সময় তাঁর ওখানে একদিন থাকব প্রতিশ্রুতি দিলাম।
রণবীর সিং চলে গেলেন। আমরা সদানন্দজীর সঙ্গে বাগান পেরিয়ে একটা দোতলা বাড়িতে এসে উপস্থিত হলুম। তিনি সঙ্গে করে ওপরে নিয়ে গেলেন। বললেন, এটা রাজাদের পান্থশালা। একটা ঘরে আমাদের নিয়ে গিয়ে বললেন, এই ঘরে আপনারা বিশ্রাম করুন।
ঘরখানা বাড়ির তুলনায় একটু ছোট মনে হলেও অমন চমৎকার ঘর আজও দেখিনি। ঘরের মেঝে থেকে প্রায় এক-মানুষ উঁচু অবধি ফিকে-নীল পংকের কাজ–মনে হয় যেন দেওয়ালে নীল কাঁচ বসিয়ে দেওয়া হয়েছে–তার ওপরের বাকি দেওয়াল ও সিলিংয়ে ফিকে সবুজ-রঙের জমিতে গাঢ় সবুজ-রঙের পদ্মপাতা ও সাদা পদ্মফুল–সমস্তটাই তেলের কাজ। ঘর-জোড়া শতরঞ্চি, তাকে কার্পেট বললেই হয়। একদিকে একটু উঁচু গদির ওপরে সাদা চাদর টান করে পাতা, তার ওপর চার পাঁচটা গোল মোটা গিদ্দে।
সদানন্দজী আমাদের বসতে বলে জিজ্ঞাসা করলেন আপনারা এখুনি আস্নান করবেন, না, আর একটু বিশ্রাম করবেন?
একটু পরে আস্নান করব বলে তাঁকে বললুম, আনন্দী, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে চাই, বিশেষ ব্যস্ত আছেন কি?
সদানন্দজী টপ করে বসে পড়ে বললেন, আমি আপনাদের সেবক।
প্রথমে আমরা তাঁর নিজের কথা জিজ্ঞাসা করলুম। বাংলাদেশে বাড়ি, অথচ বাংলা বলতে পারেন না–কেন প্রশ্ন করায় তিনি বললেন, আমি বাংলাদেশে জন্মেছি মাত্র। খুব ছেলেবেলায় আমাকে নিয়ে আমার মা-বাবা হরিদ্বারে কুম্ভমেলায় গিয়েছিলেন। সেখানে অসুখ হয়ে মৃত্যু হওয়ায় তাঁরা আমার দেহটা নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন। একদিন ‘বড়ে’ নদীতে স্নান করছিলেন এমন সময় আমার মৃতদেহটা তাঁর গায়ে এসে ঠেকল। তিনি জলের ঝাঁপটা দিয়ে-দিয়ে সেটাকে আবার স্রোতের মধ্যে ঠেলে দিলেন বটে, কিন্তু দেহটা আশ্চর্যভাবে ঘুরে আবার তাঁর কাছে ফিরে আসতেই তিনি সেটাকে জল থেকে তুলে একেবারে গুরুর কাছে নিয়ে এসে সব খুলে বললেন। গুরু সেটাকে প্রাণসঞ্চার করে মানুষ করে তুললেন, সেই ছেলে হচ্ছি আমি।
গুরুর কাছে শুনেছি, প্রথম প্রথম আমার মুখ দিয়ে বাংলা বুলি বেরিয়েছিল, তার পরে ক্রমে ক্রমে হিন্দি কথা বলতে আরম্ভ করে দিলুম।
আমরা জিজ্ঞাসা করলুম, ওই যে ‘বড়ে’ বললেন, সেই ‘বড়ে’টি কে?
সদানন্দজী বললেন, ‘বড়ে’ হচ্ছেন এখানকার রাজা অর্থাৎ সরকার। উনি দশ-বারো বছর বয়সে রাজ্য সংসার সব ছেড়ে দিয়ে গুরুর অনুগামী হয়েছিলেন। ‘বড়ে’ মহারাজের পিতামহ, তিনিও এখানকার রাজা ছিলেন–তিনিও আমাদের গুরুর শিষ্য ছিলেন, তবে তিনি ছিলেন গৃহী। ‘বড়ে’ মহারাজ সংসারত্যাগী, উনি নানা তীর্থে ঘুরে বেড়ান, মাঝে মাঝে এখানেও এসে থাকেন। তবে গৃহ-সংসারের সঙ্গে সম্পর্ক তাঁর কোনোকালে ছিলও না, এখনও নেই। বিষয় ও রাজত্বের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক না থাকলেও এখানকার বর্তমান রাজা–যিনি ওঁর ছোট ভাইয়ের নাতি, রাজপরিবারের সকলে ও প্রজারা তাঁকে রাজার মতনই সম্মান করে থাকেন। এ ছাড়া আমাদের গুরুদেবের সঙ্গে এই পরিবারের সম্পর্ক প্রায় দু-শো বছরের। এখানকার রাজপরিবারের প্রায় সমস্ত স্ত্রী-পুরুষই সাধু-মহারাজের শিষ্য ও শিষ্যা।
জিজ্ঞাসা করলুম, আপনি বললেন, এই পরিবারের সঙ্গে আপনার গুরুর সম্বন্ধ প্রায় দু-শো বছরের কিন্তু আপনার গুরুর বয়স হয়েছে কত?
সদানন্দ-মহারাজ সহাস্যে বললেন, তা আড়াইশো বছরের কিছু বেশি হবে। ত্রৈলঙ্গ-স্বামীজী ও আমার গুরু প্রায় একই বয়েসি।
জিজ্ঞাসা করলুম, ‘বড়ে’ মহারাজের কত বয়স হবে?
–ওঁর নব্বুই পার হয়ে গিয়েছে।
জিজ্ঞাসা করলুম, আপনার কত বয়স হবে আনন্দজী? ষাট পেরিয়েছে?
আনন্দজী হো-হো করে হেসে উঠে বললেন, বাবুজী আমার উম্মর আশ্শী পেরিয়ে গিয়েছে। ‘বড়ে’ মহারাজ যখন আমাকে কুড়িয়ে পান তখন আমার আন্দাজ পাঁচবছর বয়স ছিল। এখন ‘বড়ে’র বয়স নিরানব্বই বছর-আমার চেয়ে তিনি এগারো বছরের বড়।
সদানন্দজীর কথা শুনে বিস্ময়ে আমাদের মুখ দিয়ে কিছুক্ষণ আর বাক্যনিঃসরণ হল না।
.
সত্যিই এই সদানন্দ-মহারাজ অদ্ভুত মানুষ ছিলেন–ছিলেন বললে বোধ হয় ভুল হবে কারণ আমার বিশ্বাস তিনি এখনও জীবলোকেই আছেন এবং আমরা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে চলে যাবার অনেক পরেও থাকবেন।
মানুষের মধ্যে যতপ্রকার শ্রেণী আছে–অর্থাৎ জ্ঞানী, অজ্ঞানী, বিদ্বান, বুদ্ধিমান, বিবেচক, অবিবেচক, ধূর্ত, নির্বোধ, সুবোধ, দুর্বোধ–এদের কারুকেই স্রেফ দেখেই বোঝা যায় না যে, কোন শ্রেণীর মানুষ। কিন্তু একটি বিশেষ শ্রেণীর মানুষ আছে, যারা পরশমণির ছোঁয়া পেয়েছে–তাদের দেখলেই চিনতে পারা যায়। অন্তত এই শ্রেণীর যত লোকের সাহচর্যে আমি এসেছি, তাদের দেখেই চিনতে পেরেছি। গৃহত্যাগ করবার বছরখানেক আগে সর্বপ্রথমে এই শ্রেণীর একজনের সান্নিধ্যে আসবার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। যদিও সে কুড়ি-পঁচিশ মিনিটের বেশি হবে না, তবুও সে-মূর্তির প্রতিচ্ছবি আমার মানসপটে এখনও জ্বলজ্বল করছে।
এই মহাপুরুষ রবীন্দ্রনাথের পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ বিভিন্ন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ থেকে ব্রাহ্ম ধর্ম ও সমাজের অনুকূল কয়েকটি শ্লোক সঙ্কলন করে ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নাম দিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলেন। এই বইয়ের কুড়ি-পঁচিশটি সংস্কৃত শ্লোক আমাদের সুর করে পড়তে শেখানো হয়েছিল। শেখাতেন মহর্ষির ভূতপূর্ব সভাপণ্ডিত এবং রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনের প্রথম সংস্কৃত-অধ্যাপক পণ্ডিত শিবধন বিদ্যার্ণব মশায়। ছেলেরা যখন সমবেত কণ্ঠে সুর করে সেইসব শ্লোক আবৃত্তি করতে শিখে গেল তখন অভিভাবকরা স্থির করলেন, তাদের এহেন কেরামতিটা মহর্ষিকে একবার শুনিয়ে আসা চাই।
সে-সময়ে দেবেন্দ্রনাথের বয়স আশী পেরিয়ে গিয়েছিল। অধিকাংশ সময় শুয়েই থাকেন, পরের সাহায্য ব্যতীত ওঠা-চলা করতে পারেন না। কানে একেবারেই শুনতে পান না। তাঁর কর্মচারী ও পার্শ্বচর প্রিয়নাথ শাস্ত্রী মশায় তাঁর ক্যানক্যানে গলায় চিৎকার করে বললে কিছু কিছু শুনতে পান মাত্র। তবুও বালকেরা তাঁর কাছে আসতে চাষ এবং ‘ব্রাহ্মধর্মের’ শ্লোক শোনাতে চায় জেনে তিনি শুনতে রাজি হলেন।
মনে পড়ে একদিন–বোধহয় রবিবার স্নান করে পরিষ্কার ধুতি-জামা পরে আমরা কয়েকটি ছেলে জোড়াসাঁকোতে মহর্ষি-ভবনে গিয়ে উপস্থিত হলুম। ব্যবস্থা আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। সেখানে উপস্থিত হওয়ার কিছু পরে একটা ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে আমাদের তেতলার ছাতের ঘরে নিয়ে যাওয়া হল। ঘরের মধ্যে আমাদের সামনে একটা পর্দা ছিল, সেটাকে সরিয়ে দিতেই দেখলুম একখানা বড় আরাম-কেদারায় বসে আছেন বিরাট এক পুরুষ, নবোদিত সূর্যের মতন। সাদা পা-জামা ও সাদা পাঞ্জাবি পরা –ধবধবে সাদা গায়ের রঙ, মাথার চুল-দাড়ি তুষারশুভ্র–অদ্ভুত সে দৃশ্য! মানুষ যে এরকম দেখতে হতে পারে, তার ধারণা এর আগে আমার ছিল না। শুধু যে আয়তনেই তিনি বিরাট পুরুষ ছিলেন তা নয়। আমরা ঘরে-বাইরে মন্দিরে-মহোৎসবে নিত্য যেসব লোকেরা সংস্পর্শে আসি–দেখলেই বুঝতে দেরি হয় না যে, এ-মানুষ সে-শ্রেণির নয়, তার চেয়ে অনেক বড়।
দেখতে লাগলুম, মহর্ষির সমস্ত শরীরটা স্থির রয়েছে কিন্তু মাথাটা ধীরে ধীরে কাঁপছে। দুই চক্ষু মুদ্রিত–মৃদুমন্দ বাতাসে চুল-দাড়িগুলো একটু একটু নড়ছে আর সর্বাঙ্গে একটা দৈবী দ্যুতি ঝলমল করছে।
আমরা একে একে সকলে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে পায়ের কাছে অর্ধবৃত্তাকার হয়ে বসে শ্লোকগুলি সুর করে আবৃত্তি করলুম। এই সমস্তক্ষণটাই আমি তাঁর মুখের দিকে চেয়ে ছিলুম। মহর্ষির দুই চক্ষু নিমীলিত থাকলেও দেখলুম মাঝে মাঝে তাঁর মুখখানা লাল হয়ে উঠছে আবার সাদা হয়ে যাচ্ছে’। আমরা গান শেষ করতেই তিনি পরিষ্কার কণ্ঠে কিছু বললেন, তারপরে আমরা প্রণাম করে উঠে এলুম।
এর কয়েক মাস পরেই মহর্ষি দেহরক্ষা করেন।
এই সদানন্দ-মহারাজের সঙ্গে মহর্ষির চেহারার অবশ্য তুলনা হয় না। মহর্ষির বর্ণ ছিল তুষার-শুভ্র এবং যৌবনে তিনি নিশ্চয় দেখতে অতি সুন্দর ছিলেন। চেহারার দিক দিয়ে সদানন্দজীকে খুব সুন্দর তো দূরের কথা, সুন্দরই বলা চলে না। অঙ্গে তাঁর কোনো জন্মে বোধ হয় আবরণ পড়েনি। রোদে, জলে, শীতে গায়ের যে রঙ হয়েছে তার কোনো সংজ্ঞা অভিধানে পাওয়া যায় না। মাথায় জটা, মুখ দাড়ি-গোঁফে ভরা–তাও অযত্ন-রক্ষিত। কিন্তু আশীবছর বয়সে কিশোরের মতন লাফালাফি করে তাঁকে চলতে ফিরতে দেখেছি–মনে হয়েছে প্রতি ভঙ্গিতে যেন আনন্দ ছলকে পড়ছে। সদানন্দ নাম তাতে সার্থক হয়েছিল। কথাবার্তার মধ্যে দিয়ে মানুষের মনের আনন্দ বুঝতে পারা যায়। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় বেশি কথা তাঁকে বলতে দেখিনি–সত্যি কথা বলতে কি, প্রথমে তাঁকে গম্ভীর মানুষ বলেই মনে হয়েছিল। কিন্তু তাঁর চোখ মুখ–তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কার্য ও সেবার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে লাগল তাঁর মনের আনন্দ। তাঁর জীবনের ইতিহাস শুনে প্রথমে আমাদের দুঃখ হয়েছিল। মনে হয়েছিল, ঈশ্বর যদি তাঁকে বাঁচিয়েই দিলেন তবে অমন করে সারাজীবন আপনার জন থেকে তাঁকে বিচ্ছিন্ন রাখলেন কেন? কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই মনে হতে লাগল যে, গৃহে থাকলে এই অপূর্ব শক্তির অধিকারী তিনি কিছুতেই হতে পারতেন না। একমাত্র গুরুর কৃপাতেই তিনি আজ সর্ববিষয়ে সত্যিকারের সদানন্দ হয়েছেন।
একটু বিশ্রাম করে চাঙ্গা হতেই সদানন্দ-মহারাজ এসে আমাদের নিয়ে গিয়ে বাগানে এক কুয়ো থেকে স্নান করিয়ে নিয়ে এলেন। আমরা টানা-হেঁচড়া ও নানারকম আপত্তি করা সত্ত্বেও সেই আশীবছরের বৃদ্ধ-যুবক সেই সদানন্দ সন্ন্যাসী ডুলি করে জল তুলে তুলে আমাদের স্নান করালেন। বললেন, আপনারা আমাদের অতিথি। আমার গুরু নিজে বলে দিয়েছেন আপনাদের সেবা করতে–এই অতিথিসেবা থেকে অনুগ্রহ করে আমায় বঞ্চিত করবেন না। আজ থেকে অনেক–অনেক দিন পরে আপনাদের বয়স যখন আমার মতন হবে তখন এই সাধুদর্শনের কথা মনে হলেই আমার কথাও মনে হবে আর সহৃদয়তার সঙ্গে আমাকেও স্মরণ করবেন। সন্ন্যাসীর কথা বৃথা যায় না–আজ এই জাতক লিখতে লিখতে সদানন্দ-মহারাজের কথা মনে হচ্ছে আর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতায় অন্তর লুটিয়ে পড়ছে তাঁর পায়ে, চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হয়ে উঠছে।
স্নান সারা হয়ে গেলে আমরা গেলুম প্রাসাদের অন্য এক মহলে। সেখানে পাতা পেতে খাওয়া হল–পুরি তরকারি, জোঁদা-টক, ঝোলো দই আর শুকনো বোঁদে। সদানন্দজী নিজের হাতে আমাদের পরিবেশন করলেন।
আহার সেরে আমরা নিজেদের ঘরে ফিরে এলুম। সদানন্দজী বললেন আপনারা বিশ্রাম করুন, সন্ধ্যাবেলা যখন ভজন হবে তখন সাধুর কাছে নিয়ে যাব। ইতিমধ্যে যদি আপনাদের ভালো লাগে, তবে এদিক-ওদিক বেড়িয়ে আসতে পারেন।
কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে আমরা রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে জায়গাটাকে ভালো করে দেখে বেড়াতে লাগলুম। রাজপুতানার গ্রাম দেখবার সুযোগ ইতিপূর্বে আর হয়নি। কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক ঘুরে কাছেই একটা বৃক্ষলতাশূন্য ছোট পাহাড় দেখতে পেয়ে সেখানে গিয়ে উঠলুম। এইখানে বসে বসে আমরা ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে মতলব আঁটতে লাগলুম।
বিস্কুটের টিন খালি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনের জোরও নিঃশেষ হয়ে আসছিল। জনার্দন বললে, তার বাড়িতে লিখলে কিছু টাকা তারা পাঠিয়ে দিতে পারে। সেখান থেকে যদি টাকা আসে তো তা দিয়ে ব্যবসা ফাঁদা যেতে পারে। ব্যবসায় যদি আমরা লাভ দেখাতে পারি, তা হলে বাড়ি থেকে আরও টাকা পাওয়া যেতে পারে।
আমি কিন্তু বেশ বুঝতে পারছিলুম যে, টাকার অভাবই আমাদের একমাত্র অভাব নয়। একটা অদৃশ্য শক্তি প্রতি পদেই আমাদের বাধা দিয়ে চলেছিল। আগ্রায় পরেশদার মা যদি আর কিছুদিন বাঁচতেন তা হলে আমাদের একটা গতি নিশ্চয় হয়ে যেত। আমাদের একজনেরও অন্তত কাজকর্ম একটা কিছু জোটবার পর মা যদি মারা যেতেন তা হলেও না-বুঝতুম। কিন্তু তিনি যেন আমাদের জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন, আমরা আসার পরই চলে গেলেন। আগ্রাতেই সত্যদার কল্যাণে অমন মহাজন, জুটল–লোকের কপালে একটা জোটে না, আমাদের জুটল তো ছপ্পর ফুঁড়ে দু-দুটো জুটল; কিন্তু কোথা থেকে শনি এসে প্রবেশ করলেন বাঁদরের রূপ ধরে–সব এমন ফেঁসে গেল যে পালাতে পথ পেলুম না। তার পরে ভরতপুরে ও গোয়ালিয়রে–বেশ বুঝতে পারছিলুম একটা শক্তি আমাদের রক্ষা করবার, পোষণ করবার চেষ্টা করছে, আর একটা শক্তি চেষ্টা করে চলেছে আমাদের ধ্বংস করবার, আমাদের যা-কিছু প্রয়াস তা নষ্ট করবার।
তাই, জনার্দন যখন তার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে এসে ব্যবসা করবার কথা খুব উৎসাহের সঙ্গে বলতে লাগল, তখন আমি বিশেষ উৎসাহিত হতে পারলুম না। আগেই বলেছি যে, জয়পুরে এসে অবধি আমি নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন বুঝতে পারছিলুম। আমি বন্ধুদের কাছে প্রস্তাব করলুম, আচ্ছা কিছু করবার চেষ্টা করা বন্ধ করে দেখলে হয় না?
তারা বললে, সে কি করে সম্ভব হয়! তাই যদি করা হয়, তা হলে বাড়ি থেকে বেরুবার প্রয়োজনই বা কি ছিল!
আমি বললুম, আচ্ছা, এই সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ভিড়ে গেলে কেমন হয়?
জনার্দন বললে, কি সর্বনাশ! সন্ন্যেসী হব কি রে! তার চেয়ে বাড়ি ফিরে গিয়ে দাদার ব্যবসায়ে লেগে যাব।
সুকান্ত বললে, তার এক দাদা আহমেদাবাদে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ আহমেদাবাদের কাপড়ের কলওয়ালারা জনকয়েক বাঙালি ছেলেকে কলের কাজকর্ম শেখাতে রাজি হওয়ায় কয়েকটি বাঙালি ছেলে সেখানে থাকে। মিলওয়ালারা তাদের কাজ শেখবার জন্যে পয়সাকড়ি কিছু নেয় না। দু-তিন বছর কাজ শেখবার পর তারা ওখানেই চাকরি পাবে। কিছুদিনের জন্যে ওখানেই তাদের চাকরি করতে হবে, তার পর অন্যত্র যেতে পারে। বিনা পয়সায় কাজ শেখবার ব্যবস্থা থাকলেও ছেলেদের নিজের খরচায় থাকতে হয়।
সুকান্ত বলতে লাগল যে, তার দাদা সেখানে থেকে মিলের কাজ শেখেন, সে সেখানে চলে যাবে।
আমি বললুম, সন্ন্যাসীদের সঙ্গে আগে আমি কথা বলি। আমাকে যদি তারা নিতে রাজি হয় তা হলে তোমরা যার যেখানে ইচ্ছা চলে যেয়ো, না হলে আবার দেখা যাবে।
সেদিন বিকেল হতে-না-হতে ঘরে ফিরে এলুম। মন এত ভারী যে নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাই বন্ধ হয়ে গেল। বিছানার এক-একটা কোণ এক-একজন দখল করে গুম হয়ে বসে রইলুম। চারদিক ক্রমেই অন্ধকার হয়ে এল। কিছুক্ষণ পরে সদানন্দ-মহারাজ একটা আলো হাতে নিয়ে এসে বললেন, চলুন এবার ভজনের আয়োজন হচ্ছে।
আলোটা ঘরে রেখে সদানন্দ-মহারাজ আমাদের নিয়ে চললেন। সাধুর কাছে গিয়ে তাঁকে প্রণাম করতেই সকালবেলাকার মতন সস্নেহ দৃষ্টিতে আমাদের সম্ভাষণ করে ইঙ্গিতে কাছেই এক জায়গায় বসতে বললেন। ঘরের মধ্যে দুটো ঝাড়ে বোধ হয় পঞ্চাশটা মোমবাতি জ্বলছে। খুব ভিড় নেই। বোঝা গেল, যাঁরা সেখানে উপস্থিত রয়েছেন তাঁরা সকলেই বিশিষ্ট শ্রেণীর লোক। সকালবেলায় যাঁদের বসে থাকতে দেখেছিলুম, তাঁদের পোশাকে এমন পারিপাট্য দেখিনি। তীব্র একটা আতরের গন্ধে ঘর একেবারে আমোদিত। বলা বাহুল্য, সেটা আগন্তুকদের কারুর অঙ্গ থেকে বেরুচ্ছিল। আর একটা দৃশ্য দেখলুম, যা সেবার কিংবা তার পরেও রাজপুতানার অন্য কোথাও দেখিনি। ঘরের একদিকে দেখলুম, একদল মহিলা বসে আছেন। সে-দিকটা . অপেক্ষাকৃত অন্ধকার। মনে হল মহিলারা বসবেন বলে ইচ্ছা করেই সে-দিকটা আলোকিত করা হয়নি। রাজপুতানার সাধারণ মেয়েদের মধ্যে পর্দা নেই বটে, কিন্তু এই সর্দারদের বা অন্য বড়ঘরের মেয়েদের মধ্যে খুবই কড়া পর্দার রীতি প্রচলিত আছে। ঘরের মধ্যে সব চুপচাপ, শুধু মাঝে মাঝে নারীকণ্ঠের চাপা আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছিল। সাধু-মহারাজের একদিকে বড়ে-মহারাজ বসে আছেন। মুণ্ডিত-মস্তক, পরিচ্ছদেরও কোনো বাহুল্য নেই। সকালে তাঁকে মুদ্রিত-চক্ষু অবস্থায় দেখেছিলুম, এ-বেলায় দেখলুম চোখ খুলেই বসে আছেন। চোখ তুলে যখন সামনে চাইছেন তখন মনে হচ্ছে, সামনের কোনো জিনিসের প্রতি তাঁর নজর পড়ছে না–সে-দৃষ্টি সুদূরপ্রসারিত, এসব ছাড়িয়ে অন্য কোথাও কিসের অন্বেষণে সে-দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে। সাধুবাবার অন্যপাশে বসে আছেন আর একজন সন্ন্যাসী, তাঁকে বড়ে-মহারাজের চেয়ে বেশি-বয়সি বলে বোধ হয়। এঁর সামনে একটা প্রকাণ্ড একতারা মাটিতে রাখা হয়েছে। এতবড় একতারা এর আগে কখনও দেখিনি–প্রথম দৃষ্টিতে সেটাকে তম্বুরা বলে বোধ হয়।
ইতিমধ্যে সাধু-মহারাজ একবার হাসিমুখে আমায় জিজ্ঞাসা করলেন বেটা তোমাদের বিশ্রামের কোনো ব্যাঘাত হয়নি?
বললুম, বাবা আপনার দয়ায় আমাদের আহার ও বিশ্রাম হয়েছে। অনেকদিন এমন পরিতৃপ্তির সঙ্গে ভোজন করিনি।
মহারাজ বললেন, পরমাত্মা তোমাদের মনে এমনি ভক্তি জাগিয়ে রাখুন।
আবার পায়ের ধুলো নিয়ে বললুম, আপনি আশীর্বাদ করুন!
মহারাজ আবার আমার মাথায় হাত ঠেকিয়ে আশীর্বাদ করলেন। ইতিমধ্যে পূর্বের সেই সাধু একতারাটা তুলে নিয়ে ছেড়তে অর্থাৎ আওয়াজ করতে আরম্ভ করলেন। যন্ত্রটা নামেই একতারা- কারণ তা থেকে আওয়াজ হতে লাগল তানপুরার মতন। আর একজন সাধু একটা খঞ্জনি-লাগানো কাঠের খটপটি নিয়ে পাশে বসে গেলেন। এই সময় দেখা গেল, সাধু-মহারাজের সঙ্গে আট-দশজন চেলা এসেছেন, সকালবেলায় এঁদের সকলকে দেখতে পাইনি।
যাই হোক, কিছুক্ষণ সেই একতারার আওয়াজ হতে-না-হতে অতবড় ঘর একেবারে সুরে গম-গম করতে লাগল, মেয়েদের গুঞ্জন পর্যন্ত থেমে গেল। অনেকের চক্ষুই নিমীলিত হল।
সন্ন্যাসী একে একে গুটি-তিনেক মীরার ভজন গাইলেন। প্রথম গানটা মনে হচ্ছে, ফাগুনকো দিন যায় যায় রে!
যিনি গাইলেন, তাঁর কণ্ঠ মধুর। গান শুনেই বুঝতে পারা যায় যে, অশিক্ষিত পটুত্বের স্বাভাবিক শক্তির জোরে তিনি গাইছেন না, বহুদিনের শিক্ষা ও সাধনা তাঁর এই অভিব্যক্তির পেছনে রয়েছে। তা ছাড়া, শুধু সুকণ্ঠ ও শিক্ষা থাকলেই এমন গান গাওয়া যায় না। এই সুরের পেছনে রয়েছে এমন এক রহস্যময় দুর্ভেয় সত্তার আকস্মিক আত্মোদ্দীপন, যা মানুষের বুদ্ধির মূঢ় তটসীমাকে অতিক্রম করে হৃদয়কে পৌঁছে দেয় কোনো-এক চিরবেদনার অতল গভীরতায়, যেখানে যুগযুগান্ত ধরে বিরহী মানুষের অশ্রুর তরঙ্গ উদ্বেল হয়ে উঠেছে।
গান আরম্ভ হবার কিছু পরেই অপেক্ষাকৃত অন্ধকার থেকে মেয়েরা এগিয়ে এসে, একেবারে সামনেই বসলেন। আমি দেখতে লাগলুম, সাধুরা এবং আরও অন্যান্য যাঁরা সেখানে বসেছিলেন ক্রমে একে একে তাঁদের সকলের চোখ বন্ধ হয়ে আসতে লাগল, এমনকি মেয়েদের মধ্যেও অনেকেই চোখ বন্ধ করে হাত জোড় করে বসলেন। আমি জোর করে চেষ্টা করেও একাধারে চোখ খুলে রাখতে পারলুম না। একবার চোখ বন্ধ করি আবার জোর করে খুলে সবাইকে দেখি–এমনই করতে করতে আমার সমস্ত দেহ যেন ভারী হয়ে আসতে লাগল। স্পষ্ট দেখলুম, অনেকেরই দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরছে। কেন এ অশ্রু? এই অশ্রুর উৎস কোথায়? চিন্তা করতে করতে অনুভব করলুম, আমারও দুই চক্ষু দিয়ে অশ্রু ঝরছে। দেখলুম আমার পাশে জনার্দন ও সুকান্ত চোখ বুজে হাত জোড় করে বসে আছে। এই কয়মাস নিরন্তর তাদের সঙ্গে একত্র বাস করছি; কিন্তু তাদের দেখে মনে হতে লাগল, এ কি অদ্ভুত মূর্তি, এ মূর্তি এতদিন তো চোখে পড়েনি! মনে হতে লাগল যেন দুটি দেবশিশু ধ্যানে বসে আছে। শুধু আমার বন্ধুরা নয়–সেখানে যত লোক বসে ছিল, পুরুষ কিংবা স্ত্রী, সকলেই সেই গানের প্রভাবে যেন দিব্যায়িত হয়ে উঠল। দেখতে-দেখতে আমি একেবারে ডুবে গেলাম, তার পরে কিছুক্ষণ আর কিছু মনে নেই। শৈশবে একদিন ব্রহ্মমন্দিরে নামগানবিহ্বল ভক্তদের ভাবাকুল অশ্রুপাতের যে অতল রহস্য বিস্মিত মনে, হাস্যমুকুলিত চক্ষে নিরীক্ষণ করেছিলুম, আজ সেই অকূল রহস্যের কিনারায় পৌঁছনো-মাত্র এক অনাস্বাদিতপূর্ব নির্মম বেদনার নিপীড়নে আমার দু-চোখের দৃষ্টি স্তব্ধ-রোদনের অশ্রুভারে নিমীলিত হয়ে গেল।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে চোখ খুললুম। গান তখন থেমে গিয়েছে, ঘর একেবারে নিস্তব্ধ। সাধুদের চোখ তখনও বন্ধ, আরও অনেকে যাঁরা সেখানে বসে ছিলেন তাঁরা কেউ কেউ চোখ খুললেন। মেয়েদের কেউ কেউ অশ্রুসিক্ত চোখ মার্জনা করছেন। বোধ হয় মিনিট দুই-তিন এইভাবে কাটবার পর আবার গান শুরু হল, আবার সকলের চোখ বন্ধ হল।
জ্ঞানোন্মেষ হবার আগে থেকেই ঈশ্বরের নামগান কীর্তন প্রভৃতির আসরে বসতে আমি অভ্যস্ত। সমবেতভাবে নিয়মিত ধ্যান ও নাম-কীর্তন হয় এমন সমাজে আমি জন্মেছি এবং সেই আবহাওয়ায় পালিত হয়েছি; কিন্তু এরকম অভিজ্ঞতা আমার জীবনে এর আগে হয়নি। প্ৰাণস্পর্শী গান শুনে মনের মধ্যে ভক্তির উদয় হয়েছে–কখনও বেশি, কখনও কম। জ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে সে-প্রবাহকে সংযত করতে বেশি বেগ পাইনি। কিন্তু জ্ঞান, বুদ্ধি ও অহঙ্কারকে অতিক্রম করে আর-একটা হিল্লোল নিজের মধ্যে জেগে উঠেছে–বেশ বুঝতে পারছি, নিজের মধ্যে একটা কিছু হচ্ছে এবং সেই একটা কিছু যে ঘটিয়ে তুলছে সে আসছে ওই গানের রূপ ধরে।
পরে জেনেছি যে, ভাগবতী সচেতনায় সচেতন যে আধার সে জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারেও দৈবী চেতনা সঞ্চারিত করতে পারে অন্য আধারে-অবশ্য পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও যাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত হবে তাদের আধারও সে-অবস্থার অনুকূল হওয়া চাই।
গান শেষ হয়ে যাবার পর প্রথমে সাধুর চেলারা উঠে গেলেন, তার পরে বাইরের কয়েকজন যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রণাম করে চলে গেলেন। মেয়েরা আরও এগিয়ে এসে সাধুর কাছে বসলেন। আমরা উঠে প্রণাম করতেই সাধু-মহারাজ আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা রাত্রে থাকবে তো?:
বললুম, হ্যাঁ, আজ রাত্রে বিশ্রাম করে কাল বেরুব।
নির্দিষ্ট কক্ষে ফিরে গিয়ে বিছানায় গা ঢেলে দেওয়া গেল। একটু পরেই সুকান্ত ও জনার্দন দুজনেই বলতে আরম্ভ করলে, সাধু-মহারাজ যদি তোকে শিষ্য করেন তবে আমিও তাঁর শিষ্য হব–এমনি করে ঘুরতে আর ভালো লাগে না, সত্যিই যদি তাঁর চরণে আশ্রয় পাই তো বেঁচে যাই।
সুকান্ত ও জনার্দন আমাকে এমনভাবে খোশামোদ করতে আরম্ভ করলে যেন আমি ইতিমধ্যে সাধু-মহারাজের চেলা হয়ে একজন বড়োদরের সন্ন্যাসীতে পরিণত হয়েছি। অথচ সেইদিনই বিকেলবেলা সেই পাহাড়ে বসে আমি যখন তাদের বলেছিলুম যে আমি সাধু-মহারাজের শিষ্য হয়ে তাঁদের সঙ্গে চলে যাব, তখন আমার সঙ্গে যোগ দেবার জন্যে তাদেরও অনুরোধ করেছিলুম–তারা দুজনেই সে-প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান তো করেইছিল, উপরন্তু মৃদু বিদ্রূপ করতেও ছাড়েনি। রাত্রের সেই কীর্তনসভায় বসে তাদের মতামত শুধু যে পালটে গেল তা নয়, দেখলুম তারা ভগবদ্ভক্তিতে জরজর হয়ে পড়েছে। বৈষ্ণবচূড়ামণি গোস্বামী একজায়গায় বলেছেন যে, অতি রুক্ষস্বভাববিশিষ্ট লোকেরও সদ্গোষ্ঠীর সহবাসে সত্ত্বগুণ জাগ্রত হয়–আমার বন্ধুদ্বয়ের নিশ্চয় সেই অবস্থা হয়েছিল।
জনার্দন তো কেঁদেই ফেললে আর তখুনি সাধু-মহারাজের পায়ে ধরে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করবার সঙ্কল্পে তাঁর কাছে যাবার উদ্যোগ করতে লাগল। তখনকার মতন তাঁকে নিবৃত্ত করে আমরা তিনজনে পরামর্শ করে ঠিক করলুম যে, রাত্রে আহারাদির পর আমি সদানন্দজীকে আমাদের সঙ্কল্পের কথা জানাব। তিনি কি পরামর্শ দেন তাই শুনে পরে যা হয় করা যাবে।
সদানন্দজীর অপেক্ষা করতে লাগলুম, কিন্তু তাঁর দেখাই নেই। ঘণ্টা-দুই তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে রাত্রে বোধ হয় আর খেতে-টেতে দেবে না মনে করে শুয়ে পড়েছি, এমন সময় সদানন্দজী হাসিমুখে ঘরের মধ্যে এসে বললেন, চলুন, ভোজন করবেন।
আমরা জিজ্ঞাসা করলুম, কটা বেজেছে?
সদানন্দ বললেন, তা বোধ হয় বারোটা বেজে গিয়েছে।
খাবার জায়গায় গিয়ে দেখলুম, অনেক লোক খেতে বসেছে, দুপুরবেলা এত লোক দেখিনি। জিজ্ঞাসা করে জানলুম যে তারা সব সাধু দর্শন করতে এসেছে। আজ রাতে আর মহারাজের সঙ্গে দেখা হবে না, তিনি মেয়েদের সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। মেয়েরা চলে গেলেই তাঁর ঘরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। এরা সব আজ রাত্রিটা এখানে থাকবে। এদের ব্যবস্থা করতে হল বলেই আমাদের ভোজনের দেরি হয়ে গেল।
খাওয়া-দাওয়া চুকে যাবার পর সদানন্দজী আমাদের সঙ্গে সঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, এমন সময় আমি তাঁকে বললুম, মহারাজ, যদি অসুবিধা না হয় তো আমাদের সঙ্গে একটু ঘরে চলুন না–প্রয়োজন আছে।
সদানন্দ-মহারাজ বেশ প্রসন্নমনেই বললেন, বেশ তো, চলুন।
ঘরের মধ্যে এসে তাঁকে বসিয়ে আমরা তিনজনে তাঁকে ঘিরে বসলুম। প্রথমটা বলতে ইতস্তত করছি দেখে তিনি নিজেই জিজ্ঞাসা করলেন, কি বলতে চাইছেন বলুন?
তাঁর আশ্বাসবাণী শুনে বুক ঠুকে বলেই ফেললুম, মহারাজ, এই বলছিলুম কি যে, এখানে আসবার কিছুকাল আগে থেকেই আমাদের মন বড় উচাটন হয়েছে, সংসারের কিছুতে আর মন বসছে না। আমরা সন্ন্যাস গ্রহণ করব–আপনি যদি দয়া করে আপনার গুরুকে আমাদের মতন অধমদের শিষ্য করতে রাজি করান তা হলে তাঁর কাছে দীক্ষা পেয়ে আমরা ধন্য হই।
আমার কথা শুনে সদানন্দজী কিছুক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে বললেন, বাবুজী আপনাদের তিনজনের মধ্যে কারুরই সন্ন্যাস গ্রহণ করবার সময় এখনও হয়নি। তারপরে আপনারা বোধ হয় জানেন না যে, আমাদের গুরুদের কাল সকালে দেহত্যাগ করে ইহলোক থেকে চলে যাবেন।
–অ্যাঁ!!! দেহত্যাগ করবেন মানে?
কথাটা কানের মধ্যে ঢুকে সেইখানেই ঘুরপাক খেতে লাগল–মগজ অবধি পৌঁছল না।
সদানন্দজী আবার বললেন, হাঁ বাবুজী, আমাদের গুরু কাল সকালে দেহত্যাগ করবেন। কাল ফাল্গুনী পূর্ণিমা–ওইদিনই দেহত্যাগ করবার উপযুক্ত সময় বলে বিবেচিত হয়েছে। গুরুদেব এই দেশেই জন্মেছিলেন এবং এইখানেই দেহ রাখবেন বলে এসেছেন। কিছুদিন থেকে তাঁর দেহে জরা দেখা দিয়েছে–এবার দেহত্যাগ করে চলে যাবেন। কাল বেলা বারোটার মধ্যেই তিনি চলে যাবেন।
অপরম্বা কিম্ ভবিষ্যতি! মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করতে লাগল। আর একটা কথাও জিজ্ঞাসা করা হল না। কিছুক্ষণ বসে থেকে সদানন্দ-মহারাজ উঠে চলে গেলেন।
আমাদের কারুর মুখে আর বাক্যি নেই। দেখলুম জনার্দন ও সুকান্ত কিছুক্ষণ বসে থেকে থেকে শুয়ে পড়ল। অল্পক্ষণের মধ্যেই তারা ঘুমিয়ে পড়ল বলে মনে হল–আমি নিজের জায়গাটিতে বসে বসে ভাবতে লাগলুম।
বসে থাকতে থাকতে আলোটা গেল নিবে। ঘর অন্ধকার হয়ে পড়ায় আমিও শুয়ে পড়লুম, নানারকম চিন্তায় মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল। ওরই মধ্যে এপাশ-ওপাশ করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম জানি না, হঠাৎ কিরকম একটা ভয় পেয়ে ঘুম ছুটে গেল। মনে হল কে যেন আমার দেহটা স্পর্শ করছে। ঠিক রক্তমাংসের হাতের স্পর্শ নয়-স্পর্শটা ঠাণ্ডা কনকনে। খুব ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলে যেরকম অনুভব হয় অনেকটা সেইরকমের। অথচ হাওয়া যেমন ঝোঁকে ঝোঁকে লাগে এবং শরীরের অনেকখানি জায়গায় অনুভূত হয় এ যেন সেরকম নয়। শরীরের সব জায়গায় নয়–কখনও একদিকের গালে কখনও-বা একটা হাতের ওপর, কখনও বুকের খানিকটার উপর শীতল বায়ুর স্পর্শ। ভয়ে আমার শরীরে কাঁটা দিতে লাগল। এর ওপরে কাদের ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ যেন কানে আসতে লাগল –খুব ক্যানক্যানে গলায় যতদূর সম্ভব আস্তে বলা হলে যেরকম শুনতে হয়, অনেকটা সেইরকমের।
অনেকক্ষণ কান পেতে শুনতে শুনতে মনে হল, বাইরে হাওয়ায় শুকনো পাতা ওড়ার শব্দ হওয়ায় হয়তো আমার ওইরকম মনে হয়েছিল। ঘরের জানলাগুলো বন্ধই ছিল, অনেক সাহস সঞ্চয় করে ঘষটে ঘষটে গিয়ে একটা জানলা খুলে দেওয়া গেল। জানলা খুলতেই একঝলক চাঁদের আলো বিছানা ও মেঝের খানিকটা ভাসিয়ে দিয়ে ছলকে গিয়ে পড়ল সামনের দেওয়ালে। বাইরে শেষরাত্রের জ্যোৎস্নায় সমস্ত ঝকঝক করছিল, ওপর-নীচের প্রত্যেকটি জিনিস স্পষ্ট দেখা যেতে লাগল। মাঝে মাঝে হাওয়ার এক-একটা হলকায় একরাশি শুকনো পাতা খড়খড় করে উড়ে চলেছে–জানলার ধারে বসে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে একটু সাহস ফিরে এল। হঠাৎ একবার ঘরের মধ্যে মুখ ফেরতেই অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখতে পেলুম। ঘরের মধ্যে যে-জ্যোৎস্না এসে পড়েছিল এবার স্পষ্ট দেখলুম যে, ছোট ছোট খুব হালকা ধোঁয়ার পিণ্ডের মতন কতকগুলো ছায়া ভেসে ভেসে সেই জ্যোৎস্নাটুকু পার হয়ে উড়ে যাচ্ছে–একটা-দুটো পরে পরে অনেকগুলো ছোট-বড় নানা আকারের ছায়া–কোনোটা খুব ফিকে, একেবারে চাঁদের আলোর সঙ্গে মিশে আছে, কতকগুলো অপেক্ষাকৃত গাঢ় রঙের, যেন হাওয়ায় ভেসে-ভেসে সেই জ্যোৎস্নাটুকু পার হয়ে দেওয়ালে গিয়ে ঠেকে মিলিয়ে যাচ্ছে। ভয়ে আমি সেখানে থেকে উঠে জানলা থেকে দূরে গিয়ে বসে লক্ষ করতে লাগলুম–এবার যেন ঝাঁকে-ঝাঁকে সেই ছায়ার দল ঢুকে ঘর ভরে যেতে আরম্ভ করল। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, মাঝে মাঝে একটা-দুটো ছায়ার টুকরো আমার মুখ-হাত-পায়ের ওপর দিয়ে বুলিয়ে যেতে লাগল আবার সেই শীতল স্পর্শ।
কিছুক্ষণ এইরকম চলবার পর একেবারে সব পরিষ্কার হয়ে গেল। জনার্দন ও সুকান্তকে ডাকব কি না ভাবছি, এমন সময় সুকান্ত ধড়মড় করে উঠে চারিদিকে চাইতে লাগল। চাঁদের আলোতে স্পষ্ট দেখলুম, ভয়ে তার মুখখানা আঁতকে উঠেছে। কয়েক মুহূর্ত এদিক-ওদিক চেয়ে আমায় দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এসে পাশে বসে হাঁপাতে লাগল।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কি রে, কি হয়েছে?
সুকান্ত জিজ্ঞাসা করলে, কি বল্ দিকি এগুলো?
–কোনগুলো!
–এই যে সব দেখতে পাচ্ছিস না! এই যে–এই যে–এই–এই গায়ের ওপর এসে পড়ছে!
সুকান্তর হালচাল দেখে মনে হল, আমি এতক্ষণ যে দৃশ্য দেখছিলুম সেও তাই দেখছে; কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় যে, সে-সময় আমি কিছুই দেখতে পেলুম না। সুকান্ত বলতে লাগল, কিছুই দেখতে পাচ্ছিস না?
আমি বললুম, তুই ঘুম থেকে ওঠবার আগে দেখতে পাচ্ছিলুম বটে, কিন্তু এখন আর দেখতে পাচ্ছি না।
সুকান্ত বলতে লাগল, এই দেখ এই একটা–এই উড়ে যাচ্ছে–
কিন্তু আমি কিছুই দেখতে পেলুম না। এইরকম কিছুক্ষণ ‘এই–এই–এই যাচ্ছে’ করার পর সে একটু চুপ করে থেকে বললে, কিছু শুনতে পাচ্ছিস। খুব কান পেতে শোন্।
অনেকক্ষণ এক-মনে’শোনবার চেষ্টা করতে করতে যেন শুনতে পেলুম কে ফিসফিস করে কি বলছে! এই শব্দকেই কিছু আগে বাতাসে পাতা-ওড়ার শব্দ বলে মনে করেছিলুম। কখনও কখনও মনে হতে লাগল, অনেক লোক যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। তার পরে শুনতে পেলুম বাজনার আওয়াজ–অপূর্ব সে সঙ্গীত! শুনতে শুনতে মনে হতে লাগল, এ সঙ্গীত এর আগেও যেন আরও কোথাও শুনেছি। স্মৃতিসাগর মন্থন করতে করতে মনে পড়ে গেল, ছেলেবেলায় জলে ডুবতে ডুবতে জ্ঞান হারাবার ঠিক পূর্ব-মুহূর্তে এই ধরনের সঙ্গীত শুনেছিলাম। মনে হল, কারা যেন অনেকদূরে নানারকমের বাজনা বাজাচ্ছে। শুনতে শুনতে মনে হল, তার মধ্যে মানুষের কণ্ঠস্বরও মিলিয়ে রয়েছে। সে-কণ্ঠ নারী কি পুরুষের তা ঠিক ঠাহর করতে না পারলেও অশ্রুতপূর্ব সেই স্বর ক্রমে স্পষ্ট হতে স্পষ্টতর হতে লাগল। মনে হল কে যেন গাইছে–ফাগুনকো দিন যায় যায় রে!!
গান শুনতে শুনতে স্তব্ধ গম্ভীরা প্রকৃতিও যেন চঞ্চলা হয়ে উঠতে আরম্ভ করলে। প্রথমে ধীরে ধীরে তারপরে একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে বাতাস একেবারে হা-হা করে এলোমেলো ভাবে ছুটোছুটি করতে আরম্ভ করে দিলে। সেই মনোহর নতুন পুষ্পপত্রে ভরা সুন্দরী বসন্ত একেবারে উদাসিনী হয়ে দাঁড়াল। এমন অনুরাগিণী প্রকৃতির অন্তরে যে এমন বৈরাগিণী লুকিয়ে আছে, তা এর আগে এমন করে উপলব্ধি করিনি। মাথায় জোরে বাতাস লাগতে লাগতে শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল। বালিশটা জানলার কাছে টেনে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লুম–একটু চেষ্টা করতে-না-করতেই ঘুমিয়ে পড়লুম।
ঘুম ভেঙে দেখি, খোলা জানলা দিয়ে একরাশ রোদ্দুর ঢুকে ঘর ভেসে যাচ্ছে। বেশ বেলা হয়েছে, জনার্দন ও সুকান্ত তখনও অকাতরে ঘুমুচ্ছে। দূরে কারা যেন সমবেত কণ্ঠে রামনাম করছে–”দশরথনন্দন রাজারাম, পতিতপাবন সীতারাম” –অপূর্ব মধুর লাগতে লাগল তুলসীদাসের সেই সঙ্গীত, সে-সঙ্গীত অনেক ঘাটের জল খেয়ে এখন–”ঈশ্বর আল্লা তেরা নামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু যেতে দাও সে-কথা–
তাড়াতাড়ি উঠে জনার্দন ও সুকান্তকে টেনে তুলে মুখ-টুখ ধুয়ে গেলুম সাধু-মহারাজের ওখানে। সেখানে গিয়ে দেখি, লোকে একেবারে ঘর ভরতি।
মহারাজের কপালে মুখে হাতে সব চন্দন মাখানো হয়েছে। তাঁর গলায় ফুলের মালা, পাশে বড়ে-মহারাজ বসে আছেন, তাঁরও গলায় দেখলুম মালা ঝুলছে। মহারাজের বিছানায় নতুন চাদর পাতা হয়েছে–তাঁর পেছনে পাহাড়ের মতন উঁচু করে বালিশ সাজানো রয়েছে। নরনারী আসছে, সাধুঁকে প্রণাম করছে–কেউ-বা একপাশে দাঁড়াচ্ছে, কেউ-বা মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়েই আবার চলে যাচ্ছে। সাধু বাবা হাসিমুখে সকলকেই আশীর্বাদ করছেন। আমরাও গিয়ে প্রণাম করতেই তিনি হাত তুলে সকলকে যেমন আশীর্বাদ করছিলেন, আমাদেরও তেমনই আশীৰ্বাদ করলেন। আর একদিকে চার-পাঁচজন লোক বসে রামনাম গান করছেন। বাড়ির মেয়েরাও অনেকে এসেছেন, আরও দু-একজন করে আসছেন। আমরা কোথায় বসব–এদিক-ওদিক করছি এমন সময় সেই ভিড়ের মধ্যে থেকে সদানন্দজী বেরিয়ে এসে আমাদের নিয়ে গিয়ে একেবারে সাধুর সামনেই বসিয়ে দিলেন।
কাল সাধুবাবাকে সকাল-সন্ধ্যায় দু’বার দেখেছি–দু’বারেই তাঁকে ধীর, স্থির, শান্ত দেখেছি; কিন্তু আজ দেখে মনে হল, তিনি যেন ছটফট করছেন। মুখে হাসি লেগে আছে বটে, কিন্তু কখনও বালিশে হেলান দিচ্ছেন কখনও-বা সামনে এগিয়ে এসে হাত তুলে লোককে আশীর্বাদ করছেন। মুখে হাসি সত্ত্বেও মনে হচ্ছে কি যেন বিড়বিড় করে বকে চলেছেন।
ক্রমে লোক-আসা-যাওয়া কমে আসতে লাগল। শেষকালে সাধু-মহারাজের শিষ্যেরা, বাড়ির মহিলারা ও আমাদের মতন মাত্র জনকয়েক ছাড়া একে একে সকলেই বেরিয়ে চলে গেল। যাঁরা এতক্ষণ রামনাম গান করছিলেন, তাঁরা এবার জলদে শুরু করলেন। আর সকলেই চুপচাপ, আমার দৃষ্টি সাধুবাবার ওপরে স্থির নিবদ্ধ। দেখলুম, আস্তে আস্তে তাঁর দীপ্ত চোখ-দুটো বন্ধ হয়ে গেল। পা-দুটো তখনও আসন-পিঁড়ি করে বসা। একবার সেই পেছনে বালিশের দেওয়ালে হেলান দিয়ে যেন আরাম করে বসলেন। ইতিমধ্যে সেই রামনাম শেষ হয়ে গেল–ঘরের মধ্যে সুরের রেশ গুমরে গুমরে ফিরতে লাগল।
সকলে নিস্তব্ধ, কারুর মুখে কোনো কথা নেই, এমন সময়ে সেই অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতার মধ্যে বড়ে-মহারাজ সেই প্রকাণ্ড একতারাটি তুলে নিয়ে কয়েকবার ঝঙ্কার দিয়ে গান শুরু করলেন।
দেখলুম বড়ে-মহারাজাও গাইয়ে-লোক। তাঁর কণ্ঠও শিক্ষিত ও সুললিত; কিন্তু বয়সের জন্যেই হোক অথবা আসন্ন গুরুবিচ্ছেদ-বেদনায় হোক, প্রথমটা মনে হয়েছিল যেন তিনি কিছু অভিভূত হয়ে পড়েছেন। মিনিট-কয়েকের মধ্যেই কিন্তু তিনি সেই বাধাটুকু কাটিয়ে উঠলেন।
বড়ে-মহারাজ শুরু করলেন ভজন–কবীরের সেই বিখ্যাত গুরুবন্দনার অনুকরণে তাঁর নিজের রচিত ভজন–হে গুরু, আমার মোহ নাশ করবার জন্য তুমি জ্ঞান-কাটারি দিয়েছে, জ্ঞানরূপ গৃহের চাবি তুমি আমার হাতে দিয়েছ। হে পিতা, তুমি তোমার এই অধম সন্তানকে অমৃত পান করিয়েছ। অমৃতপানে অনভ্যস্ত এই অধম কতবার অমৃত ভেবে বিষপান করে অসুস্থ হয়েছে, তুমি তাকে বাঁচিয়েছ–হে পিতা, এই অধম সন্তানকে তুমি চরণে স্থান দিও। সংশয়ের ঘোর অন্ধকারে কতবার পথভ্রষ্ট হয়েছি, তুমি আমার হাত ধরে চালিত করছে সত্যপথে। আমার হাতে সত্য ও জ্ঞানের বর্তিকা দিয়েছ–হে গুরু, তুমি আমায় ভুলো না, অসময়ে দেখা দিও। আমার জীবনের ঊষায় প্রদীপ্ত ভাস্করের মতন উদয় হয়ে সারা দিনমান তুমি কিরণ বিকিরণ করেছ–এখন রাত্রির ঘনতমসা আমাকে গ্রাস করতে উদ্যত–হে গুরু, ত্রস্ত এই সন্তানকে তুমি রক্ষা কর–তুমি যেখানেই থাক, তোমার মঙ্গলহস্তের অভয়স্পর্শ যেন পাই!
সেই করুণ মিনতি শুনতে শুনতে অনেকেরই চোখ ভিজে উঠতে লাগল। মেয়েরা অনেকেই চক্ষু মার্জনা করতে লাগলেন–গায়কের কণ্ঠস্বরও আর্দ্র হয়ে উঠল। সাধু-মহারাজকে দেখলুম সেই ভাবে হেলান দিয়ে শুয়ে আছেন–চক্ষু মুদ্রিত, ঠোঁট-দুটি যেন একটু ফাঁক হয়ে গেছে–নিস্পন্দ নির্বাক।
বড়ে-মহারাজ গেয়ে চলেছেন, তুমি আমার অন্তরে বাতি জ্বালিয়েছ। ঝড় দুর্যোগে এই দীপশিখাঁটিকে তুমিই রক্ষা করেছ–তুমি দেখো শেষপর্যন্ত যেন পারে উত্তরিতে পারি–হে গুরু তুমি আমাকে চরণে রেখো, তুমি স্মরণে রেখো!
বড়ে-মহারাজের গান শেষ হতে-না-হতে আবার রামনাম শুরু হল জয় জয় রাম–জয় জয় রাম। সকলেই, এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত গলা দিলেন–জয় জয় রাম–জয় জয় রাম–
এইরকম বেশ কিছুক্ষণ চলার পর সাধু-মহারাজের এক শিষ্য চিৎকার করে উঠলেন, চলে গেছেন–চলে গেছেন!
আবার সকলে সেই সুরে শুরু করলেন, জয় জয় গুরু–জয় জয় গুরু–
শিয্যেরা গুরুর দেহটা বিছানা থেকে তুলে অন্যত্র শুইয়ে রাখলে। ঘরের সমস্ত বিছানা তুলে ফেলা হল। প্রকাণ্ড ঘটির আকারের তামার চাদরে তৈরি ঘড়াঘড়া গঙ্গাজল প্রাসাদের কোথা থেকে বাহকেরা সব বয়ে নিয়ে আসতে আরম্ভ করলে। এই কয় সপ্তাহ ধরে নাকি প্রতিদিন হরিদ্বার থেকে গঙ্গাজল এসেছে।
মৃতদেহকে বসিয়ে দুজন শিষ্য পেছন থেকে ধরে রইলেন আর দুজনে মিলে এক-একটা ঘড়া তুলে নিয়ে মৃতদেহের মাথায় জল ঢালতে লাগলেন। স্নানপর্ব শেষ হয়ে গেলে মৃতদেহে নতুন কাপড় পরানো হল-চন্দন-তিলকও বাদ পড়ল না। মেয়েরা এবং আরও অনেকে ফুলের মালা পরিয়ে দিতে লাগল মৃতদেহের গলায়। তারপরে শিষ্যরা মৃতদেহ বয়ে নিয়ে গেল বাগানের একদিকে। সেখানে গর্ত খুঁড়ে পোড়াবার জায়গা আগে থাকতেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল। দেখলুম, দমাদ্দম গাছ-কাটা চলেছে–চন্দনকাঠও এল একরাশি।
চিতা সাজিয়ে গুরুর মৃতদেহ চড়িয়ে দেওয়া হল। বড়ে মহারাজ চিতায় প্রথম অগ্নিসংযোগ করলেন—তারপরে একে একে সব শিষ্যই পরে পরে আগুন দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাঁচা কাঠ ধু-ধু করে জ্বলে উঠল–বোধ হয় ঘণ্টাতিনেকের মধ্যেই সব শেষ হয়ে গেল। আবার ঘড়া ঘড়া গঙ্গাজল ঢেলে শিষ্যেরা চিতা নিবিয়ে দিলে।
সাধু-মহারাজের শিষ্যেরা ও অন্যান্য সকলে প্রাসাদের দিকে চলে গেল। আমরা ইঁদারার ধারে গিয়ে স্নান সেরে সদানন্দ মহারাজের খোঁজ করতে লাগলুম। কিন্তু কি আশ্চর্য! এতক্ষণ যেখানে লোকারণ্য ছিল, এখন সেখানে একজনকেও দেখতে পেলুম না। আমাদের খাওয়াবার জন্যে যেখানে দু’বার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, সেদিকটায় একবার যাওয়া গেল–সকাল থেকে পেটে কিছুই পড়েনি, যদি খাবার-দাবার কিছু ব্যবস্থা হয়ে থাকে তা হলে খাওয়া যাবে, নয়তো সেখানে কোনো লোকের দেখা পেলে সাধুরা কোথায় আছেন তার সংবাদ পাওয়া যাবে; কিন্তু সেখানে দেখলুম, সব ভোঁ-ভোঁ–কেউ কোত্থাও নেই। ফিরে চলছিলুম, এমন সময় ভাগ্যক্রমে সদানন্দজীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। তাঁকে বললুম, আমরা এবার জয়পুরে ফিরে যাচ্ছি; কিন্তু যাবার আগে আপনার সঙ্গে দেখা না করে যেতে পারছিলুম না–যাক, ভাগ্যক্রমে দেখা হয়ে গেল।
সদানন্দজী বললেন, এখুনি কেন যাচ্ছেন? রাত্রে পথে কষ্ট হতে পারে। আজ মধ্যরাত্রে আমরা এখান থেকে বেরুব জয়পুরের দিকে-আপনারা আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন। আমরা উটের গাড়ি করে যাব–যদি আমাদের সঙ্গে যান তো অনেক পরিশ্রম বেঁচে যাবে।
সদানন্দজী আরও বললেন যে, আজ তাঁদের গুরুর তিরোভাব হওয়ায় তাঁরা সকলে উপবাসী থাকবেন–সেইজন্যেই সদাব্ৰত বন্ধ আছে। আপনারা ইচ্ছা করলে বাজারে গিয়ে খাবার খেয়ে আসতে পারেন।
শহরের দিকে গাড়ি যাবে শুনে তো আমরা বেঁচে গেলুম। সদানন্দ মহারাজকে বললুম, আমরা আপনাদের সঙ্গেই যাব। কিন্তু অত রাত্রে আমরা খবর পাব কি করে?
-আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। সময় হলে আমিই আপনাদের ডেকে আনব।
সন্ন্যাসীকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা কাল বিকেলে যে ন্যাড়া পাহাড়টার ওপর গিয়ে বসেছিলুম তারই চুড়োয় গিয়ে বসলুম। সেদিন সকাল থেকেই হু-হু করে বাতাস বইছিল, বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাতাসের বেগও যেন বাড়তে আরম্ভ করল। পাহাড়ের ওপর সেই এলোমেলো বাতাস লাগতে-লাগতে আমার ঘর-ভোলা মন আরও উদাস হয়ে পড়তে লাগল। মনের মধ্যে সাধু-মহারাজের সেই হাসিমাখা মুখ ও চোখ-দুটো বারে বারে ভেসে উঠতে লাগল। মনে হতে লাগল আড়াই শো বছর আগে এই মানুষটি এই দেশেরই কোনো এক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। কোন্ পরশমণির ছোঁয়া পেয়ে তাঁর মনে আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠল সেই অজানাকে জানবার? তারপর একদিন এই অজানা সংসার-সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন গৃহের স্নেহবন্ধন পেছনে ফেলে। এই আড়াই-শো বছরে ইতিহাসের কত পৃষ্ঠা লেখা হয়ে গেল, কত রাজা কত রাজ্য এল গেল–তার সন্ধান রাখবার অবকাশ ছিল না–যে আশা নিয়ে ঘরছাড়া হয়েছিলেন তাই লাভ করবার জন্যে পর্বতে কন্দরে কত বিষ্ণুা কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যায় তাঁর দিন কেটেছে তা কে জানে! অবশেষে সেই পরমপদ লাভ করে আজ স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে বরণ করে তিনি চলে গেলেন। সকালে যিনি সশরীরে সকলকে আশীর্বাদ করেছেন, এখন তাঁর দেহভস্ম নিয়ে বাতাস খেলা করছে। এ কিছু নতুন ব্যাপার নয়, আবহমানকাল থেকে এই ব্যাপার ভারতভূমিতে হয়ে আসছে। এই আমার জন্মভূমি–আমার মাতৃভূমি। মনে হতে লাগল, আমি কোথাকার লোক, আমার শিক্ষা সংস্কৃত সবই ভিন্ন; কিন্তু কি ঘটনাচক্রের মধ্য দিয়ে এখানে এসে পড়লুম! এসবই কি অকস্মাতের খেলা! না, এসব আগে থেকেই অবধারিত ছিল! বিস্ময়-বিস্ময়-বড় বিস্ময় লাগে।
আমরা ঠিক করলুম, সাধু-মহারাজার শিষ্যদের মতন তাঁর তিরোধান উপলক্ষে আমরাও সেদিন উপবাস করব। সন্ধ্যা অবধি পাহাড়ে কাটিয়ে ফিরে এলুম দু’দিনের সেই বাসায় যেখানকার অভিজ্ঞতা সারাজীবন ধরে স্মৃতিফলকে জ্বলজ্বল করছে।
সন্ন্যাসীরা জয়পুর শহর অবধি গেল না। তারা আমাদের শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে নামিয়ে দিয়ে অন্য এক রাস্তায় চলে গেল। বললে, এখনও কয়েক জায়গায় ঘুরে বর্ষার পরে তারা হিমালয়ে ফিরে যাবে।
রাস্তায় নেমে আমরা পথের ধারে প্রকাণ্ড একটা গাছের নীচে গিয়ে বসলুম। কি জানি কেন, নিজেকে অত্যন্ত অসহায় বলে মনে হতে লাগল। রোগমূর্ছিত দেহে প্রথম চেতনা সঞ্চারের সঙ্গে সঙ্গে যে অসহায়তা রোগীর মনকে আচ্ছন্ন করে–অনেকটা সেইরকম। মাত্র কয়েক ঘণ্টার পরিচিত সেই সন্ন্যাসীরা আমাদের এত আপনার হয়ে পড়েছিলেন! মাত্র কয়েক ঘণ্টা! কে জানে কত জন্ম-জন্মান্তরের আত্মীয়তার বন্ধন এই–তাই বুঝি তাঁদের সঙ্গে এই বিচ্ছেদের সময় আত্মীয়-বিচ্ছেদের ব্যথা অনুভব করলুম। দেখতে লাগলুম, জনমানবহীন পথ পড়ে রয়েছে জন্মান্তরের বিস্মৃতির মতন। একখানা কালো মেঘের আড়ালে থেকে অস্তগমনোন্মুখ সূর্য বেরিয়ে আসতেই হঠাৎ তীব্র পিঙ্গল রৌদ্রচ্ছটায় সমস্ত পথ ঝলসে উঠল। মনে হল এ কোন্ আত্মবিস্মৃতির মধ্য দিয়ে আমার এতটা কাল কেটে গেল! ওই রৌদ্রচ্ছটার মতন তীব্র উজ্জ্বল এ কোন্ চেতনায় আমার অস্তিত্বটা ভাস্বর হয়ে উঠল! মনে হতে লাগল, ওই যে অদ্ভুত জীব অদ্ভুত গাড়িতে অদ্ভুত মানুষগুলিকে বয়ে নিয়ে চলেছে দূর থেকে ক্রমশই দূরে, তাদের সঙ্গে সংসারের কোন্ সম্বন্ধে আমি আবদ্ধ! হৃৎকমল ছিন্ন করে নিয়ে ওই যে মানসহংস উড়ে চলেছে এক আকাশ থেকে আর এক আকাশে, তার সঙ্গে মৃণালসূত্রের সম্পর্ক তো এখনও ছিন্ন হয়নি–দীর্ঘ থেকে সেও দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। ওই যে মানুষটি কাল আড়াই-শো বছর পরে ছিন্নবস্ত্রখণ্ডের মতন অবলীলায় দেহটাকে ফেলে চলে গেলেন, তিনি কি এতদিন আমারই শ্রদ্ধানিবেদনের প্রতীক্ষায় ছিলেন?
পায়ে পায়ে গাড়িখানা একেবারে দৃষ্টির সীমারেখায় গিয়ে পৌঁছল। ওই দেখা যায়–এখনও দেখতে পাওয়া যাচ্ছে–ওই আর দেখা যায় না।
সূর্য ডুবে গেল, সেই কালো মেঘখানা পশ্চিমের রক্ত-আকাশের আলোকে আড়াল করে দাঁড়াতেই দেখতে দেখতে সন্ধ্যার অন্ধকার রাত্রির তারাগুঞ্জনে মুখর হয়ে উঠল।