প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

১.৩ এক সের মাছ উড়ে গেল

আমার বাবা সব সময়েই একটা-না-একটা খেয়াল নিয়েই মত্ত থাকতেন। রবারের থলিতে গ্যাস ভরে ঘরের মধ্যে ছেড়ে দিতেন আর সেগুলো উড়ে চালে গিয়ে আটকে থাকত। মধ্যে মধ্যে নানা রঙের বারো-চোদ্দটা বেলুন একসঙ্গে গুচ্ছ করে বেঁধে ছেড়ে দেওয়া হত সেগুলো সোঁ-সোঁ করে উঠতে উঠতে আকাশে মেঘের মধ্যে মিলিয়ে যেত। এই বেলুন ওড়ানো আমাদের বেশ লাগত। মা কিন্তু বাবার এইসব খেয়ালকে সুনজরে দেখতেন না। বাবা যখন ঝাঁকে ঝাঁকে রঙিন বেলুন আকাশে ছাড়তে থাকতেন, মা আমাদের সঙ্গে ছাতের এক কোণে দাঁড়িয়ে সেই দৃশ্য দেখতেন আর মন্তব্য করতেন, এই এক সের মাছ উড়ে গেল, দু সের আলু উড়ে গেল ইত্যাদি।

মধ্যে মধ্যে সংসারের টানাটানির জন্যে বাবার এই খেয়ালের খরচ মা বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু খরচ বন্ধ হলেও খেয়াল বন্ধ হত না। খেয়ালের ফানুর এইসব সময়ে আকাশ থেকে নেমে জমিতে কেরামতি দেখাতে থাকত। প্রতি রবিবারে বাবা নিয়ম করে বাড়িঘর পরিষ্কার করতে আরম্ভ করে দিতেন। সেই দোতলা তেতলা থেকে ভারী ভারী আসবাবপত্র একতলার উঠোনে নামিয়ে ঝাড়পৌঁছ করে আবার ওপরে তোলা হতে লাগল। মুটে-মজুর ডাকা হত না। বাবা আর আমরা তিন ভাই সকাল আটটা থেকে বেলা বারোটা অবধি জিনিসপত্র ওঠানো-নামানো করতুম। আমরা তিন ভাইয়ে বেদম হয়ে না পড়লে ছুটি হত না। কাজকর্ম বেলা বারোটার মধ্যে শেষ না হলে পরের রবিবারের জন্যে তা তোলা থাকত। এতখানি হয়েও নিষ্কৃতি ছিল না। এরপরে একটু জিরিয়ে নিয়ে বাবা নিজের হাতে আমাদের স্নান করিয়ে দিতেন। ওই সাংঘাতিক খাটুনির পর এই স্নানযাত্রাটি ছিল মুষ্টিযুদ্ধের ‘নক আউট’-এর পরও তলপেটে আর একটা ঘুষি পড়ার মতন। স্নানের পর কোনোরকমে দুটি ভাত মুখে দিয়ে সেই যে ঘুম লাগাতুম–একেবারে বেলা পাঁচটা অবধি।

প্রতি রবিবারে নিয়ম করে বাড়ির আসবাবপত্র ও নিজের সন্তানদের আয়ুক্ষয় দেখে দেখে মা একদিন বিদ্রোহ করলেন। সেইদিন থেকে বাবার বাড়ি পরিষ্কার করবার খেয়ালও ছুটে গেল।

কিন্তু খেয়ালি লোকের খেয়াল একেবারে কখনও ছুটে যায় না, বদলায় মাত্র। বাবার কিরকম খেয়াল হল যে, সংসারের আর্থিক উন্নতি করতে হবে। চাকরিতে সামান্য আয়, কিন্তু ব্যবসায় অর্থাগম কল্পনা দিয়েও মাপা যায় না। তিনি মাকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ঠিক করলেন, ব্যবসা করতে হবে। বাবার চামড়ার কারবার ভালোই চলত, কাজেই অর্থাগম ও সচ্ছল অবস্থা মা ইতিপূর্বে ভোগ করেছেন এবং বর্তমান দারিদ্র্য থেকে মুক্তিলাভের একটি উপায় বুঝি হল–এই ভেবে তিনিও বাবার প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে উঠলেন।

মূক ও বধির বিদ্যালয়ের অন্যতম স্থপয়িতা শ্রীনাথ সিংহ কাগজের স্লেট তৈরি করেছিলেন। কিন্তু খরিদ্দারের অভাবেই হোক বা আবিষ্কর্তার অবহেলার জন্যেই হোক, কাগজের স্লেট বাজারে বেরিয়েই বন্ধ হয়ে গেল। বাবার খেয়াল হল এমন স্লেট বার করতে হবে, যা দেখে বিলেতের লোকদের তাক লেগে যাবে।

তখন বাজারে নানারকম বিলিতি কাগজের স্লেট পাওয়া যেত, আর সেগুলোর কাটতিও খুব ছিল। পাথরের স্লেটের মতন ভারী নয় বলে ছেলেদের মহলে এ জিনিসটির খুব আদর ছিল।

প্রথমে বাবা বাজার থেকে নানারকম স্লেট কিনে আনলেন। তারপরে সেগুলোকে নিয়ে খোঁচাখুঁচি ধোয়াধুয়ি দিনকতক চলল। লেখবার স্লেটে পেনসিলের পরিবর্তে খুন্তির আঘাত দিলে তার ধর্মনষ্ট হবেই, বেচারা কাগজের স্লেটের পক্ষে কতক্ষণই বা আত্মরক্ষা করা সম্ভব! অস্বাভাবিক অত্যাচারে তারা দু-দিনেই ছতরে গেল। এইভাবে বাবা প্রমাণ করে দিলেন যে, এই অপদার্থ স্লেটগুলো মোটেই শিশুদের উপযোগী নয়। তিনি ঠিক করলেন, এমন স্লেট বানাবেন যা জলে নষ্ট হবে না, আগুনে পুড়বে না, খুন্তি দিয়ে কোপালেও ভাঙবে না, মাটির তলায় পুঁতে রাখলেও ক্ষয় হবে না। একটা স্লেট কিনলে তিন পুরুষ চলবে।

পূর্বপক্ষ প্রশ্ন করতে পারেন, যে জিনিস একটা কিনলে তিন পুরুষ চলে, সে জিনিসের ব্যবসা করে এক পুরুষে বড়লোক হওয়া যায় কি না?

বাবার উত্তর ছিল, শিলনোড়া কিংবা ঢেঁকির কারবার করেও তো লোকে বড়লোক হয়, অথচ ঢেঁকি বা শিলনোড়া সাতপুরুষ চলে।

এ ছাড়া আরও একটা হিসাবও তাঁর ছিল। সেটি হচ্ছে পৃথিবীতে সমস্ত পরিবারে তাঁর স্লেট যদি একটি করেও বিক্রি হয়, তা হলে তার যা লাভ হবে তা দিয়ে তাঁর পরের চোদ্দপুরুষ পায়ের ওপর পা দিয়ে বসে খেতে পারবে।

স্লেট তৈরি হতে লাগল মহাসমারোহে। সমারোহে এই জন্যে বলছি যে, সমারোহ নেই এমন ব্যাপারের প্রতি বাবার কোনো আকর্ষণই ছিল না, নিশ্চিত অর্থাগম হতে পারে এমন কাজেও নয়।

বাবা প্রথমেই স্থির করলেন, বিলিতি কাগজের স্লেটের বদলে তিনি করবেন টিনের স্লেট। কাগজের চাইতে টিন স্থায়ী জিনিস এবং গোড়াতেই বনেদ বিলিতির চেয়ে শক্ত করে পত্তন না করলে প্রতিযোগিতায় দাঁড়াতে পারা যাবে কেমন করে?

প্রথমে এল এক বস্তা বালি ও তার সঙ্গে বিলিতি সিমেন্ট এক পিপে। বাবা বিকেল সাড়ে পাঁচটার সময় আপিস থেকে বাড়ি ফিরতেন। বিকেলে বাড়ি ফিরেই রাত্রি সাড়ে সাতটা আটটা অবধি আর ওদিকে ভোর চারটের সময় উঠে সকাল সাতটা অবধি প্রতিদিন সেই বালি শিলে বেটে বেটে, ছেঁকে মিহি করা হতে লাগল। সপ্তাহ দুয়েক এই পরিশ্রমের পর এক বস্তা বালি মিহি হল। তারপরে কাঠকয়লাগুঁড়ো, জাপান-ব্ল্যাক, লোহাচুর, তার্পিন তেল, গর্জন তেল, কোপাল বার্নিশ ও তার সঙ্গে আরও কত কি মিশিয়ে তৈরি হল এক অপূর্ব মশলা। সমস্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে সম্ভবত সমারোহের কিছু অভাব বোধ হওয়ায় বাবা ছাতের ওপরে একটি বিরাট উনুন ফাঁদলেন। যজ্ঞিবাড়ির কড়ার মতন বড় এক ঢালাইয়ের কড়া কেনা হল। তারপরে এক রবিবারের সকালে সেই আধ-মণ-কয়লা-ধরে এমন রাক্ষুসে উনুনে আগুন দিয়ে চড়ানো হল অপূর্ব মসলা।

ঘণ্টা দুয়েক নাড়ানাড়ি করে সেই বিরাট কড়া আমরা চার বাপ-বেটায় ধরে উনুন থেকে নামিয়ে ছোট ছোট চ্যাপ্টা বুরুশ দিয়ে টিনের গায়ে বেশ করে লাগিয়ে রোদে শুকোতে দিয়ে দিলুম।

পরের দিন পেনসিল দিয়ে স্লেটে লিখে দেখা গেল, লেখা ফুটছে বটে, কিন্তু তেমন স্পষ্ট নয়। তেল বেশি হয়ে গিয়েছে বলে বাবা আফশোস করতে লাগলেন।

এক ভিয়েনেই আধ মণ কয়লা পুড়তে দেখে ও বাবার অর্ধস্ফুট আফশোস শুনে ব্যবসা সম্বন্ধে মার উৎসাহ একেবারে কমে গেল। বাবার এই অকৃতকার্যতায় মা যে অপ্রসন্ন হয়েছেন, সেটা আন্দাজ করেই বোধ হয় বাবা এর পরের দু-তিন রবিবার আর কোনো আয়োজন করলেন না। দুটো তিনটে রবিবার আমরা বিশ্রাম পেয়ে গেলুম।

উৎসাহের প্রথম ধাক্কাতেই এইরকম বাধা পেয়ে বাবার হালচালও যেন কিরকম হয়ে পড়ল। আমাদের পড়াবার সময় শাসন হয়ে গেল শিথিল। আহার সম্বন্ধে ঔদার্য ছিল তাঁর অপরিমিত, কিন্তু সেক্ষেত্রেও বিপরীত ব্যবহার লক্ষিত হতে লাগল। সকলের চাইতে আশ্চর্যের বিষয়, তাঁর সকাল-সন্ধ্যার উপাসনার সময় পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত হয়ে পড়ল। যে ভগবানকে নিশিদিন তৈলদান করা সত্ত্বেও প্রয়োজনের সময় যিনি তৈল-নিয়ন্ত্রণ করলেন না, তাঁর ওপরে অভিমান হওয়া স্বাভাবিক; কিন্তু যে মনস্তত্ত্বের ফলে মানুষ তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়, বাবার মন অথবা দেহ সে উপাদানে তৈরি ছিল না। মাসখানেক যেতে-না-যেতে আবার চাঙ্গা হয়ে এক শনিবারের সান্ধ্য-উপাসনার পর তিনি ঘোষণা করলেন, কাল সকালে আবার স্লেটের ভিয়েন চড়ানো হবে।

মা বললেন, আমি কিন্তু আগে থাকতে বলে দিচ্ছি, কয়লা দিতে পারব না। সেদিন সংসারের আধ মণ কয়লা খরচ হয়ে গিয়েছে।

বাবা বৃথা বাক্যব্যয় করলেন না।

পরদিন সকালবেলা চায়ের পালা সাঙ্গ হবার পর বাবা ভিয়েনের আয়োজন শুরু করে দিলেন। কড়া ও অন্য সব সরঞ্জামাদি ছাতের ওপরে তোলার পর তিনি আমাদের নিয়ে ঢুকলেন সেই অন্ধকার ঘরে, সেখানে তাঁর বহুদিনের সঞ্চিত পুরনো কাঠের আসবাবপত্র বোঝাই করা ছিল। বেছে বেছে একটা বড়গোছের ডেস্ক টেনে বার করে ছাতে গিয়ে সেটাকে ভেঙে চুর করা হল। তারপরে তাতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন ধরিয়ে চড়িয়ে দেওয়া হল সেই বিরাট কড়া। একটা ডেস্কে সামলাতে পারা গেল না, আরও কতকগুলো মোটামোটা চেয়ার ইত্যাদি নিয়ে এসে ছাতের ওপরে দড়াদ্দড় ভাঙা হতে লাগল। দেখতে দেখতে প্রায় অর্ধেক আসবাব চলে গেল সেই বিরাট উনুনের গহ্বরে। কত অশ্রু, অনুনয়, গৃহবিপ্লব, কত আইন-আদালত ও চিৎকারের স্মৃতি-বিজড়িত সেইসব আসবাব ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে ভস্মস্তূপে পরিণত হল।

বাবা সেই বিরাট খুন্তি দিয়ে ক্ষিপ্রহস্তে স্লেটের মশলা নাড়তে নাড়তে আমাদের বলতে লাগলেন, এনামেল যে ব্যক্তি আবিষ্কার করেছিল, তারও ঘরে এমনই কয়লার অভাব ঘটায় সে তার অতি প্রিয় আসবাবপত্র এমনই আগুনে আহুতি দিয়েছিল। সেদিন যদি সে আসবাবের মায়ায় সে-কাজ না করত, তা হলে জগতের লোক এনামেলের বাসনরূপ প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে বঞ্চিত হত। তার স্ত্রীও–

এমন সময়ে দূরে দেখা গেল, মা আসছেন। বাবা আর কিছু না বলে জোরে তাড়ু হাঁকড়াতে লাগলেন।

এনামেল-আবিষ্কারকের স্ত্রীর কাহিনীটা এ-জীবনে আমাদের কাছে অজ্ঞাতই রয়ে গেল। যা হোক, ঘণ্টা দুয়েক ধস্তাধস্তির পর কড়া নামিয়ে বুরুশ দিয়ে সেই মসলা টিনের গায়ে লাগিয়ে আমরা স্নান করতে গেলুম। সেদিন ও পরের দিন সেগুলো রোদে শুকোবার পর লিখে দেখা গেল, চমৎকার স্লেট তৈরি হয়েছে।

বাবার এবারকার সাফল্যে বাড়িময় আনন্দের সাড়া পড়ে গেল। অদূর ভবিষ্যতে যে ধনরাশি আমাদের ঘরে এসে জমা হবে, কি করে তার সদ্ব্যবহার করা হবে, সেই দুর্ভাবনায় তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। বাড়িতে নানা রকমের ব্যবসাদার লোক আসতে লাগল–গুজরাটি, ভাটিয়া, মাড়োয়ারি প্রভৃতি। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় তাদের সঙ্গে বাবার কথা চলতে লাগল। কার সঙ্গে ব্যবসা আরম্ভ করা যেতে পারে–এই নিয়ে রোজ দুপুররাত্রি অবধি বাবাতে আর মাতে আলোচনা, পরামর্শ ও তক্কাতক্কি চলতে লাগল। শেষকালে এক গুজরাটি ধনীর সঙ্গে ঠিক হল যে, সে মাসে পঁচিশ হাজার স্লেট নেবে এবং প্রত্যেক তিন মাস অন্তর হিসাব পরিশোধ করবে। এই ব্যক্তির ভারতবর্ষ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও মরিশসে খুব বড় কারবার আছে, তার জন্যে দু-তিনজন ধনী জামিনও দাঁড়ালে। উৎসাহের চোটে বাবা একেবারে দিগ্বিদিকৃজ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লেন।

ব্যবসা শুরু হবার আগেই বাবা ঠিক করে ফেললেন, আমাদের তিন ভাইকে বিলেতে Public School-এ পাঠিয়ে দেবেন। তাঁর এক ইংরেজ মহিলাবন্ধু ছিলেন। তিনি ক্রিশ্চান প্রচারিকা, নাম ছিল মিস গিলবার্ট। তিনি প্রায়ই বাবাকে বলতেন, লেখাপড়া যদি শেখাতে চাও তো ছেলেদের বিলেত পাঠিয়ে দাও। মিস গিলবার্ট বিলেতে Eton, Harrow, Rugby ইত্যাদি ইস্কুলের নিয়মাবলীর জন্যে চিঠি লিখতে লাগলেন। দু-দিন বাদে বিলেতে পড়তে যাব–এই ধারণায় আমরা তিন ভাই ধরাকে সরা জ্ঞান করতে লাগলুম।

ওদিকে প্রতিদিন হিসাব চলতে লাগল। মাসে পঁচিশ হাজার স্লেট তৈরি করতে বেশ কিছু অর্থের প্রয়োজন। বাবা এদিকে সেদিকে টাকার জন্যে ঘোরাঘুরি করতে লাগলেন। কিছু অর্থের জোগাড় হল বটে, কিন্তু সে এত অল্প যে, তা নিয়ে ব্যবসায় নামতে বাবা পর্যন্ত সাহস করলেন না। ওদিকে যারা শ্লেট নেবার জন্যে তৈরি হয়েছিল, তারা এপক্ষের কোনো গা নেই মনে করে নিরুৎসাহ হয়ে পড়তে লাগল।

ওদিকে বিলেত থেকে খবল এল, আমাদের যে বয়েস সে বয়েসে Public School– এ ঢোকা চলবে না। তার আগে বছর চারেক আর এক জায়গায় পড়াশোনা করতে হবে। মিস গিলবার্ট তার সমস্ত ব্যবস্থা ঠিক করে ফেলেছেন, বাবাকে সে সম্বন্ধে কিছুই ভাবতে হবে না।

কিন্তু টাকার জোগাড় কিছুতেই হল না। আমাদের মানস-তুবড়ি মাস ছয়েক ধরে কল্পনার ফুলঝুরি কেটে একদিন ফুস করে নিবে গেল। একদিন সন্ধ্যাবেলা ঘণ্টা দুই ধরে “তোমার ইচ্ছা হউক পূর্ণ করুণাময় স্বামী” গানটি গেয়ে আবার নবোদ্যমে বাবা আমাদের নিয়ে পড়াতে বসলেন। কোথায় গেল Eton, Harrow, আর কোথায় রইল Lake Lomond-এর ধারে মিস গিলবার্টের বন্ধুর সেই Private School, যেখানে চার বছর পড়ে আমরা Eton-এ ঢুকব! বরাতে আছে নিমতলা ঘাটের ড্রফ সায়েবের ইস্কুলে, কে তা খণ্ডাতে পারে!

মাস তিন-চার মনমরা হয়ে কাটাবার পর হঠাৎ একদিন বাবা দপ করে জ্বলে উঠলেন। আমাদের ছোট ভাই শিশুকালে পেটের অসুখে বড্ড ভুগত বলে তাকে অ্যারারুট খাওয়ানো হত। নিত্য পয়সা খরচ করে অ্যারারুট আনতে আনতে তাঁর মনে হল, অ্যারারুটের ব্যবসা করলে মন্দ হয় না। তিনি ঠিক করলেন, অ্যারারুটের ব্যবসা করতে হবে। এবার কিছু আটঘাট বেঁধে আরম্ভ করার ফলে সত্যিই তাঁর অ্যারারুট বাজারে বেরুল।

তখন প্রায় পাঁচ বছর অন্তর কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশন হত। এই সময় এখানে বিডন উদ্যানে কংগ্রেস হয়েছিল এবং তার সঙ্গে ভারতীয় শিল্প-প্রদর্শনীও খোলা হয়েছিল। আমাদের অ্যারারুট দেখাবার জন্যে এখানে ‘স্টল’ নেওয়া হল। যারা প্রদর্শনীতে ‘স্টল’ নিয়েছিল, কৰ্তৃপক্ষ কংগ্রেস দেখার জন্যেও তাদের টিকিট দেওয়ায় আমরা কংগ্রেস দেখতে গিয়েছিলুম।

ছেলেবেলায় আমাদের মনে ধারণা করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, কংগ্রেস হচ্ছে আমাদের জাতীয় মহাসভা। আমরা যে পরাধীন এবং পরাধীন অবস্থা যে অত্যন্ত হেয়–এ কথা বাবার মুখে নিয়ত শুনতুম, ও কেন জানি না, আমাদের মনে হত, এই জাতীয় মহাসভা আমাদের পরাধীনতার শৃঙ্খল মোচন করবে। কিন্তু হায়, আমাদের শিশুচিত্র যখন স্বাধীনতার মুক্ত আবহাওয়ার জন্যে ছটফট করতে থাকত, সেই সময় আমাদের বিজ্ঞচিত্তরা কংগ্রেসে বসে পরামর্শ করতেন, কেমন করে শাসকের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা আরও মধুরতর করা যেতে পারে।

সেবারের কংগ্রেস সভাপতি হয়েছিলেন দিনশা ইদালজী ওয়াচা। তখন কংগ্রেস জিনিসটি যে কি বিচিত্র ব্যাপার ছিল, তার বিবরণ দিতে গেলে শুধু তাতেই একটা বড় কেতাব হয়ে যাবে। কত রকমের লোক, কত রকমের শিরস্ত্র, তার আর ইয়ত্তা নেই। অধিকাংশ বাঙালির অঙ্গেই কোট-প্যান্টলুন। তখনকার জাতীয় নেতারা যেভাবে কংগ্রেস-রথটিকে ঠেলে নিয়ে চলেছিলেন, তাতে বহু শতাব্দী পরে সে রথ হয়তো ইংল্যান্ডের উপকূল অবধি পৌঁছতে পারত, স্বাধীনতার তোরণের নীচে গিয়ে দাঁড়াবার কল্পনাও তাঁরা করতে পারতেন না। যাঁদের মনে সে কল্পনা উঁকি দিত, তাঁরা এই সভায় প্রায় অপাঙ্ক্তেয় ছিলেন। মহাত্মা গান্ধী কংগ্রেস-পুতুলকে রক্তমাংসে গঠিত মানুষে দাঁড় করিয়েছেন–এ কথা অস্বীকার করে, এমন পাষণ্ড বোধ হয় কেউ নেই।

এই কংগ্রেসে প্রথম প্রফেসার মূর্তজাকে দেখি। ইনি একজন ব্যায়ামবীর ছিলেন। ছোট লাঠি ও তলোয়ার খেলায় তাঁর অদ্ভুত নৈপুণ্য ছিল। বেঁটেসেঁটে বলিষ্ঠ বজ্রবাঁটুলের মতন চেহারাটি, ধবধবে ফরসা রঙ। ধর্মে ছিলেন মুসলমান, কিন্তু জাতিতে যে কি ছিলেন, তা তাঁর সঙ্গে মিশেও আমরা বুঝতে পারিনি। ভদ্রলোক বোধ হয় কিছু নেশা করতেন, কারণ চোখ দুটো সৰ্বদাই লাল টকটকে থাকত। কখনও বলতেন, আমার বাড়ি তুর্কে; কখনও বলতেন, ককেশাসে। থাকতেন শ্রীরামপুরে, কত বাঙালি হিন্দুর ছেলে যে তাঁর শাগরেদ ছিল তার ঠিকানা নেই। ভবিষ্যতে আমরাও তাঁর শাগরেদ হয়েছিলুম। মূর্তজা-সায়েব, ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে আমাদের সঙ্গে কথা বলতেন। ইংরেজ গবর্মেন্ট সম্বন্ধে এমন সব গরম গরম কথা বলতেন, যা আজকের দিনেও অকুতোভয়ে প্রকাশ করতে অনেকে সাহসী হবেন না। বিচিত্র হালচাল ছিল এই প্রফেসার মূর্তজার, যাঁরা তাঁর নিকট-সম্পর্কে এসেছেন তাঁরাই এ কথা জানেন। মূর্তজা জনপ্রিয়ও কম ছিলেন না, সে-সময় কলকাতার প্রায় সব লোকই তাঁকে চিনত এবং সম্ভ্রম করত।

এই স্বদেশি শিল্পপ্রদর্শনী ও কংগ্রেসের মধ্যে যা কিছু আশ্চর্য জিনিস চোখে পড়েছিল তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে, বাঙালি দেশোদ্ধারকারীদের ইংরেজি পোশাক। দ্বিতীয়, প্রফেসার মূর্তজা। তৃতীয়, মাঠের মধ্যে সূর্যালোক চৌকো-চৌকো আয়না সাজিয়ে তারই উত্তাপ দিয়ে লুচিভাজা। চতুর্থ, রেভারেন্ড লালবিহারী সাহার অন্ধ বিদ্যালয়ের ছাত্রদের বই-পড়া।

এই প্রদর্শনীর হাঙ্গামা চুকে যাবার পরই ডফ কলেজ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আমাদের অন্য আর একটা ইস্কুলে ভর্তি করা হল। ডফ কলেজ আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় দু-মাইল দূরে ছিল। প্রতিদিন দু-বেলা এতখানি রাস্তা টানা-পোড়েন করা যে ঠিক নয়, এতদিন বাদে তা বুঝতে পেরে বাবা এবার বাড়ির কাছেই একটা ইস্কুলে আমাদের ভর্তি করে দিলেন। এই ইস্কুলের হেডমাস্টার ও যাঁর ইস্কুল, তাঁরা হলেন ব্রাহ্ম। তখনকার দিনে মালিকিয়ানা হিসেবে অনেকে ইস্কুলের ব্যবসা করতেন; বিশ্ববিদ্যালয়কে ধন্যবাদ, তাঁরা এই সমস্ত ব্যক্তিগত কারবার তুলে দিয়ে সমস্তটাই নিজেদের যৌথ-কারবারে টেনে নিয়েছেন।

ডফ সায়েবের ইস্কুলের চাইতে এই ইস্কুল আমার ঢের ভালো লাগল। তার প্রধান কারণ, এখানে আমার বন্ধু শচীন যে ক্লাসে পড়ত, ভাগ্যবশে আমি সেই ক্লাসে এসেই ভর্তি হলুম। এখানে ক্লাসে ছেলের সংখ্যা ও মারধরের মাত্রা ছিল অনেক কম। একটা মুশকিল ছিল এই যে, ছাত্রের সংখ্যা কম থাকায় প্রত্যেক শিক্ষকই প্রত্যেক ছাত্রকে পড়া জিজ্ঞাসা করবার সুযোগ পেতেন ও তার ফলে কৈ যে কেমন ছেলে তা ক্লাসের সব ছেলেই জানত।

অতীতের দিকে চেয়ে আজ মনে হয়, প্রত্যেক মানুষই তার ভাগ্য সঙ্গে করে নিয়ে আসে। তার জীবন কি ভাবে গড়ে উঠবে, কি অবস্থার মধ্যে তার মন তৈরি হবে, যাত্রাপথে চলতে চলতে কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হবে, কাদের সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে, কত লোক সারা জীবন কাছে থেকেও আপনার হবে না, কত লোক দুদিনের পরিচয়ে আপনার হয়ে যাবে–সব আগে থেকেই নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে, কোনো শক্তি দিয়েই তাকে প্রতিরোধ করা যায় না।

আমার বন্ধু শচীনের বাড়ির লোকেরা আমাকে সাংঘাতিক চরিত্রের ছেলে বলে জানত। ছ-সাত বছর বয়েস থেকে সানডে-ইস্কুলে যে দুর্নাম কিনেছিলুম, আজও তা স্খালন করতে পারিনি। এই কারণে আমার এই ইস্কুলে ভর্তি হওয়াটা শচীনের বাড়ির লোকেরা বিশেষ সুনজরে দেখলেন না, বিশেষ শচীনের বাবা ছিলেন সেই ইস্কুলের মালিক

শচীন আগে থাকতেই ক্লাসের সেরা ছেলে বলে নাম কিনেছিল। আমি এসে জুটতেই একেবারে মণিকাঞ্চন যোগ হল। এখানে টমরী বা বেত্রদণ্ডের রেওয়াজ তেমন ছিল না বটে, কিন্তু প্রায় সব মাস্টারই দেখতুম অকারণে অথবা সামান্য কারণেই শচীনকে নিদ্দম ঠেঙাতেন। শচীনের বাবা মাস্টারদের বলে দিয়েছিলেন, তার প্রতি যেন কড়া নজর রাখা হয়। সেইজন্যে শিক্ষকরা এইভাবে তাঁদের চাকরি বজায় রাখেন।

শচীন আমার শৈশবের বন্ধু, তার প্রতি অকারণ এই অকরুণ ব্যবহার দেখে আমার মন বিদ্রোহী হয়ে উঠল। ফলে দুই বন্ধুতে মিলে মাস্টারদের সঙ্গে তর্ক করে মধ্যে মধ্যে এমন হাঙ্গামা শুরু করে দিতুম যে, আমাদের শায়েস্তা করবার জন্যে হেডমাস্টার মহাশয়ের কাছে ধরে নিয়ে যাওয়া হত।

কিছুদিন এইভাবে চলার পর মাস্টারেরা ক্লাসে এসেই আমাদের দুজনকে দু-জায়গায় বসিয়ে দিতে আরম্ভ করলেন। দুই মাথা একত্র হলেই যে অনর্থের সূত্রপাত হয়, বহুদর্শিতার ফলে তাঁরা সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। তাঁরা শচীনকে চোখের সামনেই অর্থাৎ ‘ফার্স্ট বেঞ্চে’ আর আমাকে শেষে অর্থাৎ একেবারে ‘লাস্ট বেঞ্চে’ বসতে হুকুম দিলেন। লাস্ট বেঞ্চে একটি মাত্র ছেলে বসততা, তার নাম ছিল প্রমথ। আমার স্থান নির্দিষ্ট হল এই প্রমথর পাশে।

প্রমথ আমাদের চাইতে দু-তিন বছরের বড় ছিল, কিন্তু তাকে দেখলে আট-ন’ বছরের চেয়ে বেশি বলে মনে হত না। রোগে, বোধ হয় ম্যালেরিয়ায়, ভুগে ভুগে তার দেহের বাড়-বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সাতজন্মে সে স্নান করত না। চুলগুলো পাতলা, তা থেকে খুশকি উড়ছে, হাতের তেলো থেকে আরম্ভ করে সর্বাঙ্গ ফাটা, আর সেই ফাটার মধ্যে ময়লা জমে থাকায় মনে হত যেন তার গায়ে ম্যাপ এঁকে দেওয়া হয়েছে। ফুল প্যান্ট, লম্বা কোট পরে, এক তাড়া বই নিয়ে সে ইস্কুলে আসত। পড়াশুনো কিছুই করত না সে, গেল বছর বার্ষিক পরীক্ষায় ফেল হওয়ায় এই ক্লাসেই পড়ে আছে। মাস্টারেরা স্রেফ দয়া পরবশ হয়ে তাকে কোনো প্রশ্ন করতেন না।

প্রতিদিন ইস্কুল বসবার মিনিট পাঁচেক আগে এক তাড়া বই নিয়ে ক্লাসে ঢুকে তার নির্দিষ্ট জায়গাটিতে গিয়ে বসততা, সমস্ত দিন কারুর সঙ্গে কথা বলত না। ক্লাসের কোনো ছেলের সঙ্গেই তার ঝগড়া বা ভাব ছিল না। ছুটির ঘণ্টা বাজলে বিনা উচ্ছ্বাসে বইগুলি গুছিয়ে নিয়ে সে চলে যেত। মাস্টারেরা চূড়ান্ত সাজা দেবার জন্যে এই রহস্যময় প্রমথর পাশে আমাকে বসবার হুকুম দিলেন।

প্রমথর পাশে বসে সারাদিন তার হালচাল পর্যবেক্ষণ করতে লাগলুম। দেখলুম, কখনও সে খেয়ালমতো তার সেই বইয়ের তাড়া থেকে একখানা বই টেনে নিয়ে পড়ছে, কখনও-বা খাতা খুলে কি লিখছে, কখনও-বা একটার পর একটা এমনই করে পাঁচ-সাতটা পেনসিলই কাটছে। পেনসিল-কাটা কল, হাড়ের বাঁটওয়ালা ছুরি, ছুঁচমুখো Independent pen, মোটা লাল-নীল পেনসিল–কোনো সরঞ্জামের ত্রুটিই তার কাছে নেই। ক্বচিৎ কোনো শিক্ষক তাকে পড়ার প্রশ্ন করলে, সে দাঁড়িয়ে নীরব থাকত। শিক্ষক সে ইঙ্গিত বুঝতে পেরে অন্য ছাত্রকে প্রশ্ন করতেন, প্রমথ বসে পড়ত। এই কর্মতৎপর, স্বল্পভাষী, ক্লাসে বসেই তার পরিবেশ সম্বন্ধে সম্পূর্ণ উদাসীন প্রমথর মধ্যে আমি একটা রহস্যের ইঙ্গিত পেলুম।

একদিন অঙ্ক’র ঘণ্টায় দেখলুম, প্রমথ তার বইয়ের তাড়া থেকে বেঁটেসেঁটে চৌকো একখানা সুদৃশ্য লাল বই টেনে বার করে নিবিষ্ট মনে পড়তে আরম্ভ করে দিলে। আমাদের বাড়িতে বইয়ের যে রাশি আবিষ্কার করেছিলুম তার মধ্যে ঠিক এইরকম আকৃতির কালো মলাটের একখানা বই ছিল। সে বইখানার নাম ‘ত্রৈলোক্য তারিণীর জীবন বা পাপীর আত্মকথা’–এইরকম একটা কিছু। বইখানা প্রথম যেদিন খুলে বসেছি, সেইদিনই মার চোখে পড়ায় তিনি সেখানা পড়তে বারণ করে দিয়েছিলেন। ফলে একদিনেই বইখানা শেষ করে ফেলেছিলুম। সে বইয়ের কাহিনি ছিল লোমহর্ষক। এক গৃহস্থের কন্যাকে এক বৈষ্ণবী ফুসলিয়ে কুলত্যাগ করায়। শেষকালে মেয়েটি ধাপে ধাপে নামতে নামতে নরহত্যা পর্যন্ত করতে আরম্ভ করে। অনেকগুলি নরনারী হত্যা করার পর ধরা পড়ায় তার ফাঁসি হয়। কাহিনিটা খুব ভালো না লাগলেও আমার কি জানি ধারণা হয়েছিল যে, নিষিদ্ধ পুস্তকগুলির আকারই ওরকম ছোট ধরনের হয়ে থাকে। প্রমথর এই বইখানা ‘পাপীর আত্মকথা’-জাতীয় কোনো বই মনে করে তার পাশে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, কি পড়ছিস রে?

প্রমথ চমকে উঠে চট করে বইখানা বন্ধ করে ফেললে। দেখলুম, মলাটের ওপরে রুপোর জলে বড় অক্ষরে লেখা–’গীতা’।

এক মুহূর্তেই প্রমথর প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গি সম্পূর্ণ রূপান্তরিত হয়ে গেল। সেই অতি ক্ষীণ, জরাগ্রস্ত, হেয়, গায়ের বোটকা গন্ধে যার কাছে বসতে আমরা ইতস্তত করতুম এমন যে প্ৰমথ, সে আমার কাছে মহনীয় হয়ে উঠল।

আমাদের বাড়িতে বাবা ও তাঁর বন্ধুদের মধ্যে যে-সব ধর্মকথা ও ধর্মপুস্তকের আলোচনা হত তাই শুনে শুনে বেদ, বেদান্ত, সাংখ্য, পাতঞ্জল, গীতা প্রভৃতি সম্বন্ধে এমন সব চটকদার কথা আমরা আয়ত্ত করেছিলুম এবং মাঝে মাঝে তালমাফিক ছাড়তুম, যা শুনে অভিভাবকেরা আমাদের সম্বন্ধে আশান্বিত, শিক্ষক-সম্প্রদায় ক্রোধান্বিত এবং বন্ধু-সম্প্রদায় আমাদের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে উঠত। বুলিচালি ছাড়লেও বেদ, বেদান্ত বা গীতা প্রত্যক্ষ করবার সৌভাগ্য এপর্যন্ত হয়ে ওঠেনি।

যে গীতার কথা এতদিন অতি সম্ভ্রমের সঙ্গে স্মরণ করে এসেছি, সেই গীতা প্রমথর বইয়ের তাড়ার মধ্যে! এর চেয়ে বিস্ময়ের বস্তু আর কি হতে পারে।

বিস্ময়টা যতদূর সম্ভব চেপে জিজ্ঞাসা করলুম, কি রে! গীতা পড়ছিস?

প্রমথ কিছু না বলে একটু হাসল মাত্র। সে হাসির অর্থ–এতদিনে দেখলি! ও তো হাতের পাঁচ।

জিজ্ঞাসা করলুম, তুই গীতা মুখস্থ করিস বুঝি?

প্রমথ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, ও মুখস্থ হয়ে গিয়েছে কবে, তিন-চার বছর আগে। তারপরে গম্ভীর হয়ে বললে, গুরুর আদেশ কিনা!

সেদিন ড্রয়িং-মাস্টারের ঘণ্টায় আড্ডা না দিয়ে প্রমথর সঙ্গে গীতা নিয়ে আলোচনা হল। প্রমথর গীতাখানার পেছনে ‘মোহমুদ্‌গর’ কবিতাটিও ছিল। সে আমাকে সুর করে ‘মোহমুদ্‌গর’ আবৃত্তি করে শোনালে। ভারি ভালো লাগল।

পরের দিন প্রমথ জানালে যে সে শিগগিরই সংসার ত্যাগ করে জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করবে।

তার গুরুর আদেশ।

পরের দিন ইস্কুল বসবার অনেক আগেই প্রমথ এসে আমাকে আর একবার সুর করে ‘মোহমুদ্‌র’ শোনালে। উপরি উপরি তিন দিন নিয়মিত মুদ্‌গরের আঘাতে আমার মোহ প্ৰায় বোতলচুরের অবস্থা প্রাপ্ত হওয়ায় প্রমথকে বললুম, তোর সঙ্গে আমিও সংসার ত্যাগ করে জঙ্গলে গিয়ে তপস্যা করব।

আমার প্রস্তাব শুনে প্রমথ উৎসাহিত তো হলই না, বরং মুখ গম্ভীর করে রইল, কিছু জবাব দিলে না।

আমার মতন একটা লোক সঙ্গী হতে চাইছে, তাতে আনন্দ প্রকাশ না করে প্রমথ গম্ভীর হয়ে পড়ল দেখে আমার আত্মাভিমানে আঘাত লাগল। কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলুম, কি রে?

প্রমথ বললে, তোরা আবার বেম্ম কিনা-

অগ্নিতে ঘৃতাহুতি পড়ল। বললুম, যা যা ব্যাটা ম্যানচেস্টার! বেম্মরা ছিল বলে আজ তোরা ভদ্রলোকের সঙ্গে একত্র বসতে পারছিস।

প্রমথ বললে, রাগ করছিস কেন ভাই? আমি কি তোকে কিছু গালাগালি দিয়েছি? বেম্মরা যোগ-টোগ মানে না কিনা, তাই বলছিলুম।

প্রমথর সঙ্গে খুব ভাব জমে গেল। ঠিক হল, আমরা দুজনে জঙ্গলে গিয়ে, তপস্যা করব। প্রমথ কোথা থেকে–খুব সম্ভব সেগুলো বটতলা থেকে প্রকাশিত হত–সব ধর্মগ্রন্থ নিয়ে আসতে লাগল। তাকে দিয়ে একখানা ‘গীতা’ও আনিয়ে নিলুম। রোজ বিকেলে ঘুড়ি ওড়াবার আধ ঘণ্টা আগে গীতার শ্লোক, মায় বটতলার ভাষ্য, কণ্ঠস্থ করে রাতে অস্থিরকে গীতা সম্বন্ধে লেক্‌চার দেওয়া চলতে লাগল। মোট কথা, জগৎ মায়াময় ও বিরাট একটি যাতনা-যন্ত্র, সে বিষয়ে আমার আর কোনো সন্দেহই রইল না। যন্ত্রণা থেকে উদ্ধারের একমাত্র পন্থা যে যোগ, তারই অনুশীলনে মনকে মাসখানেকের মধ্যে একাগ্র করে ফেলা গেল। একদিন প্রমথ একখানা ম্যাপ নিয়ে এল। ভারতের কোথায় কোথায় জঙ্গল আছে, কোন জঙ্গলে কি কি শ্রেণীর জীব ও গাছপালা আছে, তার বিবরণ তার সঙ্গে দেওয়া ছিল। এই ম্যাপ দেখে আমরা একটা গভীর জঙ্গল ঠিক করলুম, বটে; কিন্তু কি করে কোথা দিয়ে যে সেখানে পৌঁছতে পারা যাবে, ম্যাপ দেখে তা কিছুতেই ঠিক করতে পারলুম না। শেষকালে অনেক পরামর্শ করে ঠিক হল যে, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে চলতে চলতে পথে জঙ্গল নিশ্চয় পাওয়া যাবে। বেশ ঝরনা-টরনা ও ভালো ভালো ফলমূলের গাছ আছে, এমন একটা জঙ্গল দেখে ঢুকে পড়ে সেখানে আসন পাতা যাবে।

প্রস্তাবটা দুজনেরই আমাদের বেশ লাগল। গীতাপাঠ ও তপস্যার আনুষঙ্গিক মানসিক ক্রিয়াকর্মের ওপর মন নিবিষ্ট করবার জোর চেষ্টা চলতে লাগল।

এই ইস্কুলে এসে মাস্টারদের প্রশ্ন ও তদুপযোগী চাঁটি, গাঁট্টা ও বহুবিধ তাড়নার ইঙ্গিতে আমার উদ্দাম মন পাঠে কথঞ্চিৎ মনোনিবেশ করেছিল মাত্র, এমন সময় সংসারে দারুণ বৈরাগ্য উপস্থিত হল। পড়াশুনো চুলোয় গেল, ফলে শ্যাম ও কুল অর্থাৎ ইস্কুল ও বাড়ি–দু-জায়গাতেই নির্যাতনের মাত্রা হয়ে উঠতে লাগল নির্মমতর।

একদিন প্রমথকে জিজ্ঞাসা করলুম, আচ্ছা, জঙ্গলে কোনোদিন যদি বাঘ-টাঘ আসে?

প্রমথ বললে, সে তুই কিছু ভাবিসনি। আমার কাছে গুরুর দেওয়া একটা বাণ আছে, যেটাকে জলে ভিজিয়ে সেই জল যে-কোাে জিনিসে ঠেকানো যাবে তাই মারাত্মক হয়ে উঠবে।

বলিস কি! কি রকম শুনি?

সে বাণের গুণ এই যে, কোনোরকমে একবার কারুর পাঁজরায় ঠেকাতে পারলেই হল, তা বাঘই হোক আর মানুষই হোক, তাকে আর বাঁচতে হবে না।

উঃ! প্রমথটা কি? আমার তো ভিরমি লাগবার উপক্রম হতে লাগল।

প্রমথ বলে যেতে লাগল, এই বাণ তার গুরুর দেওয়া। গুরুদেব গভীর রাত্রে ঘুমের মধ্যে রোজ তাকে দেখা দেন। বাড়ির কেউ কিছু জানতে পারে না, কারণ তার দেহটা বিছানায় পড়ে থাকে, তার আত্মাটা গুরুর সঙ্গে চলে যায় বাগানের এক কোণে, সেইখানে তিনি তাকে যোগ শিক্ষা দেন। গুরু থাকেন হিমাচলের কোন এক নিভৃত গুহায়, সেখান থেকে আসতে তাঁর এক মিনিট সময়ও লাগে না।

বাপ রে! প্রমথর কথা শুনে আমি তো শিউরে উঠতে লাগলুম। এই পুঁইয়ে-মরা প্যাংলা প্রমথ, তার মধ্যে এত গুণ!

আমি দেখেছি, আমার মনের মধ্যে দুটি বোধশক্তি সর্বদা জাগ্রত থাকে। একটি শক্তি–সে যে-কোনো জিনিস শোনা বা দেখামাত্র তা থেকে সত্য তত্ত্বটি তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতে পারে, তার কাছে আর ফাঁকি চলে না। এই বোধশক্তিটি হচ্ছে আত্মরক্ষার সংস্কার, একে সত্যবোধ অথবা সংস্কারবোধ বলা যেতে পারে। এই আত্মরক্ষার সংস্কার অথবা সত্যবোধ প্রাণীমাত্রেরই আছে। আমাদের দর্শন বলেন যে, পূর্বজন্মের সমস্ত স্মৃতি আমাদের মন থেকে মুছে গেলেও মৃত্যু এবং মৃত্যুযন্ত্রণার স্মৃতি মনের অতি গভীর প্রদেশে থেকে যায়। বিপদ থেকে নিজেকে রক্ষা করবার যে সহজাত প্রবৃত্তি জীবের থাকে, তার মূল হচ্ছে গতজন্মের মৃত্যুর অভিজ্ঞতা।

মনের মধ্যে যে আর একটি বোধশক্তি আছে, তার বর্ণনা করা সহজ নয়। সে এক অদ্ভুত রাজ্য, বিচিত্র সেখানকার হালচাল। কোনো নিয়মকানুনের বেড়িতে সে বাঁধা নয়। মনের অনুকূল যে-কোনো জিনিস বা অবস্থাকে সে আঁকড়ে ধরতে চায়। তার মধ্যে অসত্য বা অসম্ভাব্য যা আছে–সংস্কারবোধ বা সত্যবোধ তা প্রকাশ করতে থাকলেও আমার মনের এই দ্বিতীয় বোধশক্তি তার ওপরে কল্পনার রঙ চড়াতে থাকে। ক্রমে সত্য ও কল্পনায় একাকার হয়ে যায়, আর সেই সত্যমিথ্যাজড়িত কল্পলোকে মহানন্দে বাস করতে থাকি। আমার অন্তরের এই দ্বিতীয় বোধশক্তি, যা কঠিন বাস্তবের ওপর নিয়ত রামধনুর রঙ চড়ায়, দেবতারা তাকে ‘কুমতি’ আখ্যা দিতে পারেন; কিন্তু এই বোধই সংসারকে আমার কাছে সহনীয় করেছে, এ না থাকলে আমার জীবমৃত্যু হত।

প্রমথ যে আমার কাছে ডাহা মিথ্যা কথা বলছে তা বুঝতে আমরা একমুহূর্তও দেরি হল না। কিন্তু মনের মায়াকাননে যে দুটি ধ্যানস্তিমিত তরুণ তাপসমূর্তির আবির্ভাব হয়েছিল, রূঢ় সত্যালোকের জ্যোতিতে তখুনি তারা শুকিয়ে যেত। বরঞ্চ আমি এমন ভাব দেখাতে লাগলুম, যাতে প্রমথ আরও উৎসাহিত হয়ে উঠতে লাগল। শেষকালে সে নিজে থেকেই বললে, তোকে গুরুদেবের শিষ্য করে দোব।

কোন বিশেষ দিনটিতে আমরা এই মায়াময় সুখ-দুঃখের সংসার পরিত্যাগ করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করব, তা নিয়ে দিনকতক আলোচনা চলল। অবশেষে প্রমথ একদিন বললে, গুরুদেব বলেছেন, তিনি নিজেই দিন ঠিক করে দেবেন।

আমি ও প্রমথ যখন সংসারত্যাগের নেশায় মশগুল, এইরকম সময়ে একদিন শচীন এসে বসল আমাদের পাশে। অনেকদিন দূরে থেকে সে আর সহ্য করতে না পেরে বিদ্রোহ করলে। আশ্চর্যের বিষয়, মাস্টারমশায়রাও সেদিন তার এই স্থানত্যাগের ব্যাপারটা লক্ষই করলেন না।

শচীনকে কাছে, পেয়েই বলে ফেললুম, আমরা দুজনে সংসার ত্যাগ করছি, দুদিনের জন্যে কেন আর কাছে বসে মায়া বাড়াচ্ছিস?

শচীন তো আমাদের প্ল্যান শুনে একেবারে অবাক। বলা বাহুল্য, সে বললে, আমিও তোদের সঙ্গে যাব।

ঠিক হল, প্রত্যেকে খানদুয়েক করে ধুতি আর দুটো করে জামা নেবে। তাতে যতদিন চলে চলবে, তারপরে বল্কল তো আছেই। ধর্মগ্রন্থের একটা ফর্দ করে ফেলা গেল। আধমণ-টাক চিঁড়ে আর সেই অনুপাতে গুড়ও কিছু চাই। আরও অন্যান্য সমস্ত জিনিস মিলিয়ে পোঁটলা যা হল, তার আয়তন প্রত্যক্ষ না করলেও সেটা যে প্রায় অভ্রভেদী হয়ে উঠেছে, তা মনশ্চক্ষে স্পষ্ট প্রতিভাত হতে লাগল।

প্রমথ বললে, বিলাসিতা করা চলবে না। তিনটে সমান ওজনের পোঁটলা করে তিনজনে বয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।

সেদিন এই পর্যন্ত ঠিক হয়ে রইল।

পরদিন শচীন ক্লাসে এসেই আমাদের বললে, পোঁটলা বয়ে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা সব ঠিক করে ফেলা গেছে।

কি রকম?

শচীন বললে, আমাদের বাড়ির পাশেই একটা মাঠ আছে, সেখানে ধোপারা কাপড় শুকোতে দেয়। এদের একটা ছেলে আমার খুব বন্ধু। সে বলেছে, পোঁটলা বয়ে নিয়ে যাবার জন্যে আমাদের সঙ্গে একটা গাধা দেবে।

আমি বললুম, তার পরে? আমরা জঙ্গলে ঢুকে গেলে গাধার কি হবে? সারাদিন তপস্যা করব, না গাধার তদারক করব?

শচীন বললে, সে ব্যবস্থা কি আমি করিনি? ধোপার ছেলে গাধা নিয়ে আমাদের সঙ্গে জঙ্গল অবধি যাবে। সেখানে আমাদের বসিয়ে-টসিয়ে দিয়ে গাধা নিয়ে আবার ফিরে আসবে।

যাক, কাঁধ থেকে মস্তবড় বোঝা নেমে গেল।

প্রমথ বললে, জানি শচেটা চিরকালই খুব ওস্তাদ।

দু-তিন দিন যেতে-না-যেতেই মাস্টারদের টনক নড়ল। শচীনকে আমাদের পাশ থেকে উঠে আবার তার পুরনো জায়গায় গিয়ে বসতে হল বটে কিন্তু তাতে বিশেষ অসুবিধা হল না। পরামর্শ ওরই ফাঁকে ফাঁকে জোর চলতে লাগল।

একদিন প্রমথ এসে বললে, কাল রাতে গুরুদেব এসে আমাদের যাত্রার দিন স্থির করে দিয়েছেন। আগামী বুধবার বেলা বারোটার মধ্যে যাত্রা করতে হবে। তিনি আমাদের তিনজনকেই আশীর্বাদ করে গেছেন।

সেদিন ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে ঘুড়ি-লাটাই অস্থিরের হাতে দিয়ে ছাতের ওক কোণে বসে প্রাণ খুলে গান গাওয়া গেল, “তনয়ে তার’ তারিণী–”

বুধবার এল। ঘুম থেকে উঠেই ছাতে গিয়ে মহানির্বাণতন্ত্রের “ওঁ নমস্তে সর্বলোকাশ্রয়ায়” শ্লোকটি (ব্রাহ্ম version নয়) আবৃত্তি করে নীচে নেমে এসে দুখানি ধুতি ও দুখানি শার্ট কাগজে মুড়ে একটি পরিপাটি প্যাকেট বানিয়ে রাখা গেল, বেরুবার সময় দাদার চোখে পড়লে যাতে সে সন্দেহ না করতে পারে। কোনো রকমে পায়ে পা ঠেকিয়ে মাকে একটা প্রণাম করে নেবার চেষ্টা করলুম, কিন্তু সুবিধা হল না বলে মনে-মনেই তাঁকে প্রণাম করে মাত্র সংস্কৃত বইখানা ও একখানা খাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়া গেল।

নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে দেখি যে, প্রমথ আমাদের আগেই এসে অপেক্ষা করছে। তাদের বাড়িসংলগ্ন যে বাগান, তারই পেছনে সে জায়গাটা। এর ধার দিয়ে যে রাস্তা, সেই রাস্তা দিয়ে শচীন রোজ ইস্কুলে যাতায়াত করে। দশটা সওয়া দশটা অবধি রাস্তায় আপিসের লোকের ভিড় থাকে। সে-সময় গাধা ঠেঙাতে-ঠেঙাতে এলে নিশ্চয় কোনো-না কোনো চেনা লোকের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে–এই আশঙ্কায় শচীন বলেছিল, সে একটু দেরি করে আসবে। আমরা দুজনে বাগানের এক কোণে দাঁড়িয়ে তার অপেক্ষা করতে লাগলুম। প্রমথ মস্তবড় একটা পোঁটলা নিয়ে এসেছে তার মধ্যে ধুতি জামা ছাড়া রাজ্যের বই, তার সেই মারাত্মক বাণ, আরও কত যে জিনিস আছে, তার ঠিকানা নেই। আশা, উৎকণ্ঠা ও আশঙ্কায় নির্বাক হয়ে আমরা দুজনে রাস্তার মোড়ের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলুম, কিন্তু শচীনের দেখা নেই। ওদিকে ইস্কুল বসবার ঘণ্টা কানে এসে বাজতে লাগল। কয়েক মিনিট পরে দূরে শচীনকে দেখতে পাওয়া গেল। দিব্যি নিশ্চিন্ত মনে পান চিবোতে চিবোতে হেলে-দুলে সে এগিয়ে আসছে, তার ত্রিসীমানার মধ্যে রজক-নন্দন বা শীতলার বাহনের চিহ্নমাত্রও নেই।

আমি আর প্রমথ একবার দৃষ্টি-বিনিময় করেই দৌড়ে শচীনকে গিয়ে ধরলুম, কই রে, গাধা কোথায়?

শচীন অবাক হয়ে বললে, গাধা! কার গাধা রে! পাগল হলি নাকি?

প্রমথ বলে উঠল উঃ, বিশ্বাসঘাতক!

আর দেরি করা চলে না, তখুনি ইস্কুলের দিকে ছুটতে হল। ক্লাস সব বসে গিয়েছে, আমাদের ক্লাসে পণ্ডিতমশায় পড়াচ্ছিলেন। আমরা তিনজনে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে ক্লাসে ঢুকতেই পণ্ডিতমশায় বললেন, এই যে ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর–একত্রে যাওয়া হয়েছিল কোথায়?

ক্লাসসুদ্ধ ছেলে আমাদের এই নতুন নামকরণ শুনে হো-হো করে হেসে উঠল।

বোধ হয় দু-সপ্তাহ শচীনের সঙ্গে কথা বলিনি, তারপরে আবার ভাব হয়ে গেল।

.

একদিন, সেদিন কিসের ছুটি ছিল। সারাদিন পিসিমার বাড়িতে কাটিয়ে বেলা প্রায় তিনটে নাগাদ গলি দিয়ে বাড়ি ফিরছি, এমন সময় আকাশ অন্ধকার করে এল মুষলধারে বৃষ্টি। ব্যাপার গুরুতর দেখে আমি আত্মরক্ষার জন্যে একটা বাড়ির উঁচু রোয়াকে আশ্রয় নিলুম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরও বৃষ্টি থামল না। জলের ছাটে প্রায় আধভিজা হয়ে গিয়েছি। রাস্তায়ও বেশ জল দাঁড়িয়েছে, যাঁহা বাহান্ন তাঁহা তিপ্পান্ন–মনে করে বৃষ্টি মাথায় নিয়েই বাড়ির দিকে রওনা হব মনে করে ধুতি সামলাচ্ছি, এমন সময় প্রায় সামনের এক বাড়ি থেকে ছাতা নিয়ে একটি ছেলে রাস্তায় বেরিয়েই মুখ তুলে বললে, কে রে, স্থবির নাকি?

কে রে ললিত?

ললিত সুলতার ছোট ভাই। সে বছর সে মেয়ে-ইস্কুল ছেড়েছে। সে জিজ্ঞাসা করলে, কতক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে আছিস? এঃ, ভিজে গিয়েছিস যে!

আর ভাই বলিসনি, ঘণ্টাখানেক ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে ভিজছি।

এখানে দাঁড়িয়ে ভিজছিস আর বাড়ির মধ্যে যাস নি? এই তো আমাদের বাড়ি।

আরে, ওইটে তোমাদের বাড়ি? আমি তা তো জানি না।

ললিত ছাতা বন্ধ করে হাত ধরে বললে, আয় আয়।

বাড়ির মধ্যে ঢুকে ললিত চিৎকার করে উঠল, দিদি দেখ, কে এসেছে!

ললিতের চিৎকার শুনে তার ভাইবোনেরা ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত হল, সবার পেছনে এল সুলতা হাঁপাতে হাঁপাতে।

ললিত চেঁচাতে লাগল, আজ ঠিক ধরেছি, এইখানে দাঁড়িয়ে ছিল।

সুলতা আমাকে দেখেই বললে, এতদিনে মশায়ের সময় হল বুঝি? মিথ্যেবাদী কোথাকার! প্রতিজ্ঞা করেছিলি না?

সুলতার কথার কোনো জবাব দিতে পারলুম না। তাকে দেখে শুধু মনে হল, কি সুন্দর দেখতে হয়েছ তুমি?

সুলতার ছোট বোন সুজাতা আমাদের দু’-ক্লাস নীচে পড়ত। ইস্কুলময় চড়ুইপাখির মতন নেচে বেড়াত সে। সুজাতা চড়ুইপাখির মতোই কিচকিচ করে উঠল, আবার কথা কওয়া হচ্ছে না বাবুর!

সুলতা এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বললে, চল মার কাছে।

মা বড় ভালোমানুষ। প্রণাম করে বসতে-না-বসতে কয়েক মিনিটের মধ্যে একেবারে আপনার করে নিলেন। তিনি বললেন, লতু কতদিন থেকে বলছে–তুমি আসবে, তা ছেলের বুঝি সময়ই হয় না, না?

তখুনি তাস পাড়া হল। ললিত একবোঝা মুড়ি আর তেলে-ভাজা এনে হাজির করলে। তেলে-ভাজা কিনতে যাবার মুখেই আমার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল।

‘গ্রাবু’ খেলা শুরু হল। আমি আর সুলতা এক দিকে, সুজাতা ও ললিত আর এক দিকে। বাকি যারা ছিল, তারা আমাদের ঘিরে বসল। হৈ-হৈ করে খেলা জমে উঠল।

ওদিকে আকাশ বিরাট আর্তনাদে বারকয়েক দিগ্বিদিক চমকে দিয়ে আমাদের ঘিরে একঘেয়ে ঝরঝরানি সুরে বিনিয়ে বিনিয়ে কাঁদতে থাকল।

সময় যে কোথা দিয়ে কাটতে লাগল, তা বুঝতেই পারিনি। দিনের আলো আর রাতের অন্ধকার মিলিয়ে ঘরের মধ্যে যে স্বপ্নলোকের সৃষ্টি হয়েছিল, তারই মায়ায় আমার আত্মজ্ঞান লুপ্ত হয়েছিল। নিজের বাড়িতে নিয়ত নানা শঙ্কায় মন আমার সর্বদাই উৎকণ্ঠিত থাকত। উদ্যত শাসনকে কত মিথ্যা বা ছলনায় ঠেকিয়ে রাখতে হত তার আর ঠিকানা নেই; কিন্তু লতুদের ওখানে দেখলুম, ঠিক তার উল্টো। বাবা-মার সঙ্গে তাদের ব্যবহার অত্যন্ত সুন্দর ও সহজ, ঠিক বন্ধুর মতন। অথচ তাদের কেউ লেখাপড়ায় আমার চাইতে খুব ভালো ছিল না। তা ছাড়া অনাত্মীয় পরিবারের মধ্যে তেমন ভাবে মেশা এর আগে জীবনে হয়নি। আমার স্নেহলোলুপ অন্তর তাদের আদরে এমন সাড়া দিলে যে, কিছুক্ষণের জন্যে নিজের বাড়ির কথা একেবারে ভুলেই গিয়েছিলুম। হঠাৎ পাশের ঘরের একটা ঘড়ি ঢং ঢং করে জানিয়ে দিলে, সাতটা বাজল যে হে স্থবির শর্মা, আর কত আড্ডা দেবে? আজ বরাতে দুঃখু আছে তোমার।

আর নয়। তড়াক করে উঠে পড়লুম। আমার ও লতুর কাঁধে তখনও একটা পাঞ্জা ও একটা ছক্কা চাপানো রয়েছে।

উঠে পড়লুম, আর নয়, আর নয়, আর নয়।

সুজাতা বললে, কাল আসতে হবে কিন্তু।

নিশ্চয় আসব।

লতু বললে, না এলে দেখবে মজা। আজকের হারের শোধ দিতে হবে, মনে থাকে যেন।

চলতে চলতে বললুম, নিশ্চয় আসব।

পথে এক-বুক জল ঠেলে চলতে চলতে মনে হতে লাগল, কাল নিশ্চয় এসে আজকের হারের শোধ নিতে হবে।

পরাজয়ের বন্ধনে আমার ও লতুর মধ্যে বন্ধুত্ব হল।

সেদিন রাশিচক্রের কি সমাবেশ ছিল, বলতে পারি না। সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে সন্ধের পর ভিজে বাড়িতে ফেরার অপরাধে প্রহার তো হলই না; বাবার কাছে কিছু জবাবদিহি ও করতে হল না। বরং তিনি আমার অবস্থা দেখে তক্ষুনি এক কাপ গরম চায়ের হুকুম দিয়ে দিলেন।

পরদিন অস্থিরকে নিয়ে লতুদের ওখানে গিয়ে হাজির হলুম। অস্থির ওদের অচেনা নয়। লতুর ছোট বোন সুজাতা ও ললিত অস্থিরের সঙ্গে পড়ত, তাকে পেয়ে ওরা ভয়ানক খুশি হয়ে উঠল। এর পর থেকে আমরা প্রায় রোজই বিকেলে লতুদের বাড়িতে গিয়ে হাজির হতে লাগলুম।

ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বাবার হুকুমমতো আমাদের তিন ভাইকে এক পাতা ইংরিজি, এক পাতা বাংলা ও এক পাতা সংস্কৃত হাতের লেখা লিখতে হত। এ ছাড়া আবার দশটা করে অঙ্ক কষতে হত। প্রতিদিন সকালবেলায় বাবাকে এইগুলি দেখাতে হত। নিয়মমতো এইগুলো দেখাতে না পারায় সপ্তাহের মধ্যে অন্তত একদিন আমাদের তিন ভাইয়ের কেউ-না-কেউ মার খেত। আমি আর অস্থির ইস্কুল থেকে বাড়ি ফিরে যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি লেখা-টেখাগুলো সেরে ঘুড়ি লাটাই নিয়ে ছাতে উঠে যেতুম। আমাদের ছাত থেকে পাশের বাড়ির ছাত, তার পাশের বাড়ির ছাত ঘুরে সেই সন্ধের সময় নেমে পড়তে বসতুম। ঘুড়ি-ওড়ানোটা বাবা বিশেষ পছন্দ করতেন না, তবে রাস্তায় বেরুনোর চাইতে ভালো মনে করে সেটা সহ্য করতেন মাত্র। এই ছাতের ওপরে ওঠা ও সেখান থেকে নেমে আসা পর্যন্ত সময়টুকু আমাদের আর খোঁজ হত না।

আগেই বলেছি, ইস্কুলে যাওয়া ও বাড়ির কাজ ব্যতীত বাইরে বেরুনো আমাদের মানা ছিল। বিনা অনুমতিতে অন্য সময় রাস্তায় পা দেবার জো ছিল না। দিনকয়েক লতুদের ওখানে যেতে-না-যেতেই একদিন ধরা পড়ে বাবার কাছ থেকে বেশ কিছু নগদ পাওয়া গেল; আমরাও বুদ্ধি খাঁটিয়ে আর একটা উপায় আবিষ্কার করে ফেললুম। আমরা ঘুড়ি লাটাই ও সেইসঙ্গে জামা ও জুতো নিয়ে ছাতে উঠে পাশের বাড়িতে লাটাই ঘুড়ি রেখে, তাদের সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতে লাগলুম। সন্ধে হবার কিছু আগে ওই প্রণালীতে আবার বাড়িতে ফিরে আসতুম।

কিছুদিন এইভাবে বেশ চলল। ওদের ওইখানেই আমাদের লাটাই রেখে আসা গেল। চলছিল বেশ, কিন্তু একদিন আবার ধরা পড়ে গেলুম। উত্তম-মধ্যম তো হলই, সঙ্গে সঙ্গে ছাতে ওঠাও বন্ধ হয়ে গেল।

এই বাইরে বেরুনো নিয়ে আমাদের তিন ভাইকে বাল্যকালে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়েছে। বাবা মনে করতেন, ছেলেরা বাইরে গেলেই তাদের পরকালটি একেবারে ঝরঝর হয়ে যাবে। ছেলেদের জগতে ইহকাল বলে যে একটা বড় জিনিস আছে এবং সেটি বাঁচাতে না পারলে পরকালটির ঝরঝরানি যে অনিবার্য, সে সত্য তখনকার দিনের অনেক অভিাভবকই স্বীকার করতেন না।

বাড়ির মধ্যে ছেলেরা যে. নিরুদ্বিগ্নতার আওতায় বেড়ে ওঠে, সেরকম নিরুদ্বিগ্নতা ছেলেবেলায় কখনও উপভোগ করিনি। শুনতুম, লেখাপড়ার প্রতি বালকদের স্বাভাবিক অনুরাগ থাকে, কিন্তু আমার তা ছিল না; বরং বিরাগই ছিল। লেখাপড়া করাকে আমি ভীষণ, ভয়াল, ভয়ঙ্কর মনে করতুম। শৈশবে ইস্কুলে যাবার আগে বাড়িতে অক্ষরপরিচয়, দ্বিতীয় ভাগ ও তৃতীয় ভাগ পর্যন্ত লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহই ছিল; কিন্তু ইস্কুলে ভর্তি হবার পর লেখাপড়ার জন্যে যেদিন থেকে চাপ শুরু হল, সেইদিন থেকে ধীরে ধীরে তার বিরুদ্ধে মনের মধ্যে বিতৃষ্ণাই সঞ্চিত হতে লাগল। ইস্কুলের বই ছাড়া যে-কোনো বিষয়ের যে-কোনো বই আগ্রহের সঙ্গে পড়তুম ও তার মর্মার্থ জানবার চেষ্টা করতুম। পড়ার বই ছাড়া অন্য বই পড়তে দেখলে বাবা যে তার মর্মার্থ ভালো করে বুঝিয়ে দেবেন, সেই ভয়ে এই সুখও পেতুম ক্বচিৎ। এইসব কারণে বাড়ির বাইরে আমি পেতুম স্ফূর্তি, আর যদি সেখানে স্নেহ-ভালোবাসার আকর্ষণ থাকত তা হলে পেতুম স্বর্গ।

বাবার ধমক ও প্রহারের জন্যে হয়তো তাঁর প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভক্তি বেড়ে যাওয়া উচিত ছিল। হয়তো মনে হওয়া উচিত ছিল যে, ভদ্রলোক আমাদের জন্যেই চাকরি করেন, সমস্ত দিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর সন্ধ্যাবেলা ক্লান্ত শরীর নিয়ে আমাদের পড়াতে আরম্ভ করেন, আমাদের ভবিষ্যৎ মঙ্গলের জন্য অপত্যস্নেহের প্রস্রবণকে রুদ্ধ করে নিজের অন্তরকে নির্মমভাবে পীড়ন করে আমাদের এমন শাসন করেন যে, সন্তানবর্তী প্রতিবেশিনীরা ডাক ছেড়ে কাঁদতে থাকেন। হয়তো আরও অনেক কিছু মনে করা উচিত ছিল, কিন্তু আমার কল্পনা জীবনের ব্যবহারিক দিকটাকে সর্বদাই উপেক্ষা করেছে, তাই প্রহারের পূর্বে হত ভয় এবং পরে হত রাগ। রাগটা ছিল নিষ্ফল এবং প্রহার থেমে যাবার পরই ভয়টা যেত চলে। তাই বাড়ি থেকে বেরুনো বন্ধ হওয়ার অর্ডিনান্স জোরসে পাস হবার পরও লতুদের ওখানে যাওয়া বন্ধ করবার ইচ্ছে তো দূরের কথা; কোন সুযোগে আবার সেখানে রোজ হাজিরা দিতে পারা যায়, দিনরাত দুই ভাইয়ে তারই পরামর্শ চলতে লাগল।

পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে সুযোগও এসে গেল। এসে গেল বললে বোধ হয় ভুল হবে, সুযোগ করে নেওয়া গেল। ছেলেবেলায় সুযোগ জুটিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে আমার ও অস্থিরের বুদ্ধি খেলত অদ্ভুত ও চমকপ্রদ। এ বিষয়ে অস্থির আমার চাইতে ঢের বেশি ওস্তাদ ছিল। ভাগ্যে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের প্রতিভার এই দিকটা ম্লান হয়ে এসেছিল, নইলে কোথাকার জল যে কোথায় গিয়ে দাঁড়াত, তা ঠিক বলা যায় না। সুযোগ কি করে টেনে নিয়ে এসে কাজে লাগালুম, সেই কথা বলি।

আমাদের দরিদ্রের সংসার হলেও চাকরবাকর, ঝি, আশ্রিত প্রতিপাল্যের সংখ্যা নিতান্ত কম ছিল না। এছাড়া বাবার ও আমাদের তিন ভাইয়ের কুকুরের শখ থাকায় বিলিতি অভিজাত সম্প্রদায়ের গুটি পাঁচ-ছয় সারমেয়নন্দন আমাদের বাড়িতে বিশেষ সমারোহের সঙ্গে পালিত হত। তা ছাড়া মার নিজের ছিল ছাগলের শখ। বাড়ির একতলা থেকে তেতলা অবধি গুটি বারো-তেরো ছাগল অবাধে বিচরণ করত। এই মানুষ, কুকুর ও ছাগলের প্রত্যেকটিই মা অতি যত্নে পালন করতেন। এদের প্রত্যেকে কে কি খেতে ভালোবাসে, কার কি সহ্য হয় না, সব তাঁর একেবারে নখদর্পণে থাকত। বিশেষ করে জানোয়ারদের তদারক সম্বন্ধে তাঁর নজর ছিল খুবই কড়া। প্রত্যেকে ঠিক সময়ে তার নির্ধারিত খাদ্য পাচ্ছে কি না, তা তিনি নিজে দেখাশোনা করতেন। জানোয়ারদের প্রতি মার এই দুর্বলতাটা আমরা নিজেদের সুযোগে খাঁটিয়ে নিলুম।

দুই ভাই বিমর্ষ হয়ে রকে বসে আছি, সন্ধে হয় হয় এইবার পড়তে বসতে হবে, এমন সময় ঘাসওয়ালা এল ছাগলের ঘাস নিয়ে। ঘাসওয়ালাকে দেখেই মুহূর্তের মধ্যে আমাদের প্ল্যান তৈরি হয়ে গেল। তাকে বলে দিলুম, মা বলে দিয়েছেন, আজ থেকে আর ঘাস নেওয়া হবে না।

আমাদের কথা শুনে সে বেচারির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এমন বাঁধা খদ্দের হঠাৎ কি কারণে বিগড়ে গেল ভেবে সে হতভম্ভের মতো আমাদের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

আমরা বললুম, সব ছাগল বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মা বলেছেন–ছাগল বড় অপয়া জাত।

ঘাসওয়ালা বেচারি খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আবার ঘাসের বোঝা মাথায় তুলে নিয়ে চলে গেল দেখে আমরা গিয়ে পড়তে বসলুম।

কিছুক্ষণের মধ্যেই মা এসে জিজ্ঞাসা করলেন, হ্যাঁরে, ঘাস দিয়ে গেয়েছে?

কই, না!

আবার কিছুক্ষণ পরে মা বললেন, দেখ তো ঘাস দিয়ে গিয়েছে কি না? ও আবার মাঝে মাঝে কারুকে- না জানিয়েই ঘাসের বোঝা ফেলে দিয়ে চলে যায়।

আমি উঠে রক অবধি গিয়ে ফিরে এসে বললুম, ঘাস দেয়নি মা।

মা সেই যে বকতে শুরু করলেন, রাত্রি এগারোটায় গিয়ে তা থামল।

প্ল্যান আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল। পরদিন ইস্কুল থেকে এসেই শুনলুম, মা ভীষণ চেঁচামেচি করছেন। রাত্রে ঘাস খেতে পায়নি বলে ছাগলেরা দুধ দিচ্ছে না। আমরা দুজনেই ছাগলের দুঃখে ললিত-গলিত হয়ে ঘাসওয়ালার দায়িত্বজ্ঞানহীনতা সম্বন্ধে অনেকরকম মন্তব্য করতে আরম্ভ করে দিলুম। অনেক বকাবকির পর ঠিক হল যে, আমরা দুজনে রোজ ঘাস নিয়ে আসব। এতে আমাদের কষ্ট হবে, কিন্তু সেজন্যে ছাগলগুলোকে কষ্ট দেওয়া কিছু নয়। আহা, অবোলা জানোয়ার!

পরদিন থেকে আমরা ইস্কুল হতে বাড়ি ফিরে হাতের লেখা ইত্যাদি কর্তব্য-কর্ম সম্পাদন করে ঘাস আনতে যেতে লাগলুম। ঘাস আনবার প্রোগ্রামটা ছিল এই, বাড়ি থেকে বেরিয়ে দৌড়ে লতুদের বাড়ি যাওয়া। সেখানে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে ও খেলা করে মিনিট দশ-পনেরো বেলা থাকতে থাকতে বেরিয়ে পড়তুম ঘাস আনতে। তেরো আঁটি ভিজে নোনাঘাস দুই ভাইয়ে সমান ভাগ করে নিয়ে দৌড়তে দৌড়তে ফিরতুম বাড়িতে।

লতুদের বাড়ির সবার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দুজনের এত ভাব হয়ে গিয়েছিল যে, একদিন না যেতে পারলে সেখানে একেবারে হাহাকার উপস্থিত হত। পরদিন তাদের বাবা মা থেকে আরম্ভ করে চাকরদের পর্যন্ত অনুপস্থিতির জন্যে কৈফিয়ৎ দিতে হত।

মাসকয়েক’ বেশ চলল। একদিন ইস্কুল থেকে এসে শুনলুম, ঘাসওয়ালা ব্যাটা দুপুরবেলায় এসে মার সঙ্গে দেখা করে আবার ঘাস দেবার ব্যবস্থা করে গেছে।

হায় ভগবান! এত দুঃখও তোমার ভাণ্ডারে আছে! সেদিনও কিন্তু নিয়মিত সময়ে লতুদের বাড়ি গিয়ে হাজির হলুম। সেখানে সমস্তক্ষণটাই ঘাসওয়ালার বিশ্বাসঘাতকতা মনের মধ্যে খোঁচা দিতে লাগল। আবার নতুন সুযোগ আহরণের পরামর্শ শুরু হয়ে গেল।

সেদিন সন্ধের সময় দু-একটা চড় ও কানৌটি দিয়েই বাবা ক্ষান্ত হলেন। পড়তে বসে যাওয়া গেল।

দিন দুই আর লতুদের বাড়িমুখো হলুম না। তৃতীয় দিন অস্থির সেখানে গেল,আমি বাড়িতে রইলুম। বাবা আপিস থেকে ফেরবার আগেই সে ফিরে এল। পরের দিন আমি গেলুম। এইরকম চলতে লাগল।

একদিন অস্থির ওখান থেকে ফিরে এসে বললে, সুজাতার অসুখ করেছে।

পরদিন দুই ভাইয়ে একসঙ্গে লতুদের ওখানে চলে গেলুম। আমাদের দুজনকে একসঙ্গে পেয়ে তাদের ভাইবোনদের মধ্যে খুশির হুল্লোড় লেগে গেল। দেখলুম, সুজাতা শুয়ে রয়েছে, তার গলায় একটা ফ্ল্যানেল বাঁধা, গলায় ভয়ানক ব্যথা। জ্বর রয়েছে, বুকেও খুব বেদনা।

আমরা তাকে ঘিরে বসলুম। আমাদের পেয়ে সুজাতাও তার রোগযন্ত্রণা ভুলে গেল। কয়েকদিন পরে বেশ লাগতে লাগল। আমরা ঠিক করেছিলুম, বাবা বাড়ি ফেরবার আগেই চলে আসব, কিন্তু সুজাতা কিছুতেই উঠতে দেয় না। বাবা বাড়ি ফেরবার আগেই আমাদের যাওয়া যে বিশেষ প্রয়োজন, সে কথা সেখানে প্রকাশ করতে পারি না, ওদিকে লতু ও সুজাতা কিছুতেই ছাড়ে না। শেষে অনেক কষ্টে কাল তাড়াতাড়ি আসবার প্রতিজ্ঞা করে সেদিন পালিয়ে এলুম।

বাড়িতে ফিরে দেখি যে, বাবা এসে গিয়েছেন। বারকয়েক খোঁজও হয়েছিল। বেশ কিছু প্রহার-সেবান্তে পাঠে নিযুক্ত হওয়া গেল। বাবা বললেন তোমাদের বাইরে-যাওয়া রোগ আমি ছাড়াতে পারি কি না একবার দেখব

পরের দিন সাহস করে আর লতুদের ওখানে যেতে পারলুম না। দিন দুই পরে সেই পুরানো কায়দায় অস্থির সেখানে থেকে চট করে একবার ঘুরে এল। অস্থির বললে, সুজাতার নিমোনিয়া হয়েছে, কথা বলতে পারছে না।

রাত্রে ঘুমোবার আগে খালি সুজাতার কথাই মনে হতে লাগল। সুজাতা কি ভালো হবে? কতদিনে সে একেবারে সেরে উঠবে? নীলরতন সরকার যখন দেখছেন তখন আর কোনো ভাবনা নেই। আজকাল নিমোনিয়ার অনেক ভালো ওষুধ বেরিয়েছে–এ ভাবতে ভাবতে অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়লুম। সকালে ঘুম ভাঙতেই প্রথমে ‘সুজাতার কথা মনে পড়ল।

সারাদিন দারুণ উৎকণ্ঠায় কাটিয়ে বিকেলে অস্থিরকে বাড়িতে রেখে সুজাতাদের বাড়ি চলে গেলুম।

রোগিণীর ঘরের মধ্যে ঢুকলুম। একটা তীব্র ঝাঁজালো গন্ধে ঘর ভরপুর হয়ে রয়েছে। সন্তর্পণে সুজাতার কাছে এগিয়ে গেলুম, তার দুই চোখ অর্ধনিমীলিত, ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। লতু তার মাথার কাছে বসে, মা একপাশে বসে আছেন। আমি কাছে যেতেই তিনি মুখ তুলে বললেন, কে, স্থবির? আয়, এদিকে বস।

মায়ের দুই চক্ষু অশ্রুতে পরিপূর্ণ।

আমি ধীরে ধীরে লতুর পাশে বসলুম। মা বললে, কালও তোদের নাম করেছে কতবার! সুজাতার দিকে চাইলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারলুম না। কি এক অস্বাভাবিক ধরনের নিশ্বাস টানছিল সে। উজ্জ্বল গৌর তার বর্ণের ওপর কে যেন কালি ঢেলে দিয়েছে! জেগে আছে কি ঘুমিয়েছে তা বুঝতে পারলুম না। সুজাতার দিকে থেকে মুখ ঘুরিয়ে লতুর দিকে চাইলুম। রহস্যময় দৃষ্টিতে সে আমার দিকে অনিমেষ চেয়ে রইল। গভীর সে দৃষ্টির মধ্যে কি মৃত্যু লুকিয়ে ছিল? তার দিকেও চেয়ে থাকতে পারলুম না, মায়ের দিকে চাইলুম। তাঁর চোখে চোখ পড়তেই তিনি আমার পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে বললেন, কেমন আছিস বাবা? চেহারাটা তো ভালো দেখাচ্ছে না!

বাবা ফেরবার আগেই যে বাড়ি পৌঁছতে হবে সে জ্ঞান তখনও হারাইনি, তাই মিথ্যে করেই “বুললুম, শরীরটা তেমন ভালো নেই।

মা বললে, তা তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে যা।

কিছুক্ষণ বসেই বাড়ি চলে এলুম।

পরের দিন তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আধ মাইল ঘুরে ইস্কুলে যাবার আগে সুজাতাকে দেখতে গেলুম। তাকে তখন গ্যাস দেওয়া হচ্ছে। শুনলুম সে গ্যাস নিতে পারছে না। ঘরের মধ্যে ঢুকতে আর সাহস হল না, বাইরে দাঁড়িয়ে রইলুম। কিন্তু বেশিক্ষণ সেখানে থাকবারও উপায় ছিল না, তাড়াতাড়ি যেতে হবে, নইলে ইস্কুল বসে যাবে। কিন্তু লতু বলে দিলে, তাড়াতাড়ি আসিস।

ইস্কুল থেকে ফিরে নাকে-মুখে চাট্টি গুঁজে দুই ভাই ছুটলাম সুজাতাকে দেখতে। তাদের গলির মোড়ে পৌঁছেই চিৎকার শুনে বুঝতে পারলুম, সুজাতা চলে গেছে।

সেইখান থেকেই কাঁদতে কাঁদতে ছুটলুম তাদের বাড়িতে। বাড়ির ভেতরের সে হৃদয়বিদারক দৃশ্যের খুঁটিনাটির কথা আজ আর সমস্ত মনে নেই। পুজোবাড়িতে শাঁখ, ঘণ্টা, জয়ঢাক, কাঁসর মিলিয়ে যে অখণ্ড আওয়াজ বাতাসে গুমরোতে থাকে, তেমনই নানা কণ্ঠের চিৎকারোত্থিত এক অখণ্ড আওয়াজ নিষ্ফল অভিযোগে সেখানে আর্তনাদ করছিল। কত পুরুষ ও নারী যে সেখানে এসে জমেছে, তাদের এতদিন দেখিনি। আত্মীয় অনাত্মীয় সকলেই হাহাকার করছে–সুজাতা চলে গেছে।

মৃতদেহ যে ঘরে, সে ঘরে মেয়েদের ভিড়। তাঁরা সকলেই কাঁদছেন–কেউ-বা চিৎকার করে, কেউ-বা নীরবে। লতু ও তার বাবা ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে নীরবে অশ্রু-বিসর্জন করছিলেন, আমাদের দেখে তাঁরা দুজনেই চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। আমরা দুজনে একেবারে দৌড়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলুম।

দেখলুম, সুজাতার মৃতদেহ খাটের ওপরে শায়িত। তাকে স্নান করিয়ে নতুন একখানা শাড়ি পরানো হয়েছে। রুক্ষ চুলগুলি যতদূর সম্ভব গুছিয়ে আঁচড়ানো। কৈশোরের চাপল্য ও জীবনের চাঞ্চল্যর চিহ্ন সে-মুখে নেই, একদিন রোগযন্ত্রণার যে ছায়া তার মুখে দেখেছিলুম, তা একেবারে অপসারিত হয়ে গিয়েছে। শান্ত সৌম্য যে মুখমণ্ডল, বুকের ওপরে দুটি হাত জোড়া করা, সে মূর্তি আমার মনে একাধারে শোক ও শ্রদ্ধার প্রস্রবণ ছুটিয়ে দিলে। মনে হল, আমাদের এই অতি নিকট বন্ধু পরম শান্তিতে মৃত্যুর কোলে আত্মসমর্পণ করেছে। সে যেন আর আমাদের নয়, আমাদের চাইতে.অনেকে দূরে অনেকে উঁচুতে চলে গেছে। সংসারের প্রতি দারুণ অভিমানে তার মুখে এই যে গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে, কোনো কিছুতেই আর তা ভাঙবে না।

অস্থির ঘরের মধ্যে ঢুকে কিছুক্ষণ সুজাতার মৃতদেহের প্রতি শঙ্কিত বিস্ময়ে চেয়ে থেকে চিৎকার করে তার বুকের ওপর আছড়ে পড়ল।

মৃতদেহ ঘিরে বসে যে-সব মহিলা এতক্ষণ কান্নাকাটি করছিলেন, হঠাৎ অস্থিরের এই কাণ্ড দেখে তাঁরা প্রথমে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন, তারপরে সেই শোকাপ্লুত চোখগুলিতে ফুটে উঠতে লাগল বিশ্বজোড়া কৌতূহল–কে এই ছেলেটি?

অস্থিরের চিৎকার শুনে সুজাতার বাবা ঘরের মধ্যে এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

লতুদের বাড়িতে তাদের এক আধপাগলা মামা থাকত। আধপাগলা হলে কি হবে, সে-ই তাদের সংসারের বিষয়-আশয় থেকে আরম্ভ করে সব দেখাশোনা করত। মামা সমস্ত ব্যবস্থা করে সুজাতার মৃতদেহ শ্মশানে নিয়ে গেল। এগারো বছরের ললিতও তাদের সঙ্গে গেল, কারুর মানা সে শুনলে না।

সেদিনকার বিকালের একখানি মধুর ছবি আজও আমার মনের মধ্যে সঞ্চিত হয়ে আছে, স্মৃতির পরশ লাগলেই সেটি ঝকঝক করে ওঠে। দোতলার খোলা ছাতে একখানা শতরঞ্চি পাতা। মধ্যিখানে লতুর বাবা অস্থিরকে কোলে নিয়ে বসে আছেন। অস্থির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর তিনি মধ্যে মধ্যে তাকে বুকের মধ্যে চেপে ধরছেন। একধারে লতুর মা বসে আছেন, তাঁর দক্ষিণ ঊরুতে মাথা রেখে লতু শুয়ে আছে, বাঁ পাশে আমি বসে, মা ধীরে ধীরে বাঁ হাতখানি আমার পিঠে বুলোচ্ছেন। শোকের আগুনে আমাদের বয়েস ও সাংসারিক অবস্থার তারতম্য ঘুচে গেছে। সকলেই আত্মহারা, সবারই মন একই কেন্দ্রে চারিদিকে ঘুরছে। আমাদের চারদিকে বাড়ির আত্মীয়, বন্ধু ও প্রতিবেশীর দল, নারী ও পুরুষ–কেউ-বা বসে, কেউ বা দাঁড়িয়ে।

বেলা পড়ে আসার সঙ্গে একে একে সকলে বিদায় নিতে লাগলেন। আমাদের চারদিকে অন্ধকার ঘনিয়ে উঠতে লাগল, সেই অন্ধকারে আমাদের চোখে ঝরতে লাগল অশ্রু, আর মন ফিরতে লাগল অমর্ত্যলোকের সন্ধানে।

সময়ের জ্ঞান ছিল না। হঠাৎ লতুর মা নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললেন, স্থবির, অস্থির, এবার বাড়ি যাও বাবা, তাঁরা আবার ভাববেন।

লতুদের একজন চাকর চলল আমাদের বাড়ি অবধি পৌঁছে দিতে। বাড়ির দিকে কিছুদূর অগ্রসর হয়েই আমরা চাকরকে বিদায় দিয়ে রাস্তার ধারে গরু-ঘোড়ার জলখাবার জন্যে যে লোহার চৌবাচ্চা তখন থাকত, তারই একটাতে বেশ করে চোখ-মুখ ধুয়ে ভয়ে ভয়ে অত্যন্ত সন্তর্পণে বাড়িতে ঢুলুম। পথে ঠিক হল যে, বলা হবে, গড়ের মাঠে খেলা দেখতে গিয়ে ফেরবার সময় পথে হারিয়ে গিয়েছিলুম।

পড়ার ঘরের কাছে গিয়ে দেখলুম, বাতি জ্বলছে বটে, কিন্তু সেখানে বাবাও নেই, দাদাও নেই। তাড়াতাড়ি নিজের ঘরে গিয়ে জামা ছেড়ে বই নিয়ে পড়তে যাচ্ছি, এমন সময় মা এসে বললে, পোড়ামুখোরা, গিয়েছিলে কোথায়? আজ যে খুন করে ফেলবে।

শুনলুম, দাদাকে নিয়ে বাবা বেরিয়েছেন আমাদের খোঁজে।

পড়তে বসলুম। অচিরেই সাংঘাতিক রকমের একটা ফাঁড়ারয়েছে জেনেও মনের মধ্যে কোনো ত্রাসই হচ্ছিল না। নিদারুণ মানসিক ক্লান্তি সারা দেহ-মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে লাগল। মিনিট পনেরো পরেই বাবা দাদাকে নিয়ে ফিরে এলেন। মিনিট পাঁচেক জিজ্ঞাসাবাদের পরই প্রহার শুরু হল, প্রহারের সরঞ্জাম আগে থাকতেই ঠিক করা ছিল।

সেদিনকার প্রহারের বিবরণ আর দোব না। শুধু এইটুকু বললেই হবে যে, উত্থানশক্তিবিরহিত অবস্থায় আমরা মেঝেতে পড়ে গোঁ-গোঁ করছি, আর বাবা ভাঁড়ার-ঘরে ঢুকে আমাদের হত্যা করবার জন্যে বঁটি খুঁজছেন, এমন সময় কয়েকজন প্রতিবেশিনী আমাদের বাড়িতে ঢুকে মাকে গালাগালি করতে আরম্ভ করায় তিনি বাবাকে নিরস্ত করলেন।

চাকরেরা আমাদের তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে বাতি নিবিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমাদের চোখ দিয়ে নিঃশব্দে অশ্রু ঝরে পড়তে লাগল বালিশে। পিতা ও পরম-পিতা উভয়ের অত্যাচারে জর্জরিত সেই দুটি বালককে সুপ্তি এসে মুক্তি দিলে।

.

আজ আশ্বিনের বুকে আষাঢ়ের নবঘন মেঘ যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছে। ছাতের ঘরে জানলার ধারে বসে আছি, সামনে আমার জাতকের খাতা খোলা। খেয়ালি প্রকৃতির দাপাদাপি চলছে আমাকে ঘিরে-আমার মনকে ঘিরে। আমার উদাসীন মন ফিরে চলেছে স্মৃতির সরণী বৈয়ে সুদূর অতীতে! গাঢ় বিস্মৃতির যবনিকা ভেদ করে চলে গেছি একেবারে অতীতের অন্তস্তলে, সেখানে আমার মানসরচিত রাজ্য পড়ে আছে সুপ্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে। সেখানে কত বিরাট প্রাসাদ, জ্যোতির্ময় হর্ম্য, বজ্রমণির দেওয়াল, মরকতের ছাত। উপবনে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুল মূর্ছিত হয়ে নুয়ে পড়েছে মাটির দিকে। ঘরে ঘরে কত নর-নারী–বালক-বালিকা, কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা–আমার নর্মসহচর, আমার আত্মার সহধর্মিণী তারা, সকলেই ঘোরতর সুপ্তিতে আচ্ছন্ন। স্মৃতির সোনার কাঠির পরশ পেয়ে কত বন্ধু-বান্ধবী জেগে উঠতে লাগল, তারই মধ্যে ধীরে ধীরে ফুটে উঠল আমার আমার গোষ্ঠদিদির বিষণ্ণ মুখখানি–আমার দুখিনি গোষ্ঠদিদি।

আমরা তখন কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ছেড়ে গলির মধ্যে একটা নতুন বাড়িতে উঠে গিয়েছি। গলির মধ্যে বাড়িগুলো প্রায় সবই গায়ে গায়ে ঘেঁষাঘেঁষি, মধ্যে এক আঙুল পরিমিত ও জায়গা নেই। আমাদের বাড়ির ছাতে উঠলে পাশাপাশি প্রায় পাঁচছ’টা বাড়ির ছাতে যাওয়া যেত। বাড়ি সব পাশাপাশি থাকায় এবাড়ি ওবাড়ি মেয়েদের মধ্যে আলাপচারীও চলত। আমরা তখন সবে গিয়েছি, আশেপাশের প্রতিবেশিনীদের সঙ্গে মা’দের তখনও পরিচয় ভালো করে জমেনি। কৌতূহলসূচক চাহনি ও মাঝে মাঝে উভয় পক্ষ থেকে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত দু-চারটে প্রশ্নোত্তর চলছে মাত্র।

মনে পড়ছে, তখন আশ্বিন মাস, পুজোর ছুটি চলছে। নিস্তব্ধ দুপুরবেলা দুই ভাই ঘুড়ি-লাটাই নিয়ে ছাতে উঠেছি। পাশের বাড়ির মস্ত ছাত দেখে লোভ হল; অতি সন্তর্পণে সেখানে গিয়ে ঘুড়ি চড়ানো গেল।

দুপদাপ শব্দ হয়ে পাছে নীচের লোকেরা টের পেয়ে যায়–এই ভয়ে খুব সাবধানেই চলাফেরা করছিলুম; কিন্তু কিছু দূরেই আর একখানা ঘুড়ি উড়ছে দেখে আত্মহারা হয়ে গেলুম। অস্থির চেঁচিয়ে উঠল, দুয়ো লাল বুলুক-কো–ও-ও- ও, সুতো ছাড়ে না, জুতো খায়, এক্–কো–ও—ও–ও–; স্থবরে, নীচে পড়, নীচে পড়, মার টান-মার টান–ভো-কাট্‌টা হো-হো-হো

জয়ের আনন্দে উল্লসিত হয়ে অস্থিরের মুখের দিকে চেয়েছি মাত্র, এমন সময় সে লাটাইটা ফেলে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, ওরে বাবা, পাহারাওয়ালা রে! তারপরে এক দৌড় ও তিন লাফে ও-ছাত পেরিয়ে নিজেদের ছাতে পালিয়ে গেল।

সামনের দিকে চেয়ে দেখতে পেলুম, একজন মেয়ে, ইয়া লম্বা-চওড়া, রঙটি ময়লা, মাথার ওপরে চূড়ো করে বাঁধা একরাশ চুল–কোমরে একখানা হাত, দুটি টানা বিশাল চোখে অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।

আমার হাতে ঘুড়ি। পালাতে পারি না। অপ্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও যতদূর সম্ভব তাড়াতাড়ি ঘুড়ি নামাতে লাগলুম। মিনিট দুয়েক পরে সে আমার কাছে এসে বললে, তুমি কাদের বাড়ির ছেলে?

পাশের বাড়ির।

ও, তোমরা নতুন ভাড়াতে এসেছ বুঝি?

হ্যাঁ।

যে পালাল, সে তোমার কে হয়?

আমার ভাই।

দেখ দুপুরবেলায় ওই উঁচু ছাতটায় উঠো না, বুঝলে?

পরের ছাতে উঠে ধরা পড়ে এত সহজে পরিত্রাণ পাবার আশা করিনি। আশা করেছিলুম, ধমকধামক–অন্তত কিছু বিরক্তিও সে প্রকাশ করবে। কিন্তু কিছুই না করে বেশ প্রসন্ন মুখেই সে বললে, ওই ছাতের নীচে যে ঘর, সেখানে আমার শ্বশুর থাকেন। দুপুরবেলা তিনি ঘুমোন কিনা, ছাতের ওপরে দুপদাপ শব্দ হলে তিনি ঘুমুতে পারবেন না।

সেদিন আর কোনো কথা না বলে সে নীচে নেমে গেল। এরই দু-তিন মাস পরে এক শীতের দ্বিপ্রহরে মা’তে আর গোষ্ঠদিদিতে কথা হচ্ছিল–

গোষ্ঠদিদি বলছিল, দুপুরবেলাটা আর কাটতে চায় না মা। গড়িয়ে গড়িয়ে কিছুক্ষণ কাটাই, তারপরে এঘর-ওঘর ঘুরি, খানিকক্ষণ ছাতে বেড়াই, আবার এসে গড়াই-

মা বললেন, দুপুরে পড় না কেন, গল্পের বই-টই? বেশ কেটে যাবে।

কোথায় পাব মা গল্পের বই? শ্বশুরের লাইব্রেরির আলমারিতে গাদা গাদা সব ইংরিজি বই ঠাসা, একখানিও বাংলা বই নেই। মধ্যে মধ্যে বাংলা বই আনিয়ে পড়ি, রোজ তো আর পাই না।

আচ্ছা, তোমার স্বামী কখনও আসেন?

আসেন বইকি মা। ব্রহ্মচর্যটা যখন অসহ্য হয়ে ওঠে, তখন আসেন। –বলেই সে হাসতে লাগল। হাসি থামতে বললে, স্বামীর কথা আর জিজ্ঞাসা করবেন না, রাম-লক্ষ্মণ রয়েছে, ওদের সামনে আর-

গোষ্ঠদিদি আমাদের দুই ভাইয়ের নাম রেখেছিল রাম-লক্ষ্মণ। আমি রাম, অস্থির লক্ষ্মণ।

গোষ্ঠদিদির জীবন বিচিত্র। বাংলাদেশের কোন এক অখ্যাত গ্রামে অতি দরিদ্র পরিবারে তার জন্ম হয়েছিল। জ্ঞান হবার আগেই তার বাপ-মা মারা যায়। মাতুল ছিল, সেও অতি দরিদ্র। তবুও সে অনাথিনি ভাগ্নীকে তুলে নিয়ে গিয়ে নিজের পরিবারে পালন করতে লাগল। দু-তিন বছর যেতে-না যেতে মামাও মারা গেল। মামি তিন-চারটে অপোগণ্ড শিশু ও গোষ্ঠদিদিকে নিয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠল। তাদের অবস্থাও এদের চাইতে খুব উন্নত ছিল না। বরাতে নেহাৎ অনাহারে মৃত্যু নেই বলে মরণ হয়নি। তবু কিন্তু এতদিন চলছিল মন্দ নয়। কারণ নিজের বাড়ি থেকে মামার বাড়ি ও মামার বাড়ি থেকে মামার শ্বশুরবাড়ির মধ্যে পথের দূরত্ব থাকলেও অবস্থার বৈষম্য বিশেষ কিছু ছিল না। কাজেই স্থানভেদে ব্যবস্থার কিছু ইতর-বিশেষ ঘটলেও তার মধ্যে বৈচিত্র্য কিছু ছিল না। বৈচিত্র্য এল বিয়ের পর।

গোষ্ঠদিদির শ্বশুরঘর ছিল বিচিত্র। ব্রাহ্মণ ছিল তারা। শ্বশুর কোনো সরকারি আপিসে বড় চাকরি করতেন, দুশো টাকা পেনশন পেতেন। আমরা যখন তাঁকে দেখেছি, তখন তাঁর বয়স সত্তর পেরিয়ে গিয়েছে। ধবধবে সাদা বাবরি চুল ঘাড়ের ওপর লতিয়ে পড়েছে, সেই অনুপাতে লম্বা সাদা দাড়ি। ধুতি ও আলখাল্লা গেরুয়া রঙে ছোপানো। জুতো পায়ে দিতেন না, খড়ম পায়ে দিয়েই পেনশন আনতে যেতেন।

আমি আর অস্থির এঁর নাম দিয়েছিলুম–পাগলা সন্ন্যেসী।

পাগলা সন্ন্যেসীর দুই ছেলে। বড়কে তিনি বিলেত পাঠিয়েছিলেন লেখাপড়া শেখবার জন্যে। সেখানে সে বছর-পাঁচেক রহস্যজনকভাবে কাটিয়ে নামের পেছনে গুটিকয়েক রহস্যজনক অক্ষর জুড়ে ফিরে এসে বর্মায় কি এক রহস্যজনক ব্যবসা করত ও প্রতি মাসে দশ তারিখের মধ্যে বাপকে দুশো টাকা নিয়মিতরূপে পাঠাত। একদিন আমি তাঁকে বড় ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, সে কোথায় থাকে, কি করে, কিছুই জানি না। চিঠিপত্র সেও লেখে না, আমিও লিখি না। গরু আমার বটে, কিন্তু কাদের মাঠে ঘাস খায়, তা জানি না। তবে দুধ নিয়মিত পাচ্ছি, তাতেই খুশি আছি।

পাগলা সন্ন্যেসীর ছোট ছেলে যিনি, তিনিই আমাদের গোষ্ঠদিদির দেবতা। ছেলেবেলাতেই ইস্কুল-টিস্কুল ছেড়ে দিয়ে নেশা করতে শেখে। মা-মরা ছেলে, বাপ কোনোদিনই কিছু বলতেন না তাকে। পাগলা সন্ন্যেসী ছিলেন সেই পুরনো দিনের ইংরেজিওয়ালা, তার ওপরে মাসে পাঁচশো টাকা মাইনেওয়ালা সরকারি চাকরে। কলকাতায় প্রায় পনেরো কাঠা জমির ওপরে পৈতৃক ভিটে–লোকে তাঁকে বড়লোক বলেই জানত। তাই ষোল-সতেরো বছর বয়স হতে-না-হতে ছেলের চরিত্র সংশোধন করবার জন্যে একটি প্রায় সমবয়সি সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ধূমধাম করে ছোট ছেলের বিয়ে দিয়ে দিলেন।

আদিযুগের মানুষ ছিল যাযাবর। পশু পাখি কীট পতঙ্গ যাবতীয় প্রাণী যখন নিজেদের বাসা বেঁধে বাস করতে শিখেছে, মানুষ তখনও নিজের নীড় বাঁধতে শেখেনি। নেহাৎ প্রয়োজন ও বিপদ মানুষকে বাসা বাঁধতে শেখালেও অনেকের মনেই এই যাযাবর-প্রবৃত্তির বীজ সুপ্ত থাকে। অনুকূল অবস্থা পেলেই তা জেগে ওঠে। তাই মানুষের ইতিহাসের গোড়া থেকেই দেখা যায়, ঘরের বউ পালাচ্ছে, ঝি পালাচ্ছে, ছেলেপিলে পালাচ্ছে। এর মধ্যে বিস্মিত হবার কিছু নেই, বৈচিত্র্যও কিছু নেই।

একদিন সকালবেলা শয্যাতাগ করে পাগলা সন্ন্যেসী দেখলেন তাঁর ছোট ছেলে সপরিবারে হাওয়া হয়েছে।

এরকম একটা ব্যাপার বাড়িতে ঘটলে পাড়ার লোকে আইনত আশা করে যে, খুব একটা হৈ-চৈ হবে। কিন্তু পাগলা সন্ন্যেসী এ নিয়ে কোনো অনুসন্ধান, এমনকি কোনো উদ্বেগও প্রকাশ করলেন না। তাঁর একটানা জীবনযাত্রা যেমন চলছিল, তেমনই চলতে লাগল। তাঁর পুত্রবধূর বাপের বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল, তারা পুলিশে খবর দিলে। কিন্তু তাতেও তাদের সন্ধান, পাওয়া গেল না। শেষকালে তারা রটাতে লাগল যে, বুড়ো বাড়িখানা বড় ছেলেকে দেবার মতলবে ছোট ছেলে ও তার বউকে কোথায় উড়িয়ে দিয়েছে।

পাড়ার লোকদের তিনি অত্যন্ত তুচ্ছ করতেন বলে তাঁরাও তাঁর ওপর বিশেষ সন্তুষ্ট ছিল না। এই ব্যাপারের পর তারা খোলাখুলি ভাবেই বলে বেড়াতে লাগল, লোকটা অতি বদমাশ।

বছর পাঁচ-ছয় এইভাবে কাটবার পর একদিন সকালবেলায় পাগলা সন্ন্যেসীর নির্জন গৃহকুঞ্জ ‘হর হর বোম বোম্’ শব্দে ধ্বনিত হয়ে উঠল।

ব্যাপার কি! তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তিনি দেখলেন, পুত্র ও পুত্রবধূ ফিরে এসেছে। পুত্র একেবারে মহাদেব, পুত্রবধূ সাক্ষাৎ পার্বতী। পুত্রের কোমরে ন্যাঙট, সর্বাঙ্গ ৰিভূতিলিপ্ত, হাতে মাথা সমান উঁচু ত্রিশূল। পুত্রবধূর অঙ্গ গৈরিক শাড়িতে আবৃত, মাথায় চূড়া করে চুল বাঁধা, হাতে ত্রিশূল। উভয়ের চক্ষুই রক্তবর্ণ।

পাগলা সন্ন্যেসী তো এই দৃশ্য দেখে পরম পুলকিত হয়ে উঠলেন। বাইবেলের উদার পিতা ছেলের গৃহ-প্রত্যাগমনে উল্লসিত হয়ে সর্বাপেক্ষা স্থূল মেষশাবকটি বধ করেছিলেন। কিন্তু মেষপালনের কারবার এঁর ঘরে ছিল না, তাই তিনি ছেলের অভিনন্দনে মুরগি বধ করলেন গোটা পাঁচ-সাত। তাঁর এক মুসলমান চাকর ছিল, তাঁর নিজেরা যা কিছু কাজ সে-ই করত। সকালবেলা তিনি বউমার হেঁসেলে খেতেন আর রাত্রের রান্না করত এই চাকর–একটি বড় মুরগির রোস্ট, গ্রেট ঈস্টার্ন হোটেলের চারপয়সাওয়ালা একখানা রুটি দিয়ে তিনি নিত্য এই রোস্টের সদ্ব্যবহার করতেন।

ছেলে ও বউমা ফিরে আসায় দু-বেলা মুরগি বধ হতে লাগল! বাড়িতে মহোৎসব শুরু হল। ছোট ছেলে যে এমন ‘তালেবর’ হবে, এ কথা তিনি কোনোদিন কল্পনা করেননি। গার্হস্থ্য ও বানপ্রস্থের এমন synthesis ঋষি যাজ্ঞবন্ধ্যেরও সাধ্যের অতীত ছিল।

পাড়ার অধিকাংশ লোকই তাঁকে অপছন্দ করলেও অনেকে কৌতূহলপরবশ হয়ে ছেলে ও ছেলের বউকে দেখতে আসতে লাগল। ছেলে বাবার সামনেই গাঁজা ও চরস ফুঁকতে লাগল সারাদিন, রাত্রে কারণ উড়তে লাগল বোতল বোতল।

এতদূর অবধি চলছিল মন্দ নয়। কিন্তু পুত্রবধূও যখন শ্বশুরের শ্মশ্রু গাঁজার ধোঁয়ায় ধূমায়িত করতে আরম্ভ করলেন, তখন পাড়ার লোক গালাগালি দিতে লাগল। আমাদের পাগল সন্ন্যেসী কিন্তু এসব ভ্রূক্ষেপ করতেন না। বেলেল্লাপনা করুক, কিন্তু ছেলে-বউ যাতে বাড়িতেই থাকে, সে-বিষয়ে তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি; কিন্তু গৃহাশ্রমে বসেই সাধনমার্গে চলবার সর্বরকম সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও একদিন তারা আবার চলে গেল।

বছর-ছয়েক পরে একদিন পুত্র বাড়ি ফিরে এল, সঙ্গে স্ত্রী নেই। বছরখানেক ধরে পেটের নানারকম অসুখে ভুগে হরিদ্বারে তিনি দেহরক্ষা করেছেন। গৃহস্থ ভদ্রলোকের মেয়ে গাঁজা, চরস ও কারণ–এইসব দেবভোগ্য জিনিস বেশিদিন সহ্য করতে পারলেন না।

ছেলে বাড়িতে ফিরে সন্ন্যাসীর বহির্বাস অর্থাৎ ন্যাঙট ছেড়ে আবার ধুতি-পরা শুরু করে দিলে। স্ত্রীর শোকে অনেকে গৃহত্যাগ করে সন্ন্যাস গ্রহণ করে, কিন্তু এ ব্যক্তি স্ত্রীর শোকে সন্ন্যাস ত্যাগ করে গৃহী হবার দিকে মন দিল। পাগলা সন্ন্যেসী বছরখানেক ছেলের হালচাল দেখে আবার তার বিয়ে দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন।

পছন্দ-অপছন্দের বালাই যদি না থাকে, তবে কোনো দেশে কোনো কালে কোনো ছেলেমেয়েরই বিয়ে আটকায় না। পাগলা সন্ন্যেসীর ছেলের বিয়েও আটকাল না। আমাদের গোষ্ঠদিদি শিশুকাল থেকে মনে মনে শিবপুজো করত, তাই প্রজাপতি তাকে শিব জুটিয়ে দিলেন।

গোষ্ঠদিদির যখন বিয়ে হল, তখন তার পনেরো-ষোলো বছর বয়েস। বাড়ন্ত গড়ন বলে তাকে বয়সের চেয়ে অনেক বড় দেখাত। সে-সময়ে বারো বছরের মধ্যে মেয়ের বিয়ে দিতে না পেরে কত বাঙালি বাপ-মা যে নরকস্থ হত, একমাত্র চিত্রগুপ্তই তার হিসাব দিতে পারেন। কিশোর বয়সে এই সুন্দরী ধরণী রঙিন স্বপ্নের মতন যখন মেয়েদের মনে অতি সন্তর্পণে আত্মপ্রকাশ করতে থাকে, মেঘমণ্ডিত বর্ষার প্রভাতে ক্ষীণ রবিকরের মতো স্থিমিত যৌনচেতনা যখন তার অবজ্ঞাত মানসলোকে ঈষৎ চাঞ্চল্য জাগিয়ে তোলে, অজানিত সম্ভাবনাপূর্ণ ভবিষ্যৎজীবন অনভিজ্ঞ সংসার বুদ্ধির প্রতিফলকে যখন রঙিন হতে থাকে, জীবনের সেই পরম সন্ধিক্ষণে অভিভাবকের আর্তনাদ-গেল রাজ্য, গেল কুল, চৌদ্দপুরুষ বুঝি নরকস্থ হল রে-অন্তর ও বাহিরের এই বিষম হট্টগোলের মধ্যে গোষ্ঠদিদির জীবনে একদিন সানাইয়ের সাহানা বেজে উঠল।

বিয়ে দিয়ে ঘরে এনেই পাগলা সন্ন্যেসী বউমাকে ছেলের গুণের কথা সব খুলে বললেন। অতীতকালে যিনি তাঁর পুত্রবধূরূপে ঘরে এসেছিলেন, স্বামীর সঙ্গে বেরিয়ে গিয়ে তিনি কি নির্বুদ্ধিতা করেছিলেন, সে-সম্বন্ধে কয়েকদিন ধরে তাকে বিধিমতে তালিম দিলেন।

এদিকে ছেলে নতুন খেলনা পেয়ে দিনকতক খুব খুশি রইল। গৃহাশ্রমে ফিরে এলেও সন্ন্যাসাশ্রমের নেশাপত্র তখনও সে ছাড়েনি। একলা ঘরে বসে নেশা করার কোনো মজা নেই। কিছুদিন যেতে-না-যেতে সে বউকেই গাঁজা ও মদ খাবার জন্যে জেদ করতে আরম্ভ করে দিলে। কিন্তু গোষ্ঠদিদি কিছুতেই নেশা করতে রাজি নয়। শেষকালে অবাধ্য স্ত্রীর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে আবার একদিন সে বাড়ি ছেড়ে উধাও হয়ে গেল।

পাগলা সন্ন্যেসী শুনে বললেন, গেছে যাক, আবার ফিরে আসবে, তুমি কিছু ভেবো না বউমা।

এই ইতিহাস আমরা কিছু পাগল সন্ন্যেসীর মুখে ও কিছু গোষ্ঠদিদির মুখে শুনেছি।

এই পাগলা সন্ন্যেসী ও তাঁর পুত্রবধু ছিল আমার ও অস্থিরের প্রাণের বন্ধু। গোষ্ঠদিদি আমাকে রাম-ভাই আর অস্থিরকে লক্ষ্মণ-ভাই বলে ডাকত। পাগলা সন্ন্যেসী আমাদের রামবাবু আর লক্ষ্মণবাবু বলে ডাকতেন। আমরা তাঁকে ডাকতুম পাগলা সন্ন্যেসী বলে। তিনি বলতেন, আমার বাপ-মা, ছেলেপুলে, বন্ধু-বান্ধব, কেউ আমার আসল নাম ধরে ডাকেনি। তোমাদের অন্তর্দৃষ্টি আছে, এই আমার আসল নাম, এই আমার স্বরূপ, এই আমার সারা জীবনের পরিচয়। 1

একদিন বিকেলে আমরা গোষ্ঠদিদির সঙ্গে বসে গল্প করছি, এমন সময়ে পাগলা সন্ন্যেসী সেখানে এসে আমাদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করে তাঁর ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন।

ঘরের মধ্যে গিয়ে দেখি, আট-দশটা দরজাওয়ালা মস্ত বড় হলঘর। একটি কি দুটি মাত্র দরজা খোলা, সমস্ত ঘরখানাই প্রায় অন্ধকার। দেওয়ালের গায়ে ঘেঁষানো বড় বড় সারবন্দি আলমারিতে বই ঠাসা। একধারে একখানা সরু খাট, তাতে বিছানা পাতা। বিছানার চাদর বালিসের খোল সব গেরুয়া রঙের। খাটের ওপরে বালিশের চারপাশে অগোছালভাবে একরাশ বই ছড়ানো।

পাগলা সন্ন্যেসী খাটের ওপরে বসলেন। সামনেই মান্ধাতার আমলের পুরনো গোটা দুই সোফা, তারই ওপরে আমাদের বসিয়ে গল্প জুড়ে দিলেন। ডফ্ সায়েবের ইস্কুলে পড়ি শুনে ডফ্ সাহেব সম্বন্ধে, ক্রিশ্চান ইস্কুল ও তাঁদের আমলের ইংরেজ অধ্যাপকদের হালচাল ইত্যাদি অনেক মজার গল্প শোনালেন। ওঠবার সময়ে বললেন, দেখ, আমাদের সঙ্গে যখন বন্ধুত্ব হল, তখন রোজ আসবে, বুঝলে?

পাগলা সন্ন্যেসীর মতো সর্ববিষয়ে এমন উদার ও অদ্ভুত লোক আমি জীবনে দুটি দেখিনি। আমাদের বয়স তখন দশ-বারো বৎসর ও তাঁর বয়স সত্তর-বাহাত্তর, অথচ আমাদের সঙ্গে কোথাও কোনো বিষয়েই তাঁর বাধত না। আমাদের লাট্টু ঘোরানো, ঘুড়ি ওড়ানো, জানোয়ার পোষা প্রভৃতি ব্যাপারে তাঁর উৎসাহ আমাদের চাইতে কিছু কম ছিল না। পাড়ার লোকেরা কেন যে তাঁকে বদমাশ বলত, তা আমরা ভেবে ঠিক করতে পারতুম না। এঁরই বাড়ির ভেতর দিয়ে বিকেলে আমরা লতুদের বাড়ি পালিয়ে যেতুম। তাঁর কাছে আমাদের গোপন কিছুই ছিল না। আমরা কোথায় যাই আর কেমন করে যাই, কি করে ঘাসওয়ালাকে ফাঁকি দিয়ে লতুদের বাড়িতে যাবার ব্যবস্থা করেছি, সে-সব শুনে তিনি খুব উপভোগ করতেন আর হো-হো করে হাসতে থাকতেন।

সে-সময়ে শিক্ষিত অশিক্ষিত প্রায় সকলেই কথায়-বার্তায় ব্রাহ্মদের খোঁচা দিতেন, কিন্তু পাগলা সন্ন্যেসীর মুখে কখনও ব্রাহ্মদের নিন্দা শুনিনি। ব্রাহ্মসমাজের কথা উঠলে তিনি হেসে বলতেন, ওদের খেয়াল হয়েছে, সমাজ সংস্কার করবে, তা করুক না।

একদিন, বোধ হয় সেদিন শনিবার, বেলা তিনটে হবে, আমরা পাগলা সন্ন্যেসীর ঘরে গিয়ে দেখি, তিনি খাটে আধ-শোয়া হয়ে কি-একখানা বই পড়ছেন। আমরা ঘুরে ঢুকতেই তিনি ব‍ই রেখে উঠে বসে বললেন, এস এস রামবাবু, লক্ষ্মণবাবু, বস। মন আমার তোমাদেরই খুঁজছিল, ঠিক সময়ে এসে পড়েছে।

জিজ্ঞাসা করলুম, কি পড়ছিলেন?

আরে, সেইজন্যেই তো তোমাদের খুঁজছিলুম। পড়ছি শেলী; একলা পড়ে মজা নেই ব্রাদার, বড় সুসময়ে এসেছ।

এই বলে বই রেখে তিনি উঠে পড়লেন। একটা বেঁটে আলমারি খুলে একটা সজারু-কাঁটার বাক্স বের করে নিয়ে আবার খাটে এসে বসলেন। আমাদের উদ্‌গ্রীব দু-জোড়া চোখ বাক্সর ওপর গিয়ে পড়ল। তিনি বাক্স থেকে বার করলেন এক-হাতটাক লম্বা টকটকে লাল একটা তামার কলকে। কলকে একটা অতি সাধারণ জিনিস, কিন্তু তার এমন সুন্দর রূপ হতে পারে দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলুম। সেটাকে হাতে নিয়ে দেখবার ইচ্ছা হতে লাগল, কিন্তু সাহস করে কিছু বলতে পারলুম না। তারপরে বেরুল একটা মোটা ছোট্ট চন্দনকাঠের চাকতি, একটা সুন্দর ঝিনুকের বাঁটওয়ালা চকচকে ছুরি। তারপরে রুপোর পানের ডিবে থেকে কি কতকগুলো জড়িবুটি বের করে বেছে নিয়ে তাতে কয়েক ফোঁটা গোলাপজল দিয়ে টিপটে টিপতে শেলী সম্বন্ধে গল্প বলতে লাগলেন। কি করে কবি বাড়ির লোকদের সঙ্গে ঝগড়া করে বিয়ে করলেন, স্ত্রীর সঙ্গে বনল না, আবার জীবনে নতুন সঙ্গিনী এল। বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেলেন কোনো বিদেশে, তারপরে জলে ডুবে মৃত্যু–উপন্যাসের কাহিনির চেয়ে কবির সেই চিত্তাকর্ষক জীবনকথা শুনতে শুনতে আমাদের বালকমন ব্যথিত হয়ে উঠতে লাগল।

কথার সঙ্গে সঙ্গে হাত সমানভাবেই চলছিল। বেশ করে গাঁজায় কয়েকটি দম লাগিয়ে ঘরের মধ্যে দস্তুরমতো একটি মেঘলোক সৃষ্টি করে পাগলা সন্ন্যেসী আগের বইখানা তুলে নিয়ে পাতা ওলটাতে-ওলটাতে বলতে লাগলেন, তোমাদের কাছে শেলীর কবিতা পড়ব। ভয় পেয়ো না, আমি বুঝিয়ে দোব, কোনো কষ্ট হবে না বুঝতে।

এই বলে একটা পাতা বের করে বললেন, এ কবিতাটির নাম Alastor।

প্রথমে তিনি Alastor কবিতার ভাবার্থ বলে গেলেন, তারপরে সমস্ত কবিতাটি আবৃত্তি করে পড়লেন। এরকম অসামান্য আবৃত্তি এর আগে আমরা শুনিনি। মেঘগর্জনের মতন সেই কণ্ঠস্বর প্রকাণ্ড হলঘরের প্রতিধ্বনিকে জড়িয়ে নিয়ে গমগম করে আমাদের কানের মধ্যে দিয়ে সমস্ত দেহটাকে ঝঙ্কার দিতে লাগল। কবিতার ভাষা বোঝবার মতো বিদ্যে আমাদের ছিল না, তার ভাবার্থ একটু আগেই শুনেছি মাত্র। শুধু ধ্বনি ও সুর মনের মধ্যে একটার পর একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে লাগল। চোখের সামনে যেন দেখতে লাগলুম, Alastor-এর কবি চলেছে দূরে, সুদূরে–তার অন্তরে যে চেতনা জেগেছে তারই সন্ধানে। চলেছে, চলেছে–কত দেশ কত মেয়ে এল তার জীবনে, তবুও সে চলেছে, বিরামহীন। চলতে চলতে জরায় তার দেহ শুকিয়ে গেল। অমন যে সুন্দর কিশোর, তাকে দেখলে তখন ভয় হয়, চেনা যায় না। তার বুকের মধ্যে যে অতৃপ্তি, দুর্লভকে লাভ করবার যে পিপাসা, তারই আগুন শুধু দুই চোখে ধকধক করে জ্বলছে। গ্রামের লোকেরা দয়া করে তাকে দুটি খেতে দেয়, সে আবার চলা শুরু করে। পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় সে ঘোরে, লোকেরা মনে করে–সে বুঝি ঝড়ের অন্তরাত্মা, মানুষের রূপ ধরেছে। শিশুরা তাকে দেখে সভয়ে জননীর বুকে মুখ লুকোয়। দুনিয়ার কেউ তার মনের কথা বোঝে না। সকলেই সভয়ে সবিস্ময়ে বা শ্রদ্ধায় তাকে পথ ছেড়ে দিয়ে অবাক হয়ে থাকে। শুধু–

Youthful maidens, taught
By nature, would interpret half the woe
That wasted him, would call him with false names
Brother, and friend, would press his pallid hand
At parting, and watch, dim through tears, the path
Of his departure from their father’s door.

কত অদ্ভুত প্রাকৃতিক দৃশ্য! সুন্দরে ভয়ালে কি আশ্চর্য সংমিশ্রণ–তারই মধ্য দিয়ে আমাদের কবি চলল মৃত্যুর দিকে। মুখে এক মন্ত্র–

–’Vision and love!’
— I have beheld
The path of thy departure. Sleep and death
Shall not divide us long!

তারপরে একদিন অতি দূর দুর্গম শান্ত সুন্দরী প্রকৃতির কোলে তার শ্রান্ত দেহ বিছিয়ে দিলে–শান্তময়ী মৃত্যু এসে তাকে নিয়ে চলে গেল।

পড়া শেষ করে পাগলা সন্ন্যেসী বই বন্ধ করে কিছুক্ষণ করে চুপ করে রইলেন। তার পরে একটু হাসবার চেষ্টা করে বললেন, তবুও তো Alastor-এর কবির বরাতে–

One silent nook
Was there, Even on the edge of that vast mountain
…that seemed to smile
Even in the lap of horror–

ছিল হে রামবাবু! আমাদের বরাতে যে তাও জোটে না, কি বল? বলেই তিনি হো-হো করে হেসে উঠলেন। অন্ধকার হয়ে এলেও স্পষ্ট দেখতে পেলুম, তাঁর চোখ থেকে একসঙ্গে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরঝর করে ঝরে পড়ল। আমার চোখও জলে ভরে উঠেছিল। অস্থিরের দিকে ফিরে দেখলুম, তার চোখও অশ্রুতে পরিপূর্ণ।

.

সেদিন থেকে পাগলা সন্ন্যেসীর সঙ্গে আমাদের অন্তরঙ্গতা খুবই বেড়ে গেল। তাঁর কাছে গিয়ে কবিতার আলোচনা হতে লাগল। আলোচনা মানে, তিনি শেলীর কবিতা পড়ে আমাদের শোনাতেন আর ব্যাখ্যা করতেন, আর আমরা তার মধ্যে থেকে চটকদার কথা বেছে নিয়ে মুখস্থ করতুম।

একদিন পাগলা সন্ন্যেসী বললেন, আজ রামবাবু, তুমি একটা কবিতা আবৃত্তি কর।

নিজেদের কোনো একটা কেরামতি দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে একটু প্রশংসা পাবার ইচ্ছা সর্বদাই মনের মধ্যে জাগ্রত ছিল। গোষ্ঠদিদি আমাদের মুখের সামনে ও আমাদের আড়ালে মার কাছে নিয়ত আমাদের প্রশংসা করত আর বাহাদুরি দিতে থাকত। সে কথায় কথায় বলত, আমার রাম-লক্ষ্মণ ভাই আছে, আমার ভাবনা কিসের? কিন্তু পাগলা সন্ন্যেসী আমাদের গুণাগুণ সম্বন্ধে কোনো শ্রুতিসুখকর মন্তব্য করতেন না বলে ক্ষুণ্ণ না হলেও সে সম্বন্ধে মনের মধ্যে একটা উদ্‌গ্রীব আকাঙ্ক্ষা ছিল। সেদিন আবৃত্তি করার প্রস্তাব করামাত্র মনে হল আজ একটু কায়দা দেখিয়ে দেওয়া যাক তা হলে।

ইস্কুলে প্রাইজ-ট্রাইজ না পেলেও প্রাইজের জলসায় আমার খাতির ছিল। প্রায় প্রতি বছরেই প্রাইজের সময় আমাকে একটা ইংরেজি ও একটা বাংলা কবিতা আবৃত্তি করতে হত। সঙ্গে সঙ্গে হাততালিও পেতুম যদিও সে হাততালির অর্থ সম্যক বুঝতে পারিনি।

সে-সময়ে বাংলাদেশের সর্বত্রই হেমচন্দ্রের ‘বাজরে শিঙ্গা বাজ্ ঐ রবে’ কবিতাটির খুব আদর ছিল। সভা-সমিতির জমাবার ওইটি ছিল একটি অব্যর্থ বাণ। দু-তিন বার কবিতাটি আমিও আবৃত্তি করেছিলুম। পাগলা সন্ন্যেসী বলামাত্র আমি তড়াক করে উঠে বুক চিতিয়ে এমন চিৎকার করে আবৃত্তি শুরু করে দিলুম যে বাড়ির ভেতর থেকে গোষ্ঠদিদি দৌড়তে দৌড়তে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল।

আবৃত্তির পর ঘরখানা গমগম করতে লাগল। গোষ্ঠদিদির সঙ্গে চোখাচোখি হতে দেখলুম, তার মুখে-চোখে প্রশংসা উপচে পড়ছে।

গোষ্ঠদিদি বাড়ির ভেতরে চলে গেল, আমিও কোচে বসে পড়লুম। বোধ হয় মিনিট খানেক চোখ বুঝে চুপ করে বসে থেকে পাগলা সন্ন্যেসী বললেন, কি শিঙ্গে ফোঁকার কবিতা আবৃত্তি করলে হে রামবাবু! ছিঃ, তোমার কাছ থেকে এ আশা করিনি।

ইস্! এক্কেবারে দমে গেলুম।

এক মুহূর্ত পরে পাগলা সন্ন্যেসী বললেন, আচ্ছা লক্ষ্মণবাবু, এবার তুমি একটা আবৃত্তি কর।

অস্থির উঠে বিনিয়ে বিনিয়ে আবৃত্তি করলে–

‘আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে
হের ঐ ধনীর দুয়ারে দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।’

অস্থিরের আবৃত্তি শেষ হতে-না-হতে পাগলা সন্ন্যেসী বলে উঠলেন, বাবা লক্ষ্মণবাবু, তুমি ফুল-মার্কস পেলে। ছি ছি রামবাবু, তোমার কাছ থেকে এ আশা করিনি। শেষে কিনা ওই শিঙ্গে ফোঁকার কবিতা আবৃত্তি করলে!

সজারু-কাঁটার বাক্স বেরুল। গাঁজা টিপতে টিপতে বললেন, এ বিদ্যেটা আমায় ছোট ছেলে শিখিয়েছে। তা না হলে আমরা ছেলেবেলা থেকে সরাব-টরাব খাই। গাঁজা খেতে শেখালে আমার ছোট ছেলে আর বউমা–তোমাদের গোষ্ঠদিদির সতীন।

তিন-চারটি দম লাগিয়ে কলকেটি উলটে রেখে পাগল সন্ন্যোসী জিজ্ঞাসা করল, লক্ষ্মণবাবু, যে কবিতাটি আবৃত্তি করলে, সেটি কার লেখা?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের।

ঠাকুর! কোথাকার ঠাকুর? পাথুরেঘাটার, না, জোড়াসাঁকোর?

জোড়াসাঁকোর

ও, তা হলে দেবেন ঠাকুরের ছেলে হবে। হ্যাঁ দেবেন ঠাকুরের ছেলেরা খুব তালেবর বটে। বেশ লিখেছে হে ছোকরা-

“মাতৃহারা মা যদি না পায় তবে আজ কিসের উৎসব!” ছি ছি রামবাবু তোমার ওটা কি কবিতা! লক্ষ্মণবাবু, তুমি আজ ফুল-মার্কস্ পেয়েছ।

আমাদের বাড়িতে পুজো কিংবা বড়দিনের ছুটির সময় এক ভদ্রলোক এসে দিনকয়েক করে থাকতেন। এঁর নাম ছিল বিপিন চক্রবর্তী। ইনি মফস্‌সলের সরকারি চাকরি করতেন। বিপিনবাবু ছিলেন কবি এবং সে-সময় একখানা কবিতার বইও ছাপিয়েছিলেন, নাম তার ‘বুদ্বুদ’।

কবিতা লেখবার ক্ষমতা চক্রবর্তী মহাশয়ের কতখানি ছিল তা বলতে পারি না, তবে তাঁর দূরদৃষ্টি যে খুব ছিল তা বইয়ের নামকরণ দেখেই বোঝা যায়।

কিন্তু কাব্যপ্রতিভা থাক আর নাই থাক, বিপিনবাবুর প্রকৃতিটি ছিল একেবারে কবির মতো–যা কবিদের মধ্যেও দুর্লভ। এক কথায় বলতে গেলে তিনি অতি ‘মহাশয় ব্যক্তি’ ছিলেন। আমার আর অস্থিরের একটা আলাদা ঘর ছিল। বিপিনবাবু আমাদের বাড়িতে এলে আমাদের ঘরেই তাঁর থাকবার ব্যবস্থা হত, আর তাঁর সমস্ত কিছু তদারকের ভার আমাদের দুই ভাইয়ের ওপরে পড়ত।

জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর যাওয়া-আসা ছিল। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে পরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথের একজন মহাভক্ত ছিলেন তিনি। সে-সময়ে সাহিত্য-চৰ্চা অতি অল্প লোকই করতেন, যাঁরা করতেন তাঁদের মধ্যে সত্যিকারের রসগ্রাহী লোক খুব কমই ছিল। ব্রাহ্মসমাজের কেউ কেউ এবং ব্রাহ্মসমাজের বাইরে গোনাগুনতি কয়েকজন ছাড়া রবীন্দ্রনাথের কবিতা উপভোগ করা তো দূরের কথা, সকলে তাঁকে গালাগালিই দিত। এমন লোকও আমরা দেখেছি, যারা অন্য সাহিত্যিকদের যে-সব দোষকে গুণ বলে কীর্তন করত, সেইসব দোষ রবীন্দ্রনাথের ওপর আরোপ করে তাঁকে গালাগালি দিতে থাকত। এইসব ব্যক্তিগত আক্রমণের সঙ্গে কবিতা- সমালোচনার কোনো যোগ না থাকলেও রবীন্দ্র-কাব্যের রসগ্রহণ তারা ওই মাপকাঠি দিয়ে করত। এখন মনে হয়, দেশসুদ্ধ লোক রবীন্দ্রনাথের এমন ভক্ত কি করে হয়ে উঠল!

যাই হোক, রাত্রে ঘুমোবার আগে বিপিনবাবুর সঙ্গে আমাদের কাব্য-আলোচনা হত। আলোচনা শুরু হতেই আমরা কায়দা করে শেলীকে এনে ফেললুম। তার-পরে এতদিন ধরে পাগলা সন্ন্যেসীর যে-সব চটকদার বাক্য আমরা মুখস্থ করেছিলুম, গড়গড় করে বিপিনবাবুর কাছে তা ওগরাতে আরম্ভ করে দিলুম।

আমাদের বয়েসি ছেলেদের মুখে সেই সব বিজ্ঞজনোচিত বাক্য শুনে বিপিনবাবুর চক্ষু একেবারে চড়কগাছে উঠে গেল। আমরা তাঁকে দম নেবার সময় না দিয়ে Episychidion, Prince Athanase, Ode [ Hymn / to Intellectual Beauty, The Revolt of Islam–এর Dedication থেকে ছাঁকা ছাঁকা লাইন, যা-সব এইরকম সুযোগে ছাড়বার জন্যে মুখস্থ করে রেখেছিলুম, তাই পাগলা সন্নোসীর অনুকরণে আমি আবৃত্তি করতে লাগলুম, আর অস্থির চোখ বুজে বুড়ো মানুষের মতন ধরা-ধরা গলায় বলতে লাগল, আহা-হা, এর কি তুলনা আছে!

বিপিনবাবু তো খুব খুশি। এমন কি আমাদের হালচাল দেখে ভদ্দরলোক দস্তুরমতো ভড়কেই গেলেন। একদিন তিনি মাকে ডেকে বললেন, ঠাকরান, আপনার এই স্থবির ও অস্থির এরা মহাপুরুষ।

মা বললেন, হ্যাঁ, আমাদের ছলনা করতে এসেছেন।

তিনি হেসে বললেন, দেখে নেবেন আপনি, এদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।

.

রবীন্দ্রনাথের কাব্যের সঙ্গে আমাদের পরিচয় তখনও জমে ওঠেনি। ব্রহ্মসঙ্গীতের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের যে-সব গান ছিল তার সুর, বাঁধুনি ও প্রকাশভঙ্গির মধ্যে যে একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তা বুঝতে পারতুম মাত্র। ‘কথা ও কাহিনী’র দু-একটা কবিতার সঙ্গে যা পরিচয় হয়েছিল তা খুব ভালো লাগত; কিন্তু কেন যে ভালো লাগত, তা প্রকাশ করতে পারতুম না। যদিও অন্য বাংলা কবিতার সঙ্গে তার আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে তা অনুভব করতুম মাত্র। আমাদের কাব্যালোচনার মজলিশে বাংলা কবিতার কথা উল্লেখ করবার জো ছিল না। তখনকার দিনে বাঙালিরা হেম, নবীন, মধুসূদনকে, অধিকাংশ স্থলে না পড়েই, দেবতা জ্ঞান করত। পাগলা সন্ন্যেসী যখন তাঁদেরই নস্যাৎ করে দিতেন, তখন আর সেখানে রবীন্দ্রনাথের কথা তুলতেই সাহস হত না, রসভঙ্গ হবার ভয়ে।

বিপিনবাবুর সঙ্গে আমাদের ভাব খুব জমে ওঠবার পর আমরা তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ এবং তাঁর কাব্য সম্বন্ধে যে-সব কথা শুনতে লাগলুম–তাঁর ছন্দ, তাঁর প্রকাশভঙ্গি, কবিতার বিষয়-নির্বাচন ও ব্যঞ্জনা–এইসব কথা পাগলা সন্ন্যেসীর কাছে অতি সন্তর্পণে ছাড়তে আরম্ভ করে দেওয়া গেল। আর পাগলা সন্ন্যেসীর বাক্যাবলী বিপিনবাবুকে গিয়ে বলতে লাগলুম। ফলে উভয় স্থানেই দিনে দিনে আমাদের খাতির বেড়ে যেতে লাগল।

এমনই দিন চলেছে, এরই ফাঁকে ফাঁকে লতুদের বাড়িও যাওয়া-আসা ঠিক চলেছে, এমন সময় একদিন রাত্রে বিপিনবাবু আমাদের রবীন্দ্রনাথের ‘অসময়’ ও ‘দুঃসময়’ এই কবিতা দুটি শোনালেন। রবীন্দ্রনাথ যে খুব বড় কবি, মনে-মনে সে-কথা নিশ্চিত স্বীকার করলেও স্রেফ মুরব্বিয়ানা করে পাগলা সন্ন্যেসীর বুকনিগুলো শোনবার লোভে বিপিনবাবুর কাছে আমরা সে-কথা স্বীকার করতুম না। কিন্তু এই কবিতা দুটি আমাদের মুখ থেকে পাণ্ডিত্যের মুখোশ একেবারে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। ‘অসময়’ ও ‘দুঃসময়’ আমাদের এত ভালো লাগল যে, তখুনি দুই ভাই কবিতা দুটি মুখস্থ করে ফেললুম।

কয়েকদিন পরে পাগলা সন্ন্যেসীর কাছে কোনো ছুতোয় রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গে তুলে দুজনে সেই দুটো কবিতা তাঁকে আবৃত্তি করে শুনিয়ে দিলুম।

কবিতা দুটো শুনে ভদ্রলোক কিছুক্ষণ আমাদের মুখের দিকে হকচকিয়ে চেয়ে থেকে একেবারে উছলে উঠলেন–আহা, অদ্ভুত, অদ্ভুত! খুব কবিতা লিখেছে হে তোমাদের রবীন্দ্রনাথ কোনো বাঙালি এর আগে এমন কবিতা লিখতে পারেনি।

চটপট উঠে সজারু-কাঁটার বাক্স নিয়ে এসে গাঁজা তৈরি করতে করতে বলতে লাগলেন, রবীন্দ্রনাথের বই কোথায় পাওয়া যায় আমায় বল তো? ওরা নাটক লিখে বাড়িতে অভিনয় করে শুনেছি, কিন্তু এমন কবিতা লেখে তা জানতুম না।

গাঁজা-টাজা টেনে পাগলা সন্ন্যেসী ভোম হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। তারপর হঠাৎ একবার উছলে উঠে বললেন, আহা-হা, কি কথাই বলেছে হে

তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে–

বল না রামবাবু, আমার কি ছাই জানা আছে, তুমি বল, তোমার সঙ্গে আমিও বলি। কিশোর কণ্ঠের সঙ্গে বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর গর্জে উঠল–

তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে,
দীর্ঘ ভ্রমণ একদিন হবে অন্ত রে,
শান্তি-সমীর শ্রান্ত শরীর জুড়াবে-

রামবাবু, লক্ষ্মণবাবু এই শেষবয়সে তোমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হল। তোমাদের এখনও অনেক দূর চলতে হবে। দেখবে, জীবনে কত দুঃখ, কত ব্যর্থতা, কত অশান্তি আসবে। কারুর মুখেই শুনবে না যে সে বেশ ভালো আছে। এই জীবনের মধ্যে দাঁড়িয়ে কে এমন করে বুক ঠুকে আশ্বাস দিতে পারে–

তবু একদিন এই আশাহীন পন্থ রে
অতি দূরে দূরে ঘুরে ঘুরে ঘুরে শেষে ফুরাবে?

ভাগ্যে তোমাদের সঙ্গে ভাব হয়েছিল!

.

সুজাতার মৃত্যুর পরদিন অতি প্রত্যূষে বাবা দরজা ধাক্কা দিয়ে আমাদের দুই ভাইকে ঘুম থেকে তুলে হেদোয় বেড়াতে নিয়ে গেলেন। সেখানে পাক-পাঁচেক চক্কর দিয়ে বাড়িতে এসেই বললেন, জামা-টামা ছেড়ে বই নিয়ে এসে পড়তে বস।

তিনি হয়তো মনে করেছিলেন, সব দিকে তাঁর সতর্ক দৃষ্টির অভাব ঘটাতেই আমাদের পক্ষে এমন বেয়াড়া হয়ে পড়া সম্ভব হয়েছে। পড়তে বসামাত্র আমার ইতিহাসের বইখানা হাতে তুলে নিয়ে প্রশ্ন করলেন, কুতুবউদ্দিন কে ছিল?

আমার মন তখন কুতুবউদ্দিনের চেয়ে অনেক বড় বড় ঐতিহাসিক ব্যক্তি–Merry Godwin, Emily Viviana-এর চিন্তায় মশগুল। কুতুবউদ্দিনের মতন লোক সেখান থেকে চিরদিনের জন্যে নির্বাসিত হয়েছে। বাবার মুখে সে নাম শুনে কুতুবমিনারের চিন্তায় কড়িকাঠের দিকে চেয়ে আছি, এমন সময় খটখট শব্দ শুনে সামনে চেয়ে দেখি যে, ধীরপদক্ষেপে পাগলা সন্ন্যেসী আসছেন আমাদের পড়বার ঘরের দিকে।

খড়ম পায়ে খটখট শব্দ করতে করতে তিনি আমাদের ঘরে এসে ঢুকলেন। ঘরের মধ্যে একখানা তক্তাপোশ আর তার ধারে খানকয়েক চেয়ার সাজানো থাকত। আমরা বসতুম তক্তাপোশে আর বাবা বসতেন চেয়ারে। ঘরের মধ্যে কোনো গুরুজন থাকলে চেয়ারে বসা আমাদের বারণ ছিল। যাই হোক, পাগলা সন্ন্যেসী ঘরের মধ্যে আসতেই বাবা তাঁকে নমস্কার করে বললেন, বসুন।

পাগলা সন্ন্যেসী মিনিটখানেক চুপ করে বসে থেকে আমাদের দেখিয়ে বললেন, আমি এই রামবাবু আর লক্ষ্মণবাবুর বন্ধু।

আমরা প্রমাদ গুনতে লাগলুম। মনে হল, ফাঁড়াএখনও কাটেনি বোধ হয়, নইলে পাগলা সন্ন্যেসীর মতন লোক এমন কাঁচা কাজ করবেন কেন?

বাবা তো একেবারে অবাক। আমাদের দিকে একবার চেয়ে তাঁর দিকে মুখ করতেই তিনি বললেন, আমরা এদের রাম-লক্ষ্মণ বলে ডাকি। স্থবির-অস্থির আবার কোন দেশের নাম মশায়?

বাবা একটু হাসবার চেষ্টা করলেন মাত্র।

পাগলা সন্ন্যেসী আমাদের দেখিয়ে বললেন, এ দুটি কি আপনার ছেলে? হ্যাঁ।

এদের মা বেঁচে আছেন?

হ্যাঁ!

মা বেঁচে থাকতেই এই!

বাবা মনে করলেন, তিনি বোধ হয় আমাদের নামে কোনো গুরুতর অভিযোগ করতে এসেছেন। একটু সঙ্কুচিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কেন এসব প্রশ্ন করছেন বলুন তো?

একটু কারণ আছে। দেখুন, রামবাবু আর লক্ষ্মণবাবু আমার বন্ধু–বিশেষ বন্ধু। আপনি কাল রাতে এদের ওপর যখন অমানুষিক অত্যাচার করছিলেন, তখন আমার উচিত ছিল আপনার হাত থেকে এদের রক্ষা করা। কিন্তু আমি বৃদ্ধ, হয়তো সামর্থ্যে আপনার সঙ্গে পারব না, তাই ভেবে তখন আসিনি। কিন্তু আপনি এদের যত মেরেছেন, তার প্রত্যেকটি আঘাত আমায় লেগেছে। বারদিগর এমন হলে আমাকে আসতে হবে।

এমন সব কথা বাবার মুখের সামনে কেউ বলতে পারে, তা আমাদের কল্পনারও অতীত ছিল। বাবা সব শুনে একটু আমতা-আমতা করে বললেন, বড় অবাধ্য ছেলে মশায়, কিছুতেই কথা শুনতে চায় না। বড় বদ ছেলে, আপনি চেনেন না এদের।

আমি চিনি না এদের!

পাগলা সন্ন্যেসীর হাসি শুনে বাবা চমকে উঠলেন।

আমি চিনি না এদের! আপনি চেনেন না এদের। আমার তো মনে হয়, এরা মহাপুরুষ। আপনার ভাগ্য যে, এমন সব ছেলে আপনার ঘরে জন্মেছে। কিন্তু এদের মানুষ করতে পারবেন না আপনি, আমি দিব্যচক্ষুতে দেখতে পাচ্ছি।

বেশ বোঝা গেল, আমাদের প্রশংসা শুনে বাবা খুশি হয়েছেন। তিনি বললেন, দেখুন, কথা না শুনলে আমার বড় রাগ হয়, আর, একবার রাগলে আমার জ্ঞান থাকে না। এদের বিকেলে বাড়ি থেকে বেরুতে বারণ করি, কিন্তু কিছুতে ওরা সে কথা গ্রাহ্য করে না। কি করি বলুন তো?

কেন বাড়ি থেকে বেরুতে বারণ করেন?

বাইরে বদ সঙ্গী জুটতে পারে।

আচ্ছা, আপনি আর ক’বছর এদের বাড়িতে বন্ধ রাখবেন, জিজ্ঞেস করি? ওরা ইস্কুলে যায়, সেখানে তো বদ সঙ্গী জুটতে পারে! তা হলে ইস্কুলে যাওয়া বন্ধ করে ছেলেদের সিন্দুকে তুলে রেখে দিন।

বাবা একটু হাসলেন মাত্র।

পাগলা সন্ন্যেসী আবার শুরু করলেন, আপনি তো এদের বাইরে যেতে বারণ করে দিয়েই নিশ্চিন্ত হলেন। তারপর, বাইরে এদের বন্ধুবান্ধব রয়েছে, খেলা রয়েছে, কত রকম উত্তেজনা রয়েছে, তার বদলে বাড়িতে কি ব্যবস্থা করেছেন শুনি? মশায়, এই দাড়ি পাকতে সত্তর বছর লেগেছে আমার, ছেলেবয়েস আপনার একদিন ছিল, ছেলেদের মনটা সেই বয়েস দিয়ে একবার বুঝতে চেষ্টা করবেন।

বাবা আমাদের বললেন, যাও, তোমরা বাড়ির ভেতরে যাও।

আজ্ঞা পাওয়ামাত্র আমরা বই গুটিয়ে নিয়ে উঠে গেলুম।

তারপর পাগলা সন্ন্যেসীর সঙ্গে প্রায় ঘণ্টা দুয়েক ধরে বাবার আলাপ-আলোচনা চলল।

সেদিন খেতে খেতে বসে ঘোষণা করলেন, আচ্ছা তোমরা বিকেলে ঘণ্টাখানেক করে বেড়িয়ে আসবে। সন্ধেয় আগেই বাড়ি ফিরতে হবে, বুঝলে?

গোষ্ঠদিদির সঙ্গে আমাদের বাড়ির সবারই খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে আমার ও অস্থিরের ছিল সে প্রাণের বন্ধু। সেই মিষ্টভাষী, স্বামীপরিত্যক্তা, অসহায়ার চরিত্রে এমন একটা মাধুর্য ছিল যে, দু-দিনেই সে অপরিচিতকে আপনার করে নিতে পারত। অথচ সবার চেয়ে আপনার করার যাকে প্রয়োজন, সেই স্বামীকে সে কোনো আকর্ষণেই বাঁধতে পারেনি।

গোষ্ঠদিদির শ্বশুর তাঁর পেনশনের টাকা ও বড় ছেলে যে টাকা পাঠাত সে-টাকা তার কাছেই রেখে দিতেন খরচের জন্য। ভদ্রলোক কখনও তার কাছে কোনো হিসাব চাইতেন না। এজন্য গোষ্ঠদিদির তহবিল সর্বদা পূর্ণ থাকত। আমরা তার জন্যে লুকিয়ে স্যাকরা ডেকে আনতুম, সে গয়না গড়াত। খাওয়া-দাওয়া তো প্রায় নিত্যই হত। শুক্লপক্ষের সময় আগে থাকতে সে পয়সা দিয়ে রাখত আর আমরা লতুদের বাড়ি থেকে ফেরবার মুখে এক চ্যাঙারি খাবার কিনে তার কাছে জমা রেখে বাড়িতে আসতুম। অনেক রাত্রে আমাদের বাড়ি ও পাড়া নিঝুম হয়ে পড়লেও আমরা দু-ভাই বাতি নিবিয়ে জেগে পড়ে থাকতুম, তার পরে গোষ্ঠদিদির সঙ্কেতধ্বনি শোনামাত্র নিঃশব্দে তাদের ছাতে চলে যেতুম। গোষ্ঠদিদি আগে থাকতেই মাদুর, বালিশ, কুঁজো গেলাস নিয়ে এসে রাখত। আমরা আগে ভরপেট খেয়ে নিয়ে তারপরে গল্প করতুম। সেই তার ছেলেবেলাকার জীবন; অত দুঃখ-কষ্টের মধ্যেও ক’দিনের জন্যে কার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল, কে তাকে কোনোদিন কি মিষ্টি কথা বলেছিল–কত লোকের কথা, তার স্বামীর কথা, তার অদ্ভুত শ্বশুরের কথা।

আমরাও বলতুম, আমাদের ইস্কুলের কথা, লতুদের কথা, দিদিদের কথা।

গোষ্ঠদিদির সঙ্গে আমাদের সব কথা হত। তার স্বামীর কথা জিজ্ঞাসা করলে বলত, ও আমার মাছ খাওয়ার টিকিট।

শ্বশুর মারা গেলে যে তার কি হবে, তাই নিয়ে আমরা তিনজনে যে কত চিন্তা করেছি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে ছাতে বসে ভেবেছি, তার ঠিকানা নেই। গোষ্ঠদিদি থেকে থেকে বলত, তোরা আমার রাম-লক্ষ্মণ ভাই রয়েছিস, আমার ভাবনা কি?

মাঝে মাঝে সে আমাদের গল্পের বই নিয়ে আসবার জন্যে তাগাদা দিত। আমরা মধ্যে মধ্যে লতুদের বাড়ির ও দিদিদের ওখান থেকে বই এনে দিতুম। কিন্তু তার ছিল বিপুল অবসর, আর আমাদের জোগান ছিল অল্প, কাজেই তার বইয়ের পিপাসা কিছুতেই মেটাতে পারতুম না। আমাদের পাড়ায় একটা কনসার্টের আখড়া ছিল, সেখানে তিন-চারটে আলমারি থাকত বইয়ে ভরা। পাড়ার ছেলেরা এটাকে লাইব্রেরি বলত। একদিন আমি সাহস করে এই ক্লাবের একজনের কাছে বই চাইলুম। ক্লাব ঘরে তখন আর কেউ ছিল না।

আমি বই চাইতেই লোকটা একটু আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তুমি খোকা, এই বয়সেই নভেল পড়তে শুরু করেছ?

খোকা যে স্রেফ দয়া করে নভেল পড়া শুরু করেনি, সে-কথা তো আর সে জানত না যা হোক, সে অমর্যাদা উপেক্ষা করে বললুম, আমি পড়ব না, গোষ্ঠদিদির জন্যে চাইছি।

লোকটা আমার কথাগুলো ভালো করে শুনতে পায়নি। সে-একেবারে খেঁকিয়ে বললে, গোষ্ঠদা! কে তোমার গোষ্ঠদা? সে কি লাইব্রেরির মেম্বার?

বললুম, গোষ্ঠদা নয়, গোষ্ঠদি।

আহা! মুহূর্তের মধ্যেই কি অপূর্ব রূপান্তর! তবু দুর্জনেরা বলে, বাঙালি নারীর সম্মান, জানে না।

গোষ্ঠদিদির নাম শুনেই সে আমায় খাতির করে বসিয়ে ঠারে-ঠুরে তার চেহারাটা কিরকম, তা জানবার চেষ্টা করতে লাগল।

সন্ন্যেসীর ছোট ছেলের বউ বললে না?

হ্যাঁ।

ও, ওদের বাড়ির ছাতে সন্ধেবেলায় দেখেছি বটে। রঙটা খুব ফরসা, না?

হ্যাঁ, একেবারে দুধে-আলতায়।

মুখখানা তো তেমন ভালো নয়।

কেন গোষ্ঠদির চমৎকার মুখ, যেমন চোখ তেমন নাক, যেন তুলি দিয়ে আঁকা। আপনি তা হলে অন্য কাউকে দেখেছেন।

হ্যাঁ, আমি দুজনকে দেখেছি, তার মধ্যে কোনটি তোমার গোষ্ঠদি তা তো জানি না। বলা বাহুল্য, গোষ্ঠদিদিদের বাড়িতে দ্বিতীয় স্ত্রীলোক কেউ ছিল না। লোকটা কিছুক্ষণ চিন্তা করে আবার বললে, তা গোষ্ঠদি বুঝি তোমাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দিলে?

হ্যাঁ।

তা দেখ, বিকেলবেলা এসো। এখন চাবি নেই, তখন বই বের করে দোব, খুব ভালো বই দোব।

বিকেলে লোকটার কাছে যেতেই সে একখানা চটি বই দিয়ে বললে, এর পরে মোটা বই দোব।

তখন লতুদের বাড়ি যেতে হবে, তাড়াতাড়ি বইখানা গোষ্ঠদিদিকে দিয়েই মারলুম দৌড়, তবু বইখানার নাম মনে আছে–’গয়ার ভূত’, প্রকাশক গুরুদাস চট্টোপাধ্যায়।

পরের দিন গোষ্ঠদিদির সঙ্গে দেখা হতেই সে বললে, হ্যাঁ রে, কার কাছ থেকে বই এনেছিলি?

কেন?

কেন কি রে! তার মধ্যে চিঠি দিয়েছে।

সত্যি! দেখি।

পড়ে দেখি, লোকটা গোষ্ঠদিদিকে একখানা দুপৃষ্ঠাব্যাপী প্রেমপত্র ছেড়েছে। কোনো একখানা বটতলার নভেলের সর্বনাশ করে চোখা চোখা প্রেমবাণ ছেড়েছে গোষ্ঠদিদির উদ্দেশে।

গোষ্ঠদিদি বললে, বইখানা ফিরিয়ে দিয়ে আয়।

আমরা বললুম, তুমি বেশ করে গালাগালি দিয়ে একখানা চিঠি লেখো।

আমি গালাগালি জানি না।

তাতে কি হয়েছে, আমরা শিখিয়ে দিচ্ছি।

না না, কি হতে কি হবে, বইটা ফেরত দিগে যা।

বইখানা নিয়ে বাড়িতে রেখে দেওয়া গেল। রাত্রে পড়াশুনা সেরে নিজেদের ঘরে এসে দুই ভাইয়ে মিলে লোকটাকে গালাগালি দিয়ে একখানি চিঠির খসড়া করা গেল। খিস্তিবিদ্যার আদ্য ও মধ্য পরীক্ষা তখন আমরা পার হয়েছি, কাজেই ভাষার অভাব হল না। গোষ্ঠদিদিই যেন লিখছে, এই ভাবে শুরু করা গেল। তাতে লোকটার পিতৃ ও মাতৃ-পুরুষের সমস্ত গুরুস্থানীয়ার সঙ্গে তার অসম্ভব, অসঙ্গত ও অনৈসর্গিক সম্বন্ধ আরোপ করে শেষে লেখা হল–এমন চিঠি আর যদি আসে, তবে তার মুণ্ডপাত অনিবার্য।

পরের দিন ‘গয়ার ভূত:-এর মধ্যে চিঠি ভরে লোকটাকে ফিরিয়ে দিয়ে এলুম। তারপর অনেক দিন পর্যন্ত লোকটা আমাদের দেখলেই মুখ তুলে চেয়ে থাকত। তার মুখ দেখে মনে হত যেন, সে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চায়; কিন্তু কোনোদিন কিছু জিজ্ঞাসা করেনি।

গোষ্ঠদিদি সব সময়েই বেশ হাসিখুশিই থাকত, কিন্তু মাঝে মাঝে তার কি হত জানি না সে দিনের পর দিন বিষণ্ণ হতে থাকত

একদিন মনে পড়ে, অনেক রাতে ছাতের উপরে গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছি, হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই উঠে বসলুম! দেখি, একপাশে অস্থির পড়ে ঘুম লাগাচ্ছে, আর একদিকে গোষ্ঠদিদি দূর দিগন্তের দিকে চেয়ে বসে আছে। কৃষ্ণপক্ষের রহস্যময় জ্যোৎস্নার সঙ্গে শরৎ-শেষের হিমানীর জাল-বোনা চলেছে–ঘুমন্ত নগরীর ওপরে কে যেন আবরোঁয়ার মশারি ঢেকে দিয়েছে। দূর ও কাছের বাড়িগুলো যেন একটা অদ্ভুত আকারের জীব, গাছের মতন তাদেরও প্রাণ আছে কিন্তু চলবার শক্তি নেই। চারদিক দেখতে দেখতে আমার মনটা ঔদাস্যে ভরে উঠতে লাগল। পাশে অস্থির ঘুমিয়ে আছে; গোষ্ঠদিদি তখনও সেই ভাবে দূরে চেয়ে আমার মনে হতে লাগল, আমরা তিনজন যেন কোনো দূর নক্ষত্রের দেশ থেকে এইমাত্র এখানে এসে পড়েছি। আমরা এখানকার কারুর নয়, এখানে আমাদেরও কেউ নেই। এ জগতে এইমাত্র যেন আমার চেতনা আরম্ভ হল। তিনজনে কতদিন একসঙ্গে চলব? সেই মুহূর্তেই মনের মধ্যে কে যেন বললে, তুমি একা। কেন জানি না, আমার মনে হতে লাগল, এদের সঙ্গে বিচ্ছেদ হবে, দীর্ঘ জীবনপথ এদের ছাড়াই চলতে হবে। তারপর কোনোদিন কোনো লোকে দেখা হতেও পারে, নাও হতে পারে। বুকের মধ্যে সহস্র নিষেধ হাহাকার করে উঠল। অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে ডেকে উঠলুম, গোষ্ঠদি!

কি ভাই?

তুমি ক’দিন থেকে অমন মনমরা হয়ে রয়েছ কেন? তোমার কি দুঃখ আমাকে বলবে না ভাই?

গোষ্ঠদিদি ঘুরে দু-হাত দিয়ে আমার গলা জড়িয়ে ধরে আমার গালে মুখ রেখে কাঁদতে লাগল। কয়েক মিনিট সেই ভাবে থেকে মুখ তুলে বলতে লাগল, আমার দুঃখ তো তোরা জানিস। মনে কর, ছেলেবেলায় কবে বাপ-মা হারিয়েছি মনে নেই। মামার ছেলেমেয়ের সঙ্গে মানুষ হচ্ছিলুম, তারা যাকে মা বলে, আমিও তাকে মা বলে জানি; হঠাৎ একদিন জানতে পারলুম, আমার মা নেই। সেদিনকার সে-দুঃখ তোরা কল্পনা করতে পারবি না। পুজোর সময় একখানা নতুন কাপড় কখনও পাইনি। তারপর অন্নকষ্ট। ভগবান শত্রুকেও যেন তা না দেন।

তা বিয়ে হওয়ার পর তোমার সে-কষ্ট তো আর নেই।

না, তা নেই বটে, কিন্তু অন্নকষ্ট মিটলেই কি সব কষ্ট মিটে যায়?

ছেলেবেলা থেকে পথে-ঘাটে ভিখিরির আকুতি শুনে, চাকরবাকরদের দারিদ্র্য ও অতি সামান্য আহার্য দেখে, কি জানি মনের মধ্যে ধারণা হয়ে গিয়েছিল যে, অন্নকষ্টই মানুষের জীবনের একমাত্র কষ্ট। এটি কোনোরকমে এড়াতে পারলে জীবন সুখময় হয়। অন্নকষ্ট পরমসুখে নিবৃত্তি হওয়ার অনিবার্য পরিণামরূপে যে আরও নানারকম কষ্ট আসতে আরম্ভ করে, তার স্পষ্ট ধারণা তখনও হয়নি।

আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে গোষ্ঠদিদি আবার বলতে আরম্ভ করলে, এই নির্জন প্রেতপুরীর মধ্যে একলা জীবন কাটে, একটা লোক নেই যে, মনের দুটো কথা বলি। স্বামী থেকেও নেই, এ কি কম দুঃখ রাম-ভাই!

গোষ্ঠদিদিকে বললুম, তোমার স্বামী যখন তোমাকে ভালোবাসে না, তখন তুমিও অন্য

কারুকে ভালোবাসতে আরম্ভ কর না কেন?

তাতে লাভ কি?

তার সঙ্গে চলে যাবে, সে তোমায় যেখানে নিয়ে যায়।

মাঝে মাঝে তাই ইচ্ছে হয়, কিন্তু বাবা রে!

কেন?

যার সঙ্গে যাব, সে যদি কোনোদিন ফেলে পালায়! সারাজীবন ভাত-কাপড়ের কষ্ট পেয়েছি, আবার যদি সেই কষ্ট পাই, এখানে দুটি খেতে পাচ্ছি তো।

ভাত-কাপড়ের পাছে অভাব হয় সেই ভয়ে গোষ্ঠদিদি পালায় নি; কিন্তু ভবিষ্যতে অনেক মেয়ের মুখে শুনেছি ও নিজেও দেখেছি, যারা ভাত-কাপড়ের অভাব ঘোচাবার জন্যেই বাড়ির বাইরে পা বাড়িয়েছে।

.

শচীনের বিশ্বাসঘাতকতার ফলে আমাদের সন্ন্যাসব্রত তখনকার মতো ভেঙে গিয়েছিল বটে, কিন্তু বছরখানেক যেতে-না-যেতে আবার আমাদের যুক্তি শুরু হয়ে গেল। প্রমথ গোড়াতেই সাবধান করে দিলে, এবার আর শচেটাকে ভিড়তে দেওয়া নয়।

খুব গোপনে সাবধানেই আয়োজন ও পরামর্শ চলছিল, কিন্তু তবুও শচীন একদিন টের পেয়ে গেল। সে অনুতপ্ত হয়ে বললে যে, তখন সে সংসারকে ভালো করে চিনতে পারেনি, এখন সংসারের প্রতি সত্যিই তার কোনো মায়া নেই, জগৎকে ভালো করেই সে চিনে নিয়েছে।

তিনজনে মিলে আবার পরামর্শ শুরু হল। সেদিন থেকে এদিনের এক বছরের তফাৎ। বয়স মাত্র এক বছর বাড়লেও এরই মধ্যে দশ বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি। গাধার পিঠে মাল চাপিয়ে জঙ্গলে ঢুকে পড়লেই যে শান্তি ও তপস্যামার্গে বিচরণ করতে পারা যায় না, সে-বুদ্ধি টনটনে হয়েছে। তাই প্রথমেই আমরা হিংস্র জানোয়ারদের কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করতে আরম্ভ করে দিলুম।

অস্ত্র-আইন থাকলেও তখন বাজারে ভালো ভালো দিশি ও বিলিতি ছোরা কিনতে পাওয়া যেত। আমরা পয়সা জমিয়ে প্রথমেই তিনটি ভালো ছোরা কিনে ফেললুম। তারপরে তিনটি পাকা বাঁশের লাঠি। কামারের দোকানে ইস্পাত দিয়ে তিনটে চমৎকার ধারালো বর্শাফলক বানানো হল। এছাড়া প্রমথর গুরুদত্ত সেই মারাত্মক বাণগুলো তো আছেই।

অস্ত্রশস্ত্র ছাড়া ধান, কাঁচামুগ ইত্যাদি কেনা হল চাষ করবার জন্যে। দেশলাই নেওয়া হল বারো ডজনের একটি বড় বান্ডিল। দেশলাই ফুরিয়ে গেলে শুকনো পাতা সংগ্রহ করে তাতে আগুন ধরাবার জন্যে একটি বড় আতশ-কাঁচ ইত্যাদি সব প্রমথদের বাড়ির একটা অন্ধকার ঘরে জমা হতে লাগল। এসব ছাড়া ইস্কুপ, পেরেক ও ছুতোরমিস্তিরির যন্ত্রপাতিও জোগাড় হল–জঙ্গলে থাকবার মতন অন্তত একখানা ঘরও তৈরি করতে হবে তো!

আবার এক শনিবারে ইস্কুলের ছুটির পর সেই বিরাট বোঝা তিন ভাগে ভাগ করে নিয়ে একটা খাবারের দোকানে বসে ভরপেট খেয়ে আমরা গ্র্যান্ড ট্র্যাঙ্ক রোড অভিমুখে যাত্রা করলুম। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড আমার চেনা ছিল, অনেক দিন আগে দাদার সঙ্গে দেখে গিয়েছিলুম।

হাওড়ার পোল পেরিয়ে, মাঠের ধার দিয়ে গিয়ে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের কাছে এসে কিরকম সন্দেহ হল, এই রাস্তাটা সেই রাস্তা কি না! বোঝার ভারে তখন আমাদের তিনজনেরই অবস্থা কাহিল। পথের ধারে বোঝা নামিয়ে পরামর্শ করতে লাগলুম, অতঃপর কি করা যায়!

কিছুক্ষণ বাদে স্থির হল, আগে কোনো লোককে জিজ্ঞাসা করে নেওয়া যাক, এইটা আসল গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড কি না। তখন বেলা প্রায় পাঁচটা হবে, হাওড়ার মাঠে বোধ হয় কোনো খেলা-টেলা ছিল, দলে দলে লোক মাঠের দিকে যাচ্ছিল। দুটি নিরীহ-গোছের ভদ্রলোক সেই দিকেই যাচ্ছিল, আমি এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলুম, হ্যাঁ মশায়, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডটা কোন দিকে?

তাদের মধ্যে একজন মিনিট-খানেক আমার মুখের দিকে কটমট করে চেয়ে থেকে আমাকে বললে, কোথায় যাবে? গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড?

হ্যাঁ।

তোমার বাড়ি কোথায়?

আমার বাড়ি ওতোরপাড়া, গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারেই। লোকটা এবার টপ করে আমার একখানা হাত ধরে তার সঙ্গীকে বললে, দেখ, আমার মনে হচ্ছে, এ ছোকরা বাড়ি থেকে পালিয়েছে।

আমি কাঁধ থেকে পুঁটলিটা নামিয়ে এক ঝাঁপটায় হাত ছাড়িয়ে নিলুম। ততক্ষণে প্রমথ ও শচীন কাছে এসে তাদের জিজ্ঞাসা করল, কি হয়েছে মশায়, ওকে ধরে টানাটানি করছেন কেন?

তোমরা কে?

শচীন বললে, আমরা এর বন্ধু।

তোমাদের বাড়ি কোথায়?

শচীন বললে, অত হাঁড়ির খবরে তোমাদের দরকার কি হে? যাও না, যেখানে যাচ্ছ, সেদিকে এগিয়ে পড়।

ব্যাপারটা হয়তো সহজেই মিটে যেত, কিন্তু আমাদের মুখে ওইরকম চোটপাট জবাব তারা বরদাস্ত করতে পারলে না, তাদের আত্মসম্মানে আঘাত লাগল। একজন বললে, ধর এদের। ছোঁড়াগুলো নিশ্চয় বাড়ি থেকে ভেগেছে।

একজন প্রমথর হাত চেপে ধরে বললে, চল, তোমাকে থানায় যেতে হবে।

প্রমথ ছিল রোগা তার গায়েও মোটে জোর ছিল না। সে হাত ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টা করতে লাগল, কিন্তু পারলে না। আমি গিয়ে লোকটার হাত ছাড়িয়ে দিলুম। ইতিমধ্যে তাদেরই আরও দু-তিনজন বন্ধু মাঠের দিকে যাচ্ছিল, তারা ওইরকম হুটোপাটি দেখে জিজ্ঞাসা করলে, কি হয়েছে হে?

একজন বললে, এই ছোঁড়াগুলো বাড়ি থেকে পালাচ্ছে, চল, এদের ধরে থানায় নিয়ে যাওয়া যাক।

তারাও আগের লোক দুটোর সঙ্গে জুটে গিয়ে আমাদের টানাটানি আরম্ভ করে দিলে। আমরা ছেলেমানুষ হলেও নেহাৎ দুর্বল ছিলুম না, ব্যায়াম করে না এমন দু-তিনজন যুবকে মিলেও চট করে আমাদের কাবু করতে তো পারতই না, বরং বিপদে পড়ত। তার ওপরে মারামারির প্রতি আমার ও শচীনের একটা সহজাত আকর্ষণ ছিল যে, যেখানে সামান্য দু-চারটে কথা-কাটাকাটি হয়ে মিটে যেতে পারে, সেখানে হাঙ্গামা না বাধিয়ে আমরা পারতুম না। এই যে চার-পাঁচজন লোক, তাদের প্রত্যেকেরই বয়স বোধ হয় চব্বিশ-পঁচিশের কম নয়, তবুও মারামারির গন্ধ পেয়ে আমি আর শচীন একেবারে উন্মত্ত হয়ে উঠলুম; শুধু ভয় হচ্ছিল, কখন তারা পোঁটলা খুলে দেখে ফেলে।

মিনিট-দু-তিনের মধ্যে হৈ-হৈ ব্যাপার লেগে গেল। একজন আমাকে কোল-পাঁজা করে তুলে ধরামাত্র তার থুতনিতে জুতো-সমেত এমন একটি লাথি লাগালুম যে, তার দাড়ি কেটে দরদর করে রক্ত ঝরতে লাগল। আমাদের জামা-কাপড় ছিঁড়ে গেল, সর্বাঙ্গ কেটে রক্ত পড়তে লাগল।

আমরা এদিকে যখন আক্রমণে ও আত্মরক্ষায় ব্যস্ত, সে-অবকাশে একটা লোক প্ৰমথ বেচারিকে ধরে খুব ঠেঙাতে আরম্ভ করে দিলে। মারের চোটে প্রমথ ক্ষিপ্ত হয়ে শেষকালে পুঁটলি থেকে বর্শা বের করে নিয়ে আততায়ীর উরুতে ঘ্যাঁচ করে বসিয়ে দিলে।

ব্যাপারটি যে এতদূরে গড়াবে, ওরা তা কল্পনাও করতে পারেনি। বর্শার আঘাত পেয়েই সে-লোকটা–ওরে বাবা, ছুরি মেরেছে রে, বলেই রাস্তায় লুটিয়ে পড়ল। প্রমথ তার পোঁটলা তুলে নিয়ে মারলে দৌড়।

লোকটা শুয়ে পড়তেই আমাদের আততায়ীরা ও যে-সব লোক চারপাশে দাঁড়িয়ে এতক্ষণ মজা দেখছিল, তারা আমাদের ছেড়ে সেদিকে ছুটল। সে-সময় রাস্তার ওপর দিয়েই মার্টিন কোম্পানির ছোট রেল চলত, ভাগ্যক্রমে একটা ট্রেন এসে পড়ায় যে যার চারদিকে ছিটকে পড়ামাত্র আমি আর শচীন পোঁটলা তুলে নিয়ে মারলুম দৌড়। দূর থেকে এক-আধটা চিৎকার–’পাকড়ো, পাকড়ো’, ‘পুলিশ’ ইত্যাদি শোনা যেতে লাগল।

ছুটতে ছুটতে হাওড়া টাউন হলের কাছে এসে দেখি, প্রমথ সেখানে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। আমরা আর বাক্যবিনিময় না করে দৌড়ে হাওড়া স্টেশনের মধ্যে ঢুকে পড়লুম। আধ-ঘণ্টাটাক স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বুক ধড়ফড়ানি কমে গেলে পোল পেরিয়ে বড়বাজারে এসে পড়লুম। সেখানে একটা পানের দোকানে দাঁড়িয়ে পান কেনা হল। দোকানে একটা বড় আয়না ছিল তাতে আমাদের চেহারা দেখে একেবারে আঁতকে উঠলুম। মুখময় কালশিরে, জামা ছিঁড়ে কুটিকুটি, চুল উশকোখুশকো, শচীনের মাথার খানিকটা চুলই নেই, প্রমথর বাঁ কানটা ছিঁড়ে গেছে, রক্ত গড়িয়ে গলা অবধি নেমেছে–সে এক বীভৎস দৃশ্য!

পরামর্শ করে বাড়ি ফেরাই সাব্যস্ত হল, এত বড় বাধা যে ওপরওয়ালারই ইঙ্গিত, তা মেনে নিয়ে আমরা ক্ষুণ্নমনেই বাড়িমুখো হলুম। প্রমথকে পৌঁছে দিয়ে আমি যখন বাড়ি ফিরলুম, তখন সন্ধে হয়ে এসেছে। সেই অল্প-আলো অল্প-অন্ধকারে কাঁধের বোঝা একজায়গায় লুকিয়ে চুপিচুপি নিজে ঘরে ঢুকতে যাচ্ছি, এমন সময়–যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়–

ইস্কুল থেকে আমার ফিরতে দেরি হচ্ছে দেখে মা ছটফট করছিলেন। তিনি বোধ হয় কিছু সন্দেহ করে আমাদের ঘরে এসে জিনিসপত্র হাটকাচ্ছিলেন। এমন সময় আমার সেই মূর্তি দেখে একেবারে শিউরে উঠলেন।

বললুম, টেরিটিবাজারে গিয়েছিলুম এক বন্ধুর জন্যে খরগোশ কিনতে। পথে তিন-চারটে ফিরিঙ্গি ছেলে খরগোশ কেড়ে নেবার চেষ্টা করায় ভয়ানক মারপিট হয়ে গিয়েছে।

মা আর দ্বিরুক্তি না করে আমার পিঠে গদাগম পাঁচ-সাতটি কিল চাপিয়ে বললেন, পোড়ারমুখো ছেলে, ডনকুস্তি করে আর বাদাম-বাটা খেয়ে গুণ্ডা হয়েছ, না! সন্ধেবেলা গুণ্ডামি করে বাড়ি ফেরা হল!

তারপর টানতে টানতে কলতলায় নিয়ে গিয়ে গা থেকে কাদা তুলতে আরম্ভ করে দিলেন। শরীরের কত জায়গায় যে কেটে ছিঁড়ে গিয়েছিল তার আর ঠিকানা নেই, যেখানেই জল লাগে সেখানটাই জ্বালা করতে থাকে।

স্নান করে উঠে সর্বাঙ্গে তাপ্পি মেরে পাগলা সন্ন্যেসীর কাছে যাওয়া গেল। তিনি বাড়িতে বৌমা ও ঝি-চাকরদের ওপরে হোমিওপ্যাথির হাত পাকাতেন। সেখানে গিয়ে এক ফোঁটা ওষুধ খেয়ে টেরিটিবাজারের ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে মারপিটের এক লোমহর্ষক বর্ণনা করা গেল তাঁর কাছে। আর একপ্রস্থ বর্ণনা গোষ্ঠদিদির কাছেও করতে হল। সেখান থেকে ফিরে বাবার কাছে আরও বাড়িয়ে বলা গেল। বাবা সব শুনে বললেন, বাড়িতে কিছু না জানিয়ে টেরিটিবাজারে যাওয়াটা তোমার অত্যন্ত অন্যায় হয়েছিল; কিন্তু তোমরা যে মার খেয়ে পালিয়ে আসনি, তাদেরও মেরেছ, এতে আমি খুবই খুশি হয়েছি।

সত্যি কথা বলতে কি, বারকয়েক সেই কাল্পনিক ফিরিঙ্গি-নন্দনের সঙ্গে মারামারির বর্ণনা করে হাওড়ার মাঠের ধারের ব্যাপারটা মন থেকে একরকম মুছে যেতে লাগল, আর সেই জায়গায় টেরিটিবাজারের মারামারির একটা ছবি সমুজ্জ্বল হতে আরম্ভ হল।

সন্ধেবেলা লতুদের ওখান থেকে অস্থির ফিরে এসে আমার সর্বাঙ্গে ওইরকম তাপ্পি আর পটি-মারা দেখে অবাক হয়ে গেল। আমাদের পলায়নের সমস্ত খুঁটিনাটিই অস্থির জানত। এও ঠিক ছিল যে, সন্ন্যেসী লাইনে কিছু উন্নতি করতে পারলেই তাকে খবর দোব, আর সে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবে। কিন্তু সে-লাইনে পা দিতে-না-দিতে কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আমার চেহারার ওই বিষম পরিবর্তন দেখে সে বেচারি শঙ্কিত হয়ে পড়ল।

রাত্রে শোবার সময় আসল ঘটনাটি অস্থিরকে খুলে বলা গেল। তারপরে গুপ্তস্থান থেকে পোঁটলাটি বের করে বর্শা ছোরা করাত র্যাঁদা প্রভৃতি যন্ত্রগুলিকে লুকিয়ে ফেলা হল!

পরের দিন বিকেল হতে-না-হতে লতুদের ওখানে যাত্রা করা গেল। টেরিটিবাজারে ফিরিঙ্গিদের সঙ্গে মারামারির কাহিনিটি সেখানে বেশ সমারোহ করে বলে বাহাদুরি নেবার জন্যে মনটা ছটফট করছিল। কিন্তু সেখানে গিয়ে চাকরের কাছে শুনলুম, বাবা, মা, ললিত ও তার ছোট বোন কোথায় গিয়েছে, শুধু বড় দিদিমণি অর্থাৎ লতু বাড়িতে আছে।

খবরটা শুনে নিরুৎসাহ হয়ে পড়া গেল। তবুও লতুকে গল্পটা শোনানো যাবে স্থির করে তিন লাফে ওপরে উঠে গিয়ে এ-ঘর ও-ঘর খুঁজে দেখলুম, লতু নেই। শেষকালে ছাতের ঘরে তাকে আবিষ্কার করা গেল, সে জানালার ধারে বাইরের দিকে চেয়ে বসে আছে।

আমি ঘরে ঢুকতেই লতু আমার দিকে ফিরে এক অদ্ভুতভাবে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার মুখ ফিরিয়ে বাইরের দিকে চাইল! আমার ওপরে অভিমান হলে সে ওইরকম করত। আমি তার পাশে বসে জিজ্ঞাসা করলুম, অসুখ করেছে লতু?

লতু আমার দিকে ফিরে চাইলে, চোখে তার অশ্রু। লতু বললে, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব, সত্যি বলবি?

লতুকে এতখানি গম্ভীর হতে কখনও দেখিনি। বললুম, বলব।

তুই নাকি কাল বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলি সন্ন্যাসী হবার জন্যে?

আমি একেবারে স্তম্ভিত, বাক্যহীন।

বল্।

কে বললে?

অস্থির।

চুপ করে বসে অস্থিরের বিশ্বাসঘাতকতার কথা ভাবছি, লতু আমায় ঠেলা দিয়ে বললে, কেন গিয়েছিলি, বল্–কোন দুঃখে?

লতুর কথার মধ্যে কি শক্তি ছিল বলতে পারি না, আমার মনে হতে লাগল যেন ঘোরতর দুঃখ আমাকে ঘিরে ফেলেছে। নইলে আমার বয়সি ছেলে কোথায় হেসে-খেলে দিন কাটাবে, তা না করে সে বাড়ি ছেড়ে জঙ্গলে চলে যেতে যাবে কেন? তার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে চোখে জল এসে গেল। ধরা গলায় বললুম, তুমি জান না লতু। আমার যা দুঃখ তা কেউ বুঝতে পারবে না। আমাকে কেউ ভালোবাসে না, কার জন্যে থাকব?

লতুর চোখ থেকে একফোঁটা জল গালের ওপরে গড়িয়ে পড়ল। সে আবার বললে, একটা কথা সত্যি বলবি?

বলব।

তুই কারুকে ভালোবাসিস?

ঘাড় নেড়ে জানালুম, হ্যাঁ।

কাকে ভালোবাসিস, বলতে হবে।

সে তুই জেনে কি করবি? কোনো লাভ নেই তোর।

হ্যাঁ, আমার লাভ আছে, বলতেই হবে।

লতুর মুখের দিকে চাইলুম। তার চোখে অপূর্ব আলো, অশ্রুতে তা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে, ঠোঁট-দুটো থরথর করে কাঁপছে। আমার বুকের মধ্যে অদ্ভুত একটা কষ্টদায়ক অনুভূতি হতে লাগল।

বুক ঠুকে বলে ফেললুম, আমি তোকে ভালোবাসি।

বলামাত্র লতু ঝাঁপিয়ে আমার বুকের ওপরে পড়ল। তারপরে চুম্বনে অশ্রুতে কোলাকুলি।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *