কিন্তু আমরা রাস্তাটাকে যতখানি সহজলভ্য মনে করেছিলুম, সেটা ততখানি সহজলভ্য হল না। সেইদিনই এক ঘুমের পর রাত্রি তখন প্রায় দ্বিপ্রহর, রাস্তা একেবারে নির্জন হয়নি, জনকতক, তাদের কথাবার্তা শুনে ভিখিরিদের অথবা পথবাসীদেরই প্রতিনিধি বলে মনে হল–তারা আমাদের একরকম ঘুম থেকে তুলে জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করলে। তাদের কথাবার্তায় বোঝা গেল যে, কোথাকার কে আমরা এখানে এসে তাদের অন্নে ভাগ বসাতে এসেছি–এ তারা সহজে মেনে নেবে না। সর্দার বলেছে, এজন্য যদি খুন-খারাপি হয়, তাও তারা করবে।
আমি দেখলুম ব্যাপারটা ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। এদের সঙ্গে লড়াই করে রাস্তায় শোবার অধিকার সাব্যস্ত করার শক্তি আমাদের নেই। একবার মনে হল, ওদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি না করে উঠে চলে যাই। কিন্তু চলে যাব কোথায়!
আমরা কিছু বলছি না দেখে ক্রমেই তারা মারমুখো হয়ে উঠতে লাগল। শেষকালে তাদের একজন মুরুব্বিকে ডেকে বললুম–ভাই, আমরাও তোমাদেরই মতন গরিব লোক। তোমাদের অনে হাত দেবার কোনো মতলব আমাদের নেই। এখানে ওখানে শুলে পুলিশে তাড়া দেয়, তাই তোমাদের আশ্রয়ে এসেছি। তোমরা যদি দয়া করে এখানে থাকতে দাও তো থাকব, নইলে চলে যাব।
আমরা যতক্ষণ ভদ্রলোক ছিলুম অর্থাৎ ভিখিরি হয়েও অন্তরে অন্তরে ভদ্রলোকের অভিমান গজগজ করছিল, ততক্ষণ মনে হয়েছিল লড়াই করে রাস্তায় শোবার অধিকার সাব্যস্ত করে নেব। কিন্তু রাস্তার মালিকেরা যখন তাদের রাজভাষা যথোপযুক্ত অলঙ্কার সহযোগে বুঝিয়ে দিলে যে বেশি ত্যাণ্ডাই-ম্যাণ্ডাই করলে তারা খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধাবোধ করবে না, তখন আমাদেরও জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হল। অবস্থার দুর্বিপাকে পড়ে তারা ভিখিরি হয়েছে। অবস্থার দুর্বিপাকে সেই পথবাসী ভিখিরিদের ময়ূর-সিংহাসন থেকে নেমে এসে তাদের সঙ্গে সমান পৈঠেতে দাঁড়াতে হয়–অভিজ্ঞতা সেদিন হয়ে গেল। আমার সেই মিনতি-ভরা সুর তাদের অনেকের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত করলে। যখন তারা বুঝতে পারলে যে আমরাও তাদেরই মতো, তখন তাদের কথাবার্তার সুর অনেক নীচের পর্দায় নেমে এল। অনেকে বলতে লাগল–শুতে দাও–কি আর হবে! নাচার আদমি–শুয়ে থাক্।
যে মুরুব্বি এগিয়ে এসে ততক্ষণ আমাদের ধমক-ধামক দিচ্ছিল তার সুরও অনেক নেমে এল। সে জিজ্ঞাসা করলে–তোরা কোথায় ভিক্ষে করিস?
বললাম–সেই কোলাবা অঞ্চলে।
–তা সেখানে শুতে পারিস না?
-না পুলিশে বড় হাঙ্গামা করে।
–আচ্ছা, শুয়ে থাক্—
.
কথাটা বলে লোকটা চলে গেল আর আমরাও নিশ্চিন্ত হয়ে গা ঢেলে দিলুম।
সেদিন সূর্যোদয়ের আগেই আমরা উঠে গেলুম।
চা খেয়েই আমরা চাকরির খোঁজে বেরিয়ে পড়লুম। দোকান, গৃহস্থের বাড়ি, কারখানা –সব জায়গাতেই খুঁজে বেড়াই।
জিজ্ঞাসা করি–হ্যাঁ গো, লোক রাখবে?
কেউ-বা জিজ্ঞাসা করে–তোমাদের বাড়ি কোথায়? মাথায় টুপি নেই কেন?
বাঙালি শুনে কেউ-বা কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে দেখে। ভাবে এরাই বোমা মেরেছে! আজ বোম্বাই শহরের পথেঘাটে যেমন বাঙালি দেখা যায়, সেদিন তেমন ছিল না। বাঙালি তো দূরের কথা–টুপিহীন লোক পথে প্রায়ই দেখতে পাওয়া যেত না। আজ মারাঠী ছাত্ররা টুপি একরকম ত্যাগই করেছে, কিন্তু সেদিন টুপিহীন অবস্থার কথা চিন্তাই করতে পারত না। সেদিনও সন্ধে অবধি ঘুরে ঘুরে, ভাজাভুজি খেয়ে আবার সেইখানে ফিরে এলুম। একটু বসে থেকে জায়গা ঝেড়ে শোবার ব্যবস্থা করছি, এমন সময় কালকের সেই দল এসে বললে- তোরা সকালবেলায় উঠে কোথায় চম্পট দিয়েছিলি? সর্দার তোদের ডেকেছে। কাল সকালবেলা কোথাও যাসনে–সর্দারের কাছে নিয়ে যাব।
–যে আজ্ঞে-বলে তখনকার মতন শুয়ে পড়া গেল।
পরদিন ভোরবেলা উঠে দেখলুম-ভিখিরির দল তখনও পথ জুড়ে পড়ে আছে–কেউ কেউ সেই ভোরে উঠে পথেই প্রাতঃকৃত্য শেষ করছে। আশেপাশে অলিগলি থেকে যে যার টিনের কৌটো, ফুটো গেলাস-বাটি নিয়ে চায়ের দোকান থেকে চা নিয়ে এসে বসে খেতে লাগল। কেউ-বা পয়সা দিলে–কেউ-বা এমনি পেলে। কোনো তাড়া নেই, ভবিষ্যতের কোনো চিন্তা নেই, সংসার-যাত্রার উদ্বেগ নেই। কোনো আশায় তারা বুক বাঁধেনি, নিরাশা তাদের শক্তিহীন করেনি। আমরা দেখতে লাগলুম আমাদের মুরুব্বি দিব্যি রয়ে বসে চা খেয়ে বিড়ি টানতে লাগল। দেখতে দেখতে রোদ উঠে গেল, অন্য সব দোকানপত্র খোলা হতে লাগল। চলতি লোকে পথ ভরে উঠল। তখন তিনি উঠে হেলেদুলে আমাদের কাছে এসে বললেন–কি রে! চা খেয়েছিস?
বললুম-পরে খাব। আগে চল–সর্দারের সঙ্গে দেখা করি।
লোকটা আরও দু’তিনজন লোককে ডেকে নিলে। আরও কয়েকজন স্ত্রী-পুরুষ বিনা আহ্বানেই আমাদের সঙ্গ নিলে। দিব্যি শোভাযাত্রা করে আমরা এগিয়ে চললুম।
ক্রফোর্ড-বাজারের বিপরীত ফুটপাথে যেখানে হর্নবি রোড শেষ হয়েছে সেইখানে সিডেনহ্যাম কলেজের বাগানটা ঘেঁষে এক অন্ধ ভিখিরি চিৎকার করে পথচারীদের কাছে মিনতিপূর্ণ ভাষায় তার অন্ধত্ব এবং তার ফলে নাচারত্ব ঘোষণা করে চলেছিল। লোকটার রঙ ঘোর কালো, মাথায় তেল-চকচকে ভালো করে আঁচড়ানো বাবড়ি চুল। পরনে একটা লুঙ্গি ও তার ওপরে রঙিন একটা জামা–লুঙ্গি এবং জামা ভিখিরি-জন-সুলভ নোংরা নয়। মুখে লম্বা দাড়ি, দুই চোখ বোধ হয় অন্ধ। সামনে পথের ওপরে একখানা ন্যাকড়া পাতা, তাতে দুই-একটা পয়সা পড়েছে, পেছনে একটা লম্বা লাঠি শোয়ানো রয়েছে, তার কিয়দংশ এদিকে এবং কিয়দংশ ওদিকে দেখা যাচ্ছে।
সেখানে গিয়ে পৌঁছিয়েই সঙ্গের লোকেরা এই লোকটিকে চিৎকার করে বললে— সর্দার! কলকাতার সেই লোক তিনটেকে নিয়ে এসেছি, কাল পালিয়ে গিয়েছিল তাই আনতে পারিনি।
লোকগুলোর কথা শোনামাত্র অন্ধের সেই মিনতিপূর্ণ ভাষা একেবারে ধমক ও খিস্তিতে পূর্ণ হয়ে উঠল। সর্দার বলতে লাগল–আমি ক’দিন শুনছি, তোরা এখানে এসে খুব গোলমাল লাগিয়েছিস।
দেখতে-না-দেখতে একটানে পেছন থেকে লম্বা লাঠিখানা বার করে বললে–এক ঘা-এ শেষ করে দেব–জানো না, এ তোর কলকাতা নয়, এ শহরের নাম বোম্বাই। খবরদার-
আমরা তো একেবারে হতভম্ব মেরে গেলুম। এক্ষেত্রে কি করব এবং কি করা উচিত তাই ভাবতে লাগলুম।
ইতিমধ্যে সর্দার প্রশ্ন করলে– কলকাতার ঝিলমিল সর্দারকে চিনিস?
সভয়ে বললুম-আজ্ঞে ঝিলমিল বলে কারুকে তো চিনি না।
-কি! কলকাতায় থাকিস আর ঝিলমিলকে চিনিস না–হগ-সাহেবের বাজারের কাছে বসে–গায়ে কুঠ আছে।
ভাবতে লাগলুম–তাইতো বড়ই অন্যায় হয়ে গিয়েছে। কলকাতায় থাকি অথচ ঝিলমিল সর্দারকে চিনি না। ইতিমধ্যে কালীচরণ বলে উঠল–হ্যাঁ, হ্যাঁ–হগ-সাহেবের বাজারের কাছে একজন কুঠকে দেখেছি বটে।
সর্দার বলে উঠল–হ্যাঁ, আমি সেই ঝিলমিলের ভাতিজা, বেশি চালাকি করিস তো খুন করে সমন্দরের জলে ফেলে দেব– মগরায় খেয়ে ফেলবে–হাঁ–
এবার আমি বললুম–আজ্ঞে হুজুর, আমরা তো কোনো কসুর করিনি
সর্দার রেগে বললে–এ মহল্লায় এসেছিস কেন? এ মহল্লা ভর্তি হয়ে গেছে।
বললুম– আজ্ঞে, এ মহল্লায় তো আমরা বসি না–আমরা বসি সেই কোলাবায়। সেদিকে রাত্তিরে পুলিশ বড় জ্বালাতন করে তাই আপনার মহল্লায় এসে শুই। আপনি যদি বারণ করেন তা হলে এখানে শোবো না।
আমার কথা শুনে সর্দার যেন একটু নরম হল। সে গলার সুর অনেকখানি নামিয়ে জিজ্ঞাসা করলে–কোথায় বসছিস তোরা?
বললুম–আজ্ঞে, ওই কোলাবা অঞ্চলে।
সর্দার বললে–ওদিককার লোকগুলো বড় বেইমান –তোরা মালাবারের দিকে বসিস–দু’পয়সা হবে। কিন্তু খবরদার–এদিকে বসবে না। যদি জানতে পারি এদিকে ভিক্ষে করেছ তো জান্সে মেরে দেব–এ তোমার কলকাতা নয়–এর নাম বোম্বাই! এখানে শুধু রাত্তিরে শুতে পাবে। মাত্তর রাত্তিরে–যাও–
যাক! রাস্তায় শোবার সনন্দ পেয়ে তখনকার মতো চা খেতে যাওয়া গেল। একটা জিনিস বোম্বাই এসে অবধি লক্ষ করছিলুম–এখানকার পুলিশ থেকে ভিখিরি অবধি সকলেই সুযোগ পেলেই একবার করে শুনিয়ে দেয়–এ তোমার কলকাতা নয়। যাই হোক, শহরময় টো টো করে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়াই চাকরির সন্ধানে।
.
বোম্বাই শহরে একটা বৈশিষ্ট্য দেখলুম যে প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই ঘরে ঘরে কিংবা তলায় তলায় আলাদা ভাড়াটে। তাই বাড়ির মধ্যে ঢুকে একতলা থেকে আরম্ভ করে তিনতলা-চারতলা অবধি ঘরে ঘরে খোঁজ নিই। কোনো ঘরের গিন্নি সহানুভূতির সঙ্গে কিছু কিছু প্রশ্ন করেন, কেউ-বা কিছু না শুনেই ‘দূর দূর’ করেন। সারাদিন ঘুরে ঘুরে কোথাও কিছু খেয়ে পয়সা-দুয়েকের বিড়ি কিনে সন্ধেবেলাতেই নিজেদের জায়গাটিতে এসে বসি। তারপরে রাত্রি গম্ভীর হলে শুয়ে পড়ি। যে বই-এর দোকানদার কয়েকদিন আগে আমাদের ভিখিরিদের অত্যাচার থেকে বাঁচিয়েছিল, একদিন তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিলিতি সাময়িকপত্র ওলটাচ্ছি, এমন সময় দোকানদার জিজ্ঞাসা করলে–তোমরা কি ইংরেজি পড়তে পার?
বললুম–আমরা ইংরেজি পড়তে পারি, বুঝতে পারি, কিছু কিছু বলতেও পারি। দোকানদার আমাদের কথা শুনে কিছুক্ষণ হাঁ করে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। তারপর একটা বই-এর পাতা খুলে একটা জায়গা দেখিয়ে আমাকে বললে–পড় দিকিন।
গড়গড় করে পড়ে ফেললুম।
দোকানদার কিন্তু আমাদের ভিখিরিই মনে করেছিল। এক লাইন ইংরেজি পড়তেই তার মনোভাব বদলে গেল। সে বেশ সহানুভূতির সঙ্গে আমাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করতে লাগল। সে বললে–তোমাদের জন্য আমি কাজের চেষ্টা করব–এখন তোমাদের বরাত।
এ-কথা সে-কথা হবার পর সে বললে–তা তোমরা পথে এরকম করে শুয়ে কাটাচ্ছ কেন? এখানে তো অনেক বাঙালি আছে। তাদেরি ওখানে একটু জায়গা ‘ পাও না?
বললুম–তাদের ওখানে গিয়েছিলুম কিন্তু তারা বিশেষ আমল দিলে না।
লোকটা একটু ভেবেচিন্তে বললে–দেখ, এক কাজ কর। আমার দোকানের পেছনে অনেকখানি জায়গা আছে, তোমরা সেখানে শুতে পার–বেশ ঢাকা জায়গা, সেখানে কেউ তোমাদের জ্বালাতন করতে পারবে না। ঝড়-বৃষ্টি হলেও কিছু হবে না।
লোকটা দোকান থেকে বেরিয়ে এসে দোকানের পেছনে নিয়ে গেল। অনেকখানি জায়গা পড়ে রয়েছে সেখানে–দিব্যি ঘরের মতন। তিনজন আমরা–স্বচ্ছন্দে হাত-পা খেলিয়ে শুতে পারব। অসুবিধের মধ্যে দোকান বন্ধ করার তক্তাগুলো সেখানে রাখা রয়েছে, তাই দোকান বন্ধ না হওয়া অবধি সেখানে শুতে পারা যাবে না। যাই হোক, নতুন জায়গা পেয়ে ভারি ফুর্তি লাগল। তখনি বিড়ির দোকান থেকে একটা সরু মোমবাতি কিনে এনে, দোকানদারের কাছ থেকে ঝাঁটা চেয়ে নিয়ে জায়গাটা বেশ করে ঝেড়ে আমাদের শোবার উপযোগী করে নিলুম। দোকান বন্ধ করার সময় যখন হল তখন আমরাই হাতে হাতে তক্তাগুলো বার করে দিয়ে দোকানদারকে সাহায্য করলুম। দোকানদার চলে গেলে দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুম লাগানো গেল।
.
তখন রাত্রি ক’টা বলতে পারি না। হঠাৎ কালীচরণের হাঁউ-মাউ চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল–কি রে, কি হয়েছে?
কালীচরণ চিৎকার করতে লাগল–কোন্ শালা হাত মাড়িয়ে দিলে–ওঃ, হাতখানা একেবারে পিষে ফেলেছে! ওঃ-
ততক্ষণে পরিতোষ মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলেছে। সেই স্বল্প আলোকে দেখলুম একজোড়া নরনারী অন্ধকারে সরে গেল। বোঝা গেল কোনো ভিখিরি দম্পতি বোধ হয় রোজ এসে এখানে শোয়–সেই আলোচনা করতে করতে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়া গেল।
কিছুক্ষণ যেতে-না-যেতে আবার একজোড়ার আবির্ভাব। তারা সরে পড়তে আবার একজোড়া! এরপর আমরা বাতি জ্বেলে বসে-বসেই রাতটা কাটিয়ে দিলুম। বেশ বুঝতে পারা গেল যে এই জায়গাটুকু হচ্ছে এ-পাড়ায় ভিখিরিদের বিহারভূমি। ঠিক করলুম–আর এখানে শোয়া নয়। দেবতাদের বিহারভূমিতে অনবধানতায় প্রবেশ করে ইল-রাজার যা দুর্দশা হয়েছিল তা আমাদের জানা ছিল। অতএব ভাবলুম আর হাঙ্গামা না করে মানে মানে সরে পড়াই শ্রেয়।
সেদিন সন্ধ্যা হতেই পরিতোষ প্রস্তাব করলে–চার্চগেট স্টেশনে গিয়ে শোয়া যাক। স্টেশনটা শহরের এক কোণে অপেক্ষাকৃত নির্জন বলে আমরা মনে করলুম যে, সেখানে এক কোণে পড়ে থাকলে স্টেশনের লোকদের চোখে পড়বে না। কিন্তু দেখা গেল যে স্টেশনে পড়ে থাকলে তাদের বৃহৎ চক্ষুর অন্তরাল হওয়া সম্ভব নয়। রাত্রি ঠিক বারোটা নাগাদ তারা ঠিক আমাদের আবিষ্কার করে স্টেশন থেকে বার করে দিলে।
স্টেশন থেকে তো বেরিয়ে পড়লুম–কিন্তু কোথায় যাই? এ কয়দিন যেখানে নিশিযাপন করেছি, সে-স্থান এখান থেকে অনেক দূরে। অদূরেই অভিমানিনী সমুদ্র-তরঙ্গমালার অশ্রান্ত বিক্ষেপ ও ক্রন্দন চলেছে। কোথায় যাই! বিধাতা কি আমাদের জন্য ওই অঙ্ক বিস্তার করে রেখেছেন? পায়ে পায়ে একটু একটু করে বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে আমরা একেবারে সমুদ্রের কাছে এসে পড়লুম। সমুদ্রের ধারে গিয়ে একফালি সরু রাস্তা–তখনো আর্ক-লাইটে দিনের মতন হয়ে রয়েছে জায়গাটা। দেখা গেল সেই রাস্তার ধারে লম্বা লম্বা বেঞ্চি বসানো রয়েছে। আমরা পরের পর তিনখানা বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লুম। পাশেই সমুদ্র কাঁদতে লাগল অশ্রান্ত কল্লোলে।
.
তখনো ভালো করে ভোর হয়নি। বিরাট একটা আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে দেখি আমাদের চারপাশে, সেই প্রায়ান্ধকারে যতদূর দৃষ্টি যায় ততদূর বড় বড় মহিষ–ইয়া-ইয়া শিং-ওলা। তার একটার সামান্য গুঁতো লাগলে আর দেখতে হবে না! কিন্তু তারা আমাদের কিছু না বলে দিব্যি বেঞ্চিগুলোকে পাশ কাটিয়ে সমুদ্রে গিয়ে নামল। সবার পেছনে দেখলুম কয়েকটা লোক রয়েছে। এদিকে রাত্রে শোবার সময় আমরা জুতোগুলোকে পা থেকে খুলে বেঞ্চির নীচে রেখেছিলুম–মোষের পাল সরে যাওয়ার পর দেখলুম জুতো কোথায় অন্তর্হিত হয়েছে। আমি মনে করলুম বুঝি চালাকি করে কালী ও পরিতোষ আমার জুতো লুকিয়ে রেখেছে। কিন্তু শেষকালে দেখা গেল যে তাদের জুতোও নেই। অনেকক্ষণ ধরে আমরা পরস্পরকে সন্দেহ করতে লাগলুম, শেষকালে দেখা গেল আমরা কেউই কারুর জুতো লুকোইনি– সেগুলি সত্যি-সত্যি চুরিই গিয়েছে। তখন দৈনন্দিন চরার কাজে নিশ্চিত্ত হয়ে খালিপায়েই অগ্রসর হওয়া গেল।
.
বোম্বাই শহরের ভিখিরিদের সম্বন্ধে যেটুকু অভিজ্ঞতা লাভ করা গিয়েছিল, এখানে তা প্রকাশ করলে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ভিখিরিরা প্রায় দল বেঁধে থাকে। এক এক মহল্লায় এক এক দল ভিখিরির রাজত্ব, তারা সেই মহল্লায় ভিক্ষে করে খায়, শোয়। নিজেদের দলের প্রায় সকলকেই সকলে চেনে–সেইজন্য তাদের দলভুক্ত নয়–এমন কোনো লোককে নিজেদের মহল্লায় দেখলেই তারা আপত্তি জানায় এবং প্রয়োজন হলে তাকে সরাবার জন্য মারপিট, এমনকি খুনখারাপি করতেও তারা রাজি থাকে। এরা প্রায়ই দল বেঁধে রাস্তায় শুয়ে থাকত–দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্ত তাই দেখেছি। কেউ কেউ ওরি মধ্যে আনাচে-কানাচে কোনো দোকানের কোণে, কোনো বাড়ির রকে অথবা কোনো নিরাপদ জায়গায় রাত কাটায়। বোম্বাই শহরের শীত খুবই কম। কিন্তু যতই কম হোক না কেন–তাই মাথায় করে রাস্তায় পড়ে থাকা কষ্টকর। এই সময় তারা এখানে-সেখানে থেকে কিছু ইন্ধন জোগাড় করে সন্ধ্যারাতেই ধুনি জ্বালিয়ে নিয়ে এক এক দল গোল হয়ে আগুন তাপতে বসে যায়। এই আগুন থেকে অনেকসময় অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়।
শীত যে-বছর এরি মধ্যে একটু বেশি পড়ে সে-বছর দু’একজন ভিখিরি পথে মরে পড়ে থাকে। এদের মধ্যে পুরুষেরা খুব জুয়ো খেলে। মানুষের মনের কোমল বৃত্তির উপর এদের জীবনযাত্রা নির্ভর করলেও, এদের নিজেদের মনে কোনো কোমল বৃত্তির বালাই আছে বলে মনে হয় না। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মারপিট, গালাগালি লেগেই আছে। ভিখিরি হলেও এরা সকলেই খুব দরিদ্র নয়–এদের মধ্যে অনেকেরই বেশ পয়সাকড়ি থাকে। বিশেষ করে স্ত্রীলোকদের। রাস্তায় মরে পড়ে আছে অথবা হঠাৎ গাড়ি চাপা পড়ে মারা গিয়েছে এমন স্ত্রীলোক ভিখিরির কোমর থেকে দু’ দশহাজার টাকার গোঁজ আবিষ্কৃত হয়েছে একাধিকবার। এরা অভিনয়-বিদ্যায় অসম্ভব পারদর্শী। রঙ্গমঞ্চে দৃশ্যপটের মাঝে বিভ্রান্তকারী আলোকমালার সম্মুখে দাঁড়িয়ে অভিনেতা বা অভিনেত্ৰী যে ভাবরূপ মুখে ফুটিয়ে তোলেন, অবলীলায় এরা প্রকাশ্য দিবালোকে ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে নিয়তই সেইসব বিচিত্রভাবের ব্যঞ্জনায় পথিকের দৃষ্টি অনায়াসেই আকর্ষণ করে থাকে। যে ব্যক্তি দিব্যচক্ষুর অধিকারী সে হয়তো সারাজীবনে জন্মান্ধের ভূমিকায় অভিনয় করলে। দৌড়-প্রতিযোগিতায় যে প্রথম হবার যোগ্যতা রাখে, হয়তো খঞ্জের ভূমিকায় অভিনয় করেই সে জীবন কাটালে। এ ছাড়া রূপসজ্জাতেও তাদের দক্ষতা কম নয়। এমন কুঠে, এমন ল্যাংড়া এরা সাজতে পারে যে, তা আসল কি নকল ধরবার জন্য অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগাতে হয়।
ভিখিরিদের মধ্যে সাধারণত দুটি শ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। এক, যারা দুর্দশায় পড়ে এই জীবনেই ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করতে বাধ্য হয়েছে। আর এক, যারা ভিখিরি হয়েই জন্মেছে। কিন্তু প্রথম শ্রেণীরই হোক বা দ্বিতীয় শ্রেণীরই হোক- ভিখিরি-জীবনে একবার অভ্যস্ত হয়ে পড়লে তা থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। ভিক্ষা করবার সময় লোকের মনে সহানুভূতি জাগিয়ে তোলবার চেষ্টায় যেসব কাতরোক্তি এরা প্রণয়ন করে তার মধ্যে বুদ্ধির প্রাখর্য ও চাতুর্য বেশ দেখতে পাওয়া যায়। একদল লোক আছে তারা ভিখিরি পোষে। অনেক শিশু অন্ধ ও বিকলাঙ্গ লোকদের দিয়ে তারা ভিক্ষে করায়–সময়মত ঠিক জায়গাটিতে নিয়ে গিয়ে বসিয়ে দেয় ও উঠিয়ে নিয়ে আসে। ভিক্ষা করে যা রোজগার করে এরা তা নিয়ে নেয়, বদলে তাদের খেতে-পরতে দেওয়া হয় মাত্র।
ভিখিরিদের সম্বন্ধে এক কথায় বলে শেষ করা যায় না। দেশে বা প্রদেশে আবার তাদের বিভিন্ন হাল-চাল আছে। ধর্মের নামে ফোঁটা-তিলক-কাটা অথবা পুঁতির মালা আলখাল্লাধারী ভিখিরিও অসংখ্য। ভিখিরিদের জীবন-কথা বিপুল বিচিত্র এবং বিস্ময়কর। দেশে-বিদেশে ভিন্ন। অনেক লোক মিলে অনেকদিন ধরে এদের সঙ্গে মেলামেশা করলে এবং এদের জীবন সম্বন্ধে গবেষণা করলে সমস্ত জানা যেতে পারে। কিছুদিন রাস্তায় শুয়ে তাদের সম্বন্ধে যেটুকু জেনেছি তা এখানে প্রকাশ করলুম।
.
কি করে আমরা জুতোর দায় থেকে মুক্ত হলুম সে-কথা কিছু আগে বলেছি। আশ্চর্যের বিষয় যে সেই রাত্রি দ্বিপ্রহরে সমুদ্রের ধারে নির্জন জায়গাতেও আমাদের পেছনে লোক ছিল। আমাদের সঙ্গে তখনো গোটাকয়েক টাকা ছিল। তার সন্ধান পেলে হয়তো জুতোচোর প্রাণচোর হয়ে দাঁড়াতে পারত। লোকগুলি যে আমাদের হত্যা করেনি, ছেঁড়া-জুতোগুলোই নিয়ে ছেড়ে দিয়েছে এজন্য সেদিন সত্যিই তাদের ধন্যবাদ দিয়েছিলুম।
জুতো যাক–দু’দিন বাদে জামা-কাপড়গুলোও যে যাবে তার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যেতে লাগল। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াই ‘চাকরি দিবি’ ‘চাকরি দিবি’ করে। কিন্তু কোথায় চাকরি! আমার মনে বিশ্বাস ছিল, এই যে আমাদের দেশ-মন্দির-দেউল-তীর্থে ভরা, এর মধ্যে লোকে না খেয়ে মরে না। কিন্তু এতদিন এতরকম দুঃখ-দুর্দশার অভিজ্ঞতায় যা হয়নি, এবার তাই হতে আরম্ভ করলে। অর্থাৎ আমার বিশ্বাসের–আমাদের আত্মবিশ্বাসের ভিত্তিমূল–যার ওপর এতদিন ধরে আমরা কল্পনার সৌধ নির্মাণ করেছিলুম তিল তিল করে, সেই ভিত্তিমূল শিথিল হয়ে আসতে লাগল। আমরা দিব্যচক্ষে দেখতে লাগলুম, আমরাও একদিন পথচারী ভদ্রবেশধারীদের সম্মুখে হাত বাড়িয়ে সকাতরে ভিক্ষা করছি।
কিন্তু আশ্চর্য এই যে সেদিন ভিক্ষাবৃত্তির সম্মুখীন হয়েও নিজেকে সাংঘাতিক বিপদগ্রস্ত বলে মনে করিনি। শুধু এই মনে হয়েছিল, যদি ভিক্ষাবৃত্তিতেও বাধা আসে তবে কি আবার ফিরে যেতে হবে সেই জীবনে–য়ে জীবনকে উপেক্ষা করে চলে এসেছি, বাড়ি অথবা জানাশোনা লাকের সাহায্য না নিয়ে জীবনে সাফল্য লাভ করব বলে। তবুও মনে মনে ঠিক ছিল যে শেষ পর্যন্ত না দেখে ফিরব না। ভিক্ষার মধ্যে যতই দৈন্য যতই বিপদ থাকুক না কেন! বিপদ যখন দূরে থাকে তখন তাকে যত সাংঘাতিক ও অসহনীয় মনে হয়–কাছে এসে পড়লে আর ততটা থাকে না।
এই সময়ে একদিন ক্রফোর্ড-মার্কেটে ঘুরে বেড়াচ্ছি। পায়ে জুতো নেই, আস্ত জামাধুতিগুলো পুঁটুলি করে বগলদাবা করা। ক’দিন থেকেই ছেঁড়া-জামা গায়ে চড়িয়ে ঘুরছি। এক জায়গায় দেখি সার-সার চিনির দোকান রয়েছে। কিরকম খেয়াল হল, পথের মাঝে বৃহত্তর ক্ষেত্রে নামবার আগে এইখানেই ভিক্ষে করবার একটু রিহার্শাল দিয়ে নিলে মন্দ হয় না। যেমন মনে হওয়া অমনি তড়াক করে এগিয়ে গিয়ে এক দোকানদারকে গিয়ে বললুম–বাবা, আজ দু’দিন পেটে কিছু পড়েনি, একটু চিনি দাও তো খেয়ে জল খেয়ে প্রাণরক্ষা করি। বলা বাহুল্য যে বিপদের সময়ে ‘সড়া অন্ধা’-র মতো মাতৃভাষাই মুখ দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল।
আমার কথা শুনে লোকটা মুখ খেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করলে–ক্যা? ক্যা বোল্লা তুম? এক দাঁত-খিঁচুনিতেই ভিখিরির ভূত কাঁধ থেকে ‘দে দৌড়’ মারলে। কিন্তু তখন রণে ভঙ্গ দিয়ে চলেও আসা যায় না! তখুনি করুণ রস থেকে গম্ভীর রসে উত্তীর্ণ হয়ে বলা গেল–দেখ, আমার মনিবদের চায়ের দোকান আছে। সে আমাকে কয়েকরকম দানার চিনির নমুনা নিয়ে যেতে বলেছে–কয়েকরকম দানার চিনি ছোট ছোট কাগজে মুড়ে আমাকে দিতে পার?
বলা-মাত্র লোকটা লাফ দিয়ে উঠে বোধ হয় তিন-চার রকমের চিনি বেশ খানিকটা করে কাগজে মুড়ে আমার হাতে দিয়ে দাম বলে দিলে। সর্বসমেত ওজন করলে বোধ হয় সে পোয়াদেড়েক মাল হবে।
চিনি নিয়ে তো বিজয়গর্বে বন্ধুদের কাছে ফিরে এলুম–তারা এতক্ষণ হাঁ করে আমার কাণ্ড-কারখানা দেখছিল।
বেশ মনে আছে, সেদিন সারাদিন আমরা চিনি-জল খেয়েই কাটিয়ে দিয়েছিলুম।
এমনি করেই দিন কাটছিল। কাজকর্মের কোনো হদিশ নেই, মনের মধ্যে আশাও নেই, নিজেদের মধ্যে ভবিষ্যতের জন্য কোনো পরামর্শও আর নেই। সমস্ত দিন পথে পথে ঘুরে বেড়াই, বিকেলবেলায় সূর্যাস্তের কিছু আগে সমুদ্রের ধারে এসে জুটি। সেখানে সে-সময় একটু ঘাটের মতন পাথরে বাঁধানো জায়গা ছিল, তারই ধারে এসে বসি। দলে দলে পার্শী নরনারী সেখানে এসে দাঁড়াচ্ছে সমুদ্রের দিকে মুখ করে। অস্তোন্মুখ দিবাকরের দিকে ভক্তিভরে চাইছে–কোমর থেকে পৈতে খুলে নিয়ে সমুদ্রের জলে ভিজিয়ে আবার সেটাকে পেঁচিয়ে কোমরে জড়িয়ে গেরো বাঁধছে। দলে দলে লোক আসছে সমুদ্রের তীরে বায়ুসেবনের উদ্দেশ্যে–গুজরাটী, মারাঠী খোঁজা, বোরী–তরুণ-তরুণী বৃদ্ধ প্রৌঢ়। সকলের মুখই প্রফুল্ল। বসে থাকি–আর ভাবি ওই আনন্দ-কোলাহলের মধ্যে আমার কোনো স্থান নেই। আমি একটা লক্ষ্মীছাড়া, সৃষ্টিছাড়া জীব। জীবন-জল-তরঙ্গ চলেছে আমার সম্মুখ দিয়ে বেগে উদ্দাম গতিতে আর তারই কূলে আমি পড়ে আছি স্থাণুর মতন–আবর্জনার মতন। ছোট ছোট ছেলেমেয়ে সুন্দর পোশাক পরে ঘাসের ওপর খেলে বেড়ায়–মনে হয় যেন একঝাঁক প্রজাপতি রোদে খেলছে। মনে মনে ভাবি, ওদের মতন হালকা জীবন আমার কি কখনও ছিল!
রোজ রোজ সমুদ্রের ধারে একেবারে আকাশের নীচে শুয়ে শুয়ে শরীর খারাপ হতে লাগল। সকালবেলা উঠে দেখি আমাদের সকলেরই মুখ ফুলেছে–সমস্ত দিন ঘোরাঘুরি করে একটু চুপসে যায় কিন্তু পরদিন সকালবেলা আবার ফুলে ওঠে। তার ওপর প্রতিদিন পেট ভরে খাওয়া জোটে না। বেশ বুঝতে পারা যেতে লাগল–ব্যাপার সুবিধের নয়।
এরই মধ্যে একদিন এমন একটা ব্যাপার হয়ে গেল যা আর একটু হলেই সাংঘাতিক কাণ্ডে পরিণত হতে পারত। ভিখিরিদের রাস্তায় রাত না কাটলেও তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক একেবারে রহিত হয়নি। দিনের মধ্যে একবার কি দু’বার আমরা ভিখিরি-পাড়ায় সেই দোকানদারের সঙ্গে দেখা করতে যেতুম। সেখানে যাবার প্রধান আকর্ষণ ছিল মার্কিন ও ইউরোপের নানা দেশের সস্তা সাময়িক পত্রপত্রিকাগুলি–সেগুলির মধ্যে রঙিন ও একরঙা নগ্ন ও অর্ধনগ্ন নারীচিত্রগুলি। অনাহার-নিবন্ধন পাকস্থলীর যন্ত্রণা ও আপন অবস্থা সম্বন্ধে চিন্তাব্যাধির চমৎকার প্রতিষেধক ছিল সেই চিত্রগুলি। তার ওপরে সেই দোকানদার আমাদের ঠিক ভিখিরি বলে গণ্য করত না এবং তার সঙ্গে মাঝে মাঝে বিড়ি আদান-প্রদানও চলত। বলা বাহুল্য যে, দু’চারজন ভিখিরিও এই সময় আমাদের সঙ্গে এসে গল্পস্বল্প করত–মাঝে মাঝে এক-আধটা বিড়িও চেয়ে নিত। এখন আমরা কোন পাড়ায় রাত কাটাচ্ছি, সেখানে ব্যবসাপত্র কেমন চলে অর্থাৎ ভিক্ষে-টিক্ষে কেমন জোটে, সে-পাড়ার সর্দার কে, সে কেমন লোক–ইত্যাদি অনেক কথাই তারা মাঝে মাঝে জিজ্ঞাসা করত। আমরাও বানিয়ে বানিয়ে যা মনে আসে তাই বলে দিই। ওদের মধ্যে দু’একজন আমাদের বলত-আবার এখানে ফিরে আয়। কোথায় পড়ে আছিস?
মনে মনে হেসে বলতুম–তাই আসব। ওখানে তেমন সুবিধে হচ্ছে না ভাই! একদিন, তখন বিকেল প্রায় কেটে গেছে, আমরা তিনজন সারাদিন ধরে মাইল-দশেক চক্কর মেরে সেই বই-এর দোকানে ছবির বই-এর পাতা ওলটাচ্ছি এমন সময় কালীচরণ বললে–দাঁড়া, অনেকদিন বিড়ি খাওয়া হয়নি। বলেই হনহন করে চলে গেল বিড়ির দোকানের দিকে। আমরা যেখান থেকে বিড়ি কিনতুম সে দোকানটা এই বই-এর দোকান থেকে একটু দূরে হলেও সেখান থেকে দোকানটা দেখা যেত। আমরা দেখতে লাগলুম–কালীচরণ বিড়ি কিনে দোকানের দেশলাই দিয়ে একটা বিড়ি ধরালে। জাজ্জ্বল্য নারকেল-দড়ি জিইয়ে রাখার প্রথা তখনো বিড়ির দোকানে প্রচলিত হয়নি। আমাদের কালীচরণ বিড়ি টানতে টানতে হেলে-দুলে অগ্রসর হতে হতে হঠাৎ এক ভদ্রবেশধারী লোককে ধরে তার পায়ের দিকে চেয়ে কি-সব বলতে লাগল। দেখলুম লোকটা কালীর কথা শুনে অত্যন্ত উত্তেজিত হয়ে কালীকে মারতে উদ্যত হতেই কালী একটি ঘুষো তার মুখে জমিয়ে দিলে। লোকটা বেশ গুণ্ডা। সে ঘুষো খেয়ে কালীকে মারলে এক লাথি। তারপরে তাকে জাপটে ধরে পথে ফেলে মারতে আরম্ভ করে দিলে। কালীকে বাঁচাবার জন্য আমি ও পরিতোষ ছুটলুম। কিন্তু আমরা পৌঁছবার আগেই চারদিক থেকে আমাদের বন্ধুরা অর্থাৎ ভিখিরির fleet ছুটে এসে পড়ল–”কলকাত্তাওয়ালাকো মার ডালা” বলতে বলতে। ততক্ষণে আমরা গিয়ে পৌঁচেছি। দেখলুম ভিখিরির দল কালীর আততায়ীকে ধরে খুব ঠেঙাচ্ছে। একদল লোক কালীকে তুলে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিয়েছে। সবাই বলছে- কলকাত্তাওয়ালা মর গিয়া, পাঁওমে চোট লাগা-
কী যে হয়েছে কিছু বুঝতে পারবার আগেই চারদিক থেকে বোধ হয় জন-আষ্টেক কনস্টেবল ছুটে এল রুল উঁচিয়ে। পুলিশের আবির্ভাব দেখেই ভিড় গেল পাতলা হয়ে। ভিখিরির দল কালীকে কাঁধে তুলে নিয়ে কোথায় সরে পড়ল। আমরা ছুটে সেই দোকানের কাছে যেতেই দোকানদার বললে–তোমরা দোকানের মধ্যে এস, না হলে পুলিশে ধরতে পারে।
আমি ও পরিতোষ কালবিলম্ব না করে দোকানে উঠে পড়লুম। দেখলুম কনস্টেবলরা ঘুরে, ঘুরে কি হয়েছিল তার সন্ধান নিতে লাগল। একজন কনস্টেবল আমাদের দোকানে এসে জিজ্ঞাসা করায় দোকানদার বললে–এখানে সারাদিন ধরে তো হাঙ্গামার অন্ত নেই–কে তার হিসাব রাখে বাপু!
কনস্টেবল সেখান থেকে চলে গেলেও সেই পথেই ঘোরাফেরা করতে আরম্ভ করলে। আমরা তখনো ভয়ে দোকানেই বসে রইলুম। একটুক্ষণ পরে দোকানদার বললে–তোমরা এবার নেমে এই ‘রাস্তা দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাও।
আমরা বললুম–কিন্তু আমাদের বন্ধুর কি হল, সে কোথায় গেল–তাকে ফেলে যাই কি করে!
দোকানদার বললে–তোমরা ঘণ্টা-দুয়েক গা-ঢাকা দিয়ে থাক। দোকান বন্ধ করবার আগেই ফিরে এসো।
সেখান থেকে তখনকার মতন সরে পড়লুম। কিন্তু সরে পড়ে যাই কোথায়। রাস্তায় পাহারাওয়ালা দেখলেই চমকে উঠে এড়িয়ে যাই। মনে জোর করে সাহস আনবার জন্য বলি যে, আমরা তো সেই হাঙ্গামার মধ্যে ছিলুম না, অতএব ভয় করবার কিছু নেই। ভয়শূন্য মনে দু’কদম চলতে-না-চলতেই পাহারাওয়ালা দেখলেই লাগে ভয়। শেষকালে অত বড় ভয়ের বোঝা বয়ে নিয়ে ঘুরে বেড়ানো অসম্ভব হয়ে উঠল–আমরা মাঠে গিয়ে বসলুম।
সেখানে বসেও ওই চিন্তা–ওই কথা! কোথা থেকে কি হয়ে গেল! অমন যে ঠান্ডা মেজাজের কালী–সাত চড় মারলেও যে রাগে না–সে কিনা খামকা রাস্তার এক ভদ্রলোকের সঙ্গে মারপিট লাগালে! ভাগ্যে ভিখিরি-বন্ধুরা ছিল তাই রক্ষে, না হলে নিশ্চয় কালীকে পুলিশে ধরে নিয়ে যেত–কালীর সঙ্গে সঙ্গে আমাদেরও গিয়ে জুটতে হত হাজত-ঘরে।
কোনোরকম করে ঘণ্টা-দুয়েক কাটিয়ে আবার গিয়ে উপস্থিত হলুম সেই দোকানে। তখন সে-রাস্তা দেখে বোঝাও যায় না যে সন্ধ্যার সময় সেখানে হাঙ্গামা হয়ে গিয়েছে। ভিখিরিরা তখন ফিরে আঁসতে আরম্ভ করেছে। কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ কেউ ইতিমধ্যে তাদের জায়গা দখল করে শুয়ে পড়েছে, নয়তো চা বা অন্য কিছু খাবার খাচ্ছে।
আমরা যাওয়ামাত্র সেই দোকানদার বললে–তোমাদের বন্ধুর খোঁজ পাওয়া গিয়েছে। সে এইখানেই–এই কাছেই আছে এবং ভালোই আছে।
আমরা জিজ্ঞাসা করলুম–কোন্খানে আছে জানতে পারলে, যাই সেখানে। দোকানদার বললে–কোন্খানে আছে তা ঠিক জানি না,–তবে দাঁড়াও দেখছি– লোকটি দোকান থেকে নেমে আমাদের বললে–তোমরা দোকানের দিকে একটু নজর রাখো। তারপর কিছুক্ষণ এদিক-ওদিক করতে করতে দূরে কাকে দেখতে পেয়ে পা চালিয়ে এগিয়ে গেল।
একটু পরে সে একটি ছেলেকে ধরে নিয়ে এসে বললে–এই এরাই তোমাদের বন্ধুকে নিয়ে গিয়েছে।
আমরা বললুম–আমাদের নিয়ে চল সেখানে।
ছেলেটি বললে–এখন হবে না। ধোবিতালাওয়ে এক শেঠের মেয়ের বিয়ে হবে আজ রাত্রে। সেখানে ভিখিরি-বিদায় করা হবে। কাল বেলা আটটা-নটার সময় এসে তোমাদের বন্ধুর কাছে নিয়ে যাব। সে ভালো আছে, তোমরা কিছু ভেব না।
বলেই সে দৌড় দিল।
কালীচরণ সম্বন্ধে হাজার আশ্বাস পেয়েও আমরা নিশ্চিন্ত হতে পারলুম না। ভাবতে লাগলুম–বোম্বাই কি অদ্ভুত জায়গা বাবা, মুহূর্তের মধ্যে মানুষকে মানুষ গায়েব!
আমাদের অবস্থা দেখে সেই দোকানদার সহানুভূতির সঙ্গে বললে–তোমরা বৃথাই ভাবছ। তোমাদের বন্ধু দিব্যি ভালোই আছে।
খানিকক্ষণ পরে সে বললে- আজ রাত্রে তোমরা কোথায় শোবে?
কালীচরণের ভাবনায় এতক্ষণ নিজেদের কথা কিছুই মনে ছিল না। লোকটির প্রশ্ন শুনে বললুম–আজ রাত্রে এইখানেই কোথাও শুয়ে থাকব–কাল ভোরবেলা আবার ওই ছেলেটিকে ধরতে হবে তো।
দোকানদার বললে–তোমরা এক কাজ কর। সেদিনকার মতো আজও দোকানের পেছনদিকে শোও।
আমরা বললুম–সেদিন সারারাত্রি ধরে যা জ্বালাতন হয়েছি–আর ওখানে শুতে ভরসা হয় না।
দোকানদার বললে–আমি বলে দিচ্ছি। কেউ তোমাদের বিরক্ত করবে না, বেপরোয়া পড়ে ঘুমুবে।
দোকানদার আবার দোকান থেকে রাস্তায় নেমে এদিক-ওদিক ঘুরে চার-পাঁচজন মুরুব্বিগোছের ভিখিরিকে ধরে নিয়ে এসে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে বললে–দেখ, আজ থেকে এরা আমার এই জায়গায় রাত্তিরে শোবে। পরদেশী লোক এরা–এদের জ্বালাতন করবে না। মুরুব্বিরাও দেখলুম সেদিন আমাদের ওপর দয়া-পরবশ হয়ে বললে– বেপরোয়া শুয়ে থাক, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না।
আমাদের এই নতুন অনর্থপাতে দেখলুম সকলেই আমাদের ওপর দয়ার্দ্র হয়ে উঠেছে। আমি বরাবর লক্ষ করেছি যে জীবনাকাশ যখন ঘনঘটায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে, নিরাশার অন্ধকারে যখন মনে হয়–আর না, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল, তখনই আকাশের অন্য কোণ দিয়ে কখনও একটু, কখনও বা অঝোরে করুণধারা নেমে আসে। সে-রাত্রে সেই অপরিচিত দোকানদার, যে আমাদের বিদেশি ভিখিরি বলেই জানত, সে রাত্রি-যাপনের জন্য শুধু জায়গা নয়, মাটিতে পাতবার জন্য পুরোনো মোটা কাগজ ও মাথায় দেবার জন্য দু’জনকে দু’তাড়া পুরোনো ‘টিট্বিটস’ দিলে। মনে হল অনেকদিন পর ভালো বিছানায় ঘুম হবে। কিন্তু হায়! মহাকবি বলেছেন যে ঘুমও দুঃস্বপ্ন দ্বারা আক্রান্ত হয়–বাবা কালী’র চিন্তায় থেকে থেকে ঘুম ভেঙে যেতে লাগল–এই করতে করতে রাত্রি অবসান হল।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ভিখিরিদের খোঁজ করলুম। কিন্তু কে কার তোয়াক্কা রাখে, অধিকাংশই তখন রোঁদে বেরিয়ে গিয়েছে। যারা আছে তাদের মধ্যে কেউই কলকাত্তাওয়ালার খোঁজ জানে না। ইতিমধ্যে দোকানদারমশায় এসে পড়ল। সে বললে–তোমরা চা-টা খেয়ে এস, এর মধ্যে আমি ওদের কাউকে ধরে তোমাদের বন্ধুর খোঁজ করছি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা চা খেয়ে ফিরে এলুম কিন্তু কোথায় কে! কারুরই দেখা নেই! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেলা চড়ে গেল, রোদ হয়ে পড়ল চড়চড়ে। বেলা প্রায় বারোটা অবধি অপেক্ষা করবার পর একজন একেবারে অচেনা ভিখিরি ছোকরা এসে আমাদের বললে-কলকত্তাওয়ালার কাছে যাবে তো চল।
আর বাক্য-বিনিময় না করে তার অনুসরণ করলুম।
আমরা যেখানটায় থাকতুম, অর্থাৎ যে রাস্তাটায় আমরা শুতুম, তারই একটু দূরে একটা বড়-গোছের বাজার ছিল। মাছ-তরকারির বাজার নয়–কাপড়-চোপড়, কাঁচের বাসন ও মানুষের ব্যবহার্য প্রায় সব জিনিসের দোকানই ছিল এই বাজারে। আমরা বাজারের বাইরের দিকটাই এতদিন দেখেছিলুম। সেই ছেলেটি আমাদের নিয়ে বাজারের ভেতরে ঢুকল।
প্রকাণ্ড বাজার। বড় বড় দোকান,–লোকজন গমগম করছে। সে এক বিরাট কাণ্ড। কলকাতার চাঁদনী বাজারের মতনই সরু সরু রাস্তা আর তার দু’পাশে বড় বড় দোকান, কিন্তু চাঁদনীর চেয়ে অনেক অনেক বড়। এই বাজারের সরু সরু রাস্তা বেয়ে আমরা বাজারের শেষের দিকে এসে পৌঁছলুম।
এখানে অনেকখানি জমি জুড়ে সব অর্ধেক-তৈরি ঘর পড়ে রয়েছে। ঘরগুলোর ইটের দেওয়াল ছাদ সবই আছে, কিন্তু দরজা-জানলা নেই। দেওয়ালের গায়ে বালির কাজও নেই। দেওয়ালের অবস্থা দেখে মনে হয় ঘরগুলো অনেকদিন আগেই তৈরি হয়েছে, কিন্তু কেন যে সেগুলি এমন অর্ধসমাপ্ত হয়ে পড়ে আছে তা বলতে পারি না। দেখলুম এইসব ঘরে ভিখিরির দল বাস করছে–শত-শত হাজার-হাজার। ছেলে-মেয়ে নারী কুকুর বেড়াল সব কিলবিল করে বেড়াচ্ছে। এ জায়গাটাকে ভিখিরিদের family quarter বলা চলতে পারে। এক-একটা ঘরে দুটো-তিনটে ইট সাজিয়ে আগুন জ্বালিয়ে অনেক জায়গায় রান্নাও চড়ানো হয়েছে দেখলুম। কয়েকটা এইরকর্ম ঘর পেরিয়ে গিয়ে সেই ছেলেটি আমাদের নিয়ে একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল। সেই-ঘরের একটা কোণ দেখিয়ে সে বললে–ওই দেখ, তোমাদের দোস্ত শুয়ে রয়েছে।
একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলুম আমাদের ‘বাবা কালী’ শুয়ে আছেন কালাপাহাড়ের মতন। ঘরের মেঝে কাঁচা, তার ওপর চেটাইয়ের মতন কি-একটা পাতা। মাথায় একটা থান-ইট, ডান পায়ে একটা পাম্পশু। ডান পা-খানা অসম্ভব ফোলা, হাঁটুর বিঘত-খানেক নীচে একটা দগদগে ঘা। তার ওপরে মাছি বসে রয়েছে। মুখখানাও ফুলেছে। আমরা ডাকাডাকি করায় কালী চোখ খুলে বললে–এই যে এসেছিস–বোস।
তার এক পাশে একটা ভাঙা-ময়লা কাঁচের গেলাস, তাতে দুধ লেগে রয়েছে, আর একটা জ্যামের টিনও তার পাশে রয়েছে। সেগুলিকে সরিয়ে তো বসে পড়া গেল। কালী বলতে লাগল–এরা ছিল বলে কাল বেঁচে গিয়েছি। নইলে ঠিক পুলিশে ধরে নিয়ে যেত।
হঠাৎ তার অমন বীরত্ব কেন চাগলো জিজ্ঞাসা করায় কালী যা বললে তার তাৎপর্য হচ্ছে–যেদিন থেকে আমাদের জুতো চুরি গিয়েছে সেইদিন থেকে সে তক্কে তক্কে আছে, ওইরকম জুতো-পরা লোক দেখলেই ধরবে। কারণ বোম্বাই শহরে ধুতিপরা লোক-মাত্রই চপ্পল পায়ে দেয়–পাম্পৃশু-জুতো সেখানকার দেশি লোক পরে না।
কালী বলতে লাগাল–সেদিন বিড়ি কিনে ফেরবার সময় দেখি একটা লোক আমার জুতো-জোড়া পায়ে দিয়ে যাচ্ছে। ধরলুম ব্যাটাকে–তারপর এই ব্যাপার। এ বাবা আমার হক্কের ধন–এই দেখ, আমার পায়ে ঠিক ফিট্ করেছে–
এই বলে সে ডান পা তুলে দেখাতে লাগল। আর এক পাটি মাথার ইটের কাছ থেকে টেনে বার করে আমাদের দেখালে। তাতে দেখলুম, সত্যিই সেটাতে কলকাতার দোকানের টিকিট তখনো লাগানো রয়েছে।
কালীচরণ বলতে লাগল–এরা আমায় খুব যত্ন করছে। ইটের বালিশ হলে কি হবে –দিব্যি শুয়ে আছি। এরা কোথা থেকে দুধ পাঁউরুটি চা নিয়ে আসছে। না-খেয়ে খেয়ে আধমরা হয়ে গিয়েছিলুম। কাল সন্ধ্যা থেকে তিন গেলাস দুধ খেয়েছি। দেখচিস না, এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কিরকম পোস্টাই হয়েছে?
আমরা সেখানে বসে থাকতে-থাকতেই একজন কোট-প্যান্ট-পরা পার্শী ডাক্তার এসে উপস্থিত হলেন। ভিখিরিরাই তাঁকে আজ সকালে খবর দিয়েছে। দেখলুম, সে-মহলে তিনি খুবই পরিচিত। ভদ্রলোক খুব যত্ন করে কালীকে দেখে আমাদের বললেন–বেশ জ্বর রয়েছে। আমি খাবার ও পায়ে লাগাবার ওষুধ দিচ্ছি। কালকের মধ্যে যদি জ্বর না যায় তা হলে হাসপাতালে পাঠাতে হবে।
আমরা বললুম–এখানে আমরা তো কারুকে চিনি না। হাসপাতালে পাঠাতে হলে কি ব্যবস্থা করতে হয় তো কিছুই জানি না।
ডাক্তার বললেন–সে যা করবার আমি করে দেব–কিছু ভেব না।
ডাক্তারের সঙ্গে ওষুধ আনতে গেলুম তাঁর ডিপেনসারিতে। বাজারের কাছেই, মস্ত দাওয়াইখানা–ব্যবসা তাঁর নিজের। রুগিদের কাছে কিছু নেন না–খালি ওষুধের দাম। ওষুধ নেওয়ার পর ডিজ্ঞাসা করলুম–কত দিতে হবে?
ডাক্তার হেসে বললেন–একপয়সাও না। আজ বিশ বছর ধরে আমি ওদের বিনামূল্যে চিকিৎসা করি ও ওষুধ দিই। ওদের আশীর্বাদের জোরেই আমার এই ব্যবসা চলে। ওরা আছে বলে আমার এখানে এতদিন চুরিচামারি কিছু হয়নি। শুধু আমার নয়–ওই বাজারের সমস্ত দোকানদার ওদের সাহায্য দেয়–অত বড় বাজারেও কখনও চুরি হয় না–এমনকি পকেটমার পর্যন্ত ওখানে ঢুকতে পায় না। একবার বাজারের মালিকরা ওখান থেকে ভিখিরিদের বাস তুলে দেবার চেষ্টা করেছিল। ঠিক সেই সময়েই একদিন বাজারে ভীষণ আগুন লাগল। দু’দিন ধরে ফায়ার-বিগ্রেড দিন-রাত চেষ্টা করে তবে সে-আগুন নেভায়। কে বা কারা সেই আগুন লাগিয়েছিল, পুলিশ অনেক চেষ্টা করেও তা ধরতে পারলে না। তবে খোঁজ করে জানা গিয়েছিল যে, প্রথমে একসঙ্গে চার-পাঁচটি দোকানে আগুন লাগে। যাই হোক, সেই থেকে বাজারের মালিক অথবা দোকানদারেরা সকলেই ওদের সঙ্গে খুবই সদয় ব্যবহার করে–ওরাও বাজার পাহারা দেয় আর নির্বিবাদে ওদের বংশবৃদ্ধি করে।
.
কয়েকদিন পেটে ওষুধ ও পায়ে মলম লাগিয়ে কালীচরণ চাঙ্গা হয়ে আবার আমাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে আরম্ভ করলে। চলা-ফেরা শুরু করতেই সেও আমাদের সঙ্গে সেই বই-এর দোকানের পেছনে শুতে লাগল।
একদিন এইরকম পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছি এমন সময়ে এক রাস্তায় একটা নতুন বাড়ির দোতলায় দেখলুম ইংরেজি, বাংলা ও হিন্দি অক্ষরে লেখা বড় বড় সাইনবোর্ড ঝুলছে- লক্ষ্মীর ভাণ্ডার–কে. বি. সেন এন্ড কোং
লক্ষ্মীর ভাণ্ডার ও কে. বি. সেন এন্ড কোং–এই দুই নামই বাঙালিদের কাছে সে-সময়ে বিশেষ জানা ছিল। স্বদেশীর সময় কে. বি. সেন বোম্বাই থেকে দেশি ধুতি এনে কলকাতায় . চালু করেছিলেন। বড়বাজারের তুলাপটিতে তাঁর দোকানে দু’তিনবার গিয়ে ধুতি কিনে এনেছি। সেখানে তাঁকে দেখেছিও। আমাদের পাড়াতেই সরলাদেবী ও তিনি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার নাম দিয়ে একটা কারবার খুলেছিলেন। সেখানে যাবতীয় দেশি জিনিস পাওয়া যেত। সেই লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বোম্বাই শহরে দেখে বড় আনন্দ হল। আমরা সোজা ওপরে উঠে গিয়ে দেখলুম-কলকাতার লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেরই শাখা খোলা হয়েছে বোম্বাই শহরে। দোকানঘরে ওই দেশীয় একজন লোক রয়েছে। তাকে কে. বি. সেনের কথা জিজ্ঞাসা করায় জানা গেল যে, কুঞ্জবাবু ওই ঘরে বসে আছেন।
কে. বি. সেনের নামই কুঞ্জবিহারী সেন এর আগে তা জানা ছিল না। সেই লোকটির কাছ থেকে জেনে নিয়ে আমরা কুঞ্জবাবুর সঙ্গে দেখা করতে গেলুম।
একটি ছোট্ট ঘর। প্রায় ঘর-জোড়া চৌকি। তাতে বেশ পুরু বিছানা, ধবধবে সাদা চাদর পাতা। তার ওপরে ধবধবে সাদা কুঞ্জবাবু বসেছিলেন।
আমরা গিয়ে তাঁকে নমস্কার করামাত্র তিনি স্মিতমুখে বললেন–এস, এস–ভেতরে এস। মনে হল যেন তিনি এতক্ষণ আমাদেরই অপেক্ষায় বসেছিলেন। আমরা ভেতরে ঢুকতেই তিনি বললেন–দেখ, ‘আমার ঘরখানি খুবই ছোট। বসবার জায়গা নেই বললেই হয়।
আমরা আমতা-আমতা করে বললুম–তাতে কি হয়েছে! আমরা দাঁড়িয়েই আছি–আপনি ব্যস্ত হবেন না।
প্রথম সম্ভাষণটি চুকে যাওয়ার পর কুঞ্জবাবু বললেন-তারপর! বোম্বাই কতদিন আসা হয়েছে? কি করছ এখানে? কিছু সুবিধা করতে পেরেছ?
কুঞ্জবাবুর কথাবার্তায় এমন একটা সহানুভূতি ও অমায়িকতা মাখানো ছিল যা এতদিন কারুর মধ্যেই পাইনি। আমরা ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়েছি শুনে তিনি খুবই খুশি হলেন। উৎসাহ দিয়ে বললেন–এই তো চাই। বাঙালিরা বড় কুনো। তারা ঘর ছেড়ে কোথাও বেরুতে চায় না। কেরানির কাজ ছাড়া সব কাজকেই হীন বলে মনে করে। দেখ–মাড়োয়ারীরা কোথায় কোথায় ভারতবর্ষ ছেড়ে দূরদেশে গিয়ে ব্যবসা করছে। বোম্বাইয়ের লোকেরাও এসব বিষয়ে মাড়োয়ারীদের চেয়ে, কম নয়।
এইসব বলে তিনি আমাদের বললেন–চলে যাও আফ্রিকা কি মরিশস দ্বীপে। দেখ সেখানে কিছু করতে পার কি না। আমার বিশ্বাস নিশ্চয় কিছু করতে পারবে।
কুঞ্জবাবুর কথা শুনতে শুনতে বুকে আবার জোর পেতে লাগলুম। তাঁকে বললুম–আমরা যদি মাঝে মাঝে আসি, আপনার কোনো অসুবিধা হবে না তো?
কুঞ্জবাবু হেসে বললেন–কিছু না, কিছু না। তোমরা দুবেলা এস। আমি এখানে একলা থাকি, তোমরা এলে গল্পস্বল্প করা যাবে।
পরদিন সকালে আবার কুঞ্জবাবুর ওখানে গেলুম। আমাদের দেখে বললেন–এস এস। বোম্বাইয়ে একরকম লম্বা-চওড়া কলার মতন দেখতে লঙ্কা পাওয়া যায়। দেখলুম ভদ্রলোক সেই লঙ্কা চিরে-চিরে মশলা ভরে রোদে দিচ্ছেন। বললেন–একলা থাকি, অনেক কিছুই নিজের হাতে করে নিতে হয়।
সেদিনও তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হল। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলেন-তোমরা এখানে কোথায় থাক?
বললুম–আমাদের থাকবার জায়গা কিছু নেই। সমস্ত দিন রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বেড়াই, সমুদ্রে নেমে স্নান করি সমুদ্রের ধারেই বেঞ্চির ওপর পড়ে রাত কাটাই।
আমাদের কথা শুনে সেন-মশাই একেবারে চমকে উঠলেন। তিনি মনে করেছিলেন পালিয়ে এলেও তথাকথিত ভদ্রভাবে জীবনযাপন করবার সঙ্গতি আমাদের আছে। আমাদের অবস্থা শুনে বললেন–ওই সমুদ্রে কখনও স্নান কোরো না। ওই জলে অনেক বিষাক্ত সাপ থাকে। একবার ছুঁলে আর রক্ষে থাকবে না। সমুদ্রের ধারেও শুয়ো না, জুতো চুরি গিয়েছে, কোনোদিন হয়তো প্রাণ চুরি যাবে।
বই-এর দোকানের পিছনে শোবার যে আশ্রয় সম্প্রতি পাওয়া গিয়েছিল সেকথা চেপে গিয়ে তাঁকে বললুম–কোথায় রাত কাটাই! যেখানেই যাই সেখানেই পুলিশ তাড়া করে।
কুঞ্জবাবু একটু ভেবে বললেন–দেখ, এক কাজ কর। এই বাড়ির দোতলা থেকে পাঁচতলা অবধি অসংখ্য ঘর পড়ে রয়েছে, সব ঘর ভাড়া হতে এখনও অনেক কাল লাগবে। তোমরা রাত্রে একটা ঘরে শুয়ে থেকো। কেউ কিছু বলে তো বলবে তোমরা আমার লোক।
সেদিন থেকে আমরা সেই নতুন বাড়ির চকচকে মেঝেতে শুয়ে রাত কাটাতে লাগলুম। সেই বাড়িখানার নাম যতদূর মনে পড়ছে–নবাব বিল্ডিং।
যদুবাবুর আশ্রয়চ্যুত হয়ে অবধি এই প্রথম ঘরে শোবার সুযোগ মিলল।
এইরকম চলছে। রোজ দুবেলা কুঞ্জবাবুর কাছে গিয়ে বসি, নানা রকম কথাবার্তা হয়, আমাদের কাজের কিছু ঠিক নেই। একদিন মুখ ফুটে তাঁকে কাজের কথা বলেই ফেলা গেল। যদি মরিশসে কিংবা আফ্রিকায় অথবা যে-কোনো জায়গায় আমাদের কোনো কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন তো বেঁচে যাই।
আমাদের কথা শুনে কুঞ্জবাবু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন–আপাতত তো কোনো কাজকর্ম হাতে নেই। আচ্ছা দাঁড়াও–মেটাজী আসুন, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে দেখি।
পরের দিন মেটাজীর সঙ্গে দেখা হল। কুঞ্জবাবুর সঙ্গে ব্যবসাসূত্রে তিনি প্রায় প্রতিদিনই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে আসতেন। লোকটি দেখতে বেশ লম্বা-চওড়া, ধবধবে ফরসা, পরনে ধুতি অথচ মাথায় পার্শীদের মতন টুপি অথবা ডোঙার মতন একটা বস্তু। বোঁ বোঁ করে বাংলা বলেন। কুঞ্জবাবু আমাদের বললেন–এখান থেকে কিছু দূরে কল্যাণ স্টেশনের কাছে পুণের এক শেঠ গভর্মেন্টের কাছ থেকে একটা জঙ্গল কিনেছেন। খুব সুন্দর জঙ্গল-পাহাড়-ঝরনা ইত্যাদিও আছে। কল্যাণ থেকে পুণেয় যেতে হলে যেসব জঙ্গল-পাহাড় ভেদ করে যেতে হয় তারই খানিকটা আর কি! এই জঙ্গল কেটে সাফ করে তিনি এখানে চাষবাস করছেন। সামান্য খানিকটা জায়গা সাফ করে আপাতত চাষবাস শুরু করছেন, পরে আস্তে আস্তে বাড়াবেন। দুই-একজন লোক এই জমির খানিকটা করে ভাড়া নিয়ে নিজেরাও চাষবাস করছে। যাই হোক, এখানে নানা কাজের জন্য বিস্তর লোক খাটছে, মেটাজী সেখানে তোমাদের কিছু কাজ জোগাড় করে দিতে পারেন। ভেবে দেখ–
এইসব কথা বলেই তিনি সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালেন–যার অর্থ–বাণিজ্যে লক্ষ্মী বাস করে, তার অর্ধেক কৃষিকার্যে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরাও মনে মনে সংস্কৃত শ্লোক আওড়ালুম–যার অর্থ–সর্বনাশ উপস্থিত হলে পণ্ডিতেরা অর্ধেক ত্যাগ করে। অতএব বাণিজ্য যখন হলই না তখন কৃষিকাৰ্যই সই
বলা বাহুল্য, আমরা তো তখুনি রাজি হয়ে গেলুম। মেটাজী বললেন–আমি শিগিরই সেখানে গিয়ে তোমাদের জন্য সব বন্দোবস্ত করে আসব।
এরপর আমরা রোজই খোঁজ নিই, কিন্তু শুনি যে, মেটাজীর সেখানে যাবার সুবিধা হয়নি। প্রায় দিন পনেরো পরে একদিন কুঞ্জবাবু বললেন–কাল সকালে মেটাজী তোমাদের নিয়ে যাবেন।
সংবাদটি পেয়ে আমরা যে কিরকম আনন্দিত হয়েছিলুম তা বোধহয় না বললেও চলবে। উৎসাহের আবেগে রাত্রে আমাদের ভালো করে ঘুমই হল না। খুব ভোরে উঠে স্নান করে চা খেয়ে এলুম। তারপরে আমাদের ছেঁড়া কাপড়ের পুঁটলিগুলি বেঁধে কুঞ্জবাবুর ঘরে গিয়ে উপস্থিত হলুম। এ-কথা সে-কথার পর কুঞ্জবাবু একখানা কাগজ বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন–দেখ, তোমাদের কলকাতার বাড়ির ঠিকানা আর অভিভাবকের নাম লিখে দিয়ে যাও।
কাগজখানা হাতে নিয়ে ভাবলুম–কি করা যায়! বন্ধুদের সঙ্গে পরামর্শ করবারও উপায় নেই–কুঞ্জবাবু মুখের দিকে চেয়ে আছেন। ওদিকে কাগজ হাতে নিয়ে বসে থাকাও চলে না। যা-তা একটা নাম ও ঠিকানা লিখে দিলুম। আমরা দেখাদেখি পরিতোষ ও কালীচরণও যা-তা নাম-ঠিকানা লিখলে।
কুঞ্জবাবু কেন যে আমাদের অভিভাবকদের নাম ও ঠিকানা চেয়েছিলেন আজও সে-রহস্য আমি ভেদ করতে পারিনি। কারণ আমরা যে বাড়ি থেকে পলায়ন করে গিয়েছিলুম সে-কথা আমরাই তাঁকে বলেছিলুম। এই দুঃখ-কষ্ট না করে ভালো ছেলের মতো বাড়ি ফিরে গেলে সেখানে অন্ন, বস্ত্র ও আশ্রয়ের অভাব আমাদের নেই, সে-কথাও তিনি জানতেন এবং আমাদের এই দৃঢ়তার জন্য প্রশংসাই করতেন ও প্রত্যক্ষভাবেই উৎসাহ দিতেন। হঠাৎ এতদিন পরে বাড়ি ও অভিভাবকদের ঠিকানা চাওয়ায় আমরা আশ্চর্য হয়ে গেলুম। যাই হোক, কিছু পরে মেটাজী এসে পড়লেন এবং তাঁর সঙ্গে ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশন থেকে কল্যাণ যাত্রা করলুম; ট্রেন-ভাড়াটা কে দিলে তা বলতে পারি না।
.
যথাসময়ে কল্যাণে নেমে কিছুক্ষণ হেঁটে সেই জঙ্গলে এসে পৌঁছোনো গেল। সামনের দিকটা অর্থাৎ যে-দিকটা লোকালয়ের দিকে সেদিক থেকে আরম্ভ করে ভেতরের প্রায় আধ-মাইলটাক লম্বা ও আধ-মাইলটাক প্রস্থ জমি পরিষ্কার করে আবাদ করা হচ্ছে। আমরা জঙ্গলে ঢুকে সরু রাস্তা দিয়ে খানিকটা ভেতরের দিকে গিয়ে একখানা পাতা-দিয়ে-ছাওয়া ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালুম। মেটাজী উচ্চৈঃস্বরে কয়েকবার কি-একটা বলে চিৎকার করতেই ঘরের ভেতর থেকেই জবাব দিয়ে বেরিয়ে এল বেঁটে-মতো বেশ গুণ্ডা-গোছের লোক, হাঁটুর ওপরে মালকোঁচা-মারা ধুতি পরা, গায়ে একটা ফতুয়া-গোছের হাতকাটা জামা। জামাটার সামনের দিকে একটা বড় তাপ্পি-পকেট। লোকটাকে দেখেই আমাদের ‘বাবা কালী’ আস্তে আস্তে বললে, এ যে ভুলু সর্দার দেখছি।
লোকটা কাছে এসে একবার আমাদের আপাদমস্তক দেখে, তারপর মেটাজীর সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করল। মেটাজী ও ভুলু সর্দার আমাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে অগ্রসর হতে লাগলেন আর আমরা তিনজনে তাঁদের পশ্চাদনুসরণ করতে লাগলুম।
জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর গিয়ে বিরাট একটা ফাঁকা জায়গায় উপস্থিত হলুম। দেখলুম, একদিকে অনেকখানি জায়গা নিয়ে কলার বাগান করা হয়েছে। বেঁটে-বেঁটে কলাগাছ–তাতে কাঁদি-ভর্তি বড় বড় মোটা কলা গাছ থেকে ঝুলে প্রায় মাটিতে ঠেকেছে। আরও খানিকটা এগিয়ে দেখা গেল, সেখানে চিচিঙ্গের ক্ষেত করা হয়েছে–তিনচার হাত লম্বা হাজার হাজার চিচিঙ্গে উঁচু মাচা থেকে মাটির দিকে ঝুলছে। বড় বড় মানুষের সমান উঁচু ঘাসের জঙ্গল দু’ হাতে সরিয়ে তার মধ্যে রাস্তা করে মেটাজী ও ভুলু সর্দার আগে চলেছেন–তাঁদের পেছনে আমরা চলেছি। সম্মুখে পেছনে আশেপাশে মোটা মোটা বড় বড় গাছ–সেসব গাছের চেহারাও কখনও দেখিনি, নামও শুনিনি। এইসব গাছে জাহাজের কাছির মতন মোটা ও শক্ত পাকানো-পাকানো লতা ঝুলছে। কোনো কোনো জায়গায় জঙ্গল এত ঘন যে, গাছের মাথায় মাথায় ঠেকাঠেকি হয়ে আছে। কতদিন যে সেখানকার জমিতে সূর্যালোক স্পর্শ করেনি, তার ঠিকানা নেই। জায়গাটা একেবারে স্যাঁতসেঁতে হয়ে আছে। এক জায়গায় দেখলুম, অনেকখানি জমি পরিষ্কার করে লাঙল দিয়ে চষা হয়েছে–প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন স্ত্রী-পুরুয়ে মিলে সেই জমি থেকে আগাছা ও পাথর ইত্যাদি বেছে এক জায়গায় জড়ো করছে। আমরা আসতেই তারা দাঁড়িয়ে উঠে অবাক হয়ে আমাদের দেখতে লাগল। পুরুষগুলির গায়ে কোনো জামা নেই, কোমরে একখণ্ড বস্ত্ৰ জড়ানো, তাতে কোনোরকমে লজ্জা-নিবারণ হয়েছে মাত্র। মেয়েদের দেহেরও উত্তরার্ধ একরকম নগ্ন বললেই চলে। কোমরে একটু বস্ত্র জড়িয়ে রেখেছে। পুরুষ কিংবা স্ত্রী উভয়েই অত্যন্ত রোগা। পুষ্টিকর খাদ্য তো দূরের কথা, দেখে মনে হয়–কোনো রকমের খাদ্য তাদের পেটে পড়ে কি না সন্দেহ। সকলেই অদ্ভুত একরকমের দৃষ্টিতে বিশেষ করে আমাদের তিনজনকে দেখতে লাগল।
মেটাজী ও সর্দার আমাদের আগে আগে যাচ্ছিলেন। এইখানে মেটাজী পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আমাদের বললেন–ওই এদের সঙ্গে তোমাদের কাজ করতে হবে। কাজ এমন হাতি-ঘোড়া কিছুই নয়–একটা বাচ্চা ছেলেকে বললেও সে করতে পারে।
এই অবধি বলে আবার তাঁরা কথা বলতে বলতে অগ্রসর হতে লাগলেন। আমাদের সামনে ও পেছনে বিস্তীর্ণ অরণ্য, দক্ষিণে ও বামে ছোট পাহাড়ের সারি। মনে হয় যেন প্রকৃতিদেবী জঙ্গলের দু’দিকে উঁচু পাথরের দেওয়াল গেঁথে রেখেছেন। এক এক জায়গায় জঙ্গল সংকীর্ণ হয়ে গেছে–দু’দিকের পাহাড় অনেক কাছাকাছি হয়েছে। দেখলুম প্রায় সর্বত্রই এই পাহাড়ের গা বয়ে নিরন্তর জল ঝরছে–তারই ফলে পাহাড়ের গায়ে শেওলা জন্মেছে। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে এক জায়গায় দেখা গেল একখণ্ড প্রকাণ্ড পাথর–তারই ওপর দিয়ে একটা শীর্ণ জলধারা এসে নীচে একটা ডোবার মতন সৃষ্টি হয়েছে। মেটাজী আমাদের বললেন–এই দেখ কেমন সুন্দর ঝরনা। এরা এই জল খায়।
কিছুদিন আগে কুঞ্জবাবু আমাদের কাছে যে ঝরনার কথা বলেছিলেন, বোধ হয় এই সেই ঝরনা। আরও কিছুদূর অগ্রসর হবার পর মনে হল যেন এতক্ষণে আমরা গভীর জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়েছি। ছোট-বড় গাছ ও লতায় মাথার ওপর চাঁদোয়ার মতন একটা আচ্ছাদন সৃষ্টি হওয়ায় জায়গাটা অপেক্ষাকৃত অন্ধকার নির্জন বলে মনে হতে লাগল। এখানকার পথও পরিষ্কার নয়, বেশ বুঝতে পারা গেল যে এদিকে লোকজন বড় একটা কেউ আসে না।
এইদিকে খানিকটা এগিয়ে যাবার পর দূরে একটা বাড়ি দেখতে পাওয়া গেল। বাড়িখানা দেখে কালী বললে–এই পাণ্ডবর্জিত স্থানে কোন্ শৌখিন এমন বাড়ি তৈরি করলে!
এমন সময় মেটাজী পেছন ফিরে আমাদের বললেন–ওই দেখ তোমাদের বাড়ি। এমন জায়গায় এমন সুন্দর বাড়িতে লাটসাহেবও থাকতে পায় না!
একটু এগিয়েই আমরা বাড়ির কাছে এসে উপস্থিত হলুম। আমাদের অজ্ঞাতসারে প্রায় দশ-বারোজন নারী ও পুরুষ শ্রমিক যে আমাদের অনুসরণ করছিল তা আমরা টেরই পাইনি। এইখানে এসে দাঁড়াতেই তারা আরও কাছে এগিয়ে এসে আমাদের ভালো করে দেখতে লাগল। কিন্তু সর্দার রক্তচক্ষু বার করে বিকট চিৎকার করে তাদের ভাষায় কি-সব বলায় সকলেই ধীরে ধীরে ফিরে চলে গেল। সর্দারমশায়ের এই বিকট আওয়াজ শুনে তাঁর মেজাজের কিছু পরিচয় পাওয়া গেল। তিনি ভাঙা-ভাঙা হিন্দিতে অর্থাৎ আমরা যাতে বুঝতে পারি–মেটাজীকে বললেন–শুয়ারের বাচ্চারা অত্যন্ত পাজি, শয়তান এবং অসম্ভব রকমের চালাক। আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে ভুলে ডাণ্ডাটা ফেলে এসেছি–হাতে ডাণ্ডা নেই–বুঝতে পেরেছে যে, এখন আর মারতে পারবে না–অমনি আমাদের পেছু পেছু এসেছে মজা দেখতে! কাজে কোনোরকমে ফাঁকি দিতে পারলে হয়।
লোকগুলো চলে যাওয়ার পর বাড়িখানা ভালো করে দেখলুম। বেশ বড় পাথরের বাড়ি–অনেকটা গির্জা-ধরনের। মাটি থেকে প্রায় আড়াইতলা উঁচু পাথরের গাঁথুনি করে, সেখানে ঘর বানানো হয়েছে, ঘরের চারিদিকে দরজার মতো বড় বড় জানলা। মেটাজী ও সর্দার কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। বলা বাহুল্য, আমরাও তিনজনে তাঁদের পশ্চাদনুসরণ করলুম।
ওপরে গিয়ে দেখলুম প্রকাণ্ড একখানি ঘর–যেমন লম্বা তেমনি চওড়া–ঠিক গির্জাঘরের মতন। ঘরের মেঝে ও দেওয়াল কাঠের। দেওয়ালে চমৎকার ওয়ালপেপার মারা। ঘরখানাকে মাঝে পার্টিশন দিয়ে ভাগ করা হয়েছে। ঘরের পাশেই আলাদা ভিতের ওপরে তৈরি ছোট্ট একখানি ঘর। বেশ বুঝতে পারা গেল, একসময়ে সেই ঘরে কমোড ইত্যাদি থাকত।
‘মেটাজী বললেন–এই ঘরে সায়েবদের পায়খানা ছিল, তোমরা এইখানেই রান্নাবান্না কোরো। মেটাজী আরও বললেন–নীচে একখানা রান্নাঘর আছে বটে, কিন্তু তোমরা এইখানেই ব্যবস্থা কোরো। আজ থেকেই কাজে লেগে যাও–একটা দিনের ‘রোজ’ কেন আর মারা যায়।
সেই বিরাট ঘরের এক কোণে আমাদের ছেঁড়া ন্যাকড়ার পুঁটুলিগুলো রেখে তখুনি তৈরি হয়ে নিলুম। মেটাজী বলে দিলেন–দেখ, ভোর ছ’টার সময়ে কাজে লাগতে হবে। বেলা এগারোটায় ছুটি পাবে। ঘণ্টা-দুয়েকের মধ্যে খেয়ে-দেয়ে আবার বেলা একটার সময় গিয়ে কাজে লাগবে আর ছুটি পাবে বিকেল ছ’টায়। দুপুরে ছুটির সময় জল-টল তুলে রাখবে। কারণ বিকেলে ঘরে এসেই সিঁড়ির দরজা ভালো করে বন্ধ করে দেবে। তারপরে আর নীচে নামা চলবে না।
জিজ্ঞাসা করলুম–কেন মশায়?
তিনি বললেন–এ জায়গাটাতে আবার সন্ধের পর জানোয়ার বেরোয় বলে শুনেছি।
কী জানোয়ার বেরোয় সে-কথা জিজ্ঞাসা করায় মেটাজী ধমকে উঠে বললেন–সে-কথায় তোমাদের দরকার কি? বারণ করলুম, দরজা খুলে রেখো না। বাস্।
কথায় কথায় মেটাজী বললেন–মনে কোরো না যে, তোমরা এসে এখানে থাকবে বলে শেঠজী তোমাদের জন্য এই বাড়ি তৈরি করে রেখেছেন।
মেটাজীর মুখে অনেকক্ষণ থেকে এইসব ক্যাটকেঁটে কথা শুনতে শুনতে আমার ধৈর্যচ্যুতি হল। বলে ফেললুম–তা যে হয়নি তা আমরা জানি। ভাগ্যদোষে আজ আমাদের এই অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছে বলে মেটাজী মনে করবেন না আপনার চাইতে আমাদের বুদ্ধি কিছু কম আছে।
আমার জবাব শুনে মেটাজীর মেজাজ একেবারে জল হয়ে গেল। তিনি বলে উঠলেন–না না, রাগ করছ কেন? আমি ঠাট্টা করেছি।
মেটাজী বলতে লাগলেন–এইখানে তিনজন ক্রিশ্চান পাদরি থাকতেন। ইংল্যান্ড ফ্রান্স, বেলজিয়াম বা আমেরিকা–এইরকম কোনো একটা জায়গায় ছিল তাঁদের বাড়ি। ঠিক কোন্–জায়গায় তাঁদের বাড়ি তা তিনি জানেন না, তবে তাঁরা ছিলেন একেবারে গোরা।
জিজ্ঞাসা করলুম–তাঁরা এখানে কী করতেন?
–তাঁরা এসেছিলেন এখানকার আদিবাসীদের মধ্যে আলোক-বিকিরণ করতে। কিন্তু কয়েক বছর যেতে-না-যেতে পালাতে পথ পেলেন না–বলেই মেটাজী উচ্চহাস্য করলেন।
কিন্তু মেটাজীর কথাটা শুনে আমরা বিশেষ উৎসাহ বোধ করলুম না। জানোয়ারের কথা শুনে মনটা আগেই দমে ছিল–তার ওপর ক্রিশ্চান পাদরিদের পলায়নের কথা শুনে আরও দমে গেলুম। ভাবলুম, ক্রিশ্চান পাদরি–যাঁরা আফ্রিকার সিংহসঙ্কুল গভীর অরণ্যে নরখাদক অর্ধমনুষ্যদের মধ্যে সারাজীবন কাটিয়ে দিতে ভয় পান না, তাঁরা কিসের ভয়ে এখান থেকে পালিয়ে চলে গেলেন! আরা আমরাই বা এমন কি তালেবর লোক যে, সে-স্থানে আমাদের নিয়ে এসে রাখা হচ্ছে।
ব্যাপার বিশেষ সুবিধের নয় মনে করে মেটাজীকে জিজ্ঞাসাই করে ফেলা গেল–হ্যাঁ মশাই, ক্রিশ্চান পাদবিরা এখান থেকে ভেগে গেলেন কিসের ভয়ে?
মেটাজী সে-কথার কোনো উত্তর না দিয়ে বললেন–যেতে দাও। অনেকক্ষণ গল্প হয়েছে–এবার কাজে চল। তোমাদের খাওয়া-দাওয়ার কোনো ব্যবস্থা করেছ?
বললুম–কী বন্দোবস্ত হবে! আমরা তো এই এলুম। তা ছাড়া আমাদের ট্যাকে তো কানাকাড়িও নেই। রসদ কিনতে হলে পয়সা চাই তো।
আমাদের কথা শুনে মেটাজী সর্দারের সঙ্গে একটু পরামর্শ করে বললেন–আচ্ছা, আজকের দিনটা কোনোরকমে চালিয়ে নাও। কাল বিকেলে তোমাদের দু’দিনের ‘রোজ’ দেওয়া হবে–তাই দিয়ে বাজার থেকে জিনিসপত্র কিনে এনো। চল, এখন কাজে লেগে যাও
ঘর থেকে নেমে আমরা চললুম আবার যেখানে কাজ হচ্ছে। চলতে চলতে আমরা মেটাজীকে বললুম–সর্দারকে বলুন আমাদের একটা ঝাঁটা ও একটা জলপাত্র দিতে। জল না খেয়ে থাকব কি করে?
মেটাজী সর্দারের সঙ্গে কথা বলে আমাদের বললেন–কাজ শেষ করে বাড়ি ফেরবার সময় সর্দারের বাড়িতে গিয়ে চাইলে উনি ঝাঁটা দেবেন।
মেটাজী ও সর্দারের পেছনে পেছনে চলতে লাগলুম। এক জায়গায় এসে তাঁরা দাঁড়াতেই আমরাও দাঁড়ালুম। সেখানে দেখলুম পথের দু’ধারে বড় বড় মানুষ-সমান ঘাস হয়ে রয়েছে। সর্দার বললেন–এই যে বড় বড় ঘাস দেখছ–এর নীচে করোগেটেড আয়রনের মতন জমিতে আলুর ক্ষেত আছে।
মেটাজী আবার বলে দিলেন–রাঙা আলুর ক্ষেত–লতানো গাছ চেনো তো? দেখো যেন ঘাস তুলতে আসল গাছ তুলে ফেলো না।
মেটাজী যাবার সময় বললেন–বেশ মন দিয়ে কাজকর্ম করবে। আমি সর্দারকে বলে গেলুম, সে কাল তোমাদের ‘রোজ’ দেবে, তাই দিয়ে বাজার করে এনো।
মেটাজী বিদায় নিলেন আর আমরা ‘জয় দুর্গা’ বলে মনের আনন্দে আলুর ক্ষেতে ঘাস তুলতে লেগে গেলুম। আমাদের আশেপাশে যেসব নরনারী মজুরের কাজ করছিল তারা কিছুক্ষণ এই জামা-পরা মজুরদের দিকে অবাক হয়ে দেখে নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষণ বোধ হয় আমাদের সম্বন্ধে কথাবার্তা বলে আবার যে-যার কাজে লেগে গেল।