মহাস্থবির জাতক – চতুর্থ পর্ব
নিবেদন
‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হল। এইটিই শেষ পর্ব। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর মৃত্যুর পর তাঁর সম্বন্ধে যেসব কথা লেখা হয়েছে তার মধ্যে একটি কথা এই যে, তিনি ‘মহাস্থবির জাতক’ সম্পূর্ণ ক’রে যেতে পারেননি। এ-কথা কিন্তু একেবারেই ঠিক নয়। অবশ্য তাঁর মৃত্যুকালে ‘মহাস্থবির জাতক’-এর চতুর্থ পর্ব পাণ্ডুলিপি-আকারেই আমার কাছে ছিল। এই পাণ্ডুলিপি থেকে কিছু কিছু অংশ ‘শারদীয়া দেশ’ ও শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং পরে ‘দেশ’-পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে সম্পূর্ণ চতুর্থ পর্ব প্রকাশিত হয়। চতুর্থ পর্ব লেখবার সময় প্রায় দশবছর কাল তিনি ব্যাধিতে শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই সময় প্রতিদিন সন্ধ্যার পর তাঁর কাছ থেকে মুখে-মুখে শুনে, আমি চতুর্থ পর্বের কথা লিপিবদ্ধ করে নিতুম ও পরে তাঁকে প’ড়ে শোনাতুম। এই পর্বের প্রথমদিকের কিছু অংশ তিনি স্বহস্তেই লিপিবদ্ধ করেছিলেন। কিন্তু পরে আর তাঁর কলম ধরবার মতো জোর আঙুলে ছিল না বলে মুখে-মুখেই তিনি ব’লে যেতেন। এই সময়ে তাঁর শারীরিক বৈকল্য এমন ছিল যে, তাঁর সমস্ত চিঠিপত্রও আমাকেই লিখে দিতে হত–তিনি কোনোমতে কখনো নিজে সই করতেন, কখনো-বা আমাকেই নামটা বসিয়ে দিতে বলতেন। ‘মহাস্থবির জাতক’ প্রথম পর্ব যখন লেখা হচ্ছিল তখন একদিন কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, পঁচিশ বছর বয়স পর্যন্ত সময়ের কথাই তিনি লিপিবদ্ধ করবেন। কিন্তু কিছুদিন পরেই তিনি সে-ইচ্ছা পরিত্যাগ করেন। এমনকি এই পর্বের শেষের দিকের ‘সুভগার কাহিনী’-টিও তাঁর লেখবার ইচ্ছা ছিল না, আমার আগ্রহাতিশয্যেই এই কাহিনিটি তিনি লিপিবদ্ধ করেন। তৃতীয় পর্বের মতন এই পর্বেরও প্রেস-কপি আমি তৈরি করে দিয়েছি। এই পর্বটি তিনি আমাকে উৎসর্গ করবেন–বলেছিলেন, এবং লিখেও রেখে গেছেন। তাঁর হাতের লেখার একটি প্রতিলিপি ব্লক্ উৎসর্গ-পত্রে মুদ্রিত হল। প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর আশ্চর্যসুন্দর ‘মহাস্থবির জাতক’ সম্পূর্ণ-রূপে রসিক পাঠকসমাজের সম্মুখে ধরে দেবার দুর্লভ সৌভাগ্যলাভ করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে কৃতার্থ বলে মনে করছি।
উমা দেবী
.
অন্ধকার!
সম্মুখে অন্তহীন অন্ধকার সমুদ্র, মাথার ওপরে অনন্ত অন্ধকার আকাশ। আমার অন্তরেও অন্ধকার, নিবিড় অন্ধকার।
সমুদ্রে বড় ঢেউ নেই, ছোট ছোট ঢেউ এসে তটভূমিতে লাগছে; কিন্তু ঢেউ ছোট হলেও তার বুকজোড়া হাহাকার চলেছে অখণ্ড নিরবচ্ছিন্ন–স্তব্ধ গম্ভীর আকাশ লক্ষ কোটি চক্ষু মেলে অনিমেষে চেয়ে আছে নীচের দিকে। আমার পেছনে বিশাল নগরীর সহস্র রকমের শব্দ–একত্রে মিশে একটা অদ্ভুত ধ্বনি আকাশের দিকে উঠছে গমগম করে। সমুদ্রের হাহাকারের সঙ্গে সে আওয়াজ মিশে ওঙ্কারধ্বনিতে পরিণত হচ্ছে। সমুদ্রের কালো জলের মধ্যে চকচক করে ভেসে বেড়াচ্ছে বিন্দু-বিন্দু আলোর স্ফুলিঙ্গ, দিগন্তব্যাপী নিবিড় নিরাশার অন্ধকারে যেন ক্ষণস্থায়ী আশার ক্ষীণ জ্যোতি। সমুদ্র যেন আমারই মনের মুকুর, আমার মন যেন মূর্ত হয়ে উঠেছে এখানে।
আমার একটু দূরেই বন্ধু পরিতোষ ও কালীচরণ বসে আছে।
পাঠক-পাঠিকা হয়তো ইতিমধ্যে বলতে আরম্ভ করেছেন, বাপু হে! অত ভণিতা করবার আর প্রয়োজন নেই। বুঝতে পারা গেছে তুমি আবার ভেগেছ! কিন্তু জিজ্ঞাসা করি বাপু, তোমার কি লজ্জা নেই! এত দুঃখকষ্ট পেয়ে আবার ভাগলে?
— আজ্ঞে হ্যাঁ, আপনারা ঠিকই অনুমান করেছেন।
কিন্তু বৃহৎ বিচিত্রলোকের মধ্যে যে কিছুদিন কাটিয়েছে, সেখানকার দুঃখ-শোক হাসি-অশ্রু, অনির্দিষ্ট জীবনযাত্রার উত্তেজনার ঢেউ খাওয়ায় যার একবার মৌতাত ধরে গিয়েছে তার পক্ষে সুখে ঘরে বসে, নির্দিষ্ট সময়ে চারবার আহার করে কিংবা গাড়ি-ঘোড়া চড়ে প্রাসাদে বাস করে রাজভোগও অতি তুচ্ছ। তার ওপরে, অতীতকালে আমার মতন অনেক ভাগ্যান্বেষী জীবনে সফলকাম হয়েছেন তারও নজির রয়েছে। এই নজিরগুলিই সর্বনাশা–সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় প্যাঁচ এইখানে। ঘোড়দৌড়ের মাঠে গিয়ে সব লোকই যদি সর্বস্বান্ত হয়ে বাড়ি ফিরত তা হলে ঘোড়দৌড়ের মাঠ পরদিন থেকে শ্মশানভূমিতে পরিণত হত। কিন্তু ওরই মধ্যে ওই যে দু’ চারজন কিছু অর্থ নিয়ে বাড়ি ফেরে, তারই প্রেরণায় আজও সেখানে ঘোড়া ছুটছে, সঙ্গে সঙ্গে মানুষও ছুটছে। এই প্যাঁচের জোরেই সারা পৃথিবী চলেছে। দার্শনিকেরা এরই একটা ভদ্র নামকরণ করেছেন ‘লীলা’। আজ্ঞে, এই প্যাঁচ অথবা লীলার পাল্লায় পড়ে আবার আমায় ভাগতে হল।
স্বদেশীর সময় নানারকম দেশি জিনিস আবিষ্কৃত হয়েছিল। দেশাত্মবোধের ঠেলায় পড়ে সে-সময় দু’একজনকে দেশলাই-এর বদলে চকমকি পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেখেছি। এইরকম সব স্বদেশী দ্রব্যের দোকানে-দোকানে পাড়া একেবারে ভরে গিয়েছিল। এরই মধ্যে এক দোকানে চাকরি করত কালীচরণ।
দোকানে বিক্রি-বাটা কিছুই ছিল না বললেই হয়। খরচের মধ্যে ছিল কালীচরণের মাইনে, রাত্রি ন’টা অবধি গ্যাসের আলো আর দৈনিক দু’আনা করে ফৌজদারি বালাখানার তামাক বসার মূলধন ছিল যৌথ, মালিকেরা ছিলেন দেশপ্রাণ। তাঁরা ভেবে রেখেছিলেন প্রথম তিন-চার বছর লোকসান হবার পর ব্যবসা জোর চলবে। কাজেই ওই সামান্য খরচকে তাঁরা গ্রাহ্য করতেন না।
এই কালীচরণের দোকানে ছিল আমাদের আড্ডা। আড্ডার প্রধান আকর্ষণ ছিল তাম্রকূট-সেবন।
কালীচরণের চেহারাটিকে তিলোত্তমার উল্টোপিঠ বলা যেতে পারত। কারণ বিধাতা তিল তিল করে কুৎসিত সংগ্রহ করে কালীর. দেহটিকে তৈরি করেছিলেন। সেই বয়সেই কপালের দুই কোণ ঘেঁষে টাক পড়তে শুরু করেছিল। চোখ-দুটো গর্তে ঢোকা, থ্যাবড়া নাক, দাঁত এমন করে বার করা যে ছোট ছেলেপিলে দেখলে আঁতকে উঠত। তার ঊর্ধ্বমুখী অধরে ছিল একজোড়া অদ্ভুত গোঁফ। সাধারণত মানুষের গোঁফ নীচের দিকে ঝোলে; কিন্তু কালীর গোঁফ ছিল সিধে–যেন সামনের দিকে ছুটে চলেছে। সেই অদ্ভুত গোঁফের ওপর কালীর অসাধারণ মমতা ছিল। আমরা বলতুম-কেলো, গোঁফটা কামিয়ে ফেল।
কালী শিউরে উঠে বলত–ওরে বারে! বলিস কি!
গোঁফ-জোড়ার প্রতি এমন মমতার কারণস্বরূপ সে বলত–এই রকম গোঁফেই মেয়েমানুষ fallen হয়।
কালীর দোকানের সংলগ্ন রাস্তার দিকে একটা চওড়া বারান্দা ছিল। বিকেলবেলা এই বারান্দা ঝাঁট দিয়ে, জল ছিটিয়ে কালী রাস্তার দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকত–হাজার ডাকাডাকি করলেও সে ভেতরে আসতে চাইত না। একদিন শোনা গেল কালীবাবু রোজ বিকেলে ওখানে দাঁড়িয়ে গোঁফের জালে মেয়েমানুষ আটকাবার চেষ্টা করেন। বলা বাহুল্য যে সে-যুগে বৃদ্ধা ও অতিবৃদ্ধা চাকরানি ছাড়া কলকাতার পথে অন্য বয়সের মেয়ে প্রায় দেখাই যেত না।
কালীর আর একটি গুণ ছিল যার জন্যে আমাদের দলের সকলেই তাকে খাতির করত। সে তামাক টেনে কলকে ফাটিয়ে দিতে পারত। নতুন কলকে হলে তো কথাই নেই–বাজি রেখে সে পুরোনো কলকেও ফাটিয়ে দিয়েছে এমন দৃশ্য একাধিকবার আমরা দেখেছি। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা সেই কুৎসিত আবরণের মধ্যে এমন একটি সুন্দর অন্তঃকরণ দিয়েছিলেন যার জোড়া জীবনে অতি অল্পই দেখেছি। সরল, মহাপ্রাণ, উদার, পরদুঃখকাতর কালীকে এইসব গুণের জন্য আমরা সকলেই ভালোবাসতুম।
কালীচরণ এর পরে কলকাতার এক সওদাগরি আপিসে ভালো চাকরি করত। চাকরিতে বেশ উন্নতি করলেও সাংসারিক জ্ঞান তার একেবারে ছিল না বললেই চলে। বছর দশেক চাকরি করার পর বিয়ে করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে সে চলে গেল শ্বশুরবাড়ির গ্রামে। তাও একরকম ছিল ভালো; কিন্তু হঠাৎ তার বড়লোক হবার ইচ্ছা এমন প্রবল হল যে নিজেদের পৈতৃক এজমালি বাড়ি বিক্রি করে নিজের অংশে দশ-পনেরো হাজার যা পেলে তাই দিয়ে চাষবাস করতে শুরু করে দিলে। ব্যস্–আর কি! যেটুকু বাকি ছিল তাও হয়ে গেল। যে-যুগে চাষারা লাঙল ছেড়ে কলম ধরছে সেই যুগে আমাদের কালীবাবু কলম ছেড়ে লাঙল ধরলেন। অবশ্যম্ভাবী ফল ফলতে দেরি হল না। বাড়িবেচা টাকা শরতের মেঘের মতন কিঞ্চিৎ হাঁকডাক করে হাওয়ায় উড়ে গেল। বছর তিন-চারেকের মধ্যে তিন-চারটি ছেলেমেয়ে নিয়ে একদম পথে এসে দাঁড়াল।
মাঝে আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। তেরশ’ পঞ্চাশ সালের দুর্ভিক্ষের সময় গ্রীষ্মকালে একদিন পথে দেখা। বললে–দুর্দশার আর সীমা নেই। এখানকার এক প্রেসে টাইপিস্টের কাজ করি, মাইনে ত্রিশ টাকা। সকালবেলা যেদিন জোটে ফেনা-ভাত খেয়ে গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরে হেঁটে গিয়ে ট্রেন ধরি। ট্রেন এসে থামে হাওড়ায় বাঁধাঘাট না কোথায়–যেখান থেকে আপিস পাঁচ মাইল হবে–নিত্য এই দশ মাইল হাঁটা। চালের দাম ত্রিশ টাকা মণ, কোনোদিন অন্ন জোটে, কোনোদিন জোটে না।
আর একদিন, বোধহয় সেদিন শনিবার, পথে কালীর সঙ্গে দেখা, সর্বাঙ্গ দিয়ে কালঘাম ছুটছে, একেবারে নুয়ে পড়েছে। কালীকে বললুম–তোকে পয়সা দিচ্ছি, ট্রামে করে যা।
কালী বললে–ট্রামে যাবার দরকার নেই, তোর কাছে কয়েকটা টাকা যদি থাকে তো দে, চাল কিনব।
পকেটে যা ছিল বের করে তার হাতে দিলাম। সেগুলো পকেটে পুরে কিছুক্ষণ এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার মুখের দিকে চেয়ে রইল। জিজ্ঞাসা করলুম–কি রে, কি দেখছিস?
কোনো কথা না বলে সে আবার মন্থর গতিতে পা টেনে টেনে তার গন্তব্যস্থানের দিকে অগ্রসর হল। এরপর আর তার সঙ্গে দেখা হয়নি। আমার পয়সায় কেনা চাল বোধহয় সে হজম করতে পারলে না।
এই কালীকে আমরা ‘বাবা কালী’ বলে ডাকতুম।
.
সে-সময় স্বদেশী আন্দোলনের উত্তেজনায় কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়েছে। নীতিশিক্ষা দেবার জন্য যেসব ইস্কুল, কলেজ, ইউনিভারসিটি প্রভৃতি হয়েছিল সেগুলি উঠে গিয়েছে। ছাত্ররা সব মাকু হাতে করে কলকাতা এবং বাংলাদেশময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওরই মধ্যে যাদের ঘরে কিছু পয়সা ছিল তারা তাঁতের কারবার করে তা ফুকে দিয়ে অন্যত্র চাকরির চেষ্টা করছে। নেতাদের মধ্যে যাঁরা ছেলেদের তাঁতের কাজ শেখাবার জন্যে উৎসাহী ছিলেন তাঁরা নিজেদের ভ্রম বুঝতে পেরে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়েছেন।
ওদিকে বোম্বাই প্রদেশে একটার পর একটা কাপড়ের কল বেড়েই চলল।
আমার বন্ধু পরিতোষ তখন তাঁত-বিদ্যালয় থেকে ডবল-অনার্স নিয়ে বেরিয়ে কোথাও কিছু সুবিধে করতে না পেরে সারাদিন কালীর দোকানে তামাক পোড়াচ্ছিলেন। এইখানে আমরা দু’জনে বসে নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে আলোচনা করতুম। শিগগিরই যে আবার ভাগ্য-অন্বেষণে বেরুতে হবে তা ঠিকই হয়ে গিয়েছিল, বাকি ছিল কিঞ্চিৎ পাথেয়-সংগ্রহের। আমাদের আলোচনা ও পরামর্শ খুব গোপনে চললেও কালী কিরকম করে টের পেয়ে গেল। কালীকে বললুম –খবরদার, এ-কথা যদি কেউ জানতে পারে তো এই থেলো হুঁকো তোমার মাথায় ভাঙব।
কালী প্রতিশ্রুতি দিলে যে অন্তত আমরা যাবার আগে পর্যন্ত এ-কথা সে গোপনে রাখবে। তখন থেকে কালীর সামনেই আমাদের পরামর্শ ও আলোচনা চলতে লাগল। সে-সময় কালীর গ্রহচক্র নিশ্চয় খুবই খারাপ ছিল। একদিন সে বললে–ভাই আমাকেও এবার তোদের দলে নে।
–তথাস্তু! শুভ দিনক্ষণ দেখে একদিন তিন বন্ধু মিলে আবার দুর্ভাগ্যের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া গেল–এবারকার লক্ষ্যস্থল বোম্বাই শহর।
তাঁতের ইস্কুল শুধু যে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদেরই গোল্লায় যাবার পথ পরিষ্কার করেছিল তা নয়, বাংলার বাইরের অনেক প্রদেশের অনেক বাঙালি ছেলেও এইসব তাঁত-ইস্কুলে কাজ শিখতে এসেছিল। এদের মধ্যে এলাহাবাদের দু’টি ছেলের সঙ্গে আমাদের পরিতোষের খুব ভাব হয়েছিল এবং তাদের সঙ্গে ওর পত্র-বিনিময়ও চলত। ঠিক ছিল বোম্বাই যাবার মুখে এদের ওখানে আমরা দিনকতক কাটিয়ে যাব।
যথাসময়ে এলাহাবাদে বন্ধুদের ওখানে গিয়ে তো ওঠা গেল। তারা খুবই খাতির-যত্ন করলে। বন্ধুদের বাড়ি ছিল সেখানকার এক বিখ্যাত বাঙালিপাড়ায়। সারা দুপুর ঘুমিয়ে বিকেলে ফুটবল খেলতে যাওয়া গেল। সন্ধেবেলা অনেকে মিলে বেশ জমাট আড্ডা দেওয়া গেল। গান-টান ও বাদ গেল না। সকলের অনুরোধে স্থির করা গেল যে আমরা সেখানে অন্তত সপ্তাহখানেক থেকে যাব।
বোধহয় দিন-তিনেক কাটাবার পর একদিন রাত্রে বন্ধুদের বাড়িতে বসে তাস খেলা হচ্ছে এমন সময় জন-দুয়েক ভদ্রলোক এসে আমাদের বন্ধু অর্থাৎ আমরা যার বাড়িতে অতিথি ছিলুম তাকে ডেকে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে কি-সব বলতে লাগল। দেখলুম তারা কথা বলতে বলতে মাঝে মাঝে আমাদের দিকে তাকাতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদে বন্ধুবর এগিয়ে এসে আমাকে বললে–একবার এঁদের সঙ্গে যাও তো!
জিজ্ঞাসা করলুম–কোথায়?
-এই একটু এঁদের বাড়ি।
– কেন?
এরই মধ্যে একজন প্রিয়দর্শন যুবক এগিয়ে এসে আমাকে বললেন–এই একটু আমাদের বাড়ি–বেশি দূরে নয়, এই এখানেই।
ব্যাপারটা বিশেষ সুবিধের নয় বুঝতে পেরে আমি ইতস্তত করছি দেখে ভদ্রলোকটি আমায় আশ্বাস দিয়ে বললেন–তোমার কোনো ভয় নেই।
ইতিমধ্যে যে বন্ধুর বাড়ি আমরা অতিথি হয়েছিলুম সে আমাকে আলাদা ডেকে নিয়ে বললে–যাও না, ভয় কি! কিছু হলে আমরা তো রয়েছি।
এদিকে পরিতোষ ও কালী দু’জনেই বললে–যা না, ভয় কিসের! আমরা তো আর খুন করে আসিনি।
খুব শঙ্কিত মনে ভদ্রলোকের সঙ্গে চললুম। কি জানি কোথায় লোকটি নিয়ে যাবে, কার সামনে নিয়ে গিয়ে ফেলবে–চলতে চলতে মনের মধ্যে খালি এই চিন্তা খোঁচা দিতে লাগল।
এলাহাবাদে পুরোনো বাঙালিপাড়া–প্রায় কলকাতারই একটা পাড়ার মতন। এ-গলি ও-গলি দিয়ে শেষকালে আমরা একটা বাড়ির মধ্যে ঢুকলুম। বাড়ির দরজায় দুটি-তিনটি ছোট ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়েছিল–তারা যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আমরা দরজা পেরিয়ে বাড়ির মধ্যে ঢোকামাত্র তারাও নিজেদের মধ্যে গুজগাজ করতে করতে আমাদের পেছু পেছু আসতে লাগল। আমরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে একটা ঢাকা বারান্দা পেরিয়ে বেশ বড় একটা ছাতে এসে পৌঁছলুম। ভদ্রলোক এখানে এসে দাঁড়িয়েই বড় গলায় বললেন–কৈ রে, এখানে একটা বসবার জায়গা-টায়গা দিনি?
বলামাত্র দু’টি ছোট ছেলে একখানা শতরঞ্চি নিয়ে এসে পেতে দিয়ে চলে গেল। সঙ্গের ভদ্রলোকটি বললেন–বোসো ভায়া।
আমি বসতেই ভদ্রলোকটি বললেন–তুমি বোসো, আমি এখুনি আসছি।
বসে পড়লুম। একটু পরেই একজন বালিকা একটি হ্যারিকেন-লণ্ঠন এনে আমার সামনে রেখে চলে গেল।
ভাবতে লাগলুম–ব্যাপারটা যে ক্রমেই রহস্যময় হয়ে উঠছে। ভাবছি আর চারদিক দেখছি এমন সময় সমবেত নারী-কণ্ঠের গুঞ্জন কানে আসতে সামনের দিকে চেয়ে দেখি যে ছাতের একদিকে প্রায় হাত-কুড়ি-পঁচিশ দূরে অনেকগুলি নারী দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের মধ্যে বৃদ্ধা প্রৌঢ়া আধেড়া তরুণী বালিকা–সব বয়সেরই মেয়ে রয়েছে। সেই স্বপ্নালোকেই নজরে পড়ল প্রায় পঁচিশ জোড়া চোখের দৃষ্টি আমার প্রতি নিবদ্ধ রয়েছে। এই চোখগুলির মধ্যে একজোড়া চোখের দৃষ্টি আজও আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে সঞ্চিত রয়েছে।
তার মুখখানা আমার অস্পষ্ট মনে পড়ছে। সুন্দর বিষাদক্লিষ্ট অবসন্ন মুখ। মাথার চুলগুলো রুক্ষু, কয়েকগাছা চুল চোখ-মুখের ওপরে এসে পড়েছে। উদ্বেগাকুল সজল চোখে সে আমার দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে। আমি অবাক হয়ে সেই চোখ-দুটির দিকে চেয়ে আছি, সেও আমাকে দেখছে। এমন সময়ে এক বর্ষীয়সীর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম–যাও না বউমা এগিয়ে গিয়ে দেখ।
এই নির্দেশ পেয়ে মেয়েটি ধীর পদক্ষেপে একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়াল। মেয়েটির বয়স বাইশ-তেইশের বেশি হবে না। কয়েক সেকেন্ড তার মুখের দিকে চেয়ে আমি মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলুম। সঙ্গে সঙ্গে চিকারার তারের সুরের মতন একটি করুণ কণ্ঠস্বর কানে এল-পল্টু-পল্টু ভাই–
আবার তার মুখের দিকে চাইতেই সে ছোট্ট একটি ‘না’ বলে ফিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে সেই নারীদলের মধ্যে মিলিয়ে গেল।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ছাত হয়ে গেল ফাঁকা।
যে ভদ্রলোক আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়েছিলেন একটু পরেই তিনি এসে বললেন–চল ভায়া, মিছিমিছি তোমাকে কষ্ট দেওয়া হল।
কথায়বার্তায় বুঝতে পারা গেল, যে-তরুণীটি ওইরকম আগ্রহ-ভরা দৃষ্টি নিয়ে আমাকে দেখতে এসেছিলেন তিনি এঁরই পত্নী। শুনলুম তাঁর স্ত্রীর বাপের বাড়ি কলকাতার কোনো এক পল্লীতে। তাঁর স্ত্রীর যখন বছর ছয়েক বয়েস সেই সময় একবছরের ভাইকে রেখে তাঁদের মা মারা গিয়েছিলেন। স্ত্রীর মৃত্যুতে ওঁদের পিতা অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়লেন। বাচ্চা মানুষ করা, চাকরি করা, সংসার দেখা–একা সব দিক সামলানো অসম্ভব বিবেচনা করে অবিলম্বে তিনি নতুন সঙ্গিনী সংগ্রহ করে আনলেন। কিন্তু তাতে উল্টো ফল হল। বিমাতা এসেই তাদের ভাই-বোনকে দেখ্-তাড়া দেখ-মার শুরু করলেন। সেই বয়স থেকে মেয়েটি তার ভাইকে মানুষ করেছে। ষোলো বছর বয়সে তার বিবাহ হয়, তখন ভাইটির বয়স বছর দশ। এই দশ বছর সে ভাইটিকে বিমাতার দুর্ব্যবহার, পিতার অন্যায় শাসন ও বৈমাত্রেয় ভাই-বোনদের নানা উৎপীড়ন থেকে রক্ষা করে এসেছে। বিয়ের পর সে এলাহাবাদে শ্বশুর-ঘর করতে এলো বটে, কিন্তু মনটি পড়ে রইল সেই অসহায় ভাইটির কাছে। মাঝে মাঝে ভাইয়ের কাছ থেকে চিঠি আসত। তার সেই অসহায় অল্পবুদ্ধি ভাইয়ের ওপরে অযথা নির্যাতন চলেছে–তাকে রক্ষা করবার, তার দুঃখে সহানুভূতি জানাবার আর কেউ নেই। কতবার মেয়েটি তার ভাইটিকে চলে আসবার জন্যে লিখেছে–টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তার বাবা আসতে দেননি। টাকা ফেরৎ পাঠিয়ে দিয়েছেন। নিজের কোনো সন্তানাদি হয়নি; তাই নিজের হাতে মানুষ করা ভাইয়ের প্রতি মমত্বেরও হ্রাস হয়নি, বরঞ্চ বিচ্ছেদ ও অদর্শনে দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ভাইটি দিদির কাছে না আসতে পারলেও নিয়মিত চিঠিপত্র লিখত এবং দিনে দিনে বিমাতার নিষ্ঠুরতা ও পিতার শাসন যে বেড়েই চলেছে সে-কথাও জানাত। কিছুদিন থেকে ভাইয়ের চিঠিপত্র বন্ধ হওয়াতে মেয়েটি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে যে, মাস-দুয়েক হল সে বাড়ি থেকে পালিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে। পিতা ও বিমাতার নিষ্ঠুর কবল থেকে আত্মরক্ষা করবার আশায় তার অবোধ ভাই নিষ্ঠুরতর সংসারের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
আমাদের খোঁজ পেয়ে আর আমি নাকি কতকটা তার ভাইয়ের মতন দেখতে–এ-কথা জানতে পেরে আমাকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।
এইসব কথা বলতে বলতে ভদ্রলোক আমাকে ডেরায় ফিরিয়ে নিয়ে এলেন সেখানে অনেকেই আমার জন্য আগ্রহভরে অপেক্ষা করছিলেন। আমুরা ফিরে আসতে আবার ওই আলোচনা শুরু হল। সেই ভদ্রলোকটি বললেন যে, আজ দু’মাস যাবৎ তাঁর স্ত্রী দিনরাত কান্নাকাটি করছেন–খাওয়া-দাওয়া বন্ধ। অশান্তির চোটে তাঁকেও পালাই পালাই ডাক ছাড়তে হয়েছে। ভদ্রলোক গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলেন যে, আর কিছুদিনের মধ্যে তাঁর শ্যালকপ্রবর যদি এখানে এসে উপস্থিত না হয় তা হলে তাঁকেও বাড়ি ছেড়ে পালাতে হবে।
কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে ভদ্রলোক চলে গেলেন। তারপর একে একে আড্ডার সকলে চলে যাবার পর আমি কালী ও পরিতোষকে বললুম–বন্ধু, এখানে থাকা আর সমীচীন বলে বোধ হচ্ছে না। এলাহাবাদে আরও অনেক বাঙালি বাস করেন, তাঁদের মধ্যে নিশ্চয় আমাদের চেনা লোক বেরিয়ে পড়বে। আজকে একটা ফাঁড়াগেল। এখান থেকে অবিলম্বে সরে পড়াই শ্রেয়।
পরিতোষ ও কালীচরণ দু’জনেই আমার কথায় সায় দিলে। রাতে আহারাদির পরে আমরা যার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলুম তাকে বললুম–ভায়া, আমরা কালই এখান থেকে সরে পড়ব মনে করছি।
সরে পড়বার কারণ শুনে সে বললে–আরে, আজ রাতে তো ঘুমোও–কালকের কথা সে কাল হবে’খন।
যাই হোক, তখনকার মতো তো শুয়ে পড়া গেল। কিন্তু সকাল হতে-না-হতে নতুন বন্ধুর দল আমাদের ঘুম থেকে টেনে তুলে বললে–এত শিগগির তোমাদের যাওয়া কিছুতেই হতে পারে না। আগামী শনিবার তারা একটা ফুটবল-ম্যাচের আয়োজন করছে–রাজ্যসুদ্ধ লোক জেনে গেছে যে তোমরা খেলবে আর এখন যাব বললেই হল!
যাক্–তখনকার মতো তাদের কথা দিলুম থাকব বলে। কিন্তু তারা চলে যেতেই আমরা যার বাড়িতে অতিথি হয়েছিলুম তাকে খুলে বললুম যে, এলাহাবাদে আমাদের অনেক জানাশোনা লোক আছে। ফুটবল ম্যাচ দেখতে মাঠে অনেক লোক জড়ো হবে এবং তার ফলে ধরা পড়বার সম্ভাবনা প্রবল। অতএব এখান থেকে সরে পড়াই মঙ্গল।
আমাদের কথা শুনে সে বললে–ঠিক কথা, তোমরা আজ দুপুরেই সরে পড়, কারণ এরা যদি টের পায় তা হলে তোমাদের যাওয়া হবে না।
সে আরও বললে যে, বোম্বাইয়ে তাদের এক বন্ধু থাকে, সেখানে সে গয়না-তৈরির কারবার করে। তারা বড়লোক, ব্যবসাও তাদের খুব বড়। সে আবার বললে-আমি চিঠি দিচ্ছি, তোমরা সেখানে গিয়ে উঠলে তোমাদের একটা হিল্লে সে নিশ্চয় লাগিয়ে দিতে পারবে।
.
সেইদিনই দুপুরের আহারাদির পর আমাদের ছোট্ট পোঁটলা বেঁধে নিয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হলুম। সন্ধে নাগাদ আগ্রায় গিয়ে পৌঁছনো গেল। পরিতোষ কিংবা কালীচরণ আগ্রার তাজমহল দেখেনি তাই সেখানে যাওয়া। রাত্রিটা হোটেলে কাটিয়ে সারাদিন ধরে তাজ, সেকেন্দ্রাবাদ প্রভৃতি দেখে পরের দিন বিকেল নাগাদ বোম্বাই-যাত্রী একখানা প্যাসেঞ্জার গাড়িতে সওয়ার হওয়া গেল। আমাদের পুরনো বন্ধু সত্যদার সঙ্গে একবার দেখা করবার ইচ্ছে ছিল কিন্তু তা হয়ে উঠল না।
এবারকার এই বোম্বাই-যাত্রার স্মৃতি আমার মনে এখনও জ্বলজ্বল করছে। তার কারণ এই যাত্রা আর একটু হলেই মহাযাত্রায় পরিণত হত।
আগ্রা স্টেশনে শুনলুম যে দ্রুতগামী গাড়িতে চড়তে সাধারণত যে ভাড়া লাগে তার চেয়ে অনেক বেশি লাগবে। তিনজনের হিসাব করে দেখা গেল যে বেশ কিছু বেশি টাকা খরচ হয়ে যাবে। পরামর্শ করে ঠিক হল যে বেশি পয়সা খরচ করে তাড়াতাড়ি বোম্বাই গিয়ে পৌঁছবার এমন তাড়াই বা কি আছে! তার চেয়ে প্যাসেঞ্জার গাড়িতে অনেক দেশ মানে দেশের স্টেশন দেখতে দেখতে বেশ জিরুতে জিরুতে যাওয়া যাবে।
তখন গ্রীষ্মকাল। প্যাসেঞ্জার গাড়ি ঢিকিয়ে ঢিকিয়ে সমস্ত ভারতবর্ষটা মাড়িয়ে হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে এগোতে লাগল। বদ্ধ রেলের ডিবেয় বসে আছি–মাথার ওপর প্রচণ্ড সূর্য, পায়ের তলায় তাপদগ্ধা ধরণী–তার ওপরে ট্রেন চললেই দু’পাশ থেকে ধুলো উড়ে এসে দম বন্ধ করে দেয়। তৃষ্ণায় প্রাণ যায় কিন্তু জল কোথায়! যে স্টেশনে জলের ব্যবস্থা আছে সেখানে আকণ্ঠ জল পান করে নিই; কিন্তু জল খেয়েও যে তৃষ্ণা নিবারণ হয় না তার অভিজ্ঞতা জীবনে এই প্রথম হল। গাড়ি চলতে চলতে হয়তো মাঠের মাঝেই দাঁড়িয়ে গেল। ঘণ্টাখানেক কেটে যাবার পর আবার মন্থর গতিতে এগিয়ে চলল। ছোট ছোট স্টেশনে খাবারও পাওয়া যায় না কিংবা যা পাওয়া যায় তা অখাদ্য। হয়তো রাতদুপুরে কোনো বড় স্টেশনে পৌঁছল। তখন সে অবস্থায় যা মিলল তাই গিলে পানি পাঁড়ের দেখা পাওয়া গেল না। এমনি করে কত রাত কত দিন যে কাটল তা মনে নেই। শেষকালে একদিন রাত্রি এগারোটার সময় গাড়িখানা ধীরে ধীরে ভিক্টোরিয়া-টার্মিনাস স্টেশনের একটা ধারের প্ল্যাটফরমে প্রবেশ করল–ধনীর প্রাসাদে দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় যেমন সঙ্কোচে আত্মগোপন করে প্রবেশ করে।
প্রকাণ্ড স্টেশন কিন্তু তখন খাঁ-খাঁ করছে। আমাদের ট্রেনখানার দিকে কোনো কুলিও এগিয়ে এল না। আমরা গাড়ি থেকে নেমে প্ল্যাটফরমের বাইরে এলুম।
ট্রেনে বসেই ঠিক করে রেখেছিলুম যে এত রাত্রে আর সেই ভদ্রলোকদের ওখানে উঠে তাঁদের আর বিরক্ত করব না। রাত্রিটা স্টেশনেই কাটিয়ে দেব। কিন্তু প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে স্টেশনের মধ্যেই আতিপাতি করে খুঁজে কোথাও একখানা বেঞ্চিও দেখতে পেলুম না। শেষকালে উপায়ান্তর না দেখে, এক কোণে পরিষ্কার মেঝেতে শুয়ে পড়া গেল। ভাবলুম–প্রাসাদে শুয়েছি বটে, কিন্তু আমাদের বরাতে মেঝের চেয়ে উচ্চস্থান জুটল না।
ক’দিন ধরে সেই দুঃসহ ট্রেন-যাত্রার ফলে শরীর অবসন্ন হয়ে ছিল, তাই শোয়ামাত্রই চোখ বন্ধ হয়ে গেল। বোধহয় আধ-ঘণ্টাটাক কেটেছিল এমন সময় হাঁকডাকের চোটে ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে দেখি সম্মুখে পুলিশের উর্দিপরা একটি লোক দাঁড়িয়ে আমাদের ডাকছে।
–কী ব্যাপার!
লোকটি জিজ্ঞাসা করলে–তোমাদের বাড়ি কোথায়?
-কলকাতায়।
–কলকাতায় বাড়ি তো এখানে কেন?
–এখানে এসেছি বলে।
–এখানে স্টেশনে এরকমভাবে থাকবার হুকুম নেই। এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও–নইলে থানায় নিয়ে যাওয়া হবে।
আর বেশি কিছু বলতে হল না। থানার নাম শোনামাত্র উঠে পড়া গেল। আমাদের বিছানা অর্থাৎ ধুতি গুটিয়ে নিয়ে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে পড়া গেল।
স্টেশনে পা দিতে-না-দিতে এইরকম দুর্ব্যবহারের সম্মুখীন হওয়ায় মেজাজটা সত্যিই বিগড়ে গেল; কিন্তু স্টেশনের বাইরে এসে চক্ষু একেবারে জুড়িয়ে গেল। দেখলুম ঝকঝকে পরিষ্কার চার-পাঁচটা চওড়া রাস্তা এসে সেখানে মিশেছে। আর্ক-লাইটের স্নিগ্ধ আলোয় চারদিকের বড় বড় বাড়ি ও রাস্তাগুলো যেন ঝিমিয়ে পড়েছে।
পথ জনশূন্য কিন্তু একেবারে নিঃশব্দ নয়। সামনেই মিউনিসিপ্যালিটির বাড়ির সম্মুখেই ফেরোজ শা মেটার উদ্ধত ভঙ্গিমার বিরাট প্রতিকৃতি–সমস্ত মিলিয়ে বেশ ভালোই লাগতে লাগল। এর তুলনায় আমাদের কলকাতা শহরের হাওড়া স্টেশনের সেই গাড়ির ভিড় ও গাড়োয়ানের চিৎকার, তার ওপরে বড়বাজারের কাদা-প্যাঁচপেচে রাস্তা দিয়ে শহরে ঢোকা — অতি জঘন্য মনে হতে লাগল। সেই রাত্রি দ্বিপ্রহরের লগ্নে সুন্দরী বোম্বাই নগরীর সঙ্গে আমার শুভদৃষ্টির বিনিময় হয়েছিল। কলকাতা আমার মাতা আর রূপসি বোম্বাই আমার প্রেয়সী।
যাই হোক, স্টেশনের কাছাকাছি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ঘুরে পরামর্শ করতে লাগলুম এখন কি করা যায়, কোথায় রাত্রির মতো একটু আশ্রয় পাওয়া যায়। পথ-চলতি একজন লোককে জিজ্ঞাসা করলুম–ধর্মশালা কোন দিকে?
লোকটি আমাদের কথা বুঝতে না পেরে অদ্ভুত এক ভাষায় কি বললে। তারপরে দুই চক্ষের অদ্ভুত ভাষায় কিছুক্ষণ কথাবার্তা চলল, কিন্তু কেউ কারুর কথা বুঝতে পারলে না। শেষকালে স্থির করা গেল রাস্তাতেই এক জায়গায় শুয়ে রাত্রিটা কাটিয়ে দেওয়া যাক। জীবনে অনেকরকম অভিজ্ঞতাই তো হল–এটুকু আর বাকি থাকে কেন?
পরিতোষ ও কালী আমার প্রস্তাবে বিশেষ আপত্তি করল না। এই কয়দিনের ট্রেন-যাত্রায় তাদেরও প্রায় গঙ্গাযাত্রীর অবস্থা হয়েছিল। তাই বেশি কথা কাটাকাটি না করে ওরই মধ্যে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে আমার ভবিষ্যৎ কর্মভূমির পথপ্রান্তে ক্লান্ত দেহ বিছিয়ে দিলুম। দূরাগত অস্পষ্ট রেলের বাঁশি কানে এসে বাজতে লাগল। মনে হতে লাগল যেন কোন্ সুদূর ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে এই বেদনা-মধুর সুর ভেসে আসছে বর্তমানের বুকে–সে কি আমারই অন্তরের ধ্বনি?
স্বপ্নলোকের অতীতে গভীর নিদ্রায় অভিভূত হয়ে আছি এমন সময় একটা ধাক্কা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। দেখলুম কালী ও পরিতোষ দু’জনেই উঠে বসেছে। সামনে একটা লোক দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত নীল পোশাক তার অঙ্গে, মাথায় নীল ও হলদে রঙের শামলার মতো বাঁধা পাগড়ি। কোমরে রুল ঝুলছে দেখে বুঝতে আর বাকি রইল না যে তিনি কে!
লোকটা ইকড়ে-মিকড়ে করে কি বলতে লাগল কিছুই বুঝতে পারলাম না। তবে এটুকু বেশ বোঝা গেল যে রাস্তায় শুয়ে থাকার জন্য সে ঘোর আপত্তি প্রকাশ করছে এবং বলছে যে অবিলম্বে স্থান ত্যাগ না করলে বাধ্য হয়ে তাকে আমাদের জন্য রাস্তা থেকে ভালো আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
আমরা তাকে বন্ধুভাবে জিজ্ঞাসা করলুম–এত রাতে আমরা যাই কোথায়?
সে বললে–কেন? ধর্মশালায় যাও। ধর্মশালায় রাতটা কাটিয়ে কাল সকালে কোনো টেলে
চলে যেও–শহরে হাজার হাজার ভালো হোটেল আছে।
আমাদের সঙ্গে পুলিশ-কনস্টেবলের যখন এইরকম কথাবার্তা চলছে, ঠিক সেই সময়ে রাস্তা দিয়ে ঠুকঠুক করে একখানা ভাড়াটে ফিটন যাচ্ছিল। কনস্টেবল গাড়োয়ানকে ডেকে তার সেই অদ্ভুত ভাষায় বললে-এদের কোনো ধর্মশালায় পৌঁছে দাও।
পয়সার অভাবে না খেয়ে রাস্তায় পড়েছিলুম, এখন ঠেলায় পড়ে ফার্স্ট-ক্লাস ফিটনে চড়ে ধর্মশালায় চললুম। মানুষের জীবন এইরকম বৈষম্যে ভরা, এর মধ্যে তাল রাখতে না পারলেই ভরাডুবি। রাজকুলের সঙ্গে সম্পর্ক হলে হঠাৎ এই রকমই পদোন্নতি হয়ে থাকে।
অনেক বড় বড় রাস্তা ও গলি-ঘুঁচি পেরিয়ে আমাদের গাড়ি একটা মন্দিরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। এইটেই ধৰ্মশালা।
গাড়ি থেকে নেমে ধর্মশালার ভেতরে ঢুকলুম। একদিকে মন্দির ও তারই সংলগ্ন ধর্মশালা। সেখানে এখনও লোকজন যাতায়াত করছে, চারিদিক আলোয় আলো। প্রকাণ্ড একটা ঘর, তার একদিকটা খোলা। সেটাকে ঘরও বলা চলে, ঢাকা বারান্দা কিংবা দরদালানও বলা চলে। লোক সব পাশাপাশি বিছানা করেছে, যার বিছানা নেই সে শুধু জায়গাটুকু দখল করে আছে। এর মধ্যে সন্ন্যাসী, উদাসী, গৃহস্থ, ভবঘুরে, পাগল, রোগী, চক্ষুষ্মান্, অন্ধ, বিকলাঙ্গ–কেউ-বা গাঁজা খাচ্ছে, কেউ বিড়ি টানছে, কেউ শুয়ে, কেউ বসে, কেউ-বা ঘুমে অচেতন। এরই মধ্যে আমাদের একটু জায়গা মেলে কি না–ঘুরে ঘুরে তাই দেখতে লাগলুম। কিন্তু দেখলুম সেখানে আমাদের তিনজনের স্থান হওয়া সম্ভব নয়। তবুও বার বার ঘুরে ঘুরে দেখছি, এমন সময় অতি ক্ষীণ অথচ সুস্পষ্ট বাংলাভাষায় শুনতে পেলুম–আপনারা কি জিজ্ঞাসা করছেন?
এই বিচিত্র মানুষের ভিড়ের মধ্যে আমার মাতৃভাষা শুনে সত্যিই চমক লাগল। চারপাশে খুঁজে শেষকালে দেখতে পেলুম আমাদের পায়ের কাছেই একটি লোক কম্বলের ওপরে পদ্মাসনে বসে আছেন। লোকটির দেহ বেশ সুপুষ্ট, ‘মাথায় লম্বা চুল কিন্তু জটা নেই, মুখে দাড়িগোঁফ, চোখ-দুটো মাটির দিকে নিবদ্ধ, চেহারার মধ্যে বেশ একটি বিশিষ্টতার ছাপ আছে–পরনে কিন্তু সাদা থান, অঙ্গ অনাবৃত। কি জানি কেন, মনে হল এই ব্যক্তিই ওই অদ্ভুত প্রশ্নকর্তা।
আমরা বসে পড়ে তাঁকে বাংলাভাষায় জিজ্ঞাসা করলুম–আপনি কি কিছু বললেন? তিনি সেইরকম ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট সুরে মুখ না তুলেই বললেন- আপনারা কি জিজ্ঞাসা করছেন?
বললুম-আমরা রাতটুকু কাটাবার জন্যে জায়গা খুঁজছি। তা এখানে তো দেখছি একটুও জায়গা নেই।
লোকটি সেইরকম মাথা নীচু করে মাটির দিকে চেয়ে বললেন–ওই কোণের সোপান দিয়ে দ্বিতলে চলে যান- সেখানে জায়গা পেতে পারেন।
সত্যিই ঘরের এক কোণে সিঁড়ি রয়েছে দেখে আমরা ওপরে উঠে গেলুম। সেখানেও একতলারই মতন একটা বড় ঘরে পাশাপাশি লোক শুয়ে রয়েছে। একধারে একটা লোক ঝাড়ু লাগাচ্ছিল তাকে জিজ্ঞাসা করলুম–খালি ঘর-টর আছে?
সে কোনো কথা না বলে পাশেই একখানি খালি ঘর দেখিয়ে দিলে। আমরাও আর বিনা বাক্যব্যয়ে ঢুকে পড়লুম সেই ঘরে।
ঘরখানি বেশ বড় বটে, কিন্তু তার অবস্থা অতি শোচনীয়। একদিকে একটা বড় জানলা, তার দুটো পাল্লাই ভাঙা। আরও দুটো বড় জানলা রয়েছে কিন্তু সে-দুটোই বন্ধ। ঘরের মেঝেতে পুরু ধুলোর আস্তরণ। যাই হোক, কোঁচা দিয়ে তিনজনে মিলে যতদূর সম্ভব সেই ধুলো ঝেড়ে, ধুতি পেতে, মোমবাতি জ্বেলে শোবার ব্যবস্থা করছি–এমন সময় আমাদের চোখ ঝলসে দিয়ে বিদ্যুদ্বরণ এক নারী সস্মিতমুখে প্রবেশ করলেন। যিনি এলেন তাঁর যৌবন পার হয়ে গেছে অনেকদিন আগেই। দীর্ঘ শীর্ণ দেহ, রঙ দুধে-আলতার অপূর্ব সংমিশ্রণ, আয়ত চক্ষু, দীর্ঘ নাসা। দুই হাতে সোনার চুড়ি-বালা আছে বটে, কিন্তু সে-দেহের রঙের কাছে সোনার রঙ এমন ম্লান হয়ে মিলিয়ে গিয়েছে যে প্রথম দৃষ্টিতে তা চোখেই পড়ে না। গায়ে হাতে গয়না অথচ থান-পরা–আশ্চর্য হয়ে দেখছি। মনে হল সে-রমণী বোম্বাই প্রদেশের নয়, আমার বিশ্বাস তাঁর বাড়ি পাঞ্জাবে। যাই হোক, তাঁর সঙ্গে আরও দু’টি লোক ছিল–তিনি ঘরে ঢুকে আমাদের কাছে এসেই বিশুদ্ধ উর্দুভাষায় বললেন–ও এরা! এরা তো বাংলাদেশের ছেলে।
তারপরে আমার দিকে ফিরে বললেন–কেমন নয় কি?
বললাম,–আপনি ঠিক অনুমান করেছেন, আমাদের বাড়ি বাংলাদেশে।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন-তা বটে, এখানে এসে উপস্থিত হলে কি করে?
এখানে এসে উপস্থিত হবার কাহিনি শুনে তিনি বালিকার মতন খলখল হেসে উঠে বললেন–তোমাদের কোনো ভয় নেই–এখানে কেউ তোমাদের কিছু বলতে পারবে না।
তারপর আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি ইংরেজি পড়তে পার?
–আজ্ঞে, হ্যাঁ। কিছু কিছু পারি।
তিনি ডান হাতখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন–পড়। দেখলুম হাতে একটা সরু বালা, তাতে উঁচু-উঁচু অক্ষরে ইংরেজি ভাষায় কি-সব লেখা রয়েছে। হাতখানা টেনে নিয়ে ভালো করে দেখলুম–লেখা রয়েছে, Janaki Bai, presented by the Commissioner of Police, Bombay.
আমার পড়া শেষ হলেই তিনি আবার সেইরকম খলখল করে হেসে বললেন–দেখলে, এখানকার পুলিশ-কমিনার আমার বন্ধু। আচ্ছা, এখন শোও–রাত্ হয়েছে।
বলে তিনি উঠে গেলেন। যাবার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ জানকীবাই সম্বন্ধে আলোচনা করে মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়বার আয়োজন করছি এমন সময় কালীচরণ আবিষ্কার করলে যে আমাদের ঘরের দরজায় বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে।
–কি সর্বনাশ? বলিস কি রে!
তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে দেখা গেল–সত্যি-সত্যিই বাইরে থেকে দরজায় তালা লাগানো হয়েছে। ঘুমটুম তো মাথায় উঠে গেল। নিশ্চয় আমরা যাতে পালাতে না পারি সেইজন্যই এই ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমরা বলাবলি করতে লাগলুম যে ইস্টিশন ও রাস্তায় পুলিশের হাত থেকে বেঁচে গিয়ে শেষকালে পয়সা খরচ করে গাড়িভাড়া দিয়ে নিজেরাই এসে পুলিশের খপ্পরে পড়লুম? একেই বলে দুর্দৈব!
যাই হোক, আরও কিছুক্ষণ আলোচনার পর–যা হবার তাই হবে মনে করে তখনকার মতন শুয়ে পড়া গেল।
ওরই মধ্যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলুম জানি না–মুখে রোদ লাগায় ধড়মড় করে জেগে উঠে দেখি বেশ বেলা হয়ে গিয়েছে। পুব-মুখো সেই ভাঙা জানলা দিয়ে ঘরের মধ্যে রোদ এসে পড়েছে। দেখলুম পরিতোষ ও কালীচরণ তখনো ভোঁস-ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে। তাড়াতাড়ি দরজার কাছে গিয়ে টেনে দেখলুম, দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে। তৎক্ষণাৎ পরিতোষ ও কালীচরণকে টেনে তুলে শুভ সংবাদটি দেওয়া হল। আর বিলম্ব নয়–ধুতি-টুতি গুছিয়ে নিয়ে, ছাড়াপাওয়া পাখি যেমন খাঁচা থেকে বেরিয়ে পড়ে–তেমনি ঠিকরে বেরিয়ে পড়লুম। রইল জানকীবাই আর তার মন্দির পেছনে পড়ে।
এ-গলি সে-গলি দিয়ে বড় রাস্তায় পড়ে একটা চায়ের দোকানে ঢুকে চা খেয়ে ধাতস্থ হয়ে ছুটলুম আমাদের সেই এলাহাবাদী বন্ধুর বাড়ির উদ্দেশে।
ঘণ্টাখানেক পথে ঘুরে ঘুরে সেই বাড়ি আবিষ্কার করা গেল।
দোতলায় ছোট্ট একখানি ঘর, সেই ঘরে পাশাপাশি বোধ হয় সাত-আটজন কারিগর বসে কাজ করছে। আমরা যাঁর কাছে চিঠি নিয়ে এসেছিলুম তিনি তখন সেখানে ছিলেন না। আমরা সেই ছোট্ট ঘরে কোনোরকমে বসে তাঁর অপেক্ষা করতে লাগলুম। কিছুক্ষণ বাদে সেই ভদ্রলোক এসে আমাদের দেখে একেবারে বসে পড়লেন। বললেন–আপনারা করেছেন কি! আগে থাকতে চিঠিপত্র লিখতে হয়, না-বলা-না-কওয়া–একেবারে দুম করে এসে পড়লেন! ছিঃ ছিঃ–আপনারা বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে এ কী করলেন! এখানে আমাদের নিজেদের থাকবার জায়গা নেই–এ কি কলকাতা! বোম্বাই শহরে একজনের খেতেই লেগে যায় পনেরো টাকা।
আমরা বললুম–আপনারা যদি দয়া করে আমাদের একজনের কিছু লাগিয়ে দেন তা হলে তাই দিয়ে আমরা তিনজনে চালিয়ে নেব। তারপরে অন্য দু’জনে ধীরে-সুস্থে কাজ জুটিয়ে নেব। সেই ছোট্ট ঘরে আরও যে কয়জন কারিগর বসে কাজ করছিলেন, তাঁরা আমাদের এই আলোচনার মধ্যে একটি কথাও বললেন না–ঘাড় গুঁজে সোনার ফুল তুলতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ বকাবকির পর তাঁদেরই মধ্যে একজন ঘাড় তুলে বললেন–তা পরে যা হবার তা হবে এখন এঁরা এতদূর থেকে আসছেন, এঁদের খেতে-টেতে কিছু দিতে হয়।
আমরা যাঁর কাছে চিঠি নিয়ে এসেছিলুম তিনি বললেন–ও হ্যাঁ, সে ব্যবস্থা করছি। এই বলে সেই কারিগরদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত একটি অল্পবয়স্ক যুবককে ডেকে বললেন–দেখ, ওই মোড়ের দোকান থেকে কিছু লুচি, তরকারি ও মিষ্টি নিয়ে এস তো ভাই। আমাদের নাম করে বোলো–বাঙালি লুচি। তা হলে টাটকা ভেজে দেবে।
একজন কারিগর বললেন-কতটা আনবে তা না বলে দিলে কি আনবে!
–ও, হ্যাঁ–বলে তিনি নিজের মনেই বললেন–কতটা আনবে! তা এক কাজ কর–লুচিতে ও মিঠাইয়ে মিলিয়ে এক এক সের করে তিনটে আলাদা আলাদা মোড়ক বাঁধিয়ে নেবে।
লোকটি পয়সা নিয়ে চলে যাওয়ার পর আমরা বলাবলি করতে লাগলুম–আমাদের কি রাক্ষস মনে করেছে নাকি! এক সের করে লুচি-মেঠাই খেতে তো আমাদের মতো পাঁচটা লোকের দরকার হবে।
পরিতোষ বললে–বোধ হয় আমাদের আগমন উপলক্ষে কারিগরদের সবাইকেই খাওয়াবার ব্যবস্থা হল।
কিছুক্ষণ পরে যুবকটি তিনটি ছোট ছোট সুতোয় জড়ানো কাগজের মোড়ক নিয়ে উপস্থিত হল। তিনটি মোড়ক আমাদের তিনজনের হাতে দিয়ে সেই ভদ্রলোক বললেন–নিন, খান। মোড়ক খুলে দেখি–তার মধ্যে খানকতক তেলে ভাজা লুচি, মুলো কিংবা ওই জাতীয় পদার্থ খানকয়েক ভাজা আর গোটা-দুয়েক প্যাড়া-জাতীয় মিষ্টি–সবসুদ্ধ মিলিয়ে বোধ হয় পোয়াটাক মাল হবে।
পরে জানতে পারলুম যে বোম্বাই শহরে আটাশ তোলায় সের। যাই হোক, এদিকে আমরা খেয়ে দেয়ে তো ‘গ্ল্যাড’ হয়ে বসলুম। ওদিকে সেই ভদ্রলোকের লেচার চলতে লাগল। আমাদের আগমনে তিনি অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছেন দেখে আমরা তাঁকে বললুম-আপনি আমাদের জন্য অত ব্যস্ত হবেন না। আপনারা বাঙালি, সেইজন্য আমরা আপনাদের আশ্রয়ে এসেছিলুম–যদি গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য কিছু সুবিধা করে দিতে পারেন। আপনাদের অসুবিধা করে আমরা একদণ্ডও এখানে থাকব না। আপাতত অনেক দূর থেকে আমরা আসছি একটু বিশ্রাম করতে দিন–একটু পরে আমরা নিজেরাই চলে যাব–বলেন তো এখুনি উঠে পড়ি।
আমাদের কথায় দেখলুম ভদ্রলোক অনেক নরম হয়ে পড়লেন। তিনি বলতে লাগলেন না না, সে-কথা হচ্ছে না। দেখি, আপনাদের জন্য কি ব্যবস্থা করতে পারি—-ইত্যাদি। ভদ্রলোকেরা নিজেদের মধ্যে আমাদের সম্বন্ধে সশব্দে জল্পনা করতে লাগলেন–ইতিমধ্যে বেলা বাড়তে লাগল। কারিগরেরা একে একে উঠে স্নান করতে খেতে গেলেন, কেউ-বা তখনো বসে কাজ করতে লাগলেন।
এমন সময় সেখানে এক সন্ন্যাসী এসে উপস্থিত হলেন। সন্ন্যাসী বলছি এই জন্য যে তাঁর অঙ্গে গেরুয়া বসন দেখলুম এবং তা ছাড়া দু’ একজন তাঁকে সন্ন্যাসী বলে সম্বোধনও করলে।
সন্ন্যাসীর বয়স সাতাশ-আটাশের বেশি হবে না, রঙ ফরসা, মাথাতে বেশি উঁচু নয়। বেশ পুষ্ট চেহারা কিন্তু মোটা বা মেদবহুল নয়। সন্ন্যাসীর চক্ষু-দুটি অসাধারণ দীপ্তিমান, দেখলেই মনে হয় বোধ হয় তিনি কোনো অলৌকিক শক্তির অধিকারী। সন্ন্যাসী আসতেই কেউ কেউ উঠে এসে তাঁকে প্রণাম করলে। কেউ কাজ করতে করতে মুখেই বললে–ব্রহ্মানন্দজী, প্রণাম। আমরা যে ভদ্রলোকের কাছে চিঠি নিয়ে এসেছিলুম তিনি সন্ন্যাসীর কাছে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমার নাম শুনে জিজ্ঞাসা করলেন-তোমরা ব্রাহ্মণ?
ভাগ্যে আগ্রা স্টেশনে পৈতে কিনে গলায় দিয়েছিলুম। বললুম– আজ্ঞে হ্যাঁ। কিছুক্ষণ বাদে আমাদের সেই ভদ্রলোক ব্রহ্মানন্দজীকে একটু আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন। অনেকক্ষণ ধরে কি-সব বলে ফিরে এসে ব্রহ্মানন্দজী আমায় ডেকে বললেন–চল আমার সঙ্গে।
রাস্তায় নেমে সন্ন্যাসীর সঙ্গে চললুম।
.
অজানা শহর, অজানা লোকের সঙ্গে চলেছি; কোথায় চলেছি তাও জানা নেই। বন্ধুদের ছেড়ে এভাবে অন্য কোথাও যেতে মন আমার চাইছিল না। দু’একবার সন্ন্যাসীকে এ-সম্বন্ধে প্রশ্ন ও করলুম কিন্তু তিনি কোনো উত্তর না দিয়ে গভীর চিন্তান্বিতভাবে এগিয়ে চলতে লাগলেন–এ-গলি ও-গলি দিয়ে।
মিনিট পনেরো হাঁটবার পর সন্ন্যাসী আমাকে নিয়ে ঢুকলেন একটা মাঠকোঠার মতন বাড়িতে। নড়বড়ে সিঁড়ি বেয়ে আমরা দোতলার একখানা ঘরে গিয়ে পৌঁছলুম। ঘরখানা বেশ বড়, রাস্তার দিকে গোটা-কতক জানলা। সেই জানলার ধারে কয়েকখানা মাদুর পাতা হয়েছে, আর সেই মাদুরে সার-সার কয়েকজন বাঙালি কারিগর বসে গয়না-তৈরির কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। দু’একজন কানে হিরের-টাপ-পরা গুজরাটী ভদ্রলোকও –সম্ভবত খদ্দের –সেখানে বসে রয়েছেন।
আমরা পৌঁছতেই কারিগরেরা কেউ সন্ন্যাসীকে প্রণাম করলে, কেউ-বা বসে বসে মুখেই সম্ভাষণ জানালে। সন্ন্যাসী আমাকে সেখানে বসতে বলে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন–অমুক ব্যক্তি কোথায়?
লোকটি ওপরের দিকে দেখিয়ে দিলে। দেখলুম, ঘরের মধ্যেই কাঠের মাচা বা চাঙ করে দোতলা করা হয়েছে। ঘরে–সেই মাচায় ওঠবার জন্য এক কোণে একটা ছোট্ট সিঁড়ি রয়েছে–সন্ন্যাসী সেই সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
সন্ন্যাসী ওপরে উঠে যেতেই আবার যে-যার নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে মন দিল। দু’একজন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়স্ক কারিগর আমাকে সামান্য দুটো-একটা প্রশ্ন করে আবার কাজে মন দিলে। কিছুক্ষণ বাদে সন্ন্যাসী একজন প্রৌঢ় লোক সঙ্গে করে নেমে এলেন। প্রৌঢ় লোকটি আমাকে দেখে বললেন–ও, এই ছেলেটি। আচ্ছা।
সন্ন্যাসী চলে গেলেন। আমি বসে বসে তাদের কারিগরি দেখতে লাগলুম। মনে হতে লাগল–গয়না তৈরির কাজ শিখলে মন্দ হয় না। সন্ন্যাসী বোধহয় এই কাজ শেখাবার জন্যই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। কথাটা মনে হতেই মনে মনে উৎসাহিত হতে লাগলুম। মনে হতে লাগল যে আমরা তিনজনে কাজ শিখে বেশ ভালে। কারিগর তৈরি হব। পরের চাকরি ছেড়ে দিয়ে পরে বড় ব্যবসা ফাঁদব। এইরকম এঁদো ঘর ছেড়ে রাস্তার ওপরে বড় ঘর ভাড়া করব–কলকাতার পার্ক স্ট্রিটের জুয়েলারদের মতন
ভাবছি–মনে আনন্দ ও উৎসাহের জোয়ার আসছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে–বন্ধুরা কোথায়! তাদের সঙ্গে এই সম্বন্ধে পরামর্শ করতে পারলে ভালো হত।
ক্রমে সেই গুজরাটী খরিদ্দারেরা এক একে বিদায় নিয়ে চলে গেল। কারিগরদের মধ্যেও কয়েকজন উঠে গেল স্নান করতে খেতে। ইতিমধ্যে দু’জন বাঙালি এসে উপস্থিত হলেন। প্রথম সম্ভাষণাদি হয়ে যাবার পর এঁদের মধ্যে এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করলেন –হ্যাঁ হে, আজ এসেছে নাকি?
প্রশ্নটা শুনেই মনে হল–এই রে! বোধ হয় আমাদের কথা বলছে। একজন বললে–কে বললে তোমাকে?
–খবর পেলুম যে।
–যত বাজে খবর পাও কোথা থেকে!
লোকটা কথাবার্তা বলে চলে যাবার পরই আর একটি লোক হন্তদন্ত হয়ে এসে একজনকে বললে–ওহে, খবর পেলুম এসেছে–তা ভাই, আমার আসতে একটু দেরি হবে–তা আমি আটটা নাগাদ এসে পড়ব’খন।
এই বলে দুটো-তিনটে বিড়ি পকেট থেকে বার করে একে তাকে দিয়ে লোকটি যেমন এসেছিল তেমনি ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে চলে গেল।
কী যে এসেছে আর কী একটা কিছু হবে তা এদের প্রশ্নোত্তরে কিছুই বুঝতে পারা গেল না। এদিকে একে একে কারিগরেরা স্নান-খাওয়া সেরে এসে কাজে বসে গেল। কাজ করতে করতে কেউ কারুর সঙ্গে কথা বলে না। ঠুক-ঠুক করে কাজ করে চলেছে। কারুর বা চোখে ঠুলি, কেউ-বা গামলা-উনুনে হাপর চালিয়ে মুচিতে সোনা গলাচ্ছে। কেউ-বা দিনের আলোতেই সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে ছোট্ট হাতুড়ি ও পেরেকের মতন ছোট্ট ছেনি দিয়ে সোনায় ফুল-লতা-পাতা কাটছে। হাতুড়ির ঠুক-ঠুক ও হাপরের ভো-ভো শব্দ ছাড়া আর শব্দ নেই। বাইরের রাস্তায় নানারকম ফেরিওয়ালার চিৎকার ভেসে আসছে–যার একটি বর্ণও বোধগম্য হচ্ছে না। এরই মধ্যে থেকে থেকে এক-একজন বাঙালি আসছে, জিজ্ঞাসা করছে–হ্যাঁ হে, শুনেছি নাকি এসেছে?
কখনও উত্তর হচ্ছে–”হ্যাঁ”, কখনও উত্তর হচ্ছে–”না”। আমি বসে বসে আকাশ-পাতাল ভাবছি। প্রধান ভাবনা পরিতোষ ও কালীচরণ–তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হল!
ক্রমে বেলা পড়ে আসতে লাগল। ক্রমেই সেই স্বপ্নালোকিত প্রায়ান্ধকার ঘরখানির কোণে কোণে এখানে সেখানে অন্ধকার জমাট হয়ে উঠতে লাগল। কারিগরেরা একে একে সকলেই নিজেদের সামনে একটা করে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিলে। বাইরে তখনো আলো–ক্রমে সেইটুকুও নিভে গেল। আমার জীবনের আর একটি দিন অতীতের অন্ধকারে বিলীন হয়ে গেল।
সন্ধ্যা হবার কিছু পরেই ঘরের মধ্যে আর-একজন গেরুয়াধারী লোক এসে উপস্থিত হলেন। এঁর পরনে গেরুয়া রঙের ছোট-গোছের কৌপীন। সন্ন্যাসীর বয়স বেশি নয়–অন্তত তাঁকে দেখে আমার মনে হয়েছিল বাইশ-তেইশ বছরের বেশি নয়। ব্রহ্মানন্দের মতন অমলদীপ্তি চেহারা না হলেও এঁর চেহারা বেশ সুন্দর–সবার উপরে মুখখানিতে সর্বদাই হাসি যেন লেগে রয়েছে।
সন্ন্যাসী ঘরের মধ্যে আসামাত্র সেখানে একটা আনন্দের ঢেউ উঠল। সকলে উঠে তাঁকে সংবর্ধনা করতে আরম্ভ করে দিলে–আসুন, সুন্দরজী–এতদিন আসেননি কেন, আমরা কী অপরাধ করেছি, ইত্যাদি। কেউ তাঁকে প্রণাম করলে, কেউ করলে আলিঙ্গন, কাউকে তিনি জড়িয়ে ধরলেন, কারুকে চুমু খেলেন। সকলে একরকম ধরাধরি করে তাঁকে নিয়ে এসে বসালে একেবারে আমার পাশেই। সন্ন্যাসী বসে চারদিক চেয়ে হো হো করে হেসে আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন–এ মালটিকে তো নতুন দেখছি!
তারপরে আমাকেই জিজ্ঞাসা করলেন–তুমি কবে এলে ভাই?
-আজ সকালে।
–কি নাম তোমার?
নাম বললুম। ওঁদের মধ্যেই একজন বললে–বাড়ি থেকে চম্পট দিয়ে এসেছেন। ব্রহ্মানন্দজী রেখে গেছেন।
সুন্দরজী একটা বড় রকমের ‘বেশ’ বলে অন্যদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে আরম্ভ করে দিলেন। দেখলুম সুন্দরজী অত্যন্ত ছটফটে লোক। কথা বলতে বলতে তিনি কখনও উঠছেন, কখনও পায়চারি করছেন, একবার সেই মাচার ওপরে উঠে গেলেন, একবার বাথরুমের দিকে, আবার এসে বসলেন। এইরকম করতে করতে একবার তিনি বললেন–ওহে, এক কাজ কর তো।
সকলেই তার কাজ করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠল।
–আরে, হুকুম করুন কি করতে হবে?
সুন্দরজী বললেন–এই মোড়ের মেঠাইয়ের দোকানে টাটকা রাবড়ি রয়েছে, সেরখানেক নিয়ে এস তো খাই।
কথাটা শুনেই সকলের আনন্দ একেবারে চুপসে গেল। এ ওকে বলতে লাগল–যা না, নিয়ে আয় না।
ও বলতে লাগল–আমার কাছে পয়সা নেই।
এইরকম যখন চলেছে ঠিক সেই সময় ‘ওঃ’ বলে বিকট আওয়াজ করে সুন্দরজী একেবারে ঘুরে পড়ে গিয়ে মৃগীরুগীর মতন হাত-পা খিঁচতে আরম্ভ করে দিলেন! সকলে চেঁচিয়ে উঠল–কি হল–কি হল–জল জল-
সকলে মিলে তাঁর পরিচর্যা আরম্ভ করে দিলে।
একজন তাঁর মাথাটা কোলের ওপরে তুলে নিলে। মুখে চোখে জলের ছিটে দিতে আরম্ভ করলে। বোধ হয় পাঁচ মিনিট পরে সুন্দরজী চোখ খুলে গ্যাঙাতে গ্যাঙাতে বলতে লাগলেন–আমি বোধ হয় বিষ খেয়েছি–বোধ হয় আমি আর বাঁচব না। পেটে অসহ্য যন্ত্ৰণা হচ্ছে–ওরে বাপ রে-
সুন্দরজী গ্যাঙাতে গ্যাঙাতে বলতে লাগলেন–ঐ অযোধ্যাদার জামার পকেটে একটা কৌটতে কালো-মতন কি ছিল–তাই খেয়েছি, ভয়ানক তেতো লাগল–
–এই সর্বনাশ করেছে রে!
বলেই একজন ছুটে দেয়ালে ঝোলানো একটা জামার পকেটে হাত পুরে একটা টিনের কৌটো বার করে খুলে দেখেই চ্যাঁচাতে আরম্ভ করলে–কি সর্বনাশ! আমার এক হপ্তার আফিং–আজ সকালেই এনেছি—সবটা মেরে দিয়েছে–ও আর বাঁচবে না–
এদিকে সুন্দরজী বলতে লাগলেন–ওঃ, পেটের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে-আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চল–
একজন বললে–আমি যখন প্রথম আফিং খেতে আরম্ভ করি তখন মাত্রা ঠিক রাখতে না পেরে মাঝে মাঝে পেটে ওইরকম ব্যথা করত–দুধ খেলে কমে যেত। একটু দুধ খাইয়ে দাও–যন্ত্রণা কমে যাবে।
সন্ন্যাসী তখনও শুয়ে শুয়ে গ্যাঙাচ্ছেন। একজন নীচু হয়ে জিজ্ঞাসা করলে–দুধ খাবেন? বলামাত্র সুন্দরজী হাঁ করলেন।
কয়েক মুহূর্ত হাঁ করে থাকবার পরও কিছু পড়ল না দেখে তিনি মিনমিন করে বললেন–রাবড়ি–রাবড়ি–
অযোধ্যা ততক্ষণে জামাটা পরে ফেলেছিল। সে বলে উঠল–রাবড়ি–বহুৎ আচ্ছা–আমি এখুনি আনছি।
সন্ন্যাসী নিষ্পন্দ হয়ে পড়ে রইলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই রাবড়ি এসে গেল। একজন চামচে করে সেই চিত হয়ে শোয়া অবস্থাতেই তাঁর মুখে ভাঁড় থেকে রাবড়ি তুলে দিতে লাগল। ভাঁড়টি শেষ হয়ে যাবার পর সেইরকম চিত হয়ে শুয়েই সুন্দরজী এক ঘটি জল ঢঢক্ করে মেরে নিঝুম হয়ে পড়ে রইলেন। সবাই জিজ্ঞাসা করতে লাগল-এখন একটু ভালো লাগছে? কোনো কথা না বলে একবার সম্মতিসূচক ঘাড় নেড়ে তিনি সেইরকম পড়ে রইলেন। ওদিকে তখন সবাই অযোধ্যাকে নিয়ে পড়ল–কেন তুমি পকেটে ওইরকমভাবে আফিম রেখে দাও। অযোধ্যা বলতে লাগল–এই বাবা কান মালছি–আর কখনও রাখব না। এরকম যে হবে তা কে জানত?
এইরকম সব কথাবার্তা চলছে এমন সময় সুন্দরজী আড়মোড়া দিয়ে উঠে পড়লেন। তাঁকে উঠে বসতে দেখে সবাই বলতে লাগল, কেমন আছেন? এখন কিরকম লাগছে–ইত্যাদি।
সকলের প্রশ্নের উত্তরে সুন্দরজী খানিকটা ছেলেমানুষের মতন হেসে বললেন –দূর, ওটুকু আফিঙে আমার কি হবে! তোমাদের রাবড়ি খাওয়াতে বললুম–তা খাওয়ালে না–কেমন কায়দা করে রাবড়ি খেয়ে নিলুম।
একটা হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল।
সন্ন্যাসী বললেন–এবার যাই ভাই। আর একদিন আসব।
সবাই বলতে লাগল–এরি মধ্যে যাবেন কি! একটা গান শুনিয়ে যান।
-গান হবে। আচ্ছা, একটা গান গাই।
সন্ন্যাসী গান ধরলেন। অতি পরিচিত রবীন্দ্রনাথের গান–”দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি।” যেমন মিষ্টি তাঁর ব্যবহার তেমনি মধুময় তাঁর কণ্ঠস্বর। বিস্মৃতির অতল থেকে সেদিন সন্ধ্যাবেলার সেই চিত্রখানি স্মৃতির আলোকে ফুটে উঠছে। অপরিচিত শহরে, স্যাকরাদের সেই স্বপ্নালোকিত ঘরখানিতে কয়েকজন অপরিচিত লোকের মধ্যে বসে আছি। অদ্ভুত রহস্যময় সেই সন্ন্যাসী আমার অতি পরিচিত গান গাইছেন। রবীন্দ্রনাথের সুরের মধ্যে মাঝে মাঝে তিনি নিজের সুরও মিশিয়ে দিচ্ছেন, তবুও কী ভালোই লাগছে সে-গান। ডাহা প্রেমের সঙ্গীত দ্রব্যগুণের সংস্পর্শে এসে যে আধ্যাত্মিক আরাধনায় এমন রূপান্তরিত হতে পারে সেদিন তার প্রমাণ পেয়েছিলুম।
সন্ন্যাসী একবার দু’বার তিনবার ফিরে ফিরে গানটা গাইলেন। গান শেষ হয়ে যাবার পর সবাই চুপচাপ; কারো মুখে কোনো কথা নেই। শেষকালে সন্ন্যাসী বললেন–আজ তবে যাই, ভাই।
একজন বললে–একটু বসুন না, আজ আমাদের জলচর এসেছে–খেয়ে যাবেন।
সুন্দরজী ছোট ছেলের মতন তড়াক করে উঠে পড়ে বললেন–ওরে বাবাঃ, আমি স্থলচর জীব। জলচর খেয়ে শেষকালে হাবুডুবু খেয়ে মরি আর কি!
বলেই ‘হা হা” করে হাসতে হাসতে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলেন।
এঁর সঙ্গে জীবনে আর আমার দেখা হয়নি।