প্রেমাঙ্কুর আতর্থী – শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়
কত রকমের কত চরিত্র না আছে এ পৃথিবীতে!
ঘরে যার মন বসে না, বাঁধন-ছেঁড়া নৌকার মতো মন যার শুধু ভেসে ভেসে চলে যেতে চায় দিকচিহ্নহীন অসীম সমুদ্রের দিকে–তেমনি মনের কথাই আজ ভাবছি বসে বসে।
এ যেন চিরবিদ্রোহী। যেখানে বন্ধন, সেইখানেই তার বিদ্রোহ।
ছেলেবেলায় তাকে কেউ বলত–বাউন্ডুলে। কেউ বলত-আড্ডাবাজ।
তা বাউন্ডুলে কি না ঠিক জানি না। তবে আড্ডাবাজ যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই যে আড্ডায় বসততা সেখানে আর কাউকে মুখ খুলতে হতো না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো হাঁ করে তার মুখের পানে তাকিয়ে থাকতো সবাই। যে কোনো গুরুতর বিষয়কে হালকা হাসি আর আনন্দের খাতে বইয়ে দেবার সে এক অনন্যসাধারণ পারদর্শিতা!
অপরিচয়ের গণ্ডি অতিক্রম করে সেইখান থেকেই বেরিয়ে এলো একটি নিরাসক্ত শিল্পীমন। কথার জাদুকর–স্থান করে নিল সে তার সমকালীন শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পীদের আসরে।
অজানাকে জানবার অচেনাকে চেনবার নিদারুণ ব্যাকুলতা তাকে ঘরছাড়া করেছে বারম্বার। ঘর তাকে বেঁধে রাখতে পারেনি। ভারতবর্ষের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত পরিক্রমা করেছে সহায়-সম্বলহীন একটি বাঙালির ছেলে। নিতান্ত অপরিচিত পরিবেশে, চারদিকে অচেনা মানুষের মিছিল, ভিন্ন বেশ, ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন রুচি, ভিন্ন আচার।
সেই অনাত্মীয়ের ভেতর খুঁজেছে সে তার পরমাত্মীয়কে। খুঁজেছে সে তার মনের মানুষকে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত চলেছিল তার এই অনন্ত অন্বেষণ।
সেই তারই কথা ভাবছি আমি।
ভাবছি এই জন্য যে সে-মানুষটি আর ইহজগতে নেই। বাইরের জগতে কোথাও আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই আমার মনের মণিকোঠায় হাতড়ে বেড়াচ্ছি।
হাতড়ে বেড়াচ্ছি আমার অতীত দিনের স্মৃতির খাতায়। সেখানে যারা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে এই মানুষটিও তাদের মধ্যে একজন।
‘মহাস্থবির জাতকে’র স্রষ্টা শিল্পী প্রেমাঙ্কুর আতর্থী।
চুল পেকেছিল, দাঁত ভেঙেছিল, স্থবির হয়েছিল সে দেহ, কিন্তু মনে ছিল তার চিরতারুণ্য।
‘ভারতী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যাঁরা-প্রেমাঙ্কুর তাঁদেরই মধ্যে একজন। শরৎচন্দ্র, মণিলাল, হেমেন্দ্রকুমার, সৌরীন্দ্রমোহন, প্রেমাঙ্কুর। আরও অনেকেই ছিলেন। ছিলেন মোহিতলাল, ছিলেন নরেন্দ্র দেব, ছিলেন সুধীর সরকার, ছিলেন চারু রায়।
তখনকার দিনের খ্যাতিমান সব বড় বড় সাহিত্যিকরা একসঙ্গে বসে বসে গল্প-গুজব করেন। সেই তাঁদেরই মধ্যে দেখেছি প্রেমাঙ্কুর আতর্থীকে। দূর থেকে দেখেছি লুকিয়ে লুকিয়ে। কাছে যেতে ভরসা হয়নি। একে আমার চেয়ে বয়সে বড়। তার ওপর সাহিত্যজগতে ওঁরা এসেছেন আমাদের অনেক আগে। সব সময়ই মনে হতো ওঁরা আমাদের অগ্রজ–বড় ভাই-এর মতো। সাধ জাগতো পরিচিত হবার। কিন্তু সাধ্য ছিল না এগিয়ে যাবার।
কখনও দেখতাম কান্তিক প্রেসে। কখনও দেখতাম গজেনবাবুর আড্ডায়। কান্তিক প্রেস ছিল সুকিয়া স্ট্রিটে (এখন কৈলাস বোস স্ট্রিট)। আমি থাকতাম তারই কাছাকাছি একটা বাড়িতে। আর গজেনবাবুর আড্ডা ছিল বিবেকানন্দ রোডের মোড়ে। কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের উপর। বিবেকানন্দ রোড তখন তৈরি হয়নি। ওখানে ছিল প্রকাণ্ড খোলার বস্তি। এমনকি রাস্তার ধারের দোকানগুলো পর্যন্ত–খাপরার চাল আর বাঁশের খুঁটি।
তেমনি একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে হেমেন্দ্রকুমার আর প্রেমাঙ্কুর কি যেন কিনছিলেন। হেমেন্দ্রকুমারের পরনে গরদের ধুতি, জামাটাও গরদের। আর প্রেমাঙ্কুরের গায়ে সাধাসিধে ধুতি পাঞ্জাবি।
ভাবলাম কাছাকাছি গিয়ে দিই একটা নমস্কার ঠুকে। কিন্তু ভাবতে ভাবতেই দেরি হয়ে গেল। হেমেন্দ্রকুমার ততক্ষণে চলে গেছেন হেদোর দিকে। প্রেমাঙ্কুর কিন্তু এগিয়ে আসছেন।
কাছাকাছি আসতেই বলে ফেললাম, ‘নমস্কার!’
থমকে দাঁড়িয়েছেন প্রেমাঙ্কুর।
‘আপনাকে তো চিনতে পারলাম না।’
বললাম, ‘আপনি বলবেন না। তুমি বলুন।‘
‘তা না হয় বলছি, কিন্তু কি দরকার আমার সঙ্গে?’
বললাম, ‘আপনার লেখা পড়ে ভালো লেগেছে। তাই একটি নমস্কার জানালাম।’
পথ চলতে চলতেই কথা হচ্ছিল। প্রেমাঙ্কুর বললেন, ‘তোমারও লেখার বাতিক-টাতিক আছে নাকি?’
তখন কীই-বা লিখি আমি! চেপে গেলাম কথাটা।
প্রেমাঙ্কুর বলেছিলেন, ‘ও ভূতটাকে ঘাড়ে চাপিয়ো না। একবার চড়ে বসলে আর নামতে চাইবে না।’
বললাম, ‘আপনি ভারতবর্ষের অনেক জায়গা ঘুরেছেন না?”
বললেন, ‘তোমারও ঘোরবার ইচ্ছে আছে নাকি?’
‘আছে। কিন্তু হাতে পয়সা না থাকলে ঘোরা যায় না।’
‘পয়সা থাকলে তো সবাই ঘুরতে পারে। পকেটে একটি পয়সা থাকবে না, খেতে পাবে না, বিপদে পড়বে–তবে তো মজা।’
সেদিন আর কি কথা হয়েছিল মনে নেই। শুধু মনে আছে–তিনি বলেছিলেন, ‘বিপদে না পড়লে মজা নেই।’
সত্যিই, বিপদে না পড়লে নিজেকে চেনা যায় না।
পরবর্তীকালে প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে পরিচয় যখন ঘনিষ্ঠ হলো, বয়সের ব্যবধান-আপনি তুমি দূরত্ব–সবই যখন ঘুচে গেল তখন অনেক গল্প শুনেছি তার কাছ থেকে। জীবনের বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতার কাহিনি। অতি বড় দুঃখের কথাও রসিয়ে রসিয়ে আনন্দের প্রলেপ দিয়ে বলবার একটি নিজস্ব ভঙ্গী ছিল তার। তেমনি আর কোথাও শুনিনি। সময় যে কোনদিক দিয়ে কেমন করে কেটে গেছে বুঝতে পারিনি। তার মতো মনোরম সঙ্গী পাওয়া দুর্লভ সৌভাগ্যের কথা।
আমি তাকে কতটুকুই বা দেখেছি! ক’টা দিনই বা কেটেছে তার সঙ্গে! তবু যতটুকু দেখেছি–মুগ্ধ না হয়ে পারিনি। সেরকম অপূর্বসুন্দর একটি নিরাসক্ত মনের সাক্ষাৎ পেয়ে ধন্য হয়েছি।
অন্যের লেখার প্রশংসা করেছে সে। কিন্তু নিজের লেখা সম্বন্ধে কথা উঠলে থামিয়ে দিয়েছে। বলেছে, ‘থামো থামো। বেশি প্রশংসা শুনলে মাথাটা খারাপ হয়ে যাবে। তার চেয়ে অন্য কথা বল।’
একদিন বলেছিলাম, ‘আরও লেখো না কেন তুমি?”
প্রেমাঙ্কুর বলেছিল, ‘লেখার সময় কোথায় পেলাম! জীবনে একটা-না-একটা বিপদ লেগেই রইলো।’
‘সে বিপদ তো তুমি ডেকে এনেছ।’
বলেছিল, “হ্যাঁ তা এনেছি। এই খেলাই তো খেলোম রে ভাই সারাটা জীবনভর। একটা করে বিপদ ডেকে এনেছি আর ভগবানকে বলেছি–নে এইবার আমাকে উদ্ধার কর।’
‘উদ্ধার তো করেছে।’
‘হ্যাঁ তা করেছে। একবার উদ্ধার করতে না করতেই আবার বিপদ ডেকে এনেছি। এমনি করতে করতেই ভগবান বোধ হয় হয়রান হয়ে গেল। নইলে তার ইচ্ছে ছিল আমাকে একটা মিনিস্টার-ফিনিস্টার করে দেবার কিন্তু সে আর সময়ই পেলে না। শেষে রাগ করে বললে বোধ হয় দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। দিলে ব্লাড প্রেসার। বললে থাক এইবার চুপ করে শুয়ে থাক আর ঢক্ ঢক্ করে জল খা।’
এমনি করে সে কথা বলতো। সবাইকে হাসাতো কিন্তু নিজে হাসততা না।
আজ সেই মানুষটি নিজে হাসতে হাসতে আমাদের কাঁদিয়ে দিয়ে গেল।
[ সাপ্তাহিক দেশ : ৩১ বর্ষ, ৫১ সংখ্যা। ১৯৬৪ ]