প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পরিশিষ্ট : ‘মহাস্থবির’ প্রেমাঙ্কুর আতর্থী প্রসঙ্গ

পরিমল গোস্বামীর তিনটি প্রবন্ধ

পরিমল গোস্বামীর তিনটি প্রবন্ধ 

বুড়োদা প্রেমাঙ্কুর 

সূর্যের একটি পরিবার আছে, তা গ্রহ-উপগ্রহ নিয়ে গঠিত। সব মিলিয়ে সৌরজগৎ। গ্রহদের তেমনি আবার পরিবার আছে–সে-পরিবার চাঁদদের নিয়ে। সবার চাঁদ নেই। বুধ শুক্র প্লুটো নিঃসঙ্গ। অন্যান্য গ্রহপরিবারে একটা থেকে বারোটা পর্যন্ত চাঁদ আছে। পৃথিবীর আছে একটি। 

এইসব গ্রহ কি জনপ্রিয়তার মাপে বন্ধুলাভ করেছে? মানুষের সঙ্গে তুলনা করলে, তাই মনে হবে। কোনো কোনো মানুষ সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ। সে সঙ্গী আকর্ষণ করতে জানে না। আবার এমন মানুষ দেখা যায় যার আকর্ষণ দুর্নিবার। তার সঙ্গ সবার কাম্য। 

প্রেমাঙ্কুর আতর্থী ছিলেন এইরকম সঙ্গী-আকর্ষণকারী চরিত্র। তাঁর যে-কোনো বিষয়ের বর্ণনা শোনবার মতন ছিল। বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা তাঁর। পিতৃশাসনের আতিশয্যে ঘর-ছাড়া বালক স্কুলের ঘরটা শুধু পার হতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষায় অভিজ্ঞতায় এবং অকপট সরলতায় তাঁর এমন একটি মধুর ব্যক্তিত্ব গড়ে উঠেছিল তা পরম উপভোগ্য ছিল সবার। মেজাজ ছিল পুরোপুরি বৈঠকী; এ মেজাজ-গঠন রস থেকে। আধুনিক যুগের নিম্নজাতের রস নয়। আগের যুগের ব্রাহ্মরুচির মিশ্রণ ছিল এর সঙ্গে, আর তার সঙ্গে ছিল একজাতীয় চিত্তাকর্ষক আভিজাত্য। তাঁর মানসকেন্দ্রে ছিল শিল্পরসের উৎস–মধুর, কোমল, লোভনীয়। বাইরের রূপও কম আকর্ষক ছিল না। অন্তরের আভা ফুটে উঠত তাঁর সমস্ত চোখে মুখে 

তিনি ছিলেন সবার বুড়োদা। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম পরিচয় হয় গাস্টিন প্লেসে, রেডিওর বাড়িতে। সে হবে ১৯৩৪ বা ১৯৩৫, ঠিক মনে পড়ে না। সেখানে তাঁর আড্ডা জমানোর ক্ষমতায় তাঁর প্রতি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হই। 

তাঁর সঙ্গে পরিচয় হওয়ার অনেক আগে যখন তাঁর নাম প্রথম শুনি, তখন ওটাকে ছদ্মনাম মনে হয়েছিল। সে-সময় আজকের দিনের মতো এমন অশ্রুতপূর্ব, অদ্ভুত এবং অনেক ক্ষেত্রে উদ্ভট সব নাম প্রচলিত ছিল না বললেই হয়। তাই এই ভ্ৰান্তি। 

পরিচয়ের পরে একটি মজার ঘটনা ঘটেছিল। এ-সময়ে বাংলাদেশে প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর নাম শিক্ষিত মহলে অপরিচিত ছিল না। এই সময়ে দু’জন বন্ধুর সঙ্গে আমার বাইরের এক শহরে কয়েকদিনের জন্য যাবার কথা হয়। আমার অপরিচিত স্থান সেটি, এবং আমিও যে সম্পূর্ণ অপরিচিত সে-কথায় আমার সন্দেহের কোনো কারণ ছিল না। 

এক বন্ধু সেখানে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন আমিও যাচ্ছি তাদের সঙ্গে। কিন্তু আমার নাম পড়তে তাঁরা ভুল করলেন। চিঠির উত্তরে তাঁরা জানালেন সঙ্গে প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আসবেন শুনে আমরা সবাই খুশি হয়েছি, আমরা সবাই তাঁর অপেক্ষায় রইলুম। 

বলা বাহুল্য, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী আর সেখানে গেলেন না। বন্ধুরাই গেলেন। এই প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে আমার পরিচয় ক্রমে ঘনিষ্ঠ হল। কিন্তু এ দাবি তাঁর সংস্পর্শে একদিনও যিনি এসেছেন তিনিই করতে পারেন। আমার অতিরিক্ত দাবি শুধু প্রতিবেশীরূপে। আসলে তিনি ছিলেন সবার। রেডিও-বাড়ির ফরাসে যখন আড্ডা জমত তখন তার মধ্যে সবাই থাকত। অভিনয়-শিল্পী, সঙ্গীত-শিল্পী, সবাই ভিড় করত। লেখকদেরও অনেকের আড্ডা ছিল সেখানে। সবার সমান আসন তাঁর পাশে, ছোট-বড় নির্বিশেষে। তাঁর কথা সবাই সমানভাবে উপভোগ করত। যে-কোনো কথাকে জীবন্ত করে তোলার ক্ষমতা অনেকের মধ্যে দেখেছি কিন্তু তাঁর ভঙ্গির মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল যার ঠিক ব্যাখ্যা হয় না। সম্ভবত প্রাণখোলা সরলতা এবং নিজের বিষয়ে কোনো কিছু গোপন না করার একক ক্ষমতায় ছিলেন তিনি স্বতন্ত্র। সেইজন্যই ভঙ্গিপ্রধান বা ভঙ্গিসর্বস্বতায় অভ্যস্ত শ্রোতার কাছে তাঁর আবেদন ছিল পৃথক। আর ঠিক এই কারণেই তাঁর জীবনকে পাঠক গল্প মনে করেছে এবং গল্পকে জীবনী। 

এর কারণ, তিনি নিজের অভিজ্ঞতার বাইরের বিষয় এবং আত্মজীবনীমূলক ঘটনা ভিন্ন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে কম লিখতেন। ভালোমানুষ ছিলেন। পরোপকারী ছিলেন। দয়ার্দ্রহৃদয় ছিলেন। পিতা জীবিত থাকতে নিরাশ্রয়কে শীতকালের রাত্রে গোপনে নিজের ঘরে এনে শুইয়ে রেখেছেন। অনেককে টাকা দিয়ে সাহায্য করেছেন। প্রকাশকের কাছ থেকে বহু পাওনা টাকা জোর করে আদায় করতে পারেননি। যখন অসুস্থ অবস্থায় টাকার প্রয়োজন তখন পাওনা টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ঘরের বাইরে যেতে পারেননি শেষ কয়েক বছর। মহাস্থবির ঠিক এই সময়ে যথার্থ মহাস্থবির হয়েছিলেন। একদিন সকালে (১৪ ফাল্গুন ১৩৬১) রাজশেখরের জ্যেষ্ঠ শশীশেখর বসুর মৃত্যু-সংবাদ পৌঁছাল আমার কাছে। আমি তৎক্ষণাৎ তাঁকে জানিয়ে দিলাম। তিনি লিখলেন যেতে পারবেন কি না সন্দেহ। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমরা দু’জনে গেলাম। শশীশেখরের বাড়ির দূরত্ব তিন-চার মিনিটের। শশীশেখরের নিজের জীবনকথা অতি সুন্দরভাবে লিখে আমাকে ছাপতে দিয়েছিলেন, অনুরোধ ছিল তাঁর নামে যেন প্রকাশ না হয়। প্রেমাঙ্কুরের নামে ছাপা হল সেটি, বিপদ থেকে তিনি উদ্ধার করলেন আমাকে। 

গত বছর যখন হেমেন্দ্রকুমার রায়ের মৃত্যুসংবাদ পৌঁছল আমার কাছে, আমি আবার তাঁকে এ খবর টেলিফোন-যোগে জানিয়ে দিলাম। এবার তিনি নিরুপায়। টেলিফোনে দীর্ঘনিশ্বাসের শব্দ শোনা গেল। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “গেল হেমেন?–আমারও সময় হল এবারে।” কিন্তু শয্যালগ্ন এই ক্ষীণদেহ লোকটি ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত যুবকোচিত স্ফূর্তিযুক্ত ছিলেন। শিশিরকুমার ভাদুড়ী ও তিনি যখন একত্রে এসে জুটতেন আমার ঘরে তখন ওঁদের কাছে আমাকে বুড়ো মনে হত। প্রেমাঙ্কুর গল্প আরম্ভ করলে শুধু আমার ঘরখানা ছোট হয়ে যেত। উঠে দাঁড়িয়ে সমস্ত-অঙ্গ-চালনা সহ গল্পের রূপ ফোঁটাতেন। 

দেহ কখনও ন্যুব্জ হয়নি, তা আমরণ ঋজু ছিল। এত বেশি বয়সে এমন দেহ সারল্য বড় একটা দেখা যায় না। এই সরলতা তাঁর লেখার ভঙ্গির সঙ্গে মেলে। শেষ বয়সে আত্মিক সাধনায় ঝুঁকেছিলেন। কবি শ্রীমতী উমা রায় তাঁর ডিটেশন নিয়ে এতদিন তাঁর সমস্ত লেখা- প্রচারে সাহায্য করেছেন। তিনি উমাকে মৃত্যুর কয়েকদিন আগে বলেছিলেন–”আমি মারা গেলে নরেন দেব আর পরিমলকে আগে জানিয়ে দিও।” 

কিন্তু মৃত্যুর সময় উমা কাছে ছিলেন না। আঘাত-দেওয়া মৃত্যুর খবরটি টেলিফোন-যোগে প্রেমাঙ্কুরের বাড়ি থেকে পেয়েছিলাম গত ১৩ই অক্টোবর সকালে। এমন একটি আশ্চর্য-ভালোমানুষের মৃত্যু পরিচিতদের কাছে খুবই মর্মান্তিক, সাহিত্যজগতেরও ক্ষতি। এ ক্ষতি বাংলাদেশের সবার। 

[ ‘রবিবাসরীয় যুগান্তর সাময়িকী’, ২৫/১০/১৯৬৪ ] 

প্রেমাঙ্কুর-স্মরণে 

বিলিতি প্রবাদ–বিড়ালের নয়টি জীবন। আর এই বিড়ালের মতন যত বেশি জীবন থাকবে, তার ততই বহুরকম বিপদ থেকে মুক্তির সৌভাগ্য লাভ হবে, এমন একটি বিশ্বাস আছে তাদের। আমার মনে হয় প্রেমাঙ্কুরের জীবনে এটি অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেছে। বিড়ালের মতন তাঁরও নয়টি জীবন। এবং তিনিও বহু বিপদ উত্তীর্ণ হবার সৌভাগ্য লাভ করেছেন। 

স্কুলপাঠ্য নীতিশিক্ষার মানে বিচার করলে তিনি ঘোর পাপী, ঘোর অপরাধী, বিলাসী। পায়ে সর্বদা খুব দামি চটকদার মোজা, হাতে বারো শ’টাকা দামের ঘড়ি। এবং এ-বয়সেও মাথার চুল সাদা, দাঁত একটিতে এসে তখন ঠেকেছে। 

মোজেস্ মারফত গড় যে দশটি আদেশ বা ‘টেন কম্যান্ডমেন্টস’-রূপ বিধি প্রচার করেছিলেন, তা তিনি অগ্রাহ্য করেছেন সমস্ত জীবন, এবং এর বাইরে আরও পঞ্চাশরকম কম্যান্ডমেন্ট অমান্য করেছেন। 

অথচ এমন একটি মানুষের কাছে বসলে কি কখনও মনে হয়েছে তিনি নীতিহীন? তাঁর মধুর ব্যক্তিত্বে, তার আলাপে, তাঁর কাহিনি-বর্ণনার ভঙ্গি তাঁর সরলভাবে সব প্রকাশ করার মধ্যে এমন একটি আশ্চর্যসুন্দর রস ফুটে উঠত, তাঁর ভাষার এমন আকর্ষণকারী মাধুর্য ছিল যে, তাঁকে ভালোবাসার যোগ্য মহৎ শিল্পী ভিন্ন আর কিছুই মনে হত না। তাঁর সান্নিধ্য, তাঁর সঙ্গ, সবার কাম্য ছিল। ছোট-বড় সবার। তাঁর সামনে বয়স-ভেদ ভুল হয়ে যেত। তিনি ছিলেন জীবনশিল্পী। নিজের জীবনের প্রত্যেকটি খুঁটিনাটি ঘটনা ছিল তাঁর শিল্পের উপকরণ। এইতো গতবছরের-পূজা-সংখ্যা ‘অমৃতে’ তাঁর অভিনেত্রী-সংগ্রহের বিড়ম্বনা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয় অনুভব করেছেন, সম্পূর্ণ বস্তুনিষ্ঠ হয়েও উচ্চ শিল্পসৃষ্টিতে কোনো বাধা জন্মায় না; বরং উপকরণে যদি ফাঁকি না থাকে তবে তা শিল্পে বড় সহায় হয়। 

অনেকসময় এ প্রশ্ন মনে জেগেছে–তা হলে পাপ-পুণ্য, সুনীতি-দুর্নীতি, দেহ বা মনের কোথায় বাস করে? প্রশ্নটি ঠিক দেহের কোথায় আত্মার বসতি, সেই রকম। বিজ্ঞানীরা আত্মার বা ব্যক্তিসত্তার খোঁজ করেছেন মানুষের দেহে। কোনো অংশেই পাননি। দেহের প্রতিটি অংশে তন্ন তন্ন করে খোঁজ করেছেন, কোথাও সন্ধান মেলেনি। 

প্রেমাঙ্কুরের ক্ষেত্রে তেমনি দুর্নীতি কোথায় তা কারো পক্ষেই আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। কারণ ও-জিনিসটি এমনই একটি ব্যক্তিগত ব্যাপার যে, তাকে বাইরে টেনে এনে দেখা যায় না। যে নীতি নিজের ব্যক্তিসত্তা ছেড়ে অন্যের উপর অন্যায় প্রভাব বিস্তার করতে চায়, তাই হল যথার্থ দুর্নীতি। 

প্রেমাঙ্কুরের মনে কোনো inhibition ছিল না। তিনি যা করেছেন, তা একেবারে খোলাখুলিভাবে তাঁর সমস্ত লেখার মধ্যে অথবা আলাপে প্রকাশ করে বলেছেন। তার সে, বলা কি অপরূপ ভঙ্গিতে। তা কি বর্ণনা হয়? আসল জানা থাকলে বর্ণনার সঙ্গে মেলানো যায় কিছু, কিন্তু তাঁর কাছে বসে তাঁর কথা যিনি শোনেননি, তাঁকে সে-জিনিস বোঝানো যাবে না। 

আধুনিক শিক্ষা, যা কলেজে দুর্লভ, তা তিনি পেয়েছিলেন অভিজ্ঞতার ভিতর দিয়ে। ‘লিবারেল এডুকেশন’ বলতে যা বোঝায়, আক্ষরিক অর্থে তা লাভ করেছিলেন স্বাধীনভাবে। চাপে পড়ে নয়, আপনি শিল্পীমনের তাগাদায়। 

তাঁর সাধারণ আলাপের বিষয় ছিল জীবন; বই নয়, তত্ত্বকথা নয়। এসব বিষয়ে কথা তুললে তবে আলোচনা করতেন। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা এমনই মজার এবং ঘটনাগুলি এমনই সমাজবহির্ভূত যে, তা শুধু তাঁর মুখেই মানাত। উপকরণের স্থূলত্ব মরে গিয়ে ভূত হয়ে নবজন্ম লাভ করত উচ্চ-শ্রেণীর আর্ট-রূপে। সে জিনিস লেখা যায় না, লিখলে তার শুধু কঙ্কালকেই দেখা যাবে, রূপ ফুটবে না। 

আলাপের সময় তাঁর সমস্ত অঙ্গ তাতে যোগ দিত। বলতে বলতে দাঁড়িয়ে উঠতেন। সমস্ত ঘটনা প্রায় অভিনয় করে দেখাতেন। বছর চার আগে বাসব ঠাকুর বলল, বুড়োদার অসুখ, সে দেখতে যাবে। সেদিন আমি সঙ্গে ছিলাম। গিয়ে দেখি একেবারে শয্যালগ্ন। দেহ শুকিয়ে গেছে। মনে হল এসে ভালো করিনি। কথা বলতে তাঁর কষ্ট হবে। কিন্তু তিনি আমাদের দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন। অনর্গল কথা, অনেক গল্প। গল্প করতে করতে অসুখ কোথায় অন্তর্হিত হল–তড়াক করে একসময়ে উঠে বসলেন। আর ঠিক সেইসময় কোন্ মন্ত্রবলে তাঁর অসুস্থ চেহারাও মিলিয়ে গেল। উৎসবে বিদ্যুতের ছোট ছোট আলোর মালায় যেমন আলোর প্রবাহ খেলে বেড়ায়, তেমনি দেখলাম, তাঁর উচ্ছলতার আলো সর্বাঙ্গে খেলে বেড়াচ্ছে। সমস্ত অঙ্গে তাঁর মনের প্রকাশ। যেন হঠাৎ বয়সটা কমে রকে-বসা বালকটি হয়ে পড়লেন সে-সময়। এরকম শতবার দেখেছি। 

জীবনের আকর্ষণে বাইরের বহু দিকের আকর্ষণ তাঁর জীবনে নানা ডালপালা বিস্তার করেছিল–চাকরি, ব্যবসায়, সাংবাদিকতা, গল্প-উপন্যাস-লেখা, সিনেমা- পরিচালনা, থিয়েটারের জন্য নাটক-লেখা, ছোটদের জন্য বই লেখা কোনোটাই তাঁকে শক্ত করে বাঁধেনি। তাঁর এই ব্যাপক বৃত্তির প্রায় ভবঘুরে বোহেমিয়ান জীবনে তিনি অভ্যস্ত হয়েছিলেন। 

বিবাহিত জীবনও তাঁকে ঘরে সম্পূর্ণ আটকাতে পারেনি। বিবাহের কথায় ওদিকের পরিচয় একটুখানি দিচ্ছি।–এ পরিচয় শিবনাথ শাস্ত্রীর পুত্রবধূ অবন্তী দেবীর বই ‘ভক্তকবি মধুসূদন রাও ও উৎকলে মধুসূদন’ নামক সদ্যপ্রকাশিত বই থেকে উদ্ধৃত : “অক্ষয়কুমার রায়…পাঠদ্দশাতেই ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করিয়া কলিকাতাবাসী একটি ব্রাহ্মপরিবারের কন্যাকে (ইনি বিদ্যাসাগর-মহাশয়ের জীবন-লেখক চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের এক শ্যালিকা) বিবাহ করেন। ইঁহার কনিষ্ঠা কন্যার নাম কমলবাসিনী…আমার মায়ের নিকট থাকিয়া র‍্যাভেনশ বালিকা বিদ্যালয়ে পড়িত, পরে কলিকাতায় ডায়োসিসন কলেজে আই-এ পড়ার সময় বঙ্গদেশে লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সহিত ইঁহার বিবাহ হয়। দুইটি কন্যা রাখিয়া ‘বাসী’ অসময়ে পরলোক গমন করিয়াছেন।” 

এখন তো বড় বড় আসরের আড্ডা উঠেই গেছে, তাই আগের দিনের আড্ডার কথা আমরা কল্পনা করতে পারি না। এখন সমস্ত আড্ডাই নেমে এসেছে পথে, রকে রকে। বর্তমান রকের আড্ডা অধিকাংশই অশিক্ষিতদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। শিক্ষিতদের মধ্যে অন্ততপক্ষে শিক্ষায় আগ্রহী এমনসব লোকেরও তখন রকে আড্ডা ছিল। এবং সেখান থেকে উত্তীর্ণ হয়ে ধনীর হলঘরে আসর জমানোর উপযুক্ততা তাদের লাভ হত। সে আসরে আলোচিত বিষয়বস্তুর কোনো দিকেই কোনো সীমা ছিল না। জীবনের স্থূলসূক্ষ্ম দু’দিকেই সমান আকর্ষণ ছিল। এসব আড্ডার নাম ছিল ক্লাব। 

প্রেমাঙ্কুর আতর্থীও রক থেকে ক্লাবে এসেছিলেন। 

[ ‘অমৃত’ ২৩/১০/৬৪ ] 

আমি যাঁদের দেখেছি 

আমরা মনে মনে আমাদের অজ্ঞাতসারেই মানুষের একটি গড় পরিচয় বা চেহারা গড়ে নিই। তার কারণ, জনসমুদ্রে সকল মানুষকে পৃথকভাবে দেখা দূরে থাক্, আমরা সবসময় যাদের মধ্যে বাস করছি, তাদেরও অনেককে স্বতন্ত্র করে দেখার সুযোগ পাই না, অনেকসময় ইচ্ছাও হয় না; এবং অনেকসময় সে ক্ষমতারও অভাব বোধ হয়। অথচ যে-কোনো মানুষকে ভালো করে লক্ষ করলে তার মধ্যে এমন অনেক বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য আবিষ্কার করা যায়, যা সাধারণভাবে আমাদের দৃষ্টির বাইরে থাকে। মানুষের অন্তর্নিহিত সৌন্দর্যকে চেষ্টা করে আবিষ্কার সবাই করতে পারে না, তাই তাদের চোখে প্রত্যেকটা মানুষই সাধারণ গড় মানুষ। 

তবু এর মধ্যেও হঠাৎ এক এক সময় এমন মানুষের দেখা মেলে, যে মানুষ সহজেই সবার দৃষ্টির সম্মুখে নিজেকে মেলে ধরতে পারেন, এবং সেজন্য তাঁকে না দেখে উপায় থাকে না। এবং এটাও শেষ কথা নয়, কারণ এর উপরে আরও একটা গুণের পরিচয় পাওয়া যায় কোনো কোনো মানুষের মধ্যে–সে হচ্ছে তাঁদের আকর্ষণের ক্ষমতা। সে-আকর্ষণের প্রভাব এড়ানো শক্ত। একটুখানি পরিচয়েই তা প্রবলভাবে টানতে থাকে, তখন হঠাৎ যেন তাঁদের মাথা গড় মানুষ থেকে অনেক ঊর্ধ্বে উঠে যায়। একেই বোধ হয় বলা যায় ‘পার্সোন্যাল ম্যাগনেটিজম’। এই ম্যাগনেটিজম বা চৌম্বক ধর্মকে ঠিক ব্যাখ্যা করা যায় না। এর মূলে অন্তত দু’টি জিনিস থাকতে পারে, স্নেহভালোবাসা অথবা অসাধারণ কৃতিগৌরব। দুই-ই টানে। 

আমার দেখা পর্যায়ে এই দুই জাতীয় ব্যক্তিই আছেন। কারো মধ্যে একটা প্রবল, কারো মধ্যে অন্যটা প্রবল। আমাকে অধ্যবসায়ের সঙ্গে কাউকে আবিষ্কার করতে হয়নি, সে-ক্ষমতা আমার নেই। যাঁরা প্রকৃত কথাশিল্পী তাঁদের আছে সে-ক্ষমতা। আমার কাছে যাঁরা নিজগুণে প্রকাশিত হয়েছেন, শুধু তাঁদেরই আমি দেখেছি। বিচিত্র লোকের হাটে ঠেলাঠেলি করে প্রবেশ করিনি, তবু যা দেখেছি, তা বিচিত্র। এবং ‘বিচিত্র লোক’ নামক গ্রন্থের লেখক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীও আমার সীমাবদ্ধ দেখার ক্ষেত্রে অন্যতম এক বিস্ময়কর মানুষ। এমন বিচিত্র জীবন আমার মতে অন্তত এদেশে একান্তই দুর্লভ। 

আমি প্রথমেই এঁর বাল্যজীবনকে রবীন্দ্রনাথের বাল্যজীবনের বিপরীত দিকে একটুখানি তুলে ধরছি। আশা করি, কথাটা শোনামাত্র আমাকে কেউ তাড়া করে আসবেন না। আমি ওয়ার্ডসওয়ার্থ-এর ‘লুসি গ্রে’র সঙ্গেও প্রেমাঙ্কুরের জীবনের কিছু তুলনা করতে পারতাম, কিন্তু লুসি গ্রে প্রথমত মেয়ে, তার উপর আবার তার আয়ু ছিল মাত্র তিনবছর, এবং মাত্র– 

Three years she grew in sun and shower! 

কিন্তু লুসির জীবন যে ওই রোদ-বৃষ্টির মধ্যে বেড়ে উঠছিল, সেইটুকু তুলনার পক্ষে লোভনীয় হতে পারত, তা ভিন্ন আর কিছু উল্লেখযোগ্য নেই এতে। কারণ লুসি বাড়ছিল রোদ-বৃষ্টির স্নেহস্পর্শে আর প্রেমাঙ্কুর লুসির চেয়ে পাঁচ-ছয় গুণ বেশি বছর ধরে বেড়ে উঠেছেন রোদ–বৃষ্টির অতি নিষ্ঠুর দাপটের মধ্যে।  

রবীন্দ্রনাথের কথাতেই ফিরে আসা যাক। আমরা জানি তিনি শৈশবে ভৃত্যদের অধীন ছিলেন, এবং সে অধীনতা তিনি মেনে নিয়েছিলেন। তারপর ঘরে নানা শিক্ষকের কাছ থেকে পাঠ গ্রহণ করেন এবং বাইরে পিতার সঙ্গে প্রথম গিয়ে প্রকৃতির প্রভাব অনুভব করেন। এটি তাঁর উন্মুক্ত প্রকৃতির হাতের প্রথম পাঠ। বাল্যকালে বহু বেতনভুক অভিভাবক তাঁকে ঘিরে রেখেছিলেন। 

কিন্তু প্রেমাঙ্কুরের বাল্যকালে নিষ্ঠুর পিতার তাড়নায় মন বিগড়ে যায়, তখন থেকেই তিনি কারো কোনো অধীনতা মেনে নেননি, যেখানে-সেখানে মারামারিতে যোগ দিয়েছেন। পিতার হাতে শুধু বিনা প্রতিবাদে নির্মমভাবে মার খেয়েছেন। তারপর প্রকৃতির কাছ থেকে শিক্ষাগ্রহণ রবীন্দ্রনাথের মতো স্নেহচ্ছায়ায় নয়, একেবারে বিমুখ প্রকৃতির কাছ থেকে হাতে-কলমে। বিদেশের কৃপণ পরিবেশে পথে বন্যজন্তুর আসন্ন আক্রমণের ভয় অগ্রাহ্য করে শুয়ে থাকা, অথবা বোম্বাইয়ের মতো শহরের সম্পূর্ণ বিরোধী এবং অপরিচিত পরিবেশে, অগণিত ভিখারীর সঙ্গে, কাড়াকাড়ি করে পথের পাশে তাদের কাছ থেকে একটুখানি রাত কাটানোর মতো স্থান আদায় করে নেওয়া–নিঃসম্বল নিঃসহায় বালক, দু’জন সমধর্মী বালকের সঙ্গে বাইরের প্রচণ্ড শীতে ঝড়বৃষ্টিতে ভিজে পথ চলা–এই তো তাঁর প্রকৃতির কাছ থেকে হাতে-কলমে শিক্ষা। একস্থান থেকে তাড়া খেয়ে অন্যত্র, এবং সেখান থেকে তাড়া খেয়ে আর এক স্থানে। অর্থাৎ এ-প্রকৃতি বাইরের যতটা, ততটা অন্তরের। একবার ভাগ্যের স্রোতে ভেসেছেন, আবার পরমুহূর্তে কূল পেয়ে নিজের পায়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন। 

রবীন্দ্রনাথ ও প্রেমাঙ্কুর দু’জনেই স্কুল-পালানো ছেলে। এবং দুজনের শিক্ষাই (বৈপরীত্য যতই থাক) স্কুলে শিক্ষার বাইরে। নিজের জ্ঞানতৃষ্ণার উগ্রতা থেকে যা কিছু আত্মীকরণ, আত্মস্থকরণ। রবীন্দ্রনাথ কর্মবিমুখ আলস্যপ্রিয় আড্ডাধারী বাঙালিকে দেখে গভীর ক্ষোভে কল্পনা করেছেন–”ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন”। কিন্তু প্রেমাঙ্কুরের জীবনে এই “যদি” ছিল না, তিনি নিজে আরব বেদুইন হয়েছিলেন, বাঙালিসুলভ সকল আরাম বিসর্জন দিয়ে। 

দু’জনের মধ্যে এখানে পার্থক্য–অর্থাৎ দু’জনের জীবনপথের মধ্যে। মানসিক আরাম অবশ্য রবীন্দ্রনাথও পাননি, তা পেলে তাঁর কাব্যজীবনের অনেকখানিই ব্যর্থ হয়ে যেত, কিন্তু প্রেমাঙ্কুর দৈহিক আরাম সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়ে মনের আরাম পেয়েছিলেন কি না সে-বিষয়ে তিনি নীরব। অন্তত এত সংযত যে, এদিক থেকে তাঁর মনের মধ্যে প্রবেশ করা শক্ত। কারণ তিনি তাঁর ‘মহাস্থবির জাতকে’ নিজের বাল্যজীবন যে দৃষ্টিতে দেখেছেন তা সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি। তা প্রায় নিরপেক্ষ দৃষ্টি। নিজে আবেগপ্রবণ, অথচ প্রকাশে কোথাও আবেগ নেই, বরং সবচেয়ে দুঃখের দিনগুলির কথা তিনি হাসতে-হাসতেই বর্ণনা করেছেন। নিজের জীবনকে এমন অকপটে বর্ণনা করা, অথচ তাকে কোনোমতেই ‘কনফেসস’-এর পর্যায়ে ফেলা যায় না, এও এক আশ্চর্য সৃষ্টি। কোথাও জীবনের কোনো কাজের জন্য অনুতাপ নেই। 

ভাগ্যের হাতে মার খেয়ে খেয়ে আপন ভাগ্য গড়তে-গড়তে যাওয়ার দৃষ্টান্ত সংসারে অনেক মিলবে, কিন্তু ঘরের মায়া স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে বাংলাদেশের কোনো স্কুলের বালকের পক্ষে দূর অপরিচিত রাজ্যে গিয়ে দিনের পর দিন পরস্পরবিরোধী, অনভ্যস্ত, এবং অরুচিকর বৃত্তি গ্রহণ করতে করতে চলার দৃষ্টান্ত (তাঁর দু’-তিনজন সমধর্মী বালক-সঙ্গী-সহ) বাংলাদেশের আর কোনো ছেলে দেখিয়েছে কি না সন্দেহ। 

এই বাল্যজীবনে বহু প্রতিকূলতার হাতে মার খেয়েও প্রেমাঙ্কুর একটি জিনিসকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন–সেটি তাঁর শিল্পী-মন। এরকম অনেকের ক্ষেত্রেই হয় না। অনেক প্রতিভা বাইরের আঘাতে নষ্ট হয়ে যায়। সমস্ত দিন না খেয়ে ছোট নিয়োগকর্তাকে দু’আনার মধ্যে দু’পয়সা কমিশন দিয়ে ছ’পয়সা মজুরিতে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাঠে আগাছা নিড়ানো ও ঘাস কাটার কাজ করে ও, অথবা শত শত ভিখারীর সঙ্গে কাড়াকাড়ি করে পথে একটুখানি রাত কাটানোর মতো জায়গা দখল করার পরেও, শিল্প-প্রতিভা অক্ষুণ্ণ রাখা খুব সহজ নয়। তা ভিন্ন, কবির ভাষায় ‘দারিদ্র্যদোষো গুণরাশিনাশী’–এ-কথাও তো সম্পূর্ণ মিথ্যা নয়। প্রেমাঙ্কুরের ক্ষেত্রে গুণরাশি নষ্ট হয়নি। তবে এমনও মনে হয় ভাগ্যের হাতে এমন মার না খেলে তাঁর প্রতিভা হয়তো আরও বেশি স্ফুরিত হতে পারত। কিন্তু এও আমার অনুমান মাত্র। যা হয়েছে, অন্যভাবে তার অন্য কি চেহারা হতে পারত, তা আমার হিসাবের বাইরে। এবং যা হয়েছে তার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও বিস্ময়ের অন্ত নেই। 

বাল্যকাল থেকেই প্রেমাঙ্কুরের বেদুইন-জীবন। কোনো কবি, কোনো বাঙালি স্কুলের ছাত্রের এমন অবিশ্বাস্য রকমের ভয়ঙ্কর এবং দুঃসাহসিক ভবঘুরে জীবনের কথা কল্পনাও করতে পারবেন না। শুধু বাড়ি থেকে দূরে পালাবার উৎসাহে এবং প্রতিমুহূর্তে শত রকমের অনিশ্চয়তা এবং বিপদসঙ্কুল জীবনের আকর্ষণে কোনো বালকের পক্ষে ভারতবর্ষের এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত–কখনও বিনা টিকিটে, কখনও পায়ে হেঁটে মাত্র দু’জন সমধর্মী বালকের সঙ্গে ঘুরে বেড়ানোর দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে আর নেই। তাঁর এই জাতীয় চমকপ্রদ কাহিনিগুলি পুনরুক্তি হওয়া সত্ত্বেও বার বার বলতে ইচ্ছা হয়। অনাহারে, ছিন্নবস্ত্রে, শুধু ভবিষ্যতে একটা কিছু ঠিক হয়ে যাবে এ-বিষয়ে ‘মিকবার’-এর চেয়েও এক অদম্য আশা বুকে নিয়ে, সম্পূর্ণ অপরিচিত মাটিতে, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ঝড়-ঝঞ্ঝাকে বুকে ঠেলে, কখনও-বা অগ্নিবর্ষী সূর্যতাপে বিমুখ দরজায় একের পর এক ঘা মেরে যে-কোনো কাজের সন্ধানে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি, সহধর্মীদের সঙ্গে। কখনও আকস্মিকভাবে আশাতীত সৌভাগ্যলাভ, এবং পরক্ষণেই তা থেকে বঞ্চিত হয়ে কখনও পথে, কখনও ধরমশালায়, কখনও গুণ্ডার ছুরির ঘায়ে দ্বিখণ্ডিত হবার আশঙ্কায়, কখনও রাজার বন্ধু হয়ে, কখনও তিনজনে ছ’পয়সা ভাড়াকে দর-কষাকষি করে তিন-পয়সায় রফা করে ভাঙা ঘরে রাতের পর রাত কাটানো! কখনও ধনীর ঘরে ঝাড়ুদারের কাজ করে, কখনও নবাব-গৃহে গৃহশিক্ষক হয়ে, পরক্ষণেই পথে নামা।–কিন্তু শুধু কি তাই? এরকম অনেক অনেক কাহিনি। 

সম্ভবত তাঁর পিতার অমানুষিক অত্যাচারের ফলেই, পুরুষমাত্রেরই মনে যে উদাসীনতা বা বৈরাগ্যের বীজ সুপ্ত থাকে, তা বালক অবস্থাতেই প্রেমাঙ্কুরের জীবনে অঙ্কুরিত হয়ে উঠেছিল। এই অত্যাচার না হলে কি হত বলা যায় না। এই অত্যাচারের জন্যই প্রেমাঙ্কুর সন্ন্যাসী হয়ে যাবেন ঠিক করে ফেলেছিলেন। এ-কাজে স্কুলের সঙ্গীও জুটেছিল, কিন্তু প্রথমবারের সন্ন্যাস-যাত্রাটি একটি গাধার অভাবে পণ্ড হয়ে গেল। সন্ন্যাসজীবনের মোট বইবার জন্য একটি গাধার দরকার ছিল। 

মনে পড়ে কবি কোজি-এর বাল্যকালের কথা। তিনি বালককালে দেশান্তরে যেতে চেয়েছিলেন একটি মহৎ উদ্দেশ্যে। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মানুষের সমাজকে পুনর্গঠন করা। পরবর্তী যুগের কবি রবার্ট সাদি-র সঙ্গে পরামর্শ হয়েছিল তাঁরা কয়েকজন বালক আমেরিকায় পালিয়ে গিয়ে কোনো অরণ্যপ্রদেশ আশ্রয় করবেন, এবং সেখানে এক নতুন সমাজ গড়বেন–যার নাম হবে ‘প্যানটিসোক্রাসি’। কিন্তু তাঁদেরও এই মহৎ উদ্দেশ্য ব্যর্থ হল আমেরিকায় যাবার খরচের অভাবে। 

প্রেমাঙ্কুর কিশোরবয়সে এক প্রতিবেশী সত্তরবছরের বৃদ্ধকে আবিষ্কার করেছিলেন, তাঁর কাছে শেলীর কাব্যের প্রথম-পাঠ-গ্রহণ। তাঁকে সবাই পাগলাসন্ন্যাসী বলে ডাকত। ঘরে প্রচুর বই, গাঁজা টানতেন (পরে তিনি তাঁর সন্ন্যাসী-পুত্রের কাছে মদ খাওয়াও শিখেছিলেন) এবং প্রেমাঙ্কুর আর তাঁর ভাইকে কাব্যের স্বাদ দিতেন। ওই কিশোরবয়সেই ‘অ্যালাস্টর’-এর ভালো ভালো কাব্যাংশগুলি মুখস্থ হয়ে গেল এবং তার ভাবার্থ মনে গাঁথা পড়ল। ইতিমধ্যে বাইরের অনেক বিষয়ের বই পড়ে তার মধ্যে ডুবে গিয়েছিলেন। ঠিক কোজি-এর মতোই। কোরিজ স্কুল-জীবনে মদ্যপান শুরু করেন, প্রেমাঙ্কুরকেও ওই পাগলাসন্ন্যাসী পানে দীক্ষা দেন। কোজি আর একটু বেশি বয়সে আফিঙ খেতে শেখেন, প্রেমাঙ্কুর এক মহিলার কাছ থেকে ভাং খেতে শেখেন, ও পরে এক ছাগলওয়ালার কাছে গাঁজা খান। কোরিজ (ও রবার্ট সাদি) প্যানটিসোক্রাসি স্থাপনের পূর্বে দুটি বোনকে বিয়ে করেছিলেন, প্রেমাঙ্কুরও স্কুলজীবনে একটি মেয়েকে গান্ধর্বমতে বিয়ে করেছিলেন। অবশ্য কোজি-এর উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বমানবের হিতসাধন, আর প্রেমাঙ্কুরের উদ্দেশ্য ছিল স্বপদ-নির্ভরতা। প্রথম জনের আমেরিকায় পালাবার কল্পনার পিছনে বাইরের কোনো চাপ ছিল না, প্রেমাঙ্কুরের দেশত্যাগ ছিল প্রাণের দায়ে। কিন্তু তবু সন্দেহ থাকে–শুধুই কি তাই? 

কোলরিজ ‘বাল্যকালে পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে এমন আত্মহারা হয়েছিলেন যে, সে এক কাহিনি। কিশোর কোজি একদিন লন্ডনের পথে স্বপ্নাচ্ছন্ন অবস্থায় চলছিলেন। এমন সময় এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন–”এই বাচ্চা চোর, কি হচ্ছে?” এই রূঢ় সম্বোধনে কোজি-এর মধুর স্বপ্ন ভেঙে গেল। তিনি বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ভদ্রলোকের দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার পকেটে আমার দৈবাৎ হাত লেগে গেছে ইচ্ছে করে লাগাইনি। আমি কল্পনা করছিলাম আমি লিয়েন্ডার, হেলেপন্টে সাঁতার কাটছি।” (লিয়েন্ডার তার প্রেমিকা হেরো-র সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য হেলেসপন্ট নামক একটি তিন-চার মাইল প্রশস্ত প্রণালী প্রতি রাত্রে সাঁতার কেটে পার হয়ে যেত। এই প্রণালীর বর্তমান নাম ডার্ডানেল্স।) 

একটি বালকের পক্ষে কল্পনায় লিয়েন্ডার হয়ে রাজপথে সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে চলা খুবই ইঙ্গিতপূর্ণ, এবং কোজি-এর পক্ষেই তা বেশি ইঙ্গিতপূর্ণ। প্রেমাঙ্কুর তাঁর কিশোর বয়সে পাগলাসন্ন্যাসীর কাছে ‘অ্যালাস্টর’ ও তার ব্যাখ্যা শুনে কি পরিমাণ মুগ্ধ হয়েছিলেন তাঁর ভাষাতেই বলি–”কবিতার ভাষা বোঝবার মতো বিদ্যা আমাদের ছিল না,…শুধু ধ্বনি ও সুর মনের মধ্যে একটার পর একটা ছবি ফুটিয়ে তুলতে লাগল। চোখের সামনে যেন দেখতে লাগলুম অ্যালাস্টরের কবি চলেছে দূরে, সুদূরে–তার অন্তরে যে চেতনা জেগেছে তারই সন্ধানে। চলেছে, চলেছে–কত দেশ, কত মেয়ে এল তার জীবনে, তবুও সে চলেছে বিরামবিহীন। চলতে চলতে জরায় তার দেহ শুকিয়ে গেল। অমন যে সুন্দর কিশোর, তাকে দেখলে তখন ভয় হয়, চেনা যায় না। তার বুকের মধ্যে যে অতৃপ্তি দুর্লভকে লাভ করার যে পিপাসা তারই আগুন শুধু দুই চোখে ধকধক করে জ্বলছে।” (মহাস্থবির জাতক’, প্রথম পর্ব)। 

কে জানে হয়তো-বা এই কবিতা তাঁর জীবনে দৈবাৎ প্রভাব বিস্তার করে তাঁর অবচেতনমনে তাঁকে ঘর ছাড়ার প্রেরণা দিয়েছিল। এই চলা তাঁর চলার সঙ্গে যে অনেকখানি মেলে। কিন্তু অ্যালাস্টরের নায়কের (শেলী নিজে) সঙ্গে প্রেমাঙ্কুরের সর্বৈব মিল নেই কিছু। মানবজীবনের অসম্পূর্ণতার বিরুদ্ধে আদর্শ বা কল্পনার বিদ্রোহ, অ্যালাস্টারের মূল কথা। কিন্তু এর নায়কের পথ-চলার সঙ্গে প্রেমাঙ্কুরের পথ-চলার মিল আছে। প্রেমাঙ্কুর স্বেচ্ছাবৃত দুঃখময় জীবনকে মেনে নিয়েছিলেন, সেজন্য মন তাঁর বিদ্রোহ করেনি। বিদ্রোহ করেছিল চাপানো দুঃখের বিরুদ্ধে। 

কিন্তু বহু ব্যর্থতা ও কল্পনাতীত দুর্ভোগকে বুকে নিয়ে প্রতিদিনের প্রতিকূলতার আঘাত বার বার দু’হাতে ঠেলে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়ানোর লক্ষ্য স্থির রাখার এই শক্তি কোথা থেকে এল? এর কোনো ব্যাখ্যা নেই। বরং অদৃশ্য এক শক্তি বারংবার তাঁকে দূরদেশ থেকে স্বগৃহে এনে ফেলেছে, কিন্তু বাঁধতে পারেনি। আবার তিনি ছুটে গেছেন সেই জীবনে যে জীবনে চরম দুঃখ আছে, কিন্তু বন্ধন নেই। পরাভোগ আছে, কিন্তু পরাজয় নেই। 

এসব কথা তাঁর মুখে অনেকবার শুনেছি, ‘মহাস্থবির জাতক’-এর তিন খণ্ডে পড়েছি, এবং এখনও যে খণ্ড ছাপা হয়নি, তাও পড়েছি। এই বালক আরব-বেদুইনের বা এই স্ট্রিট-অ্যারাবের বাস্তব জীবনকথা আরব্য-উপন্যাসের কল্পনাকে হার মানায়। সমস্ত দুঃখসুখের পালা ক্রমিক আবর্তনের মধ্যে, অবিরাম ঘূর্ণনের মধ্যে, এ কি মনস্তত্ত্ব, এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, আর কিছু না? 

রবীন্দ্রনাথের ‘বলাকা’র মূল তত্ত্বটিরও হয়তো-বা কিছু আভাস মেলে এই ছুটে চলার বর্ণনার মধ্যে–”হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনখানে।”–কিন্তু তবু এ-চলা তো বাইরে থেকে উপলব্ধি করা নয়, এ যে সমস্ত মায়াময়, চলমান, ধাবমান রূপের মধ্যে, কালের মধ্যে নিজেকে নিক্ষেপ করে সবার সঙ্গে ছুটে চলা। 

একটি ঘরছাড়া বাঙালি স্কুলের ছেলের কি বিচিত্র অভিজ্ঞতা। প্রেমাঙ্কুর বিচিত্র মানবসংসারের, আর চরিত্রের, স্তরের পর স্তর দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছেন। এতগুলি স্তর একজন পরিণত মানুষের পক্ষে কল্পনাতেও দেখা সম্ভব নয়। অথচ একটি বালকের জীবনে তা দেখা হয়ে গেল। শত স্তরের দু-চারটে আমরা বাইরে থেকে দেখি, কেউ-বা কিছু বেশি দেখেন ও আরও কিছু বেশি কল্পনায় গড়ে নেন, কেউ-বা অভিজ্ঞতা নিয়ে আরও বেশি দেখেন। কিন্তু প্রেমাঙ্কুরের মতো এত বেশি স্তরের সঙ্গে সহজে কোনো বাঙালির পরিচয় ঘটেছে কি না আমার সন্দেহ আছে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনের সঙ্গে হয়তো অনেকটা মিলে। কিন্তু তবু মনে হয় প্রেমাঙ্কুরের অভিজ্ঞতা যেন তাঁকেও হার মানিয়েছে। সর্বভারতীয় ‘লোয়ার ডেপ’-এর সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠ পরিচয় অবশ্যই দুর্লভ। একই সঙ্গে সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন স্তরের সঙ্গে এই অঙ্গাঙ্গী পরিচয়ের তুলনা হয় না। 

আমার সবচেয়ে বিস্ময়কর বোধ হয় এই ভেবে যে, কোনো অভাজনের প্রতিই তিনি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রকাশ করেননি। কাউকে নিজের কোনো আদর্শ বা নীতিবোধের সাহায্যে বিচার করেননি। যখন ভিখারীদের অত্যন্ত অভদ্র এবং নোংরা পরিবেশে পথেরপাশে তাদের মাঝখানে শুয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, তখনও তাদের প্রতি তাঁর কোনো ঘৃণা জাগেনি। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে গভীর সহানুভূতির সঙ্গে তাদের মেনে নিয়েছেন। বোম্বাই শহরের বাইরে যেখানে প্রায় বারো ঘণ্টা না খেয়ে দৈনিক ছ’পয়সা মজুরিতে ক্ষেত নিড়িয়েছেন, ঘাস কেটেছেন, সেখানে আর এক দরিদ্রতম পরিবারের ঘরে বাস করে তাদের সঙ্গে তাদের বরাদ্দ থেকে তাদের হাতে-গড়া বাজরার রুটি শুধু একটু মাটি মেশানো নুনের সঙ্গে খেয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সেখানেও তাদের প্রতি কি গভীর শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা! যে ছাগলের দুধ-বিক্রেতার ভাঙা ঘরে প্রতিদিন তিনপয়সা ভাড়া দিয়ে রাতের পর রাত কাটিয়েছেন, সেই ঘরের মালিক-দম্পতি তাঁদের এক চরম বিপদে নিজেদের প্রাণ তুচ্ছ করে সাহায্য করেছেন তার সকৃতজ্ঞ বর্ণনা পড়লে রোমাঞ্চিত হতে হয়। প্রেমাঙ্কুরের মুখে এর অনেক ঘটনা আমার আগে শোনা ছিল। আরও অনেক ঘটনা পড়া যাবে তাঁর চতুর্থ পর্বে। 

গল্প মুখে বলার ভঙ্গি ছিল তাঁর বড়ই হৃদয়গ্রাহী। জীবনের সকল কথাই অপূর্ব রঙেরসে সাজিয়ে ধরতেন মনের চোখের সামনে। গল্প বলার সময় তাঁর সমস্ত ইন্দ্রিয় তার সঙ্গে যোগ দিত। বর্ণনার অপূর্ব ভঙ্গিতে তা চুম্বকের মতো শ্রোতার সমস্ত মনোযোগ টেনে ধরে রাখত। প্রেমাঙ্কুর সম্পর্কে যিনিই কিছু লিখেছেন তাঁরই আগে মনে পড়েছে তাঁর এই ক্ষমতার কথা 

প্রেমাঙ্কুরের কাহিনি সবই তাঁর জীবনের কাহিনি। প্রত্যেকটি ঘটনা নতুন করে বেঁচে উঠত তাঁর বর্ণনার গুণে–এবং তিনটি ডাইমেনসন সহ। তা ভিন্ন নিজের জীবনের যে-সব ঘটনা সাধারণত কেউ প্রকাশ করতে সঙ্কোচ বোধ করে, তা তিনি নিপুণ শিল্পীর মতো, অম্লানবদনে সবার কাছে বলে যেতেন। এবং এমন অনেক ঘটনা বলতেন যা ছাপার অক্ষরে আত্মপ্রকাশ করতে পারবে না’ কোনোদিন। অনেক কথাই তিনি অকপটে বলে গেছেন তাঁর ‘মহাস্থবির জাতকে’, যে ভঙ্গি বাংলাভাষায় আর কারো পক্ষে আয়ত্ত করা সম্ভব হয়নি। কারণ এ-জিনিসের অনুকরণ হয় না। জীবনের সমস্ত ঘটনা একমাত্র ‘কনফেসন্‌স’-এর নামে বলা যায়, কিন্তু তা দিয়ে সাহিত্য রচনা করার মতো কঠিন কাজ সবাই পারে না, এবং সবার তা মানায়ও না! বাংলাদেশে একমাত্র প্রেমাঙ্কুর আতর্থী তা পেরেছেন–এবং পেরেছেন যেমন তাঁর মুখের কথায় তেমনি পেরেছেন তাঁর লিখিত ‘মহাস্থবির জাতকে’। আমাদের সংস্কারে নীতি ও দুর্নীতি নামক দু’টি আচরণ বিভাগ আছে। এই দু’টি বিভাগের মাঝখানে প্রাচীর তুলে নীতিধর্মী মানুষেরা অন্যের পাপপুণ্য বিচার করেন। অথচ এ দু’টির মাঝখানে যে স্থায়ী প্রাচীর গাঁথা যায় না, দেশভেদে, সমাজভেদে, এবং ব্যক্তিভেদে এদের অর্থ আপেক্ষিক হয়ে পড়ে, এবং চিরদিনের জন্য কোনো দেশেই নীতি বা দুর্নীতির কোনোটাই তাদের স্থায়ী এবং চরম অর্থ বহন করে না, এ কথা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই বলেই আচরণক্ষেত্রে এবং শিল্পক্ষেত্রে এত দ্বন্দ্ব। 

কিন্তু যে মুহূর্তে শৈশবে নীতি-বিদ্যালয়ে পড়া প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর সাহচর্যে এসেছি, অথবা তাঁর লেখা পড়েছি, তখনই দেখেছি তাঁর বর্ণনায় বা লেখায় সংস্কারের মানদণ্ডে নীতি-দুর্নীতি বিচারের কথা একেবারেই মনে আসেনি। এ-সমস্তের ঊর্ধ্বে তার যে রসসৃষ্টি এবং শিল্পীজনোচিত প্রকৃত নিস্পৃহতা, তা মনকে বিচারকের আসন থেকে সরিয়ে দিয়ে রস-ভোক্তার আসনে বসিয়ে দিয়েছে। 

এ এক অসাধারণ ক্ষমতার দৃষ্টান্ত। 

.

গল্প বলার আর্টে অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন আর এক ওস্তাদ। প্রেমাঙ্কুর আতর্থী অবনীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পর (মৃত্যু : ৫-১২-৫১) আমাকে একটি রচনা পাঠান (ছাপা হয় ১৬-১২-৫১, ‘যুগান্তর সাময়িকীতে) তাতে তাঁর গল্প-বলার মনোহারিত্বের কথা তিনি এইভাবে লেখেন–”অবনীন্দ্ৰনাথ খুব উঁচুদরের গল্প বলিয়ে ছিলেন। আসর জমানোর আর্টেও বোধ হয় ঠাকুরবাড়ির মধ্যে রবীন্দ্রনাথের পরে তিনিই ছিলেন দ্বিতীয়। যখন তিনি কথা বলতেন, বা কোনো গল্প অথবা প্রবন্ধ পড়তেন তখন মনে হত আগাগোড়া সমস্তটাই তিনি অভিনয় করে চলেছেন। পাঠ্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখের ও হাতের ভঙ্গী চলেছে অবিরাম। নিজে না হেসে অপরকে হাসিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অননুকরণীয়।” 

এর প্রায় সবখানি বর্ণনাই প্রেমাঙ্কুরের নিজের বেলাতেও খাটে। এবং তাঁর এই গল্প শোনাবার মধ্য দিয়েই প্রথম তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়। সে-সময় তিনি অন্তত দু’শটি জন্ম এবং জন্মান্তর পার হয়ে এসেছেন, কিন্তু তখনও তাঁর সেই বিচিত্র জীবনের ইতিহাস সবটা জানি না, মাঝে মাঝে টুকরো দু’একটি শুনেছি মাত্র। তিনি যেটুকু কথাপ্রসঙ্গে বলতেন, সেইটুকু তারপর ‘মহাস্থবির জাতক’ পড়ে পরে বুঝতে পেরেছি সে-সব কথা এতে বাদ আছে, কারণ তা তাঁর প্রথম শৈশব থেকে তিনি সতেরো আঠারো বয়সের ছবি যে ছকে ফেলে এঁকেছেন, তার মধ্যে সে সব কাহিনি আসে না। 

আমার অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় তাঁর অদ্ভুত সব অভিজ্ঞতার একচতুর্থাংশও ছুঁয়ে যেতে পারিনি, এক স্থানে বিস্ময়ে থেমে যেতে হয়েছে। কিন্তু সৌভাগ্যের কথা এই যে, তাঁর মহাস্থবির জাতক’ তিন-খণ্ডের দ্বার সবার কাছেই উন্মুক্ত হয়ে আছে, যাঁরা তা পড়েছেন বা পড়বেন তাঁদের আমার এ বর্ণনা পড়বার দরকার নেই, আমি শুধু আমার বিস্ময় প্রকাশ করেই তৃপ্ত! অপ্রকাশিত চতুর্থ-খণ্ড হয়তো অল্পদিনের মধ্যেই কোথাও ছাপা হবে। 

আমার সঙ্গে যখন তাঁর প্রথম পরিচয় তখন তিনি জীবনের আরো দু’-একটি পর্ব প্রায় অতিক্রম করে এসেছেন। তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে সিনেমা পরিচালনা ও সাহিত্য রচনা। বম্বে, কোলাপুর ও বাংলাদেশ–ভারতের এই ত্রিপাদ-ভূমিতে দাঁড়িয়ে তিনি বাংলা, হিন্দি ও তামিল ভাষায় ছবি যা পরিচালনা করেছেন তার মোট সংখ্যা হবে সতেরো। তারপর সাহিত্য-সঙ্গ এবং সাহিত্যিক-সঙ্গ। উপন্যাস গল্প ইত্যাদিতে প্রায় পনেরোখানা বই। সম্পাদনায় সাহায্য করেছেন দৈনিক, সাপ্তাহিক মাসিকপত্র মিলিয়ে মোট পাঁচখানার, এবং গিরিজা বসুর সঙ্গে সম্পাদনা করেছেন একখানা। সাময়িকপত্রে প্রকাশিত 

প্রকাশিত এবং গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত বই ও আছে কয়েকখানা। তা ভিন্ন তাঁর ‘তত-এ-তাউস’ নাটক অভিনীত হয়েছে শ্রীরঙ্গমে। 

জীবনের মস্ত বড় দু’টি পর্ব। কোনোদিন বিশ্রাম নেননি জীবনে–শেষের কয়েক বছর ভিন্ন। ১৯৫১ থেকে আমাদের বাড়িতে প্রায় নিয়মিত আসতেন। তার আগেও আসতেন, কিন্তু অনিয়মিত। ১৯৫১-তে যখন শিশিরকুমার ভাদুড়ী আমার কাছে সপ্তাহে অন্তত পাঁচদিন আসতে লাগলেন, তখন থেকে বুড়োদাও আসতে লাগলেন সপ্তাহে অন্তত দু’-তিন দিন। 

হেমেন্দ্রকুমার রায় প্রেমাঙ্কুর সম্পর্কে একটি রচনা লিখেছিলেন প্রেমাঙ্কুরের জীবিতকালে। ‘এখন যাদের দেখছি’–এই পর্যায়ের লেখা–এবং ওই নামেই বই বেরিয়েছিল (প্রকাশক : ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটড; ১৯৫৫)। তাতে এক জায়গায় প্রভাতচন্দ্র, প্রেমাঙ্কুর ও হেমেন্দ্রকুমারের তর্ক-সভার চমৎকার বর্ণনা আছে। সভাটি অবশ্য ঘরে নয়, হেদুয়ার মোড় থেকে বীডন স্ট্রিট–চিৎপুরের মোড় পর্যন্ত দীর্ঘ পথ। সময় : রাত্রি দ্বিপ্রহর কিংবা আরও বেশি। 

প্রেমাঙ্কুরের বাল্যকাল থেকেই একটি জিনিসের প্রতি দুর্বলতা দেখা যায়। অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক যে কোনো ব্যাপার বিশ্বাস করতে তিনি যেন একটু বেশি আগ্রহী ছিলেন। প্রেতমূর্তি দেখার কথাও বলেছেন। তাঁর ‘মহাস্থবির জাতকে’ এসব বিষয়ে একাধিকবার আলোচনা দেখতে পাওয়া যাবে। 

আমার সঙ্গে এ-বিষয়ে আলোচনাও হয়েছে। আমি এসব বিষয়ে ভিন্ন মত পোষণ করি। ‘বর্ডারলাইন সায়েন্স’ নিয়ে আমার কোনো চিন্তা নেই। এইটুকু জানি যে মানুষের মন যে কি পদার্থ তা আজও বোঝা যায়নি, এবং এর ক্ষমতার সীমা কতখানি তাও নিশ্চিত নির্ধারিত হয়নি, তবে ‘আত্মাকে আমি মোটামুটিভাবে অন্তত মগজজাত একটি গুণ বলে মনে করি এবং দেহকে বাদ দিলে চেতনা বা আত্মা থাকতে পারে বলে আমার কোনোমতেই বিশ্বাস হয় না। চেতনা 

বা আত্মা আমার কাছে এক মনে হয়। এবং মগজে আঘাত পেলে আত্মা অজ্ঞান হয়; মগজ মাতাল হলে, আত্মা মাতাল হয়। কবি কাজি নজরুলের মগজ এখন আত্মচেতনাহীন, আত্মা মগজ থেকে পৃথক হলে তা এখন কোথায়? আত্মা কি তবে আত্মচেতনাহীন অবস্থায় বাস করছে? 

এসব আলোচনা মাঝে মাঝে করেছি প্রেমাঙ্কুরের সঙ্গে। মতে মেলেনি এই পর্যন্ত, কিন্তু এ-বিষয় নিয়ে কখনও দ্বন্দ্ব হয়নি। কারণ আমার নিজের বিশ্বাস কখনও অন্যের উপর চাপাতে 

আমি যাঁদের দেখেছি ] ৬৪৩ 

চেষ্টা করি না, তা ভিন্ন এসব উপমনস্তত্ত্ব অথবা ‘প্যারা-সাইকোলজি’ আমার বোধের বাইরে এ বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ। 

প্রেমাঙ্কুরের জীবনে এসবের প্রভাব পড়া স্বাভাবিক। দেব-দেবতার প্রতি ভক্তিও তাঁর পক্ষে অস্বাভাবিক নয়–যদিও ব্রাহ্মসন্তান তিনি। 

প্রেমাঙ্কুরের মধ্যে একটি বড় দুর্বলতা আবিষ্কার করেছিলাম–তিনি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অত্যন্ত অনুরাগী ছিলেন। আমার নিজের সঙ্গে এ বিষয়ে তাঁর ঐক্য ছিল অনেকগুলি গান সম্পর্কে এবং সে-সব গানের সুসঙ্গত সুর সম্পর্কে আমাদের অনেকদিন আলোচনা হয়েছে। 

.

প্রেমাঙ্কুর সম্বন্ধে আর কিছু বলব না। শুধু এ-কথা স্মরণ করব যে এমন একটি মধুর চরিত্রের মানুষ, যিনি বাল্যকাল থেকে মানুষের সমাজ এবং জীবনকে তন্ন তন্ন করে উল্টে-পাল্টে দেখেছেন, এবং যাঁর আলাপের আকর্ষণে তাঁর প্রতি সবাই প্রবলভাবে আকৃষ্ট হতেন, যাঁর সঙ্গে দেশি-বিদেশি সাহিত্য বিষয়ে আলাপে তাঁর জ্ঞানের পরিধি মুগ্ধ করত, অথচ যিনি স্কুল পালিয়ে প্রায় সমস্ত জীবন মুসাফির হয়ে কাটালেন, এমন একটি দুর্লভ বাঙালি ভদ্রলোকের সান্নিধ্যে পাঁচ-ছ বছর ধরে দিনের পর দিন কাটাবার সৌভাগ্য লাভ করেছি। 

আমিও যে তাঁর স্নেহাস্পদ ছিলাম তার একটি প্রমাণ বেদনার সঙ্গে স্মরণ করব, মৃত্যুর আগে তিনি জানিয়ে রেখেছিলেন–মৃত্যু হলে পরিমলকে যেন খবর দেওয়া হয়। 

প্রেমাঙ্কুরের সকল লেখার ভাণ্ডারী স্নেহাস্পদ কবি শ্রীমতী উমা রায়ের কাছ থেকে প্রেমাঙ্কুরের অপ্রকাশিত চতুর্থ-খণ্ড ‘মহাস্থবির জাতক’-এর পাণ্ডুলিপি পড়বার সুযোগ পেয়েছি, সেজন্য উমার প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। 

[ ‘সাপ্তাহিক বসুমতী’, ৩০/৬/৬৬ ] 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *