বোধ হয় ঘণ্টাখানেক কাজ করবার পর একবার ঘাসের জঙ্গল থেকে উঠে দেখি, চারিদিক একেবারে ফাঁকা–মজুরেরা সব চলে গিয়েছে। এগারোটা বেজে গিয়েছে তা তারা যে কি করে জানতে পারলে তা বুঝতে পারলুম না। লোকজন কোথাও কেউ নেই দেখে আমরাও বুঝলুম যে, সকালবেলাকার কাজ শেষ হয়েছে। আমাদের খাওয়া-দাওয়া ও রান্নাবান্নার হাঙ্গামা নেই। ঝাঁটা ও জলপাত্রের জন্য সর্দারের কুটিরে গিয়ে হানা দেওয়া গেল। দেখলুম, সে সেখানে সপরিবারে বাস করে। আমাদের দেখে সে বাড়ির ভেতরে গিয়ে যে জিনিসটি এনে দিলে তাকে ঝাঁটা তো দূরের কথা, খ্যাংরা বললেও ইজ্জত দেওয়া হয়। ঝাঁটা ও জলপাত্র দুই-ই সে আগে থেকে ঠিক করে রেখেছিল।
সে ঝাঁটা ও জলপাত্রের কথা মনে পড়লে আজও হাসি পায়। হাতখানেক লম্বা গুটি চার-পাঁচ ঝাঁটার কাঠি একটু সরু সুতো দিয়ে বাঁধা আর একটা ভাঙা মাটির পাত্র। সেটা আস্ত অবস্থায় হাঁড়ি ছিল কি কলসী ছিল তা স্থির করবার জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকের প্রয়োজন হয়। তবে বেশ বোঝা গেল যে বর্তমানে সেটাতে সংসারের আবর্জনা ফেলা হত–সদ্য আঁস্তাকুড় থেকে তুলে এনে দিয়ে সর্দার আমাদের জানালে যে আমার ঘরের জিনিসপত্র কুলিদের দিলে আমার নিজের কাজ চলবে কি করে! যা হোক, তোমরা মেটজীর লোক, তোমাদের কথা আলাদা। কাল যখন বাজারে যাবে, একটা ঝাঁটা ও জলপাত্র কিনে এনে আমার এই জিনিসগুলি ফিরিয়ে দিও।
যে আজ্ঞে।–এই কথা বলে তখনকার মতো সর্দারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে এসে সেই ঝাঁটা দিয়ে কোনোরকমে সেই বিরাট ঘরের খানিকটা পরিষ্কার করে গেলুম সেই ঝরনায়। সেখানে সর্দার-প্রদত্ত সেই পাত্রটি পরিষ্কার করে জল নিয়ে স্নান করে ঘরে এসে বসতে-না-বসতে লোকজনের চেঁচামেচি শুনতে পাওয়া গেল। কাজে যাবার সময় হয়েছে মনে করে বেরিয়ে এসে দেখি সত্যিই মজুরেরা আসতে আরম্ভ করেছে। তাদের দেখে আমরাও গিয়ে আবার ঘাস ছিঁড়তে আরম্ভ করে দিলুম। ইতিমধ্যে দু’তিনটি মজুর ও মজুরানি আমাদের কাছে এসে কি সব জিজ্ঞাসা করলে–তাদের ভাষা শুনে মনে হল মারাঠী-ভাষারই অপভ্রংশ। দুই-চারটে শব্দ যেন চেনা-চেনা মনে হতে লাগল। সেই শব্দগুলির সূত্র ধরে আমরা হিন্দিভাষায় জবাব দিতে লাগলুম। তারা কি বুঝলে জানি না, তবে দু’একজন খুব বিজ্ঞের মতন মাথা নাড়তে লাগল। কিন্তু তাদের সঙ্গে ভাব বেশ জমবার আগেই সর্দারের সাড়া পেয়ে যে-যার কাজে লেগে গেলুম।
আমরা যে জায়গাটিতে ঘাস ছিঁড়ছিলুম সেখানে আরও গুটি দুই-তিন পুরুষ ও নারী কাজ করছিল। তারা আমাদের অনভ্যস্ত হাতের কাজ দেখে মাঝে মাঝে কি সব বলাবলি ও হাসাহাসি করতে লাগল। দুনিয়ায় ঘাস-ছেঁড়ারও ভালো মন্দ আছে।
ভালোই হোক আর মন্দই হোক, কোনোরকমে বিকেলে ছ’টা অবধি কাজ করবার পর সেদিনকার মতো কাজ শেষ হল। আমরা তো একরকম ছুটতে ছুটতে এসে সেই ভাঙা পাত্রে জল তুলে হাত-মুখ ধুয়ে নিজেদের বাসস্থানে এসে ঢুকলুম।
প্রকাণ্ড দরজা বন্ধ করতে গিয়ে দেখি যে, সেটি বন্ধ করবার অসংখ্য হুড়কো, খিল ও ছিটকিনির ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই পুরোনো ও অনেকদিন অব্যবহারে প্রায় অকর্মণ্য হুড়কো প্রভৃতি যথাস্থানে সংযোজন করতে আমাদের তিনজনের প্রায় দম-বন্ধ হবার অবস্থা। কোনোরকমে সেগুলি লাগিয়ে আমরা পূর্বদিকের একটি প্রকাণ্ড জানলা খুলে দিয়ে দাঁড়ালুম।
তখনও সূর্য একেবারে অস্ত যায়নি। অস্তগামী তপনের নিবন্ত আলো এসে পড়েছে গাছের চূড়ায়। আমাদের সম্মুখে দক্ষিণে বামে–যতদূর দৃষ্টি যায় সুদূরপ্রসারী বনশ্রেণী। গাছের পর গাছ–উঁচু নীচু সরু মোটা–সকলে ধরিত্রীমাতাকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দূর-দূর–আরও দূরে পাহাড়ের সারি স্পষ্ট থেকে অস্পষ্ট হতে হতে মেঘলোকে মিলিয়ে সত্য ও কল্পনায় জড়াজড়ি হয়ে গিয়েছে। তারই মধ্যে শত-লক্ষ বিহঙ্গমের কাকলীতে মর্ত্য ও অন্তরীক্ষ পরিপূর্ণ। আমাদের চোখে সেই দৃশ্য ফুটে উঠছে–কানের মধ্যে সেই বিরাট শব্দ পৌঁছচ্ছে বটে, কিন্তু মন শূন্য–চিত্তে এসবের প্রতিক্রিয়া কিছুই হচ্ছে না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ অনুভব করলাম কখন পাখিদের কলরব থেমে গিয়েছে, বনভূমি অন্ধকারে আচ্ছন্ন।
অরণ্যমাতার কোলে আমাদের প্রথম সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। তাড়াতাড়ি জানলা বন্ধ করে দিয়ে সেখান থেকে সরে এলুম। মোমবাতি অনেকদিন আগে থেকেই কেনা ছিল, তাই জ্বালিয়ে নিজের নিজের ধুতি পেতে বিছানা করলুম। আমাদের কারো মুখে কোনো কথা নেই–সকলেরই মন ভারী। মনের কোন্ গহনে বিরাট বেদনা ও অভিযোগ জমা হচ্ছিল। কিসের বেদনা ও কার ওপরে অভিযোগ–তার স্পষ্ট ধারণা নেই। মন যেমন ভারী সেই অনুপাতে উদর তেমনি হালকা তার ওপরে সারাদিনের সেই পরিশ্রমে দেহ ক্লান্ত। শুয়ে শুয়ে এই তিনের ভারসাম্য করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লুম।
.
ভোর হতে তখনও অনেক দেরি কিন্তু পাখিদের বিপুল চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙল বটে, কিন্তু শরীর এত দুর্বল যে, পাশ ফিরতে পারি না। আরও কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে বন্ধুদের ডেকে তুলে মুখ ধুয়ে একটু বসতে-না-বসতে ভোর হয়ে গেল।
আমাদের পরিতোষ একটু ছিমছাম-গোছের লোক ছিল। ধুতি-জামা ছেঁড়া হলেও ওরই মধ্যে সুবিধা পেলেই সে সাবান দিয়ে কেচে পরিষ্কার করে নিত। যতদূর সম্ভব ছেঁড়া জায়গাটুকু ঢেকে সে গুছিয়ে ধুতি পরত। একটি আয়না ও চিরুনি সর্বদা সে কাছে রেখে দিত। স্নান করবার সুবিধা না হলেও সে রুক্ষ চুল চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে রাখত। সেদিন দুপুরবেলা স্নান করে পরিতোষ যখন চুল আঁচড়াচ্ছিল সেই সময় তার আরশিখানা নিয়ে নিজের চেহারা দেখে চমকে উঠলুম। দেখলুম ডান দিকের কানের ওপরে অনেকখানি জায়গা একেবারে সাদা হয়ে গিয়েছে। প্রথম যাত্রার ফলে আমার দাঁতগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, এবারের যাত্রায় চুলে পাক ধরল। অর্থাৎ স্থবির মহাস্থবিরে উন্নীত হল, তখনও আমার সতেরো বৎসর পূর্ণ হয়নি। কিন্তু যেতে দাও সে-কথা–
সেদিন বেলা তখন প্রায় দুটো হবে, আমরা খিদের জ্বালা সহ্য করতে না পেরে একরকম কাঁপতে কাঁপতে সর্দারের কাছে গিয়ে বললুম–হয় আমাদের কিছু খেতে দিন আর না-হয় পয়সা ও ছুটি দিন–আমরা বাজারে গিয়ে কিছু খেয়ে আসি।
সর্দার তখন ঘুমোচ্ছিল। আমাদের চেঁচামেচি শুনে সুখশয্যা ছেড়ে এসে খিদের কথা শুনে প্রথমে তো মহা তম্বি শুরু করে দিলে। শেষকালে একটা লোক ডেকে, তাকে ইকড়ি-মিকড়ি করে কি-সব বললে বুঝতে পারলুম না। শেষকালে আমাদের বললে–এই লোকের সঙ্গে বাজারে গিয়ে জিনিসপত্র কিনে নিয়ে এসো।
আমরা বললুম–পয়সাকড়ি দাও।
সর্দার একবার ‘ও’ বলে, ন’গণ্ডা পয়সা একবার দু’বার তিনবার গুনে আমার হাতে দিলে। আমিও বার-তিনেক পয়সাগুলো গুনে জিজ্ঞাসা করলুম–ন’-আনা কি হিসাবে দিচ্ছেন?
সর্দার বললে–তোমাদের রোজ ছ’পয়সা করে মজুরি। দু’দিনের মজুরি তিন আনা, তিনজনের ‘ন’-আনা।
পয়সা হাতে নিয়ে তো একেবারে হকচকিয়ে গেলুম।
অ্যাঁ! এই ফরেস্ট-ডিপার্টমেন্টে কাজ করে দৈনিক মাত্র ছ’পয়সা! এতে সবাই খাবই বা কি? আর পরবোই বা কি?
কিন্তু ক্ষুধার তাড়নায় তখন আর পরবার কথা চিন্তা করবার অবসর নেই। তখুনি সেই লোকটিকে সঙ্গে নিয়ে ছুটলুম বাজারের দিকে। পথ চলেছি তো চলেইছি। কিন্তু কোথায় বাজার! সঙ্গের লোকটিকে যত প্রশ্ন করি সে কিছুই জবাব দেয় না। অনেক সাধাসাধি করবার পর হয়তো বা যদি কিছু বলে কিন্তু সে-ভাষা কিছুতেই বুঝতে পারি না। শেষকালে প্রায় ঘণ্টা-দেড়েক পথ চলে একটা জায়গায় এসে পৌঁছলুম–শোনা গেল, সেটা নাকি বাজার।
বাজার বললে বটে, কিন্তু দোকানপত্র কোথায়! দু’ একখানা পাতা-ছাউনি ঘর–তারও দরজা অর্থাৎ ঝাঁপ বন্ধ। একটা এইরকম ঘরের সামনে নিয়ে গিয়ে লোকটা আমাদের বললে–এই একটা দোকান।
প্রায় মিনিট পাঁচেক ধরে চেঁচামেচি করার পর দোকানদার দরজা খুলতে আমাদের গাইড তাকে কি বললে। দেখা গেল, খরিদ্দাদের শুভাগমনে লোকটি বেশ উৎফুল্ল হয়ে উঠল। তাকে জিজ্ঞাসা করলুম–ভালো চাল আছে?
সে অবাক হয়ে আমাদের দিকে চেয়ে রইল। বেশ বোঝা গেল যে ‘চাল’ শব্দটি তার কর্ণকুহরে ইতিপূর্বে প্রবেশ করেনি। আমরা খাদ্য, অন্ন, তণ্ডুল, ধান্য ইত্যাদি নানা শব্দ দিয়ে তাকে বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগলুম। ইতিমধ্যে পিলপিল করে চারিদিকে থেকে লোক এসে আমাদের ঘিরে দাঁড়াতে আরম্ভ করলে। আমাদের কথা শুনে তারাও নিজেদের বিদ্যে অনুসারে দোকানদারকে বোঝাতে চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে, সে কিছুতেই বুঝতে পারলে না। শেষকালে চলে যাচ্ছি দেখে সে ঘরের ভেতর থেকে একটা পুঁটলি নিয়ে এসে সেটা আমাদের খুলে দেখাল। দেখলুম তার মধ্যে ধুলোর মতন কালো খানিকটা কী জিনিস পড়ে রয়েছে, তাতে আবার পোকা ধরেছে।
সেটি কী দ্রব্য জিজ্ঞাসা করায় দোকানদার ও আমাদের চারপাশের যত নরনারী দাঁড়িয়ে ছিল সবাই মিলে চিৎকার করে সে-দ্রব্যটির গুণাগুণ বোঝাবার চেষ্টা করতে লাগল। অনেক ধস্তাধস্তির পর বোঝা গেল যে, সে-বস্তুটি বাজরার আটা–খুবই রুচিকর ও পুষ্টিকর খাদ্য। চাল যখন পাওয়া গেল না তখন আপাতত বাজরার আটাই দিতে বললুম এক সের। দোকানদার আবার বাড়ির ভেতর থেকে এক টুকরো পাথর নিয়ে এসে বাটখারার বদলে তাই দিয়ে সেই ধুলোরূপী পুষ্টিকর ও রুচিকর গুঁড়ো ওজন করে দিলে। সেখান থেকে, একপয়সার নুন কিনে বেরোলুম অন্য দোকানের সন্ধানে। পেছনের সেই ভিড়ও চলল আমাদের সঙ্গে।
অনেক বলা-কওয়া ও জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা এক কুমোর-বাড়িতে নিয়ে গিয়ে উপস্থিত করলে। দেখলুম, সেখানে নানারকম মাটির তৈরি জিনিস রয়েছে, কিন্তু হাঁড়ি নেই। অনেক চেষ্টা করেও হাঁড়ি কী দ্রব্য তা বোঝাতে না পেরে শেষকালে আধা-কলসী ও আধা-হাঁড়ি গোছের একটা জিনিস কিনে প্রায় ছুটতে ছুটতে স্টেশনে এসে মুড়ি-ছোলাভাজা ইত্যাদি যা পাওয়া গেল একরকম পেট ভরে খেয়ে নিয়ে দৌড়লুম নিজের ডেরার দিকে।
.
জঙ্গলে গিয়ে যখন পৌঁছলুম তখন সন্ধে হয়ে এলেও একটু আলো ছিল। ওরই মধ্যে একরাশ শুকনো কাঠি জোগাড় করে, নতুন পাত্রে জল ভরে, ঘরে উঠে দরজা বন্ধ করে দিলুম। বাজার থেকে ফিরে আসবার মুখে সন্ধ্যার আবছায়ায় কালীচরণ একটা চিচিঙ্গে ছিঁড়ে এনেছিল। সে বললে–এই রুটি খাওয়ার অভ্যেস তো কখনও নেই, এই চিচিঙ্গের কালিয়া দিয়ে রুটি মারা যাবে।
প্রায় তিনদিন একরকম নির্জলা উপবাসের পর এই মহাভোজের আয়োজন দেখে মনটা খুশিই হয়ে উঠল। যাই হোক, তিনজনে মহা-উৎসাহে আমাদের রান্নাঘর অর্থাৎ পাদরিদের ভূতপর্ব পায়খানা-ঘরে তো ঢোকা গেল। তখনো ঘরের মেঝেতে দুটো-তিনটে কমোডের দাগ ঝকমক করছিল, কিন্তু জীবনে উন্নতি করতে গেলে ওসব ছোটখাটো দাগকে গ্রাহ্যের মধ্যে আনলে চলবে না।
হাত-পা মোছা ও সর্দার-প্রদত্ত সেই তিন-গাছা ঝাঁটার কাঠি দিয়ে ঘরের মেঝে যতখানি পরিষ্কার করা সম্ভব তা করে রান্নার জন্য প্রস্তুত হলুম। উনুনের জন্য তিনখানা পাথর আগেই সংগ্রহ করে রাখা হয়েছিল। ঠিক হল আধখানা চিচিঙ্গে এখন রাঁধা হবে আর আধখানা ভবিষ্যতের জন্য রেখে দেওয়া হবে। কিন্তু আধখানা চিচিঙ্গে ছুরি দিয়ে কুচিয়ে মনে হল রান্না হবে কিসে! পাত্র কোথায়? রাঁধবার একটা পাত্র কিনে আনা হয়নি বলে আফশোস হতে লাগল। শেষকালে সর্দারের দেওয়া হাঁড়ির অংশ–যা এই দু’দিন আমাদের জলপাত্রের অভাব দূর করেছে, তাইতে জল দিয়ে আগুনে চাপিয়ে দেওয়া গেল। জল একটু সোঁ সোঁ করতেই কুচনো চিচিঙ্গে, তাতে ছেড়ে দিয়ে নুন দিয়ে আমরা আটা মাখবার বন্দোবস্ত করতে লাগলুম।
মাটিতে কোঁচার খুঁট পেতে তাতে সেই ধুলোরূপী বাজরার গুঁড়ো ঢেলে একটু একটু করে জল দিয়ে মাখবার চেষ্টা করতে লাগলুম। মধ্যে মধ্যে উনুনে কাঠি দেওয়াও চলতে লাগল। ছোট করে লেচি করে থাবড়ে-থুবড়ে রুটি গড়বার চেষ্টা করছি–উনুন থেকে সোঁ-সোঁ শব্দ আসছে–মধ্যে মধ্যে কাঠি দিয়ে এক-আধটুকরো তরকারি নামিয়ে দেখা হচ্ছে–সেদ্ধ হয়েছে কি না। কখনও-বা পরামর্শ করছি যে রুটিগুলো সেঁকা হবে কি করে!–ঠিক হল যে জলপাত্র ঢাকা দেবার জন্য খুরির মতো যে-পাত্রটা আনা হয়েছে আজকের মতন সেটাতে তরকারি রেখে, যে হাঁড়িভাঙায় তরকারি রান্না হচ্ছে সেইটেতেই কোনোরকমে রুটিগুলো সেঁকে নেওয়া যাবে–এইরকম নানা কথা চলেছে–এমন সময় টাই করে এক বিরাট আওয়াজে চমকে উঠলুম। পরমুহূর্তেই অর্থাৎ চমক ভাঙবার আগেই একটি বজ্রনির্ঘোষ এবং তারপরেই অগ্নিবৃষ্টি–মুহূর্তের মধ্যে আমাদের মুখ হাত পিঠ গরম চিচিঙ্গে-চূর্ণে চড়চড়িয়ে উঠল।
–বাপরে–বলে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এসে চিচিঙ্গের টুকরোগুলো গা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলুম। তারপর ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি–মেঝেতে তরকারির টুকরোগুলো পড়ে রয়েছে। সেই ভাঙা হাঁড়ির কানা–আবর্জনা বহন করে যার শেষজীবন কাটছিল–অতিরিক্ত চাপ সহ্য করতে না পেরে সে দেহরক্ষা করেছে।
ভাবতে লাগলুম–হাঁড়ি-ভাঙা তো দেহরক্ষা করলে কিন্তু আমাদের দেহরক্ষার উপায় কি তখন সেই নিবন্ত আগুনে ময়দার ঢেলাগুলো পুড়িয়ে নিয়ে আর আধখানা চিচিঙ্গে যে ছিল তাই দিয়ে দু’দিন নিরম্বু উপবাসের পর পরমানন্দে পারণে প্রবৃত্ত হলুম।
প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি যে সে-যুগে কলকাতার বাঙালি হিন্দুরা এমন সর্বভুক্ জাতিতে পরিণত হয়নি। চিচিঙ্গে জিনিসটা অনেক হিন্দুর বাড়িতে ঢুকতেই পেত না। অনেকের বাড়িতে সভয়ে ঢুকত–কেন তার কারণ বলতে পারি না।
যাই হোক, সে-রাত্রে রান্না করার চেষ্টা করে আমরা বুঝতে পারলুম যে নিজে রান্না করে খেয়ে এখানে কাজ করা চলবে না।
সকালবেলা সর্দার আমাদের কাজের তদন্ত করতে এলে তাকে কাল রাত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বললুম–রোজ রান্না করে খাওয়া আমাদের দ্বারা সম্ভব হবে না। আমরা ঠিক করেছি–সকালে কিছু খাব না, রোজ বিকেলে স্টেশনে গিয়ে খেয়ে আসব। আমাদের বেলা চারটের সময় ছুটি দিতে হবে আর সেই সময় রোজের মজুরি চুকিয়ে দিতে হবে।
সর্দার অনেক ভেবেচিন্তে বললে–আচ্ছা তাই হবে, কিন্তু সকালবেলা কিছু না খেয়ে কাজ করবে কি করে?
বললুম–ছ’পয়সা মজুরিতে একবেলাই পেট ভরে খাওয়া হয় না, তো দুবেলা!
সর্দার চটে বললে–এত লোক ওই মজুরিতে দুবেলা পেট ভরে খাচ্ছে–আর তোমরা কি নবাব এসেছ যে ওতে দুবেলা খাওয়া হয় না? তোমাদের সেধে কেউ এখানে আনেনি! ওতে পোষায় তো কাজ কর–নইলে সোজা রাস্তা পড়ে রয়েছে–সরে পড়।
সেদিন বেলা চারটের সময় সর্দারের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে ইস্টিশনে গিয়ে সেই তল্লাটে খুঁজে খুঁজে রুটি-গোস্ত-এর দোকানে বসে আহার করা গেল। তিনজনে মিলে সেখানে দু’আনার খেয়ে পরদিন দুপুরবেলায় খাবার জন্য এক আনার রুটি কিনে নিয়ে ফিরে এলুম। আমাদের থাকবার জায়গায় এসে তখনো অনেকখানি বেলা রয়েছে দেখে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে বেড়াতে লাগলুম।
সেখানকার একটা দৃশ্য আজও মনের মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। এক জায়গায় দেখা গেল–একটা বিরাট গাছকে বেড়ে একটা লতা ওপরে উঠে নিজের ডালপালা দিয়ে গাছটার ডালপালাকে একেবারে ঢেকে দিয়েছে, আর সেই লতায় ফুটেছে ছোট ছোট সাদা ফুল। এত ফুল যে, গাছ আর লতা সে-ফুলে একেবারে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। ওপর থেকে সেই ফুল ঝরে-ঝরে গাছটার চারিদিকের মাটিতে যেন ফুলের বিছানা পাতা হয়েছে। আর সেই ফুলের সৌরভে বন আকুল হয়ে উঠেছে। আমরা কাছে যাওয়ামাত্র মৌমাছির দল ভোঁ-ও-ও করে আপত্তি জানাতেই পেছু ফিরে একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালুম। তারপর সেই ফুল-সৌরভে মন-প্রাণ-দেহ ভরে নিয়ে নেশায় টলতে টলতে ডেরায় ফিরে এলুম।
ফুলের গন্ধে নেশা লেগেই হোক কিংবা কয়েকদিন অনশন ও অর্ধাশনের পরে শত শরতের পুরাতন বলদের মাংস পেটে পড়েই হোক–ঘরে এসে দোর-জানলা দিয়ে বসতে-না-বসতেই আমাদের কালীচরণের কিরকম ভাবদশা লেগে গেল। সে শুরু করে দিলে–কি ছার আর কেন মায়া-কাঞ্চনকায়া তো রবে না।
অনেককাল আগে পাড়ায় একবার বিল্বমঙ্গল না ওই নামে কি-একটা নাটকের অভিনয় হয়েছিল। কালী একটার পর একটা সেই নাটকের গান গাইতে লাগল। সেদিন অনেক রাত্রি অর্থাৎ সন্ধে থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা গল্প করে আমরা শুয়ে পড়লুম।
ঘুমের মধ্যে বিরাট একটা শব্দ কানে যেতে ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লুম। আচমকা ওইরকম আওয়াজে আমি যেন জ্ঞানহারা হয়ে গেলুম। আমার পাশেই যে বন্ধুরা শুয়ে আছে সে-কথা স্রেফ ভুলে গিয়ে ভয়ে দিলুম দৌড়, কিন্তু আছড়ে পড়ে মাথা ও মুখে বিষম আঘাত লেগে সংবিৎ ফিরে পেলুম। ততক্ষণে কালী ও পরিতোষ উঠে মোমবাতি জ্বালিয়ে ফেলল।
সেই স্বপ্নালোকেই দেখতে পেলুম ভয়ে তাদের মুখ শুকিয়ে গিয়েছে আর হাত কাঁপছে একটু একটু করে। আওয়াজ তখনো সমানভাবে চলেছে মনে হতে লাগল–হাজার হাজার রাজহাঁস যেন একটা গলা দিয়ে চিৎকার করে চলেছে।
পরিতোষ ও কালী আমাকে সেইরকম দেওয়ালের কাছে দেখে মনে করেছিল আমার সঙ্গে সেই আওয়াজের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ স্থাপিত হয়েছে। কিন্তু যখন তাদের বুঝিয়ে দিলুম. যে আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে ঘুমের ঘোরে আমি ওইরকম ভাবে ছুটে গিয়েছিলুম তখন তারা কথঞ্চিৎ শান্ত হল।
কিন্তু শান্ত হবার জো কি! ওদের আওয়াজের প্রচণ্ডতা ক্রমেই বাড়তে লাগল। ঘরের পূর্বদিকে চারটে দরজায় বড় বড় সমান আকারের জানলা ছিল। মনে হতে লাগল যেন পালা করে এক-একবার এক-একটা জানলার কাছে আওয়াজ হচ্ছে আর তারই ধমকে জানলাগুলো থরথর করে কাঁপছে।
আমরা আস্তে আস্তে ভূমিশয্যা ত্যাগ করে পা টিপে টিপে ঘরের দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালুম। কেন যে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালুম তা ঠিক জানি না। দরজার কাছে যেতেই জানলার দিকের আওয়াজ কমে গেল। বেশ মনে হতে লাগল আওয়াজটা যেন দূরে সরে যাচ্ছে। একটুখানি প্রাণে ভরসাও এল। কিন্তু তখুনি আমাদের ভ্রম ছুটে গেল। বুঝতে পারলুম যে আওয়াজটা জানলা ছেড়ে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। পরিতোষ অনেক গবেষণা করে বললে-এ মনে হচ্ছে হাঁসভূত।
অতি দুঃখেও হাসি পেল। হংসদূতের কথা শোনা যাচ্ছে, কিন্তু হংসভূতের কথা তো কখনও শুনিনি বাবা! ওদিকে হংসভূতের গর্জনের ঠেলায় মনে হতে লাগল ঘরের মধ্যে যমদূত এসে উপস্থিত হয়েছেন। ভয়ে আমাদের দেহে কালঘাম ছুটতে আরম্ভ করলে। সন্ধ্যাবেলার রুটি-গোস্ত ও কালরাত্রের কাঁচা চিচিঙ্গে ও কাঁচা ময়দার ঠুলি জল হয়ে ‘দেহ বেয়ে ঝরতে লাগল।
কতক্ষণ ধরে এই দুর্ভোগ আমাদের ভোগ করতে হয়েছিল তা ঠিক বলতে পারি না। আমাদের তো মনে হয়েছিল–এই গর্জন শুনতে-শুনতেই জীবন অবসান হবে।
হংসভূতের গর্জন থেমে যাওয়ার পর বুকের ধড়ফড়ানি থামতে থামতে রাত্রিভোর হয়ে গেল।
সকালবেলা কাজে লাগবার খানিক পরে সর্দার যখন রোদে এল তখন তাকে কালরাত্রের অভিজ্ঞতার কথা বললুম। সর্দারের সঙ্গে কথাবার্তা বলছি এমন সময় দেখলুম আমাদের চারপাশে অনেকগুলি মজুর এসে দাঁড়িয়েছে। দেখলুম, আমাদের কথা শুনে তাদের মধ্যে জন্তুর মতো চাঞ্চল্য উপস্থিত হয়েছে। আস্তে কথা বলার রীতি তাদের মধ্যে নেই–তারা নিজেদের ভাষায় সশব্দে কি-সব আলোচনা আরম্ভ করে দিলে। সর্দার একটা বিরাট ধমক ও তাড়া দেওয়ায় তারা যে যার কাজের দিকে চলে গেল। সর্দার আমাদের একটু দূরে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললে–এসব কথা তোমরা ওদের বলেছ নাকি?
–না তো।
সর্দার বললে–খবরদার! ওদের কিছু বোলো না, তা হলে ওরা সব কাজে আসা বন্ধ করে দেবে।
আমরা জিজ্ঞাসা করলুম–ওটা কি জানোয়ার?
সর্দার তার হাঁড়ি-মুখে হাসি আনবার চেষ্টা করে বললে–ও জানোয়ার না, ও হচ্ছে দেও। জঙ্গলে কত রকমের জিনিস আছে তার ঠিক-ঠিকানা নেই।
মনে মনে বললুম–একরকম জিনিসেই যা অবস্থা হয়েছে–
সর্দার বললে–তোমরা কিছুতেই দরজা কিংবা জানলা খুলো না–তা হলে বিপদে পড়বে বলে দিচ্ছি।
সর্দার রোঁদ দিয়ে বাড়ি ফিরে যেতেই চারিদিকে মজুরের দল–যুবক-যুবতী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এসে আমাদের নানারকম প্রশ্ন করতে আরম্ভ করে দিলে। এ কয়েকদিন তাদের কথা শুনে শুনে সে-ভাষা .বলতে না পারলেও কিছু কিছু বুঝতে আরম্ভ করেছিলুম। আমাদের রাত্রের অভিজ্ঞতা শুনে তারা যা বললে–তার তাৎপর্য হচ্ছে–এ জঙ্গলে অনেকদিন থেকেই দেবতারা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে ভেতরের দিকে চলে গেছেন। মাঝে মাঝে ওই বাড়িটাতে এসে কেউ কেউ হানা দিয়ে থাকেন। ওইখানে সায়েবরা থাকত। দেবতারা এসে চলে যেতে বলায় তারা বাড়ি ফেলে চলে গিয়েছে।
মজুরেরা নানারকম মন্তব্য করে চলে গেল।
আমরা তখন একটা লাঙল-চষা জমিতে পাথর ও আগাছা বাছবার কাজে লিপ্ত ছিলুম। আমার কাছেই একটা অল্পবয়সি মেয়ে কাজ করছিল।
তার বয়স, বোধ হয় পনেরো-ষোলো বছর হবে। অত্যন্ত রোগা, কিন্তু বসন্তের বাতাস পেলে যেমন কোনো কোনো শুকনো কাঁটাগাছেও ফুল ধরে, তেমনি তার দেহে যৌবনের আগমনীর সামান্য সুরের আমেজ লেগেছে মাত্র। কাজ করতে করতে একবার দু’জনে খুব কাছাকাছি এসে পড়ায় সে আমাকে কি-যেন বললে। তার কথা ভালো করে বুঝতে না পারায় আমি আরও কাছে সরে যাওয়ায় সে আবার বললে–কাল রাতে কি হয়েছিল তোমাদের?
বললুম–তুমি কি করে জানলে?
সে বললে–সবাই বলছে, কাল রাতে তোমাদের ঘরে নাকি দেও এসেছিল।
বললুম–দেও কি না জানি না, তবে এসেছিল কেউ।
মেয়েটিকে কাল রাত্রের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেই সে দাঁড়িয়ে উঠে তার মাকে ডাকলে। মা দূরে আমাদের ক্ষেতেই কাজ করছিল, মেয়ের ডাক শুনে একরকম ছুটে কাছে এল। মায়ের দেখাদেখি বাপ, একটি ছেলে ও একটি মেয়ে যারা সকলেই কাছাকাছি কাজ করছি–ছুটে এগিয়ে এল। মেয়েটি সকলকে কি-সব বলায় মা এগিয়ে এসে আমাদের বললে–ও-বাড়িতে আর তোমরা থেকো না। দেও বড় সব্বনেশে জিনিস!
আমরা বললুম–কিন্তু সর্দার বলে দিয়েছে ঘরের দরজা বন্ধ থাকলে আর কোনো ভয় নেই–আমরা দরজা কিছুতেই খুলব না।
তারা বলতে লাগল–প্রথম প্রথম মনে হয় বটে কিছুতেই দরজা খুলব না, কিন্তু দেওদের এমন মায়া যে, দরজা না খুলে থাকা যায় না। ওই বাড়িতে পাদরিসায়েবেরা থাকত। কয়েকদিন ভয় পাবার পর দু’তিনজন সায়েব পালাল দু’তিনজন থেকে গেল। একদিন দেখা গেল যে ঘরের দরজা খোলা আর দরজার সামনে দু’জনে মরে পড়ে রয়েছে।
খবরটি শুনে আমরা যে কিরকম খুশি হয়ে উঠলুম সে-কথা বোধ হয় কাউকে আর বুঝিয়ে বলতে হবে না। সর্দার তো বলে গেল–হাজার গোলমাল হলেও দরজা খুলবে না, কিন্তু দেওদের মায়ার প্রভাবে যদি খুলে ফেলি! হায়! হায়! শেষকালে জঙ্গলে এসে ভূতের হাতে প্রাণ খোয়াব! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে সেই চষা মাঠে শুয়ে পড়লুম। কিন্তু সংসারের অনাবিল সুখও যেমন নেই তেমনি অনাবিল দুঃখও দুর্লভ। এই দুঃখের অবকাশেই আমার অরণ্যমাতা রূপ ধরতে আরম্ভ করলেন।
আমাদের অবস্থা দেখে সেই মেয়েটির মা বাবা সবাই সহানুভূতি জানাতে লাগল। তারা বলতে লাগল–ও জায়গায় আর থেকো না। আমাদের বাড়ির কাছেই তোমরা থাকবার একটা ঝোঁপড়ি তৈরি করে নিয়ে সেইখানেই বসবাস কর। আমরা অনেক ঘর সেখানে কাছাকাছি বাস করি বলে দেওরা আর সেদিকে বাস করেন না।
এই বলে তারা বারবার কার উদ্দেশে মাটিতে মাথা ঠুকতে লাগল।
তাদের মন রাখবার জন্য আমরা বললুম–আচ্ছা, তাই করা যাবে–কিন্তু আপাতত ঝোঁপড়ি যতদিন না তৈরি করতে পারছি ততদিন অন্য কোনো একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
সেদিন বিকেলে স্টেশনে গিয়ে ঠিক করা গেল যে, আজ রাতে আর ফেরা নয়। খাওয়া-দাওয়ার পর সেইখানেই তৃতীয় শ্রেণির যাত্রীদের বিশ্রাম করবার ঘরে এক কোণে পড়ে থেকে রাত্রি কাটিয়ে, খুব ভোর থাকতে উঠে বাগানে এসে কাজে লেগে গেলুম।
এইরকম করে তো দিনকয়েক কাটিয়ে দেওয়া গেল। দুপুরবেলা খাবার জন্য খানকয়েক রুটি আনা হত। ঝরনার জলে স্নান করে খাবার জল তুলে আমাদের প্রাসাদে বসে খেয়ে একটু গড়ানো যেত। তারপর আন্দাজমতো উঠে কাজে লেগে বেলা চারটের সময় সর্দারের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে স্টেশনে গিয়ে খেয়ে সেইখানেই শুয়ে পড়তুম। এই ছিল আমাদের নিত্য-কর্ম-পদ্ধতি।
এর মধ্যে কোনো সপ্তাহে দু’বার, কোনো সপ্তাহে বা একবার মেটাজী আসতেন। তিনি এসেই আমাদের ওপর তম্বি লাগাতেন। বলতেন- সর্দার বলছে, তোমরা রোজ দু’ঘণ্টা করে কাজে ফাঁকি দাও। তোমাদের আর ছ’পয়সা করে, ‘রোজ’ দেওয়া চলবে না–আসছে সপ্তাহ থেকে পাঁচপয়সা করে দেওয়া হবে।
মেটাজী আরও বললেন-সর্দার আরও বলছে মন না দিয়ে কাজ করলে সে আর তোমাদের রাখবে না।
আমরা কাজ করতে করতে ভাবলুম যে মেটাজী এলেই তাঁকে আমাদের ‘রোজ’ কিছু বাড়িয়ে দিতে বলব। কিন্তু তিনি এসেই আমাদের ওপর যেরকম চাপ লাগাতেন, তাতে আমরা আর ভরসা করে ‘রোজ’ বাড়াবার কথা তাঁকে বলতে পারলুম না। কিন্তু মেটাজী হাজার চেঁচামেচি করলেও আমরা বেশ বুঝতে পারতুম যে, পাছে ‘রোজ’ বেশি করে চাই তাই আগে থাকতেই এইসব চালের কথা বলে আমাদের থামিয়ে দেবার চেষ্টা হত।
আগেই বলেছি আমাদের সঙ্গে এক ক্ষেতে কাজ করত সেই যে মেয়েটা ও তার মা-বাবা, তাদের সঙ্গে আমাদের পরিচয় ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হচ্ছিল। তারাই একদিন’ এসে বললে–তোমাদের ‘রোজ’ থেকে ওরা দু’পয়সা করে মারে। আমরা সকলেই ‘রোজানা’ দু’আনা করে পেয়ে থাকি।
এসব কথা শোনা সত্ত্বেও আমরা ওই ছ’পয়সাতেই দিন চালিয়ে নিতে লাগলুম। কিন্তু আর বেশিদিন ওরকম চলল না। প্রতিদিন জঙ্গল থেকে স্টেশন এবং স্টেশন থেকে জঙ্গল—এই প্রায় দশ মাইল হাঁটা, তার ওপরে দিনভর রোদে পরিশ্রম, একবেলা প্রায় উপবাস ও সন্ধ্যাবেলায় অর্ধাহার, রাত্রে শয্যাহান পাথরের মেঝেতে শোয়া, এইসব কারণে আমাদের সকলের শরীরই খারাপ হয়ে চলেছিল। কালীচরণ আমাদের মধ্যে বেশ মোটাসোটা কিন্তু সেও খুব রোগা হয়ে পড়ল। স্টেশন থেকে ভোরবেলা জঙ্গলে আসবার সময় আমরা পাঁচ-ছ’মাইল দৌড়েই পার হতুম। কিন্তু ক্রমেই আমাদের গতির বেগ কমে আসতে লাগল। ইদানীং আসতে-যেতে পথে অনেকখানি সময় বিশ্রাম করতে হত।
একদিন আমার অবস্থা এমনি হল যে স্টেশন থেকে আর জঙ্গলে পৌঁছতে পারি না। বন্ধুদের বললুম–আমায় একখানি রুটি দিয়ে তোরা চলে যা। আমি এইখানেই পড়ে থাকি–বিকালবেলা স্টেশনে যাবার সময় আমায় তুলে নিয়ে যাস।
তারা আমার কথা মানলে না। বললে–ধীরে ধীরে নিয়ে যাব।
কিন্তু তখন আমার দু’ পা ও দেহ অবশ হয়ে আসছিল। দু’কদম চলেই আবার বসে পড়লুম।
কালী বললে–আচ্ছা তুই আমার পিঠে চড়।
ধীরে ধীরে তার পিঠে চড়ে দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরলুম। কিন্তু এক রশি পথ যেতে-না-যেতে কালীর অবস্থাও সঙ্কটাপন্ন হয়ে উঠল। সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে একেবারে শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ সেইভাবে পড়ে থেকে সে উঠল বটে, কিন্তু আমাকে আর পিঠে নিতে পারলে না। এবার পরিতোষের পিঠে সওয়ার হলুম। কিন্তু তার অবস্থাও আমাদের চাইতে ভালো থাকবার কথা নয়। কিছুদূর চলতে-না-চলতে সে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বললে–একটু বিশ্রাম করে নিই তারপর আবার চড়িস।
কিন্তু তার অবস্থা দেখে আমি বললুম–এবার আমি নিজেই যেতে পারব।
যাই হোক কোনোরকমে বসে শুয়ে গড়িয়ে হেঁটে কর্মস্থলে তো গিয়ে পৌঁছনো গেল। আমার অবস্থা দেখে সহকর্মীরা সকলেই সহানুভূতি দেখাতে লাগল। কেউ কেউ বললে-তোমাদের ঘরে গিয়ে শুয়ে থাক।
কিন্তু সেই মেয়েটি ও মা বললে না না–তা হলে সর্দার আজকের রোজ দেবে না। তার চেয়ে তুমি এইখানেই বসে থাক। বসে না থাকতে পারলে শুয়ে থাক। সর্দার আসছে দেখতে পেলে আমরা তোমায় তুলে দেব–তখন একটু কাজের ভান করো।
তখুনি আমাদের কাছাকাছি যত মজুর ও মজুরানি কাজ করছিল তাদের মধ্যে খবর চালাচালি হয়ে গেল যে সর্দারকে দূরে দেখতে পেলেই যেন আমাদের সতর্ক করে দেওয়া হয়।
আমি তো আর ক্ষণবিলম্ব না করে মাটিতে দেহ বিছিয়ে দিলুম। কিছুক্ষণ বাদে সর্দারকে দূরে দেখতে পেয়ে সেই মা এসে আমায় তুলে দিলে। তখনো আমার আচ্ছন্ন অবস্থা কাটেনি। তবুও সেই অবস্থাতেই ভূমিশয্যা ছেড়ে উঠে কাজের ভান করতে লাগলুম। সর্দার এসে যথারীতি চেঁচামেচি করে চলে গেল। সবাই মিলে বলতে লাগল–সর্দার চলে গেছে–এবার শুয়ে পড়। বলামাত্র আমি শুয়ে পড়লুম। সেইখানে পড়ে পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম কি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলুম বলতে পারি না। কালীচরণ আমায় ঠেলে তুলে বললে–চল, ঘরে চল।
খানিকক্ষণ বিশ্রামলাভ করায় কথঞ্চিৎ সুস্থবোধ করছিলুম। এতক্ষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলুম বটে, কিন্তু দেহে কোনো তাপ ছিল না। বন্ধুদের সঙ্গে স্নান করে ঘরে উঠে এলুম। ঝরনার ঠান্ডা জলে স্নান করে অনেকটা সুস্থ বোধ করতে লাগলুম। তারপর রুটি আর জল খেয়ে আবার শুয়ে পড়া গেল।
যথাসময়ে উঠে আবার কাজ করতে গেলুম বটে, কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে আবার শরীর খুব খারাপ বোধ করতে লাগলুম। কাছেই সেই রোগা মেয়েটির মা কাজ করছিল। শরীরে আমি যে অস্বস্তি বোধ করছিলুম আমাকে দেখেই সে তা বুঝতে পেরে তার ভাষায় ও ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলে যে এখন আর সর্দার আসবে না–তুমি নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়তে পার।
আমি নিশ্চিন্তে ধরণীর কোলে নিজেকে বিছিয়ে দিলুম।
* * *
তখন দিন প্রায় অবসান হয়ে এসেছে, পাখিদের চিৎকারে বনভূমি সরগরম। চোখ চেয়ে দেখলুম আমার বন্ধুরা ও আরও কয়েকজন মজুর-মজুরানি আমার পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। পরিতোষ বললে–তুই ইস্টিশন অবধি হেঁটে যেতে পারবিনে। আজ রাত্রির মতো এদের বাড়িতে গিয়ে থাক্। সন্ধে হয়ে এসেছে–আমরা চললুম।
সঙ্গে সঙ্গে আমার চারদিকের আরও অনেকে অনেক কথা বলতে লাগল। তাদের ভাষা অবোধ্য হলেও বুঝলুম যে তারা আমায় সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছে। কিন্তু আমি তখন প্রায় অজ্ঞান–নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণ করেছি। তাদের সেই প্রবোধ্যবাক্য কানেই যাচ্ছিল মাত্র, কিন্তু অন্তরে কোনো প্রতিক্রিয়াই হচ্ছিল না। তারপর বন্ধুরা কখন চলে গেল–কখন সেই স্ত্রীপুরুষের দল আমাকে তুলে–কখনও চ্যাংদোলা করে কখনও ঝুলিয়ে–কখনও হিঁচড়ে– কখনও হাঁটিয়ে নিয়ে চলল তাদের ঘরের দিকে। এ-যাত্রার স্পষ্ট চেতনা আমার নেই।
শুধু মনে পড়ে––আমি চলেছি তো চলেইছি। কখনও অর্ধচেতন-কখনও-বা অচেতন অবস্থায়। আমার মনে হচ্ছিল, আমি যেন যুগাযুগান্ত ধরে এই জরাভাব বহন করে চলেছি–এই বন্ধুর পথ বেয়ে–কত জীবন পার হয়ে চলেছি–এর আরম্ভও নেই–শেষও নেই। চলতে চলতে কখনও সম্পূর্ণ জ্ঞানহারা, কখনও-বা পারিপার্শ্বিক বস্তুসমূহ সম্বন্ধে সামান্য চেতনা–তারপরে সম্পূর্ণ অচেতন। যখন সামান্য জ্ঞান ফিরে এল তখন বুঝতে পারলুম আমি একটা ঝোঁপড়ির মধ্যে শুয়ে আছি। মাথার ওপরে পাতার আচ্ছাদন, তারই শত-সহস্র রন্ধ্র দিয়ে অজস্র ধারায় চন্দ্রালোক ঝরে পড়ছে আমার অঙ্গে, আমার চারদিকের মাটিতে–এখানে, ওখানে, সেখানে।
চোখ চেয়েই আমার মুখ দিয়ে মাতৃনাম উচ্চারিত হল। ক্ষীণ কণ্ঠে ডাকলুম–মা–মা!
কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বেরুনো-মাত্র একখানি শীর্ণ-কঙ্কাল-হস্ত আমার কপালে এসে পড়ল। সে-হাতের স্পর্শ কঠিন ও কর্কশ হলেও স্পর্শের অতীত মাতৃহৃদয়ের যে বাৎসল্য-সেই অনুভব আমার মনে শরীরে সঞ্চারিত হয়ে আমায় যেন মৃত্যুর দুয়ার থেকে টেনে নিয়ে এল।
আজ মনে ভাবি সৃষ্টিকর্তা কী অপূর্ব কৌশলে সেই অরণ্যের মধ্যে আমার জন্য একখানি মাতৃহৃদয় সঞ্চিত করে রেখেছিলেন!
আমার অরণ্যমাতা বিড় বিড় করে কি বলতে বলতে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। কিছুক্ষণ বাদেই সেই মেয়েটি, যার মাধ্যমে আমরা এই পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলুম, সে এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে আমার দু’হাত ধরে টেনে তুলে বসালে। আমি ততক্ষণে অনেকটা আরাম বোধ করছিলুম। মেয়েটি তার বাবা ও ভাই সকলে নানারকম প্রশ্ন করতে লাগল।
ছোট একখানা নীচু ঘর-পাহাড়ের গায়ে ঘেঁষা অর্থাৎ একদিকের দেওয়াল হচ্ছে পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে শেওলা ধরে আছে, তাই বয়ে নিরন্তর জল পড়ছে। তাই সেইদিকে বেশ চওড়া একটা নালা করে রাখা হয়েছে, কারণ বর্ষাকালে পাহাড়ের গা বেয়ে বেশ তোড়ে জলধারা নামে। ঘর নীচু–কোনো-রকমে ঘাড় নীচু করে একজন পুরুষমানুষ দাঁড়াতে পারে।
গাছের সরু-সরু ডাল লম্বা ও আড়াআড়িভাবে সাজিয়ে চাল করা হয়েছে। কোনো কোনো ডাল মধ্যে ঝুলে পড়ে সাংঘাতিক খোঁচার মতন হয়ে আছে। অনভ্যস্ত ব্যক্তির চোখে নাকে লাগলে বিষম কাণ্ড হতে পারে। চালের সহস্র অবকাশ দিয়ে আকাশ দেখা যাচ্ছে। ঘরের তিনদিকের দেওয়ালও সেই মেকদারের। ঘরের মেঝে অত্যন্ত স্যাঁতসেতে। তারই মধ্যে একই জাগায় স্রেফ কাঁচা ও শুকনো পাতার শয্যায় একটি বালক ঘুমুচ্ছে–এদেরই ছোট ছেলে। অদূরে এক কোণে একখানা বড় পাথরের ওপরে ছোট্ট একটি মাটির প্রদীপ জ্বলছে। কোণে মেঝে খুঁড়ে উনুন করা হয়েছে। সরু ও ছোট ছোট শুকনো গাছের ডাল জ্বালানো হয়েছে। বাড়ির বড় মেয়ে অর্থাৎ আমাদের সেই প্রথম বন্ধু তারই সামনে বসে রুটি তৈরি করছে। আধ-ইঞ্চি মোটা ও গ্রামোফোনের দশ-ইঞ্চি রেকর্ডের মতো গোল বাজরার রুটি তৈরি হচ্ছে। চাকি নেই বেলুন নেই।–বড় বড় কালো-কালো সেই বাজরার আটার তাল অর্থাৎ লেচি দিয়ে স্রেফ দু’হাতে পটাপট শব্দে পিটে পিটে অদ্ভুত তৎপরতার সঙ্গে রুটি তৈরি করে সেই গনগনে আগুনের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে আবার লেচি ছিঁড়ছে। আশ্চর্য এই যে প্রত্যেকটি রুটি সামন মাপে গ্রামোফোনের দশ-ইঞ্চি রেকর্ডের মতো গোল ও প্রায় আধ-ইঞ্চি মোটা। রুটি তৈরি করতে করতে ঠিক সময়ে বুঝে সে আগুনের রুটিখানা আবার উল্টে দিচ্ছে।
আমি বসে বসে সেই দৃশ্য দেখছিলুম, এমন সময় আমার অরণ্যমাতা উঠে গিয়ে ঘরের কোণ থেকে একটা সদ্য-ভাঙা গাছের ডাল টেনে নিয়ে এসে তা থেকে পড় পড় করে কতকগুলো পাতা ছিঁড়ে নিয়ে হাতের তেলোয় ফেলে দু’হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সেগুলোকে থেঁতো করতে আরম্ভ করে দিলে।
কিছুক্ষণ এই প্রক্রিয়ার পর পাতাগুলো নরম হয়ে এলে আমাকে হাঁ করতে বললে। তারপর কয়েক ফোঁটা সেই পাতার রস নিংড়ে আমার মুখে দিয়ে বললে।–যা এবার তুই ভালো হয়ে যাবি।
আরও কিছুক্ষণ কাটবার পর রুটি তৈরি হয়ে গেল। সবার ভাগে একখানা করে রুটি। সেই পাঁচবছরের শিশু ও ঘরের কর্তা–আধবুড়ো, সবারই সমান ভাগ। বলা বাহুল্য আমিও একখানা রুটি পেলুম। কালো কাঠের মতো শক্ত বাজরার রুটি, তার মধ্যে এক-আধটা আস্ত বাজরা বা বাজরার খোসা খোঁচার মতো সিং উঁচিয়ে রয়েছে যা বেকায়দায় গলায় বেঁধে গেলে সাংঘাতিক মাছের কাঁটার কাজ হতে পারে। আমি অন্য সবার দেখাদেখি তাই একটু একটু ভেঙে মুখে দিয়ে খেতে আরম্ভ করে দিলুম। খেতে খুব খারাপ নয়, তার ওপর খিদের মুখে সে-খাদ্য অমৃতের মতন লাগতে লাগল। বিনা তরকারিতে খেতে অসুবিধা হচ্ছে বুঝতে পেরে মেয়েটি তার মাকে কি বললে। মেয়ের কথা শুনে মা কাছেরই একটা ছোট্ট গর্ত থেকে কি-সব বেছে বেছে তুলে আমার হাতে দিয়ে বললে–এই দিয়ে খাও ভালো লাগবে।
দেখলুম কালো-কালো কতকগুলো নুনের টুকরো।
আমাকে সেই নুনটুকু দেওয়ামাত্র ছেলেমেয়েরা সকলেই বায়না ধরলে। তখন মা আবার সেই গর্ত থেকে, কারুকে বেছে–কারুকে মাটি চেঁছে নুন দিয়ে, নিজে খানিকটা সেই নোনতা মাটি চেঁছে নিয়ে তাই টাকনা দিয়ে-দিয়ে রুটিখানা খেয়ে ফেললে।
একখানা সেই রুটি খেতে আমার প্রায় পনেরো মিনিট সময় লেগে গেল ও পেটও ভরে গেল। কিন্তু অন্য সবাই দেখলুম দু’ তিন মিনিটের মধ্যেই রুটি নিঃশেষ করে ফেললে। সকলেরই, এমনকি সেই পাঁচ-ছ’বছরের বাচ্চাটারও মুখ দেখে মনে হল যে খেয়ে তাদের পেট ভরল না। আরও অন্তত গড়ে দু’খানা করে রুটি খেতে পারলে হত। কিন্তু উপায় নেই!
ঘরের কোণে একরাশ শুকনো পাতা জড়ো করা ছিল। আমি এতক্ষণ মনে করেছিলুম যে উনুন জ্বালাবার জন্যে সেগুলি সংগ্রহ করে রাখা হয়েছে। কিন্তু খাওয়ার পরই দেখা গেল, এক-একজনে দু’হাতে করে এক এক বোঝা পাতা তুলে এনে, একটুখানি করে জায়গায় তাই বিছিয়ে বিছানার মতন করে সেখানে যে-যার শুয়ে পড়ল। মাথায় বালিশ নেই, ভূমির ওপর একখণ্ড ছেঁড়া বস্ত্র পর্যন্ত নেই।
তাদের কাণ্ড দেখছি–এমন সময় আমার অরণ্যমাতা একবোঝা পাতা এনে এক কোণে বিছিয়ে আমায় ইঙ্গিতে বললে–শুয়ে পড়।
ঘরের কোণে টিমটিম করে একটা মাটির প্রদীপ জ্বলছিল, সেটাকে ফুঁ দিয়ে নিবিয়ে সেও শুয়ে পড়ল। আমি কোঁচা খুলে সেই পাতাগুলোর ওপর বিছিয়ে শুয়ে পড়লুম। যদিও মাটিতে বিনা উপাধানে শোওয়া অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল–তবুও সেই প্রায়-ভিজে মাটির ওপর শুতে প্রথমটা বেশ অসুবিধা হতে লাগল। কিন্তু কিছুক্ষণ এ-পাশ করতে-করতেই চিন্তার সমুদ্রে ডুবে গেলুম–দেহের অসুবিধার কথা আর মনেই রইল না।
ঘরের মধ্যে অন্ধকার, এক কোণে সেই উনুনের আগুন ভস্মরাশির ভেতর থেকে একটু চকচক করছে, আমার চারপাশে প্রায়-নগ্ন কয়েকটি নরনারীর কঙ্কাল পড়ে রয়েছে। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর আধপেটা-সিকিপেটা খেয়ে স্রেফ শ্রান্তিতে গভীরঘুমে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। বাইরে নিস্তব্ধ বনানী স্তব্ধ নিঃঝুম–তারই মধ্যে মাঝে মাঝে কিসের যেন চিৎকার উঠছে–হয়তো কোনো রাতপাখির কিংবা কোনো জানোয়ারের কিংবা কোনো ‘দেও’–সবই হতে পারে।
আমার চোখে ঘুম নেই। সমস্তদিনই ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। মাথার মধ্যে নানারকম চিন্তা এসে জুটতে লাগল। মনে হতে লাগল–আমি কোথাকার লোক–কেমন করে এদের মধ্যে এসে এখানে রাত্রে শুয়ে আছি! কী অসম্ভব সংঘটন আমার চারপাশে এই যে যারা শুয়ে আছে, যারা কিছুদিন আগে পর্যন্ত সম্পূর্ণ অপরিচিত ছিল, অথচ আজ তারা পরমাত্মীয়ের মতন আমার জীবন রক্ষা করেছে,–এদের সঙ্গে আমার কিসের সম্বন্ধ! কোন্ অজ্ঞাত বন্ধনের মায়ায় আমার প্রতি বাৎসল্য জেগে উঠেছে এই অরণ্যমাতার হৃদয়ে! এই পরিবারের ছেলেমেয়েরা সকলেই আমাকে ভাইয়ের মতন শুশ্রূষা করে সুস্থ করবার চেষ্টা করছে। ভাবতে ভাবতে এদের প্রতি, এমনকি সেই বনভূমির প্রতি আমি যেন আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করতে লাগলুম।
মনে হতে লাগল–কোনো জন্মান্তরে এই বনভূমিই ছিল আমার মাতৃভূমি, এখানকার ছেলেমেয়েরা ছিল আমার সেদিনের খেলার সঙ্গী ও সঙ্গিনী। বিশেষ করে এই পরিবারের সঙ্গেই ছিল আমার বিশেষ সম্বন্ধ! সেই আকর্ষণেই আজ আমি অভাবিতরূপে এদের আশ্রয়ে এসে পড়েছি। তা না হলে আজ আমি অসুস্থ না হয়ে পরিতোষ কিংবা এদের মধ্যেই যে-কেউ অসুস্থ হয়ে পড়তে পারত। ভাবতে লাগলুম–এখান থেকে কিছুদূরেই তো সুন্দরী বোম্বাই নগরী; কিন্তু সেখানকার সুখ-দুঃখ-ভোগ-ঐশ্বর্য-সমারোহের কিছুই এরা জানে না। সেখানকার জীবনযাত্রার কোনো প্রতিক্রিয়াই এদের জীবনযাত্রায় প্রতিফলিত হয়নি। সকাল-সন্ধ্যা দু’খানা মোটা-মোটা অখাদ্য বাজরার রুটি-তাও আবার বিনা তরকারিতে যেখানে একদিন সামান্য একটু নুন রাখা হয়েছিল সেখানকার মাটি চেঁছে নিয়ে তাই দিয়ে খাওয়া–এমনি করে একদিন এই মাটিতেই এখানকার জীবন শেষ করে দিয়ে চলে যাবে। ভাবতে ভাবতে আমার মাথা গরম হয়ে উঠতে লাগল। কয়েকবার উঠে বসলুম। সেই জীর্ণ কুটিরের চাল ও আশপাশের দেওয়ালের শত-সহস্ৰ ফাঁক দিয়ে ঘরের মধ্যে অজস্রধারায় চন্দ্রকিরণ বর্ষিত হচ্ছিল। সেই আলোতে দেখতে লাগলুম চারদিকের ঘুমন্ত সেই মানুষগুলিকে–অনেক বাল্যকালে রাত্রে ঘুম থেকে জেগে উঠে যেমন দেখতুম আমার আপনজনকে। আবার আমি এদের মধ্যে ফিরে এসেছি। এই ফিরে আসার মধ্যে কোনো প্রাকৃতিক রহস্য, কোনো ইঙ্গিত কি লুকিয়ে আছে?
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করতে লাগলুম–এদের অবস্থা, এদের দারিদ্র্য দুঃখ দূর করবার চেষ্টা করতে হবে। এই উদ্দেশ্যেই সৃষ্টিকর্তা আমায় এদের মধ্যে এনে ফেলেছেন। এদের নগ্ন অঙ্গে বস্ত্র দিতে হবে, অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়াবার শক্তি জাগিয়ে তুলতে হবে এদের বুকে। এইসব কথা চিন্তা করতে করতে আনন্দে আমার বুকের মধ্যে গুরুগুরু করতে লাগল, কাঁপতে কাঁপতে আবার শুয়ে পড়লুম।
একদিন এই সংকল্প মনের মধ্যে নিয়ে সংসার-সমুদ্রে জীবন-তরণী ভাসিয়েছিলুম। তারপরে সুখ-দুঃখ, শোক-তাপ, ভোগ-দুর্ভোগ, সাচ্ছল্য-দারিদ্র্যের তরঙ্গাঘাতে চলেছিলুম –কখনও স্রোতের মুখে কুটোর মতন, কখনও-বা তরঙ্গের বিপরীতে। কখনও এসেছে তমসাময়ী ঝটিকাচ্ছন্ন রাত্রি, কখনও-বা নাতিশীতোষ্ণ আনন্দময় স্নিগ্ধোজ্জ্বল প্রভাত। ঘাটে ঘাটে, বন্দরে বন্দরে নতুন অভিজ্ঞতাসম্ভার বোঝাই করে–অতীতে কখনও কোনো একদিন কোনো দীনদরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েদের অন্তরে ভাই বলে আলিঙ্গন করেছিলুম, তাদের মাকে মা বলে মেনেছিলুম–তাদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করব, তাদের অবস্থার উন্নতি করব বলে একদিন গভীর রাত্রে নিজের অন্তরের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলুম–কোথায় মনের কোন্ অতলে তলিয়ে গেল–তার অস্তিত্ব–তার লেশমাত্রও মনে রইল না।
তাদের স্থানে কত লোককে ভাই বললুম, কত শয়তানকে আলিঙ্গন করলুম ভাই বলে, কত মহৎকে পদাঘাত করলুম শত্রু বলে। এমনি করে বহুদিন–বহু-বৎসর দুর্লভ মানবজীবনের তৃতীয়াংশ ক্ষয় করে একদিন জীবন-তরণী চড়ায় আটকে গেল। আকস্মিক বজ্রপাতের মতন অভাবিতরূপে মনে পড়ে গেল সেই আমার জীবন-প্রভাতের ফেলে আসা দিনটির কথা। সেই কথাটিই আগে শেষ করি।
.
কল্যাণে এসে দু’টি বিষয়ে আমার যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল–তার একটি হচ্ছে অতিলৌকিক, আর একটি ইহলৌকিক। অতিলৌকিক অভিজ্ঞতার সূত্রপাত ঠিক কবে হয়েছিল বলতে পারি না, তবে হংসভূতের কণ্ঠে তার প্রথম সরব আমন্ত্রণ শুনেছিলুম। পরবর্তী জীবনে এই অদৃশ্য রহস্যের বিপুল বৈচিত্র্য অনুভব করলেও সে-দেশের কথা আজও আমার বুদ্ধির অগম্য হয়ে আছে।
.
দিন-কয়েকের মধ্যেই আমি অপেক্ষাকৃত সুস্থ হলুম।
আমি, কালী আর পরিতোষ–তিনজনে মিলে পরামর্শ করে স্থির করলুম– এখানে সমস্ত দিন বিরামহীন পরিশ্রমের বিনিময়ে ছ’পয়সা রোজগার করি। একদিন অন্তর একবেলা চালভাজা কিংবা চিঁড়ে খেয়ে কাটাতে হয়। এর চেয়ে বোম্বাইয়ে গিয়ে মুটেগিরি করব। স্টেশনে মুটের কাজ করলে পরে দৈনিক এক-একজন একটাকার চেয়েও বেশি রোজগার করতে পারে। ইদানীং সর্দার হপ্তায় একদিন করে আমাদের মাইনে চুকিয়ে দিত। সন্ধেবেলায় এক হপ্তার মাইনে পেয়ে তাকে বললুম–আমরা আর এখানে কাজ করব না।
সর্দার বললে–আচ্ছা–যা।
তিনজনের পয়সা একত্র করে প্রায় টাকা-দেড়েক হয়েছিল। বোম্বাই যাওয়ার ট্রেনের ভাড়া তাতে কুলোয় না। সুতরাং বিনা-টিকিটের তিন যাত্রী হয়ে বোম্বাইগামী এক ট্রেনে চড়ে বসা গেল। ট্রেনটা ছিল প্যাসেঞ্জার গাড়ি। অনেক দেরি করে শহরের মধ্যে এসে পৌঁছল।
দাদর স্টেশনে আমাদের পাশের কামরা থেকে জনকয়েক বিনা টিকিটের যাত্রীকে টিকিট-চেকাররা নামিয়ে নিয়ে গেল দেখে আমরা টপ্প্ করে ট্রেন থেকে নেমে প্ল্যাটফরমের দেয়ালে আঁটা বিজ্ঞাপন পড়তে লাগলুম।
ট্রেন চলে গেল, ভিড়ও পাতলা হয়ে গেল। আমরাও সাবধানে প্ল্যাটফরম থেকে বেরিয়ে পড়লুম।
এখন চিন্তা হল রাতটা কোথায় কাটাই! স্থির করা গেল নবাব-বিল্ডিং-এ কুঞ্জবাবুর ওখানে একবার ঢুঁ-মারা যাক। আমরা ভদ্রলোকের ছেলে জেনে-শুনে যেরকম চাকরি আমাদের জুটিয়ে দিয়েছিলেন সেজন্য তাঁর প্রাপ্য ধন্যবাদটা তাঁকে দেওয়া উচিত। ওখানে ফাঁকা ঘর যদি থাকে তো সেইখানেই রাতটা কাটানো যাবে। নচেৎ ভিখিরিপাড়ায় গিয়ে রাস্তায় শুয়ে থাকব। চেহারা ও পোশাকের যা খোলতাই হয়েছে তাতে সেখানে আমাদের বিশেষ বেমানান হবে না।
চলতে চলতে নবাব-বিল্ডিং-এর কাছে পৌঁছনো গেল। বাইরে থেকে দেখলুম–লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের দরজা-জানলা সব বন্ধ। ভেতরে কোনো আলোও জ্বলছে না। বুঝলুম এ-সময়ে কুঞ্জবাবুর দেখা পাওয়া যাবে না। ‘জয় তারা’ বলে বাড়ির মধ্যে তো ঢুকে পড়া গেল।
ভেতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার, অবারিত সিঁড়ি। পা টিপে টিপে আমরা ওপরে উঠতে লাগলুম। মাঝে মাঝে অন্ধকার এত ঘন যে দেশলাই জ্বালাতে হচ্ছিল। এইসব বাড়ি কারুর থাকবার জন্য তৈরি হয়নি। এখানে প্রত্যেক তলায় বড় বড় ঘর ব্যবসাদারদের ভাড়া দেবার জন্য। কোথাও দোকান হয়, কোথাও আপিস বসে। দোতলায় উঠে কুঞ্জবাবুর ঘরের কাছে গিয়ে দেখলুম যে দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতলায় দু’ একখানা ঘরে তালা লাগানোও দেখতে পেলুম। তখন তেতলার দিকে অগ্রসর হওয়া গেল।
সেখানে রাস্তার ধারের ঘরখানা তখনও খালি পড়ে ছিল। দরজা-জানলা সব খোলা। মেঝেতে ক্লান্তদেহ বিছিয়ে দেওয়া গেল।
শুয়ে শুয়ে মনে হতে লাগল–কোথাকার কে নবাব, তার এই বিল্ডিং–কোথাকার কোন্ দূরদেশের ছেলে আমরা অন্ধকার এই ঘরে পড়ে আছি। এখন যদি এর মালিক পুলিশ নিয়ে এসে আমাদের গ্রেফ্তার করে! কথাটা ভাবতেও শিউরে উঠলুম। ওদিকে ‘বাবা কালী’র নাসারন্ধ্র ঘন ঘন গর্জন করে জানিয়ে দিতে লাগল : যা হবার তাই হবে–এখন তো ঘুমিয়ে পড়।
খুব ভোরবেলা উঠে আমরা গরম গরম চা খেয়ে দোকানেই খানিকক্ষণ কাটিয়ে কুঞ্জবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এলুম। মনে করেছিলুম আমাদের দেখে তিনি খুব আশ্চর্য হয়ে যাবেন, কিন্তু তাঁকে দেখে মনে হল–তিনি যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছেন।
আমরা বললুম–খুব চাকরি জুটিয়ে দিয়েছিলেন যা হোক! দৈনিক ছ’পয়সায় কী খাব, কীই-বা পরব।
তিনি সে-কথার জবাব না দিয়ে বললেন–কিন্তু তোমরা বাপু কিরকম বাড়ির ঠিকানা আমাকে দিয়েছিলে?
আমরা আশ্চর্য হবার ভান করলুম।
তিনি বললেন–আমি কলকাতায় আমার বাড়িতে চিঠি দিয়েছিলুম তোমাদের খোঁজ করবার জন্য। কিন্তু তারা গিয়ে জেনেছে–ও-নামের ঠিকানায় কেউ থাকে না। আমাকে তা হলে তোমরা মিথ্যে ঠিকানা দিয়েছিলে!
এবার স্বরূপমূর্তি বার করতে হল।
–আমাদের ঠিকানা কেন চেয়েছিলেন?
তিনি বললেন–তোমরা এখানে কষ্ট পাচ্ছ সে-কথা তোমাদের বাড়িতে জানিয়ে দেওয়া উচিত বিবেচনা করলুম।
বললুম–কষ্ট পাচ্ছি বলেই তো আপনার শরণাপন্ন হয়েছিলুম। বাড়িতে জানবার হলে তো আমরা নিজেরাই জানাতুম।
আমাদের কথা শুনে ভদ্রলোক আর কোনো জবাব দিলেন না। তিনি নীরবে ঘরের কাজ করতে লাগলেন, আমাদের সঙ্গে আর কথাও বললেন না।
ধীরে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালুম।
অতঃপর কী করা যায়!
স্টেশনের দিকে পা চালিয়ে দেওয়া গেল।
মনের মধ্যে নবীন আশা নবীন উৎসাহ, জীবনের নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করব। ওঃ কী উন্নতি! ভদ্রলোকের ছেলে–সুখে বিছানায় শুয়ে দুবেলা রাঁধা ভাত ছেড়ে দিয়ে এসে আজ ঝাঁকামুটে হতে চলেছি।
ঝাঁকামুটে বললেও অত্যুক্তি হয়, কারণ ঝাঁকা তখনও কেনা হয়নি। ঠিক করা আছে–স্টেশনে মুটেগিরি করে কিছু পয়সা জমিয়ে ঝাঁকা কেনা হবে।
পায়ে পায়ে স্টেশনে পৌঁছনো গেল। রাস্তার দিকে প্ল্যাটফরমে গিয়ে দেখি লোকজন খুবই চঞ্চল হয়ে এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করছে। ক্যালকাটা মেল অর্থাৎ কলকাতায় যেটা বোম্বাই মেল তা এখনও এসে পৌঁছায়নি। কুলিরা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘ বলিষ্ঠ চেহারা তাদের। তাদের সামনে আমরা কিছুই নই। তবুও আমরা কোঁচা খুলে সেইটেকে বিড়ের মতন পাকিয়ে তাদেরই পেছনে একজায়গায় দাঁড়ালুম।
কিছুক্ষণের মধ্যে দূরে ট্রেন দেখা গেল।
মহাস্থবির জাতক। ৫৫৩ তারপরই বিরাট শব্দ করে ট্রেন ঢুকে পড়ল স্টেশনের মধ্যে–সঙ্গে সঙ্গে প্যান্ডিমোনিয়াম খাঁচা ছাড়া।
প্ল্যাটফরমে গাড়িখানা ঢুকতেই স্টেশনে যে লোকগুলো এতক্ষণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিল তারা সব যেন দিগ্বদিকে ছুটোছুটি আরম্ভ করে দিলে। আমরাও যাত্রীগাড়ির একটা একটা জানলার ফাঁক দিয়ে তিন-চারজন বাঙালি প্যাসেঞ্জারকে লক্ষ্য করে দৌড়তে লাগলুম।
স্টেশনের মধ্যে গাড়ি ঢুকেই আধমিনিটের মধ্যেই থেমে গেল। গাড়ি থামতেই লোকজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে দেখলুম–সত্যিই তারা বাঙালি যাত্রী। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে বললুম–দেখুন, আমরা বাঙালি মুটে। আমাদের এরা মোট বইতে দেয় না।
কে দেয় না?–বলেই এক ভদ্রলোক তাঁর সুটকেসটা আমাকে দিয়ে বললেন–এইটে নিয়ে বাইরে চল।
ঘরের মধ্যে প্ল্যাটফরমের কুলি যে দু’চারজন উঠেছিল, তারা আমার হাত ধরে ওদের বললে–না বাবু, তা হতে পারে না, এখানে মুটেগিরি করতে হলে লাইসেন্স নিতে হবে। বলেই লোকটা আমার কাঁধ খিমচে ধরে-’যা বাহার’–বলে আমাকে কামরার ভেতর থেকে বাইরে ছুঁড়ে ফেললে।
আমি ছিকে গিয়ে একটা ভিড়ের মধ্যে পড়লুম। সম্বিৎ ফিরে আসতেই দেখলুম আমাদের কালীচরণের মুখখানা হয়ে উঠেছে ক্রুদ্ধ চিতাবাঘের মতো এবং সে একাধারে কতকগুলো প্ল্যাটফরমের কুলিকে কামড়ে খিমচে মেরে অস্থির করে তুলেছে। কোনোরকমে জড়িয়ে ধরে কালীকে তো থামানো গেল।
ওদিকে আমাদের ঘিরে বেশ বড়রকমের একটা ভিড় জমে উঠেছিল। কি ভাগ্যি–পুলিশ তখনও আসেনি। কারণ শহর তো দূরের কথা–ভিক্টোরিয়া টার্মিনাস স্টেশনেও সবসময় পুলিশের ভিড় লেগেই থাকে।
সকলেই হাত-পা মুখ নেড়ে আমাদের বুঝিয়ে দিতে লাগল যে, লাইসেন্স না হলে স্টেশনের মধ্যে কারুকে মুটেগিরি করতে দেওয়া হয় না এবং লাইসেন্সড্ কুলিরও কেউ জামিন হওয়া চাই।
এক সেকেন্ডই আমরা “নিচল বলিয়া উচলে উঠিতে পড়িনু অগাধ জলে।”
আর বাক্যবয় করা বৃথা এই ভেবে ভিড় ঠেলে বাইরে আসছিলুম। এমন সময় একটি লোক, মোটা-সোটা তার দেহ, বোধহয় পাগড়ি বাঁধবার চেষ্টা করা হচ্ছিল কিন্তু তাড়াতাড়িতে তা আর হয়ে ওঠেনি। মাথার সবখানিই প্রায় দেখা যাচ্ছে। গায়ে জামা পরা, গলায় একটা পৈতে ঝুলছে–যার শেষ অবধি গিয়ে পৌঁছেচে পায়ের গাঁটের কাছে–”কি হয়েছে, কি হয়েছে?”–বলতে বলতে রণাঙ্গনে প্রবেশ করল।
অবিশ্যি তার অঙ্গে যথোচিত ফতুয়া, হাকোট ইত্যাদি চড়ানো। তিনি আসরে প্রবেশ করা-মাত্র দু’চারজন করে এগিয়ে এসে বললে–এরা কুলিগিরি করছে। আমরা ধরে ফেলেছি। এরই মধ্যে একজন কুলি চেঁচিয়ে আমাদের বললে–ইনি হচ্ছেন আমাদের সর্দার, ইনি সরকারকে কুলির জোগান দেন। এর ‘গিরিন্টি’ না পেলে কুলি নেওয়া হয় না।
কুলির সর্দার আমাদের অপরাধ শুনে বললে- তোমরা খবরদার আর এ-কাজ করতে যেও না, তোমাদের কখনও কুলিগিরি দেওয়া হবে না। দ্বিতীয়বার ধরা পড়লে তোমাদের হাতে-পায়ে শেকল বেঁধে রাত্রিবেলা ইঞ্জিনের সামনে ফেলে দেব। বুঝলে? যাও, আপনার কাজে যাও।
মনে হল আমাদের হাতে-পায়ের শেকল খুলে গেছে। গুটিগুটি স্টেশন থেকে বেরিয়ে আসছি, এমন সময় একটি লোক আমাদের কাছে এগিয়ে এল। প্রায় সাড়ে-ছ’ফুট উঁচু এবং দেহের বেড়ও সেই মাপের। মাথায় একটা কালো মখমলের টুপি, বুকে চেনঘড়ি ঝুলছে। একটা চোখ বন্ধ করে, ঠোঁট ও ডান হাতের তর্জনী বেঁকিয়ে আমাকে ইশারায় ডাকলে।
এগিয়ে যেতেই সে জিজ্ঞাসা করলে- তোমরা চাকরি করবে?
–নিশ্চয় করব।
–আমার হোটেল আছে হর্নবি রোডে–বোম্বে-বরোদা-বেঙ্গল হিন্দু হোটেল। তোমরা স্টেশন থেকে হোটেলের জন্য লোক ধরে নিয়ে যাবে। খেতে পাবে, কিন্তু মাইনে কিছু পাবে না। আমি এখনি হোটেলে যাচ্ছি–তোমরা এসো।
তারপর কালীর দিকে আঙুল বাড়িয়ে বললে–কিন্তু ওই লোকটাকে সঙ্গে করে এনো না। হোটেলটা আমাদের জানা ছিল। তখুনি বেরিয়ে গিয়ে সেখানে উঠলুম।
লোকটা জাতিতে সিন্ধী। নাম সেদিন কি বলেছিল আজ আর তা মনে নেই। সে আরও বললে–দু’খানা লাইসেন্স আমার করা আছে।
এই বলে সে টিনে-বাঁধানো দু’খানা ছোট ছোট লাইসেন্স আমাদের দিয়ে বললে–সকালবেলা এগারোটার মধ্যে খেয়ে নেবে। তিনটে থেকে সন্ধে অবধি চা হয়। তারপরে রাতের খাবার যত তাড়াতাড়ি খেয়ে নিতে পার। রাত্রিবেলা হোটেলেই থাকবে।
সে বার বার করে বলে দিলে–মাইনে কিছু দিতে পারব না, আর ওই লোকটাকে যেন সঙ্গে না নিয়ে যাই।
কালীকে দেখিয়ে কথাটা বলায় আমাদের তিনজনের বুকেই চাবুকের মতো কথাটা এসে লাগল। পরস্পরের মধ্যে সে-সম্বন্ধে আর কোনো উচ্চবাচ্য না করে আমরা হোটেলের দিকে অগ্রসর হতে লাগলুম।