বোধ হয় দু-তিন ঘণ্টা ঘুমিয়েছিলুম। ধাক্কা খেয়ে ধড়মড় করে উঠে দেখি, দিদিমণি আমার পাশে বসে, এরই মধ্যে তার স্নান হয়ে গিয়েছে, শুধু বসনাঞ্চল গায়ে জড়ানো। আমি উঠতেই আমার হাত ধরে বাইরে টেনে নিয়ে গিয়ে দুখানা দশটাকার নোট দিয়ে বললে, এ টাকাটা তোর কাছে আলাদা করে রেখে দে। বিশুর জন্যে বাবা বিশ্বনাথের কাছে মানত করেছি।
নোট-দুটোকে মুড়ে ট্যাকে গুঁজে আবার এসে লেপের তলায় লম্বা হয়ে পড়া গেল।
সেদিন সকালেও বিশুদার অবস্থা সেইরকম রইল। বাবুজী সেদিন আর বেরুলেন না। পরিতোষ বিশুদার সেবা করতে লাগল মায়ের মতন। সকাল থেকে তাকে ‘বেড্প্যান’ দেওয়া, মাথায় জলপটি লাগানো, ঠায় বসে থেকে সে রোগীর পরিচর্যা করতে থাকল। শেষকালে দিদিমণি একসময়ে এসে তার হাত ধরে তুলে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে-দাইয়ে আমাদের ঘরে শুইয়ে দিলে।
আমরা মনে করেছিলুম, এ-যাত্রা বিশুদার আর রক্ষে নেই। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বাবুজীর দাওয়াইয়ের গুণেই হোক অথবা তার জীবনীশক্তির জোরেই হোক, দিন-তিনেকের মধ্যেই তার জ্বর একেবারে নেমে গেল। সাত-আট দিন পরে আবার সে সকালবেলায় লাঠি আঁকড়ে নেংচে-নেংচে গিয়ে ছাতের আড্ডায় বসতে আরম্ভ করে দিল। অবিশ্যি সন্ধ্যাবেলা নিয়মিত জ্বর-আসা বন্ধ হল না বটে, তবে টুপি-সেলাই ফতুয়া-সেলাই সেই আগের মতোই চলতে লাগল।
তারপর একদিন, ফাল্গুনের মাঝামাঝি হলেও তখনও বেশ শীত, তবুও মধুমাসের আগমনী-সঙ্গীতে প্রকৃতির সঙ্গে শিহরন আরম্ভ হয়েছে মাত্র, দিদিমণি আমায় ডেকে বললে, স্থবির, আমরা কাল সকাল আটটার গাড়িতে কাশী যাব বাবার পুজো দিতে, মনে আছে তো? তুই, আমি আর পরিতোষ–এই তিনজনে যাব। সারাদিন কাশীতে থেকে রাত্রি সাড়ে আটটার গাড়িতে ফিরব। বাবুজী আসবার ঘণ্টাখানেক আগেই বাড়ি পৌঁছে যাব। আজ রাত্রে আমি বাবুজীকে বলে রাখব’খন
সন্ধেবেলা বিশুদার ঘরে বসে কাশী যাবার পরামর্শ হতে লাগল। এ-কথা সে-কথার পর হঠাৎ বিশুদা দিদিমণিকে বললে; তুই আর শর্মাজী কাশী যা, রায়সাহেব এখানে থাক, সারাটা দিন একলা থাকব, কি বল পরিতোষ?
ঠিক হল আমি আর দিদিমণি কাশী যাব, পরিতোষ বাড়ি থাকবে। সে-রাত্রে পরিতোষ বললে, একবার তোর রাজকুমারীর কাছে গিয়ে জয়ার খোঁজটা নিয়ে আসিস।
আমি বললুম, জয়াগিন্নি বলেছিল যে, তাদের ফিরতে ছ’মাস লাগবে, তার দু-মাসও এখনও কাটেনি। তার ওপরে ওই ব্যবহারের পর আর কি সেখানে যাওয়া ঠিক হবে?
পরিতোষ কিছুক্ষণ চোখ বুজে ধ্যানস্থ হয়ে রইল। তারপর বললে, ঠিক বলেছিস। ও-মাগির বাড়িতে আর যাস নে। মাস ছয়েক কেটে গেলে জয়াকে চিঠি লিখব; সে এখানে চলে আসবে। আবার কিছুক্ষণ ধ্যানস্থ হয়ে থেকে সে বললে, জয়ার কথা আমি দিদিমণিকে বলে ফেলেছি।
বেশ করেছ।
পরিতোষের কথাটা শুনে মনে একটা তীক্ষ্ণ আঘাত পেলুম। সে যে দিদিমণিকে জয়ার কথা বলে ফেলেছে, ঠিক সেজন্যে নয়। কিন্তু দিদিমণি এ-কথা ঘুণাক্ষরেও কোনোদিন আমার কাছে প্রকাশ করেনি, সেইজন্যে তার ওপর আমার দারুণ অভিমান হতে লাগল।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটবার পর জিজ্ঞাসা করলুম, আর কিছু বলেছিস নাকি? রাজকুমারীর কথা বলিসনি তো?
পরিতোষ বললে, সব বলেছি।
রেগে-মেগে বলে ফেললুম, দূর শালা! এসব বলতে গেলি কেন?
পরিতোষ হাসতে লাগল।
পরদিন সকালবেলা একটা টিনের হাত-বাক্সের মধ্যে দিদিমণি ও আমার কাপড়, গামছা, তেলের শিশি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে, দুখানা টিকিট কিনে একটা খালি সেকেন্ড-ক্লাসের কামরায় গিয়ে উঠলুম। আমি স্টেশনের দিকে আর দিদিমণি অন্য দিকের বেঞ্চিটা দখল করে বসে পড়লুম। একটু পরেই গাড়ি ছেড়ে দিলে।
.
এখন রাত্রি দ্বিপ্রহর অতীত হয়ে গিয়েছে। মুখর মহানগরী কলিকাতার কোলাহল স্তব্ধ। এমনই এক রাত্রে জাতক লেখা শুরু করেছিলুম। ভাবছিলুম, এই সামান্য কয়বৎসরে জগতের কত পরিবর্তনই না হয়ে গেল! আজই সকালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে, এক বর্বর জতি আর-এক বর্বর জাতির দেশে অ্যাটমিক বোমা ফেলে এক মুহূর্তের মধ্যে একটা শহর একেবারে ধ্বংস করে ফেলেছে। এতখানি নৃশংসতা মূঢ়তা ও কাপুরুষতার নিদর্শন প্রাকৃতিক বিপ্লবের ইতিহাসেও দুর্লভ। এই কথাটাই মনের মধ্যে জ্বলজ্বল করছিল, এমন সময় স্মৃতি-সাগরের গর্ভ থেকে সেই দিনের সকালবেলাটি অপূর্ব এক রূপ ধরে আমার সম্মুখে এসে দাঁড়াল–তার স্বরূপ বাণীমূর্তি গঠন করা আমার সাধ্যাতীত।
রেলগাড়ি ছুটে চলেছে, স্তব্ধ ধরণীর বুকে অর্থহীন প্রলাপের নিরবচ্ছিন্ন ঝঙ্কার তুলে। জানলার বাইরে মুখ বাড়িয়ে আমি বসে আছি। কাশীর কথা, কাশীর অভিজ্ঞতার কথা ভাবছি, ভাবছি নিজের ভবিষ্যতের কথা। এমন সময় দিদিমণি ডাক দিলে, ওখানে কেন, এখানে আয়, একটু গল্প করি।
এদিক থেকে উঠে গিয়ে দিদিমণির বেঞ্চিতে গিয়ে বসলুম। সে আমার দিকে একটু সরে এসে বললে, দেখ্, কাশীতে গিয়ে কিন্তু এক্কায় চড়তে হবে, আমার এক্কা চড়তে ভারি ভালো লাগে। সেই কবে ছেলেবেলায় বেরিলিতে থাকতে এক্কায় চড়তুম, আর চড়া হয়নি।
বললুম, এক্কায় উঠবে কি করে! পড়ে যাবে না? বাঙালির মেয়েকে তো কখনও এক্কায় চড়তে দেখিনি।
দিদিমণি হাসতে হাসতে বললে, পড়ব কেন রে! দেখ না তুই, কেমন চড়ি! শুধু চোখ রাখবি, বাবুজী বা আমার বড়ভাই না দেখতে পায়। তা হলে ভারি লজ্জায় পড়তে হবে।
তারপর সে গড়গড় করে বলতে আরম্ভ করলে, দশাশ্বমেধ ঘাটে গিয়ে স্নান সেরে আগে ছোট্কার পুজো দিতে হবে। তারপর খাবার-দাবার কিনে নৌকো ভাড়া করব, নৌকোতে বসে খেয়ে নিয়ে রামনগর যাব। সেখানে রাজবাড়িতে গিয়ে সব দেখে-শুনে কিছুক্ষণ গঙ্গায় ঘুরে বেরিয়ে যাব চৌকে। সেখানে ভাং খেয়ে যাব বড়-গৈরিতে, সেখান থেকে স্টেশনে ফিরে চলে আসব বাড়িতে, বুঝলি?
আমি বললুম, দিদি, ভাং আমার সহ্য হয় না, বড্ড বুক ধড়ফড় করে।
আমার কথা শুনে অভয় হাসি হেসে পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে দিদিমণি বললে, দূর পাগলা, কিচ্ছু হবে না, আমি আছি।
রেলগাড়ি ছুটে চলেছে শব্দের তুফান তুলে, তার চেয়ে দ্রুত চলেছে আমার জীবনস্রোত, মনের মধ্যে তারই আন্দোলন চলেছে। একটার পর একটা স্টেশন আসছে যাচ্ছে। প্যাসেঞ্জার গাড়ি, প্রতি স্টেশনেই থামে। আমরা দু-জনে পাশাপাশি বসে বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিয়েছি। দূরে পাহাড়, গাছ, গ্রাম সবই বিপরীত দিকে ছুটেছে, মাঝে মাঝে চোখে কয়লার কুচি পড়ে যতিভঙ্গ হচ্ছে।
এইরকম সময় কাটছে, হঠাৎ দিদিমণি জানলা থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে আমাকে বললে, আচ্ছা স্থবির, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?
কর।
না থাক্, তুই হয়তো রাগ করবি।
বললুম, না, রাগ করব না, সত্যি বলছি, রাগ করব না, বল তুমি।
দিদিমণি কিন্তু কোনো কথা না বলে আবার বাইরে দৃষ্টি প্রসারিত করে দিলে। চুপ করে বসে ভাবতে লাগলুম, কি কথা বলতে গিয়ে এমন করে সে চেপে গেল। মনের মধ্যে ভারি একটা অস্বস্তি বোধ হতে লাগল। কৌতূহল জাগিয়ে দিয়ে চুপ করে বসে থাকা, এ হচ্ছে নারীর স্বাভাবিক ধর্ম, এ-বিষয়ে দিদিমণি ও দিদিমাতে কোনো তফাৎ নেই।
কিছুক্ষণ এইভাবে কাটবার পর অর্থাৎ আমার কৌতূহল যখন চরমে উঠেছে, জানলা থেকে মুখ ফিরিয়ে সে জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা মনে কর, আমরা দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান সেরে উঠেছি, এমন সময় দেখা গেল, তোর রাজকুমারী সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে যদি বলে, স্থবির, আমার সঙ্গে চলে আয়। তা হলে? তা হলে তুই চলে যাবি তো?
আমি বললুম, পরিতোষের কাছে তুমি কি শুনেছ তা জানি না, কিন্তু আমার মন বলছে, তুমি আমায় বিশ্বাস কর না। বিশ্বাস কর, রাজকুমারী যদি আজ এসে লক্ষ-লক্ষ টাকার প্রলোভন দেখিয়ে আমাকে বলে–তুই আমার কাছে ফিরে আয় তো আমি তার সঙ্গে কথা না বলে মুখ ফিরিয়ে চলে যাব। আমাকে বিনা কারণে সে যা অপমান করেছে, তার শোধ তা হলে আজই হয়ে যাবে।
আমার কথা শুনে দিদিমণি যেন আশ্বস্ত হয়ে আবার প্রশ্ন করলে, তা হলে তুই তাকে ভালোবাসিস না?
আমি তাকে ঘৃণা করি।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, আচ্ছা, লতুকে কি এখনও ভালোবাসিস?
এ-কথার কি জবাব দেব! আমার জীবনের প্রথম প্রেম সে। আজও জীবনশেষে যার কথা মনে হলে মনে হয়, আমার জীবন ব্যর্থই হয়েছে। সেদিন, তখনও সেই ক্ষত বুকের মধ্যে দগদগ করছে, হঠাৎ সেখানে খোঁচা লাগতেই কে যেন আমার টুটি টিপে দম বন্ধ করে দিতে লাগল। দিদিমণি একটা হাত দিয়ে আমার হাত ধরে ছিল, সেই হাতে আমার অশ্রুজল ঝরঝর করে পড়তে লাগল।
কাঁদতে দেখে সে আমাকে একরকম জড়িয়ে ধরে বলতে লাগল, আমায় মাপ কর। লক্ষ্মী ভাই আমার, কাঁদিসনি। আমি জানি, আমি জানি–
দিদিমণি কাঁদতে কাঁদতে নিজের বসনাঞ্চল দিয়ে আমার অশ্রু মুছিয়ে দিতে লাগল। একবার তার মুখের দিকে চেয়ে দেখলুম, সহানুভূতিতে তার মুখখানা থমথম করছে, দু-চোখে করুণার প্রস্রবণ বয়ে চলেছে।
দিদিমণি বলতে লাগল, দেখ ভাই, ভালোবাসা সকলের ভাগ্যে সহ্য হয় না। আমার কথাই একবার ভেবে দেখ। আমার সেই আধ-পাগলা স্বামী, মাত্র কয়েক দিনের জানাশোনা তার সঙ্গে–তবুও ভগবান যদি তাকে বাঁচিয়ে রাখতেন–
এই অবধি বলে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলে।
দুটো-তিনটে স্টেশন এইভাবেই চলে গেল।
দিদিমণি মুখ তুলে বলতে আরম্ভ করলে, আমার অবস্থা তো দেখছিস? ছোটকা তো চলল। বাবুজী আর ক’দিনই বা আছেন! বড়ভাইটা তো জানোয়ারের অধম, সে তার বিষয়-আশয় আলাদা করে নিয়েছে। বাবুজী গেলেই তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক চুকে যাবে। তারপর আমার কি হবে? কোন বিদেশে কোথায় কি ভাবে মরব, মুখে একটু জল দেবার লোকও থাকবে না কাছে। স্থবির, স্থবির ভাই, আমাকে ছেড়ে যাসনে, আমি বড় অসহায়!
দিদিমণি আমার হাত ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলে।
আমি বললুম, দিদিমণি, আমি যতদিন আছি, তোমার কোনো ভয় নেই। তোমাকে ছেড়ে আমি কখনও কোথাও যাব না, তুমি বিশ্বাস কর।
আজ জীবনশেষে হিসাব করে দেখছি, সারাজীবন ধরে যত প্রতিজ্ঞা করেছি, সরল মনেই করেছি। প্রতিজ্ঞাপূরণের ভার যার ওপরে ছিল, সে-ই করেছে বিশ্বাসঘাতকতা। আমি নির্দোষ।
আমার কথা শুনে দিদিমণি স্থির নেত্রে আমার দিকে চাইলে। কাঁদতে-কাঁদতে তার মুখখানা লাল হয়ে উঠেছিল, তবুও দেখে বুঝতে পারলুম, সে-চোখে কি আশ্বস্তি! কিছুক্ষণ আমাকে একরকম জড়িয়ে ধরে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে বসে শেষকালে আমার ঊরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল।
জীবন-প্রভাতের সেই মধুময় স্বপ্ন আজ এক বিচিত্র রূপ ধরে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, কোন ভাষায় আমি তাকে রূপ দান করব!
কাশীর ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে যখন গাড়ি পৌঁছল, তখনও আমরা নিজের চিন্তায় বিভোর। লোকজনের ওঠানামা ও ফেরিওয়ালাদের চিৎকারে চটকা ভেঙে গেল। আমরা নেমে স্টেশনের বাইরে এসে ভালো দেখে একখানা এক্কা ভাড়া করলুম দশাশ্বমেধ ঘাট অবধি। ভাড়া ঠিক হল তিন আনা। তখনকার দিনে সিকরোল থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট অবধি এক্কার ভাড়া ছিল ছ’পয়সা, বড়জোর দু-আনা।
দিদিমণি বললে, যাগে, এইটেই ঠিক কর্, এক্কাটা ভালো আছে।
দিদিমণি এক-লাফে এক্কায় চড়ে চাদরে মাথা ঢেকে বসল, আমি একদিকে পা ঝুলিয়ে বসলুম। এক্কাওয়ালাটা ছিল অল্পবয়সি। দিদিমণিকে দেখে বোধ হয় তার ‘ফিলিংস’ চাগল, এক্কা চালাতে চালাতে সে-ব্যক্তি তারস্বরে চিৎকার করে পিরীতের গজল গাইতে শুরু করে দিলে। লোকটা বোধ হয় মনে করেছিল, তার গানের ব্যঞ্জনা আমরা বুঝতে পারব না। অবশ্য সে-গানের বাচ্যার্থ বোঝবার মতন ভাষাজ্ঞান আমার তখনও আয়ত্ত হয়নি; কিন্তু দিদিমণি যে তার সমস্ত কথাই বুঝতে পারছিল, সে-বিষয়ে সন্দেহ নেই। একবার তার দিকে চেয়ে দেখি যে, তার মুখখানা রাগে রাঙা টকটকে হয়ে উঠেছে। গায়ক বোধ হয় তার রাগকে অনুরাগ মনে করে এক-একটা পক্তি ইনিয়ে-বিনিয়ে গেয়েই বারে বারে পেছন ফিরে দেখতে লাগল, সেই সুন্দরী সোয়ারির ওপর তার কণ্ঠস্বর কিরকম প্রভাব বিস্তার করছে!
যা হোক, এমনই করে পনেরো-বিশ মিনিটের মধ্যে তো দশাশ্বমেধ ঘাটে এসে পৌঁছানো গেল।
গাড়ি থেকে নেমে হাত-বাক্সটি নামিয়ে নিয়ে রাস্তার একধারে দাঁড়ালুম, দিদিমণি তার গেঁজে থেকে একটা ছোট রুপোর দু-আনি আর চারটে পয়সা আমার হাত দিলে–’আনি’ জিনিসটির তখনও জন্ম হয়নি।
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে এক্কাওয়ালাকে পয়সাগুলো দিয়ে দিদিমণির কাছে এসে দাঁড়ালুম। এক্কাওয়ালা গুনে দেখেই গাড়ি থেকে লাফিয়ে রাস্তায় নেমে আমার পিছু পিছু একরকম ছুটে এসে বললে, এ বাবু, এ কি দিচ্ছ! পাঁচ-আনা ভাড়া ঠিক করে এখন তিন-আনা দিচ্ছ কেন?
আমি বললুম, তোমার সাথে তো তিন-আনা ভাড়া ঠিক হয়েছিল!
কিন্তু এক্কাওয়ালা এমন ষাঁড়ের মতন চেঁচাতে লাগল যে, লোক দাঁড়াতে আরম্ভ করে দিলে। শেষকালে দিদিমণি আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজে সামনে এসে বললে, কি বলছিস তুই?
লোকটা দিদিমণিকে কি-একটা কথা বলামাত্র ঠাস করে একটি চড় পড়ল তার গালে, দেখতে-না-দেখতে আর-একটি চড়-
মেয়েমানুষ বিশেষত বাঙালির মেয়ে, জোয়ান পুরুষমানুষের গালে এমন বেপরোয়া চড় লাগাতে পারে, এ আমার কল্পনার বাইরে ছিল।
দেখতে দেখতে চারিদিক লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। একটু দূরেই একজন কনস্টেবল .দাঁড়িয়ে ছিল, হাঙ্গামা দেখে সে ছুটে আসতেই দিদিমণি তাকে উর্দুতে কি বললে। তার কথা শুনেই সে এক্কাওয়ালার কাঁধে মারলে একটি জোর’ ঘিস্সা, লোকটা ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে নিজের গাড়িতে চড়েই ভিড়ের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে বেরিয়ে গেল।
দশাশ্বমেধ ঘাটে স্নান সেরে কাপড় ছেড়ে আমরা চললুম দিদিমণিদের পাণ্ডার বাড়িতে। পাশেই, মানমন্দিরের ঘাটের কাছেই ছিল তাদের পাণ্ডাবাড়ি। দিদিমণি সেখানে যেতেই বাড়িতে হৈ-হৈ উৎসব লেগে গেল। পাণ্ডাবাড়ির মেয়েমহলেও দেখলুম তার খুবই প্রতিপত্তি। বৃদ্ধ পাণ্ডা-মহারাজ চিৎকার করতে লাগল, আজ আমার বরাত ভালো, আজ মনোরমা-মায়ি এসেছে–
যা হোক, আদর-আপ্যায়নের পর পুজো দিতে চললুম। পাণ্ডাজী গর্ভগৃহ থেকে একেবারে ভিড় সরিয়ে দিয়ে দিদিমণির পুজো দেওয়ালে। পুজো সাঙ্গ হয়ে যাবার পর পাণ্ডা মহারাজ ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ তখনও সেখানে উপস্থিত রয়েছে-দিদিমণি আমার একখানা হাত ধরে টেনে এনে বলল, ঠাকুরের মাথায় হাত দে।
তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি দস্তুরমতন ভড়কে গেলুম।
দিদিমণি কঠিন সুরে বললে, দে, হাত দে ঠাকুরের মাথায়!
আমি সারাজীবন ধরে বহুবার লক্ষ করেছি, অতি আপনার জনও মাঝে মাঝে এমন দুর্বোধ্য, রহস্যময় ও কঠিন হয়ে ওঠে, যার হদিশ পাওয়া মুশকিল। অনন্যোপায় হয়ে ভয়ে ভয়ে শিবলিঙ্গের ডগায় দক্ষিণ-হস্তের মধ্যমাকে চেপে ধরলুম।
দিদিমণি বললে, সৌগন খা (ভাষাজ্ঞান কিছু অগ্রসর হবার পর জেনেছি, এর মানে–শপথ কর), আমাকে ছেড়ে কখনও যাবিনে।
বললুম, তোমাকে ছেড়ে কখনও যাব না। পাণ্ডা-মহারাজ হাসতে হাসতে বললে, ছেলেটাকে পুষ্যি নিলি বুঝি মনো-মায়ি? বড় সুলক্ষণ ছেলে আছে।
আজ সেইসব কথা মনে হয়ে বুকের মধ্যে একটা অট্টহাসি গুমরে উঠছে, আর মনে পড়েছে বিশ্বকবির বাণী–সব ঝুট হ্যায়।
দিদিমণি পাণ্ডাজীর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে আমার হাত ধরে গর্ভগৃহ থেকে বেরিয়ে এল।
আমরা ঠিক করেছিলুম, বাজার থেকে খাবার কিনে বজরায় বসে খাওয়া হবে, কিন্তু পাণ্ডা-মহারাজ কিছুতেই ছাড়লে না! সে একরকম জোর করে তাদের বাড়িতে নিয়ে গিয়ে ভুরিভোজন (অবশ্য নিরামিষ) করিয়ে ছেড়ে দিলে। বেলা তখন প্রায়ু বারোটা।
পাণ্ডার বাড়ি থেকে বেরিয়ে মানমন্দিরের ঘাট থেকে আমরা একখানা বজরা ঠিক করলুম। প্রথমে আমাদের রামনগরে নিয়ে যাবে, সেখানে আমরা ঘণ্টাদুয়েক থাকব। তারপর বেলা চারটে অবধি অসিঘাট থেকে রাজঘাট অবধি ঘুরিয়ে এনে আবার মানমন্দির-ঘাটে নামিয়ে দেবে। যতদূর মনে পড়ছে, ভাড়া ঠিক হয়েছিল বারো আনা।
এর আগে কাশীতে এতদিন কাটিয়েছি, ঘাটে দাঁড়িয়ে ওপারে রামনগরের সাদা প্রাসাদ কতদিন দেখেছি, কিন্তু সেখানে যাবার সৌভাগ্য কোনোদিনই হয়নি।
রামনগরের রাজা, তিনি তখনও মাত্র ‘কাশী-নরেশ’ই ছিলেন। তিনি তখনও মহাঅমান্য (মহামান্য) ইংরেজ রাজের অধীনস্থ সামন্ত রাজা হননি। কিন্তু একদিন যে তাঁরা প্রতাপান্বিত রাজা ছিলেন, তা প্রাসাদের কাছাকাছি এলেই বুঝতে পারা যায়।
প্রকাণ্ড দরজা, যেমন উঁচু তেমনই চওড়া। দরজার দু’দিকে গাদা-বন্দুকধারী শাস্ত্রী দাঁড়িয়ে আছে, অনেকটা পুরনো দিনের তাসের রাজার মতন চেহারা তাদের। কিন্তু প্রাসাদের দরজা অবারিত, রাজ্যের লোক ঢুকছে বেরুচ্ছে, কেউ কারুকে বারণ করছে না। সিংহ-দরজা পেরিয়েই প্রকাণ্ড প্রাঙ্গণ, সেখানে দুটো-তিনটে মহাকায় বাঁধা রয়েছে। প্রাঙ্গণ পেরিয়ে উঁচু-নীচু সরু-মোটা গলিপথ দিয়ে গঙ্গার শিবের মন্দিরে এসে পৌঁছলুম। দিদিমণি গলবস্ত্র হয়ে এক-একটি দেবতাকে প্রণাম করলে। একটা মন্দিরের দেওয়ালের গায়ে মস্তবড় একখানা তৈলচিত্র টাঙানো রয়েছে দেখলুম। ছবিখানা দেখেই আমার কৌতূহল জাগল। মন্দিরের মধ্যে ঢুকে সেটা ভালো করে দেখবার চেষ্টা করতে লাগলুম। ধূপধুনোর ধোঁয়ায় ছবিখানা প্রায় অদৃশ্যই হয়ে গিয়েছে। অনেকক্ষণ চেয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারা যায়, সেটা একজন সন্ন্যাসীর ছবি।
দিদিমণিকে জিজ্ঞাসা করলুম, এটা কার ছবি।
দিদিমণি বললে, ব্যাসদেবের।–বলেই সে গলবস্ত্র হয়ে ছবির উদ্দেশে একটা গড় করলে।
দিদিমণির কথা শুনে আমার হাসি পেল। বললুম, দূর, ব্যাসদেবের ছবি, না আরও কিছু!
কাছেই মন্দিরের পুরোহিত-গোছের এক ব্রাহ্মণ দাঁড়িয়ে ছিল, সে দিব্যি বাংলায় বললে, হাঁ হাঁ বাবু, মা যা বলছেন, তা ঠিকই আছে, উনি ব্যাসদেবই আছেন।
আমি বললুম, ব্যাসদেবের ছবি কোথায় পেলে! কোন সালে, কত হাজার-হাজার বছর আগে ব্যাসদেব জন্মেছিলেন, তার জান কিছু? ব্যাসদেবের ছবি বললেই আমি অমনই মেনে নেব!
ব্রাহ্মণ আমার কথায় রাগ না করে হেসে বেশ মিষ্টি-মিষ্টি করে বললে, আপনি বালক হলেও বাংগালি তো! বাংগালিরা তো ফিরিঙ্গিদের চেলা-আছে। তারা তো ধর্মকর্ম কিছুই মানে না। শুধু মায়েরা আছে বলেই তো আপনাদের ধর্মকর্ম এখনও বজায় আছে। ব্যাসদেব কবে জন্মেছিলেন, আর আর সব বৃত্তান্ত এই মাকে জিজ্ঞাসা করবেন, তিনি আপনাকে সব বুঝিয়ে দেবেন।
কথাগুলো এক-নিশ্বাসে বলে ফেলেই লোকটা অত্যন্ত উচ্চহাস্যে পারাবতকুল চঞ্চল করে এমন একটা মুখভঙ্গি করে আমার দিকে চাইলে, যার জবাব দেবার মতন শক্তি আমার অঙ্গে ছিল না। কাজেই হার মেনে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম।
আমি ক্ষুণ্ণ ও অপ্রতিভ হয়ে পড়েছি দেখে দিদিমণি আমার হাত ধরে বললে, চল্, গঙ্গার মন্দিরে যাই।
গঙ্গার কোলেই ছোট একখানি মন্দির। তারই মধ্যে গঙ্গামূর্তি–মকরবাহিনী গঙ্গা।
মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে দিদিমণি বললে, দেখ দিকিন, কেমন সুন্দর মূর্তি!
সত্যিকথা বলতে কি, ছেলেবেলা থেকে সেদিন অবধি মূর্তিকে আমি স্রেফ ‘মূর্তি’ বলেই দেখে এসেছি। যে সমাজে ও পরিবারে আমার জন্ম হয়েছিল, রূপের মধ্যে অরূপের সংকেত যে থাকতে পারে তেমন শিক্ষা তাঁদের ছিল না–এমন কথা তাঁদের শত্রুও বলতে পারবে না। কিন্তু যে সংস্কৃত মন (cultured mind) রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধান পায় সে-মন তাঁদের ছিল না। এই কারণে বাল্যকাল থেকে দেব-দেবীর মূর্তিকে মূর্ত বলেই দেখতে শিখেছি, সে সুন্দর কি অসুন্দর-এ-বিচার মনের মধ্যে কখনও উদয়ই হয়নি। দেব-দেবী দেব-দেবীই মাত্র। দেব-দেবীত্ব ছাড়া অন্য কোনো গুণ তাদের প্রতি আরোপিত হতে পারে, এমন কথা আমাদের সংস্কারের বাইরে ছিল। শুদ্ধমাত্র সৌন্দর্যবোধের বিচারে কোনো দেব-দেবীর মূর্তিকে দেখবার মতন সাহসই আমাদের ছিল না। কিন্তু দিদিমণি সামান্য একটু ইঙ্গিত করা-মাত্র যেন আমার দিব্যদৃষ্টি খুলে গেল। কিছুক্ষণ সেই মূর্তির দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে মনে হল, আহা, কি সুন্দর!
এ-কথা যেন কেউ মনে না করেন যে, রামনগরের এই মকরবাহিনী গঙ্গামূর্তিকে আমি ভারতের শ্রেষ্ঠ মূর্তিগুলির সঙ্গে এক পর্যায়ে ফেলছি। আমি ভারতের তথাকথিত প্রায় সমস্ত শ্রেষ্ঠ মূর্তিই স্বচক্ষে দেখেছি। এইসঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করছি যে, তাদের প্রত্যেকটিকে প্রথম শ্রেণীর পর্যায়ে ফেলতে আমার বাধা লাগে, দৃষ্টান্তস্বরূপ দক্ষিণ-দেশের সুন্দরস্বামীর মূর্তি। এই মূর্তিটি সম্বন্ধে কত কথাই শুনেছি ও পড়েছি, আচার্য অবনীন্দ্রনাথের অপূর্ব ভাষায় তার সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা শোনবার সৌভাগ্যও আমার হয়েছে; কিন্তু আজও মনের দ্বিধা ঘোচেনি। কিন্তু দক্ষিণ-দেশের নটরাজ, দিলদারনগরের যক্ষিণী অথবা মহাবলিপুরমের মহিষমর্দিনী কোনো বক্তৃতার অপেক্ষা রাখে না। সে-মূর্তি দেখলেই শিল্পসৌন্দর্য প্রকাশ করবার বাঁচালতা স্তব্ধ হয়ে গিয়ে মন শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে পড়ে, তার পেছনে কি ইতিহাস লুকিয়ে আছে তা না জেনেও। রামনগরের এই গঙ্গামূর্তি এদের সমকক্ষ না হলেও সে এই জাতেরই মূর্তি, যা দেখলেই মনে হয়, আহা!
যাক, অনধিকার-চর্চা আর করব না। গঙ্গামায়িকে গড় করে আমরা বজরায় এসে বসলুম। বজরা মাঝগঙ্গায় পড়তে দিদিমণি আমার ঊরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। আমার ধুতিখানা ছিঁড়ে গেছে দেখে দিদিমণি বলে উঠল, ছি-ছি আমার তো মনেই ছিল না-যে, তোদের ধুতি-জামা নেই। কাল সকালবেলা তুই আর পরিতোষ কাশীতে এসে দুজনে ছ’-জোড়া ধুতি আর চারটে করে শার্ট নিয়ে যাবি। দুটো তুলোর ফতুয়াও কিনে নিস। দশাশ্বমেধ ঘাটে ওই যে বাঙালিদের বড় দোকান আছে কাপড়-জামার, ওখানে দুজনে দুটো গরম কোটের অর্ডার দিয়ে দিবি।
আমি বললুম, আর তো শীত চলে গেল বলে। এখন আর গরম কোট দিয়ে কি হবে?
দিদিমণি বললে, সেই ভালো। আসছে বছরে তো আবার তোরা বেড়ে যাবি।
দিদিমণি দুঃখ করতে লাগল, পাণ্ডাজীকে পঞ্চাশটা টাকা দিয়ে দিলুম, বাড়ি গিয়ে পাঠিয়ে দিলেও চলত। তোদের জামা-কাপড় নেই, কথাটা মনেই ছিল না।
শেষকালে যথারীতি আমার ঘাড়ে সব দোষ চাপিয়ে দিয়ে দিদিমণি উপসংহার করলে, সব দোষ তোর, তুই কেন আগে আমায় বললি না? এত কাজের মধ্যে আমার কি সব কথা মনে থাকে!
বজরা ভেসে চলল উত্তরবাহিনীর বুকের ওপর দিয়ে তরতর করে, আর আমরা ভবিষ্যৎ স্বপ্নের জাল বুনতে লাগলুম–কোথায় কাশ্মীরের অমরনাথ, হিমালয়ের বুকে মানস সরোবর, কেদার ও বদরীনাথ। কোথায় ভারতের এক কোণে দ্বারকায় রণছোড়জীর মন্দির, আবুপাহাড় আর রাজস্থানে পুষ্কর, কোথায় জুনাগড় আর কোথায় পুরুষোত্তম! আমি, পরিতোষ, দিদিমণি আর জয়া এক তীর্থ থেকে আর এক তীর্থ ছুটে বেড়াতে লাগলুম।
বেলা প্রায় চারটের সময় বজরাওয়ালা আমাদের মানমন্দিরের ঘাটে নামিয়ে দিলে। সেখান থেকে হেঁটে গোধুলিয়া অবধি গিয়ে একটা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে প্রথমে আমরা চৌকে গেলুম। দেখলুম, কাশীর সমস্ত রাস্তাঘাট দোকানপত্তর দিদিমণির একেবারে নখদর্পণে।
চৌকের এক জায়গায় গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিদিমণি আমাকে দূর থেকে ভাঙের দোকানটা দেখিয়ে বললে, চার পয়সা দিয়ে আমার জন্যে দু-ভাঁড় শরবত কিনে নিয়ে আয় তো।
চার পয়সা দিয়ে দু-ভাঁড় শরবত কিনে নিয়ে এলুম। দিদিমণি চোঁ-চো করে ভাঁড়-দুটো নিঃশেষ করে টপটপ করে জানলা দিয়ে গলিয়ে ফেলে বললে, আর দু-ভাঁড় কিনে নিয়ে আয়।
আবার দু-ভাঁড় শরবত কিনে নিয়ে এলুম। দিদিমণি আমাকে গাড়ির মধ্যে উঠে আসতে বলে গাড়োয়ানকে বললে, চল।
গাড়ি চলতে শুরু করল। দিদিমণি একটা ভাঁড় আমাকে দিয়ে বললে, নে, খেয়ে ফেল, কিচ্ছু হবে না।
এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে ভাঁড় বাইরে ফেলে দেওয়া গেল।
গাড়ি চলতে লাগল বড়-গৈবির দিকে। কাশীতে এতদিন কাটিয়েছি, কিন্তু রাজকুমারীর, জয়া অথবা বাঙাল-মার কাছে কোনোদিনই গৈবির নাম বা তার মাহাত্ম্য শুনিনি। দিদিমণির মুখেই প্রথম শুনলাম বড়-গৈবি, ছোট-গৈবির কথা। শুনলুম বড়-গৈবি অর্থাৎ আমরা যেখানে যাচ্ছি, সে-স্থান নাকি সন্ন্যাসীদের মঠ। সেখানকার ইঁদারার জল নাকি খুবই উপকারী। ভরপেট খাওয়ার পর এক গ্লাস সেই জল খেলে আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার খিদেয় পেট চনচন করতে থাকবে।
নেশা করতে শেখার প্রথম অবস্থায় পেটে ‘নৈশিয়’ দ্রব্য পড়লেই বুদ্ধিটা প্রখর হয়ে ওঠে। সেই প্রাখর্যের প্রেরণায় আমার মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগতে লাগল, সন্ন্যাসীদের আশ্রমে এমন হজমি পানির অস্তিত্ব গৃহজীবনের পক্ষে মঙ্গলদায়ক কি না। কারণ গৃহস্থজনের ট্যাক শোষণ করেই তো সন্ন্যাসীদের মঠাশ্রম পোষিত হয়।
দিদিমণি বলে চলল, কাশীর বড় বড় লোকেরা প্রতিদিন গাড়ি পাঠিয়ে এখান থেকে ঘড়া ঘড়া, জালা জালা জল নিয়ে যায়।
গাড়ি চলেছে আর সেইসঙ্গে দিদিমণি অনর্গল বকে চলেছে। দেখতে-দেখতে তার চক্ষুদুটি ভাঙের প্রভাবে ঈষৎ লাল হয়ে উঠল। এমনিতে সে একটু গম্ভীরই ছিল; কিন্তু দেখলুম, সামান্য কথায় সে খিলখিল করে চেঁচিয়ে হাসতে আরম্ভ করে দিলে, হাসি আর থামে না।
আমি তার মুখের দিকে অবাক হয়ে চেয়ে আছি দেখে হঠাৎ হাসি থামিয়ে নিজের জায়গা থেকে উঠে আমার পাশে বসে বললে, তুই বোধ হয় মনে করছিস, আমার নেশা হয়েছে। কিন্তু সত্যি বলছি তোকে, আমার কিছু হয়নি। আরে দূর, দু-ভাঁড় ঐ বাজারের শরবত খেয়ে কি নেশা হয়! একদিন বাড়িতে দুধ দিয়ে বানাব’খন। আরও এক ভাঁড় খেলে হত।
পরবর্তী জীবনে অনেক পাকা নেশাখোরের মুখে এই উক্তি শুনেছি, এবং জেনেছি যে, নেশা হওয়ার এমন স্পষ্ট প্রমাণ আর নেই।
দিদিমণির কথার উত্তরে বললুম, না, আমি অন্য কথা ভাবছি।
কি ভাবছিস?
না, কিছু ভাবছি না।
এই যে বললি, অন্য কথা ভাবছিস!
এমনই বললুম।
দূর তোরও নেশা হয়েছে।–বলে আমার পিঠে একটা কিল মেরে সে আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।
গাড়ি চলেছে, তারই তালে তালে অশ্বিনীতনয়যুগলের গলার ঘণ্টা ঝমঝম করে বাজছে। শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে আমরা মাঠের রাস্তায় পড়েছি। দু-ধারে জোয়ার ভুট্টা কি আখের ক্ষেত জানি না, মাথা-সমান উঁচু-উঁচু গাছ যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত। তারই মধ্যে দিয়ে সরু সর্পিল পথ বেয়ে চলেছে আমাদের গাড়ি। রাস্তায় বোধ হয় একহাত পুরু ধুলোর বিছানা। তার ফলে ভাড়াটে গাড়ির চক্রমুখরতা অনেক পরিমাণে সংযত হওয়ায় চোখে একটু তন্দ্রার ঘোর এসে লাগতে লাগল।
গৈবিতে এসে গাড়ি দাঁড়াল। আমরা নেমে আশ্রমের ভেতরে ঢুকলুম। একটুখানি জায়গা গাছের বেড়া দিয়ে ঘিরে নেওয়া হয়েছে। সামান্য দু-একটা চালাঘর কি কোঠাঘর, তা আজ ঠিক মনে পড়ছে না। সুন্দর শান্ত নির্জন পরিবেশ, কোনো গোলমাল নেই।
দিদিমণি অগ্রসর হতে হতে আবার বললে, এটা একটা মঠ, সন্ন্যাসীরা থাকে এখানে।
দিদিমণির পেছনে পেছনে একটা ইঁদারার ধারে গিয়ে পৌঁছলুম। দেখলুম, ইঁদারার বাঁধানো পাড়ে বোধ হয় দশ-বারোটা ইয়া-ইয়া জোয়ান ন্যাঙট পরে বসে আছে। সেখানকার জল যে কি ভয়ঙ্কর রকমের, হজমি, এদের চেহারা দেখলে সে-সম্বন্ধে আর বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
দিদিমণিকে দেখবামাত্র তারা সকলেই উল্লসিত হয়ে সমস্বরে অভ্যর্থনা করতে আরম্ভ করে দিলে। একজন অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সি সন্ন্যাসী অথবা পালোয়ান তারস্বরে চিৎকার করতে লাগল, আজ মনো-মায়ি এসেছে, আজ পেট ভরে মিঠাই খাব, আজ বরাত ভালো, ইত্যাদি।
লোকগুলোর চেহারা ও হালচাল দেখে জায়গাটাকে একটা কুস্তির আখড়া বলে মনে হতে লাগল।
দিদিমণি ইঁদারার পাড়ে বসতে বসতে বললে, বেশ তো, মিঠাই আনাও।
আমার কাছ থেকে হাত-বাক্সটা নিয়ে একটা দশটাকার নোট বের করে সেই লোকটার হাতে দিয়ে দিদিমণি বললে, আর একদিন এসে তোমাদের ভরপেট মিঠাই খাওয়াব, আজ এতেই চালিয়ে নাও।
পরে শুনেছিলুম, তাঁদের এক-একজনেই দশটাকার মেঠাই আড়ে মেরে দিতে পারেন। যা হোক, লোকটা নোট হাতে পেয়ে সেই ন্যাঙট-পরা অবস্থাতেই শহরের দিকে ছুটল মিঠাইয়ের উদ্দেশে। নিকটবর্তী মিঠাইয়ের দোকান সেখান থেকে অন্তত চার মাইল দূর হবে। আলাপচারী হতে লাগল, ও কেমন আছে, সে কেমন আছে? অমুককে দেখতে পাচ্ছি না কেন? সে এখন হরিদ্বারে আছে, অমুক নাসিক গিয়েছে, ইত্যাদি।
একবার দিদিমণি জিজ্ঞাসা করলে, বুটিটুটি ছানা হয়ে গিয়েছে বোধ হয়?
এক বৃদ্ধ বললে, হ্যাঁ, খাবি তুই?
দিদিমণি বললে, থাকলে একটু দিতে পার। না থাকলে নতুন করে করবার দরকার নেই, চৌক থেকে আমি খেয়ে এসেছি।
লোকটা চেঁচিয়ে হুকুম করতেই বোধ হয় পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা ঝকঝকে কাঁসার গেলাস-ভর্তি ভাঙের শরবত এসে উপস্থিত হল। দিদিমণি একটি চুমুকে গেলাস নিঃশেষ করে বললে, জল খাওয়াও।
আমার জীবনে সে এক অভিজ্ঞতা। যদিও পরে দেখেছি, বিশেষ দিনে ঘরে ঘরে মেয়েরা ভাং খেয়ে হুল্লোড় করছে। অবিশ্যি আধুনিক বাত্যায় পুরাকালের ভাং আর তেমন প্রশ্রয় পায় না। সেখানে এসে জুটেছেন বিলিতি মাল। সমস্ত ইন্দ্রিয় বজায় রেখে কর্মকর্তা যদি আরও কিছুদিন জীইয়ে রাখেন তো হয়তো অনেক কিছুই দেখতে হবে। তবে দুঃখ এই যে, শুধু এই নেশা করবার অপরাধেই মেয়েদের কাছে চিরজীবন অপরাধীই রয়ে গেলুম।
একজন অল্পবয়সি সাধু ইঁদারা থেকে জল তুলে আমাদের খাওয়ালে। দিদিমণি বললে, পেট পুরে জল খা, এখানকার জল ভারি উপকারী।
জল পান করার পর আমার নেশাটা যেন আরও চড়ে গেল। দিদিমণির কিন্তু কিছুই হল না, সে সেই ন্যাঙট-পরা কুস্তিগীর অথবা সাধুদের সঙ্গে ধর্মতত্ত্ব আলোচনা করতে লাগল, আর আমি গুম হয়ে বসে তার রসাস্বাদন করতে লাগলুম।
কথাবার্তার মাঝখানে হঠাৎ সেই বৃদ্ধ একবার বলে উঠল, বাবাকে প্রণাম করবি নে?
নিশ্চয়ই।–বলে দিদিমণি উঠে তার সঙ্গে চলে গেল মঠের একদিকে।
প্রায় দশ-পনেরো মিনিট বাদে দিদিমণি ফিরে আমার পাশে এসে বসল।
আবার কথাবার্তা গল্পগুজব শুরু হল বটে; কিন্তু আমি লক্ষ করলুম, যেন তার কথাবার্তা, অনেক পরিমাণে সংযত হয়ে পড়েছে। অত্যন্ত ধীর ও সংযত ভাবে সে তাদের কথার উত্তর দিতে লাগল। নিজের দিক থেকে তার আর কোনো প্রশ্নই নেই, দেবদর্শনে যেন তার অন্তরের সব সমস্যারই সমাধান হয়ে গিয়েছে।
বেলা পড়ে এল। দিদিমণি বললে, এবার উঠি। আর একদিন তাড়াতাড়ি এসে অনেকক্ষণ থাকব।
কথাবার্তা অবিশ্যি বিশুদ্ধ হিন্দি-উর্দুতেই চলছিল। এরই মধ্যে একজন যুবক বললে, মনো-মায়ি, কতদিন তোর ছেলেকে খাওয়াসনি মনে আছে?
দিদিমণি বললে, তুই তো আমার ছেলে নস, তুই হচ্ছিস আমার সতীনের ছেলে। তা না হলে, মা মলো কি বাঁচল তা আজ ছ’-মাসের মধ্যে একবার খোঁজ নিলি নে!
লোকটা বিমর্ষ হয়ে বললে, ছেলে কুপুত্র হলে মাতা কখনও কুমাতা হয় না। মাপ কর্ মনো-মায়ি, এবারে তোর ঘরে গিয়ে ছ’মাস থাকব।
দিদিমণি বললে, ছোট্কার ভারী ব্যারাম, তার খোঁজ রাখিস? সে বোধ হয় বাঁচবে না, তার সঙ্গেও তো একবার দেখা করা উচিত।
সে ব্যক্তি অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে বললে, কি করব মনো-মায়ি, মঠ ছেড়ে কোথাও যাবার উপায় এ-সময়ে একেবারেই নেই। পনেরো দিন বাদেই অমুক নাসিক থেকে ফিরে আসবে, সে এলেই তোর ওখানে চলে যাব!
সন্ধে ঘনিয়ে এল। আমরা উঠি-উঠি করছি, এমন সময় আমাদের গাড়োয়ান এসে বললে, সরু গলিতে গাড়ি ঘোরাতে গিয়ে তার গাড়ির একখানা চাকা ভেঙে গিয়েছে।
কি সর্বনাশ! তা হলে উপায় কি হবে? এখান থেকে লোকালয় যে পাঁচ মাইল দূরে! গাড়োয়ান প্রায় কাঁদ-কাঁদ সুরে বললে, আপনার যা খুশি করুন।
দিদিমণি তাকে ভাড়া চুকিয়ে দিলে। ঠিক হল, সে ভাঙা গাড়িখানা এখানেই রেখে ঘোড়াদুটো নিয়ে চলে যাবে। কাল এসে গাড়ি টেনে নিয়ে যাবে কিংবা এখানেই মেরামত করে নেবে। গাড়োয়ান তো ভাড়া নিয়ে চলে গেল। আমাদের আর বসে থাকা চলে না বেরিয়ে পড়া গেল। মঠের সাধুরা কিছুদূর অবধি আমাদের এগিয়ে দিয়ে ফিরে গেল নিজেদের আস্তানায়
সে-দিন কি তিথি ছিল জানি না। কিছুক্ষণ ঘুটঘুঁটে অন্ধকারের পর আকাশে একফালি চাঁদ দেখা দিলে।
দিদিমণি চলেছে আগে স্থির মন্থর, পদক্ষেপে। তার মাথা থেকে পা অবধি একখানা সাদা শালে আবৃত। সে চলেছে আগে, আমি হাত-বাক্স নিয়ে চলেছি তার পিছু-পিছু। আমি লক্ষ করেছি, গৈবিতে সেই ঠাকুর-প্রণাম করে আসবার পর থেকে সে অস্বাভাবিক রকমের গম্ভীর হয়ে পড়েছে। আমার মনে হতে লাগল, তার সিদ্ধির নেশা বোধ হয় বেশ জমেছে। কারণ সিদ্ধি আমার দুশমন হলেও তার স্বভাব আমার অজ্ঞাত নয়। সে-সময় সিদ্ধির নেশা সম্বন্ধে আমাদের মহলে একটা ছড়া প্রচলিত ছিল। ছড়াটা আজ সম্পূর্ণ মনে নেই, তবে তার ভাবটা ছিল এই যে, সিদ্ধির নেশার প্রথম অবস্থায় লোকে টিয়ে-পাখির মতন মুখর হয় এবং দ্বিতীয় অবস্থায় প্যাঁচার মতন গম্ভীর হয়ে পড়ে।
দিদিমণির ওই গাম্ভীর্য দেখে সেই ছড়াটা মনে পড়ে আমার ভয়ানক হাসি পেতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে দুষ্ট-সরস্বতী চেপে বসলেন মাথায়। একটা রসিকতা করতে যাচ্ছি, এমন সময় কোথা থেকে একটা দমকা বাতাস এসে দু-পাশের সেই ক্ষেতকে তোলপাড় করতে আরম্ভ করে দিলে। হঠাৎ সেই নীরব, নিথর, নুয়েপড়া গাছগুলো সহস্র হাতে হাততালি দিয়ে হৈ-হৈ করে চিৎকার করতে আরম্ভ করে দিলে। সঙ্গে সঙ্গে দেহ-মনে একটা মধুর শিহরন জাগিয়ে আমার সমস্ত প্রগল্ভতাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলে গেল, তার পরে সব স্থির।
দিদিমণি আগে চলেছে সেই ধীর মন্থর পদবিক্ষেপে। ডান হাতে টিনের বাক্স ঝুলিয়ে নিয়ে আমি চলেছি পশ্চাতে, কিন্তু অন্তরের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারে বদলে গিয়েছে। সেই স্তিমিত চন্দ্রালোকের আলো-আঁধারি আমার কাছে এক রহস্য বলে মনে হতে লাগল। আমার মনে হতে লাগল, ওই যে অবগুণ্ঠনবতী নারী চলেছে আমার সম্মুখে, সে রহস্যময়ী। দু-পাশে এই যে ক্ষেতের গাছগুলো, যারা হঠাৎ অধীর হয়ে আকাশের দিকে মুখ তুলে উল্লাসে চিৎকার করে আবার ধরণীর দিকে নুয়ে পড়ল, তারাও রহস্যময়। এই যে চন্দ্রালোক, এও এক রহস্য। আমি কে? কোথায় ছিলুম আমি? আমার জীবনের যে ধ্রুবতারা, হঠাৎ অন্য এক ব্যক্তির জীবনের সর্বস্ব হয়ে সে চলে গেল, সেও এক রহস্য। আমার মনে হতে লাগল, আমি যেন এই রহস্যের গভীরতম গভীরে ধীরে ধীরে প্রবেশ করছি, নিজের ইচ্ছায় নয়, কে যেন আমাকে টেনে নিয়ে চলেছে। তার কাজ শুধু টেনে নিয়ে যাওয়া আর আমার কাজ শুধু বিস্মিত হওয়া। বিস্ময়-রসই জগতের একমাত্র রস। সমস্ত রসেরই অন্তরতম প্রদেশে আছে বিস্ময়। যে বিস্মিত হয় না, সে-ই অন্য রসে মজতে পারে।
বোধ হয় ঘণ্টাখানেকেরও ওপর পথ চলে আমরা লোকালয়ে এসে পৌঁছলুম। সেখান থেকে একটা ভাড়াটে গাড়ি করে আমরা স্টেশনে এসে ট্রেন ধরলুম।
বাড়ি যখন ফিরলুম তখন বেশ রাত হয়ে গিয়েছে। বাড়ির দেউড়ি পার হয়ে একটু অগ্রসর হওয়ামাত্র আহিয়ার সঙ্গে দেখা। আমাদের দেখামাত্র আহিয়া চিৎকার করে এক অদ্ভুত ভাষায় কি বলতে আরম্ভ করে দিলে। আহিয়ার কথা শুনে দিদিমণি আঁতকে উঠে সেই ভাষাতেই তাকে কি বললে। দুজনের একজনের কথাও কিছুমাত্র বোধগম্য হল না বটে, তবে কণ্ঠস্বরের উচ্চতা ও সুরে বোধ হল, বাড়িতে নিশ্চয় কিছু একটা হাঙ্গামা হয়েছে।
দিদিমণি আর বাক্যব্যয় না করে শালখানা আহিয়ার গায়ে একরকম ছুঁড়ে দিয়ে ছুটল বাড়ির ভেতর দিকে। আমিও ছুটলুম তার পেছনে। আহিয়া শাল সামলাতে সামলাতে তার সাধ্যমতো দ্রুতপদে আসতে লাগল আমাদের পশ্চাতে।
আমার মনে হতে লাগল, নিশ্চয় বিশুদার কিছু হয়েছে। দিদিমণিও বিশুদার ঘরের দিকেই ছুটতে লাগল। কিন্তু আমাদের ঘরের কাছাকাছি এসেই বড়কর্তার গর্জন শুনে বুঝতে পারলুম, হাঙ্গামাটা কি, ও হচ্ছে কোথায়! বুকের মধ্যে ধড়মড় করে উঠল, পরিতোষের কিছু হয়নি তো? হয়তো এতদিনের পরিকল্পিত ‘জিন্দা গেড়ে’ দেবার শুভকর্মটি আমাদের অনুপস্থিতিতে বড়কর্তা নির্বিঘ্নে সম্পন্ন করে ফেলেছেন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, খাটের বিছানাপত্র তছনছ হয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। একধারে বড়কর্তা পরিতোষের বুকে ডান পায়ের হাঁটু দিয়ে তাকে দেওয়ালের সঙ্গে ঠেসে ধরেছে, তার হাতে উদ্যত বিছুয়া আর মুখ থেকে ছুটছে অশ্লীল গালাগালি ও থুতুর অবিশ্রান্ত নির্ঝর। আমরা যে তিনটে লোক দুমদাম করে ঘরের মধ্যে ঢুকলুম সে-জ্ঞান পর্যন্ত তার নেই।
দিদিমণি সেই অদ্ভুত ভাষায় চিৎকার করে উঠতেই বড়কর্তা চমকে পরিতোষের বুক থেকে পা নামিয়ে আমাদের দিকে ফিরে চাইলে।
তার পরে উঠল কথার ঝড়। দুই পক্ষে সেই ভাষায় তুমুল ঝগড়া শুরু হয়ে গেল। আমি পরিতোষের কাছে যেতেই সে কাঁদতে শুরু করে দিলে। দেখলুম, তার কনুইয়ের কাছে ছোরার একটা খোঁচা লেগে দরদর করে রক্ত ঝরছে।
ওদিকে দিদিমণি ও বড়কর্তার চিৎকার চলতে লাগল। তার সঙ্গে আহিয়াও রীতিমতো যোগ দিলে। চারদিক থেকে ঝি-চাকর ও পাহারাদারদের দল ছুটে এসে জমা হতে লাগল দরজার সুমুখে।
সেই ঝগড়ার মধ্যেই আমি পরিতোষকে জিজ্ঞাসা করলুম, কি হয়েছিল রে?
পরিতোষ কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, কি আবার হবে? ঘরে এসে গালাগালি দিতে আরম্ভ করে দিলে। বললে, ছোটকার সঙ্গে তোর অত ভাব কিসের? ভালোমানুষ পেয়ে বেশ দু-পয়সা হাতাচ্ছিস তো ওর কাছ থেকে?
আমার দোষের মধ্যে আমি বলেছিলুম, হ্যাঁ, পয়সা হাতিয়ে এবার এখানে একটা বাড়ি কিনব ঠিক করেছি।
আর যায় কোথায়! ছোরা বের করে বললে, আজ তোর শেষদিন। তোরা না এসে পড়লে ঠিক ছুরি বসিয়ে দিত।
পরিতোষ ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, বাপ-মাকে দুঃখ দিয়ে চলে এসেছি, এসব তো হবেই। কান্নার বেগ একটু সামলে পরিতোষ বলতে লাগল, রাস্তায় ভিক্ষে করে খাব, কিন্তু এখানে আর নয়। তুই এখানে থাক্
পরিতোষের মুখে সেইসব মর্মান্তিক কথা শুনে আমার চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল। মনে হল, সত্যিই তো! তার তো জীবনে কোনো দুঃখই ছিল না। বাপ-মা ভাই-বোন নিয়ে আনন্দেই তার দিন কেটে যাচ্ছিল। এই অভাগ্যের জন্যই তো সে গৃহত্যাগ করে অনিশ্চিত অদৃষ্টসাগরে জীবনতরী ভাসিয়ে দিয়েছে।
আমি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললুম, ঠিক বলেছিস। কালই আমরা এখান থেকে চলে যাব–দেখি, অদৃষ্টে আর কত দুঃখ লেখা আছে।
ওদিকে তখন বড়েসাহেব ও দিদিমণি সেই অদ্ভুত ভাষা ছেড়ে আভিধানিক হিন্দিতে ঝগড়া শুরু করেছে। মাঝে মাঝে ‘সড়া অন্ধার মতন মাতৃভাষাতেও দু-চারটে বকুনি বেরিয়ে পড়ছে।
ঝগড়া করতে করতে হঠাৎ একবার ফিরে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে দিদিমণি আমার দিকে তাকালে। বুঝতে পারলুম, ওই হাঙ্গামার মধ্যেও আমাদের কথাবার্তায় অনেকখানিই তার শ্রুতিগোচর হয়েছে।
বড়কর্তা তখনও বকবক করে বকে চলেছিল। আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে দিদিমণি বড়েসাহেবকে হুকুম করলে, বেরিয়ে যাও এ-বাড়ি থেকে
কথাটা শুনে বড়কর্তা একমুহূর্তের জন্যে হকচকিয়ে গিয়ে বিশুদ্ধ বাংলাভাষায় বললে, এ কি তোর বাপের বাড়ি রে শালী যে, বেরিয়ে যেতে বলছিস?
একটা জিনিস আমি ছেলেবেলা থেকেই লক্ষ করে আসছি যে, বাঙালি পুরুষ প্রচণ্ড ক্রোধান্বিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলে। অবিশ্যি এজন্যে তাদের আমি দোষ দিই না। কারণ, সম্পর্কের তাল বজায় রেখে নারী-জাতিকে মোক্ষমরূপে আহত করবার মতন বাক্যবাণ আমাদের মাতৃভাষায় নেই। মা, মাসি, পিসি, বোন, স্ত্রী, কন্যা, ভাগ্নীদের সঙ্গে ঝগড়া করতে করতে এই অভাব বার বার অনুভব করে কতবার যে ধর্মযুদ্ধে পরাভূত হয়েছি তার আর ইয়ত্তা নেই।
বড়কর্তার কথা শুনে দিদিমণি একেবারে স্থির কাঠের পুতুলের মতন দাঁড়িয়ে রইল। আহিয়া চেঁচিয়ে বড়কর্তাকে কি সব বলতে লাগল, কিন্তু সে তাকে গ্রাহ্যের মধ্যেই আনলে না। হঠাৎ দৃপ্ত ভঙ্গিতে স্থির, শান্ত, অথচ দৃঢ়কণ্ঠে দিদিমণি বললে, আমার বাপের বাড়ি হলে এটা তোমার ও বাপের বাড়ি হত। কিন্তু এটা আমার নিজের বাড়ি-আমার পয়সায় আমার নামে এ-বাড়ি কেনা হয়েছে। এখুনি এখান থেকে বেরিয়ে যাও, নইলে পাহারাদারকে দিয়ে গলাধাক্কা দিয়ে তোমায় বের করে দেব। খবরদার, আর এখানে কখনও আসবে না। শয়তান! ছোটলোক!
দিদিমণির কথা শুনে বড়কর্তা একেবারে দমে গেল। হাতে খোলা বিছুয়া, ঘাড় নীচু করে ধীর পদক্ষেপে দরজার দিকে অগ্রসর হতে হতে হঠাৎ ফিরে বললে, যাদের জন্যে তুই আমাকে এতখানি অপমান করলি, তাদের একটাকে আজ শেষ করে দিয়ে যাব।
কি সর্বনাশ! জয় বাবা বিশ্বনাথ!
বড়কর্তা ছোরা তুলে আমাদের দিকে তেড়ে আসতেই দিদিমণি দু-হাত তুলে বিকট চিৎকার করে মাঝখানে এসে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে বড়কর্তার বিছুয়া তার বাঁ-হাতের তর্জনীটা প্রায় দুখানা করে দিলে।
ইত্যবসরে আমরা ছুটে ছাতে বেরিয়ে গিয়ে পাহারাদারদের হাত থেকে লম্বা লাঠিটা কেড়ে নিয়ে দাঁড়ালুম। উদ্দেশ্য, ঘর থেকে বেরুলেই এক-লাঠিতে বড়কর্তার মাথাটি দুফাঁক করে দেব। আহত হয়ে দিদিমণি চিৎকার করে ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, আহিয়ার মড়াকান্নায় পাড়া উঠল কেঁপে, আর সঙ্গে সঙ্গে আমার হাত থেকে লাঠিখানা খসে সশব্দে পড়ে গেল।
দরজার মুখে এতক্ষণ ঝি-চাকর দাঁড়িয়ে ছিল, তারা কলরব করতে-করতে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। চেঁচামেচি শুনে বিশুদা তার লাঠির ওপরে ভর দিয়ে ন্যাংচাতে ন্যাংচাতে এসে উপস্থিত হল। দেখলুম, বড়কর্তা ছোরাখানা খাপের মধ্যে পুরে সেটাকে কোমরের মধ্যে গুঁজে ভিড় ঠেলে নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে হনহন করে চলে গেল।
ঘরের মধ্যে ঢুকে দেখি, রক্তে ঘর ভেসে যাচ্ছে। বিশুদা দিদিমণির মাথার কাছে বিষণ্ণ মুখে বসে আছে; আহিয়া ছেঁড়া নেকড়া দিয়ে দিদিমণির আঙুলটা বাঁধবার চেষ্টা করছে, দেখলুম, আঙুলটা নড়নড় করছে।
সে-রাত্রে বাবুজী বাড়িতে ফিরে আহিয়া ও চাকর-বাকরদের মুখে সব শুনে, দিদিমণির ক্ষত সেলাই করে হাতের কবজি অবধি ব্যান্ডেজ বেঁধে হাতখানা গলায় ঝুলিয়ে দিয়ে তাকে শুয়ে পড়তে বললেন।
বাড়িতে এতবড় এক কাণ্ড ঘটে গেল; কিন্তু সে-সম্বন্ধে তিনি কোনো মন্তব্য করলেন না, শুধু পরিতোষকে আদর করে বললেন, তুমি আমায় ক্ষমা কর বাবা, এসব আমারই দোষ। সে-রাত্রে আমাদের ঘরেই ঢালা বিছানা করে দিদিমণি, বিশুদা, আহিয়া ও আমরা সব শুয়ে পড়লুম, শুধু বাবুজী নিজের ঘরে চলে গেলেন।
শেষরাত্রে একবার ওঠবার দরকার হয়েছিল। উঠে দেখলুম, ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে, দিদিমণি তখনও জেগে রয়েছে, অদ্ভুত একরকম উদাসসৃষ্টিতে সে আমার দিকে চাইতে লাগল।
ছাত থেকে ঘুরে এসে তার পাশে এসে বসে মাথায় হাত দিয়ে মনে হল, খুব জ্বর হয়েছে।
বললুম, ঘুমোওনি?
ঘুম আসছে না।
জ্বরে কি খুবই কষ্ট হচ্ছে?
ও কিছু না, কালই সেরে যাবে। ছোট্কার গায়ে রেজাইটা ভালো করে চাপা দিয়ে তুই শুয়ে পড়।
বিশুদার গায়ে লেপটা ভালো করে চাপা দিয়ে আবার দিদিমণির শিয়রে এসে বসলুম। দিদিমণি একটা হাত উঁচু করে আমার ঘাড় ধরে মুখটা তার মুখের কাছে টেনে নিয়ে এসে কানে কানে বললে, আমার ওপরে খুব রাগ হয়েছে তোদের, না?
কিছু না।–বলে তার কপালে ও চুলের মধ্যে আঙুল চালিয়ে তাকে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করতে লাগলুম, তার পরে ক্লান্ত হয়ে নিজেই কখন তার মাথার কাছে শুয়ে পড়লুম মনে নেই।
ভোর হতে-না-হতে ঘুম ভেঙে গেল।
বোধ হয় দিন-পনেরোর মধ্যেই দিদিমণি চাঙ্গা হয়ে উঠল। শুধু বাঁ-হাতের তর্জন। একটু বেঁকে রইল মাত্র। আবার পুরনো দিনের মতন সেই শেষরাত্রে উঠে স্নান ও সারাদিন ধরে সংসারের কাজকর্ম শুরু হয়ে গেল।
.
সেই ব্যাপারের পর থেকে বড়কর্তা বাড়িতে আসা একেবারে ছেড়ে দিলে। নিশ্চিন্ত আরামে ভবিষ্যৎ-ভাবনা-মুক্ত দিন কাটতে লাগল। ডাক্তারখানার সঙ্গে দিদিমণির সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। কারণ সে-ব্যাপারের পর ঠিক হয়ে গিয়েছিল যে, সেখানকার সমস্ত হিসাবপত্র বড়কর্তাই দেখবে, লাভ-লোকসান সে-ই ভোগ করবে; কিন্তু অর্থের প্রয়োজন হলে বাড়ি থেকে আর কিছুই দেওয়া হবে না। বাবুজি যে-সব মাসোহারা পান ও দৈনিক রুগি দেখে ভিজিটের দরুন যা পান ও তাঁর পেনশনের সব টাকা বাড়িতেই আসবে।
বাবুজী রোজ বাড়ি ফিরে সেদিনকার ভিজিটের টাকা-কটি দিদিমণির হাতে দিয়ে দেন, তারই একটা হিসাব প্রতিদিন আমাকে রাখতে হয়। প্রতিদিনের বাজার খরচ, গরুর খরচ, চাকর-বাকরদের খরচ সব পরিতোষের হাতে। রোজ সকালবেলা সে হিসেব দিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে যায়, সন্ধে হলে আমরা তিনজনে বসে সারাদিনের হিসেব চুকিয়ে বিশুদার ঘরে গিয়ে গল্প করে রাত্রি দশটার সময় খেয়ে-দেয়ে নিজেদের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ি। আগ্রার বাঙাল ব্যাঙ্কে দিদিমণির নগদ টাকা গচ্ছিত আছে, ছ’মাস অন্তর তার সুদ আনতে যেতে হয় সেখানে বাবুজীকে। ছ’-মাসের সুদ প্রায় চার হাজার টাকা। ঠিক হয়েছে, এবার থেকে আর বাবুজী যাবেন না, দিদিমণিকে নিয়ে আমি আর পরিতোষ যাব। দিদিমণির শ্বশুরবাড়ির দেশে তার একটা বড় গ্রাম আছে জমিদারি, যতদিন সে বেঁচে থাকবে ততদিন বাড়ির বড়বউ হিসাবে তার উপস্বত্ব সে ভোগ করবে। সেখানকার আমদানি বছরে প্রায় তিন হাজার টাকা। প্রতি বছর বৈশাখ মাসের শেষে বাবুজীকে সেখানে গিয়ে দশ-পনেরো দিন করে থাকতে হয়। ঠিক হয়েছে, এবার বৈশাখের শেষে দিদিমণিকে নিয়ে আমি, পরিতোষ ও বাবুজী সেখানে যাব। বছর দু-তিন পরে আর দিদিমণি কিংবা বাবুজী কারুকেই যেতে হবে না। আমি আর পরিতোষ যাব, আমরা ততদিনে সাবালক হয়ে যাব কিনা, আমাদের নামে দিদিমণি ওকালতনামা দিয়ে দেবে।
এই ফাঁকে ফাঁকে দুই বন্ধুর পরামর্শ চলতে থাকে, রাজকুমারীর প্রতিশ্রুতির প্রশ্রয়ে বেড়ে-ওঠা আমাদের সেই বিরাট বস্ত্র-ব্যবসায়, যা বিনা কারণে অতি অকস্মাৎ একদিন ফেল পড়েছিল, তারই কথা। ঠিক করে রাখা গেছে, দিদিমণির কাছ থেকে টাকা নিয়ে আবার সেই ব্যবসা জাঁকিয়ে তুলতে হবে, চিরদিন কোথাও অন্নদাস হয়ে থাকা চলতে পারে না। ব্যবসা কিছুদিন চলবার পর টাকা শুধে দিলেই চলবে।
মনে পড়ছে সেই দিনগুলির কথা। শীতান্তের উতলা বাতাসে দেখ-দেখ করে প্রকৃতি মাতাল হয়ে উঠল। দিনরাত্রি হু-হু হাওয়া আর বড় বড় গাছের উল্লাস ও চিৎকারে ধণী মুখরিত। বিকালবেলা মাঝে মাঝে আমরা রাস্তায় বেড়াতে বেরিয়ে পড়ি, গাছগুলো নতুন পাতায় একেবারে চিক্কণ সবুজ। মধ্যে মধ্যে এক এক ঝোঁক বাতাস ওঠে হা-হা করে, আর সেগুলো থেকে ঝরঝর করে শুকনো পাতা খসে পড়তে থাকে চারিদিকে, সজীব বড় বড় গাছগুলোর মধ্যে কোথায় এত শুকনো পাতা লুকিয়ে থাকে, এমনিতে তো বোঝা যায় না। কলকাতার জীব আমরা, প্রকৃতির এই অপরূপ রীত্ এর আগে দেখিনি-
আর মনে পড়ছে সেদিন সকালের কথা–দিন ছিল রবিবার। বাবুজীর কাশী যাবার তাড়া নেই। চা-জিলিপির পর্ব তখনও শেষ হয়নি, এমন সময় দিদিমণি কাগজ ও দোয়াত-কলম নিয়ে এসে হাজির হল আমাদের ঘরে। বললে, আজ তোরা দুজনে কাশীতে গিয়ে এই জিনিসগুলো কিনে আন, আমি খাবার তৈরি করতে বলেছি, খেয়ে বেরিয়ে যা, সন্ধে নাগাদ ফিরে আসবি।
জিনিসপত্রের লম্বা ফর্দ তৈরি হল। মনে আছে, তার মধ্যে আমাদের জন্যে তিন জোড়া করে ধুতি, চারটে করে শার্ট ও এক জোড়া করে জুতো। তা ছাড়া বাবুজীর পা-জামা ও ফতুয়ার জন্যে এক থান সবচেয়ে ভালো লাটা অর্থাৎ লংক্লথ, তা ছাড়া আরও কত কি জিনিস!
হিসেব করে দেখা গেল, সব জিনিসের দাম সত্তর টাকার কিছু বেশি হবে। দিদিমণি আঁচলের গেরো খুলে একখানা একশো টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললে, সাবধানে রাখ।
নিজের হোক বা পরের হোক, একশো টাকার নোট হাতে করবার সৌভাগ্য জীবনে এর আগে আমার হয়নি। আজকের দিনে এক প্যাকেট সিগারেট কিনলে বিড়িওয়ালার দোকানে যেমন একশো টাকার নোটের ভাঙানি পাওয়া যায়, সেদিন তেমন ছিল না। একশো টাকার নোট তখনকার দিনে নম্বরী নোটের মধ্যে গণ্য ছিল। বয়স্ক লোকেরা সে-নোট ভাঙাতে গেলেও উলটো পিঠে নাম-ঠিাকানা লিখে দিতে হত, ছেলেমানুষের হাতে দেখলে দোকানদারেরা হয় তাকে ফিরিয়ে দিত, নয়তো পুলিশ ডেকে ধরিয়ে দিত।
একশো টাকার নোট নিয়ে নাড়াচাড়া করবার সুবিধা না পেলেও এসব বিষয়ে আমরা ওয়াকিবহাল ছিলুম। নোটখানা হাতে নিয়েই বললুম, সর্বনাশ! এ-নোট দেখলে দোকানদার নিশ্চয় আমাদের পুলিশে দেবে।
দিদিমণি বললে, দূর, তাও কি কখনও হয়!
শেষকালে মীমাংসার জন্যে বাবুজীর কাছে যাওয়া হল। বাবুজী বললেন, ওরা ঠিকই বলেছে। ছেলেমানুষদের হাতে ও-নোট দেখলে হাঙ্গামা হতে পারে, ওদের খুচরো টাকা দিয়ে দাও।
দিদিমণির হাতে খুচরো অত টাকা নেই। শেষকালে বাবুজীই দশটা দশটাকার নোট দিয়ে আমাদের হাত থেকে সেই নোটখানা নিয়ে নিজের মানিব্যাগে পুরে রাখলেন।
যতদূর মনে পড়ছে, পাঁচটাকার নোটের আবির্ভাব তখনও হয়নি।
ট্যাড়সের এক চচ্চড়ি দিয়ে দিস্তে-খানেক করে আটার ফুলকো লুচি মেরে বাকি জায়গা দুধে ভর্তি করে আমরা বেরিয়ে পড়লুম কাশীর উদ্দেশে।
.
আবার সেই রাজঘাট স্টেশন।
প্রথম যেদিন সন্ধ্যারাত্রে শীতে কাঁপতে কাঁপতে এইখানে ট্রেন থেকে নেমে পড়েছিলুম, সেদিন থেকে আজকের দিনে কত প্রভেদ! সেদিন আমাদের জীবনের ভবিষ্যৎ-আকাশ ছিল দিগন্তবিস্তৃত মেঘে সমাচ্ছন্ন। বিশ্বনাথের দয়ায় আজ সে-মেঘ অপসারিত হয়েছে। ভাগ্যলক্ষ্মীর প্রসন্ন হাসি কল্পনার পরকলা দিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে ভবিষ্যৎৎ হয়ে উঠেছে উজ্জ্বল। আশ্বাসে বুক ভরা, ট্যাকও পয়সায় ভর্তি।
স্টেশন থেকে বেরিয়ে একখানা এক্কা ভাড়া করা গেল চৌক অবধি, সেখান থেকে জুতো কিনে দশাশ্বমেধ ঘাটে যাব, সেখানে বাঙালিদের বড় কাপড়ের দোকান আছে।
চৌকে নেমে দু-তিনটে জুতোর দোকান ঘুরলুম, কিন্তু জুতো আর পছন্দ হয় না। শেষকালে রাস্তার ধারেই একটা বাড়ির দেওয়ালে আলমারি-ঝোলানো এক দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আলমারিতে সাজানো জুতোগুলো দেখছি আর দোকানদারের সঙ্গে দর-দাম নিয়ে কথাবার্তা চলছে, এমন সময় একটা তীব্র চিৎকার কানে এল, এই যে শালার ছেলে!
চমকে উঠে ফিরে দেখি, আমাদের বড়কর্তা অর্থাৎ বড়েভাই কিনা শ্রীযুক্ত অমরনাথ বন্দ্যোউপাধ্যায় মহাশয় অক্টোপাসের মতন পরিতোষের একখানা হাত আঁকড়ে ধরেছে। ভয়ে বেচারার মুখখানা একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
বড়কর্তা পরিতোষের গালে বিরাশী-সিক্কা ওজনের একটি চড় কষিয়ে হুঙ্কার ছাড়লে, এবার তোর কোন বাবায় বাঁচাবে রে শালা?
পরিতোষ বেচারা চিৎকার করে কেঁদে উঠল। দেখলুম, তার গালে ও ঘাড়ের খানিকটা জায়গায় লম্বা-লম্বা আঙুলের দাগ লাল হয়ে ফুটে উঠল।
আমি বললুম, কেন ওকে মারছেন? কি করেছে ও আপনার?
লোকটা ‘চোপ’ বলে আচমকা আমার কোমরে একটা লাথি লাগাতেই আমি একেবারে রাস্তায় লুটিয়ে পড়লুম। ব্যাপার বিশেষ সুবিধার নয় বুঝে উঠে পালাবার জোগাড় করছি, এমন সময় বড়কর্তা চিৎকার করে উঠল, পাড়ো শালেকো।
এতক্ষণে দেখতে পেলুম, বড়কর্তাকে ঘিরে চার-পাঁচজন দুশমন-চেহারার লোক দাঁড়িয়ে আছে। তাদের মধ্যে একটা লোক দৌড়ে এসে আমাকে ধরে আমারই কোঁচাটা দিয়ে বাঁ-হাতের বাহুতে এমন জোরে একটি বন্ধন লাগালে যে, হাতখানা ঝিমঝিম করতে করতে একেবারে অবশ হয়ে গেল।
ওদিকে বড়কর্তা পরিতোষের মুখে চড় ঘুষি ও তার চেয়ে নিদারুণ খিস্তি চালিয়ে যেতে লাগল। দেখতে দেখতে আমাদের ঘিরে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠল।
জুতোওয়ালা সামান্য একটু আপত্তি জানাতেই বড়কর্তা চিৎকার করে বলতে লাগল, এই হারামজাদা খেতে পেত না, রাস্তায় রাস্তায় ভিক্ষে করে বেড়াত, আমার ছোটভাই দয়াপরবশ হয়ে এদের বাড়িতে নিয়ে এসে মানুষ করছিল; কিন্তু শেষকালে নিমকহারামেরা তার বাক্স ভেঙে টাকা চুরি করে পালিয়েছিল, আজ ধরেছি। চল্ শালা কোতোয়াল
ব্যস্, আর যায় কোথায়! বড়কর্তার মুখ দিয়ে এই বাক্যটি বেরুনো মাত্র সেই ভিড় ভেঙে পড়ল চারিদিক থেকে আমাদের ওপরে। তারপর ঘুষি কিল চড় লাথি, যার যাতে হাত বা পা আসে তাই লাগাতে আরম্ভ করলে। চোখের সামনে দেখলুম, পরিতোষ এলিয়ে পড়ল পথের ওপরে। কিন্তু তখন আমার আর অন্য কারও দিকে দেখবার অবসর নেই,–বাঁ-হাতখানা অন্য লোকের কবলে, ডান হাত দিয়ে যতটা সম্ভব নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে লাগলুম। কিন্তু কত আটকাব। তিন-চার মিনিটের মধ্যেই চোখের সম্মুখে ফুটে উঠল বিস্তীর্ণ সরষের ক্ষেতু
সংসারে কোনো জিনিসই বৃথা যায় না। শৈশব থেকে পিতৃহস্তে যে তালিম পেয়েছিলুম, এতদিন পরে তা সত্যিকারের কাজে লাগল, এত প্রহার সত্ত্বেও কিন্তু আমি জ্ঞান হারাইনি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয় টলতে লাগলুম
ও-দিকে বোধ হয় ভিড় বাড়ছে দেখে বড়কর্তার দল আমাদের টানতে টানতে নিয়ে চলল কোতোয়ালির দিকে।
পরিতোষের দিকে ফিরে দেখলুম, তার মুখখানা ফুলে এক অদ্ভুত রকমের দেখতে হয়েছে। আমার মুখও যে ফুলে উঠেছে, তা চোখে না দেখলেও বেশ বুঝতে পারছিলুম।
অঙ্গের বেদনায় এক-পা চলতে পারি না এমন অবস্থা। আমাদের দুজনকে একরকম হেঁচড়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পরিতোষকে ধরেছে বড়কর্তা, আর আমাকে যে ধরেছে তার চেহারা ভিক্তোর হুগোর কল্পনারও অতীত।
সামনেই কোতোয়ালির লাল প্রাসাদোপম অট্টালিকা। মনে করেছিলুম, আমাদের বোধ হয় সেইখানেই নিয়ে যাওয়া হবে কিন্তু সেখানে না গিয়ে তারা ঠিক কোতোয়ালির পাশেই একটা সরু রাস্তা দিয়ে আমাদের টেনে নিয়ে চলল, পশ্চাতে বিপুল জনসংঘ।
সরু একখানা গলিতে ছোট একখানা বাড়ির সামনে এসে আমরা দাঁড়ালুম, পেছনে তখনও অনেক লোক। বড়কর্তা তাদের একটা ধমক দিয়ে কি সব বলতেই ভিড় কিছু পাতলা হল বটে, কিন্তু তখনও কেউ কেউ দাঁড়িয়ে রইল মজা দেখতে। বাড়ির দরজা বন্ধ ছিল। বড়কর্তা জোরে কড়া নাড়তেই দরজা খুলে গেল।
বাড়িটা এত নীচু যে রাস্তা থেকে লাফিয়ে দোতলার রাস্তার ধারের জানলার খড়খড়ি ধরে ফেলা যায়। দরজা খুলে যাওয়ামাত্র লোকগুলো আমাদের টেনে একরকম হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে তুলতে লাগল। সিঁড়ির মাথাতেই একটা সরু বারান্দা, তার গায়ে ঘর। আমরা ওপরে পৌঁছবার আগেই ঘর থেকে একটি মেয়ে বেরিয়ে এসে ব্যাপার দেখে ‘থ’ হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে জিজ্ঞাসা করলে, কি ব্যাপার?
এ দলের লোকেরা কিন্তু তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমাদের টানতে-টানতে মেয়েটি যে-ঘর থেকে বেরিয়েছিল, সেই ঘরে নিয়ে গেল।
যাই হোক, এতক্ষণে নারীমূর্তি দেখে মনে আশা জাগতে লাগল, হয়তো এবার এই নিরর্থক নির্যাতনের কবল থেকে মুক্তি পাব।
ঘরখানা অত্যন্ত ছোট ও নীচু, লাফিয়ে ছাতে হাত লাগানো যায়। ঘরজোড়া একটা ময়লা শতচ্ছিন্ন শতরঞ্চি পাতা। এক কোণে প্রায় চৌকো একটা গদির ওপরে বিচিত্র দাগ-ধরা চাদর পাতা। ওরা আমাদের দুজনকে সেই গদির ওপরে একরকম ছুঁড়েই ফেলে দিলে। তার পরে বড়কর্তা গদির ওপর উঠে এক কোণে বসে হাঁক দিলে, দুলারী, জল খাওয়া এক গেলাস।
দুলারী তাড়াতাড়ি একটা মুরাদাবাদী গেলাসে জল ভরে এনে দিল। বড়কর্তা স্রেফ এক ঢোকে সেটা শেষ করে হাঁপাতে হাঁপাতে গেলাসটা তার হাতে ফিরিয়ে দিলে। এতক্ষণে বড়কর্তার অনুচরের দল কেউ-বা শতরঞ্চির ওপর, কেউ-বা গদিতে উঠে বসল।
দুলারী গেলাসটা যথাস্থানে রেখে জিজ্ঞাসা করলে, ব্যাপার কি?
বড়কর্তা একবার রোষকষায়িত লোচনে আমাদের দিকে চেয়ে বললে, আজ শালাদের ধরেছি।
কথাটা বলেই পরিতোষের হাতের বাঁধনটা ধরে এক টানে তার কাছে টেনে নিয়ে এসে মারলে এক চড়।
দুলারীর দিকে ফিরে একবার তাকে ভালো করে দেখে নিলুম, বেশ হৃষ্টপুষ্ট, সুন্দরী স্ত্রীলোক। আশা করেছিলুম, এই অমানুষিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে সে হয়তো কিছু বলবে; কিন্তু তার চোখে বিপুল কৌতূহল ছাড়া সহানুভূতির চিহ্নমাত্রও দেখতে পেলুম না।
বড়কর্তা দুলারীকে সম্বোধন করে বলতে লাগল, সেই যে কলকাতার ছোঁড়াদুটোর কথা তোকে বলেছিলুম, আমাদের বাড়ি থেকে বাক্স ভেঙে পালিয়েছিল, আজ রাস্তায় ধরেছি।
এই কথা বলেই সে পরিতোষকে মারতে আরম্ভ করে দিলে, পরিতোষ নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল।
এবার আমি মরিয়া হয়ে উঠলুম। ইতিমধ্যে হাতের বাঁধন খুলে কোঁচা দিয়েছিলুম। দাঁড়িয়ে উঠে, যতটুকু হিন্দি-জ্ঞান তখন হয়েছিল, সেই ভাষাতেই দুলারীর দিকে চেয়ে বললুম, এসব আগাগোড়া মিথ্যে কথা। প্রমাণ চাও তো তোমরা সবাই চল ওদের বাড়িতে। তারা যদি বলে, আমরা টাকা ভেঙে পালিয়েছি তো যত টাকা তারা বলবে, তার ডবল টাকা গুণে ওদের নাকের ওপর ফেলে দেবে। আমরাও ভিখিরির ‘ছেলে নই।
তার পরে বড়কর্তাকে সোজাসুজি বলে দিলুম, তোমার মতন দশ-পনেরোটা বদমাইশ আমার বাড়িতে দারোয়ানের কাজ করে। আর চুরি যদি করেই থাকি, তা হলে আমাদের পুলিশে দিয়ে দাও, বুঝিয়ে দেব কত ধানে কত চাল হয়!
আসর এবারে নিস্তব্ধ। সবার মুখের দিকে দেখলুম, এক বড়কর্তা ছাড়া আর সকলেই বিস্মিত। আমি উৎসাহিত হয়ে আবার শুরু করলুম, আমাদের মেরেছ ভালোই করেছ, যদি নিজে বাঁচতে চাও তো একেবারে মেরে ফেল, নইলে তোমার বরাতে দুঃখ আছে বলে দিচ্ছি।
আমার কথা শেষ হতে-না-হতে বড়কর্তা ক্ষিপ্ত হয়ে একরকম লাফিয়ে এসে, ‘তবে রে’ বলেই আমার মুখে মারলে এক ঘুষো।
দুলারী হাঁ-হাঁ চিৎকার করে আমাদের দুজনের মাঝে পড়েও বাঁচাতে পারলে না, নাক দিয়ে আমার ঝরঝর করে রক্ত পড়তে লাগল।
রক্ত দেখে দুলারী মহা চেঁচামেচি শুরু করে দিলে। সে বলতে লাগল, আমার বাড়িতে এসে এসব খুনোখুনি চলবে না, সেসব করতে হয় তো ওদের নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাও। আমি আগে থাকতে বলে দিচ্ছি, আমাকে নিয়ে যদি শেষে টানাটানি হয় তো কারুর ভালো হবে না।
ঠারে-ঠোরে বুঝতে পারলুম, এর আগে এখানে খুন-খারাবিও হয়ে গিয়েছে এবং এদের বাঁচাতে গিয়ে দুলারীকে যথেষ্ট হাঙ্গামাও পোয়াতে হয়েছে।
দুলারীর ওই চেঁচামেচি শুনেও কিন্তু আমার মনে কোনো ভয়েরই উদ্রেক হল না, বরঞ্চ সমস্ত বিশ্ব-সংসারের প্রতি একটা দারুণ অভিমান মনে হতে লাগল, এরা যদি এখানে আমাদের সত্যিই মেরে ফেলে, তাহলে ভালোই হয়। নিত্য বিনাদোষে এই অপমান আর সহ্য হয় না। ইতিমধ্যে দুলারী চেঁচাতে চেঁচাতে এক গেলাস জল গড়িয়ে অঞ্জলি ভরে আমার নাকে ছিটিয়ে দিতে আরম্ভ করলে, জামা-কাপড় রক্ত ও জলে ভিজে যেতে লাগল।
মনে হল দুলারীর চিৎকারে বড়কর্তা একটু যেন দমে গেল। সে তার কথার কোনো জবাব না দিয়ে ট্যাক থেকে একটা সিকি বার করে সামনের দিকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে, এক প্যাকেট রেলওয়াই সিগারেট নিয়ে আয় তো।
একটা লোক সিকিটা তুলে নিয়ে বেরিয়ে গেল।
আমার নাকের রক্ত-পড়া কমে গেল বটে, কিন্তু ভেতরটা খুব জ্বালা করতে লাগল। আমি কোঁচা দিয়ে নাকটা চেপে ধরে বসে রইলুম। একটু দূরেই পরিতোষ বসে নিঃশব্দে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল, দেখতে দেখতে তার মুখখানা অসম্ভব রকমের ফুলে উঠতে আরম্ভ করল।
একটু বাদে দুলারী আমাকে প্রশ্ন করলে, তোমরা কবে কাশীতে এসেছ?
আজ সকালে। এই ঘণ্টাদেড়েক আগে।
এই যে বাবু বললে, তোমরা ওদের বাড়ি থেকে টাকা ভেঙে অনেকদিন হল পালিয়েছ?
ওসব মিথ্যে কথা। ও আজ পনেরো দিন আগে ওর বোনকে ছুরি মেরে বাড়ি থেকে চলে এসেছে, ওকে আর বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হয় না, তাই আমাদের ওপরে এত রাগ।
আমার কথা শেষ হতে-না-হতে বড়কর্তা সিংহের মতন গর্জন করে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, কেয়া বোলা! আজ তুঝে মার হি ডালুঙ্গা-
বলেই কোমর থেকে সাঁই করে সেই সনাতন বিছুয়া বার করে ফেললে।
পরিতোষ সেই দৃশ্য দেখে চিৎকার করে কেঁদে উঠল, নিমেষের মধ্যে আমাদের দুজনের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে দুলারী বললে, খবরদার, ওসব করতে চাও তো এদের নিয়ে অন্যত্র চলে যাও, নইলে এখুনি আমি কোতোয়ালিতে খবর পাঠাব।
বড়কর্তা হঠাৎ যেমন দাঁড়িয়ে উঠেছিল, দুলালীর সেই মূর্তি দেখে ও কথা শুনে তেমনই ধড়াস করে বসে পড়ল।
ইতিমধ্যে তার অনুচর এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসায় একটি ধরিয়ে সে নির্বিকারভাবে সাঁ-সাঁ করে টানতে শুরু করে দিলে।
দুলারী আবার আমায় জিজ্ঞাসা করলে, হ্যাঁ ভাই, তো কাশী কি করতে এসেছিলে আজ? আমি বললুম, দিদিমণি ও বাবুজী অর্থাৎ ওঁর বোন আর ওঁর বাবা আমাদের কাশী পাঠিয়েছেন বাড়ির কতকগুলো জিনিস কেনবার জন্যে।
এবার দুলারী বড়কর্তার দিকে ফিরে বললে, শুনা তুমনে?
বড়কর্তা সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বললে, শুনিস কেন ওদের কথা!
তারপর বললে, কোথায় কি জিনিস দিয়েছে দেখি?
ফদখানা আমার কাছে ছিল, পকেট থেকে বের করে দুলারীর হাতে দিতেই ফস করে কাগজখানা সে তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললে, এ বাংগালীতে লিখেছে, তুই বুঝতে পারবি নে।
অনেকক্ষণ ধরে বানান করে ফদখানা পড়ে সে বললে, টাকা কোথায়?
টাকা পরিতোষের কাছে ছিল। সে পকেট থেকে নোটের তাড়াটা বের করে তার হাতে দিতেই সে গুনে দেখে তার অনুচরদের নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা দুলারীর ঘরে বসে রইলুম।
কিছুক্ষণ পরে ছাতের সিঁড়ি দিয়ে এক অতি বৃদ্ধা নেমে এসে দুলারীকে কি-সব বললে, বোধ হয় রান্না-বান্না খাওয়া-দাওয়া সম্বন্ধে। তার সঙ্গে কি সব আলোচনা করে দুলারী ওপরে উঠে গেল, আমরা দুজনে সেই গদির দু’কোণে গাড়ু হয়ে বসে রইলুম।
অদৃষ্টের এই নতুন প্যাঁচে উভয়েই কাত, কারুর মুখে কোনো কথাও নেই। হঠাৎ পরিতোষ তার আঙুল থেকে দিদিমণির দেওয়া সেই আংটিটা খুলে আমায় দিয়ে বললে, এটা লুকিয়ে রাখ্।
আমি তাড়াতাড়ি কোচার খুঁটে আংটিটা বেঁধে ফেললুম।
দুজনে দু-কোণে বসে আছি। পরিতোষ চোখ বুজে–আমার নাক চাপা থাকলেও চোখদুটো তার দিকে স্থিরনিবদ্ধ। হঠাৎ মনে হল, যেন সে থরথর করে কাঁপছে, দেখতে-না-দেখতে কাঁপতে কাঁপতে সে গদির ওপরে এলিয়ে পড়ল। আমি উঠে গিয়ে তার মাথায় হাত দিতেই সে বললে, বড্ড শীত করছে রে।
পরিতোষ আচ্ছন্নের মতন পড়ে রইল। আর আমি তার মাথার কাছে নাকে কাপড় চেপে বসে রইলুম।
দুলারী সেই যে ওপরে গিয়েছিল, আর সে নামল না। মধ্যে মধ্যে তাদের কথাবার্তা, রান্নার আওয়াজ ও গন্ধ নাকে ও কানে এসে পৌঁছতে লাগল।
বোধ হয় ঘণ্টা-দেড়েক এইভাবে কেটে, যাওয়ার পর, বড়কর্তা তার দলবল নিয়ে ফিরে এল, প্রত্যেকে একেবারে মদে চুরচুর হয়ে। আমি মনে করেছিলুম, আমাদের অঙ্গসেবা করে বোধ হয় মনে অনুতাপ হওয়ায় আমাদের হয়ে সে জিনিসপত্র কিনতে গিয়েছিল। হায় রে আশা!
বড়কর্তা ঘরে ঢুকতেই আমাদের বললে, এই ওঠ।
পরিতোষ তখনও চোখ বুজে পড়ে, তাকে ঠেলে-ঠুলে দাঁড় করালুম। সে একরকম আমার ওপরেই ভর করে দাঁড়িয়ে ধরা-গলায় জিজ্ঞাসা করলে, কি রে?
বড়কর্তা ধমকের সুরে আবার বললে, চল্।
আমরা তাদের সঙ্গে নীচের রাস্তার বেরিয়ে গেলুম। বড়কর্তার অনুচরদের মধ্যে যে লোকটা সব-চাইতে ষণ্ডা ও দুশমনের মতন চেহারা, দেখলুম, সেই সবচেয়ে বেশি মাতাল হয়েছে। নেশা হলে লোকের যেমন মাথার প্রতিক্রিয়ায় পা টলে, এর কিন্তু সেরকম হচ্ছিল না। এর কোমর থেকে মাথা অবধি লোহার ডাণ্ডার মতন স্থির। পা-দুটো একটু ল্যাক-প্যাক করছিল বটে, কিন্তু চলতে চলতে হঠাৎ পা-দুটো মুড়ে একেবারে বসে পড়বার মতন হয়ে সেই অবস্থাতেই একটা-দুটো পাক খেয়ে, কাতরানো লাট্টু যেমন সোজা হয়ে ওঠে, তেমনই সামলে উঠতে লাগল।
আমি এক হাতে কোঁচার কাপড় জড়ো করে নাকে চেপে ধরেছি, আর এক হাত দিয়ে পরিতোষকে ধরেছি জড়িয়ে। সে একরকম আমার ওপরেই ভর দিয়ে চলেছে। নিজের অঙ্গও প্রায় অবশ, তবুও সেই লোকটার ওইরকম সার্কাসের ক্লাউনের ধাঁচে চলবার ছিরি দেখে হাসি পেতে লাগল।
যা হোক, কোনোরকমে তো বড়রাস্তায় এসে পৌঁছনো গেল। সেখানে একটা ঠিকে-গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল, ওরা আগেই সেখানা ভাড়া করে এনেছিল। আমাদের দুজনকে ঠেলে ঠেলে গাড়ির মধ্যে পুরে দিলে। তারপর বড়কর্তা উঠে সেই মাতাল লোকটাকে গাড়ির ভেতরে আসতে বললে।
লোকটা বললে, বে ফিক্ থাক্, আমি কোচ-বাক্সে চড়ব।
বলেই সে সেইরকম হাঁটু মুড়ে মুড়ে বাকি তিনজনকে গাড়ির মধ্যে পুরে দিলে। তারপর নিজে কোচ-বাক্সে চড়বার কসরৎ করতে আরম্ভ করলে। দু-তিন বার ওঠবার চেষ্টা করে একবার হাঁটু মুড়ে ওপর থেকে দড়াম করে নীচে পড়ে গেল।
গাড়ির ভিতর থেকে বড়কর্তা ও আর-একটা লোক বিশ্রী গালাগালি দিতে দিতে বেরিয়ে পড়ে লোকটাকে রাস্তা থেকে টেনে তুললে।
ভূমিশয্যা থেকে উঠেই আবার সে কসরৎ করে কোচ-বাক্সে ওঠবার চেষ্টা করতে লাগল, ওদের মানা শুনলে না।
যা হোক, ওরা ও রাস্তায় আরও দু-চারজন লোকের সাহায্যে লোকটাকে কোচ-বাক্সে তুলে দেওয়া হল। বড়কর্তা গাড়ির মধ্যে ফিরে এসে গাড়োয়ানকে হুকুম দিলে, রাজঘাট চল।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই গাড়ি রাজঘাট স্টেশনে এসে উপস্থিত হল। বড়কর্তা গাড়ি থেকে নেমে আমাকে বললে, উৎরো।
গাড়ি থেকে নেমে দেখা গেল, কোচ-বাক্সের সেই লোকটা গাড়ির ছাতে হাত-পা ছড়িয়ে একেবারে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। তাকে না তুলে, গাড়োয়ানকে অপেক্ষা করতে বলে তারা আমাদের স্টেশনে নিয়ে গিয়ে প্ল্যাটফর্মের একটা বেঞ্চিতে বসল।
কিছুক্ষণ, বোধ হয় মিনিট পনেরো বাদে মোগলসরাই-যাত্রী একটা ট্রেন আসতেই তারা আমাদের নিয়ে একটা তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় গ্যাঁট হয়ে বসল।
গাড়ি ছাড়ে-ছাড়ে এমন সময় বড়কর্তা উঠে বাইরে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে ডেকে পকেট থেকে দুখানা টিকিট বের করে বললে, এই নাও, দুখানা হাওড়ার টিকিট, ফের যদি কখনও এখানে তোমাদের দেখতে পাই তো জান্সে মেরে দেব; মনে থাকে যেন।
আমি হাত বাড়িয়ে টিকিট-দু-খানা নেবার কয়েক মিনিট পরেই গাড়ি ছেড়ে দিলে, বড়কর্তার অনুচরদের মধ্যে তিনটে লোক আমাদের সঙ্গে গাড়িতে বসে রইল।
দেখতে দেখতে গাড়ি মোগলসরাই স্টেশনে পৌঁছে গেল। আমাদের সঙ্গের লোকেরা স্টেশনে নেমেই বললে, ওই গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে, চলে এস তাড়াতাড়ি।
আমরা ‘ওভারব্রিজ’ পেরিয়ে অন্য একটা প্ল্যাটফর্মে এসে পৌঁছলুম। একটা ট্রেন দাঁড়িয়ে ছিল, তার কামরাগুলো একেবারে খালি বললেই হয়। লোকগুলো আমাদের নিয়ে একটা একেবারে খালি কামরায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে।
এতক্ষণে পরিতোষের সেই তন্দ্রা-ঘোর কেটে গিয়ে আমাকে জিজ্ঞাসা করলে, কি ব্যাপার রে?
আমার মুখে সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপার শুনে আর কোনো কথা না বলে সে বেঞ্চির ওপর গা ঢেলে দিলে।
প্রায় ঘণ্টাখানেক অতি অস্বস্তিকর অপেক্ষার পর আমাদের ট্রেন নড়ে উঠল। দেখলুম বড়কর্তার তিনজন অনুচরের মধ্যে একজন নেমে গিয়ে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াল, আর দুজন গাড়িতেই বসে রইল।
গাড়ি ছেড়ে দিলে। বিদায় বারাণসী।
.